ভূমিকা :

মানবীয় কর্ম যতই উন্নত হৌক না কেন, রচয়িতা যতই সতর্ক হৌন না কেন সেখানে ভুলভ্রান্তি কিছু থাকবে এটাই মানবীয় ফিতরাতের অন্তর্ভুক্ত। মানুষের এই সৃষ্টিগত অক্ষমতার দিকে ইঙ্গিত করে ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেছেন, أبى الله ان يصح إلا كتابه ‘আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় কিতাব কুরআন ব্যতীত অন্য কিছুকে বিশুদ্ধ জ্ঞান করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন’। শায়খ আলবানী (রহঃ) জীবনের অধিকাংশ সময় প্রভূত ধৈর্য ও উদ্দীপনা নিয়ে তাহক্বীক্বী ময়দানে লিপ্ত ছিলেন। প্রায় ৬০ বছর যাবৎ তাছনীফ, তাখরীজ, তাহক্বীক্ব ও তা‘লীকের কাজে ব্যাপৃত থেকেছেন। কিন্তু তিনিও মানবীয় বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী সমালোচনা ও পর্যালোচনার সম্মুখীন হওয়া থেকে রেহাই পাননি। সমসাময়িক কিছু বিদ্বানসহ একদল মানুষ তাঁর নানা সমালোচনায় লিপ্ত হয়েছেন।

মূলত : দুনিয়ার প্রত্যেক মহৎ ব্যক্তির ব্যাপারে তিন শ্রেণীর মানুষ থাকে- (১) তাঁর প্রতিটি কথাকে সঠিক হিসাবে গ্রহণকারী এবং তাঁর একনিষ্ঠ প্রশংসাকারী। (২) তাঁর প্রতি হিংসা পোষণকারী ও মানুষের মাঝে তাঁর প্রতি বিদ্বেষ সৃষ্টিকারী। (৩) উদারপন্থী ও মধ্যমপন্থী, যারা তাঁর ভাল দিকগুলোর স্বীকৃতি প্রদান করেন এবং তাঁর ভুলগুলো সংশোধনের প্রয়াস পান, যেন পরবর্তীগণ একই ভুলে পতিত না হন। সাথে সাথে এটাও মনে করেন যে, মানুষ হওয়ার দরুন তাঁর ভুলও হ’তে পারে। সুতরাং তাঁর ভাল কর্ম ও অপরিসীম খেদমতের দৃষ্টিকোণ থেকে তারা তাঁকে স্রেফ সমালোচনা ও পর্যালোচনার লক্ষ্যবস্ত্ত বানান না। তবে তাঁর ভুলগুলো সম্পর্কে সতর্ক করার ব্যাপারেও কোন দ্বিধা করেন না। বরং জ্ঞানী ও ইনছাফকারীদের দায়িত্ব হ’ল, সাধারণ জনগণকে এরূপ ভুলসমূহ থেকে সাবধান করা এবং ইনছাফের সাথে ছিরাতে মুস্তাক্বীম-এর পথে নির্দেশনা দান করা। সালাফে ছালেহীন এই নীতিরই অনুসরণ করে গেছেন।

শায়খ আলবানী সম্পর্কেও উক্ত তিন শ্রেণীর মানুষ পাওয়া যায়। তাই তাঁর প্রশংসাকারী ও অন্ধ অনুসারীর সংখ্যা যেমন অগণিত, তেমনি তাঁর প্রতি বিদ্বেষ-পোষণকারী ও তাঁর সমালোচকের সংখ্যাও কম নয়। তাই একদিকে যেমন তাঁর জীবন পরিক্রমা, চিন্তাধারা ও অবদান সম্পর্কে শতাধিক গ্রন্থ রচিত হয়েছে। অন্যদিকে তাঁর সমালোচনা ও ভুল-ত্রুটি বিশ্লেষণেও বহু গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচিত হয়েছে।

তাঁর সমালোচকদের মধ্যে রয়েছেন প্রসিদ্ধ আলেম ও মুহাক্কিক শু‘আইব আরনাঊত্ব, মুছত্বফা আ‘যমী, ইসমাঈল আনছারী, আহমাদ আল-গুমারীর মত বিদ্বান। তন্মধ্যে প্রথমজন এব্যাপারে একটি সাক্ষাৎকারে বেশ কিছু সমালোচনা পেশ করেছেন।[1] যার জবাবে প্রবন্ধ লিখেছেন পাকিস্তানের প্রখ্যাত মুহাদ্দিছ শায়খ ইরশাদুল হক আছারী, যা করাচীর ‘মাসিক বাইয়েনাত’ পত্রিকার ৭৭তম বর্ষ ৮ম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।[2] হাবীবুর রহমান আ‘যমী স্বীয় ‘আল-আলবানী শুযূযুহু ওয়া আখত্বাউহূ’ গ্রন্থে তাঁর বেশ কিছু সমালোচনা তুলে ধরেছেন।[3] আর অন্য লেখকগণ এ ব্যাপারে তাদের বিভিন্ন গ্রন্থে আলোচনা করেছেন। এক্ষণে সেগুলো থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সমালোচনা ও তার যৌক্তিকতা সম্পর্কে আলোকপাত করা হ’ল-

১. হাদীছের হুকুম প্রদানের ক্ষেত্রে স্ববিরোধিতা ও নানা ভুলভ্রান্তি :

শায়খ হাবীবুর রহমান আ‘যমী ও সাইয়েদ হাসান ইবনু আলী আস-সাক্কাফ সহ কিছু বিদ্বান আলবানীর ব্যাপারে উক্ত অভিযোগ আরোপ করেছেন।

মূলত : কারো কোন ফৎওয়া বা মতামত প্রদান করার পর যদি তার নিকটে তা ভুল হিসাবে প্রতিভাত হয়, তবে তা থেকে ফিরে আসাই ন্যায়পরায়ণতার দাবী। সেকারণে ন্যায়পরায়ণ ও আমানতদার ওলামায়ে কেরামের সার্বজনীন বৈশিষ্ট্য হ’ল, সত্যের উপর দৃঢ় থাকা এবং ভুল থেকে ফিরে আসা, যদিও তা নিজ সিদ্ধান্তের বিপরীত হয়। সালাফে ছালেহীন এপথেই পরিচালিত হয়েছেন। ওমর (রাঃ) আবু মূসা আশ‘আরীর উদ্দেশ্যে লিখিত পত্রে বলেছিলেন, ‘আপনি একদিন যে রায় প্রদান করেছেন (তাতে ভুল ধরা পড়লে) তা নিজের যথার্থ বুদ্ধিমত্তার দ্বারা পরিবর্তন করে সঠিক রায় প্রদান করতে বিলম্ব করবেন না। কেননা সত্য চিরন্তন। কোনকিছু তা বাতিল করতে পারে না। আর সত্যের দিকে ফিরে আসা বাতিলের ওপর অনড় থাকার চেয়ে বহুগুণ উত্তম’।[4] সেকারণ ‘যখন ছহীহ হাদীছ পাবে, জেনে রেখো সেটাই আমার মাযহাব’ যুগে যুগে ওলামায়ে কেরাম এ নীতির উপরেই পরিচালিত হয়েছেন। 

