মানব
জীবনে পারিবারিক বন্ধন এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। স্বামী ও স্ত্রীর মাধ্যমে এই
পরিবার গড়ে ওঠে। বিবাহের মাধ্যমেই এ সম্পর্কের সূত্রপাত। আবার কখনো যদি
সম্পর্কের টানাপোড়নে একত্রে বসবাস সম্ভব না হয়, তাহ’লে তালাকের মাধ্যমেই
তার পরিসমাপ্তি ঘটে। তাই তালাক সম্পর্কে সবিস্তার অবহিত হওয়া যরূরী। আলোচ্য
নিবন্ধে তালাকের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোচনা করা হ’ল।-
তালাক সম্পর্কে জানতে হ’লে কয়েকটি পরিভাষা জানা আবশ্যক। যথা- ইদ্দত, মাসিক বা ঋতু, পবিত্রকাল, রাজঈ তালাক, বায়েন তালাক, মুগাল্লাযা তালাক ইত্যাদি।
ইদ্দত : তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী ঋতুবতী হ’লে তালাকপ্রাপ্তির পর থেকে তিন ঋতু পর্যন্ত এবং ঋতুবতী না হ’লে তিন মাস বা ৯০ দিন পর্যন্ত শারঈ নিয়মে যে বিশেষ অবস্থায় কালাতিপাত করে তাকে ইদ্দত বলে। ইদ্দত চলাকালে অন্য পুরুষকে বিয়ে করা যায় না। কোন কোন তালাকে ইদ্দতকালে বিয়ে বহাল থাকে এবং স্বামী চাইলে স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে পারে। এরূপ ক্ষেত্রে ইদ্দতকালে স্বামী মারা গেলে স্ত্রী তার ওয়ারিছও হবে।
মাসিক : প্রাপ্তবয়স্কা নারীদের সাধারণতঃ প্রতি মাসে একবার গর্ভাশয় থেকে রক্তস্রাব হয়। একে মাসিক বা ঋতু বলে। মাসিকের আরবী প্রতিশব্দ ‘হায়েয’ (الحيض)। সাধারণতঃ তিন থেকে দশ দিন এই রক্ত নির্গত হয়। মাসিকের সময় তালাক দেওয়া শরী‘আতে নিষিদ্ধ।
পবিত্রকাল : দুই মাসিকের মধ্যবর্তী সময়কালকে পবিত্রকাল বলে। পবিত্রকালের আরবী প্রতিশব্দ ‘তুহুর’ (الطهر)। তালাক এই পবিত্রকালে সহবাসমুক্ত অবস্থায় দিতে হয়। অবশ্য যাদের মাসিক শুরু হয়নি কিংবা বয়সজনিত কারণে বন্ধ হয়ে গেছে তারা সব সময় পবিত্রকালের মধ্যে গণ্য। তাদের তালাকদানে সহবাস থেকে মুক্ত হওয়ার কথা নেই।
রাজঈ তালাক : যাদের মাসিক হয় এমন নারীদের পবিত্রকালে সহবাসমুক্ত অবস্থায় এবং যাদের মাসিক হয় না তাদের যেকোন অবস্থায় এক তালাক দিলে ইদ্দতকাল পর্যন্ত উক্ত তালাককে রাজঈ তালাক বলে। রাজঈ অর্থ ফিরে আসা, প্রত্যাহার করা। এরূপ তালাকে ইদ্দতের মধ্যে তালাক প্রত্যাহার করে স্ত্রীর সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কে ফিরে আসা যায়। তাই একে রাজঈ তালাক বলে। বৈবাহিক সম্পর্ক পুনরায় স্থাপনের পর স্বামী দুই তালাকের মালিক থাকবে। এর মধ্যে স্বামী চাইলে স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে পারবে।
