পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ । পর্ব ৬ । পর্ব ৭। পর্ব ৮। পর্ব ৯। শেষ পর্ব ।
কাদিয়ানী মতবাদের বিরুদ্ধে মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী (রহঃ)-এর ঐতিহাসিক সংগ্রাম :
ভন্ড নবী মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী ১৮৯১ সালের ২২শে জানুয়ারী যখন নিজেকে ‘প্রতিশ্রুত মাসীহ’ (مسيح موعود) দাবী করেন, তখন মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী ছাত্র ছিলেন। এই দাবীর দেড় বছর পর অমৃতসরী ফারেগ হন এবং উলূম ও ফুনূনে ঋদ্ধ হয়ে ১৮৯২ সালে নিজ জন্মভূমি অমৃতসরে ফিরে আসেন। সে সময় বড় বড় আলেম-ওলামা যেমন মাওলানা মুহাম্মাদ হুসাইন বাটালভী (মৃঃ ১৯২০ খৃঃ), শায়খুল কুল ফিল কুল সাইয়িদ নাযীর হুসাইন মুহাদ্দিছ দেহলভী (১২৪৬-১৩২০ হিঃ), মাওলানা আব্দুল হক গযনভী, মাওলানা মুহাম্মাদ বাশীর সাহসোয়ানী (১৮৩৪-১৯০৮ খৃঃ), মাওলানা কাযী মুহাম্মাদ সুলাইমান মানছূরপুরী, মাওলানা আব্দুল জববার গযনভী, মাওলানা আহমাদুল্লাহ অমৃতসরী, মাওলানা গোলাম আলী কাছূরী, মাওলানা হাফেয আব্দুল মান্নান ওয়াযীরাবাদী (১৮৫১-১৯১৫ খৃঃ), মাওলানা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী, মাওলানা মুহাম্মাদ আলী মুঙ্গেরী, মহাকবি ড. মুহাম্মাদ ইকবাল, মাওলানা আতাউল্লাহ শাহ বুখারী, ‘যমীনদার’ পত্রিকার সম্পাদক যাফর আলী খান (১৮৭৩-১৯৫৬ খৃঃ) প্রমুখ কাদিয়ানীদের মুখোশ উন্মোচনে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এর ফলে জনসম্মুখে গোলাম আহমাদের স্বরূপ স্পষ্ট হয়ে যায়। এ সময় মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী তার বিরুদ্ধে ময়দানে নেমে পড়েন এবং অল্প সময়ের মধ্যেই অন্য ওলামায়ে কেরামকে ছাড়িয়ে যান।[1]
মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী (রহঃ) বলেন, ‘মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী যখন থেকে প্রতিশ্রুত মাসীহ হওয়ার দাবী করেছেন, তখন থেকেই অধম (মাওলানা অমৃতসরী) তার দাবীগুলি সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে থাকেন এবং তার ও তার অনুসারীদের লেখনী সমূহ যা হাতের নাগালে পাই সাধারণভাবে তা অধ্যয়ন করি। ইস্তেখারার মাধ্যমে কাজ করি। অনেক বাহাছ-মুনাযারা করি’।
এখানে আরেকটি ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সেটি হ’ল, একদিন রাতের বেলা নিরিবিলি পরিবেশে অমৃতসরে হাকীম নূরুদ্দীনের সাথে ছানাউল্লাহ অমৃতসরীর কয়েক ঘণ্টা আলাপ হয়। শেষে হাকীম ছাহেব বলেন, ‘আমাদের অভিজ্ঞতা হ’ল বাহাছ-মুনাযারায় কোন ফায়েদা হয় না। আপনি মির্যা ছাহেবের ‘নিশানে আসমানী’ (আসমানী নিদর্শন) পুস্তিকার বিষয়ে ইস্তেখারা করুন। আল্লাহ যেটা মঞ্জুর করবেন সেটা আপনার নিকট স্পষ্ট হয়ে যাবে’। মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী (রহঃ) বলেন, ‘আমি ১৫ দিন মির্যার ‘নিশানে আসমানী’ পুস্তিকার ব্যাপারে ইস্তেখারা করি। আমার প্রভু জানেন, আমি আমার পক্ষ থেকে স্বচ্ছতার ব্যাপারে কোন ত্রুটি রাখিনি। দুঃখ-বেদনাকে সম্পূর্ণরূপে দূরে রেখে অত্যন্ত বিনয়-নম্রতার সাথে আল্লাহর দরবারে দো‘আ করেছি। বরং যতদিন পর্যন্ত ইস্তেখারা করেছি ততদিন মির্যার সম্পর্কে আমার মনে নেই যে, আমি কারো সাথে বাহাছ বা মুনাযারা করেছি। শেষে চৌদ্দতম রাতে আমি মির্যাকে স্বপ্নে দেখি, তিনি একটি সংকীর্ণ গৃহে সাদা বিছানায় বসে আছেন। আমি তার নিকটে বসি এবং জিজ্ঞাসা করি, আপনার মাসীহত্বের দলীল সমূহ কি? তিনি বলেন, তুমি দু’টি মাসআলা ছেড়ে দিচ্ছ। প্রথম: হযরত মাসীহ-এর মৃত্যুর মাসআলা। দ্বিতীয়: তাঁর পুনরায় দুনিয়াতে প্রত্যাবর্তন না করার মাসআলা। যার মীমাংসা হওয়া উচিত। আমি তাকে বলি, আপনি এ দু’টি বিষয়কে মীমাংসিতই মনে করুন। অতঃপর আমি তার সাথে হাদীছ সমূহে বর্ণিত মাসীহ ও মাসীহ-এর সদৃশ বিষয়ে আলোচনা করি। মির্যা ছাহেব এর জওয়াব দিতে না দিতেই আরো দু’জন ব্যক্তি চলে আসেন। আমরা তাদের আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়ি এবং একে অপরের মুখোমুখি হওয়া থেকে একটু দূরে সরে পড়লে মির্যাকে দেখি যে, লাক্ষ্ণৌর পতিতাদের মতো তার চেহারা চুপ্সা এবং দাড়িগুলো ক্লীন শেভ করা। আমি অত্যন্ত পেরেশান হয়ে যাই। এরই মধ্যে ঘুম থেকে জেগে উঠি। আমার মাথায় এর তাবীর বা ব্যাখ্যা এরূপ আসে যে, মির্যার পরিণতি ভাল হবে না।[2]
উক্ত উদ্ধৃতি থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী এই ইস্তেখারার পূর্বেও যেমন গোলাম আহমাদের মাসীহত্বের দাবীর বিষয়ে বাহাছ-মুনাযারা করেছিলেন, তেমনি পরেও। মাওলানা ছফিউর রহমান মুবারকপুরী (রহঃ)-এর গবেষণা মতে, বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের আলোকে অনুমিত হয় যে, ১৮৯২ ও ১৮৯৪ এর মাঝামাঝি কোন এক সময়ে এই ইস্তেখারা করা হয়েছিল। এজন্য বুঝা যায় যে, মাওলানা অমৃতসরী লেখাপড়া শেষ করে অমৃতসরে ফিরে আসা মাত্রই মির্যা গোলাম আহমাদের ভ্রান্ত মতবাদ খন্ডনে রণাঙ্গনে নেমে পড়েছিলেন। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হ’ল, তিনি তার সেই প্রাথমিক যুগে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন আমাদের জানা মতে এখন সেগুলি জানার কোন মাধ্যম মওজুদ নেই। তবে মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী মাওলানা অমৃতসরীকে সম্বোধন করে যা বলেছিলেন তাত্থেকে এর গুরুত্ব অনুমান করা যেতে পারে’।[3]
