পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ । পর্ব ৬ । পর্ব ৭। পর্ব ৮। পর্ব ৯। শেষ পর্ব ।
হানাফীদের সাথে বাহাছ-মুনাযারা :
মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী কাদিয়ানী, হিন্দু ও খ্রিস্টানদের সাথে সবচেয়ে বেশী মুনাযারা করেছেন।[1] অমুসলিম ও বাতিল ফিরক্বাগুলির সাথে বিতর্কের সময় তিনি মুসলমানদের প্রতিনিধি হিসাবে মুনাযারায় অংশগ্রহণ করতেন। হানাফী আলেমগণও অমুসলিমদের সাথে বিতর্কের সময় তাঁকে নিয়ে যেতেন।[2] মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী বলতেন, ‘মাওলানা মাহমূদুল হাসান দেওবন্দী আমাকে নিজের সন্তানের মতো ভালবাসতেন। এজন্য বড় বড় বাহাছে, যেখানে আকাবিরে দেওবন্দ-এর কর্তৃত্ব থাকত, সেখানে এই অধমের উপরেই বাহাছের দায়িত্ব অর্পিত হ’ত। যেমন নাগীনা, রামপুর প্রভৃতি স্থানের বাহাছ’।[3] মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধের বিষয়ে অমৃতসরী যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। সঙ্গতকারণেই হানাফীদের সাথে তিনি একান্ত বাধ্য না হ’লে বাহাছে অবতীর্ণ হ’তেন না। উপমহাদেশের খ্যাতনামা হানাফী বিদ্বান সাইয়িদ সুলায়মান নাদভী পত্র মারফত তাঁকে আমীন, রাফ‘উল ইয়াদায়েন প্রভৃতি ফিক্বহী মাসআলায় বিতর্ক না করার জন্য আহবান জানাতেন।[4] তথাপি এসব বিষয়ের গুরুত্ব, ক্ষেত্র বিশেষে হানাফীদের বাড়াবাড়ি ও পারিপার্শ্বিক কারণে তিনি হানাফীদের সাথে বেশ কিছু বাহাছ-মুনাযারা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। নিম্নে হানাফীদের সাথে কৃত তাঁর ৭টি বিতর্কের সংক্ষিপ্ত বিবরণ উপস্থাপিত হ’ল।-
১. অমৃতসরের মুনাযারা (১৮৯৮) :
১৮৯৮ সালে অমৃতসরে হানাফী আলেম মৌলভী খায়ের শাহের সাথে ছানাউল্লাহ অমৃতসরীর উক্ত লিখিত বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। এতে হানাফী ও আহলেহাদীছ উভয় পক্ষের একজন করে মোট দু’জন বিচারক নিযুক্ত হন। ১. মাওলানা আহমাদুল্লাহ অমৃতসরী (আহলেহাদীছ) এবং ২. ‘তাফসীরে হক্কানী’র লেখক মাওলানা আব্দুল হক হক্কানী। প্রথমে লিখিত বিতর্ক শুরু হ’লেও পরে এটি মৌখিক বিতর্কে রূপ নেয়। ২/৩ দিন ধরে বিতর্ক চলতে থাকে। শেষে বিচারকগণ সর্বসম্মতিক্রমে মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরীকে বিজয়ী ঘোষণা করেন। মাওলানা আব্দুল হক হক্কানী অমৃতসরীর পক্ষে রায় দিয়ে বলেন, ‘আহলেহাদীছ মুনাযিরের দলীলগুলি শক্তিশালী ছিল। হানাফী মুনাযির সেগুলি খন্ডন করতে পারেননি। এজন্য আমি যে ফায়ছালা দিয়েছি তা সঠিক’। এ বিতর্কে বিজয়ের ফলে বহু মানুষ হাদীছের প্রতি আমলকারী হয়ে যায় এবং অমৃতসরে আহলেহাদীছদের প্রচার-প্রসার ঘটতে থাকে।[5]
২. দরওয়াযা হাকীমা-এর মুনাযারা (১৮৯৯) :
‘তাক্বলীদ’ বিষয়ে মৌলভী আব্দুছ ছামাদ হানাফীর সাথে অমৃতসরের ‘দরওয়াযা হাকীমা’তে মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরীর এই বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। হানাফীরা যখন দেখল যে, মৌলভী আব্দুছ ছামাদ অমৃতসরীর সাথে বিতর্কে হেরে যাচ্ছেন, তখন তারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার চেষ্টা করল। কিন্তু হাকীম মুহাম্মাদুদ্দীন নামক এক শক্তিশালী ব্যক্তি সামনে এসে তাদেরকে রুখে দিলেন। এভাবে হানাফী মৌলভী ছাহেব পরাজিত হয়ে সেখান থেকে পলায়ন করেন।[6]
৩. সোহদারার মুনাযারা (১৯২২) :
