একে
অন্যের প্রতি ভালবাসা একটি স্বভাবজাত বিষয়। মানুষ নিজের প্রয়োজনে,
ভবিষ্যতে কারো সাহায্য পাওয়ার জন্য, অতীতে কারো কাছ থেকে সাহায্য পাওয়ার
কারণে একে অপরকে ভালবেসে থাকে। কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দুনিয়ার কোন
স্বার্থ ব্যতীত কোন মুসলিমের অন্য মুসলিম ভাইকে ভালবাসা একটি বড় ইবাদত।
আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য অন্য মুমিনকে ভালবাসা ও একসাথে কাজ করা ঈমানের
দাবী (তাওবা/৭১)। রাসূল (ছাঃ) মুমিনদের উদাহরণ দিয়েছেন একটি দেহের
ন্যায়, একজন ব্যক্তির ন্যায় অথবা একটি দালানের ন্যায়। যার এক অংশ অন্য
অংশকে শক্তিশালী করে। আবার কোন কারণে শরীরের কোন অঙ্গ অসুস্থ হ’লে পুরো
শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে।[1] কিন্তু আজকে মুসলমানদের মধ্য থেকে এ গুণটি প্রায়ই
উঠে গেছে। বিভিন্ন ঠুনকো অযুহাতে, ব্যক্তি স্বার্থের কারণে অথবা ফিক্বহী
মাসআলার কারণে বা দলীয় ভিন্নতার কারণে মুমিনদের মধ্যে ভালবাসার অভাব দেখা
যাচ্ছে। শুধু তাই নয় সামান্য কারণে তারা সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং পরস্পরে
শত্রুতে পরিণত হয়। অনেক সময় মুসলিম ভাইয়ের পরিবর্তে বরং কোন অমুসিল বা শিরক
ও বিদ‘আতী আক্বীদা সম্পন্ন লোককে সাহায্য করে। এ অবস্থা থেকে বাঁচার
অন্যতম পথ হ’ল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোন মুসলিম ভাইকে ভালবাসা অথবা ঘৃণা
করা। আলোচ্য প্রবন্ধে আল্লাহর জন্য ভালবাসা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা পেশ
করা হ’ল।-
আল্লাহর জন্য ভালবাসার অর্থ :
الحب শব্দটি শব্দটি একবচন, বহুবচন হ’ল- أحباب। যার অর্থ ভালবাসা, বন্ধুত্ব, পসন্দ, আসক্তি, ঝোঁক ইত্যাদি। যেমন আল্লাহ বলেন, إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُحْسِنِيْنَ ‘নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদেরকে ভালবাসেন (বাক্বারাহ ২/১৯৫)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, وَاللهُ لاَ يُحِبُّ الْفَسَادَ ‘আল্লাহ অশান্তি পসন্দ করেন না’ (বাক্বারাহ ২/২০৫)। হাদীছেও শব্দটির ব্যবহার পাওয়া যায়। যেমন-
ومَنْ يَجْتَرِئُ عَلَيْهِ إلاَّ أُسَامَةُ بنُ زَيْدٍ، حِبُّ رَسُوْلِ اللهِ صَلّى اللهُ عليه وسلَّمَ ‘একমাত্র রাসূল (ছাঃ)-এর প্রিয়তম উসামা বিন যায়েদ (রাঃ) এ ব্যাপারে আলোচনা করার সাহস করতে পারেন’।[2] ইসলামী শরী‘আতের পরিভাষায় এর দ্বারাالحب في الله ‘আল্লাহর জন্য কাউকে ভালবাসা’ বুঝায়। অর্থাৎ দুনিয়ার কোন স্বার্থ ব্যতীত একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাউকে ভালবাসা।
আল্লাহর জন্য কে কাকে ভালবাসবে :
মহান আল্লাহ মানুষকে পৃথিবীতে পাঠানোর পূর্বে রূহের জগতে সকলের নিকট থেকে একত্বের সাক্ষ্য নিয়েছিলেন (আ‘রাফ ৭/১৭২)। কিন্তু তারা তাদের দ্বীনকে বহু ভাগে বিভক্ত করে ফেলে। আর প্রত্যেক দলই তাদের কাছে যা আছে, তাই নিয়ে সন্তুষ্ট (মু‘মিনূন ২৩/৫৩)। আল্লাহর এ ইচ্ছা অনুযায়ী যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনে সৎ কাজ করে সে সকল মুমিন বা মুসলিমগণ পরস্পর ভাই ভাই।[3]
আর তারা একে অপরকে ভালবাসবে। যে মুসলিমের মত ছালাত আদায় করবে, ক্বিবলাকে
ক্বিবলা মানবে এবং যবহকৃত পশু ভক্ষণ করবে তাকেই মুসলিম ব্যক্তি ভালবাসবে।[4] এই
ভালবাসা ভিন্ন কোন দেশের কারণে, মাযহাবের কারণে, পথ ও মতের কারণে বিনষ্ট
করা যাবে না। শায়খুল ইসলাম ইবনে তায়মিয়াহ (রহঃ) (৬৬১-৭২৮ হিঃ) বলেন, ‘বংশ,
এলাকা, বিভিন্ন মাযহাব, তরীক্বা, পথ, সম্পর্ক ইত্যাদির কারণে মুমিনদের
মধ্যে পার্থক্য করা চলবে না। বরং আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ) নির্দেশিত