১৮৯৬ সালে মির্যা গোলাম আহমাদ ‘আঞ্জামে আথাম’ লিখে তাকে মিথ্যা প্রতিপন্নকারীদেরকে অশালীন ভাষায় গালি-গালাজ করেন। গোলাম আহমাদ-এর ভাষায়, ‘হে নিকৃষ্ট মৌলভী সম্প্রদায়! তোমরা কতদিন পর্যন্ত সত্যকে গোপন করবে? কখন সেই সময় আসবে যখন তোমরা ইহুদীদের স্বভাব পরিত্যাগ করবে? এই যালেম মৌলভীরা! তোমাদের জন্য আফসোস হ’ল, তোমরা খিয়ানতের পেয়ালা পান করেছ এবং চতুষ্পদ জন্তুতুল্য সাধারণ জনগণকেও তা পান করিয়েছ’? (আঞ্জামে আথাম, পৃঃ ২১; রূহানী খাযায়েন ১১/২১)। এ প্রসঙ্গে একটু অগ্রসর হয়ে তিনি তার কঠিন ও প্রসিদ্ধ বিরোধিতাকারীদের মধ্যে মাওলানা মুহাম্মাদ হুসাইন বাটালভী ও মাওলানা আহমাদুল্লাহ অমৃতসরীর পাশাপাশি মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরীর নামও উল্লেখ করেছেন। এই তিনজন সম্পর্কে মির্যা লিখেছেন, ‘এরা মিথ্যাবাদী। এরা কুকুরের মতো মিথ্যার মরা জন্তু খায়’ (মুলহাক আঞ্জামে আথাম, পৃঃ ২৫)। উক্ত গ্রন্থের পরিশিষ্টের ২০ পৃষ্ঠার হাশিয়া থেকে এটাও জানা যায় যে, এই গ্রন্থটি রচনার পূর্বেই কাদিয়ানী মতবাদ খন্ডনে মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরীর মর্যাদা এত উঁচুতে গিয়ে পৌঁছেছিল যে, মির্যা গোলাম আহমাদ ও অমৃতসরীর মাঝে মুবাহালার জন্য পত্র লেখার সূচনা হয়েছিল। তাছাড়া উক্ত গ্রন্থের পরিশিষ্টের ২০ পৃষ্ঠায় মির্যা গোলাম আহমাদ মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী ও অন্য আলেমগণকে মুবাহালার দাওয়াত দিয়েছিলেন।[4]
‘আঞ্জামে আথাম’ লেখার প্রেক্ষাপট হ’ল, মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, ডেপুটি আব্দুল্লাহ আথাম ১৮৯৪ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর মারা যাবেন। কিন্তু বার্ধক্য সত্ত্বেও তিনি উক্ত তারিখের পরে জীবিত থাকেন। এর ফলে ওলামায়ে কেরাম ও সাধারণ মুসলমানরা মির্যাকে এমনভাবে সমালোচনার তীরে বিদ্ধ করেছিলেন যে, জনসম্মুখে তার মুখ দেখানো মুশকিল হয়ে পড়েছিল। তবে ভবিষ্যদ্বাণীর দুই বৎসর পর ১৮৯৬ সালের ২৭শে জুলাই ডেপুটি আথামের মৃত্যু হলে গোলাম আহমাদ দ্রুত ‘আঞ্জামে আথাম’ গ্রন্থটি লিখে ফেলেন। এতে বিরোধী আলেমদেরকে তিনি অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করেন।
এই দীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে এ বিষয়টি সুস্পষ্ট হ’ল যে, ১৮৯৪ সালে বা তার পূর্বেই কাদিয়ানীদের অন্যতম বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ও বিরোধিতাকারী হিসাবে মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরীর সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল। এই ফিৎনা নির্মূলে শীর্ষস্থানীয় আলেমগণের পাশাপাশি তাঁর নাম আসা শুরু হয়ে গিয়েছিল। ১৯০০ সালের ২৫শে মে মির্যা গোলাম আহমাদ ‘মি‘য়ারুল আখয়ার’ নামে একটি ইশতেহার প্রকাশ করেন এবং এতে বড় বড় আলেমদেরকে বাহাছের দাওয়াত দেন। এই ইশতেহারে বাহাছের জন্য আহবানকৃত আলেমদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী। মির্যার আহবানে সাড়া দিয়ে উক্ত ইশতেহারের জবাবে যারা বাহাছ করার জন্য ময়দানে আবির্ভূত হয়েছিলেন অমৃতসরী ছিলেন তাদের অগ্রসারিতে।
অনুরূপভাবে ১৯০০ সালের ২০শে জুলাই মির্যা একটি ইশতেহার প্রকাশ করে মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী ও পীর মোহর আলী শাহ গোলড়বীকে এ মর্মে দাওয়াত দেন যে, ‘আমার সামনে ৭ ঘণ্টা হাঁটু গেড়ে বসে কুরআনের চল্লিশটি আয়াতের আরবীতে তাফসীর লিখুন। যা বড় সাইজের বিশ পৃষ্ঠার কম হবে না। অতঃপর যার তাফসীরটি ভাল বিবেচিত হবে সেটাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে সমর্থনপুষ্ট বলে গণ্য করা হবে’।[5] তার এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতঃ নির্দিষ্ট দিনে মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী ও অন্যান্য ওলামায়ে কেরাম লাহোরে উপস্থিত হন। কিন্তু গোলাম আহমাদ তাদের মুখোমুখি হওয়ার সাহস পাননি। মজার ব্যাপার হ’ল, তিনি কাপুরুষের মতো কাদিয়ানে ঘরের মধ্যে লুকিয়ে থেকে ওলামায়ে কেরামের পলায়নের ইশতেহার প্রকাশ করেন।
সম্মানিত পাঠক! কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরীর প্রত্যয়দৃপ্ত ঐতিহাসিক সংগ্রামের এ ঘটনাগুলো প্রমাণ করে যে, কাদিয়ানী মতবাদের সূচনা ও আবির্ভাবলগ্নেই অমৃতসরী তাদের বিরুদ্ধে ময়দানে নেমে পড়েছিলেন। কিন্তু দুঃখজনক হ’ল তাঁর সেই সময়কার সংগ্রামের বিস্তারিত তথ্য আমরা অবগত হতে পারিনি।[6]
ইলহামাতে মির্যা প্রণয়ন ও এর প্রভাব :
ইস্তেখারা ও আল্লাহর নিকট কাতর কণ্ঠে বিনম্র প্রার্থনার পর মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী ১৯০১ সালে ‘ইলহামাতে মির্যা’ গ্রন্থটি প্রণয়ন করেন। কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে এটিই তাঁর প্রথম লিখিত গ্রন্থ।