১৯২২ সালের ২৮ ও ২৯শে মার্চ ‘আঞ্জুমানে আহলেহাদীছ সোহদারা’-এর ১ম বার্ষিক জালসা অনুষ্ঠিত হয়। পাল্টা হানাফীরাও জালসার আয়োজন করে। মোল্লা মুলতানী (নিযামুদ্দীন ওয়াযীরাবাদী) জালসায় আহলেহাদীছদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করার কারণে মুনাযারার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। হানাফীরা তাদের বিখ্যাত মুনাযির সাইয়িদ নূর শাহকে নিয়ে আসে। ‘ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পাঠ’ বিষয়ে তাঁর সাথে অমৃতসরীর বাহাছ হয়। মৌলভী নূর শাহ তাঁর সাথে এক ঘণ্টাও মুনাযারা করতে সক্ষম হননি। হানাফীরা নিশ্চিত পরাজয় অাঁচ করতে পেরে হট্টগোল সৃষ্টি করে মৌলভী নূর শাহকে ওখান থেকে সরিয়ে নেয়। এতে শত শত মানুষ ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পাঠের প্রবক্তা হয়ে যায়। মুনাযারায় উপস্থিত সরদার মুহাম্মাদ ওয়ায়েয পান্ডুরিয়া তার সঙ্গী-সাথী সহ আহলেহাদীছ হয়ে যান। এটি ছিল আহলেহাদীছদের জন্য অনেক বড় বিজয়।[7]
৪. চক রেজাদী, গুজরাটের মুনাযারা (১৯২৩) :
গুজরাট যেলার চক রেজাদী নামক স্থানে হানাফীদের বেশ দাপট ছিল। এখানে কিছু আহলেহাদীছ বসবাস করত। স্থানীয় মাওলানা হাকীম আব্দুল গণী যুবক বয়সে এখানে তাবলীগের কাজ করতেন এবং জালসার আয়োজন করতেন। এতে সেখানে আহলেহাদীছদের প্রচার-প্রসার বাড়তে থাকলে হানাফীরা তাদের প্রতি মুনাযারার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়।
মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী ও মাওলানা আব্দুল আযীযের (গুজরানওয়ালা) মাঝে ‘তাক্বলীদে শাখছী’ বিষয়ে ১৯২৩ সালের ৩রা ও ৪ঠা এপ্রিল মুনাযারা অনুষ্ঠিত হয়। হানাফী মুনাযির অত্যন্ত ধীরগতিতে ১ ঘণ্টা পর্যন্ত বিতর্ক করতে সমর্থ হন। মাওলানা ছানাউল্লাহ এই সুযোগে শ্রোতামন্ডলীর উপর প্রভাব বিস্তার করেন। উপস্থিত ৯৮% শ্রোতা হানাফী ছিল। তারা বলে উঠে, ‘আমাদের মৌলভী ঠান্ডা হয়ে গেছে। উত্তর দিতে পারছে না’। অবস্থা বেগতিক দেখে মৌলভী করম দ্বীন (ঝিলাম) মৌলভী আব্দুল আযীযকে জোরপূর্বক বসিয়ে দিয়ে নিজেই মুনাযারা করার জন্য এগিয়ে আসেন। বিতর্ক চলা অবস্থায় মুনাযির পরিবর্তনের ফলে শ্রোতাদের কাছে বিষয়টি বিব্রতকর মনে হয়। অমৃতসরী বিতর্কে এতটা জ্বলে উঠেন যে, মৌলভী করম দ্বীন আধা ঘণ্টাও তাঁর কাছে টিকতে পারেননি। ফলে হানাফীদের নিযুক্ত সভাপতিই স্বীকার করে নেন যে, ‘আহলেহাদীছ মুনাযির অমৃতসরী বিজয়ী হয়েছেন। আমাদের মুনাযির তার কোন যুক্তিসঙ্গত জবাব দিতে পারেননি’। অত্র এলাকায় এ মুনাযারার দারুণ প্রভাব পড়ে এবং আহলেহাদীছদের প্রতি হানাফীদের যে ঘৃণা ছিল তা অনেকটাই বিদূরিত হয়ে যায়।[8]
৫. জালালপুর, মুলতানের মুনাযারা (১৯২৮) :
১৯২৮ সালের ৫ই অক্টোবর মুলতান যেলার জালালপুর পীরওয়ালা গ্রামে ‘রাফ‘উল ইয়াদায়েন’ বিষয়ে এই বিতর্কটি অনুষ্ঠিত হয়। হানাফীদের পক্ষে ছিলেন মৌলভী গোলাম মুহাম্মাদ ঘোটবী (শায়খুল জামে‘আ আববাসিয়া, বাহাওয়ালপুর) এবং তার সহযোগী ছিলেন মাওলানা মোর্তযা হাসান দেওবন্দী। আহলেহাদীছদের পক্ষে ছিলেন মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী। এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব মাখদূম দেওয়ান সাইয়িদ মুহাম্মাদ গাওছ বিচারক মনোনীত হন। তিনি ১৯২৮ সালের ৭ই অক্টোবর লিখিত ফায়ছালা প্রদান করে বলেন, ‘আমি মহান আল্লাহকে সাক্ষী রেখে নিজের ঈমান থেকে এই ফায়ছালা প্রদান করছি যে, রাফ‘উল ইয়াদায়েন রাসূল (ছাঃ)-এর কর্ম ও সুন্নাত।
উক্ত বিচারকের লিখিত ফায়ছালার সারসংক্ষেপ নিম্নরূপ :
১. মাওলানা ছানাউল্লাহ ছাহেব রুকূতে যাওয়ার সময় ও রুকূ থেকে উঠার সময় রাফ‘উল ইয়াদায়েন করা সম্পর্কে তিরমিযীতে (হা/৩০৪) বর্ণিত আবু হুমাইদ আস-সায়েদীর যে ছহীহ হাদীছ পেশ করেছেন তার জবাবে মৌলভী গোলাম মুহাম্মাদ ছাহেব হাদীছের একজন রাবী আব্দুল হামীদ বিন জা‘ফরকে ‘মাতঊন’ (নিন্দিত বা সমালোচিত) আখ্যা দেন এবং আবু কাতাদা থেকে মুহাম্মাদ বিন ‘আমরের শ্রবণ অসম্ভব বলে বর্ণনা করেন। সেই সাথে আতা বিন খালেদ সূত্রের এক রাবীকে মাজহূল বা অপরিচিত আখ্যা দেন। তিনি আরো বলেন যে, হাকেম ও তিরমিযীর বিষয়ে ওলামায়ে কেরামের মত হ’ল, তাদের তাছহীহ ও তাহসীন-এর উপর নির্ভর করা যাবে না। মৌলভী গোলাম মুহাম্মাদ ছাহেব তার এই বক্তব্যের স্বপক্ষে কোন গ্রন্থের সূত্র উল্লেখ করেননি যা দেখে এটা বুঝা যাবে যে, মৌলভী ছাহেবের কথা ঠিক না বেঠিক?
