পর্ব ১ । পর্ব ২ ।

বাহাছ-মুনাযারা : মাওলানা আবুল কাসেম সায়েফ বেনারসী একজন প্রসিদ্ধ ও অভিজ্ঞ মুনাযির (তার্কিক) ছিলেন। বাহাছ-মুনাযারায় বিপক্ষ দলের তার্কিকরা তাঁর সামনে আসতে ভয় পেত। তিনি লিখিত ও মুখোমুখি উভয় প্রকার বিতর্কে অংশগ্রহণ করেছেন। বেনারসের চৌকি হনুমান ফাটক শাহ মুতাওয়াল্লী মসজিদে তিনি জীবনের প্রথম বিতর্কে অংশগ্রহণ করেন। দুই ঘণ্টা যাবৎ বিতর্ক চলে। শেষে তিনিই বিজয়মাল্যে ভূষিত হন।[1] তিনি জীবনে বহু মুনাযারা করেছেন এবং আল্লাহর রহমতে সবগুলিতেই বিজয়ী হয়েছেন। তবে কানপুর, এলাহাবাদ, ফাররুখাবাদ, জবলপুর, দিনাজপুর, বেনারস, টান্ডা (যেলা ফয়যাবাদ), পাটনা, বিহার, বাংলা প্রভৃতি স্থানে কাদিয়ানী, শী‘আ, হানাফী, হাদীছ অস্বীকারকারী, খ্রিস্টান, আর্য সমাজী, নেচারী প্রমুখের সাথে তাঁর বিতর্কগুলি প্রসিদ্ধ।[2]

ফাতিহে কাদিয়ান মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী একবার বেনারসে আগমন করলে বেনারসবাসী তাঁর কাছে অভিযোগের সুরে বলেন, ‘আপনি বেনারস প্রভৃতি স্থানে মুনাযারায় কেন অংশগ্রহণ করেন না’? জবাবে অমৃতসরী বলেন, ‘মাওলানা সায়েফ বেনারসী যেহেতু ইউপি, বিহার ও বাংলার জন্য যথেষ্ট, সেজন্য এসব এলাকার ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিন্ত আছি’।[3]

কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম : মাওলানা সায়েফ বেনারসী কাদিয়ানী ফিৎনা সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে ওয়াকিফহাল ছিলেন। বেনারসে এই ফিৎনার আর্বিভাব হলে তিনি একাই কাদিয়ানীদের মুখোমুখি হন এবং তাদেরকে একের পর এক বিতর্কে পরাজিত করেন। তিনি এদের বিরুদ্ধে মোট ৮টি বই লিখেন।[4] এগুলি হ’ল-

১. ইযহারে হাকীকাত : ভন্ডনবী গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর প্রতিশ্রুত মাসীহ, মাহদী ও নবী-রাসূল হওয়ার দাবী খন্ডনে এ পুস্তিকাটি রচিত। ১৯৩২ সালে বেনারসের সাঈদুল মাতাবে‘ প্রকাশনী থেকে এটি প্রথম প্রকাশিত হয়।

২. রদ্দে মির্যাইয়াত (১ম প্রকাশ : ১৩৫২ হিঃ) : এতে খতমে  নবুঅত সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

৩. কাযায়ে রববানী বর দো‘আ কাদিয়ানী (ফায়ছালায়ে ইলাহী) : এতে কাদিয়ানী ইশতেহার (মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরীর সাথে শেষ ফায়ছালা) সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে এবং কাদিয়ানী-লাহোরী লেখনী সমূহের বিস্তারিত জবাব দেয়া হয়েছে।

৪. মৌলভী গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী কে বা‘য জওয়াবাত পর এক নযর (১ম প্রকাশ : ১৩২৫ হিঃ) : জনৈক কাদিয়ানী মৌলভীর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর খতমে নবুঅত বিষয়ে লিখিত প্রবন্ধের জবাবে এ গ্রন্থটি লিখিত।

৫. জওয়াবে দাওয়াত (১ম প্রকাশ : ১৩২৫ হিঃ) : জনৈক কাদিয়ানীর লিখিত ‘দাওয়াত ইলাল হক’ পুস্তিকার জবাবে লিখিত। এতে ঈসা (আঃ)-এর আসমান থেকে অবতরণ ও হারূণ (আঃ)-এর বোন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

৬. নূরে ইসলাম বাজওয়াবে যুহূরে ইমাম (১ম প্রকাশ : ১৯৪৩) : কাদিয়ানীদের ‘যুহূরে ইমাম’ পুস্তিকার জবাবে লিখিত। এতে ঈসা (আঃ) সম্পর্কে কাদিয়ানী আলেমদের লেখনী সমূহের খন্ডন করা হয়েছে।

৭. দাফয়ে ইমাম আয যুহূরে ইমাম (১ম প্রকাশ : ১৯৩৪) : এটিও কাদিয়ানীদের ‘যুহূরে ইমাম’ পুস্তিকার খন্ডনে রচিত। এর বিষয়বস্ত্ত হ’ল ঈসা (আঃ)-এর ব্যক্তিত্ব।[5]

৮. মি‘য়ারে নবুঅত : এতে প্রথমত কুরআন মাজীদ থেকে নবী (ছাঃ)-এর মানুষ হওয়ার বিষয়টি প্রমাণ করা হয়েছে। অতঃপর নবুঅতের মানদন্ডের পরিচয় পেশ করতে গিয়ে দলীলসহ নবী (ছাঃ)-এর ১০টি ভবিষ্যদ্বাণী এবং কাদিয়ানী গ্রন্থের সূত্রসহ মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর ১০টি ভবিষ্যদ্বাণী লিপিবদ্ধ করে সেগুলি পর্যালোচনা করা হয়েছে। এভাবে হক ও বাতিলের পার্থক্য সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়েছে। ১৩৫২ হিজরীতে বেনারসের ‘আঞ্জুমানে ইশা‘আতে ইসলাম’ এটি প্রকাশ করে। পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৬।[6]

ছহীহুল বুখারীর প্রতিরক্ষায় বেনারসী : হাদীছে নববীর প্রতি তাঁর মহববত ছিল প্রবাদতুল্য। এ ব্যাপারে তিনি সামান্যতম শৈথিল্য বরদাশত করতেন না।[7] বিশেষত ছহীহুল বুখারী ও ইমাম বুখারী (রহঃ)-এর সাথে মাওলানা সায়েফ বেনারসীর একান্ত আন্তরিক সম্পর্ক ও ভালবাসা ছিল। তিনি সর্বমোট ৪০ বার ছহীহুল বুখারীর দরস প্রদান করেন। এর ফলে একদিকে যেমন ছহীহুল বুখারীর নিগূঢ় তত্ত্ব ও ইঙ্গিত সম্পর্কে তাঁর পূর্ণ দক্ষতা অর্জিত হয় এবং ইমাম বুখারী (রহঃ)-এর অতুলনীয় ফিক্বহী দক্ষতা ও ইজতিহাদ সম্পর্কে তিনি সঠিক জ্ঞান লাভ করেন, তেমনি অন্যদিকে তাঁর মধ্যে ছহীহুল বুখারী ও ইমাম বুখারী (রহঃ)-এর প্রতি কৃত সকল সারবত্তাহীন আপত্তি ও সমালোচনার যথাযথ জবাব প্রদানের পূর্ণ প্রস্ত্ততি ও অনন্য যোগ্যতা সৃষ্টি হয়।[8] এজন্য আমরা দেখি যে, যখন ছহীহুল বুখারী ও ইমাম বুখারী (রহঃ)-এর বিরুদ্ধে হানাফী মুক্বাল্লিদগণ এবং হাদীছ অস্বীকারকারীরা গোঁড়ামি ও হঠকারিতাবশত ভিত্তিহীন সমালোচনার ঝড় শুরু করে তখন মাওলানা বেনারসী বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখে এবং বই-পুস্তকের মাধ্যমে এর ইলমী ও তাহক্বীক্বী জবাব প্রদান করেন। প্রথমদিকে ছহীহুল বুখারীর প্রতিরক্ষায় মাওলানা বেনারসীর লেখনীগুলি মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘আহলেহাদীছ’ প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। যখনই বিরোধী পক্ষের পক্ষ থেকে ছহীহুল বুখারী বা ইমাম বুখারী (রহঃ)-এর প্রতি কোন আপত্তি আরোপ বা সমালোচনা করা হ’ত, বেনারসী তার জবাব লিখে আহলেহাদীছদের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করে দিতেন। কিন্তু এই ফিৎনা যখন বাড়তে থাকল তখন তিনি এসব সমালোচনার জবাবে গ্রন্থ লেখা শুরু করলেন। যাতে সমালোচকদের মুখে লাগাম দেয়া যায় এবং মুসলমানদেরকে গোমরাহী ও ভ্রম থেকে বাঁচানো যায়।[9] বিশেষ করে গোঁড়া হানাফী মুক্বাল্লিদ ওমর করীম পাটনাবী ইমাম বুখারী ও ছহীহুল বুখারীর বিরুদ্ধে নিরর্থক সমালোচনা ও বিষোদগার শুরু করলে আল্লামা শামসুল হক আযীমাবাদীর উৎসাহ-উদ্দীপনা ও সার্বিক সহযোগিতায় তাঁর দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়ে বেনারসী গ্রন্থ রচনা শুরু করেন। এ বিষয়ে লিখিত তাঁর ৭টি গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা নিম্নে পেশ করা হল:-

