পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ । পর্ব ৬ । পর্ব ৭। পর্ব ৮। পর্ব ৯। শেষ পর্ব  

ব্রেলভীদের সাথে মুনাযারা :

উপমহাদেশে কবর-মাযারপূজারী বিদ‘আতী গোষ্ঠী ব্রেলভীরা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের ওলামায়ে কেরামকে হরহামেশা কাফের-মুরতাদ ফৎওয়া দিত এবং তাঁদের উপর নানা অপবাদ আরোপ করত। তাদের এই ফৎওয়া ও অপবাদ থেকে ভারতগুরু শাহ অলিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী (১৭০৩-১৭৬২ খ্রিঃ) ও ব্রিটিশ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রসৈনিক শাহ ইসমাঈল শহীদ (১৭৭৯-১৮৩১ খ্রিঃ) পর্যন্ত রেহাই পাননি। শাহ ইসমাঈল শহীদ সম্পর্কে ব্রেলভী মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা আহমাদ রেযা খান ব্রেলভী (১৮৫৬-১৯২১ খ্রিঃ) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই ইসমাঈল দেহলভী নির্ভেজাল কাফের ছিলেন’। তিনি তাঁর ‘তাকভিয়াতুল ঈমান’ গ্রন্থ সম্পর্কে বলেছেন, ‘এটি তাকভিয়াতুল ঈমান (ঈমান মযবূতকরণ) নয়; বরং তাফবীতুল ঈমান (ঈমান হরণ)। এটি ওহাবী ধর্মমতের মিথ্যা কুরআন’।[1] এমনিভাবে মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী (রহঃ) সম্পর্কে আহমাদ রেযা খান বলেছেন, ‘ছানাউল্লাহর অনুসারীরা ও অন্যরা সবাই পবিত্র শরী‘আতের বিধান অনুযায়ী কাফের মুরতাদ (ধর্মত্যাগী)’।[2] অথচ আল্লামা রশীদ রিযা মিসরীর (১৮৬৫-১৯৩৫ খ্রিঃ) মতো ব্যক্তি অমৃতসরীকে رجل إلهى ‘আল্লাহর সাহায্যপ্রাপ্ত ব্যক্তি’ বলে উল্লেখ করেছেন।[3] আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর (১৯৪৫-১৯৮৭ খ্রিঃ) লিখেছেন, والذي ألجم السكوت جميع الفرق الباطلة والمناوئة للإسلام والشريعة السماوية الغراء من القاديانية والآرية والهندوس والمجوس والمسيحيين وغيرهم من الفرق الكافرة والمنحرفة فقالوا فيه: إن ثناء الله ورئيس غير المقلدين مرتد ‘যিনি (অমৃতসরী) যাবতীয় বাতিল ফিরক্বা এবং ইসলাম ও উজ্জ্বল শরী‘আতের শত্রু কাদিয়ানী, আর্য-সমাজ, হিন্দু, অগ্নি উপাসক, খ্রিস্টান এবং অন্যান্য কাফের ও পথভ্রষ্ট ফিরক্বাগুলোর মুখে তালা লাগিয়ে দিয়েছিলেন। তার সম্পর্কে ব্রেলভীরা (রেযা খান নিজেই) বলেছেন, ‘ছানাউল্লাহও গায়ের মুক্বাল্লিদদের (আহলেহাদীছ) প্রধান মুরতাদ’।[4] আহমাদ রেযা খান ব্রেলভী অমৃতসরী সম্পর্কে আরো বলেছেন, ‘ছানাউল্লাহ অমৃতসরী ইসলামের ছদ্মবেশ ধারণ করেছেন। আসলে তিনি হিন্দুদের চর’।[5] শুধু তাই নয়, তারা দেওবন্দের মাওলানা মুহাম্মাদ কাসেম নানূতুবী, মাওলানা রশীদ আহমাদ গাঙ্গুহী, মাওলানা আশরাফ আলী থানবী, মাওলানা আহমাদ আলী সাহারানপুরী, মাওলানা ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মাক্কী প্রমুখ ওলামায়ে কেরাম এবং নাদওয়াতুল ওলামা লাক্ষ্মৌ ফারেগ ‘নাদভী’দেরকে পথভ্রষ্ট ও কাফের আখ্যা দিয়েছেন।