২. মৌলভী ছানাউল্লাহ ছাহেব আবূদাঊদের একটি হাদীছ পেশ করে বলেন, আবূদাঊদের মূলনীতি হ’ল যে হাদীছের ব্যাপারে তিনি চুপ থাকেন তা ছহীহ। এর জবাবে মৌলভী গোলাম মুহাম্মাদ বলেন, বিস্তর সমালোচনা (جرح مفصل) বিদ্যমান থাকার কারণে ‘তাছহীহে মুবহাম’ (অস্পষ্ট ছহীহ) গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু এখানেও মৌলভী ছাহেব জারহে মুফাছ্ছালের কোন হাওয়ালা বা সূত্র উল্লেখ করেননি।
৩. এরপর মৌলভী গোলাম মুহাম্মাদ ছাহেব আবু হুমাইদ সায়েদীর হাদীছ দ্বারা সাধারণভাবে রাফ‘উল ইয়াদায়েনের বিষয়টি মেনে নেন। কিন্তু তিনি এটা বলেন যে, মতভেদপূর্ণ বিষয় হ’ল, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রাফ‘উল ইয়াদায়েন করেছেন? এর জবাবে মাওলানা ছানাউল্লাহ ছাহেব রাফ‘উল ইয়াদায়েন অব্যাহত থাকার ব্যাপারে বলেন যে, مَا كُنْتَ أَقْدَمَنَا لَهُ صُحْبَةً ‘তুমি তো আমাদের আগে রাসূল (ছাঃ)-এর সান্নিধ্য লাভ করতে পারনি’[9] বাক্যটি প্রমাণ করে যে, এই ঝগড়া রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পরের। তখন মৌলভী গোলাম মুহাম্মাদ ছাহেব বলেন, ছাহাবী যখন হ্যাঁ (بلى) বলেছেন, তখন ঝগড়া কিসের? এখানে তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কর্তৃক রাফ‘উল ইয়াদায়েন করার বিষয়টিকে মেনে নিয়ে শুধু এটুকু বলেন যে, এই হাদীছটি রাফ‘উল ইয়াদায়েন অবশিষ্ট থাকা প্রমাণ করতে পারে না।
৪. অতঃপর মৌলভী ছানাউল্লাহ ছাহেব ছহীহ বুখারী (হা/৭৩৯) থেকে ইবনে ওমরের হাদীছ পেশ করে বলেন যে, তিনি রুকূতে রাফ‘উল ইয়াদায়েন করতেন এবং এটিকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে মারফূ বর্ণনা করতেন। মৌলভী গোলাম মুহাম্মাদ ছাহেব এর জবাবে বলেন, ফাতহুল বারীতে উক্ত হাদীছকে নাফে’-এর সূত্রে মাওকূফ বলা হয়েছে। অথচ ফাতহুল বারীতে যে বর্ণনাটি মাওকূফ রয়েছে সেটি আব্দুল ওয়াহ্হাব থেকে বর্ণিত। আর উল্লেখিত হাদীছটি আব্দুল আ‘লা থেকে বর্ণিত। যেটাকে বুখারী মারফূ লিখেছেন। এজন্য যে হাদীছটিকে মাওকূফ বলা হয়েছে, সেটি আসলে মাওকূফ নয়; বরং মারফূ। এটি প্রমাণ করে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমৃত্যু রাফ‘উল ইয়াদায়েন করতে থাকেন।
৫. যেহেতু রুকূতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর রাফ‘ঊল ইয়াদায়েন করা সাব্যস্ত হয়ে গেছে এবং এর বিপরীতে মৌলভী গোলাম মুহাম্মাদ ছাহেব রাফ‘ঊল ইয়াদায়েন মানসূখ হওয়ার কোন হাদীছ পেশ করতে পারেননি, সেহেতু রাসূলের কর্ম হিসাবে রাফ‘ঊল ইয়াদায়েন অব্যাহত থাকা প্রমাণিত হয়ে গেল।[10]
৬. লাহোরের মুনাযারা (১৯৩০) :
১৯৩০ সালে মৌলভী মুহাররম আলী চিশতীর বাড়িতে ‘ইলমে গায়েব’ বিষয়ে হানাফী আলেম মৌলভী অলী মুহাম্মাদ জলন্ধরীর সাথে অমৃতসরীর এই মুনাযারাটি অনুষ্ঠিত হয়। হানাফী মুনাযির অমৃতসরীর কোন জবাব দিতে পারেননি। এজন্য হানাফীরা পর্যন্ত বলে ওঠে, ‘এই মাসআলায় ওহাবী তথা অমৃতসরী হকের উপরে আছেন। আমাদের মৌলভীদের নিকট ইলমী, আক্বলী (যুক্তিসঙ্গত) ও নাকলী দলীল না থাকার পরেও কেন তারা ওহাবীদের সাথে মুনাযারা করতে আসে। এতে তো অযথা হানাফীদের দুর্নাম হয়’।[11]