এ গ্রন্থে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েছেন। সেটি হ’ল, মির্যা গোলাম আহমাদ তার মাসীহত্বের দাবীতে সত্যবাদী না মিথ্যাবাদী? এ বিষয়টি তখন আলেম-ওলামা সহ সকলের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। সাধারণ মানুষ মনে করত, অন্যান্য মাসআলাগুলির মতো মাসীহ-এর জীবন ও মৃত্যুর মাসআলাটিও একটি মতভেদপূর্ণ মাসআলা। ধূর্ত গোলাম আহমাদ এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দুর্বল ঈমানের মুসলমানদেরকে তার ষড়যন্ত্রের জালে ফাঁসাতে শুরু করেন। এজন্য মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী অন্য সকল প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে তার ইলহামগুলোকে মিথ্যা ও ভুয়া প্রমাণের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন। অতঃপর মির্যা তার নিজের সত্যবাদী বা মিথ্যাবাদী হওয়ার যে মানদন্ড নির্ধারণ করেছিলেন তার আলোকেই তার সত্যবাদিতা ও মিথ্যাবাদিতা পরীক্ষা করেন। যেমন মির্যা গোলাম আহমাদ বলেছেন, ‘আমার সত্যবাদিতা বা মিথ্যাবাদিতা যাচাই করার জন্য আমার ভবিষ্যদ্বাণীগুলির চেয়ে বড় কোন পরীক্ষা হতে পারে না’। অমৃতসরী মির্যার এই উদ্ধৃতি উল্লেখ করে বলেন, ‘যেহেতু কাদিয়ানী মতবাদকে যাচাই করার এটিই প্রধান মূলনীতি, সেহেতু যরূরী হ’ল আমরা এই পদ্ধতিতেই উক্ত দাবী পরীক্ষা করব, যার মাধ্যমে মির্যা ছাহেবের ইলহামের স্বরূপ উন্মোচিত হয়ে যাবে’।[7]
উক্ত গ্রন্থের ১ম সংস্করণে অমৃতসরী মির্যার ৪টি মৌলিক ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন, যেগুলি সে সময় মানুষের মাঝে খুব প্রসিদ্ধ ছিল। মির্যার বর্ণনার আলোকে তিনি তার ভবিষ্যদ্বাণীগুলিকে যাচাই-বাছাই করে অকাট্য দলীলের মাধ্যমে সেগুলিকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেন। এভাবে মির্যার নির্ধারিত মানদন্ডের আলোকেই তিনি সবগুলো ভবিষ্যদ্বাণীকে বাতিল ও মিথ্যা সাব্যস্ত করেন। উল্লেখ্য যে, পরবর্তী সংস্করণগুলিতে মির্যার অন্যান্য ইলহামগুলি সম্পর্কেও এতে তিনি আলোচনা করেছেন।[8]
কাদিয়ানী মতবাদ খন্ডনে অমৃতসরীর এটি একটি অসাধারণ, অদ্বিতীয় ও অতুলনীয় গ্রন্থ। এর মাধ্যমে বহু দুর্বলচিত্তের মুসলমানের পদসমূহ ইসলামের উপরে অটল ও দৃঢ় হয়ে যায়। অন্যদিকে কাদিয়ানী সমাজে এটি হৈচৈ ফেলে দেয়। মির্যা গোলাম আহমাদের খাছ মুরীদ ও কাদিয়ানী মতবাদের অন্যতম স্তম্ভ হিসাবে পরিচিত ড. আব্দুল হাকীম পাটিয়ালবী এই গ্রন্থটি পড়ে সর্বপ্রথম প্রভাবিত হন। তিনি ১৯০৬ সালে কাদিয়ানী মতবাদ ত্যাগ করে তাদের বিরুদ্ধে জোরালো কর্মতৎপরতা শুরু করেন। এমনকি মির্যা গোলাম আহমাদের জীবদ্দশায় ও তার মৃত্যুর পরেও তিনি তাদের পিছু ছাড়েননি।
গ্রন্থটি প্রকাশের পর বড় বড় ওলামায়ে কেরাম এর ভূয়সী প্রশংসা করেন। মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরীর শিক্ষক মাওলানা হাফেয আব্দুল মান্নান ওয়াযীরাবাদী (রহঃ) বলেন, ‘এ বিষয়ে এর চেয়ে সুন্দর কোন গ্রন্থ আমার নযরে পড়েনি। এটি মির্যার মহামিথ্যাবাদী হওয়ার সুস্পষ্ট দলীল। মির্যার আক্বীদার ব্যাপারে দোদুল্যমান ব্যক্তিরা তো বটেই, খোদ তার ভক্ত-অনুসারীদের আক্বীদাতেও (ইনছাফের শর্তে) প্রচন্ড ভূমিকম্প সৃষ্টিকারী গ্রন্থ এটি’।
অমৃতসরীর আরেক শিক্ষক মাওলানা আহমাদুল্লাহ অমৃতসরী বলেন, ‘কাদিয়ানী মতবাদ খন্ডনে ‘ইলহামাতে মির্যা’ একটি চমৎকার ও অনবদ্য গ্রন্থ। বুদ্ধিমান ব্যক্তি এই গ্রন্থ পাঠ করার পর মির্যা গোলাম আহমাদের অনুসারী থাকতে পারে না’।
পীর মোহর আলী শাহ গোলড়বী বলেন, ‘আমি আশা করছি যে, আপনার ইলহামাতে মির্যা গ্রন্থটি পাঠ হকপন্থীদের দৃঢ়তার জন্য যেমন সহায়ক হবে, তেমনি বা তার চেয়ে বেশী প্রতিপক্ষের অন্তরে ভীতির সঞ্চার করবে’ (ইলহামাতে মির্যা, ৩য় সংস্করণ, পৃঃ ১)।
মাওলানা অমৃতসরী যে আশায় বুক বেঁধে গ্রন্থটি প্রণয়ন করেছিলেন তাঁর সেই আশা ষোল কলায় পূর্ণ হয়েছিল। মির্যা গোলাম আহমাদ মৃত্যু পর্যন্ত এর জওয়াব দিতে ব্যর্থ হন। ১ম সংস্করণে লেখক মির্যাকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন যে, তিনি যদি এর উত্তর দিতে পারেন তাহ’লে ৫০০ রূপিয়া পুরস্কার দেয়া হবে। ২য় সংস্করণে পুরস্কারের অংক বাড়িয়ে ১ হাযার রূপিয়া করা হয়েছিল। এই চ্যালেঞ্জ কাদিয়ানী শিবিরে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। কাদিয়ানীদের পক্ষ থেকে এর জওয়াবের আশায় অমৃতসরী তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশের জন্য এক বছর অপেক্ষা করেছিলেন। কিন্তু গোলাম আহমাদ উক্ত চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে এর জবাব দিতে সক্ষম হননি। ফলকথা, ১৯০৪ সালের মধ্যে এর ৩টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এবার অমৃতসরী পুরস্কারের অংক ২ হাযার রূপিয়াতে বর্ধিত করেন। কিন্তু তথাকথিত কলম সৈনিক মির্যা গোলাম আহমাদ সত্যের নির্ভীক কলম সৈনিক অমৃতসরীর চ্যালেঞ্জে যথারীতি নীরব ও নিরুত্তর থাকেন। মির্যার জীবদ্দশায় এর ৩টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। প্রত্যেক সংস্করণেই নতুন নতুন আলোচনা যুক্ত হয়েছে। এর ফলে এ বিষয়ে এটি একটি অনন্য ও প্রামাণ্যে গ্রন্থে পরিণত হয়েছে।[9]
মুদ, অমৃতসর-এর মুনাযারা (অক্টোবর ১৯০২) :
১৯০২ সালের ২৯ ও ৩০শে অক্টোবর অমৃতসর যেলার ‘মুদ’ নামক গ্রামে বৃহৎ পরিসরে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে এই মুনাযারা অনুষ্ঠিত হয়। মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী এর প্রেক্ষাপট সম্পর্কে নিজেই বলেছেন, ‘অমৃতসর যেলার মুদ নামক স্থানে কাদিয়ানীরা হৈচৈ শুরু করলে মুদ-এর বাশিন্দারা লাহোরে একজন ব্যক্তিকে এ মর্মে পাঠান যে, ওখান থেকে কোন আলেমকে নিয়ে আস। যিনি তাদের সাথে বাহাছ করবেন। লাহোরবাসীদের পরামর্শে মুনাযারার জন্য আমাকেই নির্বাচন করা হয়। একটি টেলিগ্রাম আসে। সকাল বেলায় হঠাৎ এক ব্যক্তি এসে বলেন, চলুন! না হ’লে গ্রামের সবাই এমনকি আশেপাশের লোকজনও সব গুমরাহ হয়ে যাবে। অগত্যা অধম উল্লেখিত মুদ নামক স্থানে পৌঁছেন। বাহাছ হয়’।[10]