শায়খ আলবানী তাঁর সুদীর্ঘ গবেষণাকালে হাযার হাযার হাদীছের তাখরীজ করেছেন এবং হুকুম সাব্যস্ত করেছেন। এর মধ্যে অনেক হাদীছের ক্ষেত্রে তিনি প্রথমে কোন হুকুম প্রদান করেছেন। পরবর্তীতে তা ভুল সাব্যস্ত হওয়া বা কোন শক্তিশালী দলীল পাওয়ার ভিত্তিতে মত পরিবর্তন করে ভিন্ন হুকুম প্রদান করেছেন। যেমন কোন গ্রন্থে কোন হাদীছকে যঈফ বলেছেন। পরবর্তীতে তাঁর রচিত অন্য গ্রন্থে বা উক্ত গ্রন্থের পরবর্তী সংস্করণে তা পরিবর্তন করে ছহীহ বলেছেন। এক্ষেত্রে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ নীতি ছিল العلم لا يقبل الجمود ‘জ্ঞান স্থবিরতাকে গ্রহণ করেনা’।

ভুল স্বীকার এবং নিজ গ্রন্থে তা প্রকাশ করার এ নীতি শায়খ আলবানীর একটি ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য। উপরন্তু কেউ ভুল ধরিয়ে দিলে তিনি তার প্রতি শুকরিয়া জ্ঞাপন করতেন। যেমন একটি ভুলের ক্ষেত্রে আলবানী বলেন, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ঐ বান্দার উপর রহম করুন, যিনি আমাকে আমার ভুলগুলো ধরিয়ে দিয়েছেন এবং আমার দোষ-ত্রুটি সম্পর্কে অবহিত করেছেন। কেননা এর ফলে আমার জন্য ভুল থেকে ফিরে আসা সহজ হয়েছে। আমার প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থাবলী এবং তার মধ্যে যেগুলোর পরবর্তী সংস্করণ প্রকাশ পেয়েছে, সেগুলো এরূপ পরিবর্তনের বড় দলীল। তিনি বলেন, যারা আমার বা অন্যান্য বিদ্বানদের ভুল ধরতে চান তাদের ব্যাপারে আমার নছীহত হ’ল, আমার লেখনীর ভুল-ত্রুটি এবং সঠিক চিন্তাধারার সীমা অতিক্রমের ব্যাপারে আমাকে অবহিত করুন। তবে খন্ডনের আদর্শ যেন নছীহত, পথপ্রদর্শন এবং হকের প্রতি উপদেশ হয়। হিংসা-বিদ্বেষপূর্ণ না হয়। কেননা রাসূল (ছাঃ)-এর বাণী অনুযায়ী তা দ্বীনের মূলোৎপাটনকারী।[5]

‘যিলালুল জান্নাহ ফী তাখরীজিস সুন্নাহ’ গ্রন্থে একটি হাদীছের ব্যাপারে তিনি বলেছেন, ‘আস-সুন্নাহ’ গ্রন্থের লেখক যে হাদীছের দিকে ইশারা করেছেন, তা আমি জানি না। অন্যদিকে একই গ্রন্থে তাঁর নিজস্ব পান্ডুলিপিতে লিখেছেন, ‘হাদীছটি ত্বাবারাণী যঈফ সনদে আবুদ্দারদা থেকে বর্ণনা করেছেন। দেখুন- মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ (১/৩৩৩)। আমার এই ভুলটি ধরিয়ে দিয়েছেন আব্দুল্লাহ আদ-দুওয়াইশ। আল্লাহ তার উপর রহম করুন ও তাকে উত্তম প্রতিদানে ভূষিত করুন’।[6]

কিছু মত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে তিনি নিজেই উল্লেখ করেছেন। আর কিছু পরবর্তী গবেষকগণ চিহ্নিত করেছেন। যেমন ইবনু কুতায়বা থেকে বর্ণিত হাদীছ الأنبياء صلوات الله عليهم أحياء في قبورهم يصلون ‘নবীগণ তাদের কবরে জীবিত এবং সেখানে তারা ছালাত আদায় করেন’-এর ব্যাপারে তিনি বলেন, ইমাম বায়হাক্বীর বক্তব্য অনুযায়ী ইবনু কুতায়বা হাদীছটি এককভাবে বর্ণনা করেছেন মনে করে আমি তা যঈফ বলে ধারণা করতাম। অতঃপর আমি মুসনাদে আবী ইয়া‘লা এবং আখবারে ইস্ফাহান গ্রন্থদ্বয়ে উল্লেখিত সনদ তদন্ত করে নিশ্চিত হ’লাম যে, এর সনদ ‘শক্তিশালী’। ইবনু কুতায়বা কর্তৃক একক সনদে বর্ণিত বলে ধারণা করা ঠিক হয়নি। সেকারণ ইলমী আমানত আদায় ও দায়মুক্তির লক্ষ্যে আমি হাদীছটি সিলসিলা ছহীহায় সংকলন করলাম। যদিও এটা অজ্ঞ ও বিদ্বেষপরায়ণদের অন্যায় আক্রমণ, কুৎসা ও কটাক্ষের পথ খুলে দেবে। তবে যেহেতু আমি দ্বীনের আবশ্যকীয় দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি, তাই এসব সমালোচনার কোনই পরওয়া আমি করি না। বরং আমি আল্লাহর নিকট নেকীর আশা করি মাত্র। সুতরাং হে সম্মানিত পাঠক! আমার কোন রচনায় যদি এই তাহক্বীক্বের বিপরীত দেখতে পাও, তবে তা পরিত্যাগ কর এবং এই তাহক্বীক্বের উপরে নির্ভর কর।[7]

অতএব এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, শায়খ আলবানী (রহঃ) ভুল বুঝতে পারার পর তা থেকে ফিরে আসতে কুণ্ঠিত হন নি এবং ভুল ধরিয়ে দেওয়া ব্যক্তির প্রতি শুকরিয়া ও সম্মান জানাতেও কোনরূপ দ্বিধা করেননি।

উদাহরণ :