৭. লায়ালপুরের মুনাযারা (১৯৩৪) :
১৯৩৪ সালের ২৩ ও ২৪শে সেপ্টেম্বর লায়ালপুর যেলার তান্দলিয়ানওয়ালায় (Tandlianwala) আহলেহাদীছদের জালসায় এই বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরীর প্রতিপক্ষ ছিলেন হানাফী আলেম মাওলানা গোলাম মুহাম্মাদ ঘোটবী (শায়খুল জামে‘আ আববাসিয়া, বাহাওয়ালপুর)। যবরদস্ত আলেম হওয়া সত্ত্বেও বিতর্কে তিনি তাক্বলীদে শাখছীকে ওয়াজিব প্রমাণ করতে ব্যর্থ হন। তিনি এ বিষয়ে যত দলীল পেশ করেন অমৃতসরী তার সবগুলিই খন্ডন করেন। এতে শায়খুল জামে‘আ তাক্বলীদে শাখছী ওয়াজিব হওয়ার দাবী থেকে সরে এসে একে মুস্তাহাব বলে মত প্রকাশ করেন। এতে উপস্থিত শ্রোতামন্ডলীর উপর এর দারুণ প্রভাব পড়ে। সাধারণ মানুষ বুঝে নেয় যে, তাক্বলীদে শাখছী কোন যরূরী ও দ্বীনী বিষয় নয়। এর ফলে দূর-দূরান্ত পর্যন্ত আহলেহাদীছদের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।[12]
হাদীছ অস্বীকারকারীদের সাথে মুনাযারা :
অমৃতসরে মুনকিরীনে হাদীছ তথা হাদীছ অস্বীকারকারীদের সাথে মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরীর অনেক মুনাযারা হয়। প্রত্যেকবারই তারা পরাজয় বরণ করে।[13] ১৯১৮ সালের ৩, ৪ ও ৫ই মে মাদ্রাজে হাফেয আব্দুল্লাহ গাযীপুরীর সভাপতিত্বে ‘অল ইন্ডিয়া আহলেহাদীছ কনফারেন্স’-এর বার্ষিক জালসা অনুষ্ঠিত হয়। জালসার শেষ দিন কাদিয়ানী ও হাদীছ অস্বীকারকারীদেরকে বাহাছের আহবান জানানো হয়। কারণ এরা মাদ্রাজ ও এর আশপাশের এলাকাগুলোতে তাদের বাতিল আক্বীদা প্রচার করে সাধারণ মানুষকে পথভ্রষ্ট করছিল। এ আহবানে কাদিয়ানীদের পক্ষ থেকে কেউ সাড়া না দিলেও মুনকিরীনে হাদীছ-এর পক্ষ থেকে মৌলভী হাশমত আলী দেহলভী এগিয়ে আসেন। লিখিত বাহাছ অনুষ্ঠিত হয়। মাওলানা আব্দুস সোবহান অনারারী ম্যাজিস্ট্রেট বাহাছের সভাপতি নিযুক্ত হন। মাওলানা আব্দুল্লাহ গাযীপুরী ও মাওলানা যিয়াউদ্দীন মুহাম্মাদ মাদ্রাজী সর্বসম্মতিক্রমে বিচারক নিযুক্ত হন। মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী আহলেহাদীছদের পক্ষ থেকে বাহাছ করেন। বাহাছের পর বিচারকদ্বয় হাদীছের প্রামাণিকতা সাব্যস্তকারী মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরীকে বিজয়ী ঘোষণা করে বলেন, ‘হাদীছের প্রামাণিকতা সাব্যস্তকারী যেসকল দলীলের মাধ্যমে স্বীয় দাবীকে প্রমাণ করেছেন হাদীছ অস্বীকারকারী তার কোন জবাবই দেননি এবং যা কিছু বলেছেন দলীলের সাথে তার কোন সম্পর্ক ছিল না’।[14] এভাবে বারবার অমৃতসরীর কাছে পরাজয় বরণের পর তিনি নীরব হয়ে যান।
এরপর হাদীছ অস্বীকারকারী অমৃতসরী গ্রুপের নেতা মৌলভী আহমাদুদ্দীন ময়দানে নামেন। তিনি অমৃতসরীর কাছে কয়েকবার মৌখিক বিতর্কে পরাজিত হওয়ার পর সামনে আসার সাহস না পেয়ে পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে লিখিত বাহাছ শুরু করে দেন। আহমাদুদ্দীন ‘আল-বালাগ’ পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখতেন আর অমৃতসরী সাপ্তাহিক ‘আহলেহাদীছ’ পত্রিকায় তার জবাব দিতেন। এই লিখিত বিতর্কটি অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক ছিল। কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই আহমাদুদ্দীন কলম তুলে রাখতে বাধ্য হন। অমৃতসরী তাকে বারংবার বাহাছ শেষ করার জোর তাকীদ দিলেও আহমাদুদ্দীন সামনে অগ্রসর হ’তে সাহস পাননি।[15]
