ভূমিকা : ভারতীয় উপমহাদেশে আহলেহাদীছ আন্দোলনের প্রচার ও প্রসারে আফগানিস্তানের গযনভী পরিবারের অবদান অনস্বীকার্য। এ পরিবারেরই কৃতী সন্তান মাওলানা আব্দুল্লাহ গযনভী। আহলেহাদীছ আন্দোলনের এই প্রাণপুরুষ ছিলেন দুনিয়ার মোহ, খ্যাতি ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য থেকে সম্পূর্ণ বিমুখ এক পুণ্যবান মানুষের প্রতিভূ। তিনি ছিলেন সমকালীন খ্যাতিমান মুহাদ্দিছ, দাঈ ইলাল্লাহ ও সমাজ সংস্কারক। মিয়াঁ নাযীর হুসাইন দেহলভীর (১৮০৫-১৯০২) এই খ্যাতিমান ছাত্র ও তাঁর ১২ জন মুহাদ্দিছ পুত্রের দাওয়াত ও তাবলীগের বদৌলতেই মূলত আফগানিস্তানের মানুষ আহলেহাদীছ আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক অবগত হয়।[1] এই সংগ্রামী মনীষীর জীবন ও কর্ম অত্র নিবন্ধের প্রতিপাদ্য বিষয়।
জন্ম ও বংশ পরিচিতি : মাওলানা আব্দুল্লাহ গযনভী ১২৩০হিঃ/১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে আফগানিস্তানের গযনী যেলার বাহাদুর খায়ল দুর্গে এক বিখ্যাত অলী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মূল নাম ছিল মুহাম্মাদ আযম। যার অর্থ মহান মুহাম্মাদ। অর্থগত দিক থেকে এ নামটি মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর সাথেই একমাত্র মানানসই। এজন্য গযনভী তাঁর নাম পরিবর্তন করে আব্দুল্লাহ রাখেন। তাঁর পিতা ও দাদা উভয়ের নাম ছিল মুহাম্মাদ এবং প্রপিতামহের নাম ছিল মুহাম্মাদ শরীফ। এরা সবাই আল্লাহর অলী ছিলেন।[2]
জ্ঞানার্জন : বাল্যকালেই আব্দুল্লাহ গযনভী জ্ঞানার্জনে প্রবৃত্ত হন। তিনি তদানীন্তন বরেণ্য আলেমদের নিকটে শরী‘আতের বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানার্জন করেন। তাঁর শিক্ষকদের মধ্যে বিশিষ্ট ফকীহ ও উছূলবিদ ‘মুগতানামুল হুছূল’ গ্রন্থের রচয়িতা শায়খ হাবীবুল্লাহ কান্দাহারীর নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনি তাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন।[3]
জীবনের মোড় পরিবর্তন : যৌবনকালে একদা তিনি প্রপিতামহ মুহাম্মাদ শরীফের কবর যিয়ারত করতে গিয়ে অনুভব করেন যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো দিকে প্রত্যাবর্তন করা ইবাদত ও সাহায্য প্রার্থনায় শিরক। কোন হাজত পূরণের নিয়তে কবরে যাওয়া তাওহীদের সম্পূর্ণ বিরোধী। যদি কেউ ধারণা করে যে, আমি কোন কিছু চাওয়ার জন্য কোন পীর বা অলির কবরে যাই না; বরং এজন্য যাই যে, ঐ কবরটি বরকতময় স্থান এবং ওখানে আমার দো‘আ দ্রুত কবুল হবে, তাহ’লে এটাও ভ্রান্ত ধারণা হিসাবে পরিগণিত হবে। কারণ ইবাদত এবং দো‘আ কবুলের জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সবচেয়ে উত্তম জায়গা হিসাবে মসজিদকে নির্ধারণ করে দিয়েছেন। অন্যদিকে প্রিয় শিক্ষক হাবীবুল্লাহ কান্দাহারীর অনুপ্রেরণায় ভারতীয় উপমহাদেশে আহলেহাদীছ আন্দোলনের অকুতোভয় সিপাহসালার শাহ ইসমাঈল শহীদ (১৭৭৯-১৮৩১) রচিত ‘তাকভিয়াতুল ঈমান’ গ্রন্থটি অধ্যয়ন করে তিনি সব ধরনের শিরক বর্জন করেন। এ সময় তিনি হাদীছের বিভিন্ন গ্রন্থ বিশেষত ছহীহুল বুখারী অধ্যয়ন করে সুন্নাতের প্রতি আমল