নিয়মানুযায়ী প্রত্যেককে তার হক্ব প্রদান করতে হবে। মুসলিমগণ অবস্থানগত
ভিন্নতা ও ভাষাগত ভিন্নতা থাকলেও তাদের সম্পর্ক হবে একটি দেহের মত। রাসূল
(ছাঃ) বলেছেন,تَرَى المُؤْمِنِيْنَ فِيْ تَرَاحُمِهِمْ وَتَوَادِّهِمْ
وَتَعَاطُفِهِمْ كَمَثَلِ الجَسَدِ إِذَا اشْتَكَى عُضْوًا تَدَاعَى لَهُ
سَائِرُ جَسَدِهِ بِالسَّهَرِ وَالحُمَّى، ‘মুমিনদের দৃষ্টান্ত তাদের
পারস্পরিক সম্প্রীতি, দয়ার্দ্রতা ও সহমর্মিতার দিক দিয়ে একটি দেহের মত। যখন
তার কোন একটি অঙ্গ অসুস্থ হয়, তখন তার সমগ্র দেহে তাপ ও অনিদ্রা ডেকে
আনে’।[5]
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,لَا تَجِدُ
قَوْمًا يُؤْمِنُونَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ يُوَادُّونَ مَنْ حَادَّ
اللهَ وَرَسُولَهُ وَلَوْ كَانُوا آبَاءَهُمْ أَوْ أَبْنَاءَهُمْ أَوْ
إِخْوَانَهُمْ أَوْ عَشِيرَتَهُمْ، ‘আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসী এমন কোন
সম্প্রদায়কে তুমি পাবে না, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণকারীদের
সাথে বন্ধুত্ব করে। যদিও তারা তাদের বাপ-দাদা, সন্তান-সন্ততি, ভাই-বেরাদর
বা আত্মীয়-স্বজন হৌক’ (মুজাদালাহ ৫৮/২২)। এজন্য যাকে তাকে ভালবাসা
যাবে না। বরং প্রত্যেকের দ্বীনের অবস্থা দেখে তাকে ভালবাসতে হবে। রাসূল
(ছাঃ) বলেন,الرَّجُلُ عَلَى دِيْنِ خَلِيلِهِ فَلْيَنْظُرْ أَحَدُكُمْ مَنْ
يُخَالِلُ ‘মানুষ তার বন্ধুর রীতি-নীতির অনুসারী হয়। কাজেই তোমাদের
প্রত্যেকেই যেন লক্ষ্য করে যে, সে কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে’।[6] রাসূল
(ছাঃ) আরো বলেছেন,لاَ تُصَاحِبْ إِلاَّ مُؤْمِنًا وَلاَ يَأْكُلْ طَعَامَكَ
إِلاَّ تَقِيٌّ ‘তুমি মুমিন ব্যতীত অন্য কারো সঙ্গী হবে না এবং তোমার
খাদ্য যেন কেবল পরহেযগার লোকে খায়’।[7]
কোন অজুহাতেই মুসলিমগণের পরস্পরের ভালবাসা নষ্ট করা যাবে না। ঈমানদারগণের মধ্যে কখনই শত্রুতা বা ঘৃণা সৃষ্টি করা যাবে না। আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক প্রকৃত ঈমানদারকে তার ঈমানের কারণে জাহান্নাম থেকে এক সময় মুক্তি দান করবেন।[8] সুতরাং সকল মুসলমান ইসলামের বন্ধনে আবদ্ধ থাকা অবস্থায় তাদের মধ্যে ভালবাসা থাকতে হবে। ইমাম ইবনে তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, ‘মুমিনের জানা দরকার যে, মুমিনকে ভালোবাসা ওয়াজিব, যদিও সে তোমার প্রতি যুলুম-অবিচার করে। পক্ষান্তরে কাফেরের সাথে সম্পর্কহীনতা বজায় রেখে চলা ওয়াজিব যদিও সে তোমাকে কিছু দেয় ও তোমার প্রতি দয়া করে’।[9]
ঈমানের কারণে যেমন মুমিনকে
ভালবাসবে অপরদিকে তার মধ্যে কোন অপরাধ থাকলে অপরাধের জন্য অপরাধ অনুযায়ী
তাকে ঘৃণা করবে। ইমাম ইবনে তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, ‘যদি কোন ব্যক্তির মধ্যে
ভাল-মন্দ, পাপ-পুণ্য ও সুন্নাত-বিদ‘আত একত্রিত হয়, তবে সে ততটুকু ভালবাসা
প্রাপ্তির যোগ্য হবে, যতটুকু ভাল তার মধ্যে রয়েছে। পক্ষান্তরে সে ততটুকু
ঘৃণা ও শাস্তি প্রাপ্তির যোগ্য হবে, যতটুকু মন্দ তার মধ্যে রয়েছে। অতএব একই
ব্যক্তির মধ্যে সম্মান ও অপমান উভয়ের কারণ সমবেত হ’তে পারে। যেমন চুরি
করার অপরাধে গরীব চোরের হাত কাটতে হবে, তবে তার চাহিদা মিটানোর জন্য বায়তুল
মাল থেকে তাকে দিতে হবে। এটি এমন একটি মূলনীতি, যে বিষয়ে আহলুস-সুন্নাহ
ওয়াল জামা‘আত একমত পোষণ করলেও খারেজী-মু‘তাযিলী ও এদের পক্ষাবলম্বনকারীদের
বিরোধিতা রয়েছে’।[10]
আল্লাহর জন্য কাউকে ভালবাসার ফযীলত :
মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই (হুজুরাত ৪৯/১০)। তারা একে অপরকে আল্লাহর জন্য ভালবাসবে এটা ঈমানের অন্যতম দাবী। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য মুসলমানদের পারস্পরিক ভালবাসার অনেক ফযীলত রয়েছে। এ বিষয়ে নিম্নে আলোচনা পেশ করা হ’ল।-
