পর্ব ১। পর্ব ২ । পর্ব ৩ । শেষ পর্ব ।

তিন অনন্য ইলমী খিদমত :

মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ীর রচনা সমূহের মধ্যে বিশেষভাবে তিনটি গ্রন্থ স্বীয় মহিমায় সমুজ্জ্বল। এ তিনটি গ্রন্থের ইহসান উর্দূভাষী জনগণ কখনো ভুলতে পারবে না। কিয়ামত পর্যন্তএই তিন অক্ষয় কীর্তি লক্ষ লক্ষ পাঠকের হৃদয়ে তাঁর নাম জাগরুক রাখবে। এগুলি হল-

১. তাফসীর ইবনে কাছীরের উর্দূ অনুবাদ ‘তাফসীরে মুহাম্মাদী’ : দিল্লীর বাড়া হিন্দুরাও মহল্লায় অবস্থিত ‘আখবারে মুহাম্মাদী’ পত্রিকা অফিসে মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী এক সময় তাফসীর ইবনে কাছীরের দরস দেয়া শুরু করেছিলেন। এই জগদ্বিখ্যাত তাফসীরের অনন্য রচনাশৈলী ও চমৎকার তাফসীর পদ্ধতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি এই মোখিক দরসগুলি লিপিবদ্ধ করাও শুরু করেছিলেন। এ ব্যাপারে তিনি স্বীয় বড় ভায়রা ভাই মাওলানা আব্দুল্লাহ নাদভী (১৯০০-১৯৭২) ও অন্যদের পরামর্শ নিতে থাকেন। ‘আখবারে মুহাম্মাদী’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে কিস্তি আকারে তাফসীর ইবনে কাছীরের উর্দূ অনুবাদ প্রকাশিত হয়। অতঃপর তিনি তা গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন। ১ম পারা ১৩৪৬ হিজরীতে দফতরে আখবারে মুহাম্মাদী, আজমিরী গেট, দিল্লী থেকে প্রকাশিত এবং জাইয়েদ বারকী প্রেস থেকে মুদ্রিত হয়। ১৩৪৬ হিজরীতে তিনি এ তাফসীরটি অনুবাদ করা শুরু করেন। দীর্ঘ ৮ বছরের সাধনায় তা সমাপ্তির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে।

তাফসীর ইবনে কাছীরের উর্দূ অনুবাদ ‘তাফসীরে মুহাম্মাদী’-এর ভাব-ভাষা অত্যন্ত সহজ-সরল ও সাবলীল। যা পড়লে অনুবাদ মনে হয় না। এতদিন এটি উর্দূতে অনূদিত না হওয়ার কারণে উর্দূভাষী বিশাল জনগোষ্ঠী এ থেকে উপকৃত হতে পারছিল না। জুনাগড়ী সে অভাব পূরণ করে এক ঐতিহাসিক খিদমত আঞ্জাম দেন।[1]

পাক-ভারতের বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে এটি বহুবার প্রকাশিত হয়েছে। উক্ত অনুবাদের গ্রহণযোগ্যতা বিবেচনায় প্রথমতঃ রিয়াদের দারুস সালাম প্রকাশনী অতঃপর বাদশাহ ফাহাদ কুরআন প্রিন্টিং কমপ্লেক্স, মদীনা মুনাওয়ারাহ থেকে হাফেয ছালাহুদ্দীন ইউসুফ-এর তাফসীরসহ ‘কুরআনে কারীম মা‘আ উর্দূ তরজমা ওয়া তাফসীর’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে।[2]

বর্তমানে তাফসীর ইবনে কাছীরের জনপ্রিয় এ অনুবাদ গ্রন্থটি ৫ খন্ডে লাহোরের মাকতাবা ইসলামিয়াহ থেকে ২০০৯ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত হয়েছে। এটি তাখরীজ করেছেন গবেষক কামরান তাহের এবং তাহকীক ও সম্পাদনা করেছেন হাফেয যুবায়ের আলী যাঈ।