সঙ্গতকারণেই ব্রিটিশ ভারতে ইংরেজদের সেবাদাস এই বিদ‘আতী ও তাকফীরী গোষ্ঠীর সাথে অমৃতসরীর বেশ কিছু মুনাযারা অনুষ্ঠিত হয়। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য ৩টি মুনাযারার সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে পেশ করা হল :

১. বুধওয়ানার মুনাযারা (অক্টোবর ১৯২০) :

১৯২০ সালের ৫ই অক্টোবর (২১শে মুহাররম ১৩৩৯ হিঃ) পাকিস্তানের ঝাঙ্গ যেলার বুধওয়ানা নামক স্থানে ‘তাক্বলীদে শাখছী’ বিষয়ে ব্রেলভীদের সাথে মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরীর এই বিতর্কটি অনুষ্ঠিত হয়। এতে ব্রেলভী হানাফীদের পক্ষে তার্কিক ছিলেন মাওলানা গোলাম হোসাইন শাহ মুযাফ্ফরগড়ী। বিচারক হিসাবে ছিলেন মেŠলভী গোলাম মুহাম্মাদ (হানাফী) এবং শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জা‘ফরের দরবারের মুহাদ্দিছ মাওলানা মুহাম্মাদ ইয়ার (আহলেহাদীছ)। উভয় পক্ষের জওয়াব ও খন্ডন শ্রবণ করার পর দু’জন বিচারকই মাওলানা অমৃতসরীর পক্ষে রায় দেন। ঐ সময় এতদঞ্চলের মানুষজন মুনাযারাটিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করেছিল। প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন আলেমও অমৃতসরীর জবাবগুলোকে পসন্দ করেছিলেন। আর সাধারণ জনগণ অমৃতসরীর এ বক্তব্যকে মনে-প্রাণে ধারণ করেছিলেন যে, তাক্বলীদে শাখছী কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। বিতর্কে অমৃতসরী হানাফী ফিক্বহ গ্রন্থ থেকে তাক্বলীদের সংজ্ঞা প্রদান করতে গিয়ে বলেন,

 أخذ القول من غير معرفة دليله‘দলীল না জেনেই কোন আলেমের কথা মেনে নেয়া’ (জামউল জাওয়ামে ২/৩৫১)। সুতরাং যে দলীল জিজ্ঞেস করবে সে তাক্বলীদের গন্ডী থেকে বের হয়ে যাবে। যারা ফিক্বহের গ্রন্থাবলী অধ্যয়ন করেন এবং দলীল জানার চেষ্টা করেন তারা কিভাবে মুক্বাল্লিদ হ’তে পারেন? এরপরেও তাক্বলীদের কথা বার বার বলা অর্থহীন নয় কি? তাঁর এই দলীল সাব্যস্তকরণ দ্বারা জনগণ খুবই প্রভাবিত হয়। এরপর তিনি হানাফী বিদ্বান ইবনু আবিদীনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, فَتَحَصَّلَ مِمَّا ذَكَرْنَاهُ أَنَّهُ لَيْسَ عَلَى الْإِنْسَانِ الْتِزَامُ مَذْهَبٍ مُعَيَّنٍ ‘আমাদের উল্লেখিত বক্তব্য থেকে প্রমাণিত হয় যে, কোন ব্যক্তির জন্য নির্দিষ্ট একটি মাযহাবের অনুসরণ করা ওয়াজিব নয়’ (রাদ্দুল মুহতার ১/৫৩)। ব্রেলভী মুনাযির এর কোন সদুত্তর দিতে ব্যর্থ হন। ফলে জনগণের কাছে সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়ে যায় যে, তাক্বলীদে শাখছী কোন

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। এভাবে অমৃতসরী বিতর্কে বিজয়ী হন।[6]

২. মিরপুরের মুনাযারা (নভেম্বর ১৯২২) :