(১) ঈমানের স্বাদ পাওয়া যায় : আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেন, ‘যার মধ্যে তিনটি গুণ বিদ্যমান, সে ঈমানের স্বাদ পাবে- (ক) যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে সর্বাধিক ভালোবাসে, (খ) যে একমাত্র আল্লাহরই জন্য কাউকে ভালোবাসে এবং (গ) আল্লাহ যাকে কুফরী থেকে মুক্তি দিয়েছেন, সে কুফরীতে ফিরে যাওয়াকে ঐরূপ অপসন্দ করে, যেরূপ অপসন্দ করে আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ হওয়াকে’।[11] অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ سَرَّه أنْ يَّجِدَ طَعْمَ الإيْمانِ فليُحِبَّ الْمَرْءَ لاَ يُحِبُّهُ إلَّا للهِ عزَّ وجلَّ ‘যে ব্যক্তি ঈমানের স্বাদ পেতে পসন্দ করে, সে ব্যক্তি কেবল সুমহান আল্লাহর উদ্দেশ্যেই অপরকে ভালবাসুক’।[12]
(২) শিরক থেকে রক্ষা : মুশরিকরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যকে আল্লাহর মত ভালবাসে। ফলে তারা আল্লাহর জন্য ভালবাসার নে‘মত থেকে দূরে থাকে। অপরদিকে মুমিনগণ আল্লাহর জন্য একে অপরকে বেশী ভালবাসে। আল্লাহ বলেন, وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَتَّخِذُ مِنْ دُوْنِ اللهِ أَنْدَادًا يُحِبُّوْنَهُمْ كَحُبِّ اللهِ وَالَّذِيْنَ آمَنُوْا أَشَدُّ حُبًّا لِلَّهِ وَلَوْ يَرَى الَّذِيْنَ ظَلَمُوْا إِذْ يَرَوْنَ الْعَذَابَ أَنَّ الْقُوَّةَ لِلَّهِ جَمِيْعًا وَأَنَّ اللهَ شَدِيْدُ الْعَذَابِ- ‘আর মানুষের মধ্যে কিছু লোক এমন রয়েছে, যারা অন্যকে আল্লাহর সমকক্ষ সাব্যস্ত করে। তারা তাদেরকে ভালোবাসে আল্লাহকে ভালোবাসার ন্যায়। কিন্তু যারা ঈমানদার তারা আল্লাহর জন্য সর্বাধিক ভালোবাসা পোষণ করে থাকে। আর যালেমরা (মুশরিকরা) যদি জানত যখন তারা আযাবকে প্রত্যক্ষ করবে যে সমস্ত ক্ষমতা আল্লাহর জন্য এবং আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা (তাহ’লে তারা শিরকের অনিষ্টকারিতা ব্যাখ্যা করে দিত)’ (বাক্বারাহ ২/১৬৫)।
(৩) আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ : কোন মুসলমানকে ভালবাসার কারণে তার সাথে দেখা-সাক্ষাতের ফলে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায়। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেন,أنَّ رَجُلاً زَارَ أَخَاً لَهُ في قَريَة أُخْرَى، فَأرْصَدَ الله تَعَالَى عَلَى مَدْرَجَتِهِ مَلَكاً، وَذَكَرَ الحدِيثَ إلى قَولِهِ: إِنَّ اللهَ قَدْ أَحَبَّكَ كَمَا أحْبَبْتَهُ فِيْهِ- ‘এক ব্যক্তি তার কোন (মুসলমান) ভাইয়ের সাথে সাক্ষাতের জন্য অন্য গ্রামে রওয়ানা হয়, পথে আল্লাহ তার জন্য একজন ফেরেশতা বসিয়ে দেন। অতঃপর তিনি একথা পর্যন্ত হাদীছ বর্ণনা করেন যে, (ফেরেশতা তাকে বলেন) নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাকে এরূপ ভালোবাসেন, যেরূপ তুমি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে অমুক ব্যক্তিকে ভালোবাস’।[13]
(৪) আল্লাহর সাহায্য লাভ : আল্লাহর জন্য কোন মুমিনকে ভালোবেসে তার কোন সাহায্যে এগিয়ে আসলে আল্লাহ তার জন্য অনুরূপ সাহায্য নিয়ে হাযির হন। রাসূল (ছাঃ) বলেন,
مَنْ نَفَّسَ عَنْ مُؤْمِنٍ كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ الدُّنْيَا نَفَّسَ اللهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَمَنْ يَسَّرَ عَلى مُعْسِرٍ يَسَّرَ اللهُ عَلَيْهِ فِي الدُّنْيَا وَالْاۤخِرَةِ وَمَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ اللهُ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَاللهُ فِي عَوْنِ الْعَبْدِ مَا كَانَ الْعَبْدُ فِي عَوْنِ أَخِيهِ