জীবনের শেষ মুনাযারা :
১৯৪৪ সালের ২৪শে মে মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী জীবনের সর্বশেষ মুনাযারা করেন আর্য সমাজের প্রখ্যাত তার্কিক পন্ডিত রামচন্দ্রের সাথে। ইতিপূর্বে তিনি অমৃতসরীর সাথে কয়েকবার বিতর্ক করেছিলেন। এবার তিনি বেশ প্রস্ত্ততি নিয়ে আটঘাট বেঁধে ময়দানে নামেন। হিন্দু মহাসভা কলেজে এ বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। বিতর্ক ময়দানে উপস্থিত হয়েই রামচন্দ্র হুংকার ছেড়ে বলেন, ‘আপনি ইতিপূর্বে আর্য সমাজের কয়েকজনের সাথে বিতর্ক করেছেন এবং তাদেরকে পরাজয়ের স্বাদ আস্বাদন করিয়েছেন। কিন্তু আজ রামচন্দ্র সামনে এসেছে। একটু রয়ে সয়ে বিতর্ক করবেন’। বড় বড় প্রফেসর, গ্রাজুয়েট, হিন্দু, মুসলিম, শিখ, উকিল এবং জজ এই ঐতিহাসিক বিতর্ক দেখতে উপস্থিত হয়েছিলেন। বিতর্ক শুনে সবাই অমৃতসরীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন। এমনকি শেষতক স্বয়ং রামচন্দ্র জনসম্মুখে একথা বলতে বাধ্য হন যে, ‘মাওলানা ছানাউল্লাহ যেই দৃঢ়তা, গাম্ভীর্য, পান্ডিত্য ও যোগ্যতার সাথে বিতর্ক করেন, সেরকম কোন মুনাযিরকে আমি পাইনি’।[16]
অমৃতসরীর মুনাযারার বৈশিষ্ট্য :
মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরীর জীবনীকার মাওলানা আব্দুল মজীদ খাদেম সোহদারাভী অমৃতসরীর মুনাযারার ১০টি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন।[17] এগুলি হ’ল-
১. মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী প্রতিপক্ষকে কখনো তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য বা লাঞ্ছিত করতেন না। বরং তাদেরকে সম্মান করতেন এবং সহাস্যবদনে তাদের মুখোমুখি হ’তেন। এমনকি তাঁর বাসস্থান অমৃতসর শহরে কোন জায়গা থেকে কেউ তাঁর সাথে মুনাযারা করতে আসলে মুনাযারা শেষে জনসম্মুখে তাকে তাঁর বাড়ীতে অবস্থানের ও আতিথেয়তা গ্রহণের দাওয়াত দিতেন।[18]
২. সমালোচনা বা প্রত্যুত্তর প্রদানের ক্ষেত্রে তার শব্দগুলো সর্বদা সংক্ষিপ্ত অথচ অর্থপূর্ণ ও সারগর্ভ হ’ত।
৩. সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়কেও সাবলীল ভাষায় বর্ণনা করতে এবং হেসে হেসে আরবী, উর্দূ ও ফার্সী কবিতা পাঠের মাধ্যমে তাতে বৈচিত্র্য সৃষ্টিতে তিনি অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন।
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক মাওলানা গোলাম রসূল মেহেরের অমৃতসরীর কিছু মুনাযারায় অংশগ্রহণের সুযোগ হয়েছিল। তিনি বলেন, অনেক কবির কবিতা অমৃতসরীর মুখস্থ ছিল। তিনি যখন কবিতা পাঠ করতেন তখন মনে হ’ত যে, কবি বোধ হয় এই স্থানের জন্যই এই কবিতাটি বলেছিলেন। অনেক সময় একটি কবিতাই বিপক্ষ দলের মুনাযিরকে পেরেশান করে দিত এবং তার পক্ষে জওয়াব দেওয়া মুশকিল হয়ে যেত। মেহের ছাহেব আরো বলেছেন, অমৃতসরী কবি মির্যা গালিবের কবিতা পাঠ করলে বলতেন, চাচা গালিব কত সুন্দরই না বলেছেন। কোন ক্ষেত্রে কবি নওয়াব মির্যা খান দাগ দেহলভী (১৮৩১-১৯০৫)-এর কবিতা পড়ার প্রয়োজন হ’লে বলতেন, এ বিষয়ে দাগ-এর কবিতা শুনুন! প্রত্যেক ব্যক্তি তার কবিতা পাঠের স্টাইল দেখে আনন্দিত হ’ত।[19]