এই মুনাযারায় কাদিয়ানীদের পক্ষে বিতর্কে অংশ নেন মৌলবী সুরূর শাহ। বিতর্কের বিষয় ছিল ‘মির্যা ছাহেব তার ইলহামী দাবী সমূহে সত্যবাদী না মিথ্যাবাদী’? মাওলানা অমৃতসরী মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী কর্তৃক নির্ধারিত মানদন্ড ও মূলনীতি সমূহের আলোকে অকাট্যভাবে তাকে মিথ্যাবাদী ও ধোঁকাবাজ প্রমাণ করেন। কাদিয়ানী মৌলবী তাঁর দলীলগুলি খন্ডনের বহু চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। অবশেষে শোচনীয় পরাজয় স্বীকার করে নিয়ে চূড়ান্ত অপমানিত হয়ে সঙ্গী-সাথী সহ বিতর্ক ময়দান ছেড়ে পলায়ন করেন।
পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে কাদিয়ানী প্রতিনিধি দল কাদিয়ান পৌঁছে গোলাম আহমাদকে মুনাযারায় পরাজয়বরণের লাঞ্ছনাকর কাহিনী শুনালে তিনি রাগে-ক্ষোভে ও দুঃখে ফেটে পড়েন এবং ‘কাছীদা ই‘জাযিয়াহ’ রচনা করে মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরীকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। উক্ত কবিতায় গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী তার শোচনীয় অবস্থার কথা বর্ণনা করে বলেন,
فأفردتُ إفراد الحسين بكربلا * وفى الحى صرنا مثل من كان يُقبَرُ
‘হুসাইন যেমন কারবালা ময়দানে একাকী হয়ে পড়েছিলেন, আমার অবস্থাও তথৈবচ। আর ঐ অঞ্চলে আমরা দাফনকৃত মৃত ব্যক্তির মত হয়ে গেলাম’।
এতদিন পর্যন্ত মাওলানা মুহাম্মাদ হুসাইন বাটালভীকে মির্যা গোলাম আহমাদ তার সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতেন। কিন্তু মুদ-এর বিতর্কের পর তিনি অমৃতসরীকে তার সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ও সবচেয়ে কড়া তার্কিক হিসাবে আখ্যা দেন। যেমন মির্যা বলেন,
ألا رب خصم قد رأيتُ جداله * وما أن رأينا مثله من يزوّر
فأوصيك يا ردف الحسين أبا الوفا * أنِبْ، واتق الله المحاسب واحذر
فقال ثناء الله لى أنت كاذب * فقلت لك الويلات أنت ستحسر
‘সাবধান! আমি অনেক বাহাছকারীকে দেখেছি। কিন্তু তাঁর (মাওলানা ছানাউল্লাহ) মতো ধোঁকাবাজ কাউকে দেখিনি। মুহাম্মাদ হুসাইন বাটালভীর পদাংক অনুসরণকারী হে আবুল অফা! আমি তোমাকে নছীহত করছি, তুমি তওবা করো এবং হিসাব গ্রহণকারী আল্লাহকে ভয় করো। ছানাউল্লাহ আমাকে বলল, তুমি মিথ্যাবাদী। তখন আমি তাকে বললাম, তোমার ধ্বংস অনিবার্য। তুমি অচিরেই আফসোস করবে’।
মুসলমানদের উপরে এই মুনাযারার দারুণ প্রভাব পড়েছিল। এই মুনাযারার মাধ্যমে অমৃতসরী কাদিয়ানীদের ষড়যন্ত্র, প্রতারণা ও ধোঁকার পর্দা জনসমক্ষে উন্মোচন করে দিয়েছিলেন। মুনাযারায় তাদের নিরঙ্কুশ পরাজয়বরণের ফলে সরলপ্রাণ মুসলমানদের পদসমূহ ইসলামের উপরে সুদৃঢ় হয়ে গিয়েছিল এবং মুদ ও এর আশেপাশের অধিবাসীরা কাদিয়ানী ফিৎনা থেকে বেঁচে গিয়েছিল। যারা কাদিয়ানীদেরকে এতদিন চাঁদা দিত তারাও তাদের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল। এজন্য গোলাম আহমাদ এই গ্রামের উপর লা‘নত করে এর ধ্বংস কামনা করেছেন।[11]
মির্যার আহবানে মুনাযারার বরপুত্র কাদিয়ানে (জানুয়ারী ১৯০৩) :
১৯০২ সালে মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী ‘ই‘জাযে আহমাদী’ নামে একটি বই লিখেন। এতে তিনি মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরীকে মুনাযারার চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলেন, ‘যদি ইনি (মৌলভী ছানাউল্লাহ) সত্যবাদী হন তাহলে কাদিয়ানে এসে (আমার) যেকোন ভবিষ্যদ্বাণীকে মিথ্যা প্রমাণ করুন। প্রত্যেকটি ভবিষ্যদ্বাণীর জন্য ১০০ রূপিয়া পুরস্কার দেওয়া হবে এবং আলাদাভাবে যাতায়াত ভাড়া দেওয়া হবে’।[12] অতঃপর উক্ত বইয়ের ২৩ পৃষ্ঠায় মির্যা লিখেন, ‘মৌলভী ছানাউল্লাহ (মুদ-এর বাহাছে) বলেছিলেন যে, আমার ভবিষ্যদ্বাণীগুলি সব মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। এজন্য আমি (মির্যা) তাকে আহবান জানাচ্ছি এবং আল্লাহর কসম দিচ্ছি যে, তিনি এই বিষয়টি যাচাই করার জন্য কাদিয়ানে আসুন! স্মর্তব্য যে, ‘নুযূলুল মাসীহ’ (ঈসার অবতরণ) গ্রন্থে আমি দেড়শ ভবিষ্যদ্বাণী লিখেছি। সুতরাং এসব ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা প্রমাণ করতে পারলে মৌলভী ছানাউল্লাহ ছাহেব ১৫ হাযার রূপিয়া নিয়ে যাবেন এবং এখান সেখান থেকে ভিক্ষা চাওয়া থেকে মুক্তি পাবেন। বরং আমি তার সামনে দলীল সহ আরো ভবিষ্যদ্বাণী পেশ করব এবং ঐ ওয়াদা মোতাবেক প্রত্যেক ভবিষ্যদ্বাণীর জন্য ১০০ রূপিয়া করে দিতে থাকব। বর্তমানে আমার দলের সদস্য সংখ্যা ১ লাখের বেশী। কাজেই আমি যদি মৌলভী ছানাউল্লাহ ছাহেবের জন্য আমার প্রত্যেক মুরীদের কাছ থেকে ১ রূপিয়া করে নেই তাহলেও তো এক লক্ষ রূপিয়া হয়ে যাবে। এগুলি সব তাকে উপহার হিসাবে প্রদান করা হবে’। উপরন্তু উক্ত গ্রন্থের ৩৭ পৃষ্ঠায় তিনি এও লিখেন যে, মৌলভী ছানাউল্লাহ তার ভবিষ্যদ্বাণীগুলোকে মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য কস্মিনকালেও কাদিয়ানে আসবেন না।[13]