২. ই‘লামুল মুওয়াক্কি‘ঈন-এর উর্দূ অনুবাদ ‘দ্বীনে মুহাম্মাদী’ : হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম রচিত জগদ্বিখ্যাত ফিক্বহ গ্রন্থ হল ‘ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন’। মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী ‘দ্বীনে মুহাম্মাদী’ নামে ৭ খন্ডে এ বৃহৎ গ্রন্থটি অনুবাদ করেন। ১৯৩৪ সালে তিনি এর অনুবাদ শুরু করেন এবং ১৯৩৮ সালে শেষ হয়। প্রথমতঃ তা ‘আখবারে মুহাম্মাদী’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। অতঃপর ৭ খন্ডে জাইয়েদ বারকী প্রেস, দিল্লী থেকে প্রকাশিত হয়। তারপর আখবারে মুহাম্মাদী অফিস, দিল্লী থেকে প্রকাশিত হয়।[3] বর্তমানে এটি সুবৃহৎ দুই খন্ডে চমৎকার মুদ্রণ ও দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদে মৌনাথভঞ্জনের মাকতাবাতুল ফাহীম থেকে প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম খন্ডের পৃষ্ঠা সংখ্যা ৬১১ এবং দ্বিতীয় খন্ডের পৃষ্ঠা সংখ্যা ৬৩৮।

স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মাওলানা আবুল কালাম আযাদ (১৮৮৮-১৯৫৮) গ্রন্থকারে প্রকাশের পূর্বে আখবারে মুহাম্মাদী পত্রিকায় প্রকাশিত উক্ত অনুবাদ পড়ে অত্যন্ত খুশী হন এবং মাওলানা জুনাগড়ীকে ধন্যবাদ দিয়ে দু’টি পত্র লিখেন। ঐতিহাসিক মূল্য বিবেচনায় পত্র দু’টির বঙ্গানুবাদ নিম্নে প্রদত্ত হল-

প্রথম পত্র

আস-সালামু আলায়কুম ওয়া রহমাতুল্লাহ

প্রিয়ভাজনেষু

আমি অবগত হয়েছি যে, আপনি হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িমের ‘ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন’ গ্রন্থটি উর্দূতে অনুবাদ করেছেন। এ সংবাদ শুনে আমি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছি। অনুবাদকর্মে আগ্রহী কতিপয় প্রিয়ভাজনকে আমি অনেক দিন পূর্বে শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ ও শায়খুল ইসলাম ইবনুল ক্বাইয়িমের গ্রন্থ সমূহ উর্দূতে রূপান্তর করার কাজে নিয়োজিত করেছিলাম। অনুবাদের জন্য নির্বাচিত গ্রন্থগুলির মধ্যে ই‘লামও ছিল। কিন্তু গ্রন্থটি বিশাল হওয়ায় তা সম্ভব হয়নি। অবশ্য তাঁদের ছোট ছোট গ্রন্থগুলির অনুবাদ প্রকাশিত হয়ে গেছে। এখন আপনি এদিকে মনোনিবেশ করেছেন বিধায় আমি বলব যে, আপনি অত্যন্ত চমৎকার একটি গ্রন্থ অনুবাদ করার জন্য নির্বাচন করেছেন।

আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে ফলপ্রসূ কাজ করার তৌফিক দিন। হাদীছ ও ফিক্বহ বিষয়ে পরবর্তী আলেমদের পর্যাপ্ত ভান্ডার মওজুদ রয়েছে। কিন্তু এর চেয়ে ভাল ও বিশুদ্ধ কোন গ্রন্থ নেই। এজন্য উর্দূতে অনুবাদ করে এ বিষয়ের সকল প্রয়োজন একবারেই পূর্ণ করে দেয়।

বিশেষতঃ ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত শ্রেণীর জন্য এর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এই শ্রেণীর বহু মানুষ ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। কিন্তু এরা ছহীহ মাসলাকের খবর রাখেন না এবং আরবী না জানার কারণে সরাসরি অধ্যয়ন করতে পারেন না। যদি ই‘লাম উর্দূতে প্রকাশিত হয় তাহলে তাদের অনুধাবন ও দূরদৃষ্টির জন্য পর্যাপ্ত উপাত্ত প্রস্ত্তত হয়ে যাবে। যদি এই অনুবাদ প্রকাশে আমি আপনাকে কোন সহযোগিতা করতে পারি তাহলে অত্যন্ত আনন্দিত হব।