মাওলানা হানীফ নাদভী বর্ণনা করেছেন যে, একবার প্রখ্যাত হানাফী আলেম মাওলানা আব্দুল আযীয দেওবন্দীর (গুজরানওয়ালা) সাথে মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরীর ‘ইমামের পিছনে সূরা ফতিহা পাঠ’ বিষয়ে গুজরানওয়ালায় বাহাছ হয়। বাহাছের শর্ত ছিল, মাওলানা ছানাউল্লাহ ছাহেব মুনাযারায় আরবী, উর্দূ বা ফার্সী কবিতা পাঠ করবেন না। এই শর্ত মানা এবং এর উপর কায়েম থাকা মাওলানার জন্য খুবই মুশকিল ছিল। গুজরানওয়ালা শহর এবং এর আশপাশ থেকে বহু মানুষ মুনাযারা শুনার জন্য এসেছিল। মাওলানা আব্দুল আযীয কোন কথার উত্তর প্রদান করতে একটু নমনীয়তা দেখালেই অমৃতসরী বলে উঠতেন, ‘মাওলানা! আমার কথার জবাব দিন। না হ’লে আমি এখনি কবিতা পাঠ করছি’। একথা তিনি এমন ঢংয়ে বলেছিলেন যে, মানুষজন হেসে ফেটে পড়ে। কবিতা পাঠের চেয়েও এর প্রভাব ছিল বেশী।[20]
৪. উপস্থিত বুদ্ধি বা প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব মুনাযারার প্রাণ। মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরীকে আল্লাহ রববুল আলামীন ইলমের গুণে বিভূষিত করার পাশাপাশি উপস্থিত বুদ্ধির নে‘মত দ্বারা পরিপূর্ণরূপে সুশোভিত করেছিলেন। প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব যেন তাঁর নিকট এসে শেষ হয়ে গিয়েছিল। এ বিষয়ে তাঁকে ‘ইমাম’ মানা হ’ত। তাঁর মতো প্রত্যুৎপন্নমতি কোথাও দৃষ্টিগোচর হয়নি। তাঁর মৃত্যুর পর ‘যমীনদার’ পত্রিকার প্রখ্যাত সম্পাদক সাংবাদিক যাফর আলী খান বলেন, ‘মাওলানা ছানাউল্লাহর মৃত্যুর সাথে সাথেই দুনিয়া থেকে প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব শেষ হয়ে গেছে’।[21]
মাওলানা হানীফ নাদভী বলেন, মাওলানা ছানাউল্লাহ অমতৃসরী একবার আর্য সমাজের সাথে বিতর্ক করার জন্য দিল্লী যান। সে সময় একটি মাযহাবী জামা‘আতের কিছু মানুষ তার বিরুদ্ধে কতিপয় মাসআলা সম্পর্কিত একটি ইশতেহার প্রকাশ করেছিল। এতে এমন কিছু কথা তাঁর প্রতি সম্পর্কিত করা হয়েছিল যার ভিত্তিতে অমৃতসরীর মুসলমানিত্বের বিষয়েই সন্দেহের উদ্রেক হয়। আর্য সমাজের তার্কিকের হাতে এটি এসে পৌঁছে। তিনি আরবী, ফার্সী প্রভৃতি ভাষা জানতেন এবং আক্বীদা ও আমলের ক্ষেত্রে ওলামায়ে কেরামের পারস্পরিক মতভেদপূর্ণ মাসআলা-মাসায়েল সম্পর্কেও অবগত ছিলেন। উভয় পক্ষ মুনাযারার ময়দানে উপস্থিত হ’লে আর্য সমাজী মুনাযির তার জায়গা থেকে উঠে আসেন এবং হাতে ইশতেহারটি নিয়ে বলেন, ভদ্র মহোদয়গণ! আমি তো এখানে কোন মুসলমান আলেমে দ্বীনের সাথে বিতর্ক করতে এসেছি। মাওলানা ছানাউল্লাহ ছাহেব নিঃসন্দেহে আমার নিকট সম্মানিত ব্যক্তি। কিন্তু এই দেখুন ইশতেহার! তার স্বধর্মের লোকজনই তো তাকে মুসলমান মনে করেন না। আমি কিভাবে তাকে মুসলমান মনে করব?