ভন্ডনবী মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর এই চ্যালেঞ্জের জবাব দেওয়ার জন্য মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী ১৯০৩ সালের ১০ই জানুয়ারী কাদিয়ানে পৌঁছেন এবং তাকে মুনাযারায় হাযির হওয়ার আহবান জানান। কিন্তু মুনাযারায় অবতীর্ণ না হওয়ার জন্য গোলাম আহমাদ কৌশল অবলম্বন করেন এবং মুহাম্মাদ আহসান আমরূহীর নিকট চিরকুট লিখে পাঠান যে, কারো সাথে মুনাযারা না করার জন্য তিনি কসম করে আল্লাহর নিকট অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছেন। এই চিরকুট পাঠ করে মাওলানা অমৃতসরী কাদিয়ানে বক্তব্য প্রদান করেন এবং মির্যাকে তাঁর নবুঅতের দাবীতে ডাহা মিথ্যাবাদী প্রমাণ করেন। উপমহাদেশের খ্যাতিমান ঐতিহাসিক মাওলানা মুহাম্মাদ ইসহাক ভাট্টী বলেন, ‘মাওলানা অমৃতসরীই প্রথম আলেম ছিলেন যিনি মির্যা ছাহেবের নবুঅত দাবী করার পর কাদিয়ান গিয়েছিলেন এবং কাদিয়ানীদের দুর্গে গিয়ে তাদেরকে নাস্তানাবুদ করেছিলেন’।[14]
মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর সাথে মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরীর মুবাহালা (এপ্রিল ১৯০৭) :
মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী ১৯০৩ সালের ১৩ই নভেম্বর তারিখে সাপ্তাহিক ‘আহলেহাদীছ’ পত্রিকা বের করেন। এটি গোলাম আহমাদ ও তার অনুসারীদের জন্য গোদের উপর বিষফোঁড়া স্বরূপ ছিল। কারণ এই পত্রিকাটি একদিকে যেমন আর্য সমাজ, খ্রিস্টান ও অন্যান্য ইসলাম বিরোধী শক্তির বুদ্ধিবৃত্তিক হামলার মুকাবিলায় নিয়োজিত ছিল, তেমনি কাদিয়ানী মতবাদের খন্ডনেও উৎসর্গিত ছিল। সপ্তাহব্যাপী কাদিয়ানীদের পক্ষ থেকে যা কিছু প্রকাশিত ও প্রচারিত হ’ত, মাওলানা অমৃতসরী এতে তার সমুচিত জবাব দিতেন। এতে মুসলমানরা দারুণভাবে উপকৃত হ’ত। বিশেষত ১৯০৪ সালের মহামারী সম্পর্কে কাদিয়ানীদের স্বরূপ এমনভাবে উন্মোচিত হয়েছিল যে, তারা শত চেষ্টা করেও সফলতার মুখ দেখতে পারেনি। এভাবে প্রত্যেক সপ্তাহের ধারাবাহিক চপেটাঘাত কাদিয়ানী শিবিরকে এমনভাবে পর্যুদস্ত করেছিল যে, সাপ্তাহিক ‘আহলেহাদীছ’ পত্রিকা বের হওয়ার মাত্র ৩ বছর ৫ মাসের মধ্যেই গোলাম আহমাদ আসমানী ফায়ছালার জন্য মাওলানা অমৃতসরীর সাথে মুবাহালা করতে বাধ্য হন। মুবাহালার ঠিক ১৩ মাস ১০ দিন পর আল্লাহর পক্ষ থেকে চূড়ান্ত ফায়ছালা নেমে আসে। কাদিয়ানী ও মুসলমানদের সংগ্রামের ইতিহাসে যেটিকে ‘সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নিরূপণকারী দিন’ হিসাবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে।[15]
মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরীর চ্যালেঞ্জের পর চ্যালেঞ্জের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে ভন্ডনবী মির্যা গোলাম আহমাদ ১৯০৭ সালের ১৫ই এপ্রিল একটি লম্বা ইশতেহার প্রকাশ করে অমৃতসরীকে মুবাহালার আহবান জানান, যা হুবহু নিম্নরূপ:
মৌলভী ছানাউল্লাহ ছাহেবের সাথে শেষ ফায়ছালা
বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম
নাহমাদুহু ওয়া নুছল্লী ‘আলা রাসূলিহিল কারীম
‘তারা তোমার কাছে জানতে চায় ক্বিয়ামতের শাস্তি কি সত্য? তুমি বল, আমার প্রতিপালকের কসম! অবশ্যই ওটা নিশ্চিতভাবে সত্য’।[16]
মৌলভী ছানাউল্লাহ ছাহেব সমীপে!
আস-সালামু আলা মানিত তাবা‘আল হুদা
দীর্ঘদিন যাবৎ আপনার ‘আহলেহাদীছ’ পত্রিকায় আমাকে মিথ্যাবাদী ও ফাসেক সাব্যস্তকরণের পরম্পরা অব্যাহত রয়েছে। আপনি সর্বদা আপনার এই পত্রিকায় আমাকে মারদূদ (প্রত্যাখ্যাত), মিথ্যুক, দাজ্জাল, অশান্তি সৃষ্টিকারী হিসাবে উল্লেখ করে থাকেন এবং পৃথিবীব্যাপী আমার সম্পর্কে বদনাম করেন যে, এই ব্যক্তি মিথ্যা অপবাদ দানকারী, মিথ্যাবাদী ও দাজ্জাল। এই ব্যক্তির প্রতিশ্রুত মাসীহ হওয়ার দাবী নির্জলা মিথ্যা। আমি আপনার কাছ থেকে অনেক কষ্ট পেয়েছি এবং ধৈর্য ধারণ করতে থেকেছি। কিন্তু আমি হক প্রচারের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে আদিষ্ট। আপনি আমার প্রতি বহু মিথ্যা অপবাদ দিয়ে মানুষকে আমার নিকট আসতে বাধা দেন এবং এমন সব গালি, মিথ্যা অপবাদ এবং শব্দ উল্লেখ করে আমাকে স্মরণ করেন যার চেয়ে কোন কঠিন শব্দ হতে পারে না।
যদি আমি এতবড় মিথ্যাবাদী ও অপবাদ দানকারী হই, যেভাবে বেশীরভাগ সময় আপনি আপনার পত্রিকার প্রত্যেকটি সংখ্যায় আমাকে উল্লেখ করে থাকেন, তাহলে আমি আপনার জীবদ্দশাতেই ধ্বংস হয়ে যাব। কেননা আমি জানি যে, অশান্তি সৃষ্টিকারী ও মিথ্যাবাদী বেশী দিন বাঁচে না। অবশেষে সে লাঞ্ছনা ও অবমাননার সাথে তার চরম শত্রুদের জীবদ্দশাতেই ব্যর্থ ও ধ্বংস হয়ে যায়। আর তার ধ্বংস হয়ে যাওয়াই শ্রেয়। যাতে সে আল্লাহর বান্দাদেরকে ধ্বংস করতে না পারে।
আর আমি যদি মিথ্যাবাদী ও অপবাদ দানকারী না হই, আল্লাহর কালাম ও সম্বোধন দ্বারা সম্মানিত হই এবং প্রতিশ্রুত মাসীহ হই তাহলে আমি আল্লাহর ফযলে আশা রাখছি যে, আল্লাহর রীতি অনুযায়ী আপনি মিথ্যাবাদীদের শাস্তি থেকে রেহাই পাবেন না। কিন্তু যদি ঐ শাস্তি যেটি মানুষের হাতে নেই, বরং স্রেফ আল্লাহর হাতে রয়েছে যেমন মহামারী, ডায়রিয়া প্রভৃতি ধ্বংসকারী রোগ সমূহ, আমার জীবদ্দশাতেই আপনার উপরে আপতিত না হয় তাহলে আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত নই।