ঝিলাম থেকে ২০ মাইল দূরত্বে অবস্থিত জম্মু-কাশ্মীরের একটি স্থানের নাম মিরপুর। এখানে আহলেহাদীছ জামা‘আতের বহু তাবলীগী জালসা অনুষ্ঠিত হ’ত। বার্ষিক জালসায় কখনো কাদিয়ানীদের সাথে, কখনো ব্রেলভীদের সাথে, কখনো আর্য সমাজের সাথে মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরীর বিতর্ক হ’ত। প্রত্যেকবারই বিপক্ষ দল অমৃতসরীর কাছে পরাজিত হ’ত।

মিরপুরের মুনাযারার কাহিনী ছিল মজাদার ও চিত্তাকর্ষক। ১৯২২ সালের ১৩, ১৪ ও ১৫ই নভেম্বর ‘আঞ্জুমানে আহলেহাদীছ’-এর বার্ষিক জালসা এখানে অনুষ্ঠিত হয়। জালসার পূর্বেই ব্রেলভী হানাফীরা আহলেহাদীছদেরকে মুনাযারার চ্যালেঞ্জ জানায় এবং শর্ত দেয় যে, সার্টিফিকেটধারী আলেম ছাড়া কেউ মুনাযারায় অংশগ্রহণ করতে পারবে না। বাহাছের পূর্বে বিশেষজ্ঞ কমিটির কাছে উভয় পক্ষের তার্কিকগণ তাদের সার্টিফিকেট দেখাবেন। আহলেহাদীছগণ এ শর্ত মেনে নেন এবং মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরীকে মুনাযির হিসাবে দাওয়াত দেন। হানাফীদের পক্ষ থেকে মৌলভী করীমুদ্দীন (ঝিলাম), মৌলভী গোলাম আহমাদ, মৌলভী মুহাম্মাদ আযীম, মৌলভী মুহাম্মাদ মাসঊদ প্রমুখ মুনাযারায় অংশগ্রহণের জন্য আসেন। মুনাযারা শোনার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে মানুষজন আসেন। মুনাযারার শর্ত অনুযায়ী মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী কমিটির নিকট পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি, দারুল উলূম দেওবন্দ, মাযাহিরুল উলূম সাহারানপুর ও মাদ্রাসা ফয়যে ‘আম কানপুরের সার্টিফিকেট উপস্থাপন করেন। কিন্তু ব্রেলভী মৌলভীরা কোন সার্টিফিকেট দেখাতে ব্যর্থ হন। এতে জালসাস্থলে পিন-পতন-নীরবতা নেমে আসে। মাওলানা অমৃতসরী বলতে থাকেন, ‘হানাফী ভাইয়েরা! যাও সার্টিফিকেটধারী কোন আলেমকে নিয়ে আসো এবং মুনাযারা করো। আমি মুনাযারার জন্য প্রস্ত্তত আছি। তোমরা যেহেতু নিজেরাই এই শর্ত দিয়েছ, এজন্য তোমাদের জন্য তা পালন করা আবশ্যক’। এতে ব্রেলভী হানাফীরা লজ্জায় লাল হয়ে বিতর্ক ময়দান থেকে প্রস্থান করে।

বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্যগণ বলেন, ‘আপনি সার্টিফিকেট বিহীন এসব আলেমের সাথেই বিতর্ক করুন! আমরা তো মুনাযারা শুনতে চাচ্ছি’। এর জবাবে অমৃতসরী বলেন, ‘আপনারা তো সর্বদা আমার মুনাযারা শ্রবণ করতেই থাকেন। এ বছর তাদের নিকট থেকে অন্তত এতটুকু আমাকে লিখিয়ে নিয়ে এসে দিন যে, আমাদের কোন সার্টিফিকেট নেই। ভবিষ্যতে আমরা এ ধরনের শর্ত আরোপ করব না’। তারা বলেন, ‘তারা কি আর একথা লিখে দিবে’? তখন মাওলানা বললেন, ‘ঠিক আছে আপনারা অন্তত এতটুকু লিখে দিন যে, এরা সব সনদবিহীন আলেম’। তারা বলেন, ‘বেশ ভালো কথা। আমরা লিখে দিব। কিন্তু তাদেরকে একটু জিজ্ঞেস করে নেই’। ব্রেলভী মৌলভীদেরকে জিজ্ঞেস করা হ’লে তারা বলেন, ‘যদি আপনারা একথা লিখে দেন তাহ’লে আমরা মুনাযারা করব না’। এভাবে আর বিতর্কই অনুষ্ঠিত হয়নি। তবে এলাকায় সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে যে, বিদ‘আতী ব্রেলভী মৌলভীদের কোন সনদ নেই।[7]