আবুল কালাম আযাদ

কলকাতা।[4]

দ্বিতীয় পত্র

আস-সালামু আলায়কুম ওয়া রহমাতুল্লাহ

প্রিয়ভাজনেষু

ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন-এর অনুবাদ দেখে অত্যন্ত খুশী হয়েছি। ফিক্বহ ও হাদীছের আলোচনা এবং ইসলামী বিধি-বিধানের তাৎপর্য বিষয়ে পরবর্তী আলেমদের কোন গ্রন্থ এরূপ গবেষণামূলক ও উপকারী নয়। যে মর্যাদা এ গ্রন্থটি লাভ করেছে। আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন যে, আপনি এই কল্যাণকর দ্বীনী খিদমতের দিকে মনোনিবেশ করেছেন। যারা ধর্মীয় বিষয়ে  জানার আগ্রহ রাখে এবং মূল আরবী গ্রন্থ পড়তে পারে না আমি তাদেরকে পরামর্শ দেব তারা যেন অবশ্যই এ গ্রন্থটি অধ্যয়ন করে। যদিচ ইসলামের অভ্যন্তরীণ মাযহাব ও সম্প্রদায় সমূহের ঝগড়া সম্পর্কে সাধারণত মুসলমানরা অনবগত নয়। এজন্য অনেক সময় মাযহাবের প্রতি তাদের আকর্ষণ ভুল পথে পরিচালিত হয়। এ গ্রন্থ পাঠ করলে তাদের নিকট পরিস্কার হয়ে যাবে যে, প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের সঠিক পথ কোন মানুষদের পথ? কুরআন ও সুন্নাহর অনুসারীদের, না বিতর্ক ও মতভেদকারীদের? স্বয়ং ই‘লাম প্রণেতা তাঁর ‘ক্বাছীদায়ে নূনিয়া’য় অত্যন্ত চমৎকারভাবে বলেছেন-

اَلْعِلْمُ قَالَ اللهُ قَالَ رَسُوْلُهُ * قَالَ الصَّحَابَةُ هُمْ أُوْلُو الْعِرْفَانِ

مَا الْعِلْمُ نَصْبَكَ لِلْخِلاَفِ سَفَاهَةً * بَيْنَ النُّصُوْصِ وَبَيْنَ رَأْيِ فُلاَنِ

‘আল্লাহ ও রাসূলের বাণীই ইলমে দ্বীন। যা জ্ঞানী-গুণী ছাহাবীদের মুখ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। অজ্ঞতাবশতঃ কুরআন ও সুন্নাহর মুকাবিলায় কারো রায়কে প্রাধান্য দিয়ে মতভেদে লিপ্ত হওয়া ইলমে দ্বীন নয়’।

এই গ্রন্থের অনুবাদ গ্রন্থাকারে প্রকাশের প্রয়োজন ছিল। বর্তমান এই পরিস্থিতি অত্যন্ত দুঃখজনক যে, এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় কাজের প্রতি সামর্থ্যবান ও দানশীল ব্যক্তিদের ভ্রূক্ষেপ নেই। আশা করি, অতি দ্রুত এমন সুযোগ সৃষ্টি হবে যে আপনি এটা প্রকাশ করতে পারবেন। হাফেয ইমামুদ্দীন ইবনু কাছীরের তাফসীর উর্দূতে অনুবাদ করে প্রকাশ করেও আপনি দারুণ একটা কাজ করেছেন। পরবর্তীদের তাফসীরের ভান্ডারে এটি সবচেয়ে ভাল তাফসীর।

আশা রাখি যে, সামর্থ্যবান ও দানশীল ভাইয়েরা এ ব্যাপারে আপনাকে সহযোগিতা করবেন।

আবুল কালাম আযাদ

কলকাতা

১৬.০৪.১৯৩৬ইং।[5]

৩. খুৎবাতে মুহাম্মাদী :