‘যে
ব্যক্তি কোন মুমিনের দুনিয়াবী বিপদসমূহের কোন বিপদ দূর করে দিবে, আল্লাহ
ক্বিয়ামতের দিন তার (কঠিন) বিপদসমূহের কোন একটি বিপদ দূর করে দিবেন। যে
ব্যক্তি কোন অভাবগ্রস্ত লোকের অভাব সহজ করে দিবে, আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে
তার অভাব সহজ করে দিবেন। আর যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের দোষ-ত্রুটি গোপন করে,
আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন। আল্লাহ তাঁর
বান্দাদেরকে ততক্ষণ পর্যন্ত সহযোগিতা করেন যতক্ষণ সে তার অপর ভাইয়ের
সাহায্যে রত থাকে’।[14]
(৫) আল্লাহর ভালবাসা লাভ :
কোন মুমিনকে ঈমানের কারণে ভালোবাসলে আল্লাহ তাকে ভালোবাসবেন। বারা বিন
আযিব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) আনছারদের সম্পর্কে বলেছেন,لاَ
يُحِبُّهُمْ إلاَّ مُؤمِنٌ، وَلاَ يُبْغِضُهُمْ إلاَّ مُنَافِقٌ، مَنْ
أحَبَّهُمْ أَحَبَّهُ الله، وَمَنْ أبْغَضَهُمْ أبْغَضَهُ الله، ‘তাদেরকে
কেবল মুমিনই ভালোবাসে এবং তাদের প্রতি কেবল মুনাফিকরাই বিদ্বেষ রাখে। যে
ব্যক্তি তাদেরকে ভালোবাসে, আল্লাহ তাকে ভালোবাসেন। আর যে ব্যক্তি তাদের
প্রতি বিদ্বেষ রাখবে, আল্লাহ তার প্রতি বিদ্বেষ রাখবেন’।[15] আবু ইদ্রীস
খাওলানী (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি,
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَجَبَتْ مَحَبَّتي لِلْمُتَحَابِّينَ فِيَّ،
وَالمُتَجَالِسينَ فِيَّ، وَالمُتَزَاوِرِينَ فِيَّ، وَالمُتَبَاذِلِينَ
فِيَّ ‘আমার সন্তুষ্টি লাভের জন্য যারা পরস্পরের মধ্যে মহববত রাখে, একে
অপরের সঙ্গে বসে, একে অপরের সাথে সাক্ষাৎ এবং একে অপরের জন্য খরচ করে,
তাদের জন্য আমার মহববত ও ভালোবাসা ওয়াজিব হয়ে যায়’।[16] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)
আরো বলেন,مَا تَحَابَّ رَجُلَانِ فِي اللهِ إِلَّا كَانَ أَحَبُّهُمَا
إِلَى اللهِ عَزَّ وَجَلَّ أَشَدَّهُمَا حُبًّا لِصَاحِبِهِ، ‘দুই ব্যক্তি
পরস্পরকে ভালোবাসলে, তাদের মধ্যে যে অপরজনকে অধিক ভালোবাসবে সে আল্লাহর
নিকটে অপরজন থেকে অধিক ভালোবাসার পাত্র হবে’।[17]
(৬) একে অপররে ভালবাসা আল্লাহর বড় নে‘মত : এই ভালোবাসা আল্লাহর পক্ষ থেকে বড় নে‘মত। আল্লাহ বলেন,
وَاذْكُرُوْا نِعْمَتَ اللهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنْتُمْ أَعْدَاءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوْبِكُمْ فَأَصْبَحْتُمْ بِنِعْمَتِهِ إِخْوَانًا وَكُنْتُمْ عَلَى شَفَا حُفْرَةٍ مِنَ النَّارِ فَأَنْقَذَكُمْ مِنْهَا كَذَلِكَ يُبَيِّنُ اللهُ لَكُمْ آيَاتِهِ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُوْنَ-
‘আর তোমরা তোমাদের উপর আল্লাহর সেই নে‘মতের কথা স্মরণ কর, যখন তোমরা পরস্পরে শত্রু ছিলে। অতঃপর আল্লাহ তোমাদের অন্তর সমূহে মহববত পয়দা করে দিলেন। অতঃপর তোমরা তার অনুগ্রহে পরস্পরে ভাই ভাই হয়ে গেলে’ (আলে ইমরান ৩/১০৩)। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوْبِهِمْ لَوْ أَنْفَقْتَ مَا فِي الْأَرْضِ جَمِيْعًا مَا أَلَّفْتَ بَيْنَ قُلُوْبِهِمْ وَلَكِنَّ اللهَ أَلَّفَ بَيْنَهُمْ إِنَّهُ عَزِيْزٌ حَكِيْمٌ، ‘তিনি তাদের অন্তর সমূহে পরস্পরে ভালোবাসা সৃষ্টি করেছেন। যদি তুমি পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ ব্যয় করতে, তবুও তাদের অন্তর সমূহে ভালোবাসা সৃষ্টি করতে পারতে না। কিন্তু আল্লাহ তাদের মধ্যে পরস্পরে মহববত পয়দা করে দিয়েছেন। নিশ্চয়ই তিনি পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়’ (আনফাল ৮/৬৩)।
রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,الأَرْوَاحُ جُنُوْدٌ مُجَنَّدَةٌ، فَمَا تَعَارَفَ مِنْهَا ائْتَلَفَ، وَمَا تَنَاكَرَ مِنْهَا اخْتَلَفَ ‘সমস্ত রূহ সেনাবাহিনীর মত একত্রিত ছিল। সেখানে তাদের যে সমস্ত রূহের পরস্পর পরিচয় ছিল, এখানেও তাদের মধ্যে পরস্পর মতভেদ ও বিরোধ থাকবে’।[18]
(৭) ঈমানের পূর্ণতা লাভ : আবূ ইমামাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ أَحَبَّ لِلّهِ وَأَبْغَضَ لِلّهِ وَأَعْطى لِلّهِ وَمَنَعَ لِلّهِ فَقَدِ اسْتَكْمَلَ الْإِيْمَان ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য কাউকে ভালবাসে, আর আল্লাহর জন্য কারও সাথে বিদ্বেষ পোষণ করে এবং আল্লাহর জন্যই দান-খয়রাত করে আবার আল্লাহর জন্যই দান-খয়রাত থেকে বিরত থাকে সে যেন ঈমান পূর্ণ করল’।[19]
(৮) আল্লাহর জন্য একে অপরকে ভালোবাসা ছাহাবীদের বৈশিষ্ট্য : ছাহাবীদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে আল্লাহ বলেন,مُحَمَّدٌ رَسُوْلُ اللهِ وَالَّذِيْنَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ، ‘মুহাম্মাদ আল্লাহরত্মাসূল এবং যরা তার সাথী তারা কাফেরদের ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর। কিন্তু নিজেদের মধ্যে পরস্পরে রহমদিল’ (ফাতাহ ৪৮/২৯)। আনছার ছাহাবীদের প্রশংসা করে আল্লাহ বলেন,وَالَّذِيْنَ تَبَوَّءُوا الدَّارَ وَالْإِيْمَانَ مِنْ قَبْلِهِمْ يُحِبُّوْنَ مَنْ هَاجَرَ إِلَيْهِمْ وَلَا يَجِدُوْنَ فِيْ صُدُوْرِهِمْ حَاجَةً مِمَّا أُوتُوْا وَيُؤْثِرُوْنَ عَلَى أَنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ وَمَنْ يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ- ‘আর যারা মুহাজিরদের আগমনের পূর্বে এ নগরীতে বসবাস করত এবং ঈমান এনেছিল। যারা মুহাজিরদের ভালবাসে এবং তাদেরকে (ফাই থেকে) যা দেওয়া হয়েছে, তাতে তারা নিজেদের মনে কোনরূপ আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে না। আর তারা নিজেদের উপর তাদেরকে অগ্রাধিকার দেয়, যদিও তাদেরই রয়েছে অভাব। বস্ত্ততঃ যারা নিজেদেরকে হৃদয়ের কার্পণ্য হ’তে বাঁচাতে পেরেছে, তারাই হ’ল সফলকাম’ (হাশর ৫৯/৯)।
(৯) আল্লাহর পক্ষ থেকে সম্মান লাভ :
আল্লাহর জন্য অন্য ভাইকে ভালোবাসলে আল্লাহ তাকে সম্মানিত করেন। রাসূল
(ছাঃ) বলেন, ما أحَبَّ عَبْدٌ عبْدًا للهِ، إلَّا أكْرَمَ رَبَّهُ ‘কোন
বান্দা অন্যকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালোবাসলে, তার রব তাকে সম্মানিত করেন’।[20]
(১০) ক্বিয়ামতের দিন আরশের নীচে স্থান লাভ : আল্লাহ বলেন, ‘সেদিন মানুষ পালাবে তার ভাই থেকে, তার মা ও বাপ থেকে এবং তার স্ত্রী ও সন্তান থেকে। প্রত্যেক মানুষের সেদিন এমন অবস্থা হবে যে, সে নিজেকে নিয়েই বিভোর থাকবে’ (আবাসা /৩৪-৩৭)। যেদিন মানুষ নগ্ন দেহে দাঁড়াবে এবং নিজের ঘামের মধ্যে হাবুডুবু খাবে। সেদিন যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একে অপরকে ভালোবেসেছিল তারা আল্লাহর আরশের ছায়ার নীচে থাকবে। রাসুল (ছাঃ) বলেন, إنَّ الله تَعَالَى يَقُوْلُ يَوْمَ القِيَامَةِ : أيْنَ المُتَحَابُّوْنَ بِجَلاَلِيْ؟ اليَوْمَ أُظِلُّهُمْ فِيْ ظِلِّيْ يَوْمَ لاَ ظِلَّ إلاَّ ظِلِّيْ- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামতের দিন বলবেন, আমার মহিমা ও শ্রেষ্ঠত্বের জন্য পরস্পরকে যারা ভালোবেসেছিল তারা কোথায়? আজ আমি তাদেরকে ছায়া দিব আমার ছায়াতলে, যে দিন কোন ছায়া নেই আমার ছায়া ব্যতীত’।[21]
আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত অন্য হাদীছে আছে,
আল্লাহ সাত শ্রেণীর লোককে তাঁর সুশীতল ছায়াতলে স্থান দিবেন, যেদিন তাঁর
ছায়া ব্যতীত আর কোন ছায়া থাকবে না। তাদের একশ্রেণী হ’ল ঐ দুই লোক যারা
একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই একে অপরকে ভালবাসে এবং আল্লাহর
সন্তুষ্টির জন্যই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়’।[22]
(১১) আখিরাতে উচ্চ মর্যাদা লাভ : রাসূল (ছাঃ) বলেন, মহা সম্মানিত পরাক্রমশালী আল্লাহ বলেন,المُتَحَابُّوْنَ فِيْ جَلاَلِي، لَهُمْ مَنَابِرُ مِنْ نُوْرٍ يَغْبِطُهُمُ النَّبِيُّوْنَ وَالشُّهَدَاءُ ‘আমার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যারা পরস্পরকে ভালোবাসে, তাদের জন্য (পরকালে) থাকবে নূরের মিম্বর, যা দেখে নবী ও শহীদগণ তাদের ঈর্ষা করবেন’।[23] রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,
إنَّ مِن عِبادِ اللهِ لَأُناسًا ما هم بأنبياءَ، ولا شُهداءَ، يَغبِطُهمُ الأنبياءُ والشُّهداءُ يَومَ القيامةِ لِمَكانِهم مِنَ اللهِ. قالوا: يا رَسولَ اللهِ تُخبِرُنا مَن هم. قال: هم قَومٌ تَحابُّوا برُوحِ اللهِ على غَيرِ أرحامٍ بَينَهم، ولا أموالٍ يَتعاطَوْنها، فواللهِ إنَّ وُجوهَهم لَنورٌ، وإنَّهم لَعَلى نُورٍ: لا يَخافونَ إذا خافَ الناسُ، ولا يَحزَنونَ إذا حَزِنَ الناسُ. وقَرَأ هذه الآيةَ أَلَا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ-
‘নিশ্চয়ই আল্লাহর বান্দাদের মাঝে এমন কিছু লোক আছে
যারা নবী নন এবং শহীদও নন। ক্বিয়ামতের দিন মহান আল্লাহর দরবারে তাদের
মর্যাদার কারণে নবীগণ ও শহীদগণ তাদের প্রতি ঈর্ষান্বিত হবেন। ছাহাবীগণ
বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমাদের অবহিত করুন, তারা কারা? তিনি বললেন,
তারা ঐসব লোক যারা আল্লাহর মহানুভবতায় পরস্পরকে ভালোবাসে, অথচ তারা পরস্পর
আত্মীয়ও নয় এবং পরস্পরকে সম্পদও দেয়নি। আল্লাহর শপথ! তাদের মুখমন্ডল যেন
নূর এবং তারা নূরের আসনে উপবেশন করবে। তারা ভীত হবে না, যখন মানুষ ভীত
থাকবে। তারা দুশ্চিন্তায় পড়বে না, যখন মানুষ দুশ্চিন্তায় থাকবে। তখন তিনি এ
আয়াত তেলাওয়াত করলেন, ‘জেনে রাখো! আল্লাহর বন্ধুদের কোন ভয় নেই এবং তারা
দুশ্চিন্তাগ্রস্তও হবে না’ (ইউনুস ১০/৬২)।[24]
(১২) ক্বিয়ামতের দিন ব্যক্তি ভালবাসার মানুষের সাথে থাকবে :
ক্বিয়ামতের কঠিন দিন আল্লাহর জন্য যারা একে অপরকে ভালোবেসেছে তারা পরস্পর
এক সাথে শান্তিতে অবস্থান করবে। আল্লাহ বলেন,وَمَنْ يُطِعِ اللهَ
وَالرَّسُولَ فَأُولَئِكَ مَعَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللهُ عَلَيْهِمْ مِنَ
النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِينَ وَحَسُنَ
أُولَئِكَ رَفِيقًا ‘বস্ত্ততঃ যে কেউ আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করে, তারা
নবী, ছিদ্দীক, শহীদ ও সৎকর্মশীল ব্যক্তিদের সাথী হবে, যাদের প্রতি আল্লাহ
অনুগ্রহ করেছেন। আর এরাই হ’লেন সর্বোত্তম সাথী’ (নিসা ৪/৬৯)।[25]
আনাস
(রাঃ) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি নবী করীম (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করল, ক্বিয়ামত
কখন হবে? তিনি বললেন, তুমি ক্বিয়ামতের জন্য কি জোগাড় করেছ? সে বলল, কোন
কিছু জোগাড় করতে পারিনি, তবে আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসি। তখন তিনি
বললেন,أَنْتَ مَعَ مَنْ أَحْبَبْتَ قَالَ أَنَسٌ فَمَا فَرِحْنَا بِشَيْءٍ
فَرَحَنَا بِقَوْلِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم أَنْتَ مَعَ مَنْ
أَحْبَبْتَ قَالَ أَنَسٌ فَأَنَا أُحِبُّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم
وَأَبَا بَكْرٍ وَعُمَرَ وَأَرْجُوْ أَنْ أَكُوْنَ مَعَهُمْ بِحُبِّيْ
إِيَّاهُمْ وَإِنْ لَمْ أَعْمَلْ بِمِثْلِ أَعْمَالِهِمْ ‘তুমি তাদের