(১) কিছু হাদীছের ক্ষেত্রে মত পরিবর্তন সম্পর্কে আলবানী নিজেই উল্লেখ করেছেন। নিম্নে এরূপ কিছু উদাহরণ পেশ করা হ’ল।-

যঈফ থেকে ছহীহকরণ :

আদী ইবনু যায়েদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, حَمَى رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم كُلَّ نَاحِيَةٍ مِنَ الْمَدِينَةِ بَرِيدًا بَرِيدًا لاَ يُخْبَطُ شَجَرُهُ وَلاَ يُعْضَدُ إِلاَّ مَا يُسَاقُ بِهِ الْجَمَلُ ‘রাসূল (ছাঃ) মদীনার চতুষ্পার্শ্বের বার মাইল এলাকাকে সংরক্ষিত ঘোষণা করেছেন। অতএব সেখানকার বৃক্ষসমূহে আঘাত করা বা কর্তন করা যাবে না। তবে উট চরানোয় বাধা নেই’। উক্ত হাদীছটির সনদে সুলায়মান ইবনু কিনান ও আব্দুল্লাহ ইবনু আবি সুফিয়ান নামক দু’জন অপরিচিত রাবী থাকায় আলবানী প্রথমে হাদীছটিকে যঈফ (যঈফ আবূদাউদ, হা/৩৪৯) সাব্যস্ত করেন। কিন্তু পরবর্তীতে ছহীহ মুসলিম (হা/১৩৬৩) সহ আরো কয়েকটি গ্রন্থে এর শাহেদ বা সমর্থক হাদীছ পাওয়ায় মত পরিবর্তন করে হাদীছটিকে ‘ছহীহ’ সাব্যস্ত করেছেন (সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৩২৩৪)। যেমন তিনি বলেন, আবূদাঊদের উক্ত হাদীছটির সনদ যঈফ। কিন্তু পরবর্তীতে আমি এর দু’টি শাওয়াহেদ খুঁজে পেয়েছি, যার একটি ছহীহ। অতঃপর উক্ত হাদীছটি শাওয়াহেদসহ আমি ‘সিলসিলা ছহীহাহ’-তে সংকলন করেছি।[8]

হাসান থেকে যঈফকরণ :

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীছ, রাসূল (ছাঃ) বলেন, لِيَسْتَرْجِعْ أَحَدُكُمْ فِي كُلِّ شَيْءٍ حَتَّى فِي شِسْعِ نَعْلِهِ، فَإِنَّهَا مِنَ الْمَصَائِبِ ‘তোমাদের প্রত্যেকে যেন সকল কষ্টে ‘ইন্না লিল্লাহি...’ পাঠ করে। এমনকি জুতার ফিতা ছিঁড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও। কেননা সেটিও একটি বিপদ’।

হাদীছটির ব্যাপারে ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ)-এর الكلم الطيب গ্রন্থের তাহক্বীক্বে আলবানী বলেন, হাদীছটি হাসান। ইবনুস সুন্নী হাদীছটি যঈফ সনদে বর্ণনা করেছেন। তবে এর একটি

মুরসাল শাহেদ রয়েছে।

অতঃপর পরবর্তী সংস্করণে তিনি উক্ত বক্তব্যের সাথে যোগ করে বলেন, পরবর্তীতে আমার নিকটে স্পষ্ট হয় যে, এর সনদ ‘যঈফ জিদ্দান’ বা অতীব দুর্বল। আমার ইঙ্গিতকৃত শাহেদটি ভিন্ন অর্থবোধক। সিলসিলা যঈফাহ ৫৫৯৫ নম্বর হাদীছে বিস্তারিত এবং মিশকাতুল মাছাবীহ ১৭৬০ নম্বর হাদীছে এ সম্পর্কে কিছু আলোচনা পেশ করেছি।[9]

সিলসিলা যঈফাহ-তে উক্ত হাদীছ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার পর তিনি বলেন, এ হাদীছটি যঈফ হওয়ার ব্যাপারে ইবনুল ক্বাইয়িম স্বীয় ‘আল-ওয়াবিলুছ ছাইয়িব’ গ্রন্থে ইঙ্গিত করেছেন। একই কথা বলেছেন তাঁর উস্তায ইবনু তায়মিয়াহ স্বীয় ‘আল-কালিমুত ত্বাইয়িব’ গ্রন্থে। তাদের বক্তব্যই সঠিক। যদিও তা হাদীছটির চরম দুর্বলতার ব্যাপারে প্রথমে সচেতন না থাকার কারণে আমি যে মন্তব্য পেশ করেছিলাম তার বিরোধী (অর্থাৎ হাদীছটি হাসান সাব্যস্ত করে আমি ভুল করেছিলাম)। সেকারণ আমি দ্রুততার সাথে আমার নিজেকে ও আমার গ্রন্থের পাঠকগণকে নছীহতমূলকভাবে বলতে চাই যে, আমি আমার এ ভুলের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি। এর দায় সবটাই আমার। আর তিনি ক্ষমাশীল ও দয়াময়।[10] অর্থাৎ হাদীছটি ‘হাসান’ নয়, বরং যঈফ।

হাসান থেকে ছহীহকরণ :

‘গায়াতুল মারাম’ গ্রন্থের ৩৭৫ নং হাদীছে বলা হয়েছে যে, একবার এক বৃদ্ধা মহিলা রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে এসে আবেদন করলেন যে, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি আমার জন্য জান্নাত লাভের দো‘আ করুন। রাসূল (ছাঃ) বললেন, হে ওমুকের মা! জান্নাতে তো কোন বৃদ্ধ মানুষ প্রবেশ করবে না। একথা শুনে বৃদ্ধা খুবই উৎকন্ঠিত হ’লেন এবং কখনোই তিনি জান্নাতে যেতে পারবেন না ভেবে কাঁদতে শুরু করলেন। বৃদ্ধার অবস্থা দৃষ্টে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ব্যাখ্যা করে বললেন যে, কোন বৃদ্ধা বৃদ্ধাবস্থায় জান্নাতে প্রবেশ করবে না। বরং আল্লাহ তাদেরকে নতুন সৃষ্টিতে রূপান্তরিত করবেন। ফলে তারা পূর্ণযৌবনা ও কুমারী অবস্থায় জান্নাতে প্রবেশ করবে। এরপর তিনি কুরআনের এ আয়াতটি পড়ে শোনালেন,إِنَّا أَنْشَأْنَاهُنَّ إِنْشَاءً- فَجَعَلْنَاهُنَّ أَبْكَارًا- عُرُبًا أَتْرَابًا (আমরা তাদেরকে (জান্নাতী নারীদের) সৃষ্টি করেছি বিশেষ রূপে। অতঃপর তাদেরকে আমরা করেছি কুমারী, সোহাগিনী ও সমবয়সী)।