এটি কোন ইলহাম বা অহীর ভিত্তিতে ভবিষ্যদ্বাণী নয়; বরং স্রেফ দো‘আ স্বরূপ আমি আল্লাহর নিকট ফায়ছালা চেয়েছি। আমি আল্লাহর নিকট দো‘আ করছি, হে আমার প্রভু, সর্বদ্রষ্টা ও সর্বশক্তিমান, যিনি মহাজ্ঞানী ও সর্বজ্ঞ, যিনি আমার অন্তর জগতের খবর রাখেন। যদি প্রতিশ্রুত মাসীহ হওয়ার এই দাবী নিছক আমার কপোলকল্পিত হয় এবং আমি তোমার দৃষ্টিতে অশান্তি সৃষ্টিকারী ও মিথ্যুক হই এবং দিনরাত মিথ্যা অপবাদ দান করা আমার কাজ হয়ে থাকে তাহলে হে আমার প্রিয় মালিক! আমি মিনতির সাথে তোমার নিকট দো‘আ করছি, মৌলভী ছানাউল্লাহ ছাহেবের জীবদ্দশাতেই আমাকে ধ্বংস করে দাও এবং আমার মৃত্যু দিয়ে তাকে ও তার জামা‘আতকে খুশী করে দাও। আমীন! কিন্তু হে আমার সত্যবাদী আল্লাহ! যদি মৌলভী ছানাউল্লাহ কর্তৃক আমার উপরে আরোপিত মিথ্যা অপবাদগুলিতে তিনি সত্যের উপরে না থাকেন, তাহলে আমি বিনয়-নম্রতার সাথে তোমার দরবারে দো‘আ করছি, আমার জীবদ্দশাতেই তাকে ধ্বংস করো। তবে মানুষের হাতে নয়; বরং মহামারী, ডায়রিয়া প্রভৃতি ধ্বংসকারী রোগ-ব্যাধি সমূহের মাধ্যমে। শুধু এক্ষেত্রে ব্যতীত যে, তিনি প্রকাশ্যে আমার ও আমার জামা‘আতের সামনে ঐ সকল গালিগালাজ ও অশ্লীল ভাষা থেকে তওবা করবেন গুরুদায়িত্ব মনে করে, যেগুলি দ্বারা তিনি আমাকে সর্বদা কষ্ট দিয়ে থাকেন। আমীন ইয়া রববাল আলামীন।
আমি তার নিকট থেকে অনেক কষ্ট পেয়েছি এবং ধৈর্যধারণ করে গেছি। কিন্তু এখন দেখছি, তার অশ্লীল ভাষা সীমা অতিক্রম করে গেছে। তিনি আমাকে ঐ সকল চোর ও ডাকাতদের চেয়েও অত্যন্ত নিকৃষ্ট মনে করেন যাদের অস্তিত্ব ধরাপৃষ্ঠের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তিনি ঐ সকল মিথ্যা অপবাদ ও অশ্লীল ভাষা প্রয়োগের ক্ষেত্রে ‘যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তার পিছনে পড়ো না’[17] শীর্ষক আয়াতের উপরেও আমল করেননি এবং গোটা পৃথিবীর চেয়ে আমাকে নিকৃষ্ট মনে করেছেন। তিনি দূর-দূরান্তের দেশগুলিতে পর্যন্ত আমার সম্পর্কে এটা প্রচার করেছেন যে, এই ব্যক্তি আসলেই অশান্তি সৃষ্টিকারী, প্রতারক, মিথ্যার বেসাতী, মিথ্যুক, মিথ্যা অপবাদ দানকারী এবং অত্যন্ত খারাপ প্রকৃতির মানুষ।
যদি এ ধরনের শব্দগুলি সত্যানুসন্ধানীদের উপরে খারাপ প্রভাব না ফেলত তাহলে আমি এসব অপবাদের ব্যাপারে ধৈর্যধারণ করতাম। কিন্তু আমি লক্ষ্য করছি যে, মৌলভী ছানাউল্লাহ এ অপবাদগুলির মাধ্যমে আমার সিলসিলাকে ধ্বংস করতে চান এবং ঐ বিল্ডিংকে ধ্বংস করতে চান, যা তুমি হে আমার প্রভু ও আমার প্রেরক নিজ হাতে নির্মাণ করেছ। এজন্য আমি এখন তোমারই পবিত্রতা ও রহমতের অাঁচল ধরে তোমার দরবারে আশ্রয়প্রার্থী হয়েছি যে, আমার ও ছানাউল্লাহর মাঝে সঠিক ফায়ছালা করে দাও এবং যে তোমার দৃষ্টিতে প্রকৃত অশান্তি সৃষ্টিকারী এবং মিথ্যাবাদী, তাকে সত্যবাদীর জীবদ্দশাতেই দুনিয়া থেকে উঠিয়ে নাও অথবা মৃত্যুতুল্য অন্য কোন কঠিন রোগে আক্রান্ত করো। হে আমার প্রিয় মালিক! তুমি এমনটাই করো। আমীন! ছুম্মা আমীন!
رَبَّنَا افْتَحْ بَيْنَنَا وَبَيْنَ قَوْمِنَا بِالْحَقِّ وَأَنْتَ خَيْرُ الْفَاتِحِيْنَ-
‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের ও আমাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে তুমি যথার্থ ফায়ছালা করে দাও। আর তুমিই তো শ্রেষ্ঠ ফায়ছালাকারী’।[18] আমীন!
পরিশেষে মৌলভী ছাহেবের নিকট আবেদন হ’ল, এই পুরা ইশতেহারটি তিনি যেন তার পত্রিকায় ছেপে দেন এবং যা চান এর নিচে লিখে দেন। এখন ফায়ছালা আল্লাহর হাতে।
লেখক : আব্দুল্লাহ আছ-ছমাদ মির্যা গোলাম আহমাদ প্রতিশ্রুত মাসীহ, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করুন এবং শক্তিশালী করুন। ১৫ই এপ্রিল ১৯০৭ মোতাবেক ১লা রবীউল আউয়াল ১৩২৫ হিঃ।[19]
ভন্ড নবী গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর মৃত্যু :
মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরীর সাথে মুবাহালা করার পর থেকেই মির্যা গোলাম আহমাদ মৃত্যুর আতঙ্কে ভুগছিলেন। মৃত্যুর পূর্বে রচিত একটি কবিতায় তিনি এই আশংকা ব্যক্ত করে লিখেছিলেন-
ہنستا ہے ميرے حال پہ ظالم ابو الوفا
ڈرتا ہوں ميں كہيں يہ قضا كي ہنسى نہ ہو
‘যালেম আবুল অফা (অমৃতসরী) আমার অবস্থা দেখে হাসছেন। আমার ভয় হচ্ছে এই হাসি যেন আমার ভাগ্যে লিখিত মৃত্যুর হাসি না হয়’।
অবশেষে তার আশংকাই সত্যে পরিণত হ’ল। অমৃতসরীর সাথে মুবাহালার ১৩ মাস ১০ দিন পরে ১৯০৮ সালের ২৫শে মে রাতে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ২৬শে মে সকাল সাড়ে ১০-টায় লাহোরের আহমদিয়া বিল্ডিংয়ে তিনি মারা যান। মৃত্যুর সময়ে তার মুখ দিয়ে পায়খানা বের হচ্ছিল। অতঃপর দাফনের উদ্দেশ্যে লাশ কাদিয়ানে নিয়ে যাওয়ার পথে লাহোরের আহমাদিয়া বিল্ডিং থেকে রেল স্টেশন পর্যন্ত গোলাম আহমাদের লাশের উপর ময়লা-আবর্জনা ও পায়খানা এমনভাবে বর্ষিত হয় যে, অনেক কষ্টে লাশ স্টেশনে পৌঁছে। তার সমর্থক ও বিরোধী সবাই এ লাঞ্ছনাকর দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে। ১৯০৮ সালের ২৭শে মে মির্যাকে কাদিয়ানে (তার নিজের নামকরণকৃত) ‘বেহেশতী মাক্ববারাহ’ বা জান্নাতী কবরস্থানে (?) দাফন করা হয়। এরপর হাকীম নূরুদ্দীন তার খলীফা ও স্থলাভিষিক্ত নিযুক্ত হন। অপরদিকে মাওলানা ছানাউল্লা অমৃতসরী মুবাহালা ঘোষণার ৪০ বছর ১১ মাস পরে ১৯৪৮ সালের ১৫ই মার্চ তারিখে ৮০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। এভাবে সত্যবাদীর জীবদ্দশাতেই ভন্ড নবী গোলাম আহমাদের নিকৃষ্ট মৃত্যু হয়। আল্লাহ যুগে যুগে ভন্ড নবীদেরকে এভাবেই নাস্তানাবুদ করে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেছেন।[20] উল্লেখ্য যে, ১৮৯১ সালের ২২শে জানুয়ারী মির্যা গোলাম আহমাদ নিজেকে ‘প্রতিশ্রুত মাসীহ’, ১৮৯৪ সালের ১৭ই মার্চ ‘ইমাম মাহদী’ এবং ১৯০৮ সালের ৫ই মার্চ নবী ও রাসূল দাবী করেন।[21]