৩. পাডরার (গুজরাট) মুনাযারা (ডিসেম্বর ১৯২৫) :

ভারতের গুজরাটের বরুডা শহরের একটি স্থানের নাম পাডরা। এখানে দিন দিন আহলেহাদীছদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ব্রেলভীরা তাদের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করার জন্য ঘোষণা করে যে, গায়ের মুক্বাল্লিদরা কাফের। এই প্রেক্ষিতে উভয় পক্ষের মধ্যে মুনাযারা অনুষ্ঠিত হয়। ব্রেলভী হানাফীরা মৌলভী হাশমত আলী লাক্ষ্ণৌভীকে এবং আহলেহাদীছরা মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরীকে দাওয়াত দেয়। সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, লিখিত বাহাছ অনুষ্ঠিত হবে এবং আধা ঘণ্টা পরপর প্রশ্ন উত্থাপন করা হবে। অতঃপর ১৫ মিনিট পর শ্রোতামন্ডলীর সামনে তার জবাব শুনানো হবে।

১৯২৫ সালের ২১ ও ২২শে ডিসেম্বর দু’দিন যাবৎ ‘আহলেহাদীছরা কাফের’ বিষয়ে বিতর্ক অব্যাহত থাকে। ব্রেলভী মুনাযির মৌলভী হামশত আলী আহলেহাদীছদেরকে কাফের সাব্যস্ত করার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালান। কিন্তু তিনি শাহ ইসমাঈল শহীদ (রহঃ) রচিত ‘তাকভিয়াতুল ঈমান’ গ্রন্থের কিছু উদ্ধৃতি প্রদান ছাড়া আহলেহাদীছদের কাফের হওয়ার কোন শক্তিশালী দলীল পেশ করতে ব্যর্থ হন। মাওলানা অমৃতসরী শান্ত ও ধীরস্থিরভাবে তাঁর আপত্তিগুলো শুনেন। অতঃপর মার্জিত ভাষায় তার সকল অভিযোগ-আপত্তি ও সন্দেহ-সংশয়ের জবাব প্রদান করেন। ঐ অঞ্চলে এই মুনাযারার দারুণ প্রভাব পড়ে।[8]

শী‘আদের সাথে মুনাযারা :

মোগল শাসন ও তার পূর্ব থেকেই ভারতে শী‘আরা তাদের দাওয়াত ও দাবী প্রচার করতে থাকে। প্রত্যেক যুগেই মহান আল্লাহ তাঁর এমন কিছু মর্দে মুজাহিদ বান্দাকে প্রেরণ করেন, যারা তাদের ভ্রান্ত দাবীর যথোচিত জবাব প্রদান করেন এবং ইসলাম ও মুসলমানদেরকে তাদের ভ্রান্ত আক্বীদা থেকে রক্ষা করেন। কিন্তু ইংরেজ শাসনামলে ব্রিটিশদের পৃষ্ঠপোষকতায় ও ছত্রছায়ায় শী‘আ মতবাদ পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। তারা আবুবকর ও ওমর (রাঃ)-এর খেলাফতের বিষয়টি নতুনভাবে জনগণের সামনে উপস্থাপন করে তাদের ঈমান হরণের অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। এসময় শী‘আ ও আহলুস সুন্নাহর আলেমদের মাঝে বহু বাহাছ-মুনাযারা অনুষ্ঠিত হয়। মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। মযবূত দলীল ও শাণিত যুক্তির সাহায্যে তিনি শী‘আদের ভ্রান্ত দর্শনের পোস্টমর্টেম করেন।[9] নিম্নে শী‘আদের

সাথে কৃত তাঁর ৪টি মুনাযারার বিবরণ উপস্থাপিত হ’ল :

১. কাদিরাবাদ, গুজরাটের মুনাযারা (এপ্রিল ১৯১৪) :