করার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হন এবং প্রত্যেক মাসআলায় ছহীহ হাদীছের প্রতি আমল করা শুরু করেন। কোন খন্ড ফিক্বহী মাসআলা হাদীছের বিরোধী হলে তিনি সেটি নির্দ্বিধায় পরিত্যাগ করতেন এবং বলতেন, ‘বিভিন্ন সূত্রে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পর্যন্ত পৌঁছা ছহীহ হাদীছ ছেড়ে দিয়ে তার বিপরীতে ফিক্বহী মতামতের উপর আমল করা সত্যিই বিস্ময়কর ব্যাপার। যেসব মতামত মুফতী এবং কাযীরা নকল করেছেন এবং কোন মাধ্যমে সেগুলো তাদের কাছে পৌঁছেছে তাও জানা যায় না’। মূলতঃ হাদীছ পড়ে তিনি রাফ‘উল ইয়াদায়েন, জোরে আমীন বলা এবং ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পাঠের প্রতি আমল শুরু করে দেন। সাথে সাথে বিনয়-নম্রতার সাথে আউয়াল ওয়াক্তে ছালাতও আদায় করতে থাকেন।[4]
এভাবে তাঁর জীবনের মোড় পরিবর্তন হয়ে যায়। ছূফী ঘরানায় জন্মগ্রহণ করেও হাদীছ অধ্যয়ন তাঁর মনে তাওহীদের আলো প্রজ্জ্বলিত করে দেয়। সে আলোয় ক্রমান্বয়ে উদ্ভাসিত হতে থাকে তাঁর আমলী যিন্দেগী।
দাওয়াত ও তাবলীগ : তিনি সমাজ সংস্কারের মানসে কুরআন ও সুন্নাহর প্রচার-প্রসার এবং শিরক ও বিদ‘আত মূলোৎপাটনের কণ্টকাকীর্ণ ময়দানে অবতীর্ণ হন। আউলিয়াদের মাযার যিয়ারত ও সাহায্য প্রার্থনার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠে বক্তব্য রাখেন। সকলকে কুরআন ও হাদীছ অনুসরণের দাওয়াত প্রদান করেন। তাঁর দাওয়াতে অনেকেই শিরক ও বিদ‘আত পরিত্যাগ করে আহলেহাদীছ হয়ে যান। ফলশ্রুতিতে এলাকার আলেম-ওলামা এবং আম জনতা তাঁর বিরোধিতায় অবতীর্ণ হয়। কাবুলের আমীর দোস্ত মুহাম্মাদ খানের নিকট তদানীন্তন বিদ‘আতী আলেম সমাজ তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন। এদের অগ্রভাগে ছিলেন খান মোল্লা দুর্রানী, মোল্লা মিশকী এবং মোল্লা নাছরুল্লাহ লোহানী। তিনি এসকল আলেমকে খুশি করার জন্য গযনভীকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করেন।[5]
দেশ ত্যাগ ও মিয়াঁ ছাহেবের ছাত্রত্ব গ্রহণ : মাতৃভূমি গযনী ত্যাগ করে তিনি দিল্লীতে এসে মিয়াঁ নাযীর হুসাইন দেহলভীর (১৮০৫-১৯০২) নিকট কুতুবে সিত্তাহ অধ্যয়ন করেন এবং হাদীছের সনদ লাভ করেন।[6] ইত্যবসরে (১০ই মে ১৮৫৭, ১৬ রামাযান ১২৭২ হিঃ) সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হয়ে যায়। মিয়াঁ ছাহেব বলতেন, ‘কামানের গোলা প্রতিদিন শহরে বৃষ্টির মতো বর্ষিত হত এবং পাঞ্জাবী কাটরায় অবস্থিত আমার মসজিদের পাশ দিয়েও চলে যেত। (একদিন) একটি গোলা আমার মসজিদের আঙ্গিনাতেও এসে পড়েছিল, এতদসত্ত্বেও আমি এবং আব্দুল্লাহ ছাহেব সারাদিন ছহীহুল বুখারী পড়ানো ও পড়তে ব্যস্ত ছিলাম’।[7]