১. হাল্লে মুশকিলাতে বুখারী : মৌলভী ওমর করীম ও তার বশংবদরা অমৃতসরের ‘আহলে ফিক্বহ’ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধগুলি ‘আল-জারহু আলাল বুখারী’ নামে প্রকাশ করলে মাওলানা বেনারসী ‘আল-কাওছারুল জারী ফি জাওয়াবিল জারহ আলাল বুখারী’ ওরফে ‘হাল্লে মুশকিলাতে বুখারী’ শিরোনামে এর জবাব লিপিবদ্ধ করেন। এ গ্রন্থটি তিন খন্ডে বিভক্ত।

ক. হাল্লে মুশকিলাতে বুখারী (১ম খন্ড, ১ম প্রকাশ : ১৩৩০ হিঃ) : এই গ্রন্থে ‘আল-জারহু আলাল বুখারী’ গ্রন্থের ৬৬ পৃষ্ঠা পর্যন্ত ওমর করীম হানাফীর লিখিত প্রবন্ধগুলির জবাব দেয়া হয়েছে। মাওলানা বেনারসী মাত্র ১ মাসে এই বিশাল গ্রন্থটি লিপিবদ্ধ করেন।[10]

খ. হাল্লে মুশকিলাতে বুখারী (২য় খন্ড, ১ম প্রকাশ : ১৩৩২ হিঃ) : এ খন্ডটি দুই ভাগে বিভক্ত। ১ম ভাগে আল-জারহু আলাল বুখারী (১ম অংশ) গ্রন্থের ৬৬ পৃষ্ঠার পরবর্তী প্রবন্ধগুলির জবাব দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে উক্ত গ্রন্থে ১ম ভাগের জবাব সমাপ্ত হয়েছে। এতে সমালোচনাকারীদের ৩ বছরে লিখিত প্রবন্ধগুলির জবাব বেনারসী মাত্র ৫ সপ্তাহে দিয়েছেন। আর ২য় ভাগে সাপ্তাহিক ‘আহলে ফিক্বহ’ পত্রিকায় প্রকাশিত ঐ সকল প্রবন্ধের জবাব দেয়া হয়েছে যেগুলি আল-জারহু আলাল বুখারী গ্রন্থের ১ম ভাগে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।[11]

গ. হাল্লে মুশকিলাতে বুখারী (৩য় খন্ড, ১ম প্রকাশ : ১৩৩২ হিঃ) : ১৯১১-১৩ সালে ‘আহলে ফিক্বহ’ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধগুলির (১৯১৪ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত) জবাব দেয়া হয়েছে এ খন্ডে।[12]

২. আল-আমরুল মুবরাম লিইবতালিল কালাম আল-মুহকাম : ওমর করীম হানাফী তাঁর ‘আল-কালামুল মুহকাম’ গ্রন্থে ছহীহুল বুখারীর ১৭৫ জন রাবীর ব্যাপারে সমালোচনা করেন। উক্ত গ্রন্থে তাঁর জবাব দেয়া হয়েছে।[13] বেনারসী লিখেছেন, ‘এই আল-আমরুল মুবরাম গ্রন্থটিও অকিঞ্চন তাঁর (শামসুল হক আযীমাবাদী) ইঙ্গিতেই লেখা শুরু করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আল-কালামুল মুহকাম-এর জবাব লিখ, আমি তোমাকে পুরস্কারস্বরূপ দু’টি সুন্দর কিতাব প্রদান করব। ১. ইবনুল আছীরের আন-নেহায়া (৪ খন্ড)। ২. তাহযীবুত তাহযীব (১২ খন্ড)।[14] এমনকি আযীমাবাদী উক্ত গ্রন্থটি প্রকাশের জন্য তাঁকে আর্থিক সহযোগিতা প্রদানের ওয়াদা করেছিলেন এবং কিছু অর্থও দিয়েছিলেন। দুঃখজনক হ’ল গ্রন্থটি প্রকাশের পূর্বেই আযীমাবাদী মৃত্যুবরণ করেন।[15]

৩. মাউন হামীম লিল-মৌলবী ওমর করীম : ওমর করীম পাটনাবী ১৩২২ হিজরীতে একটি ইশতেহার প্রকাশ করেন। যেখানে ছহীহ বুখারী সম্পর্কে ১২টি প্রশ্ন ছিল। মাওলানা বেনারসী ‘মাউন হামীম’ নামে এর জবাব দেন। পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৯।

৪. ছিরাতে মুস্তাক্বীম লিহেদায়াতে ওমর করীম : উক্ত মৌলভী ছাহেব ১৩২২ হিজরীতে ২নং ইশতেহার প্রকাশ করে ছহীহ বুখারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করলে বেনারসী ‘ছিরাতে মুস্তাক্বীম’ পুস্তিকায় তার জবাব দেন। মূলতঃ এটি ‘আর-রীহুল আকীম’ পুস্তিকার ভূমিকা। ১৩২৯ হিজরীতে এটি ১ম প্রকাশিত হয়। পৃষ্ঠা সংখ্যা ১২।

৫. আর-রীহুল আকীম লিহাসমে বিনায়ে ওমর করীম : উক্ত মৌলভীর ২নং ইশতেহারের বিস্তারিত জবাব দেয়া হয়েছে ৬৮ পৃষ্ঠার এই পুস্তিকায়। এটি মূলতঃ ছিরাতে মুস্তাক্বীমের ২য় অংশ। এতে ছহীহ বুখারীর বিরুদ্ধে ৫৯টি সমালোচনার জবাব দেয়া হয়েছে। এতে সমালোচকের বক্তব্যকে مُرِيْبٌ (সন্দেহ সৃষ্টিকারী) এবং এর জবাবকে مُجِيْبٌ (উত্তরদাতা) হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।[16] ১৩২৮ হিজরীতে এটি প্রথম প্রকাশিত হয়।

৬. আল-উরজূনুল ক্বাদীম ফী ইফশায়ে হাফওয়াতে ওমর করীম : ওমর করীম ১৩২৪ হিজরীর জুমাদাল আখেরাহ মাসে ইমাম বুখারী (রহঃ) ও ছহীহুল বুখারীর বিরুদ্ধে ৩নং ইশতেহার প্রকাশ করলে এর জবাবে বেনারসী ১ মাসে ‘আল-উরজূনুল ক্বাদীম’ রচনা করেন।[17] গ্রন্থটি সম্পর্কে অমৃতসরী লিখেছেন, ‘আল-উরজূনুল ক্বাদীম গ্রন্থে সবিস্তারে মৌলবী ওমর করীম পাটনাবীর ৩নং ইশতেহারের খন্ডন করা হয়েছে। ইমাম বুখারীর বর্ণনাকারীগণ, হাদীছ সমূহ প্রভৃতি সম্পর্কে ইশতেহার প্রকাশকারী যে বেহুদা কথা বলেছেন, তার যুক্তিপূর্ণ জবাব এটি। মূলতঃ ইমাম বুখারী (রহঃ)-এর প্রতিরক্ষায় এই গ্রন্থটি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে এবং এতে ইমাম বুখারীর সংক্ষিপ্ত জীবনীও লিপিবদ্ধ রয়েছে’।[18]