১৯১৪ সালের ২৮শে এপ্রিল গুজরাট (পাকিস্তান)-এর কাদিরাবাদ নামক স্থানে শী‘আদের সাথে এই মুনাযারাটি অনুষ্ঠিত হয়। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মুনাযারা ছিল। এতদঞ্চলে আহলেহাদীছ ছিল না বললেই চলে। এজন্য হানাফীরা তাদের আলেমদের সাথে পরামর্শ করে মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরীকে মুনাযির হিসাবে নির্বাচন করেন। মুনাযারার সময় অমৃতসরী সেখানে পৌঁছলে শী‘আরা তাঁকে দেখে ঘাবড়ে যায়। তারা মুনাযারা না করার জন্য শর্ত নির্ধারণের নামে তালবাহানা করতে থাকে। মুনাযারার একটি শর্ত ছিল, উভয় পক্ষের কেউই তিন খলীফার বিরুদ্ধে কোন শ্রুতিকটু শব্দ উচ্চারণ করতে পারবে না। শী‘আ মুনাযির এই শর্ত মানতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, তিন খলীফার প্রতি ঈমান আনার এই শর্তে তো আমি মুনাযারা করতে পারব না। এ বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। অমৃতসরী তাকে বুঝাতে সক্ষম হন যে, এই শর্তে মুনাযারা করা যেতে পারে। আরেকটি শর্ত ছিল, বিতর্কে যিনি পরাজিত হবেন এবং বিচারক যার পরাজয়ের ফায়ছালা প্রদান করবেন তিনি বিজয়ীর মাযহাব গ্রহণ করবেন। অমৃতসরী দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন যে, আমি পরাজিত হলে অবশ্যই শী‘আ মাযহাব গ্রহণ করব। কিন্তু শী‘আ মুনাযির পরাজিত হলে সত্যিকার অর্থে সুন্নী মাযহাব গ্রহণ করবেন তার কি গ্যারান্টি রয়েছে? কেননা তারা তো ‘তাকিয়া’ নীতিতে বিশ্বাসী। এতে শী‘আ তার্কিক লজ্জিত হন এবং বলেন, আপনি আমাকে খুব লাঞ্ছিত-অপমানিত করলেন এবং আমার মাযহাবের সমালোচনা করলেন। তখন অমৃতসরী বললেন, আপনার আক্বীদা অনুযায়ী আমি আপনার মাযহাব বর্ণনা করলাম। কারণ আপনাদের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘উছূলে কুলায়নী’তে আছে যে, দ্বীনের দশ ভাগের নয় ভাগ তাকিয়াতে রয়েছে। দ্বিতীয়বারের মতো শী‘আ তার্কিক লজ্জিত হলেন এবং এর জবাব দিতে অপারগতা প্রকাশ করলেন। এই শর্তের আলোচনাতেই শ্রোতারা অর্ধেক মুনাযারার স্বাদ পেয়ে গেল।

শী‘আ মুনাযির সাইয়িদ আহমাদ শাহ তার উত্থাপিত অভিযোগগুলোর জবাব দিতে পারলে এক হাযার রূপিয়া পুরস্কার প্রদানের কথা ঘোষণা করলেন। অমৃতসরী এর যথোচিত জবাব প্রদান করে তাঁকে লা-জওয়াব করে দিলেন। কিন্তু শী‘আ মুনাযির তাঁর ওয়াদা রক্ষা করলেন না। অমৃতসরীকে এক হাযার রূপিয়া দেওয়া তো দূরে থাক ১০ রূপিয়াও দিলেন না।