খুৎবাতে মুহাম্মাদী মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী রচিত পাঁচ খন্ডে সমাপ্ত এক অনন্য ও অসাধারণ গ্রন্থ। এতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর এক হাযারের বেশী খুৎবা রয়েছে। প্রায় পাঁচশ শিরোনামে বিন্যস্ত এ গ্রন্থে দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন বিষয়ের আলোচনা সন্নিবেশিত হয়েছে। এটি জুনাগড়ীর জীবনের সর্বশেষ রচনা। এ গ্রন্থটি এতটা জনপ্রিয় ছিল যে, তাঁর জীবদ্দশাতেই অল্প সময়ের মধ্যেই এর সকল কপি শেষ হয়ে যায়। ১৯৪১ সালে জুনাগড়ীর মৃত্যুর পর ১৯৫৩ সালে করাচীর মুহাম্মাদী রোডে অবস্থিত ‘শাম‘এ ইসলাম’ ও ‘মাকতাবা শু‘আইব’ থেকে এটি প্রকাশিত হয়েছিল। পরবর্তীতে মুম্বাইয়ের ‘বাযমে মুহাম্মাদী’ সংস্থা থেকে এটি অত্যন্ত সুন্দরভাবে প্রকাশিত হয়।[6] মাওলানা মুখতার আহমাদ নাদভী প্রতিষ্ঠিত আদ-দারুস সালাফিইয়াহ, মুম্বাই থেকে ২০০০ সালের নভেম্বর মাসে এর একটি চমৎকার অখন্ড (পাঁচ খন্ড এক সাথে) সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এ সংস্করণের সর্বমোট পৃষ্ঠা সংখ্যা ৯০২। এতে নাদভী লিখিত সংক্ষিপ্ত অথচ পান্ডিত্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

‘খুৎবাতে মুহাম্মাদী’ সংকলনের পিছনে দু’টি কারণ সক্রিয় ছিল বলে মনে হয়। ১. মাওলানা জুনাগড়ী নিজে জাদরেল খতীব ও বাগ্মী ছিলেন। ‘খতীবে হিন্দ’ রূপে তাঁর খ্যাতি ছিল তুঙ্গে। তাঁর যাদুকরী বক্তব্য শ্রোতামন্ডলী গভীর মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করত। খুৎবা দেয়ার সময় তিনি নিজে কাঁদতেন এবং অন্যদেরকেও কাঁদাতেন। অন্যরাও তাঁর মতো দক্ষ বাগ্মী ও খতীব হৌক এটা তার মনষ্কামনা ছিল। এজন্যই তিনি খুৎবাতে মুহাম্মাদী রচনা করেন।

২. বিভিন্ন বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রদত্ত খুৎবাগুলি আরবীতে। এজন্য উর্দূভাষী জনগণের সামনে সেগুলি পাঠ করার সময় তেমন একটা প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যেত না এবং তাদের মধ্যে কোন জাযবা সৃষ্টি হত না। মনে হয় কবরস্থানে অথবা ঘুমের সাগরে নিমজ্জিত কোন গ্রামে এগুলি পাঠ করা হচ্ছে। শ্রোতারা যেন মৃত বা স্বপ্নের ঘোরে বিভোর। উর্দূভাষীদের এহেন দুর্দশা দেখে জুনাগড়ী হাদীছের বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে এগুলি চয়ন করে উর্দূতে অনুবাদ করে দেন। যাতে শ্রোতাদের বুঝতে সুবিধা হয়।

উক্ত খুৎবা সংকলনের ইলমী মর্যাদা সম্পর্কে মারকাযী জমঈয়তে আহলেহাদীছ, হিন্দ-এর সাবেক আমীর মাওলানা মুখতার আহমাদ নাদভী বলেন, ‘সাধারণভাবে জুম‘আর খুৎবার যে সকল সংকলন উর্দূতে পাওয়া যায় সেগুলি সাধারণত খুবই অগভীর, মানহীন এবং অনির্ভরযোগ্য। কিচ্ছা-কাহিনী ও কবিতায় ভরপুর সেসব খুৎবাগুলিতে না আছে যুগের চাহিদার প্রতি খেয়াল, আর না আছে আধুনিক যুগের সমস্যা সমূহ সম্পর্কে দিকনির্দেশনা ও পর্যালোচনা। এগুলি শুনে শ্রোতাদের উপর কবরস্থানের মতো এক অদ্ভূত নীরবতা বিরাজ করে। কিন্তু ‘খুৎবাতে মুহাম্মাদী’র ভাষা এত মধুর যে, পাঠক ও শ্রোতা উভয়ের উপরেই সমান প্রভাব পড়ে। মানুষ অনুভব করে যে, কোন জাদুকরী বর্ণনার অধিকারী খতীব নিজের সুমধুর বর্ণনার জাদু দেখাচ্ছেন এবং খুৎবার প্রতিটি শব্দ মনের মধ্যে গেঁথে যায়।