৭. আল-খিযউল আযীম লিল-মৌলবী ওমর করীম : ১৩২৮ হিজরীর ২২শে রজব মৌলবী ওমর করীম ৪নং ইশতেহার প্রকাশ করে ছহীহুল বুখারীর ১০টি হাদীছ বাবের শিরোনামের সাথে সামঞ্জস্যশীল নয় বলে মন্তব্য করলে এর জবাবে বেনারসী এ গ্রন্থটি রচনা করেন। বেনারসী উক্ত গ্রন্থের উপসংহারে বলেন, ‘আল্লাহর প্রশংসা যে, কোন প্রকার কষ্ট-ক্লেশ ছাড়াই একদিনের পরিশ্রমে আপনার ইশতেহারের জবাব দ্রুত তৈরী হয়ে গেছে এবং আপনি যেটাকে জটিল ও দুর্বোধ্য মনে করেছিলেন দ্রুত তার সমাধান হয়ে গেছে। এখন আপনি আপনার ২০ রূপিয়ার পুরস্কার উত্তরদাতাকে দেয়ার পরিবর্তে নিজের মস্তিষ্কের চিকিৎসার জন্য ব্যয় করে নিজেকে সুস্থ করুন! অন্যথা শত্রুতার ঘুণ ভিতরে ভিতরে আপনাকে শেষ করে দিবে। আর আপনি তা টেরও পাবেন না’।[19]

ইমাম বুখারী (রহঃ) ও ছহীহু বুখারীর প্রতিরক্ষায় লিখিত উক্ত ৭টি গ্রন্থ হাফেয শাহেদ মাহমূদের তাহক্বীক্ব ও তা‘লীক সহ গুজরানওয়ালা, পাকিস্তানের উন্মুল কুরা পাবলিকেশন্স থেকে ‘দিফায়ে ছহীহ বুখারী’ শিরোনামে ২০০৯ সালে প্রকাশিত হয়েছে। মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা ১০৪৮।

বেনারসীর সমৃদ্ধ লাইব্রেরী : মাওলানা সায়েফ বেনারসীর লাইব্রেরী মূল্যবান বই-পুস্তকে ঠাসা ইলমের এক মারকায ছিল। মুদ্রিত-অমুদ্রিত বহু দুর্লভ গ্রন্থের ভান্ডার ছিল এটি। মিসর থেকে মুদ্রিত প্রায় প্রত্যেকটি গ্রন্থ তাঁর নিকটে আসত।[20] বেনারসীর সহোদর মাওলানা ক্বামার বেনারসী লিখেছেন, ‘মরহুমের যতটুকু আয় ছিল তার সবই ইলমী খিদমতে ব্যয় হ’ত। বোম্বে, মিসর, উপরন্তু দায়েরাতুল মা‘আরিফ, হায়দ্রাবাদে মরহুমের নাম নথিভুক্ত ছিল। যেকোন ইলমী কিতাব প্রকাশিত হ’লে সেটি মরহুমের নিকট চলে আসত’।[21] বেনারসীর মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে ও ভাতিজারা এই ইলমী ভান্ডার ১৯৬৮ সালে জামে‘আ সালাফিইয়াহ, বেনারসে দান করে দেন।[22]

মাদরাসা সাঈদিয়া : মাওলানা আবুল কাসেম বেনারসীর পিতা প্রখ্যাত মুহাদ্দিছ মাওলানা মুহাম্মাদ সাঈদ বেনারসী (১৮৫৩-১৯০৪) মাত্র ৯ জন ছাত্র নিয়ে ১২৯৯ হিজরীতে বেনারসে ‘মাদরাসা ইসলামিয়াহ’ নামে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর মাদরাসার নাম রাখা হয় ‘মাদরাসা সাঈদিয়া’।[23] কালক্রমে এই প্রতিষ্ঠানের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লে দূর-দূরান্ত থেকে জ্ঞানপিপাসী ছাত্ররা এখানে এসে তাদের জ্ঞানতৃষ্ণা নিবারণ করতে থাকে। উক্ত মাদরাসায় পড়তে আসা ছাত্রদের মধ্যে অধিকাংশের লক্ষ্য ছিল মাওলানা সায়েফ বেনারসীর হাদীছের দরসে অংশগ্রহণ করা। তাঁর দরসে হাদীছ ইলমী ঝর্ণাধারার প্রস্রবণ ছিল। তিনি ধারাবাহিকভাবে একাগ্রচিত্তে দীর্ঘ ৪০ বছর যাবৎ এখানে হাদীছের দরস প্রদান করেন।[24] গবেষক মুহাম্মাদ ইউনুস মাদানী বলেন, ‘মাওলানা মুহাম্মাদ আবুল কাসেম সায়েফ বেনারসী (রহঃ)-এর যুগে মাদরাসা সাঈদিয়া, বেনারস ইলমে হাদীছের মারকায বা কেন্দ্র ছিল। দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন ইস্তেফাদার জন্য (এখানে) আসত এবং এই মহান আলেমের কাছে ইলমে হাদীছের সাগরে অবগাহন করে নিজেদের জ্ঞানতৃষ্ণা নিবারণ করে ফিরে যেত’।[25]

ছাত্রবৃন্দ : সুদীর্ঘ ৪০ বছরের শিক্ষকতা জীবনে অসংখ্য ছাত্র মাওলানা বেনারসীর নিকট থেকে ইলমে দ্বীন হাছিল করে কর্মক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন এবং উপমহাদেশে আহলেহাদীছ আন্দোলনের প্রচার-প্রসারে ভূমিকা পালন করেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হ’ল-

১. মাওলানা মুখতার আহমাদ নাদভী (সাবেক আমীর, মারকাযী জমঈয়তে আহলেহাদীছ হিন্দ)। ২. মাওলানা ফায়যুর রহমান ছাওরী (মুফতী, দারুল হাদীছ, মেŠনাথভঞ্জন)। ৩. মাওলানা হাকীম ওবায়দুল্লাহ কাশ্মীরী। ৪. মাওলানা মুহাম্মাদ মউবী (সাবেক শায়খুল জামে‘আহ, জামে‘আহ আলিয়া, মউ)। ৫. মাওলানা আব্দুশ শাকূর সিদ্ধার্থনগরী। ৬. মাওলানা মুহাম্মাদ হানীফ সাঈদী। ৭. মাওলানা আব্দুল্লাহ সাঈদী (গোন্ডা)। ৮. মাওলানা মুহাম্মাদ ইসমাঈল খাঁ পিরওয়াঈ। ৯. মাওলানা আহমাদ আলী বেনারসী। ১০. মাওলানা মুহাম্মাদ শাকির গিয়াবী। ১১. মাওলানা আব্দুল মুবীন মানযার। ১২. মাওলানা আব্দুল কাইয়ূম ছিদ্দীক্বী বেনারসী (১৯২৭-১৯৮৩)। ১৩. মাওলানা আব্দুল ওয়াহিদ সালাফী (১৯২৪-১৯৮৯)। ১৪. সহোদর মাওলানা আবু মাসঊদ ক্বামার বেনারসী। ১৫. মাওলানা মুহাম্মাদ বাশীর আযমী (মৃঃ ২০০৩)।[26]