খিলাফতের আলোচনায় অমৃতসরী ‘নাহজুল বালাগাহ’ থেকে একটি উদ্ধৃতি দেন। যেখানে আলী (রাঃ) মু‘আবিয়া (রাঃ)-কে লিখেছেন, ‘আমাকে মুহাজির ও আনছারগণ খলীফা বানিয়েছেন। যারা আবুবকর, ওমর ও ওছমান (রাঃ)-কে খলীফা বানিয়েছিলেন’। এর সাথে সাথে তিনি ‘উছূলে কুলায়নী’ বের করে দেখালেন যে, আলী (রাঃ) যদি ওমর (রাঃ)-কে এমনটিই মনে করতেন তাহলে তার মেয়ে উম্মে কুলছূমকে কেন তার সাথে বিয়ে দিলেন? এসব কিছু যখন তোমাদের কিতাবে মওজুদ রয়েছে তাহলে তোমরা ওমর (রাঃ)-এর ধার্মিকতা, আমানতদারিতা ও খিলাফতকে কেন অস্বীকার করছ’? শী‘আ মুনাযির এর উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়ে বললেন, ‘উমাইয়া যুগে আমাদের কিতাবে এগুলি সংযোজন করা হয়েছে’। তখন অমৃতসরী বলেন, ‘তোমাদের কিতাবে যেহেতু ভেজাল পাওয়া গেছে সেহেতু তোমাদের সব কিতাব ভিত্তিহীন হয়ে গেল। যেভাবে কোন স্ট্যাম্পের একটি শব্দও যদি সন্দেহযুক্ত হয়, তাহলে সকল চুক্তিই অগ্রহণযোগ্য হয়ে যায়। এভাবে এখন তোমাদের সব কিতাব অপ্রমাণিত হয়ে গেল’। এতে শী‘আ মুনাযিরের চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। শী‘আদের প্রধান বলে উঠলেন, আমাদের মুনাযির দুর্বল এবং সুন্নীদের মুনাযির অনেক বড় আলেম, অভিজ্ঞ ও পন্ডিত ব্যক্তি। এজন্য আমরা প্রস্ত্ততি নিয়ে পুনরায় মুনাযারা করব’।[10]

২. মানছূরপুরের মুনাযারা (মার্চ ১৯২৪) :

১৯২৪ সালের ১০ই মার্চ পাকিস্তানের হোশিয়ারপুর যেলার মানছূরপুরে মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী ও শী‘আ আলেমদের মাঝে এই বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। ‘তিন খলীফার খিলাফত’ বিষয়ে এটি একটি লিখিত মুনাযারা ছিল। এতে উভয় পক্ষের দু’জন এবং একজন অমুসলিম বিচারক ছিলেন। মুনাযারাটি অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক ছিল। বিচারকগণ অমৃতসরীর পক্ষেই রায় দিয়েছিলেন। কারণ তাঁর দলীলগুলো ছিল অত্যন্ত মযবূত। আলী (রাঃ)-এর বর্ণনা এবং শী‘আদের গ্রন্থ থেকেই তিনি তিন খলীফার খিলাফত সাব্যস্ত করেছিলেন। এর ফলে প্রতিপক্ষের মুখ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অমৃতসরী বলেছিলেন, ভ্রাতৃমন্ডলী! এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আমরা দুই মুনাযির মূলত উকিল। আমার মক্কেল হলেন তিন খলীফা (আবুবকর, ওমর ও ওছমান) আর দ্বিতীয় পক্ষের মক্কেল হ’লেন আলী (রাঃ)। শারঈ ও আইনগত মূলনীতি হ’ল, বিবাদী যদি বিপক্ষের দাবী মেনে নেন তাহ’লে উকিলের তা অস্বীকার করার উপায় নেই। আমি দ্বিতীয় পক্ষের [অর্থাৎ আলী (রাঃ)] কবুলকৃত সত্য দাবী পেশ করে দিয়েছি। এক্ষণে দ্বিতীয় পক্ষের উকিল যদি তা অস্বীকার করেন তাহ’লে তার অস্বীকৃতি জ্ঞাপন অযৌক্তিক ও শ্রবণ অযোগ্য হবে। এভাবে অমৃতসরীর যুক্তির কাছে শী‘আ আলেমরা অসহায় হয়ে পরাজয়ের গ্লানি স্বীকার করে নেন।[11]

৩. ওয়ারবার্টনের মুনাযারা (মে ১৯২৪) :

১৯২৪ সালের ১৮ই মে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের শেখুপুরা যেলার ওয়ারবার্টনে (Warburton) অমৃতসরীর সাথে শী‘আদের এই মুনাযারাটি অনুষ্ঠিত হয়। শী‘আদের পক্ষে মৌলভী মির্যা আহমাদ আলী লাহোরী এবং আহলুস সুন্নাতের পক্ষে মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী বিতর্কে অংশ নেন। স্বয়ং হানাফীরা অমৃতসরীকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। বাহাছের বিষয়বস্ত্ত ছিল (১) খিলাফত (২) তারাবীহ-এর মাসআলা ও (৩) ওযূতে দুই পা ধৌতকরণ।