বায়েন তালাক : রাজঈ তালাক দেয়ার পর ইদ্দতের মধ্যে স্বামী স্ত্রীকে ফিরিয়ে না নিলে উক্ত রাজঈ তালাক ইদ্দত শেষ হওয়ার সাথে সাথে বায়েন তালাকে পরিণত হবে। বায়েন অর্থ বিচ্ছিন্নকারী। অর্থাৎ তালাক বায়েন হওয়ার সাথে সাথে বিবাহ পুরোপুরি ছিন্ন হয়ে যাবে। এবার স্ত্রী চাইলে অন্য পুরুষকে বিয়ে করতে পারবে, আবার চাইলে তালাকদাতা স্বামীকেও নতুনভাবে বিয়ে করতে পারবে। বায়েন তালাকও দু’বার পর্যন্ত সিদ্ধ। অবশ্য বিয়ের পর স্বামী স্ত্রীর সাথে সহবাস কিংবা নির্জনবাসের পূর্বেই তালাক দিলে তৎক্ষণাৎ তা এক তালাক বায়েন বলে গণ্য হবে।
মুগাল্লাযা তালাক : দুই তালাক রাজঈ কিংবা দুই তালাক বায়েনের পর স্বামীর হাতে থাকা এক তালাকও দিয়ে দেয়া হ’লে তাকে মুগাল্লাযা তালাক বলে। মুগাল্লাযা অর্থ চূড়ান্ত। এই তালাকের পর ইদ্দতের মধ্যে কিংবা শেষে স্ত্রীকে আর ফিরিয়ে নেয়া যাবে না। এবার স্ত্রী স্বাধীনভাবে অন্য পুরুষকে বিয়ে করবে। তারপর উক্ত স্বামীও যথা নিয়মে তালাক দিলে কিংবা মারা গেলে প্রথম স্বামীকে চাইলে সে পুনরায় বিয়ে করতে পারবে। অতএব তালাক প্রথমে রাজঈ তারপর বায়েন এবং সর্বশেষে মুগাল্লাযায় পরিণত হয়।
কুরআন ও হাদীছে তালাক :
ইসলাম নারী-পুরুষের বিবাহকে একটি পবিত্র বন্ধন মনে করে। এই বন্ধনের পবিত্রতা ও শুদ্ধতার উপর তাদের ভবিষ্যৎ বংশধারার পবিত্রতা নির্ভর করে। এর ভিত্তিতেই তার স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির উত্তরাধিকার নির্ণীত হয়। তাই এহেন বন্ধনকে ছিন্ন করা ইসলাম পসন্দ করে না। ইসলাম কেবল অনন্যোপায় অবস্থায় তালাক বৈধ করেছে।
তালাক দান কালে স্বামীকে সুস্থ মস্তিষ্ক, প্রাপ্তবয়স্ক ও
স্বাধীন হ’তে হবে। পাগল, অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও অন্য কর্তৃক বল প্রয়োগের ফলে
প্রদত্ত তালাক কার্যকর হবে না।[1]
এখন তালাক কিভাবে দিলে শরী‘আতসম্মত হবে তা আমাদের দেখতে হবে। স্ত্রীর কারণে যদি তালাকের পরিস্থিতির উদ্ভব হয় তবে সূরা নিসার ৩৪ ও ৩৫ নং আয়াত অনুসারে কাজ করা ভাল। আল্লাহ বলেন,
الرِّجَالُ قَوَّامُوْنَ عَلَى النِّسَاءِ بِمَا فَضَّلَ اللهُ بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ وَبِمَا أَنْفَقُوا مِنْ أَمْوَالِهِمْ فَالصَّالِحَاتُ قَانِتَاتٌ حَافِظَاتٌ لِلْغَيْبِ بِمَا حَفِظَ اللهُ وَاللَّاتِي تَخَافُونَ نُشُوزَهُنَّ فَعِظُوهُنَّ وَاهْجُرُوْهُنَّ فِي الْمَضَاجِعِ وَاضْرِبُوهُنَّ فَإِنْ أَطَعْنَكُمْ فَلَا تَبْغُوا عَلَيْهِنَّ سَبِيْلًا إِنَّ اللهَ كَانَ عَلِيًّا كَبِيْرًا، وَإِنْ خِفْتُمْ شِقَاقَ بَيْنِهِمَا فَابْعَثُوْا حَكَمًا مِنْ أَهْلِهِ وَحَكَمًا مِنْ أَهْلِهَا إِنْ يُرِيْدَا إِصْلَاحًا يُوَفِّقِ اللهُ بَيْنَهُمَا إِنَّ اللهَ كَانَ عَلِيْمًا خَبِيْرًا-