দাম্পত্য জীবন : মাওলানা বেনারসী মোট ৩ বার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯০২ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি ১ম  বিয়ে করেন। বিয়ের ১ বছর পরেই ১৯০৩ সালে তার ১ম স্ত্রী বিয়োগ হয়। এরপর পান্ডে হাভেলীর এক সম্ভ্রান্ত বংশে হাজী বিসমিল্লাহ ছাহেবের কন্যা উম্মে কুলছূমের সাথে তাঁর দ্বিতীয় বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়। এ স্ত্রীর গর্ভে ১৯২৪ সালের ফেব্রুয়ারীতে মুহাম্মাদ কাসেম নামে এক পুত্রসন্তান  জন্মলাভ করে। বিয়ের দীর্ঘদিন পর ১ম সন্তান জন্মগ্রহণ করায় মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী বেনারসীকে অভিনন্দন জানান এবং দো‘আ করেন যেন এই বাচ্চা দাদার যোগ্য উত্তরসূরী হয়।[27] কিন্তু একই বছরের মার্চ মাসে শিশু সন্তানটি মৃত্যুবরণ করে। ১৯৪২ সালের ১১ই জুন ২য় স্ত্রীও মৃত্যুবরণ করেন। এরপর তিনি সহোদর মাওলানা আব্দুর রহমানের বিধবা স্ত্রীকে বিয়ে করেন। এ স্ত্রীর গর্ভে ৪ সন্তান জন্মগ্রহণ করে। এঁরা হল- ১. আবু আছেম। রেলওয়েতে সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন। এখন অবসরপ্রাপ্ত। ২. আবু বাসেম। জীপ ফ্যাক্টরীতে চাকুরী করতেন। বর্তমানে এলাহাবাদে বসবাস করছেন। ৩. আবু হাশেম। ৪. ড. আবু হাতেম। ইনি বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে আরবী বিভাগের প্রফেসর ছিলেন। ২০১৫ সালের ৩রা জানুয়ারী মৃত্যুবরণ করেন। বেনারসীর শেষোক্ত স্ত্রী দীর্ঘজীবন লাভ করে কয়েক বছর পূর্বে মৃত্যুবরণ করেছেন।[28]

মৃত্যু ও দাফন : ১৯৪৩ সালের মার্চে তিনি প্রথম প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হন এবং চিকিৎসার পরে সুস্থ হয়ে ওঠেন। কিন্তু ১৯৪৮ সালের শেষের দিকে তিনি পুনরায় প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হন এবং ১৯৪৯ সালের ২৫শে নভেম্বর দুপুর সাড়ে ১২-টায় মৃত্যুবরণ করেন।[29] মাগরিবের পর সহোদর মাওলানা আব্দুল আখের (১৯০৫-১৯৮৩), মৌলভী হাবীবুল্লাহ (মৃঃ ১৯৭৮) এবং মৌলবী আব্দুল হান্নান তাকে গোসল দেন। অতঃপর তার লাশ আযাদ পার্ক ময়দানে নিয়ে যাওয়া হয়। এশার ছালাতের পর হাফেয আব্দুল্লাহ রহীমাবাদী (মৃঃ ১৯৫৪) জানাযার ছালাত পড়ান। রাত ১০-টায় হিন্দুস্তানের এই খ্যাতিমান মুহাদ্দিছকে দাফন করা হয়।[30] তাঁর মৃত্যুতে রচিত একটি কবিতায় মুর্শেদ মুর্শিদাবাদী লিখেছেন,

‘আর বেনারসে তওহিদ রসে

কে ডুবাবে মন সেথা বসে বসে

হাদীছে-রছুল, কে শোনাবে আর

কোরানের সু বয়ান?

আবুল কাছেম ইহলোকে নাই

চলিয়া গেছেন যেথা তাঁর ঠাঁই

এলমে হাদিছ এতিম হইল

আহলে হাদিছ মুহ্যমান’।[31]

গুণাবলী : তিনি আখলাকে হাসানাহর অধিকারী ছিলেন। তাঁর গলার আওয়ায ছিল উঁচু। সেকারণ অনেক সময় জালসায় তার জন্য লাউড স্পীকারের প্রয়োজন হ’ত না। বক্তব্য প্রদানের সময় তার সামনে বিষয়বস্ত্তর দ্বার এমনভাবে খুলে যেত যেন তিনি উত্তাল ঢেউয়ের সমুদ্র। কৃত্রিমতা ও বিলাসিতা থেকে তিনি দূরে থাকতেন। নিজের কাজ নিজেই করতেন।[32] পাকিস্তানের ‘আল-ই‘তিছাম’ পত্রিকায় তার আখলাক সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘তিনি অত্যন্ত প্রিয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। যে বন্ধুর সাথে একবার মিশেছেন তাকে চিরদিনের জন্য আপন করে নিয়েছেন। কত ইখলাছ, কত আপন করে নেয়া এবং কি পরিমাণ বিনয়-নম্রতার দৃশ্য পরিদৃষ্ট হয়েছে। হায় আল্লাহ! এখন এসব গুণ কোথায় দেখতে পাওয়া যাবে’।[33]

ফৎওয়া : বিস্ময়ের ব্যাপার হ’ল, জীবনী গ্রন্থগুলি মাওলানা সায়েফ বেনারসীর ফৎওয়ার ব্যাপারে একেবারেই নীরব। ‘তারাজিমে ওলামায়ে হাদীছ হিন্দ’-এর মতো প্রাচীন জীবনীগ্রন্থ এবং ‘তারাজিমে ওলামায়ে আহলেহাদীছ বেনারস’-এর মতো আধুনিক গ্রন্থগুলিতেও এ বিষয়ে কোন বক্তব্য এমনকি সামান্যতম ইঙ্গিতও নেই। আমরা অনেক খোঁজাখুঁজির পর ‘ফাতাওয়া ছানাইয়া’তে তাঁর কয়েকটি ফৎওয়ার সন্ধান  পেয়েছি।[34] যেমন একটি প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যিকির ও ইবাদতের ক্ষেত্রে শুধু لا إله إلا الله বলতে হবে। কেননা ইবাদতের যোগ্য কেবল আল্লাহর যাত বা সত্তা। মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তো স্রেফ আব্দ (বান্দা), মা‘বূদ (উপাস্য) নন। যেমন হাদীছে উল্লেখিত عبده ورسوله শব্দ থেকে বুঝা যায়।[35] আর হাদীছ সমূহেও এমন ক্ষেত্রে শুধু لا إله إلا الله ই এসেছে। এরপর তিনি لَقِّنُوا مَوْتَاكُمْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ ‘তোমরা মৃত ব্যক্তিকে লা ইলাহা ইল্লাল্লহ-এর তালক্বীন দাও’।[36] أَفْضَلُ الذِّكْرِ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ ‘সর্বোত্তম যিকির হ’ল লা ইলাহা ইল্লাল্লহ’।[37] প্রভৃতি হাদীছ উল্লেখ করে বলেন, এগুলি এবং এ জাতীয় হাদীছ সমূহে مُحَمَّدٌ رَّسُوْلُ اللهِ নেই। সম্ভবত এজন্যই ছূফীদের নিকটেও যিকরে ইবাদতে শুধু لا إله إلا الله ই বলার বিধান আছে’।[38]

রচনাবলী : বক্তৃতা ও দরস-তাদরীসের মতো অল্প বয়সেই তিনি পুরা ভারতে গ্রন্থ রচনায় প্রসিদ্ধি অর্জন করেন। ছাত্রজীবনে তিনি আরবী ও উর্দূতে কয়েকটি পুস্তিকা রচনা করেন। তাঁর রচনা সমূহের মধ্যে জামউল কুরআন ওয়াল আহাদীছ, হাল্লে মুশকিলাতে বুখারী (৩ খন্ড), আল-আমরুল মুবরাম ও সাওয়াউত তরীক সবচেয়ে প্রসিদ্ধ।[39] তাঁর গ্রন্থ সংখ্যা ৬০-এর অধিক। এর অধিকাংশই বিতর্কধর্মী ও সমালোচকদের জবাবে রচিত।[40] নিম্নে তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থ সম্পর্কে আলোকপাত করা হ’ল :