উক্ত হাদীছ সম্পর্কে আলবানী বলেন, হাদীছটি আমি সিলসিলা ছহীহাহ ২৯৮৭ নং হাদীছে إن الجنة لا يدخلها عجوز শব্দে উল্লেখ করেছি। তবে আমি হাদীছটি গায়াতুল মারামসহ কিছু রচনায় হাসান হিসাবে উল্লেখ করেছি। অতএব উপরোল্লিখিত ছহীহ হাদীছ এবং উক্ত আয়াতের তাফসীরে যা বর্ণিত হয়েছে তার কারণে হাদীছটি আরো শক্তিশালী হয়েছে।[11]

শব্দে বা স্থানে ভুল সংশোধন :

কোন কোন স্থানে আলবানী তাঁর অন্য গ্রন্থে উল্লিখিত হাদীছের বিভিন্ন ভুল সম্পর্কে ইঙ্গিত করেছেন। যেমন ছহীহুল জামে‘ হা/৭৫৯৯-এ তিনি জাবির (রাঃ) থেকে মারফূ‘ সূত্রে বর্ণিত لَا يَبِيتَنَّ رَجُلٌ عِنْدَ امْرَأَةٍ فِي بَيْتٍ إِلَّا أَنْ يَكُونَ نَاكِحًا أَوْ ذَا مَحْرَمٍ ‘কোন নারীর সাথে কোন গৃহে তার সাথে বিবাহিত স্বামী অথবা মাহরাম ব্যতীত কেউ যেন রাত্রি যাপন না করে’ হাদীছটি এনে ছহীহ সাব্যস্ত করেছেন। কিন্তু পরবর্তীতে একই অর্থবোধক হাদীছ সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩০৮৬-এ সংকলন করেছেন أَلاَ لاَ يَبِيتَنَّ رَجُلٌ عِنْدَ امْرَأَةٍ ثَيِّبٍ، إِلاَّ أَنْ يَكُونَ نَاكِحًا أو مَحْرَماً ‘(কোন বিবাহিতা নারীর সাথে তার স্বামী অথবা মাহরাম ব্যতীত কেউ যেন রাত্রি যাপন না করে)’ শব্দে। অতঃপর তিনি বলেন, আলোচ্য হাদীছে امرأةٍ ثيبٍ শব্দ এসেছে। যা ছহীহ মুসলিম, তারীখু বাগদাদ ও বায়হাক্বীর রেওয়ায়াতে এসেছে। আর আবূ ইয়া‘লা ও ইবনু হিববানের বর্ণনায় এসেছে, امرأت في بيت। বায়হাক্বীর একই রেওয়ায়াত ইবনু আবী শায়বা ও নাসাঈতে এসেছে। কিন্তু সেখানে امرأت في بيت أو ثيب ،কোন শব্দই নেই। তবে সম্ভবত মুসলিমের রেওয়ায়াতটি আসমা বিনতে ‘উমাইসের হাদীছের অনুরূপ হওয়ায় তা অধিক গ্রহণযোগ্য হবে। আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।

তবে ইমাম সুয়ূত্বী স্বীয় জামি‘ ছগীরে আবু ইয়া‘লার বর্ণনামতে امرأت في بيت শব্দে হাদীছটি এনেছেন। কিন্তু সূত্র হিসাবে ছহীহ মুসলিমের নাম উল্লেখ করেছেন। একইভাবে এসেছে ফাৎহুল ক্বাদীরে।[12]

(২) কিছু হাদীছের ক্ষেত্রে মত পরিবর্তনের ব্যাপারে আলবানী নিজে উল্লেখ করেননি। বরং পরবর্তী গবেষকগণ তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থের প্রকাশনার তারিখ পর্যবেক্ষণ করে পূর্বের ও পরের সিদ্ধান্তসমূহ চিহ্নিত করেছেন এবং মত পরিবর্তনের বিষয়টি নির্ধারণ করেছেন।

এরূপ পরিবর্তন সম্পর্কে অবহিত হওয়ার উপায় হ’ল, পূর্বে ও পরবর্তীতে রচিত ও পুনরায় তাহক্বীক্বকৃত গ্রন্থসমূহ সম্পর্কে সম্যক অবহিত হওয়া। যেমন غاية المرام في تخريج أحاديث الحلال والحرام গ্রন্থে আলবানী মোট ৯০টি হাদীছ যঈফ সাব্যস্ত করেছেন। কিন্তু পরবর্তীতে ২৬টি হাদীছের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে তিনি ছহীহ বা হাসান সাব্যস্ত করেছেন। ضعيف الجامع الصغير গ্রন্থে সংকলিত যঈফ হাদীছসমূহের মধ্যে ১৬১টি হাদীছকে তিনি পরবর্তীতে ছহীহ সাব্যস্ত করেছেন। صحيح الجامع الصغير গ্রন্থের ৮৫টি হাদীছকে তিনি পরবর্তীতে যঈফ সাব্যস্ত করেছেন। الثمر المستطاب في فقه السنة والكتاب গ্রন্থের ৭টি স্থানে হাদীছ ও ফিক্বহী বিষয়ে পরবর্তীতে তিনি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছেন। تخريج أحاديث مشكلة الفقر গ্রন্থে ১২টি হাদীছ তিনি যঈফ বলেছেন। কিন্তু পরবর্তীতে ৬টি হাদীছকে ছহীহ সাব্যস্ত করেছেন। মিশকাতুল মাছাবীহ-এর ১৫৪টি হাদীছের ব্যাপারে পরবর্তীতে মত পরিবর্তন করেছেন। এছাড়া মিশকাতুল মাছাবীহ, ইরওয়াউল গালীল, মুখতাছারুশ শামাইল, গায়াতুল মারাম প্রভৃতি গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণ (তাহক্বীক্ব ছানী) প্রকাশিত হয়েছে।[13]

উদাহরণ :

ছহীহ থেকে যঈফকরণ :

আলী (রাঃ) থেকে মাওকূফ সূত্রে বর্ণিত আছার أنه ذكر فةنا ةكون في آخر الزمان فقال له عمر مةى ذلك يا علي قال إذا ةفقه لغير الدين وةعلم العلم لغير العمل والةمسة الدنيا بعمل الآخرة। আলবানী আছারটিকে ছহীহ সাব্যস্ত করে ছহীহুত তারগীবের (হা/১০৭৬) অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। গ্রন্থটির তৃতীয় প্রকাশ পর্যন্ত তা এভাবেই ছিল। অতঃপর দারুল মা‘আরিফ থেকে নতুনভাবে ১ম সংস্করণ প্রকাশের সময় তিনি মত পরিবর্তন করেন এবং ছহীহুত তারগীব থেকে যঈফুত তারগীবে (হা/৮৮) স্থানান্তর করেন।[14]