‘পুরুষেরা নারীদের উপর কর্তৃত্বশীল। এজন্য যে, আল্লাহ একের উপর অন্যকে প্রাধান্য দান করেছেন এবং এজন্য যে, তারা (নারীদের ভরণ-পোষণের জন্য) তাদের মাল-সম্পদ হ’তে ব্যয় করে থাকে। অতএব সতী-সাধ্বী স্ত্রীরা হয় অনুগত এবং আল্লাহ যা হেফাযত করেছেন, আড়ালেও (সেই গুপ্তাঙ্গের) হেফাযত করে। আর যদি তোমরা তাদের অবাধ্যতার আশংকা কর, তাহ’লে তাদের সদুপদেশ দাও, তাদের বিছানা পৃথক করে দাও এবং (প্রয়োজনে) প্রহার কর। অতঃপর যদি তারা তোমাদের অনুগত হয়, তাহ’লে তাদের জন্য অন্য কোন পথ অনুসন্ধান করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বোচ্চ ও মহীয়ান...। আর যদি তোমরা (স্বামী-স্ত্রী) উভয়ের মধ্যে বিচ্ছেদের আশংকা কর, তাহ’লে স্বামীর পরিবার থেকে একজন ও স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন শালিস নিযুক্ত কর। যদি তারা উভয়ে মীমাংসা চায়, তাহ’লে আল্লাহ উভয়ের মধ্যে (সম্প্রীতির) তাওফীক দান করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও ভিতর-বাহির সবকিছু অবহিত’ (নিসা ৪/৩৪-৩৫)।
উভয়ের মধ্যে আপোষ হ’লে ভাল, নচেৎ তালাকের প্রশ্ন দেখা দেবে। স্বামী তখন তালাক দিতে চাইলে সূরা বাক্বারার ২২৯ আয়াত, সূরা তালাকের ১ ও ২ আয়াত এবং ইবনু ওমর (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর স্ত্রীকে যেভাবে তালাক দিতে বলেছিলেন ঐ নিয়ম মেনে তালাক দেবে। যেমন আল্লাহ বলেন,
اَلطَّلَاقُ مَرَّتَانِ فَإِمْسَاكٌ بِمَعْرُوْفٍ أَوْ تَسْرِيْحٌ بِإِحْسَانٍ وَلَا يَحِلُّ لَكُمْ أَنْ تَأْخُذُوْا مِمَّا آتَيْتُمُوْهُنَّ شَيْئًا إِلَّا أَنْ يَخَافَا أَلاَّ يُقِيمَا حُدُوْدَ اللهِ فَإِنْ خِفْتُمْ أَلاَّ يُقِيْمَا حُدُوْدَ اللهِ فَلاَ جُنَاحَ عَلَيْهِمَا فِيْمَا افْتَدَتْ بِهِ تِلْكَ حُدُوْدُ اللهِ فَلاَ تَعْتَدُوْهَا وَمَنْ يَتَعَدَّ حُدُوْدَ اللهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُوْنَ-
‘তালাক হবে দু’বার। অতঃপর হয় তাকে ন্যায়ানুগভাবে রেখে দিবে, নয় সদাচরণের সাথে পরিত্যাগ করবে। আর তাদেরকে তোমরা যা কিছু দিয়েছ, তা থেকে কিছু ফেরৎ নেওয়া তোমাদের জন্য সিদ্ধ নয়। তবে যদি তারা আল্লাহর নির্ধারিত সীমা ঠিক রাখতে পারবে না বলে আশংকা করে। এক্ষণে যদি তোমরা ভয় কর যে তারা আল্লাহর নির্ধারিত সীমা ঠিক রাখতে পারবে না, তাহ’লে স্ত্রী কিছু বিনিময় দিলে তা গ্রহণে উভয়ের কোন দোষ নেই। এটাই আল্লাহর সীমারেখা। অতএব তোমরা তা অতিক্রম করো না। যারা আল্লাহর সীমারেখা সমূহ অতিক্রম করে, তারা হ’ল সীমালংঘনকারী’ (বাক্বারাহ ২/২২৯)।