১. জামউল কুরআন ওয়াল আহাদীছ : তিনি এ গ্রন্থে প্রমাণ করেছেন যে, বর্তমানে যেই ধারাবাহিকতায় কুরআন মাজীদ মওজুদ রয়েছে এবং যেভাবে মানুষ তেলাওয়াত করে, ঠিক সেই ধারাবাহিকতায়ই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় কুরআন মাজীদ সংকলিত হয়েছিল। অনুরূপভাবে নবী করীম (ছাঃ)-এর বরকতময় যুগে হাদীছ সংগ্রহ ও সংকলনের সূচনাও ছাহাবীগণ করেছিলেন এবং অসংখ্য হাদীছ সংগৃহীত হয়ে গিয়েছিল। উর্দূ ভাষায় এ বিষয়ে মাওলানা বেনারসীই প্রথম গ্রন্থ লিখে অগ্রগণ্য কৃতিত্বের অধিকারী হন।[41] এ গ্রন্থটির ভূয়সী প্রশংসা করে মা‘আরিফ পত্রিকায় মাওলানা শাহ মঈনুদ্দীন আহমাদ নাদভী লিখেছেন, ‘কিন্তু যতদূর পর্যন্ত কুরআন সংকলনের ইতিহাসের সম্পর্ক রয়েছে, মাওলানা আবুল কাসেম ছাহেবের পুস্তকটি সবচেয়ে বেশী সারগর্ভ ও প্রামাণ্য। এতে হাদীছ সমূহ ও ছাহাবীদের অখন্ডনযোগ্য সাক্ষ্য সমূহের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যুগে কুরআন মাজীদ সম্পূর্ণরূপে বিন্যস্ত হয়েছিল এবং বর্তমান কুরআন সেই যুগেরই বিন্যাসকৃত’।[42] ২০১৪ সালে গ্রন্থটি লাক্ষ্ণৌ থেকে আহসান জামীল মাদানীর তাহক্বীক্ব সহ পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে। পৃষ্ঠা সংখ্যা ১০৪।

২. কাযিয়্যাতুদ দাহীছ ফী হুজ্জিয়াতিল হাদীছ : হাদীছ অস্বীকারকারীদের জবাবে এটি লিখিত। এতে কুরআন মাজীদের আলোকে হাদীছের মর্যাদা ও স্থান বর্ণনা করা হয়েছে। এতে এটাও প্রমাণ করা হয়েছে যে, যেভাবে আল্লাহ তা‘আলা কুরআন সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছেন, সেভাবে তিনি হাদীছ সংরক্ষণেরও দায়িত্ব নিয়েছেন। কুরআনের বিধি-বিধানের প্রতি আমল করা যেমন ওয়াজিব, তেমনি হাদীছের বিধানের প্রতিও আমল করা ওয়াজিব। ১৩২৯ হিজরীতে (১৯১১) কানপুরের মাতবা ইন্তেযামী থেকে এটি ১ম প্রকাশিত হয়। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩২।[43] মাকতাবা সালাফিইয়াহ দারভাঙ্গা থেকে ‘মাশ‘আলে রাহ’ শিরোনামে এর উর্দূ অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে।[44]

৩. হুছূলুল মারাম : এতে দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন মাসআলা-মাসায়েল সম্পর্কিত হাদীছ ও আছার সংকলন করা হয়েছে।

৪. কিতাবুর রদ্দি আলা আবী হানীফা : ইমাম আবুবকর বিন আবী শায়বা (মৃঃ ২২৫ হিঃ) মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বায় এমন ১২৫টি হাদীছ জমা করেছেন যেগুলি ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর ফৎওয়া ও মাসআলা বিরোধী। মাওলানা  বেনারসী সেই হাদীছগুলির উর্দূ অনুবাদ ও ব্যাখ্যা করেছেন। ১৩৩৩ হিজরীতে মাতবা ফারূকী, দিল্লী থেকে এটি প্রকাশিত হয়।

৫. হুসনুছ ছিনা‘আহ ফী ছালাতিত তারাবীহ বিল-জামা‘আহ : এতে হাদীছের আলোকে জামা‘আতে তারাবীহ ছালাত আদায়ের বিষয়টি প্রমাণ করা হয়েছে। ছানাঈ বারকী প্রেস, অমৃতসর থেকে ১৩৬৩ হিঃ/১৯৪৫ সালে এটি প্রকাশিত হয়। পৃষ্ঠা সংখ্যা ২০।

৬. হেদায়াতুল মাসায়েল ইলা আহাদীছে ওয়ায়েল : এতে তিনি আমীন সম্পর্কিত ওয়ায়েল বিন হুজর (রাঃ)-এর হাদীছগুলি জমা করেছেন এবং বিভিন্ন হাদীছের আলোকে সশব্দে আমীন বলা প্রমাণ করেছেন।

৭. আস-সাঈদ (ট্রাক্ট নম্বর ১) : পামফ্লেট জাতীয় এ পুস্তিকায় কুরআন, হাদীছ ও ইমামগণের উক্তির মাধ্যমে আল্লাহ ছাড়া অন্যের নিকট সাহায্য চাওয়া, নযর-নিয়ায ও ফাতেহাখানীর খন্ডন করা হয়েছে। ১৩৩০ হিজরীতে সাঈদুল মাতাবে প্রেস, বেনারস থেকে প্রকাশিত হয়। পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৬।

৮. শারঈ বায পুরস দর ফৎওয়া জাওয়াযে উরস : এটি ‘ফৎওয়া জাওয়াযে উরস’-এর ২০টি প্রশ্নের খন্ডনে রচিত। ১৩৩০ হিজরীতে সাঈদুল মাতাবে প্রেস, বেনারস থেকে প্রকাশিত হয়।

৯. আত-তানকীদ ফী রদ্দিত তাক্বলীদ : হাবীবুল্লাহ নানদূরীর ‘আত-তাক্বলীদ’ গ্রন্থের জবাবে রচিত।

১০. ইজতিলাবুল মানফা‘আহ লিমান ইউতালিয়ু আহওয়ালাল আইম্মা আল-আরবা‘আহ : ১৬ পৃষ্ঠার ছোট্ট এ পুস্তিকায় ইমাম চতুষ্টয় তথা ইমাম আবূ হানীফা, ইমাম মালেক, ইমাম শাফেঈ ও ইমাম আহমাদ (রহঃ)-এর জীবনী ও তাঁদের চিন্তাধারা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।[45]

১১. ইলাজে দর মান্দা দর কায়ফিয়াতে মুবাহাছায়ে টান্ডা : ফয়যাবাদ যেলার টান্ডা নামক স্থানে ১৩৩১ হিজরীর জুমাদাল আখেরাহ মাসে মাওলানা সায়েফ বেনারসী এবং মাওলানা মুহাম্মাদ ফাখের হানাফী এলাহাবাদীর মাঝে শুরু হওয়া লিখিত প্রশ্নোত্তর একপর্যায়ে মুনাযারায় পর্যবসিত হয়। বিতর্কের বিষয় ছিল ‘শিরকী আক্বীদা সমূহ’। উক্ত গ্রন্থে এ লিখিত মুনাযারার সারসংক্ষেপ আলোচনা করা হয়েছে।

১২. সাওয়াউত তরীক : ১৯৪৩ সালের ১২ই এপ্রিল এলাহাবাদ যেলার মউ ঈমায় অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া আহলেহাদীছ কনফারেন্সে সভাপতির ভাষণে প্রদত্ত বক্তব্য এটি। এতে মাওলানা বেনারসী অত্যন্ত সংক্ষেপে আহলেহাদীছদের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। ১৯৪৮ সালে এলাহাবাদের আসরারে কারীমী প্রেস থেকে এটি ১ম মুদ্রিত হয়। অতঃপর ১৯৬৬ সালে মাওলানা দাঊদ রায-এর প্রচেষ্টায় তা পুনঃপ্রকাশিত হয়। ‘মাসলাকে আহলেহাদীছ পর এক নযর’ নামে এ পুস্তিকটি বহুবার প্রকাশিত হয়েছে। ড. আব্দুল গফূর রাশেদ-এর ভূমিকা ও সম্পাদনায় ইদারায়ে তাবলীগে ইসলাম, জামপুর, পাঞ্জাব থেকে এর একটি চমৎকার সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। উক্ত গ্রন্থের উপসংহারে মাওলানা বেনারসী বলেন, ‘স্মরণ রাখুন যে, আহলেহাদীছ জামা‘আতের উন্নতি এইসব জালসা ও কনফারেন্সের মাধ্যমে হবে না। এইসব মজলিসের ফলাফল স্রেফ উঠা-বসা ও আলাপন বৈ কিছুই নয়। আমাদের দ্বীনী মাদরাসাগুলি থেকেই হাদীছের প্রচার-প্রসার হয়ে আসছে এবং এখনো কোন না কোনভাবে হচ্ছে। কিন্তু এটা যথেষ্ট নয়। আমাদের এমন একটি স্বাধীন পত্রিকার প্রয়োজন রয়েছে। যেটি কোন ব্যক্তির মালিকানায় থাকবে না। জাতি তার মালিক হবে। আর একজন সচেতন, দক্ষ, অভিজ্ঞ এবং পুরাতন ও নতুন জ্ঞানে বিজ্ঞ আলেম তা সম্পাদনা করবেন’।[46]