ইসলামী শরী‘আতের এমন কোন বিষয় বাকী নেই যে বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) খুৎবা দেননি। তাঁর খুৎবা সমূহের এ সকল বিক্ষিপ্ত মুক্তাগুলিকে এ সংকলনে একটি আকর্ষণীয় হারের মতো সুন্দরভাবে গেঁথে দেয়া হয়েছে’।[7]

অনুবাদক জুনাগড়ী :

মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ অনুবাদক ছিলেন। উর্দূ তাঁর মাতৃভাষা ছিল না। তথাপি তিনি উর্দূ ভাষায় অসংখ্য গ্রন্থ রচনা ও অনুবাদ করে যে দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন তা রীতিমত বিস্ময়কর। এর মাধ্যমে তিনি উর্দূ ভাষা ও সাহিত্যের সমৃদ্ধিসাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর উর্দূতে অনূদিত গ্রন্থের ভাবা-ভাষা সহজ-সরল, সাবলীল ও উচ্চ সাহিত্যিকমান সমৃদ্ধ। তাফসীর ইবনে কাছীর ও ই‘লামুল মুওয়াক্কি‘ঈন ছাড়াও তিনি যেসব গ্রন্থ আরবী থেকে উর্দূতে অনুবাদ করেছেন সেগুলি নিম্নরূপ:

১. সুন্নাতে মুহাম্মাদী : প্রখ্যাত মুহাদ্দিছ মাওলানা মুহাম্মাদ হায়াত সিন্ধী রচিত ‘ফাতহুল গাফূর ফী ওয়ায‘ইল আয়দী আলাছ ছুদূর’ শীর্ষক মূল্যবান পুস্তিকার অনুবাদ এটি। এ গ্রন্থে ছালাতে বুকের উপর হাত বাঁধার ৪০টি দলীল পেশ করা হয়েছে। সাথে সাথে এ ব্যাপারে যেসব অভিযোগ রয়েছে সেগুলির জবাব এবং নাভীর নীচে হাত বাঁধার হাদীছ ছহীহ না হওয়ার প্রমাণ পেশ করা হয়েছে। গ্রন্থাকারে প্রকাশের পূর্বে এটি ‘আখবারে মুহাম্মাদী’ পত্রিকার ৮ম বর্ষে প্রবন্ধাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। তারপর ১৩৬৪ হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এর মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা ৮।[8]

২. বুরহানে মুহাম্মাদী : শায়খ তাকিউদ্দীন সুবকী রচিত ‘জুযউ রাফ‘ইল ইয়াদায়েন’ গ্রন্থের অনুবাদ এটি। আরবী টেক্সট ও উর্দূ অনুবাদসহ এর মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা ১০। এ গ্রন্থে রাফ‘ঊল ইয়াদায়েন করার হাদীছ সমূহ সংকলন পূর্বক প্রমাণ করা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমৃত্যু রাফ‘ঊল ইয়াদায়েন করেছেন। চার খলীফা, আশারায়ে মুবাশ্শারাহ (জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশ জন ছাহাবী) ও ছাহাবায়ে কেরাম রাফ‘ঊল ইয়াদায়েন করতেন। শাওয়াল ১৩৫৫ হিঃ/জানুয়ারী ১৯৩৭ সালে এটি প্রথম প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটির শেষে নিম্নোক্ত আছারটি উল্লেখ করা হয়েছে- أَن بن عُمَرَ كَانَ إِذَا رَأَى رَجُلًا لَا يَرْفَعُ يَدَيْهِ إِذا ركع وَإِذا رفع رَمَاه بالحصا ‘রুকূতে যাওয়ার সময় ও রুকূ হতে উঠার সময় ইবনু ওমর (রাঃ) কাউকে রাফ‘ঊল ইয়াদায়েন করতে না দেখলে তাকে ছোট পাথর ছুঁড়ে মারতেন’।[9]