অন্য কেউ হ’লে আর্য সমাজীর এরূপ অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন শুনে ঘাবড়ে গিয়ে ময়দান ছেড়ে পালাত। আর আর্য সমাজী মুনাযির ফাঁকা মাঠে গোল দিত। কিন্তু উপস্থিত বুদ্ধির বরপুত্র এমন অদ্ভূত প্রশ্ন শুনে মোটেই বিচলিত হ’লেন না। তিনি মুচকি হেসে অত্যন্ত প্রশান্তির সাথে বললেন, সম্মানিত ভ্রাতৃমন্ডলী! আমার প্রতিপক্ষ বন্ধু একদম ঠিক বলেছেন। সবাই জানেন যে, কালেমা শাহাদাত পাঠ করে মুসলমান হ’তে হয়। আমি আপনাকে সাক্ষী রেখে উপস্থিত শ্রোতামন্ডলীর সামনে কালেমা শাহাদাত পড়ছি এবং ইসলাম কবুল করছি। এ কথা বলে তিনি কালেমা শাহাদাত পাঠ করতে শুরু করেন। এরপর বলেন, এখন তো আমার মুসলমানিত্বের ব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকল না। এবার আসুন মুনাযারা করি।[22]
৫. কোন বিতর্কে তিনি কখনো ভড়কে যাননি। বরং তিনি অত্যন্ত প্রশান্তির সাথে হেসে হেসে বিতর্ক করতেন।
৬. বিতর্কে সর্বদা তাঁর স্টাইল ছিল আলেমসুলভ বা বিজ্ঞজনোচিত। অবিজ্ঞজনোচিত বা সাধারণ স্টাইল তিনি কখনো বেছে নেননি।
৭. প্রতিপক্ষকে কখনো বিতর্কের বিষয়বস্ত্তর বাইরে যেতে দিতেন না। বাইরে চলে গেলেও আটঘাট বেঁধে মূল বিষয়ের দিকে ফিরিয়ে আনতেন।
৮. বিতর্কে সর্বদা মুনাযারার মূলনীতিগুলোর প্রতি খেয়াল রাখতেন এবং অন্যান্য বিষয়ের মতো বিতর্কের মূলনীতির আলোকেই বিতর্ক করতেন।
৯. খোলা মনে বিতর্কের শর্তগুলো গ্রহণ করতেন। বারংবার প্রতিপক্ষের অন্যায্য শর্তগুলোও অবলীলায় মেনে নিতেন। যাতে এই সুযোগে তারা পালানোর পথ খুঁজে নিতে না পারে। অনেক সময় এমন হ’ত যে, অন্য কারো মুনাযারা হ’ত। তিনি শুধু মুনাযারা শোনার জন্য ওখানে যেতেন। যখন শর্তের ব্যাপারে ঐক্যমত্যে পৌঁছতে না পারার কারণে উভয় পক্ষের মধ্যে বিতর্ক অনুষ্ঠিত হওয়া কঠিন হয়ে পড়ত তখন তিনি দ্রুত সামনে এগিয়ে যেতেন এবং বলতেন, ভাই! আমি বিনা শর্তে মুনাযারা করার জন্য প্রস্ত্তত আছি।[23]
এ প্রসঙ্গে দু’টি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। ক. একবার আঞ্জুমানে নু‘মানিয়ার জালসায় ব্রেলভী ও দেওবন্দীদের মাঝে বিতর্ক অনুষ্ঠিত হওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মাওলানা ছানাউল্লাহ ব্যক্তিগত কাজে লাহোর এসেছিলেন। বন্ধুদের অনুরোধে তিনি মুনাযারা শোনার জন্য হঠাৎ সেখানে উপস্থিত হয়ে জানতে পারেন যে, মুনাযারার শর্তের ব্যাপারে দু’পক্ষ ঐক্যমতে পৌঁছতে পারেনি। উভয় পক্ষের মধ্যে কড়া বাক্য বিনিময় হয়েছে। এ অবস্থা দেখে পুলিশ ইন্সপেক্টর জালসা বন্ধ করে দিতে চেয়েছেন। তখন অমৃতসরী পুলিশ ইন্সপেক্টরকে বলেন, ‘জনাব! এজন্য এই মুনাযারা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে যে, উভয় পক্ষ শর্ত সমূহের ব্যাপারে ঐক্যমত্যে পৌঁছতে পারেনি। আপনি অনুমতি দিলে আমি বিনা শর্তে ব্রেলভীদের সাথে মুনাযারা করার জন্য প্রস্ত্তত আছি। আমি তাদের সব শর্ত মেনে নিব। আমার পক্ষ থেকে কোন শর্ত দিব না’। ইন্সপেক্টর তাঁর পরিচয় পেয়ে মুনাযারার অনুমতি দিলেও ব্রেলভীরা রাযী হয়নি।