মিয়াঁ নাযীর হুসাইন মুহাদ্দিছ দেহলভী সম্পর্কে তিনি উক্ত গ্রন্থের এক জায়গায় লিখেছেন, ‘অলিউল্লাহী মসনদে শায়খুল কুল ফিল কুল হযরত মাওলানা সাইয়িদ মুহাম্মাদ নাযীর হুসাইন ছাহেব (রহঃ) যখন সমাসীন হলেন, তখন জনৈক হানাফী ‘তানভীরুল হক’ নামে ‘তানভীরুল আইনাইন’-এর জবাব প্রকাশ করেন। আমাদের শায়খ ‘মি‘য়ারুল হক’ নামে তার জবাব দেন এবং নিজের আমল উপরন্তু ওয়ায ও দরসের মাধ্যমে বিশাল জনগোষ্ঠীকে আহলেহাদীছ করেন। আজকে এই দেশে হাদীছে নববীর যতটুকু চর্চা এবং আহলেহাদীছের সংখ্যাধিক্য দেখা যায় তা ঐ বরকতময় সত্তার পুণ্যকর্মের ফল’।[47]

১৩. আয-যাহরুল বাসেম ফির-রুখছাতি ফিল জাময়ি বায়না মুহাম্মাদ ওয়া আবিল কাসেম : মুহাম্মাদ নাম ও আবুল কাসেম কুনিয়াত এক সাথে রাখা যাবে না মর্মে মাওলানা হাকীম আবু তুরাব মুহাম্মাদ আব্দুল হক অমৃতসরী লিখিত  একটি পুস্তিকার জবাবে এটি রচিত। মাওলানা বেনারসী ছহীহ হাদীছ, ছাহাবী, তাবেঈ ও তাবে তাবঈগণের উক্তির মাধ্যমে শক্তভাবে অমৃতসরীর জবাব দেন এবং প্রমাণ করেন যে, মুহাম্মাদ ও আবুল কাসেম নাম ও কুনিয়াত একসাথে রাখা জায়েয। ১৩৩১ হিজরীতে সাঈদুল মাতাবে, বেনারস থেকে এটি প্রথম প্রকাশিত হয়। পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৬।

১৪. তানকীদুল মি‘য়ার : এ গ্রন্থে বিদ‘আতীদের শাহ ইসমাঈল শহীদ ও মাওলানা মুহাম্মাদ সাঈদ বেনারসীর সমালোচনার জবাব দেয়া হয়েছে। ১৯২৪ সালে এটি প্রথম প্রকাশিত হয়।

১৫. তাযকিরাতুস সাঈদ : ৩৬ পৃষ্ঠার এ পুস্তিকায় বেনারসী তাঁর পিতা মাওলানা মুহাম্মাদ সাঈদ বেনারসীর জীবনী সংলাপাকারে লিপিবদ্ধ করেছেন। ১৯১০ সালে এটি প্রথম প্রকাশিত হয়।

১৬. সফরনামায়ে বায়তুল্লাহ : ৬৪ পৃষ্ঠার এ পুস্তকে তিনি হজ্জ সফরের বিবরণ পেশ করেছেন। এতে হজ্জের নিগূঢ় তত্ত্ব ও উদ্দেশ্য, কুরবানীর বিধান, হারামাইন শরীফাইন-এর অবস্থা, হজ্জের আরকান সমূহের মাসনূন দো‘আ সমূহ প্রভৃতি বিষয় আলোচনা করা হয়েছে। ১৩৩১ হিজরীতে এটি প্রথম প্রকাশিত হয়।

মনীষীদের দৃষ্টিতে বেনারসী : ১. মাওলানা মুহাম্মাদ হানীফ নাদভী ১৯৪৯ সালের ৯ই ডিসেম্বর ‘আল-ই‘তিছাম’ পত্রিকায় তাঁর মৃত্যুতে লিখেন, ‘আবুল কাসেম বেনারসী মরহুম অতুলনীয় আলেম, বিশুদ্ধভাষী বাগ্মী এবং চৌকস মুনাযির ছিলেন। তিনি হাদীছ ও ফিক্বহের খুঁটিনাটি বিষয়ে গভীর জ্ঞান রাখতেন। ইসলামের ইতিহাস যার সাথে আলেম সমাজের যোগসূত্র কম ছিল, সেটি মাওলানার খাছ বিষয় ছিল। অতঃপর ইসলামের ইতিহাসের ঐ অংশ যার সম্পর্ক মুহাদ্দিছগণের জীবন চরিতের সাথে সেটা তো তার প্রায় কণ্ঠস্থ ছিল। সমকালীন সকল জ্ঞানগত ও রাজনৈতিক আন্দোলনে তিনি জোরেশোরে অংশগ্রহণ করেন। শুরু থেকেই ‘জমঈয়তে ওলামায়ে হিন্দে’র সাথে ছিলেন এবং কয়েকবার জেলেও গিয়েছেন। আহলেহাদীছ দর্শনের সাথে তো মরহুমের প্রেম ছিল। তিনি যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন এর প্রচার-প্রসারে সচেষ্ট ছিলেন’।[48]

২. ভারতের বিখ্যাত উর্দূ মাসিক পত্রিকা ‘মা‘আরিফ’-এর সম্পাদকীয় নিবন্ধে মাওলানা শাহ মঈনুদ্দীন আহমাদ নাদভী লিখেছেন, ‘দুঃখজনক হল যে, গত মাসে আহলেহাদীছ জামা‘আতের প্রসিদ্ধ ও খ্যাতিমান আলেম এবং নামকরা মুনাযির মাওলানা মুহাম্মাদ আবুল কাসেম ছাহেব সায়েফ বেনারসী ৬১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। মরহুমের সারাজীবন ইসলাম ও দ্বীনী ইলমের খিদমতে অতিবাহিত হয়। মাদরাসা সাঈদিয়া, বেনারসে ৪০ বছর যাবৎ তিনি হাদীছে নববীর দরস প্রদান করেছেন। যা তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। দরস-তাদরীসের সাথে সাথে ওয়ায ও তাবলীগ এবং গ্রন্থ রচনার ব্যস্ততাও ছিল। কিন্তু তাঁর অধিকাংশ গ্রন্থ বিতর্কধর্মী। তিনি আর্য সমাজী, খ্রিস্টান এবং কাদিয়ানীদের সাথে বড় বড় মুনাযারা যুদ্ধ করেন। হানাফীদের সাথেও কখনো কখনো তার বিতর্ক হ’ত। এদিকে কয়েক বছরের মধ্যে তিনি কয়েকবার প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হন। যার ফলে তার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়েছিল। এতদসত্ত্বেও তার ইলমী ও তা‘লীমী কর্মকান্ড জারী ছিল। অবশেষে গত ২৫শে নভেম্বর জুম‘আর দিন পুনরায় হঠাৎ প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হন এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ক্বালাল্লাহ ও ক্বালার রাসূল-এর এই আওয়ায চিরদিনের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। মরহুমের মৃত্যুতে ভারতের এক খ্যাতিমান আলেমের স্থান শূন্য হয়ে গেল। হে আল্লাহ! তাঁকে অবারিত ক্ষমা করুন’।[49]