৩. ফাযাইলে মুহাম্মাদী : মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী (রহঃ) উক্ত শিরোনামে খতীব বাগদাদী (রহঃ)-এর বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ ‘শারফু আছহাবিল হাদীছ’ (আহলেহাদীছদের মর্যাদা)-এর উর্দূ অনুবাদ করেছেন। মদীনা মুনাওয়ারার লাইব্রেরীতে এর পান্ডুলিপি মজুদ ছিল। মাওলানা জুনাগড়ী হজ্জে গিয়ে সেটি কপি করে আনেন এবং উর্দূ অনুবাদসহ আরবী মতন (Text) প্রকাশ করেন।[10]

৪. ঈমানে মুহাম্মাদী : ইমাম বায়হাকী (রহঃ) ‘শু‘আবুল ঈমান’ নামে ঈমানের শাখা-প্রশাখা বিষয়ে একটি মূল্যবান হাদীছ গ্রন্থ সংকলন করেন। ইমাম আবু জা‘ফর ওমর কাযবীনী ‘মুখতাছার শু‘আবুল ঈমান’ শিরোনামে এটি সংক্ষিপ্ত করেন। মাওলানা জুনাগড়ী ‘ঈমানে মুহাম্মাদী’ শিরোনামে সেটি উর্দূতে অনুবাদ করে রবীউল আউয়াল ১৩৪৬ হিজরীতে প্রকাশ করেন। গ্রন্থটি অনুবাদের কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে জুনাগড়ী নিজেই বলেছেন, ‘মুসলমান বাচ্চাদেরকে ছোট থেকেই ইসলামের বিধান ছালাত-ছিয়াম এর তা‘লীম দেয়া উচিত মনে করে ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের উপর আমি ছোট ছোট পুস্তিকা লিপিবদ্ধ করেছি। আল্লাহর শোকর যে, তিনি এগুলির কবূলিয়াত (গ্রহণযোগ্যতা) দান করেছেন। অনেকবার সেগুলি মুদ্রিত হয়েছে। যখন ঈমান সম্পর্কে গ্রন্থ রচনার ইচ্ছা পোষণ করি তখন এ বিষয়ে ইমাম বায়হাকী (রহঃ)-এর শু‘আবুল ঈমান এর সংক্ষিপ্ত গ্রন্থের উপর দৃষ্টি পড়ে। এ বরকতপূর্ণ গ্রন্থে ঈমানের সকল শাখা-প্রশাখার বিবরণ ছিল। এজন্য আমি এর অনুবাদ করাই যথোপযুক্ত মনে করি। বস্ত্ততঃ তা অনুবাদ করি। এটা মুদ্রিত হয়ে মানুষের হাতে হাতে চলে যায়। এখন এটা দ্বিতীয়বার ছাপাচ্ছি। আল্লাহ আমার এই সামান্য খিদমতটুকু কবুল করুন, আমাদের সবাইকে এর উপর আমল করার তৌফিক দিন এবং আমাদেরকে দুনিয়া থেকে ঈমানের সাথে উঠিয়ে নিন। আমীন ইয়া রববাল আলামীন।[11] সূচীপত্রের পর এতে তিনি ইমাম বায়হাকীর জীবনী লিপিবদ্ধ করেছেন।[12] এর সর্বমোট পৃষ্ঠা সংখ্যা ৬৫।

৫. ইমামে মুহাম্মাদী : খতীব বাগদাদী রচিত ‘তারীখু বাগদাদ’ গ্রন্থের ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর জীবনী অংশটুকু তিনি উক্ত শিরোনামে উর্দূতে অনুবাদ করেন। এতে আবু হানীফা (রহঃ)-এর সমসাময়িক এবং পরবর্তী ইমাম ও মুজতাহিদগণ কর্তৃক ইমাম ছাহেবের সমালোচনা রয়েছে। ইমাম ছাহেবের ভুল ফৎওয়াগুলির খন্ডনও এতে রয়েছে। মোটকথা, প্রশংসা ও সমালোচনা সবই আছে।[13]