যঈফ থেকে ছহীহকরণ :

ইবনু মাস‘ঊদ থেকে মারফূ‘ সূত্রে সুনান তিরমিযীতে সংকলিত হাদীছ اقتدوا باللذين من بعدي من أصحابي : أبي بكر وعمر واهتدوا بهدي عمار وتمسكوا بعهد ابن أم عبد ‘তোমরা আমার পরের দুইজন ব্যক্তির অনুসরণ কর। একথা বলে তিনি আবুবকর ও ওমর (রাঃ)-এর দিকে ইশারা করেন। আর তোমরা আম্মারের অনুসৃত পন্থা অনুসরণ কর এবং যে হাদীছ ইবনু মাস‘ঊদ তোমাদের কাছে বর্ণনা করে তা বিশ্বাস কর’। আলবানী হাদীছটি মিশকাতুল মাছাবীহ-এর ৬২২১ নং হাদীছের তাহক্বীক্বে যঈফ সাব্যস্ত করে বলেন, এর সনদে ইয়াহইয়া ইবনু সালামা নামে একজন যঈফ রাবী রয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে মাকতাবাতুল মা‘আরিফ থেকে প্রকাশিত ছহীহুত তিরমিযীতে এবং সিলসিলা ছহীহায় এটি ছহীহ সাব্যস্ত করেছেন।[15]

সিদ্ধান্ত পরিবর্তনকৃত হাদীছসমূহ নিয়ে প্রকাশিত বইসমূহ :

শায়খ আলবানীর এরূপ মত পরিবর্তন নিয়ে গবেষকগণ ইতোমধ্যে কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাদের মধ্যে একজন হ’লেন আব্দুল বাসিত ইবনু ইউসুফ। তার সংকলিত গ্রন্থটি হ’ল, الةنبيهاة المليحة على ما ةراجع عنه الألباني من الأحاديث الضعيفة أو الصحيحة।[16] এখানে তিনি কয়েকটি ভাগে আলোচনা পেশ করেছেন। ১ম ভাগে ঐ হাদীছসমূহ এনেছেন, যেখানে মত পরিবর্তনের বিষয়টি আলবানী নিজেই উল্লেখ করেছেন। ২য় ভাগে এনেছেন যে হাদীছসমূহ ভুলবশত কোন ছহীহ বা যঈফ সংকলনে থেকে গেছে। ৩য় ভাগে ঐ হাদীছগুলো এনেছেন, যেগুলো তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থের প্রকাশনার তারিখ পর্যবেক্ষণ করে, পূর্বের ও পরের সিদ্ধান্তসমূহ চিহ্নিত করা হয়েছে এবং তার ভিত্তিতে মত পরিবর্তনের বিষয়টি নির্ধারণ করা হয়েছে।

শায়খ ‘আওদা ইবনুল হাসান এরূপ সিদ্ধান্ত পরিবর্তনকৃত ৫০০ হাদীছ নিয়ে রচনা করেছেন ৫০০ حديث مما تراجع عنهم العلامة المحدث الألباني في كتبه। অপর গবেষক আবুল হাসান মুহাম্মাদ হাসান আশ-শায়খ রচনা করেছেন تراجع العلامة الألباني فيما نص عليه تصحيحًا وتضعيفًا ويليه تراجعه فيما ينص عليه مع زيادات ১৭৭ موضعا। এখানে তিনি মোট ৮২৬ টি হাদীছ সম্পর্কে দুই অধ্যায়ে আলোচনা পেশ করেছেন।[17] ১ম অধ্যায়ে যেসব হাদীছে মত পরিবর্তনের বিষয়ে আলবানী নিজেই আলোচনা করেছেন, সেগুলো চারটি অনুচ্ছেদে ভাগ করা হয়েছে। (১) যঈফ থেকে ছহীহকরণ (২) ছহীহ বা হাসান থেকে যঈফকরণ (৩) ছহীহ থেকে হাসান বা হাসান থেকে ছহীহকরণ (৪) হাদীছের বিভিন্ন শব্দে বা স্থানে সংঘটিত কিছু ভুল শুদ্ধিকরণ।

সিদ্ধান্ত পরিবর্তন ও ভুলভ্রান্তির সমালোচনায় রচিত বইসমূহ :

অনেক সমালোচক তাঁর এই মতপরিবর্তনকে পুঁজি করে তাঁর বিরুদ্ধে নানা সমালোচনা ও গীবত- তোহমত পেশ করেছেন, বইপুস্তক রচনা করেছেন এবং এর মাধ্যমে তাহক্বীক্বী ময়দানে তাঁর সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চেয়েছেন।

তাঁর সমালোচকদের মধ্যে সবচেয়ে বিদ্বেষপূর্ণ সমালোচক ছিলেন সাইয়েদ হাসান ইবনু আলী আস-সাক্কাফ। এ বিষয়ে তিনি যে গ্রন্থ রচনা করেন তা হ’লتناقضات الألباني الواضحات فيما وقع له في تصحيح الأحاديث وتضعيفها من أخطاء وغلطات- তিন খন্ডে রচিত এই গ্রন্থটিতে তিনি আড়াই শতাধিক হাদীছের ব্যাপারে তার ভাষায় আলবানীর تناقضات বা স্ববিরোধী হুকুমসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। এছাড়া ইলমুল হাদীছের ক্ষেত্রে তাঁর নানা ভুল নিয়ে বিস্তারিত সমালোচনা পেশ করেছেন।[18]

একইভাবে সমালোচনা পেশ করেছেন হিন্দুস্তানী বিদ্বান শায়খ হাবীবুর রহমান আ‘যমী। তিনি তাঁর সমালোচনামূলক গ্রন্থ الألباني شذوذه وأخطاؤه -তে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আলবানীর সমালোচনা করেছেন।[19] ভারত, মিসর, লেবাননসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে তা ছাপা হয়। এমনকি জর্দানের বিভিন্ন অঞ্চলে তা বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়।[20]

এছাড়া সিরীয় বিদ্বান শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ লিখেছেন كلمات في كشف أباطيل وافتراءات[21] এবং শায়খ আব্দুল্লাহ হারারীর একদল ছাত্র সংকলন করেছেনتبيين ضلالات الألباني شيخ الوهابية المتمحدث।[22]