স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও যুলুম-নির্যাতন : মিয়াঁ নাযীর হুসাইন দেহলভীর কাছ থেকে হাদীছের সনদ লাভ করে তিনি পাঞ্জাবে চলে আসেন। এখানে কিছুদিন অবস্থান করে তিনি গযনীতে প্রত্যাবর্তন করেন। তাঁর আশা ছিল কাবুলের আমীরের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু গযনীতে মাত্র একমাস অবস্থান করার পর হঠাৎ একদিন কাবুলের আমীরের সৈন্যবাহিনী বহিষ্কারাদেশ নিয়ে তাঁর বাড়িতে হাজির হয়। তিনি গযনী ত্যাগ করে ‘নাওয়াহ’ নামক স্থানে চলে যান। সেখান থেকেও তাঁকে বহিষ্কার করে সপরিবারে ইয়াগিস্তানের পাহাড়ী অঞ্চলের দিকে বের করে দেয়া হয়। তিনি এখানে অবস্থান করে কিতাব ও সুন্নাতের তাবলীগ শুরু করে দেন। ‘নাওয়াহ’-এর বিদ‘আতী আলেমরা সশস্ত্র সৈন্যবাহিনীকে তাঁর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। তাঁর ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয় এবং কয়েকজন আহলেহাদীছকে আহত করা হয়। অগত্যা সেখান থেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে তিনি বিভিন্ন পাহাড়ী এলাকায় মুসাফিরের মতো ঘুরতে থাকেন। তিনি যেখানেই যেতেন সেখানেই বিদ‘আতী আলেমরা তাঁর বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগত। তাদের বিরোধিতা ও অত্যাচারে তিনি কোথাও স্থির হতে পারেননি। কাবুলের আমীর দোস্ত মুহাম্মাদ খানের মৃত্যুর পর তার ছেলে শের আলী খান কাবুলের শাসনভার গ্রহণ করেন। শাসকের পরিবর্তনে অবস্থার পরিবর্তনের আশায় তিনি পুনরায় গযনীতে ফিরে আসেন। কিন্তু প্রতিহিংসাপরায়ণ আলেমরা নতুন আমীরের কাছেও তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করলে তিনি তাঁকে দেশ ত্যাগের হুকুম জারি করেন। এ নির্দেশ পেয়ে তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান। কোথায় যাবেন তা ভেবে পাচ্ছিলেন না। ইত্যবসরে কাবুলে বিদ্রোহ ঘটে যায়। শের আলী খান ক্ষমতা ছেড়ে হেরাতে চলে যান। এরপর মুহাম্মাদ আফযাল খান এবং মুহাম্মাদ আযম খান কাবুলের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। বিদ‘আতী আলেমরা তাদেরকেও মাওলানার ব্যাপারে উসকিয়ে দেয়। মুহাম্মাদ আফযাল খান এর নির্দেশে তাঁকে গ্রেফতার করে দোস্ত মুহাম্মাদ খানের ছেলে সরদার মুহাম্মাদ ওমর খানের নিকটে হাজির করা হয়। তদীয় পুত্র মাওলানা আব্দুল্লাহ, মাওলানা মুহাম্মাদ এবং মাওলানা আব্দুল জাববার গযনভী সে সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন। সরদার ওমর খান মাওলানার নূরানী চেহারা দেখে নরম হয়ে যান। তিনি তাঁকে বলেন, ‘আপনি এই তরীকা ছেড়ে দিয়ে বর্তমান আলেম সমাজের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান এবং তারা যা করে আপনিও তাই করুন’। মাওলানা দৃঢ়কণ্ঠে জবাব দেন, ‘আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ হল কুরআন ও সুন্নাহর বিধান প্রচার করা’। সরদার মাওলানার কথায় দারুণভাবে প্রভাবিত হয়ে কাবুলের আমীরের কাছে এ মর্মে পত্র লিখেন যে, ‘আপনার আদেশ মতো আমি এই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছি। আমি অনুভব করেছি যে, এই ব্যক্তি সৎ এবং দুনিয়ার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য থেকে বিমুখ। (তাঁর ব্যাপারে) আপনার (পরবর্তী) নির্দেশ জানাবেন’। কাবুলের আমীর মাওলানাকে কাবুলে পৌঁছিয়ে দেয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। নির্দেশ পাওয়া মাত্র কতিপয় সেনার সাথে সরদার তৎক্ষণাৎ মাওলানাকে কাবুলে পাঠিয়ে দেন। মোল্লা মিশকী, মোল্লা নাছরুল্লাহ গং কাবুলের আমীরের নিকট গিয়ে বলেন, দোস্ত মুহাম্মাদ খানের সময় আমরা এই ব্যক্তির কুফরী সাব্যস্ত করেছি। তাই তার ব্যাপারে পুনরায় তদন্ত করার প্রয়োজন নেই। তারা মাওলানাকে বেত্রাঘাত করার এবং গাধার পিঠে শহরময় ঘুরানোর ফৎওয়া জারি করে।