৬. আক্বাইদে মুহাম্মাদী : এটি ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রচিত ‘আস-সুন্নাহ’ গ্রন্থের উর্দূ অনুবাদ। আক্বীদা বিষয়ে এটি এক অনন্য গ্রন্থ।

৭. সীরাতে মুহাম্মাদী : ইবনু জারীর ত্বাবারী (২২৪-৩১০ হিঃ) রচিত ‘খুলাসাতুস সিয়ার’ গ্রন্থের উর্দূ অনুবাদ এটি। মূল আরবী সহ তিনি এর উর্দূ অনুবাদ প্রকাশ করেন।[14]

অন্যান্য রচনা :

১. সায়ফে মুহাম্মাদী : এ গ্রন্থে তিনি হানাফী মাযহাবের এমন ৬০০ মাসায়েল একত্রিত করেছেন, যা কুরআন-হাদীছের বিরোধী। প্রত্যেকটি মাসআলায় হানাফীদের যত দলীল আছে তা উল্লেখ করে সেগুলির যথোপযুক্ত উত্তর প্রদান করা হয়েছে। এটি রবীউল আখের ১৩৪৮হিঃ/১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লীর আযাদ বারকী প্রেস থেকে মুদ্রিত হয়। মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৩৯।

২. হেদায়াতে মুহাম্মাদী : এতে হানাফী ফিক্বহের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘হেদায়া’তে বর্ণিত ১০০টি মাসায়েল আলোচনা করেছেন, যা হাদীছ বিরোধী। ১৯২৮ সালে এর ৩য় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৮। এ গ্রন্থের শেষে তিনি উদাত্ত আহবান জানিয়ে বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক মুসলিমকে কুরআন ও হাদীছের আনুগত্য করার চেতনা ও আগ্রহ দান

করুন এবং আপোসে একে অন্যের সকল কথা মান্য করাকে নিজের উপর ফরয জেনে তাকে রব বানানো থেকে বাঁচান! আমীন!![15]

৩. শাম‘এ মুহাম্মাদী : ‘ইযহারুত ত্বইয়িব ওয়াল খাবীছ বিতাকাবুলিল ফিক্বহ ওয়াল হাদীছ’ ওরফে ‘শাম‘এ মুহাম্মাদী’ গ্রন্থে তিনি ১৫৬টি হাদীছ সংকলন করেছেন এবং সাথে সাথে তার বিপরীত হানাফী মাসায়েল উল্লেখ করেছেন (পৃঃ ২০-৯৮)। বইটির মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা ১১৬। বইয়ের শেষের দিকে ‘তাহকীক ওয়া তাক্বলীদ পর এক নযর বেতওরে খাতেমা কে’ শিরোনামে তাহকীক ও তাক্বলীদ সম্পর্কে চমৎকার আলোচনা করেছেন।[16]

৪. ত্বরীকে মুহাম্মাদী : এতে কুরআন, হাদীছ ও ফিক্বহ গ্রন্থাবলী থেকে তাক্বলীদের খন্ডনে ৬০০ দলীল একত্রিত করেছেন এবং তাক্বলীদের ক্ষতি বর্ণনা করেছেন। মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩০৪। মাওলানা আবু সুহাইল আনছারীর পাদটীকা এবং জামে‘আ আলিয়া আরাবিয়া, মৌ-এর হাদীছ ও ফিক্বহ-এর শিক্ষক মাওলানা আব্দুল লতীফ আছারীর তাহকীক ও তা‘লীক সহ আহলেহাদীছ একাডেমী, মৌনাথভঞ্জন থেকে ২০০৮ সালের জুলাইয়ে এর তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এতে মূল্যবান মতামত পেশ করেন আল্লামা ছফিউর রহমান মুবারকপুরী।

৫. ইরশাদে মুহাম্মাদী : এটি মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রচিত ‘আল-ইকতিছাদ ফিত-তাক্বলীদ ওয়াল ইজতিহাদ’ গ্রন্থের জবাবে লিখিত। তাছাড়া এতে মাওলানা থানবীর ‘বেহেশতী যেওর’ কিতাবের ৫০টি ভুল আলোচনা করা হয়েছে। দিল্লী ছাপা ১৩৫৬ হিঃ/১৯৩৭ খ্রিঃ। মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা ৮৪।[17]