এসব সমালোচনার নিন্দনীয় দিক হ’ল, অধিকাংশ সমালোচক প্রজ্ঞাপূর্ণ ইলমী সমালোচনার চেয়ে বিদ্বেষপূর্ণ হীন সমালোচনার দিকে অগ্রগামী হয়েছেন। মত পরিবর্তনের মাধ্যমে আলবানী যে ন্যায়পরায়ণতার পরিচয় দিয়েছেন, তাকে তারা তাঁর স্ববিরোধিতা বলে প্রমাণ করতে চেয়েছেন।

সমালোচনার জবাবে রচিত বইসমূহ :

আলবানীর সমালোচনায় যেমন নানা রচনা প্রকাশ পেয়েছে, তেমনি তার জবাবেও অনেক বই লেখা হয়েছে। যেমন- (১) হাবীবুর রহমান আ‘যমীর সমালোচনার জবাবে আলবানী নিজে রচনা করেছেন الرد علي رسالة أرشد السلفي। (২) আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ-এর সমালোচনায় আলবানী লিখেছেন,كشف النقاب عما في كتاب أبي غدت من الأباطيل والإفتراءات (৩) সালীম হেলালী লিখেছেন,الرد العلمي على حبيب الرحمن الأعظمي المدعي بأنه أرشد السلفي في رده على الألباني وبيان افترائه عليه[23] (৪) শায়খ আলী হাসান আল-হালাবী রচনা করেছেনالأنوار الكاشفة لةناقضاة الخساف الزائفة وكشف ما فيها من الزيغ والةحريف والمجازفة[24] এবং الرد البرهاني في الإنةصار للعلامة المحدث الإمام الشيخ محمد ناصر الدين الألباني[25] (৫) আব্দুল্লাহ ইবনু ফাহাদ আল-খালীফী রচনা করেছেন, التوفيق الرباني في الذب عن العلامة الألباني (৬) আবু মু‘আয তারেক ইবনু ‘আওযিল্লাহ রচনা করেছেন,ردع الجاني المتعدي على الألباني।[26]

সমালোচনার কিছু উদাহরণ ও তাঁর জবাব :

(ক) আবু সাঈদ খুদরী থেকে বর্ণিত হাদীছ, রাসূল (ছাঃ) বলেন,إن الناس لكم تبع وإن رجالا يأتونكم من أقطار الأرضين يتفقهون في الدين فإذا أتوكم فاستوصوا بهم خيرا ‘(আমার পরে) মানুষ তো তোমাদের অনুসারী হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ ধর্মীয় জ্ঞানার্জনের জন্য তোমাদের নিকটে আসবে। তারা তোমাদের কাছে এলে তোমরা তাদের কল্যাণ কামনা কর’।[27]

হাসান সাক্কাফ বলেন, আলবানী হাদীছটি সিলসিলা ছহীহাহ (হা/২৮০)-তে ছহীহ সাব্যস্ত করেছেন। কিন্তু আমরা দেখেছি যে, একই রাবী থেকে বর্ণিত একই হাদীছকে তিনি মিশকাতুল মাছাবীহ (হা/২১৫)-এর তাহক্বীক্বে যঈফ সাব্যস্ত করেছেন। কারণ হিসাবে বলেছেন, তিরমিযী বলেছেন যে, এর সনদে আবু হারূণ আল-‘আবাদী রয়েছেন, শু‘বা যাকে যঈফ গণ্য করেছেন। আমার (আলবানী) মতে, তার নাম আম্মারা ইবনু জুওয়াইন। সে খুবই দুর্বল। কিছু ইমাম তাকে মিথ্যাবাদী বলেছেন। আলবানীর এ বক্তব্য উল্লেখের পর সাক্কাফ বলেন, হায়! কি স্ববিরোধিতা!![28]

এর জবাবে আলবানী বলেন, আমি সিলসিলা ছহীহাহ (হা/ ২৮০)-তে আবু নাযরা ও অন্যান্য রাবী থেকে আবু সাঈদ সূত্রে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত বাক্যে বর্ণিত হাদীছটি শক্তিশালী গণ্য করেছি, যেখানে বলা হয়েছে, كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يوصينا بكم؛ يعني: طلبة الحديث ‘রাসূল (ছাঃ) আমাদেরকে তোমাদের তথা হাদীছের জ্ঞানান্বেষীদের ব্যাপারে অছিয়ত করেছেন’। আর মিশকাতে যঈফ গণ্য করেছি মিথ্যার দোষে অভিযুক্ত হারূণ ‘আবাদী থেকে আবু সাঈদ সূত্রে অনেক দীর্ঘ বাক্যে বর্ণিত অন্য একটি হাদীছকে। যেখানে বলা হয়েছে, একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের বললেন,إن الناس لكم تبع وإن رجالا يأتونكم من أقطار الأرضين يتفقهون في الدين فإذا أتوكم فاستوصوا بهم خيرا ‘জনসাধারণ তোমাদের অনুসারী হবে। আর দিক-দিগন্ত হ’তে তারা তোমাদের নিকট দ্বীনের জ্ঞান লাভ করার উদ্দেশ্যে আসবে। সুতরাং যখন তারা আসবে, তখন তোমরা তাদের সদুপদেশ দিবে’। উভয় হাদীছের সনদ ও মতনে এত পার্থক্য থাকায় উভয় হাদীছকে ছহীহ ও যঈফ গণ্যের মাঝে পার্থক্য হওয়া আবশ্যক হয়ে যায়। অথচ উক্ত অন্যায়কারী ব্যক্তিটি একে স্ববিরোধিতা বলে আখ্যায়িত করছেন! অতএব চক্ষুষ্মান ব্যক্তিগণ এথেকে শিক্ষা গ্রহণ করুন![29]

(২) হাসান সাক্কাফ বলেন, রাবী جُرَي بن كُليب النهدي الكوفي এর ব্যাপারে আলবানী বলেছেন, তার থেকে أبو إسحاق السَّبيعي ব্যতীত অন্য কেউ হাদীছ বর্ণনা করেননি। অথচ একথা সঠিক নয়। বরং আবু ইসহাক্ব ব্যতীত অন্য রাবীও তার থেকে হাদীছ বর্ণনা করেছেন। যেমন ইবনু হাজার স্বীয় তাহযীবে বলেন, জুরাই ইবনু কুলাইব থেকে يونس بن أبي إسحاق ও عاصم بن أبي النجود বর্ণনা করেছেন এবং তা মুসনাদে আহমাদে সংকলিত হয়েছে। আলবানীর এরূপ সিদ্ধান্তের মাঝে প্রবিষ্ট হওয়ার কারণ হ’ল, কেবলমাত্র মীযানুল ই‘তিদালের উপর নির্ভর করা।[30] 