[8] বস্ত্তত তাঁর দাড়ি উপড়িয়ে ফেলে মুখে চুনকালি মাখিয়ে গাধার পিঠে চড়িয়ে সারা শহর প্রদক্ষিণ করানো হয়।[9] তাঁকে ও তাঁর তিন ছেলেকে বেত্রাঘাতও করা হয়। এরূপ নৃশংস, অমানবিক ও জঘন্য শাস্তির পর তিন পুত্রসহ দুই বছর মাওলানাকে জেলখানায় বন্দী রাখা হয়।[10]
ভারতের পথে : আফযাল খানের মৃত্যুর পর আযম খান কাবুলের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তিনিও খান মোল্লা দুর্রানী এবং খান আব্দুর রহমানের উসকানিতে মাওলানাকে পেশাওয়ারের দিকে বের করে দেন।[11] মাওলানা আব্দুল হাই লাক্ষ্ণৌভী বলেন, فلما قدم الهند أقام بمدينة بشاور أياما قلائل، ثم سكن بأمرتسر من بلاد بنجاب وعكف على العبادة والإفادة. ‘ভারতে এসে তিনি অল্প কিছুদিন পেশাওয়ারে অবস্থান করেন। অতঃপর পাঞ্জাবের অমৃতসরে স্থায়ী হন এবং ইবাদত ও দরস-তাদরীসে নিমগ্ন হন’।[12]
পাঞ্জাবে এসে তিনি জোরেশোরে দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ আঞ্জাম দিতে থাকেন। এ প্রদেশ থেকে শিরক-বিদ‘আত দূরীকরণে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাঁর দাওয়াতে এখানকার অসংখ্য মানুষ শিরক-বিদ‘আত পরিহার করে আহলেহাদীছ হয়ে যান।[13]
মৃত্যু : মাওলানা আব্দুল্লাহ গযনভী ১২৯৮ হিজরীর ১৫ রবীউল আউয়াল (১৮৮০ খ্রিঃ) মঙ্গলবার ৬৫ বছর বয়সে অমৃতসরে ইন্তিকাল করেন এবং সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়।[14]
সন্তান-সন্ততি : মাওলানা গযনভীর সন্তান সংখ্যা ২৭ জন। তন্মধ্যে ১২ জন পুত্র ও ১৫ জন কন্যা। বার জন পুত্রের সবাই মুহাদ্দিছ ছিলেন। পুত্রদের নাম হল : (১) মাওলানা আব্দুল্লাহ (২) মাওলানা মুহাম্মাদ (৩) মাওলানা আহমাদ (৪) মাওলানা আব্দুল জাববার (৫) মাওলানা আব্দুল ওয়াহিদ (৬) মাওলানা আব্দুর রহমান (৭) মাওলানা আব্দুস সাত্তার (৮) মাওলানা আব্দুল কাইয়ূম (৯) মাওলানা আব্দুল আযীয (১০) মাওলানা আব্দুল হাই (১১) মাওলানা আব্দুল কুদ্দূস (১২) মাওলানা আব্দুর রহীম।[15] এদের মধ্যে প্রথম চারজন মিয়াঁ নাযীর হুসাইন দেহলভীর নিকট থেকে দিল্লীতে হাদীছের সনদ লাভ করেন।[16] পশ্চিম পাকিস্তানের খ্যাতনামা আহলেহাদীছ বাগ্মী, আলেম, রাজনীতিবিদ এবং পশ্চিম পাকিস্তান জমঈয়তে আহলেহাদীছের প্রথম সভাপতি মাওলানা সাইয়িদ মুহাম্মাদ দাউদ গযনভী বিন আব্দুল জাববার (১৮৯৫-১৯৬৩) মাওলানা আব্দুল্লাহ গযনভীর স্বনামধন্য পৌত্র ছিলেন।[17]
চরিত্র-মাধুর্য : মাওলানা আব্দুল্লাহ গযনভী সালাফে ছালেহীনের উত্তম নমুনা ছিলেন। ইবাদত-বন্দেগী, তাক্বওয়া-পরহেযগারিতা ও যিকর-আযকার তাঁর চরিত্রের ভূষণ ছিল। আবুদাঊদের বিশ্ববরেণ্য ভাষ্যকার আল্লামা শামসুল হক আযীমাবাদী বলেন,
وكان في جميع أحواله مستغرقا في ذكر الله عز وجل، حتى أن لحمه وعظامه وأعصابه وأشعاره وجميع بدنه كان متوجها إلى الله تعالى فانيا فى ذكره عز وجل.