শী‘আ মুনাযির মাওলানা অমৃতসরীকে দেখে ভয় পেয়ে যান এবং মুনাযারা করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে বলেন, আহলে সুন্নাত ও শী‘আদের মধ্যে মুনাযারা। আর মৌলভী ছানাউল্লাহ আহলেহাদীছ, আহলে সুন্নাত নন। সুতরাং আমাদের সাথে তাঁর মুনাযারা করার কোন অধিকার নেই। এর জবাবে অমৃতসরী বলেন, ‘মির্যা ছাহেব! আহলে সুন্নাত একটি বৈশিষ্ট্যগত নাম। যেমন হিন্দুস্তানী। বিভিন্ন প্রদেশের মানুষ এর অন্তর্ভুক্ত। যেমন পাঞ্জাবী, বাঙ্গালী, সিন্ধী, মাদ্রাজী প্রভৃতি। আপনি কোন বাঙ্গালীকে একথা বলতে পারেন না যে, তিনি হিন্দুস্তানী নন। আবার কোন মাদ্রাজীকে বলতে পারেন না যে, উনি ইন্ডিয়ান নন। এভাবে আহলে সুন্নাতের মধ্যে হানাফী, শাফেঈ, মালেকী, হাম্বলী, আহলেহাদীছ সবাই শামিল আছে। হানাফী আলেমগণ অমৃতসরীর এ বক্তব্যকে সমর্থন করলে অমৃতসরী ও শী‘আ তার্কিক আহমাদ আলীর মাঝে বিতর্ক শুরু হয়। তিনি যখন শী‘আদের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ তাবারসীর তাফসীর মাজমাউল বায়ান, উছূলে কুলায়নী ও নাহজুল বালাগাহ থেকে ওমর (রাঃ)-এর খেলাফত সাব্যস্ত করেন, তখন শী‘আ তার্কিক এর কোন সদুত্তর দিতে পারেননি।

তারাবীর মাসআলাতেও অমৃতসরীর ইস্তিদলাল দেখে শী‘আ মুনাযির পেরেশান হয়ে যান। অতঃপর ওযূতে পা ধৌত বা মাসাহ করার বিষয়ে অমৃতসরী যখন শী‘আদের কিতাব থেকে স্বয়ং আলী (রাঃ)-এর পা ধৌতকরণ সাব্যস্ত করেন তখন শী‘আ মুনাযিরের জবাব দেয়ার মতো আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। এ বিতর্কে অমৃতসরীর বিজয় লাভের ফলে কয়েকজন শী‘আ মতাবলম্বী শী‘আ মতবাদ থেকে তওবা করেন এবং তাঁর আলেমসুলভ বর্ণনাভঙ্গি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কয়েকজন হানাফী আহলেহাদীছ হয়ে যান।[12]

৪. ওয়াযীরাবাদের মুনাযারা (সেপ্টেম্বর ১৯৩১) :

১৯৩১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তানের ওয়াযীরাবাদের ভেড়ী শাহ রহমানে মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী ও শী‘আদের মাঝে ‘তিন খলীফার ঈমান’ বিষয়ে এই মুনাযারাটি অনুষ্ঠিত হয়। ওয়াযীরাবাদে শী‘আরা তিন খলীফার বিরুদ্ধে ধৃষ্টতা প্রদর্শন করে এবং এতদঞ্চলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। ফলে সুন্নীরা তাদের সাথে বাহাছ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পূর্বের মতো এখানেও অমৃতসরী আহলে সুন্নাতের পক্ষে এবং মির্যা আহমাদ আলী শী‘আদের পক্ষে মুনাযারা করেন।