অমৃতসরীর জীবদ্দশায় আল্লামা রশীদ রিযা মিসরী লিখেছিলেন,وقد تباهل هو مع القادياني نفسه على أن الكذاب منهما في دعوته يموت قبل الآخر، فمات القادياني في الكنيف شر ميتة، ولا زال ثناء الله حيّا قائما على المبطلين يناظرهم ويكسر شوكتهم، ‘তিনি (অমৃতসরী) স্বয়ং (গোলাম আহমাদ) কাদিয়ানীর সাথে এ মর্মে মুবাহালা করেছিলেন যে, তাদের দু’জনের মধ্যে যে তার দাবীতে মিথ্যাবাদী তিনি অন্যজনের পূর্বে মারা যাবেন। অতঃপর কাদিয়ানী টয়লেটে নিকৃষ্ট মৃত্যুবরণ করেন। আর ছানাউল্লাহ বহাল তবিয়তে জীবিত থেকে বাতিলপন্থীদের সাথে বিতর্ক করে তাদের প্রতিপত্তিকে নস্যাৎ করে দিতে থাকেন’।[22]
মাওলানা আব্দুল হাই লাক্ষ্মৌভী (রহঃ) লিখেছেন,
وقد تحداه المرزا غلام أحمد القادياني عام ست وعشرين وثلاثمائة وألف بأن من يكون كاذباً منهما ويكون على باطل يسبق صاحبه إلى الموت ويسلط الله عليه داء مثل الهيضة والطاعون، وقد ابتلي المرزا بهذا الداء بعد مدة قليلة ومات، أما الشيخ ثناء الله فقد عاش بعد هذا أربعين سنة-
‘মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী ১৩২৬ হিজরীতে তাঁকে (অমৃতসরী) চ্যালেঞ্জ করেছিলেন যে, তাদের মধ্যে যে মিথ্যাবাদী এবং বাতিলের উপরে প্রতিষ্ঠিত তিনি অন্যের আগে মৃত্যুবরণ করবেন এবং আল্লাহ ডায়রিয়া, মহামারী জাতীয় রোগ তার উপরে চাপিয়ে দিবেন। অল্প কিছুদিন পরেই মির্যা এই রোগে আক্রান্ত হন এবং মৃত্যুবরণ করেন। পক্ষান্তরে শায়খ ছানাউল্লাহ এর পরে ৪০ বছর জীবিত ছিলেন’।[23]
সাইয়িদ সুলাইমান নাদভী (রহঃ) বলেন, ‘এটা ঐ সময়ের কথা যখন মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর দাবী সমূহের কারণে পাঞ্জাবে ফিৎনা সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। তিনি মির্যার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন এবং সেই সময় থেকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত এই আন্দোলন এবং এর ইমামের খন্ডনে পুরা সময় ব্যয় করেছিলেন। অবশেষে উভয় পক্ষের মধ্যে মুবাহালা হয়েছিল। যার ফলাফল এটা হয়েছিল যে, সত্যবাদীর সামনে মিথ্যাবাদী মৃত্যুবরণ করেছিল’।[24]
আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর (রহঃ) বলেন,
وفعلا قبلت دعوته هذه، وقضى بينه وبين ثناء الله بالحق، وبعد ثلاثة عشر شهرًا وعشرة أيام بالضبط جاءه قضاء الله وقدره بصورة بشعة كان يتمناها للشيخ الجليل ثناء الله، نعم بنفس الصورة وبنفس المرض الذى نص عليه هو؟ بالكوليرا، ‘বাস্তবিকই তার এই দো‘আ কবুল হয়েছিল। তার ও ছানাউল্লাহর মাঝে সত্য ফায়ছালা করা হয়েছিল। মুবাহালার ঠিক ১৩ মাস ১০ দিন পরে বীভৎস রূপে তার নিকট আল্লাহর ফায়ছালা ও নিয়তি চলে এসেছিল। যা তিনি মহান শায়খ ছানাউল্লাহর জন্য কামনা করতেন। হ্যাঁ, তিনি ঠিক যেভাবে লিখেছিলেন ঠিক সেই রূপে ও সেই ব্যাধি কলেরাতে’।[25]
মির্যা গোলাম আহমাদের মৃত্যুর পর কাদিয়ানীদের সাথে মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরীর বাহাছ-মুনাযারা :
মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর জীবদ্দশায় মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী ও কাদিয়ানীদের মাঝে সরাসরি যেসব টক্কর হয়েছে তার মধ্যে দু’টি ঘটনা পূর্বে আলোচিত হয়েছে। ১. অমৃতসর যেলার ‘মুদ’ নামক গ্রামের মুনাযারা এবং ২. মির্যার আহবানে সাড়া দিয়ে বাহাছ করার জন্য অমৃতসরীর কাদিয়ানে আগমন। দ্বিতীয় ঘটনার পর মির্যা এতটাই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে, এরপর তিনি যেমন নিজে ছানাউল্লাহ অমৃতসরীর মুখোমুখি হওয়ার দুঃসাহস দেখাননি, তেমনি তার কোন মুরীদকেও এর অনুমতি দেননি। তবে মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর মৃত্যুর পর বিভিন্ন সময় তার ধোঁকাবাজ মুরীদ ও শিষ্যদের সাথে অমৃতসরীর বহু বাহাছ ও মুনাযারা হয়েছে। মাওলানা ছফিউর রহমান মুবারকপুরীর গবেষণা মতে, মির্যার মৃত্যুর পর মাওলানা অমৃতসরী ও কাদিয়ানী অনুসারীদের মধ্যে মুনশী কাসেম আলী কাদিয়ানীর সাথে রামপুরে সর্বপ্রথম মুনাযারা অনুষ্ঠিত হয়।[26] নিম্নে কাদিয়ানীদের সাথে তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি মুনাযারার বিবরণ উপস্থাপিত হ’ল-
১. রামপুরের মুনাযারা (জুন ১৯০৯) :
রামপুরের (ইউপি) নওয়াব মুহাম্মাদ হামিদ আলী খান-এর দরবারে কর্মরত মুনশী যুলফিকার আলী কাদিয়ানী মতবাদে দীক্ষিত হন। তাঁর চাচাতো ভাই হাফেয আহমাদুল্লাহ কাদিয়ানীদের কঠিন বিরোধী ছিলেন। নওয়াবের সামনেই দু’ভায়ের মধ্যে এ বিষয়ে আলোচনা হত। অনেক সময় নওয়াব ছাহেব নিজেই তা আগ্রহভরে শুনতেন। যখন দুই ভাইয়ের দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করল তখন নওয়াব ছাহেব তাদেরকে বললেন, ‘তোমরা তোমাদের ভাল ভাল আলেমগণকে ডেকে নিয়ে এসে আমার সামনে মুনাযারা করাও। মুনাযারার যাবতীয় খরচ আমি বহন করব’। তাঁর কথামতো মুনাযারার জন্য ভারতবর্ষের বিভিন্ন মাযহাব ও মাসলাকের শতাধিক আলেমকে দাওয়াত দেওয়া হ’ল। শী‘আ-সুন্নী উভয় ঘরানার আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ জুববা ও পাগড়ি পরে হাযির হলেন। সবার সম্মতিক্রমে মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী মুসলমানদের পক্ষে মুনাযির হিসাবে নির্বাচিত হলেন। আর কাদিয়ানী পক্ষ থেকে গোলাম আহমাদের খাছ মুরীদ ও খলীফা নূরুদ্দীনের ডান হাত হিসাবে পরিচিত মৌলভী মুহাম্মাদ আহসান আমরূহী মুনাযির নির্বাচিত হলেন। মুসলমানদের প্রস্তাব ছিল, ‘মির্যার সত্যবাদিতা ও মিথ্যাবাদিতা’ এ বিষয়ে বাহাছ হোক। কিন্তু কাদিয়ানীদের জোরাজুরির কারণে নওয়াব ছাহেব নির্দেশ দিলেন, প্রথমে ‘মাসীহ-এর জীবন ও মৃত্যু’ বিষয়ে বাহাছ হোক। তারপর অন্য বিষয়ে বাহাছ হবে।