‘সর্বাবস্থায় তিনি আল্লাহর যিকরে ডুবে থাকতেন। এমনকি তাঁর গোশত, হাড্ডি, শিরা-উপশিরা, চুল এবং সমস্ত শরীর আল্লাহ অভিমুখী এবং তাঁর যিকরে নিমগ্ন ছিল’।[18] দুনিয়ার প্রতি তিনি ছিলেন নিরাসক্ত।[19] এজন্য শামসুল হক আযীমাবাদী তাঁকে عَلَمُ الزُّهَّادِ বা ‘দুনিয়াত্যাগী বান্দাদের প্রতীক’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন।[20] আব্দুল হাই লাক্ষ্ণৌভী তাঁর চরিত্র-মাধুর্য সম্পর্কে বলেছেন, انتهى إليه الورع وحسن الصمت والتواضع. ‘আল্লাহভীরুতা, নীরবতা ও বিনয়-নম্রতা তাঁর নিকট এসে থেমেছে’।[21]
মনীষীদের দৃষ্টিতে মাওলানা গযনভী : মাওলানা আব্দুল্লাহ গযনভী একজন উঁচুদরের মুহাদ্দিছ ছিলেন। তাঁর জ্ঞান-গরিমা ও তাক্বওয়া-পরহেযগারিতার কথা সকলে এক বাক্যে স্বীকার করেছেন। নিম্নে কয়েকজন মনীষীর মতামত উদ্ধৃত করা হ’ল-
১. আল্লামা শামসুল হক আযীমাবাদী বলেন,
كان عارفا بالله، ساعيا في مرضاته، عابدا، كثير الذكر، رجاعا إلى الله، متذللا، خاشعا، خاضعا، ورعا، متضرعا، متواضعا، حنيفا، كاملا، بارعا، مُلْهَمًا، محدثا، مخاطبا بالمخلص الصديق الكريم، الجواد الأواه الحليم، المتوكل المنيب، الصابر القانت.
‘তিনি আল্লাহর পরিচয় সম্পর্কে অবগত, তাঁর সন্তুষ্টির জন্য প্রচেষ্টাকারী, ইবাদতগুযার, অধিক যিকরকারী, আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনকারী, বিনয়ী, আল্লাহভীরু, একনিষ্ঠ, কামিল, দক্ষ, এলহামপ্রাপ্ত, মুহাদ্দিছ, হিতাকাঙ্ক্ষী বাগ্মী, দানশীল, ক্রন্দনকারী, সহিষ্ণু, আল্লাহর উপর ভরসাকারী, তওবাকারী, ধৈর্যশীল ও ইবাদতকারী ছিলেন’।[22] তিনি আরো বলেন,
لم يأخذه في الله لومة لائم قط، مؤثرا رضوان الله عز وجل على نفسه وأهله وماله وأوطانه.