আব্দুল্লাহ ইবনু ফাহদ আল-খালীফী বলেন, এখানে আলবানী যা বলেছেন, সেটাই সঠিক। বরং হাসান সাক্কাফ ভুল করেছেন। কেননা জুরাই ইবনু কুলাইব নামে দু’জন রাবী আছেন। একজন কূফী, যার থেকে কেবল أبو إسحاق السبيعي বর্ণনা করেছেন। অপরজন বাছরী, যার থেকে قةادة বর্ণনা করেছেন। যেমনটি ইমাম আবূদাঊদ বলেছেন। আর তার থেকে অপর বর্ণনাকারী يونس بن أبي إسحاق বাছরী, তিনি কূফী নন। যেমন মুসনাদে আহমাদে তাকে নাহদী বলা হয়েছে। আর নাহদী হ’লেন বাছরী, যার থেকে ক্বাতাদাহ বর্ণনা করেছেন। বিষয়টি ইবনু হিববান স্বীয় ‘ছিক্বাতে’ এবং ইবনু হাজার স্বীয় ‘তাহযীবে’ বর্ণনা করেছেন। আলবানীর পূর্বে ইমাম বুখারী জুরাই ইবনু কুলাইব আন-নাহদীর জীবনীতে তার থেকে ক্বাতাদার বর্ণনার কথা উল্লেখ করেছেন।[31] যা প্রমাণ করে যে তিনি মনে করতেন যে নাহদী মূলত বাছরী।[32] অতএব উক্ত রাবীর ক্ষেত্রে আলবানীর বক্তব্যই সঠিক। হাসান সাক্কাফ একই নামের দু’জন রাবীকে এক মনে করে আলবানীর ভুল প্রমাণের অপপ্রয়াস চালিয়েছেন মাত্র।

এরূপ বিভ্রান্তিকর সমালোচনার জন্য আলবানী হাসান সাক্কাফের উদ্দেশ্যে নছীহতস্বরূপ বলেন, আমি তার জন্য কিছু কোমল কথা বলতে চাই। হয়তো তিনি উপদেশ গ্রহণ করতে পারেন এবং ভীত হ’তে পারেন। প্রথমত আপনি কি মা‘ছূম? ইলমের ক্ষেত্রে কি আপনার কখনোই ভুল হয় না? যদি তিনি বলেন, তিনি মা‘ছুম নন, তারও ভুল হয়, আর মুমিনের জন্য এ জবাব দেওয়াই ওয়াজিব।

দ্বিতীয় যে কথা আমি বলব তা হ’ল- আপনার নিকটে (কোন ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত প্রদানের পর) পরবর্তীতে যদি কিছু সঠিক প্রমাণিত হয়, তখন কি আপনি আলবানীর ন্যায় সঠিক সিদ্ধান্তের দিকে ফিরে আসবেন, না ভুলের উপরেই অটল থাকবেন? যদি আপনি ইতিবাচক জবাব দেন, যেটা মুমিনের জবাব, তাহ’লে আলবানী সঠিক সিদ্ধান্তে ফিরে আসলে কেন আপনি তাকে এর প্রতি সদা-সর্বদা উৎসাহিত করার পরিবর্তে তাঁর ভুল হিসাবে গণ্য করছেন? যদিও এটা আল্লাহর একান্ত দান, যার জন্য আপনার মতো ব্যক্তির উৎসাহের কোন প্রয়োজন নেই।.... বরং আমি আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করি তিনি যেন হাদীছ ও সুন্নাহর ক্ষেত্রে আমার খেদমতের ক্ষমতা আরো বৃদ্ধি করেন, এক্ষেত্রে আমার ভুলসমূহ শুদ্ধ করার সুযোগ দেন এবং এই খেদমতকে বিচার দিবসে আমার পাপ মোচনের মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করেন।[33]

তবে অনেক লেখক আলবানীর তাখরীজকৃত হাদীছের ব্যাপারে নিরপেক্ষভাবে সমালোচনা পেশ করেছেন। তারা আলবানীর কিছু কিছু ভুল যথার্থভাবে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন। যেমন শায়খ ফাহদ আস-সুনাইদ রচনা করেছেন الإعلام في إيضاح ما خفي على الإمام، تعقبات حديثية على الشيخ محمد ناصر الدين الألباني। এখানে তিনি তাঁর তাখরীজকৃত ২৫টি হাদীছের ব্যাপারে ভুল-ত্রুটি তুলে ধরেছেন।[34] এছাড়া শায়খ আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ আদ-দুওয়াইশ রচনা করেছেন تنبيه القاري لتقوية ما ضعفه الألباني।[35] এটি আলবানীর ভুল-ত্রুটি পর্যালোচনার উপর সবচেয়ে উপকারী গ্রন্থ। এছাড়া প্রফেসর আনাস সুলায়মান মিছরী রচনা করেছেন الأحاديث المعلولة التي صححها الألباني على شرط الشيخين। যেখানে তিনি মোট ২২টি ত্রুটিযুক্ত হাদীছ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন, যেগুলো আলবানী বুখারী ও মুসলিমের শর্তে ছহীহ সাব্যস্ত করেছেন।[36]

(ক্রমশঃ)


[1]. ইবরাহীম যীবাক্ব, আল্লামা শায়খ শু‘আইব আরনাঊত্ব; সীরাতুহূ ফী ত্বলাবিল ‘ইলমি ওয়া জুহূদুহূ ফী তাহকীকিত তুরাছ, পৃ. ১৯৬-২১৫।

[2]. উল্লেখ্য যে, উক্ত প্রবন্ধটির অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে মাসিক আত-তাহরীক, ২১তম বর্ষ (২০১৭-১৮ খ্রি.), ১ম -৫ম ও ১০ম সংখ্যায়।

[3]. হাবীবুর রহমান আ‘যমী, আলবানী শুযূযুহু ওয়া আখত্বাউহূ (কুয়েত : মাকতাবা দারুল ‘আরূবাহ, ১ম প্রকাশ, ১৯৮৪ খ্রি.), পৃ. ৯-১৭২।

[4]. ইবনুল ক্বাইয়িম, ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন, ১ম খন্ড (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ‘ইলমিইয়াহ, ১ম প্রকাশ, ১৯৯১ খ্রি.), পৃ. ৮৬।

[5]. সিলসিলা যঈফাহ, ১/৬।

[6]. ছাবাতু মুআল্লাফাতিল আলবানী, পৃ. ৬৩।

[7]. সিলসিলা ছহীহাহ, ২/১৯০, হা/৬২১।

[8]. ছহীহ আবূদাঊদ, ৬/২৭৬।

[9]. ইবনু তায়মিয়াহ, আল-কালিমুত তাইয়েব (রিয়াদ : মাকতাবাতুল মা‘আরিফ, ১ম প্রকাশ, ২০০১ খ্রি.), পৃ. ১২৭।