সঙ্গেই থাকবে যাঁদেরকে তুমি ভালোবাস। আনাস (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ)-এর
কথার দ্বারা আমরা এত আনন্দিত হয়েছি যে অন্য কোন কথায় এত আনন্দিত হইনি। আনাস
(রাঃ) বলেন, আমি নবী করীম (ছাঃ)-কে ভালোবাসি এবং আবূ বকর, ওমর (রাঃ)-কেও।
আশা করি তাঁদেরকে আমার ভালোবাসার কারণে তাদের সঙ্গে জান্নাতে বসবাস করতে
পারব, যদিও তাঁদের আমলের মত আমল আমি করতে পরিনি’।[26]
আনাস
ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর
ছাহাবীদেরকে একটি ব্যাপারে এতটা আনন্দিত দেখতে পেলাম যে, অন্য কোন
ব্যাপারেই এরূপ আনন্দিত হ’তে দেখিনি। তা হ’ল এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর
রাসূল (ছাঃ)! এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে তার সৎকাজের জন্য ভালোবাসে, কিন্তু
সে তার মতো সৎকাজ করতে পারে না। রাসূল (ছাঃ) বলেন, المَرءُ مَعَ مَن
أَحَبَّ ‘প্রত্যেক ব্যক্তিই যাকে ভালোবাসে সে তার সাথী হবে’।[27]
(১৩) ভাল লোকদের সাথে থাকা বা থাকার আকাঙ্ক্ষা করা এবং আল্লাহর কাছে এজন্য দো‘আ করা পূর্ববর্তী নবীদের শিক্ষা। যেমন-
(ক) ইবরাহীম (আঃ) আল্লাহর কাছে এই বলে দো‘আ করেছেন, رَبِّ هَبْ لِي حُكْمًا وَأَلْحِقْنِي بِالصَّالِحِينَ ‘হে আমার পালনকর্তা! তুমি আমাকে প্রজ্ঞা দাও এবং আমাকে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত কর’ (শু‘আরা ২৬/৮৩)।
(খ) ইউসুফ (আঃ) এই বলে দো‘আ করেছেন,رَبِّ قَدْ آتَيْتَنِي مِنَ الْمُلْكِ وَعَلَّمْتَنِي مِنْ تَأْوِيلِ الْأَحَادِيثِ فَاطِرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ أَنْتَ وَلِيِّي فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ تَوَفَّنِي مُسْلِمًا وَأَلْحِقْنِي بِالصَّالِحِينَ ‘হে আমার পালনকর্তা! আপনি আমাকে রাষ্ট্রক্ষমতা দান করেছেন এবং আমাকে স্বপ্নসমূহের ব্যাখ্যাদানের শিক্ষা প্রদান করেছেন। নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের হে সৃষ্টিকর্তা! আপনিই আমার কার্যনির্বাহী দুনিয়া ও আখেরাতে। আপনি আমাকে ‘মুসলিম’ হিসাবে মৃত্যু দান করুন এবং আমাকে সৎকর্মশীলদের সাথে মিলিত করুন’ (ইউসুফ ১২/১০১)।
(গ) সুলায়মান (আঃ) দো‘আ করতেন,رَبِّ أَوْزِعْنِي أَنْ أَشْكُرَ نِعْمَتَكَ الَّتِي أَنْعَمْتَ عَلَيَّ وَعَلَى وَالِدَيَّ وَأَنْ أَعْمَلَ صَالِحًا تَرْضَاهُ وَأَدْخِلْنِي بِرَحْمَتِكَ فِي عِبَادِكَ الصَّالِحِينَ- ‘হে আমার পালনকর্তা! তুমি আমাকে সামর্থ্য দাও, যাতে আমি তোমার নে‘মতের শুকরিয়া আদায় করতে পারি, যা তুমি আমাকে ও আমার পিতা-মাতাকে দান করেছ। আর যাতে আমি এমন সৎকর্ম করতে পারি যা তুমি পসন্দ কর এবং আমাকে তোমার অনুগ্রহে তোমার সৎকর্মশীলবান্দাদের অন্তর্ভুক্ত কর’ (নমল ২৭/১৯)।
(১৪) একে অপরের সাথে ভালোবাসা স্থাপনকারী ব্যক্তিদের চেহারা নূরানী হবে :
ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর জন্য পরস্পর ভালোবাসা স্থাপনকারী ব্যক্তিদেরকে
মর্যাদা স্বরূপ নূরানী চেহারা দান করা হবে। রাসূল (ছাঃ)
বলেছেন,لَيَبْعَثَنَّ اللهُ أَقْوَامًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ فِيْ
وُجُوْهِهِمُ النُّوْرُ، عَلَى مَنَابِرِ اللُّؤْلُؤِ، يَغْبِطُهُمُ
النَّاسُ، لَيْسُوْا بِأَنْبِيَاءَ وَلَا شُهَدَاءَ. ... فَقَالَ: يَا
رَسُوْلَ اللهِ، حَلِّهِمْ لَنَا نَعْرِفْهُمْ. قَالَ: هُمُ
الْمُتَحَابُّوْنَ فِي اللهِ، مِنْ قَبَائِلَ شَتَّى، وَبِلَادٍ شَتَّى،
يَجْتَمِعُوْنَ عَلَى ذِكْرِ اللهِ يَذْكُرُوْنَهُ. ‘আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন
এমন একদল লোকদেরকে পুনরুত্থান করাবেন যাদের চেহারা হবে মণি-মুক্তার উপরে
নূরানী, যাদেরকে দেখে লোকেরা ঈর্ষা করবে অথচ তারা নবীও নন শহীদও নন। ...