‘আল্লাহর পথে কোন নিন্দুকের নিন্দা তাঁকে কখনো স্পর্শ করেনি। তিনি নিজের জীবন, পরিবার, সম্পদ ও দেশের উপর আল্লাহর সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দানকারী ছিলেন’।[23]
২. মাওলানা আব্দুল হাই লাক্ষ্ণৌভী হানাফী বলেন, وكان حسنة الزمان وزينة الهند، قد غشيه نور الإيمان وسيما الصالحين. ‘তিনি যুগের কল্যাণ ও ভারতের সৌন্দর্য ছিলেন। ঈমানের আলো ও পুণ্যবানদের বৈশিষ্ট্য তাঁকে পরিবেষ্টন করেছিল’।[24]
৩. মাওলানা ফযল হুসাইন বলেন, ‘তিনি ছূফী মুহাদ্দিছ ছিলেন। হিজরী ত্রয়োদশ শতকে কেউ তাছাউওফে নববীর নমুনা দেখতে চাইলে তাঁর সমতুল্য আর কাউকে দেখতে পেত না’।[25]
৪. ড. আব্দুর রহমান ফিরিওয়াঈ বলেন, الإمام المصلح المحدث عبد الله الغزنوى (১২৩০-১২৯৮هـ) من كبار دعاة السنة وعلمائها المولعين بالعمل بها ونشرها وإحيائها. ‘ইমাম, সমাজ সংস্কারক, মুহাদ্দিছ আব্দুললাহ গযনভী (১২৩০-১২৯৮ হিঃ) সুন্নাহর একজন বড় মাপের দাঈ, হাদীছের প্রতি আমল, তার প্রচার-প্রসার ও পুনর্জীবিতকরণে আগ্রহী আলেমদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন’।[26]
৫. আব্দুর রশীদ ইরাকী বলেন, ‘মাওলানা আব্দুল্লাহ গযনভী স্বীয় যুগের প্রসিদ্ধ কারামতওয়ালা বুযর্গ ছিলেন’।[27]
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, মাওলানা আব্দুল্লাহ গযনভী ছূফী পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও ছহীহুল বুখারী ও তাকভিয়াতুল ঈমান অধ্যয়নের ফলে তাঁর জীবনের গতি আমূল পরিবর্তন হয়ে যায়। তিনি সকল প্রকার শিরক ও বিদ‘আত বর্জন করে ছহীহ হাদীছের প্রতি আমল এবং দাওয়াত শুরু করে দেন। তাঁর দাওয়াতে অনেকেই আহলেহাদীছ হন। এতে বিদ‘আতী আলেম সমাজের গাত্রদাহ শুরু হয়ে যায়। তাঁর বাড়ি-ঘর ভস্মীভূত করে তাঁকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হয়। এমনকি কাফের ফৎওয়া দিয়ে কাবুলের আমীরের নির্দেশে তাঁকে বেত্রাঘাত এবং গাধার পিঠে শহর প্রদক্ষিণ করানো হয়। এতো যুলুম-নির্যাতনের মুখেও তিনি হক-এর পথ থেকে সামান্যতম বিচ্যুত হননি। বরং নীরবে মুখ বুঁজে সব নির্যাতন-নিষ্পেষণ সহ্য করে হকের পথে ছিলেন অবিচল, হিমাদ্রির মতো দৃঢ়। এজন্য আল্লামা শামসুল হক আযীমাবাদী তাঁকে ‘অবিচল বান্দাদের আদর্শ’ (قدوة أهل الاسةقامة) হিসাবে অভিহিত করেছেন।[28] হকপিয়াসী মানুষদেরকে হকের পথে টিকে থাকতে তাঁর ঘটনাবহুল সংগ্রামী জীবন নিত্য প্রেরণা যুগিয়ে যাবে এবং অনাগত আহলেহাদীছদের জন্য তিনি প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন অনন্তকাল।
নূরুল ইসলাম
পিএইচ.ডি গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