[10]. সিলসিলা যঈফাহ, ১২/২০২, হা/৫৫৯৫।

[11]. আবুল হাসান আশ-শায়খ, তারাজু‘ঊল ‘আল্লামা আল-আলবানী, ২য় খন্ড (রিয়াদ : মাকতাবাতুল মা‘আরিফ, ১ম প্রকাশ, ২০০২ খ্রি.), পৃ. ৩৭১-৭২।

[12]. সিলসিলা ছহীহাহ, ৭/২২৫-২৭।

[13]. মুহাম্মাদ আহমাদ উওয়াইস, মানহাজুল আলবানী ফীত তাখরীজ ওয়া বায়ানিছ ছুন‘আতিল হাদীছিইয়াতি ফীহি (কায়রো : দারুস সালাম, ১ম প্রকাশ, ২০১৪ খ্রি.), পৃ. ২৬৩-৬৪।

[14]. আব্দুর রহমান আন-নাজদী, ৫০০ হাদীছুন মিম্মা তারাজা‘আ ‘আনহাল আলবানী ফী কুতুবিহী, (জর্দান : দারুন নাফাএস, ১ম প্রকাশ, ২০০৩ খ্রি.), পৃ. ১২৬।

[15]. তারাজু‘ঊল ‘আল্লামা আল-আলবানী, ২/২২০-২১।

[16]. এটি আম্মানের দারুদ দবী থেকে ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত হয়।

[17]. রিয়াদস্থ মাকতাবাতুল মা‘আরিফ থেকে ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে ২ খন্ডে প্রকাশিত হয়।

[18]. আম্মান : আল-মাকতাবাতুল মুখাসসাসাহ লির রাদ্দি ‘আলাল ওয়াহহাবিয়াহ, ১১তম প্রকাশ, ২০০৭ খ্রি.।

[19]. কুয়েত : মাকতাবাতু দারিল ‘আরূবাহ, ১ম প্রকাশ, ১৯৮৪ খ্রি./ ১৪০৪ হি.।

[20]. সালীম হেলালী, আর-রাদ্দুল ‘ইলমী ‘আলা হাবীবির রহমান আল-আ‘যমী, ১ম খন্ড (আম্মান : আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, ১ম প্রকাশ, ১৯৮৪ খ্রি.), পৃ. ৫।

[21]. হালব : মাকতাবাতুল মাতবূ‘আতিল ইসলামিইয়াহ, ২য় প্রকাশ, ১৪১১ হি.।

[22]. বৈরুত : দারুল মাশারী‘, ৩য় প্রকাশ, ২০০৭ খ্রি.।

[23]. আম্মান : আল-মাকতাবাতুল ইসলামিয়াহ, ১ম প্রকাশ, ১৯৮৪ খ্রি.।

[24]. জর্দান : দারুল আছালাহ, ১ম প্রকাশ, ১৯৯১ খ্রি.।

[25]. আজমান, আরব আমিরাত : মাকতাবাতুল ফুরক্বান, ১ম প্রকাশ, ২০০২ খ্রি.।

[26]. কায়রো : মাকাতাবাতুত তারবিয়াতুল ইসলামিয়াহ, ২য় প্রকাশ, ২০০১ খ্রি.।

[27]. তিরমিযী, হা/২৬৫০, ৬/১৫০।

[28]. হাসান সাক্কাফ, তানাকুযাতুল আলবানী আল-ওয়াযিহাহ (স্থানবিহীন, আল-মাকতাবাতুল মুতাখাছছাছাহ লির রাদ্দি ‘আলাল ওয়াহহাবিইয়াহ, ১১তম প্রকাশ, ২০০৭ খ্রি.), পৃ. ৬০।

[29]. সিলসিলা ছহীহাহ, ১/১৫, ভূমিকা দ্রষ্টব্য।

[30]. তানাকুযাতুল আলবানী আল-ওয়াযিহাহ, ১/১৯৬।

[31]. মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল আল-বুখারী, আত-তারীখুল কাবীর, ২য় খন্ড (হায়দ্রাবাদ : দাইরাতুল মা‘আরিফ আল-‘উছমানিইয়াহ, তাবি), পৃ. ২৪৪, রাবী নং ২৩৩৬।

[32]. আব্দুল্লাহ ইবনু ফাহদ আল-খালীফী, তাওফীকুর রববানী ফিয যাবিব ‘আনিল আলবানী (প্রকাশক ও তারিখ বিহীন), পৃ. ৫২।

[33]. সিলসিলা ছহীহাহ, ৭/৩৭১, হা/৩১৩৩।

[34]. কায়রো : মাকতাবাতুস সুন্নাহ, ১ম প্রকাশ, ১৯৯৬ খ্রি.।

[35]. আল-কাছিম : দারুল ‘আয়লান, ১ম প্রকাশ, ১৯৯০ খ্রি.।

[36]. ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় গাযা কর্তৃক প্রকাশিত মাজাল্লাতুল জামি‘আহ লিদ দিরাসাতিল ইসলামিইয়াহ-এ প্রকাশিত প্রবন্ধ, ২৬ তম খন্ড, ১ম সংখ্যা, ২০১৮ খ্রি., পৃ. ২১৭-২৪৪। https:/journals.iugaza.edu .ps/index.php/IUGJIS/article/view/2762, 21.05.2019.






শেরে পাঞ্জাব, ফাতিহে কাদিয়ান মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী (রহঃ) - ড. নূরুল ইসলাম
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) (জুলাই’১৮ সংখ্যার পর) - ড. নূরুল ইসলাম
শেরে পাঞ্জাব, ফাতিহে কাদিয়ান মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী (রহঃ) (শেষ কিস্তি) - ড. নূরুল ইসলাম
মাওলানা আব্দুল ওয়াহ্হাব মুহাদ্দিছ দেহলভী - ড. নূরুল ইসলাম
ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (রহঃ) (শেষ কিস্তি) - ড. নূরুল ইসলাম
মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী (রহঃ) (শেষ কিস্তি) - ড. নূরুল ইসলাম
যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) (৭ম কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী (রহঃ) - ড. নূরুল ইসলাম
ড. মুক্তাদা হাসান আযহারী - ড. নূরুল ইসলাম
মাওলানা আব্দুর রঊফ ঝান্ডানগরী - ড. নূরুল ইসলাম
মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী (রহঃ) (২য় কিস্তি) - ড. নূরুল ইসলাম
যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) (২য় কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
আরও
আরও
.