১৯০৯ সালের ১৫, ১৬ ও ১৯শে জুন মুনাযারা অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম দিন মৌলভী আহমাদ আহসান স্টেজে আসেন। কিন্তু দ্বিতীয় বার আর আসার হিম্মত হয়নি। বাকী দিনগুলিতে মৌলভী কাসেম আলী তার প্রতিনিধিত্ব করেন। নওয়াব ছাহেবের অসুস্থতার কারণে ১৭ তারিখ এবং কাদিয়ানী নেতা বিনা অনুমতিতে মুরাদাবাদ চলে যাওয়ার কারণে ১৮ তারিখ এই দু’দিন মুনাযারা হয়নি। ১৫ ও ১৬ই জুন ‘মাসীহ-এর জীবন ও মৃত্যু’ বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা হওয়ার কারণে ১৯শে জুন নওয়াব ছাহেব ‘মির্যার সত্যবাদিতা ও মিথ্যাবাদিতা’ বিষয়ে বাহাছ করাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কাদিয়ানীরা কোনভাবেই এতে রাযী হননি। ২০শে জুন তারা মুনাযারা ময়দানে হাযির না হয়ে নওয়াবের অনুমতি ছাড়াই রামপুর থেকে পলায়ন করেন।
নওয়াব ছাহেব নিজে শী‘আ হলেও মাওলানা অমৃতসরীর জোরালো আলোচনা, দ্রুত উত্তর প্রদান, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, ইস্তিদলালী পদ্ধতি ও গাম্ভীর্য দ্বারা এতটাই প্রভাবিত হন যে, তিনি তাঁকে সম্মান প্রদর্শন ও অভিনন্দন জানাতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেননি। মুনাযারা চলাকালে নওয়াব ছাহেব মন্ত্রমুগ্ধের মতো অমৃতসরীর বক্তব্য শুনছিলেন এবং মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে পিঠ চাপড়ে তাঁকে সাবাশ দিচ্ছিলেন।
২২শে জুন ভারতের বড় বড় আলেম-ওলামা মুনাযারার রায় লিখেন এবং সর্বসম্মতিক্রমে অমৃতসরীকে বিজয়ী ঘোষণা করেন।২৭ রামপুরের নওয়াব এ উপলক্ষ্যে তাঁকে একটি সার্টিফিকেট প্রদান করেছিলেন। তাতে লেখা ছিল, ‘রামপুরে
কাদিয়ানীদের সাথে মুনাযারার সময় মৌলভী আবুল অফা মুহাম্মাদ ছানাউল্লাহ ছাহেবের আলোচনা আমি শুনেছি। মৌলভী ছাহেব অত্যন্ত বিশুদ্ধভাষী। তাঁর বড় বৈশিষ্ট্য এই যে, তিনি উপস্থিত আলোচনা করেন। তিনি তাঁর আলোচনায় যে বিষয়ের অবতারণা করেছেন সেটি দলীলসহ প্রমাণ করেছেন| আমি তাঁর আলোচনায় প্রীত ও আনন্দিত হয়েছি’।২৮
[চলবে]
ড. নূরুল ইসলাম
ভাইস প্রিন্সিপাল, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।
[1]. মাওলানা ছফিউর রহমান মুবারকপুরী, কাদিয়ানিয়াত আপনে আয়না মেঁ (বেনারস : জামে‘আ সালাফিইয়াহ, মার্চ ১৯৮১), পৃঃ ২৪৪-২৬০; আব্দুল মুবীন নাদভী, আশ-শায়খ আল-আল্লামা আবুল অফা ছানাউল্লাহ আল-আমরিতসারী, পৃঃ ২২০।
[2]. ফিৎনায়ে কাদিয়ানিয়াত আওর মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী, পৃঃ ৬৮-৭০।
[3]. ঐ, পৃঃ ৭০।
[4]. ফিৎনায়ে কাদিয়ানিয়াত, পৃঃ ৭০-৭১; আব্দুল মুবীন নাদভী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২২৪।
[5]. তারীখে মির্যা, পৃঃ ৩৪; ইহতিসাবে কাদিয়ানিয়াত (মুলতান : আলমী মজলিসে তাহাফ্ফুযে খতমে নবুঅত, ১৪২৩ হিঃ/২০০২ খ্রিঃ), ৮/৫২৬।
[6]. ফিৎনায়ে কাদিয়ানিয়াত, পৃঃ ৭১-৭২।
[7]. ইহতিসাবে কাদিয়ানিয়াত ৮/১১।
[8]. ফিৎনায়ে কাদিয়ানিয়াত, পৃঃ ৭৩-৭৫।
[9]. ফিৎনায়ে কাদিয়ানিয়াত পৃঃ ৭৫-৭৬; আব্দুল মুবীন নাদভী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৩০-৩১।
[10]. ইহতিসাবে কাদিয়ানিয়াত ৮/১৮।
[11]. ফিৎনায়ে কাদিয়ানিয়াত, পৃঃ ৭৬-৭৯; আব্দুল মুবীন নাদভী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৩১-২৩৪।
[12]. ই‘জাযে আহমাদী, পৃঃ ১১; সীরাতে ছানাঈ, পৃঃ ৩৯৫।
[13]. তারীখে মির্যা, পৃঃ ৪৩; ইহতিসাবে কাদিয়ানিয়াত ৮/৫৩৫; ফিৎনায়ে কাদিয়ানিয়াত, পৃঃ ৭৯-৮২।
[14]. মাওলানা মুহাম্মাদ ইসহাক ভাট্টী, বার্রে ছাগীর মেঁ আহলেহাদীছ কী আওয়ালিয়াত (গুজরানওয়ালা : দারু আবিত তাইয়িব, ১ম প্রকাশ, সেপ্টেম্বর ২০১২), পৃঃ ১০৫-১০৬; ঐ বঙ্গানুবাদ : ভারতীয় উপমহাদেশের আহলেহাদীছগণের অগ্রণী ভূমিকা, পৃঃ ৮৮।
[15]. ফিৎনায়ে কাদিয়ানিয়াত, পৃঃ ৯১।
[16]. সূরা ইউনুস ৫৩।
[17]. সূরা বনী ইসরাঈল ৩৬।
[18]. সূরা আ‘রাফ ৭/৮৯।
[19]. মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী, ফায়ছালায়ে মির্যা, রাসাইলে ছানাইয়াহ (লাহোর : মাকতাবা মুহাম্মাদিয়াহ, ২য় সংস্করণ, ফেব্রুয়ারী ২০১১), পৃঃ ৪৭০-৪৭২; ইহতিসাবে কাদিয়ানিয়াত ৮/২০০-২০২।
[20]. নুযহাতুল খাওয়াতির ৮/১৩১৯; ফিৎনায়ে কাদিয়ানিয়াত, পৃঃ ৯৫-৯৭; আব্দুল মুবীন নাদভী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৫১-২৫৪; ইহসান ইলাহী যহীর, আল-কাদিয়ানিইয়াহ দিরাসাতুন ওয়া তাহলীল (রিয়াদ : কেন্দ্রীয় দারুল ইফতা, ১৪০৪ হিঃ/১৯৮৪ খ্রি.), পৃঃ ১৫৭-১৫৯; মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, ‘খতমে নবুওয়াত’, মাসিক আত-তাহরীক, অক্টোবর’৯৯, পৃঃ ১২।
[21]. কাদিয়ানিয়াত আপনে আয়েনা মেঁ, পৃঃ ৩৯-৫২।
[22]. আল-মানার, মিসর, ডিসেম্বর ১৯৩৩, পৃঃ ৬৩৯।
[23]. নুযহাতুল খাওয়াতির ৮/১২০৫।
[24]. সাইয়িদ সুলাইমান নাদভী, ইয়াদে রফতেগাঁ (করাচী : মজলিসে নাশরিয়াতে ইসলাম, ২০০৩), পৃঃ ৩৭০।
[25]. আল-কাদিয়ানিইয়াহ দিরাসাতুন ওয়া তাহলীল, পৃঃ ১৫৭।
[26]. ফিৎনায়ে কাদিয়ানিয়াত, পৃঃ ১০৫।
২৭. ফিৎনায়ে কাদিয়ানিয়াত, পৃঃ ১০৫-১০৭; সীরাতে ছানাই, পৃঃ ৩৯৭-৩৯৮। গৃহীত : সাপ্তাহিক আহলেহাদীছ, অমৃতসর, ২রা জুলাই ১৯০৯।
২৮. নূরে তাওহীদ, পৃঃ ৪৫।