খ. একবার মসজিদে ওয়াযীর খাঁ-তে মৌলভী হাশমত আলী ব্রেলভী ও মৌলভী মুহাম্মাদ মানযূর দেওবন্দীর মাঝে মুনাযারা হওয়ার কথা ছিল। হাযার হাযার মানুষ বিতর্ক শোনার জন্য সেখানে উপস্থিত হয়েছিল। দুই ঘণ্টা আলোচনার পরেও মুনাযারার শর্ত নির্ধারণ না হওয়ায় জনগণ বিরক্ত হয়ে যায়। এমন সময় মাওলানা দাঁড়িয়ে বলেন, ভাইয়েরা! শর্ত নিয়ে ঝগড়া বাদ দিন। আমাকে বিনা শর্তে মৌলভী হাশমত আলীর সাথে মুনাযারা করতে দিন। জানি না ইনি আবার কবে পাঞ্জাব আসবেন, না আসবেন না। কিন্তু অমৃতসরীকে দেখে মৌলভী হাশমত আলীর চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। তিনি তার সাথে মুনাযারা করতে অস্বীকার করেন।[24]
১০. তিনি বিতর্কের ময়দানে তথ্যসূত্রবিহীন বা সূত্রের বিপরীতে কোন অভিযোগ আরোপ করেননি বা জবাব প্রদান করেননি। বরং সর্বদা দলীলের আলোকেই বক্তব্য পেশ করেছেন।
এ বৈশিষ্ট্যগুলো মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরীর মুনাযারার অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। বিতর্কের সময় প্রতিপক্ষ কোন ভুল শব্দ বললে অপরপক্ষের মুনাযির সাধারণত দ্রুত বলে ফেলে, সেতো সঠিক শব্দই বলতে পারে না। মূল শব্দ এরূপ নয়; বরং এরূপ। মাওলানা হানীফ নাদভী বলেছেন, মাওলানা ছানাউল্লাহর সামনে প্রতিপক্ষ ভুল শব্দ বললেও না তিনি সেটা শুদ্ধ করে দিতেন, আর না তাকে বাঁধা দিতেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, যদি সে ভুল শব্দ বলে তো বলতে থাকুক। তাকে সঠিক শব্দ বলে দেয়ার আমার কী ঠেকা পড়েছে।[25]
এসব বৈশিষ্ট্যের কারণে তাঁকে ‘ইমামুল মুনাযিরীন’ (তার্কিকদের নেতা) বলা হ’ত। জীবনীকার মাওলানা আব্দুল মজীদ সোহদারাভী বলেন, তবে তাঁকে ‘খাতামুল মুনাযিরীন’ বা সর্বশেষ তার্কিক বললেও সম্ভবত অত্যুক্তি হবে না।[26]
(ক্রমশঃ)
ড. নূরুল ইসলাম
ভাইস প্রিন্সিপাল, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।
[1]. সীরাতে ছানাঈ, পৃঃ ৩৮৮।
[2]. বায্মে আরজুমন্দাঁ, পৃঃ ১৬৬।
[3]. ঐ, পৃঃ ১৬৩।
[4]. ইয়াদে রফতেগাঁ, পৃঃ ৩৭২।
[5]. সীরাতে ছানাঈ, পৃঃ ৪০৩; তাযকিরাতুল মুনাযিরীন ১/২৪০।
[6]. তাযকিরাতুল মুনাযিরীন ১/২৪১।
[7]. সীরাতে ছানাঈ, পৃঃ ৪১৬-৪১৭।
[8]. ঐ, পৃঃ ৪১৯-৪২০।
[9]. তিরমিযী হা/৩০৪; ইবনু মাজাহ হা/১০৬১, হাদীছ ছহীহ।
[10]. সীরাতে ছানাঈ, পৃঃ ৪৩৪-৪৩৭, ৪২৫; তাযকিরাতুল মুনাযিরীন ১/৪৭৫-৪৮৪।
[11]. সীরাতে ছানাঈ, পৃঃ ৪১২।
[12]. ঐ, পৃঃ ৪২৪-৪২৫।
[13]. ফিৎনায়ে কাদিয়ানিয়াত আওর মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী, পৃঃ ৫৫।
[14]. মুহাম্মাদ তানযীল ছিদ্দীকী হুসাইনী, দাবিস্তানে নাযীরিয়াহ (গুজরানওয়ালা : দারু আবিত তইয়িব, ১ম প্রকাশ, ডিসেম্বর ২০১৯), ২/১২৬-১২৭।
[15]. সীরাতে ছানাঈ, পৃঃ ৪০৪-৪০৫; ফিৎনায়ে কাদিয়ানিয়াত, পৃঃ ৫৫।
[16]. সীরাতে ছানাঈ, পৃঃ ৪০৬; পাক্ষিক তারজুমান, ১৬-৩০শে এপ্রিল ২০১৫, পৃঃ ২৭।
[17]. সীরাতে ছানাঈ, পৃঃ ৩৮৬-৩৮৭।
[18]. বায্মে আরজুমন্দাঁ, পৃঃ ১৬৬।
[19]. ঐ, পৃঃ ১৬৩।
[20]. ঐ, পৃঃ ১৬৪; পাক্ষিক তারজুমান, ১৬-৩০শে এপ্রিল ’১৫, পৃঃ ২৮।
[21]. সীরাতে ছানাঈ, পৃঃ ১৬৬; রাঈসুল মুনাযিরীন, পৃঃ ২৭৭।
[22]. বায্মে আরজুমন্দাঁ, পৃঃ ১৬৪-১৬৫।
[23]. রাঈসুল মুনাযিরীন, পৃঃ ২৭৫।
[24]. সীরাতে ছানাঈ, পৃঃ ৪১১-৪১২; রাঈসুল মুনাযিরীন, পৃঃ ২৭৫।
[25]. বার্রে ছাগীর মেঁ আহলেহাদীছ কী আওয়ালিয়াত, পৃঃ ১০৮।
[26]. সীরাতে ছানাঈ, পৃঃ ৩৮৭।