৩. ‘আখবারে  ছিদক্ব’  পত্রিকার ৯ই ডিসেম্বর সংখ্যায় লেখা হয়েছে, ‘অত্যন্ত দুঃখ ও বেদনার সাথে এ সংবাদ জানানো যাচ্ছে যে, ইমামুল মুতাকাল্লিমীন (বাগ্মীদের নেতা), রঈসুল মুনাযিরীন (তার্কিকদের গুরু), ফখরুল মুহাদ্দিছীন (মুহাদ্দিছগণের গর্ব), মুজতাহিদুল আছর (যুগের মুজতাহিদ) হযরতুল আল্লামা কুদওয়াতুল ফাহহামা আলহাজ্জ মাওলানা  হাফেয মুহাম্মাদ আবুল কাসেম ছাহেব সায়েফ বেনারসী কয়েক ঘণ্টার কঠিন পীড়ার পর ২৫শে নভেম্বর জুম‘আর দিন ১২-টার সময় মৃত্যুর ডাকে সাড়া দেন’।[50]

৪. মাওলানা মুহাম্মাদ ইসহাক ভাট্টী বলেন, ‘মাওলানা আবুল কাসেম তাঁর যুগে অত্যন্ত প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। বক্তৃতা ও লেখনীতে তাঁর মর্যাদা অনেক উঁচু ছিল। পাঠদান ও গ্রন্থ রচনায় তিনি অত্যন্ত সুনাম অর্জন করেন। অনেক আলেম তাঁর কাছ থেকে জ্ঞানার্জন করেন এবং ইসলামের প্রচার-প্রসারের কারণ হন। রাজনীতিতেও তার পরিধি ছিল ব্যাপক। দেশের স্বাধীনতার জন্য অনেকবার জেলে যান এবং শাস্তি ভোগ করেন। তিনি প্রজ্ঞাবান, তীক্ষ্ণধীশক্তি সম্পন্ন এবং উন্নত চিন্তা-চেতনার অধিকারী আলেম ছিলেন। সুমিষ্ট ভাষা, সাদা মন এবং আমল ও কর্মে নিজের উদাহরণ নিজেই ছিলেন’।[51]

৫. জীবনীকার আব্দুর রশীদ ইরাকী বলেন, ‘মাওলানা বেনারসী মাসলাকে আহলেহাদীছের প্রতিরক্ষা এবং এর প্রসার ও উন্নয়নে কার্যকর অবদান রাখেন এবং এর সাথে সাথে বাতিল ধর্ম সমূহের খন্ডনেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন’।[52]

৬. গবেষক তানযীল ছিদ্দীক্বী বলেন, ‘আল্লামা সায়েফ বেনারসী বিভিন্ন বিষয়ে সমান পারদর্শী ছিলেন। তাঁর ইলমে চিন্তার গভীরতা এবং সূক্ষ্মদৃষ্টি ছিল। যেহেতু তিনি উঁচুদরের মুনাযিরও ছিলেন সেজন্য বিশ্লেষণের পরিবর্তে সংক্ষেপে সারগর্ভভাবে উদ্দেশ্য বর্ণনা করতেন। বিভিন্ন বিষয়ে তার রচনাসমূহ তার জ্ঞান ও চিন্তার গভীরতার সাক্ষ্য। কবিতা ও সাহিত্যের প্রতিও তার অনুরাগ ছিল। আরবী, ফারর্সী ও উর্দূ তিন ভাষাতেই ছন্দ রচনা করতেন। সংস্কৃত ও ইংরেজী ভাষাও জানতেন। তিনি একজন উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন বাগ্মী এবং সাহসী সাংবাদিক ছিলেন’।[53]

৭. গবেষক মুহাম্মাদ উযাইর শামস বলেন, هو المحدث الكبير العلامة الشيخ محمد أبو القاسم سيف بن الشيخ محمد سعيد البنارسى، من العلماء المحققين المتأخرين فى الهند. ‘তিনি বড় মুহাদ্দিছ আল্লামা শায়খ মুহাম্মাদ আবুল কাসেম সায়েফ বিন শায়খ মুহাম্মাদ সাঈদ বেনারসী। তিনি ভারতের পরবর্তী মুহাক্কিক আলেমদের অন্যতম’।[54]

৮. ‘দিফায়ে ছহীহ বুখারী’র মুহাক্কিক হাফেয শাহেদ মাহমূদ বলেছেন, ‘হিন্দুস্তানের বড় বড় আলেম ও মহান ব্যক্তিদের মধ্যে মাওলানা বেনারসীকে গণ্য করা হ’ত। তিনি আহলেহাদীছ মাসলাকের প্রচার-প্রসারের জন্য লেখনী ও বক্তৃতার মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। আহলেহাদীছের উল্লেখযোগ্য প্রত্যেকটি জালসায় তাঁর অংশগ্রহণ ফরযে কিফায়া মনে করা হ’ত। মাসলাকে আহলেহাদীছের সাংগঠনিক ও জামা‘আতী বিষয় সমূহে তিনি সর্বাগ্রে থাকতেন। কোন দিক থেকে আহলেহাদীছ মাসলাকের বিরুদ্ধে কোন পুস্তিকা বা গ্রন্থ সামনে আসলে দ্রুত তার উত্তর লিখতে মগ্ন হয়ে যেতেন এবং কোন জায়গায় বাহাছ-মুনাযারার প্রয়োজন দেখা দিলে নির্দ্বিধায় বিরোধীপক্ষের সাথে মুনাযারা করার জন্য পৌঁছে যেতেন। মোটকথা, আহলেহাদীছ মাসলাকের প্রচার-প্রসার, সাহায্য-সহযোগিতা ও প্রতিরক্ষা, বিরোধিতাসুলভ লেখনী সমূহের এবং সন্দেহ-সংশয়ের অপনোদন করাই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য’।[55]

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, মাওলানা মুহাম্মাদ আবুল কাসেম সায়েফ বেনারসী উপমহাদেশের একজন খ্যাতিমান মুহাদ্দিছ, অপ্রতিদ্বন্দ্বী মুনাযির ও বহু গ্রন্থপ্রণেতা আলেমে দ্বীন ছিলেন। তাঁর পিতা মাওলানা মুহাম্মাদ সাঈদ বেনারসীও প্রখ্যাত মুহাদ্দিছ ছিলেন। পিতার প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা সাঈদিয়ায় তিনি ৪০ বছর যাবৎ হাদীছের দরস প্রদান করে এক অনন্য মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছিলেন। এটি তাঁর জীবনের অমূল্য পাথেয় ও সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি। পিতা-পুত্রের প্রচেষ্টায় হিন্দু অধ্যুষিত বেনারস আহলেহাদীছ আন্দোলনের মারকাযে পরিণত হয়েছিল। ইসলামের খেদমত ও হাদীছের হেফাযতে তিনি আজীবন নিয়োজিত ছিলেন। হাদীছে নববীর উপর তাঁর অগাধ দখল, পান্ডিত্য ও ভালবাসা ছিল সর্বজনস্বীকৃত। কথা, কলম, সংগঠন এই ত্রয়ী মাধ্যমে আহলেহাদীছ আন্দোলনের  প্রচার-প্রসারে তিনি যে অবদান রেখে গেছেন, ইতিহাসের সোনালী পাতায় তা সতত সমুজ্জ্বল, দীপ্তিমান। ছহীহুল বুখারীর এই সাচ্চা প্রেমিক আমাদের প্রেরণার উৎস। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাঊসে স্থান দান করে সম্মানিত করুন! আমীন!!