অতঃপর সে (ছাহাবী) বলল, হে আল্লাহর রাসূল! তাদের বৈশিষ্ট্য বলুন, যাতে আমরা
তাদেরকে চিনতে পারি। রাসূল (ছাঃ) বললেন, তারা বিভিন্ন গোত্রের যারা
আল্লাহর জন্য পরস্পরকে ভালোবাসতেন এবং তারা বিভিন্ন দেশের যারা আল্লাহকে
স্মরণ করার জন্য একত্রিত হ’তেন’।[28]
(১৫) জান্নাত লাভের মাধ্যম : আল্লাহর জন্য কাউকে ভালবাসা, তাঁর সন্তুষ্টির জন্য কারো সাথে সাক্ষাৎ করা জান্নাত লাভের অন্যতম মাধ্যম। রাসূল (ছাঃ) বলেন,أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِرِجَالِكُمْ مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ؟ النَّبِيُّ فِي الْجَنَّةِ وَالشَّهِيدُ فِي الْجَنَّةِ وَالصِّدِّيقُ فِي الْجَنَّةِ وَالْمَوْلُودُ فِي الْجَنَّةِ وَالرَّجُلُ يَزُورُ أَخَاهُ فِي نَاحِيَةِ الْمِصْرِ فِي الْجَنَّةِ، ‘আমি কি তোমাদেরকে জান্নাতবাসীদের সম্পর্কে খবর দিব না? নব x জান্নাতী, শহীদ জান্নাতী, ছিদ্দীক্ব জান্নাতী, নবজাতক জান্নাতী, আর ঐ ব্যক্তিও জান্নাতী যে তার ভাইয়ের সাথে সাক্ষাতের জন্য দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে’।[29] অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) আরো বলেন, مَنْ عَادَ مَرِيْضًا أَوْ زَارَ أَخًا لَهُ فِي اللهِ نَادَاهُ مُنَادٍ أَنْ طِبْتَ وَطَابَ مَمْشَاكَ وَتَبَوَّأْتَ مِنَ الجَنَّةِ مَنْزِلاً، ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির আশায় কোন অসুস্থ লোককে দেখতে যায় অথবা কোন ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করতে যায়, একজন ঘোষক (ফেরেশতা) তাকে ডেকে বলতে থাকেন, কল্যাণময় তোমার জীবন, কল্যাণময় তোমার এই পথ চলাও। তুমি তো জান্নাতের মধ্যে একটি বাসস্থান নির্দিষ্ট করে নিলে’।[30]
উপরোক্ত আলোচনায় প্রমাণিত হয় যে, এক মুসলমান অপর মুসলমানকে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ও ক্বিয়ামতের দিন শান্তি পাওয়ার জন্য সর্বোপরি জান্নাত লাভের আশায় ভালোবাসবে। এই ভালোবাসা যেন দুনিয়াবী স্বার্থে ব্যাহত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মুমিনের ভুল-ত্রুটির প্রতি লক্ষ্য না করে তার ভাল কাজগুলোর প্রতি খেয়াল করতে হবে, আর ভুলগুলো সংশোধনের জন্য সাধ্যানুযায়ী, মার্জিত ভাষায় শরী‘আতের নির্দিষ্ট পন্থা অনুযায়ী চেষ্টা করতে হবে। সাথে সাথে আল্লাহর কাছে তার হেদায়াতের জন্য দো‘আ করতে হবে।
[চলবে]
[1]. বুখারী হা/৪৮১; মুসলিম হা/২৫৮৬; মিশকাত হা/৪৯৫৫।
[2]. বুখারী হা/২৪৭৫।
[3]. হুজুরাত ৪৯/১০; বুখারী হা/৬০৬৪; তিরমিযী হা/১৯২৭।
[4]. বুখারী হা/৩৯১; নাসাঈ হা/৫০১২।
[5]. বুখারী হা/৬০১১; মুসলিম হা/২৫৮৬।
[6]. আবূদাঊদ হা/৪৮৩৩; তিরমিযী হা/২৩৭৮,সনদ হাসান।
[7]. বুখারী হা/৬০১১; মুসলিম হা/২৫৮৬; মিশকাত হা/৪৯৫৩।
[8]. আবূদাঊদ হা/৪৮৩৩; তিরমিযী হা/২৩৭৮; ছহীহুল জামে‘ হা/৩৫৪৫।
[9]. আবূদাঊদ হা/৪৮৩২; তিরমিযী হা/২৩৯৫।
[10]. তিরমিযী হা/২৫৯৮; ছহীহুল জামে‘ হা/৮০৬২; ছহীহাহা হা/২৪৫০।
[11]. বুখারী হা/৫৮২৭; মুসলিম হা/৯৪।
[12]. মাজমূঊল ফাতওয়া, (মদীনা, সঊদী আরব : বাদশাহ ফাহাদ কুরআন প্রিন্টিং কমপ্লেক্স; ১৪১৬ হিঃ/১৯৯৫), ২৮/২০৯।
[13]. মুসলিম হা/২৫৬৭।
[14]. মুসলিম হা/২৬৯৯; মিশকাত হা/২০৪।
[15]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৬২০৭।
[16]. তিরমিযী, মিশকাত হা/৫০১১।
[17]. মুস্তাদরাকে হাকেম হা/৭৩২৩; ছহীহাহ হা/৪৫০।
[18]. বুখারী হা/৩৩৩৬; মুসলিম হা/২৬৩৮; মিশকাত হা/৫০০৩।
[19]. আবূদাঊদ, মিশকাত হা/৩০; ছহীহাহ হা/৩৮০।
[20]. আহমাদ হা/২২২৮৩; মিশকাত হা/৫০২২, সনদ হাসান।
[21]. মুসলিম হা/২৫৬৬; মিশকাত হা/৫০০৬।
[22]. বুখারী হা/১৪২৩, ৬৮০৬; মিশকাত হা/৭০১।
[23]. তিরমিযী হা/২৩৯০; মিশকাত হা/৫০১১; ছহীহুল জামে‘ হা/৪৩১২।
[24]. আবূদাঊদ হা/৩৫২৭; মিশকাত হা/৫০১২; ছহীহ আত-তারগীব হা/৩০২৬।
[25]. আবূদাউদ হা/৩৫২৭; মিশকাত হা/৫০১২, সনদ ছহীহ।
[26]. বুখারী হা/৩৬৮৮; মুসলিম হা/২৬৩৯।
[27]. বুখারী হা/৬১৬৯; মুসলিম হা/২৬৪০।
[28]. ছহীহ আত-তারগীব হা/১৫০৯, ৩০২৫, সনদ ছহীহ।
[29]. ছহীহাহ হা/২৮৭; ছহীহুল জামে‘ হা/২৬০৪।
[30]. তিরমিযী হা/২০০৮; ছহীহুল জামে‘ হা/২১৬৩; মিশকাত হা/৫০১৫।