মাওলানা অমৃতসরী প্রথমে কুরআন মাজীদের আয়াত দ্বারা আবুবকর ও ওমর (রাঃ)-এর মুমিন হওয়া সাব্যস্ত করেন। শী‘আ মুফাস্সিরদের তাফসীর থেকেই তিনি এটি প্রমাণ করেন। অতঃপর আলী (রাঃ)-এর মেয়ে উম্মে কুলছূমের সাথে ওমর (রাঃ)-এর বিবাহ প্রমাণ করেন এবং বলেন যে, ওমর (রাঃ) যদি মুমিন নাই হন, তাহলে আলী (রাঃ)-এর মতো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি কেন এই বিবাহ দিলেন? এরপর ‘ফুরূয়ে কাফী’ থেকে তিনি উল্লেখ করেন, ইমাম আবু আব্দুল্লাহ একজন নারীকে নির্দেশ দেন যে, আবুবকর ও ওমর (রাঃ)-এর প্রতি ভালবাসা পোষণ করবে। যদি তারা ঈমানদার না হন তাহ’লে তিনি কেন এই নির্দেশ দিয়েছিলেন?

এভাবে মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী বেশ কিছু দলীল পেশ করেন, যা শী‘আদের ‘উসতাযুল মুনাযিরীন’ (তার্কিকদের শিক্ষক) ও ‘রাঈসুল মুতাকাল্লিমীন’ (ধর্মতত্ত্ববিদদের গুরু) খ্যাত মুনাযির আহমাদ আলী খন্ডন করতে বা তার তাবীল করতে সক্ষম হননি। পক্ষান্তরে অমৃতসরীর ইস্তিদলাল পদ্ধতি দেখে জনগণ বুঝতে পারে যে, শী‘আরা কিভাবে তাকিয়া নীতি অবলম্বন করে মানুষকে ধোঁকা দেয়?[13]

(চলবে)

ড. নূরুল ইসলাম

ভাইস প্রিন্সিপাল, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।

[1]. ইহসান ইলাহী যহীর, আল-ব্রেলভিয়া আকাইদ ওয়া তারীখ, পৃঃ ১৬৭

[2]. ঐ, পৃঃ ১৭৮

[3]. আল-মানার, মিসর, বর্ষ ৩৩, ১৩৫১ হিঃ, পৃঃ ৬৩৯

[4]. আল-ব্রেলভিয়া আকাইদ ওয়া তারীখ, পৃঃ ১৭৮

[5].

[6]. সীরাতে ছানাঈ, পৃঃ ৪৩২-৪৩৩; আব্দুল মুবীন নাদভী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৯০

[7]. সীরাতে ছানাঈ, পৃঃ ৪২০-৪২২

[8]. সীরাতে ছানাঈ, পৃঃ ৪২৫-৪২৬; আব্দুল মুবীন নাদভী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৯১-৯২

[9]. আব্দুল মুবীন নাদভী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪০১-৪০২

[10]. সীরাতে ছানাঈ, পৃঃ ৪২৬-৪৩০; তাযকিরাতুল মুনাযিরীন ১/৩৫৪-৩৫৭

[11]. সীরাতে ছানাঈ, পৃঃ ৪২২-৪২৩

[12]. ঐ, পৃঃ ৪২৩-৪২৪

[13]. ঐ, পৃঃ ৪৩৮-৪৪০; আব্দুল মুবীন নাদভী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪২১-৪২২।






মাওলানা আব্দুর রঊফ ঝান্ডানগরী - ড. নূরুল ইসলাম
মাওলানা আব্দুল্লাহ মাদানী ঝান্ডানগরী - ড. নূরুল ইসলাম
মাওলানা মুহাম্মাদ আবুল কাসেম সায়েফ বেনারসী - ড. নূরুল ইসলাম
যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) (১০ম কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) (২য় কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী (রহঃ) (শেষ কিস্তি) - ড. নূরুল ইসলাম
ইমাম নাসাঈ (রহঃ) - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী (রহঃ) (৩য় কিস্তি) - ড. নূরুল ইসলাম
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) - ড. নূরুল ইসলাম
মাওলানা আব্দুল ওয়াহ্হাব মুহাদ্দিছ দেহলভী - ড. নূরুল ইসলাম
শেরে পাঞ্জাব, ফাতিহে কাদিয়ান মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী (রহঃ) (২য় কিস্তি) - ড. নূরুল ইসলাম
যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) (৮ম কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
আরও
আরও
.