[1]. তাযকিরাতুল মুনাযিরীন ১/৩২৬; চালীস ওলামায়ে আহলেহাদীছ, পৃঃ ২১৫

[2]. তাযযিয়াতুল মুনাযিরীন, ১/৩২৬; নওশাহরাবী, তারাজিম, পৃঃ ২৯৩

[3]. তারাজিমে ওলামায়ে আহলেহাদীছ বেনারস, পৃঃ ৩২৮

[4]. মুহাম্মাদ রামাযান ইউসুফ সালাফী, আক্বীদায়ে খতমে নবুঅত কে তাহাফ্ফুয মেঁ ওলামায়ে আহলেহাদীছ কী মিছালী খিদমাত (শিয়ালকোট : মাকতাবা রহমানিয়া, মে ২০১০), পৃঃ ৫৫-৫৬; তাযকিরাতুল মুনাযিরীন ১/৩২৩, ৩২৬; আল-ই‘তিছাম, লাহোর, পাকিস্তান, ২৯শে অক্টোবর-২রা নভেম্বর, ২০১৭, পৃঃ ২৪

[5]. তারাজিমে ওলামায়ে আহলেহাদীছ বেনারস, পৃঃ ৩৩৯

[6]. আব্দুর রশীদ ইরাকী, খতমে নবুঅত কে দালায়েল আওর উসকে দেফা‘ মেঁ পাক ওয়া হিন্দ কে ওলামায়ে আহলেহাদীছ কা ফিরদার, আল-ই‘তিছাম, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৪

[7]. চালীস ওলামায়ে আহলেহাদীছ, পৃঃ ২১৪

[8]. দিফায়ে ছহীহ বুখারী, পৃঃ ২৪

[9]. ঐ, পৃঃ ২৫, মুক্বাদ্দামাতুত তাহকীক

[10]. ঐ, পৃঃ ৬৮, ২৪২

[11]. ঐ, পৃঃ ২৬, ২৮৮

[12]. ঐ, পৃঃ ২৬, ৩২০

[13]. ঐ, পৃঃ ৪০১

[14]. ঐ, পৃঃ ৭০২

[15]. ঐ, পৃঃ ৭০২

[16]. ঐ, পৃঃ ৭৫৪

[17]. ঐ, পৃঃ ৯৩৭

[18]. ঐ, পৃঃ ৯৩৯

[19]. ঐ, পৃঃ ৯৬২

[20]. দিফায়ে ছহীহ বুখারী, পৃঃ ৫৯; তারাজিমে ওলামায়ে আহলেহাদীছ বেনারস, পৃঃ ৩২৯

[21]. নূরে তাওহীদ, লাক্ষ্ণৌ, সায়ফুল ইসলাম সংখ্যা, জানুঃ-ফেব্রুঃ ১৯৫১, পৃঃ ১৩

[22]. তারাজিমে ওলামায়ে আহলেহাদীছ বেনারস, পৃঃ ৩২৯

[23]. ঐ, পৃঃ ৩৭৫

[24]. ঐ, পৃঃ ৩২২, ৩২৯-৩৩০

[25]. ঐ, পৃঃ ১৮১

[26]. ঐ, পৃঃ ৩৩০; দিফায়ে ছহীহ বুখারী, পৃঃ ৪৯

[27]. আহলেহাদীছ, ফেব্রুয়ারী ১৯২৪, বর্ষ ২১, সংখ্যা ১৮

[28]. তারাজিমে ওলামায়ে আহলেহাদীছ বেনারস, পৃঃ ৩৪০-৩৪১

[29]. দিফায়ে ছহীহ বুখারী, পৃঃ ৫৯

[30]. তারাজিমে ওলামায়ে আহলেহাদীছ বেনারস, পৃঃ ৩৪৪

[31]. মাসিক তর্জুমানুল হাদীছ, ১ম বর্ষ, ৩য় সংখ্যা, রবীউল আউয়াল ১৩৬৯ হিঃ, পৃঃ ১৪৭

[32]. তারাজিমে ওলামায়ে আহলেহাদীছ বেনারস, পৃঃ ৩২৩

[33]. ঐ, পৃঃ ৩২৩-৩২৪

[34]. দ্র. ফাতাওয়া ছানাইয়াহ, সংকলনে: মাওলানা মুহাম্মাদ দাঊদ রায (দিল্লী : মাকতাবায়ে তারজুমান, অক্টোবর ২০০১), ১/১০৭, ১৭৯, ২৭৬; ২/৩০৪, ৬০২

[35]. বুখারী হা/৮৩১

[36]. মুসলিম হা/২১৬২

[37]. তিরমিযী হা/৩৭১১; ইবনু মাজাহ হা/৩৯৩২

[38]. ঐ, ১/১৮০

[39]. তারাজিমে ওলামায়ে আহলেহাদীছ বেনারস, পৃঃ ৩৩১

[40]ঐ, পৃঃ ৩৩০-৩৪০; দিফায়ে ছহীহ বুখারী, পৃঃ ২৫-৩৪, ৪৯-৫৮

[41]. মুহাম্মাদ ইসহাক ভাট্টী, বার্রে ছাগীর মেঁ আহলেহাদীছ কি আওয়ালিয়াত (গুজরানওয়ালা, পাকিস্তান : দারু আবিত ত্বাইয়িব, ১ম প্রকাশ, সেপ্টেম্বর ২০১২), পৃঃ ৪২; ঐ বঙ্গানুবাদ: ভারতীয় উপমহাদেশের আহলেহাদীছগণের অগ্রণী ভূমিকা, পৃঃ ৩০

[42]. মাসিক মা‘আরিফ, আযমগড়, ইউপি, ভারত, বর্ষ ৪০, সংখ্যা ১, জুলাই ১৯৩৭, পৃঃ ৭৬

[43]. তারাজিমে ওলামায়ে আহলেহাদীছ বেনারস, পৃঃ ৩৩১-৩২; দিফায়ে ছহীহ বুখারী, পৃঃ ৫০

[44]. পাক্ষিক তারজুমান, দিল্লী, ৩৬/২ সংখ্যা, ১৬-৩১শে জানুঃ’১৬, পৃঃ ১২

[45]. এই দুর্লভ গ্রন্থটি মুহতারাম আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব স্যারের ব্যক্তিগত লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত আছে।-লেখক

[46]. মাসলাকে আহলেহাদীছ পর এক নযর, পৃঃ ৪৪-৪৫

[47]. ঐ, পৃঃ ৪০-৪১

[48]. চালীস ওলামায়ে আহলেহাদীছ, পৃঃ ২১৭

[49]. মাসিক মা‘আরিফ, ভারত, বর্ষ ৬৪, সংখ্যা ৬, ডিসেম্বর ১৯৪৯, পৃঃ ৪০২

[50]. নওশাহরাবী, তারাজিম, পৃঃ ২৯৩, পাদটীকা দ্রঃ

[51]. চালীস ওলামায়ে আহলেহাদীছ, পৃঃ ২১৭

[52]. ঐ, পৃঃ ২১৪

[53]. দিফায়ে ছহীহ বুখারী, পৃঃ ৪৪

[54]. হায়াতুল মুহাদ্দিছ শামসুল হক ওয়া আ‘মালুহু, পৃঃ ২৬৯

[55]. দিফায়ে ছহীহ বুখারী, পৃঃ ২৩, মুক্বাদ্দামাতুত তাহকীক





মাওলানা মুহাম্মাদ আবুল কাসেম সায়েফ বেনারসী - ড. নূরুল ইসলাম
মাওলানা মুহাম্মাদ আবুল কাসেম সায়েফ বেনারসী (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - ড. নূরুল ইসলাম
মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ)-এর ব্যাপারে কিছু আপত্তি পর্যালোচনা (৪র্থ কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) (জুলাই’১৮ সংখ্যার পর) - ড. নূরুল ইসলাম
যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) (৪র্থ কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
মাওলানা আব্দুল ওয়াহ্হাব মুহাদ্দিছ দেহলভী - ড. নূরুল ইসলাম
ইমাম নাসাঈ (রহঃ) (২য় কিস্তি) - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ)-এর ব্যাপারে কিছু আপত্তি পর্যালোচনা (২য় কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) (৭ম কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (রহঃ) (৪র্থ কিস্তি) - ড. নূরুল ইসলাম
ইবনু মাজাহ (রহঃ) (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
ড. মুক্তাদা হাসান আযহারী - ড. নূরুল ইসলাম
আরও
আরও
.