(ক্রমশঃ)




[1]. মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী: হায়াত ও খিদমাত, পৃঃ ৪৫-৫০

[2]. কুরআনে কারীম মা‘আ উর্দূ তরজমা ওয়া তাফসীর (মদীনা মুনাওয়ারাহ : বাদশাহ ফাহাদ কুরআন প্রিন্টিং কমপ্লেক্স), শায়েখ ছালেহ বিন আব্দুল আযীয বিন মুহাম্মাদ আলে শায়খ লিখিত ভূমিকা দ্রঃ; ইমাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব কী দাওয়াত, পৃঃ ৬৩-৬৪

[3]. মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী, পৃঃ ৫৫-৫৬।

[4]. চালীস ওলামায়ে আহলেহাদীছ, পৃঃ ১৬০-১৬১।

[5]. মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী, পৃঃ ৫৭-৫৮।

[6]. ঐ, পৃঃ ৬৬-৬৭

[7]. মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী, খুৎবাতে মুহাম্মাদী, ভূমিকা ও শুদ্ধিকরণ : মাওলানা মুখতার আহমাদ নাদভী (মুম্বাই : আদ-দারুস সালাফিইয়াহ, ৪র্থ সংস্করণ, নভেম্বর ২০০০), পৃঃ ৪

[8]. মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী, সুন্নাতে মুহাম্মাদী (বাড়া হিন্দুরাও, দিল্লী : দফতরে আখবারে মুহাম্মাদী, ১ম প্রকাশ, ১৩৬৪ হিঃ), পৃঃ ২-৮

[9]. মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী, বুরহানে মুহাম্মাদী (দিল্লী : জাইয়েদ বারকী প্রেস, ১৩৫৫ হিঃ/১৯৩৭ খ্রিঃ), পৃঃ ১০

[10]. মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী, পৃঃ ৫৪

[11]. মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী, ঈমানে মুহাম্মাদী (দিল্লী : জাইয়েদ বারকী প্রেস, ১৩৪৬ হিঃ), পৃঃ ২

[12]. ঐ, পৃঃ ৬-৮

[13]. মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী, পৃঃ ৫৪

[14]. ঐ, পৃঃ ৫৩, ৫৫

[15]. মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী, হেদায়াতে মুহাম্মাদী, পৃঃ ১৮।

[16]. মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী, শাম‘এ মুহাম্মাদী (দিল্লী : জাইয়িদ বারকী প্রেস, শাওয়াল ১৩৫৩ হিঃ/১৯৩৭ খ্রিঃ), পৃঃ ৯৯-১১৬

[17]. চালীস ওলামায়ে আহলেহাদীছ, পৃঃ ১৬৬





শেরে পাঞ্জাব, ফাতিহে কাদিয়ান মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী (রহঃ) - ড. নূরুল ইসলাম
মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ)-এর ব্যাপারে কিছু আপত্তি পর্যালোচনা - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) (৩য় কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
মাওলানা আব্দুর রঊফ ঝান্ডানগরী - ড. নূরুল ইসলাম
মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ)-এর ব্যাপারে কিছু আপত্তি পর্যালোচনা (২য় কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
শেরে পাঞ্জাব, ফাতিহে কাদিয়ান মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী (রহঃ) (শেষ কিস্তি) - ড. নূরুল ইসলাম
মাওলানা আব্দুস সালাম মুবারকপুরী : মুবারকপুরের এক ইলমী নক্ষত্র - ড. নূরুল ইসলাম
ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (রহঃ) (২য় কিস্তি) - ড. নূরুল ইসলাম
মাওলানা আব্দুল্লাহ মাদানী ঝান্ডানগরী - ড. নূরুল ইসলাম
মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী (রহঃ) (শেষ কিস্তি) - ড. নূরুল ইসলাম
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) - ড. নূরুল ইসলাম
যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) (৬ষ্ঠ কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
আরও
আরও
.