[1]. আফগানিস্তানে আহলেহাদীছ আন্দোলনের সূচনা ও বিকাশ সম্পর্কে জানার জন্য দেখুন : মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, আহলেহাদীছ আন্দোলন : উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষিত সহ, (ডক্টরেট থিসিস), পৃঃ ৪৯৬-৫০০, ‘আফগানিস্তানে আহলেহাদীছ আন্দোলন’ অধ্যায়; শায়খ হাদিয়ুর রহমান বিন জামীলুর রহমান এর গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকার দেখুন, মাসিক আত-তাহরীক, জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী ২০১৪, পৃঃ ৩১-৩৩।
[2]. আব্দুল হাই লক্ষ্ণৌভী, নুযহাতুল খাওয়াতির (বৈরূত : দারু ইবনি হাযম, ১৪২০হিঃ/১৯৯৯ খ্রিঃ), ৭ম খন্ড, পৃঃ ১০৩০; মাওলানা মুহাম্মাদ ইবরাহীম মীর শিয়ালকোটী, তারীখে আহলেহাদীছ (মুম্বাই: ইদারাহ দাওয়াতুল ইসলাম, তা.বি.), পৃঃ ৩০৮।
[3]. শামসুল হক আযীমাবাদী, গায়াতুল মাকছূদ ফী শারহি সুনানি আবীদাঊদ (ফায়ছালাবাদ, পাকিস্তান : হাদীছ একাডেমী, ১ম প্রকাশ : ১৪১৪ হিঃ), ১ম খন্ড, পৃঃ ৫৬; নুযহাতুল খাওয়াতির ৭/১০৩০।
[4]. ইবরাহীম মীর শিয়ালকোটি,তারীখে আহলেহাদীছ, পৃঃ ৩০৮।
[5]. তদেব; আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃঃ ৪৯৭।
[6]. তারীখে আহলেহাদীছ, পৃঃ ৩০৯; নুযহাতুল খাওয়াতির ৭/১০৩০।
[7]. মাওলানা ফযল হুসাইন, আল-হায়াত বা‘দাল মামাত (নয়াদিল্লী : আল-কিতাব ইন্টারন্যাশনাল, তা.বি.), পৃঃ ৩৯১, পাদটীকা-১ দ্রঃ।
[8]. তারীখে আহলেহাদীছ, পৃঃ ৩০৯।
[9]. নুযহাতুল খাওয়াতির ৭/১০৩০ فأمر أن تنتف لحيته ويسود وجهه ويركب على الحمار، ويشهر فى البلد. ।
[10]. তারীখে আহলেহাদীছ, পৃঃ ৩০৯; আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃঃ ৪৯৭।
[11]. তারীখে আহলেহাদীছ, পৃঃ ৩০৯।
[12]. নুযহাতুল খাওয়াতির ৭/১০৩০।
[13]. ড. আব্দুর রহমান ফিরিওয়াঈ, জুহূদ মুখলিছাহ (বেনারস : জামে‘আ সালাফিয়া, ১৯৮৬), পৃঃ ১০৭; নুযহাতুল খাওয়াতির ৭/১০৩০।
[14]. আল-হায়াত বা‘দাল মামাত, পৃঃ ৩৯০; গায়াতুল মাকছূদ ১/৫৭; নুযহাতুল খাওয়াতির ৭/১০৩১।
[15]. তারীখে আহলেহাদীছ, পৃঃ ৩১০।
[16]. আল-হায়াত বা‘দাল মামাত, পৃঃ ৩৯১।
[17]. আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃঃ ৪৯৭-৪৯৮; মাসিক শাহাদাত, ইসলামাবাদ, পাকিস্তান, ডিসেম্বর ২০০৮, পৃঃ ২১।
[18]. গায়াতুল মাকছূদ ১/৫৬।
[19]. হায়াতুল মুহাদ্দিছ শামসুল হক ওয়া আ‘মালুহু, পৃঃ ২৮৩।
[20]. গায়াতুল মাকছূদ ১/৫৬।
[21]. নুযহাতুল খাওয়াতির ৭/১০৩১।
[22]. গায়াতুল মাকছূদ ১/৫৬।
[23]. তদেব।
[24]. নুযহাতুল খাওয়াতির ৭/১০৩০-৩১।
[25]. আল-হায়াত বা‘দাল মামাত, পৃঃ ৩৯০।
[26]. জুহূদ মুখলিছাহ, পৃঃ ১০৬।
[27]. মাসিক শাহাদাত, ডিসেম্বর ২০০৮, পৃঃ ২১।
[28]. গায়াতুল মাকছূদ ১/৫৬।