يَاأَيُّهَا النَّبِيُّ إِذَا طَلَّقْتُمُ النِّسَاءَ فَطَلِّقُوْهُنَّ لِعِدَّتِهِنَّ وَأَحْصُوْا الْعِدَّةَ وَاتَّقُوا اللهَ رَبَّكُمْ لاَ تُخْرِجُوْهُنَّ مِنْ بُيُوْتِهِنَّ وَلاَ يَخْرُجْنَ إِلاَّ أَنْ يَأْتِينَ بِفَاحِشَةٍ مُبَيِّنَةٍ وَتِلْكَ حُدُوْدُ اللهِ وَمَنْ يَتَعَدَّ حُدُوْدَ اللهِ فَقَدْ ظَلَمَ نَفْسَهُ لَا تَدْرِيْ لَعَلَّ اللهَ يُحْدِثُ بَعْدَ ذَلِكَ أَمْرًا، فَإِذَا بَلَغْنَ أَجَلَهُنَّ فَأَمْسِكُوْهُنَّ بِمَعْرُوْفٍ أَوْ فَارِقُوْهُنَّ بِمَعْرُوْفٍ وَأَشْهِدُوْا ذَوَيْ عَدْلٍ مِنْكُمْ-
‘হে নবী! (তুমি মুমিনদের বলে দাও) যখন তোমরা স্ত্রীদের তালাক দেবে তখন তাদের ইদ্দতের প্রতি লক্ষ্য রেখে তাদেরকে তালাক দেবে এবং ইদ্দতের হিসাব রাখবে। তোমরা তোমাদের প্রভু আল্লাহকে ভয় কর। তোমরা তাদেরকে তাদের বাসগৃহ থেকে বের করে দেবে না। আর তারাও বেরিয়ে যাবে না। যদি না তারা স্পষ্ট অশ্লীলতায় লিপ্ত হয়। এগুলো আল্লাহর বিধান। যে আল্লাহর বিধান লংঘন করবে সে নিজের উপর যুলুম করবে। তুমি জান না হয়ত আল্লাহ এর পর কোন উপায় করে দেবেন। তারপর যখন তাদের ইদ্দত পূরণের কাল কাছাকাছি হবে তখন তোমরা হয় বিধি অনুযায়ী তাদের রেখে দেবে অথবা বিধি অনুযায়ী তাদের বিচ্ছিন্ন করে দেবে এবং তোমাদের মধ্য হ’তে দু’জন ন্যায়পরায়ণ লোককে সাক্ষী রাখবে’ (তালাক্ব ৬৫/১-২)।
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ رضى الله عنهما أَنَّهُ طَلَّقَ امْرَأَتَهُ وَهِىَ حَائِضٌ عَلَى عَهْدِ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَسَأَلَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم عَنْ ذَلِكَ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم مُرْهُ فَلْيُرَاجِعْهَا، ثُمَّ لِيُمْسِكْهَا حَتَّى تَطْهُرَ ثُمَّ تَحِيضَ، ثُمَّ تَطْهُرَ، ثُمَّ إِنْ شَاءَ أَمْسَكَ بَعْدُ وَإِنْ شَاءَ طَلَّقَ قَبْلَ أَنْ يَمَسَّ، فَتِلْكَ الْعِدَّةُ الَّتِى أَمَرَ اللهُ أَنْ تُطَلَّقَ لَهَا النِّسَاءُ. وفى رواية لمسلم ان النبى صلى الله عليه وسلم قال لعمر مُرْهُ فَلْيُرَاجِعْهَا ثُمَّ لْيُطَلِّقْهَا طَاهِرًا أَوْ حَامِلاً-
ইবনু
ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যুগে তার স্ত্রীকে
মাসিকের সময় তালাক দিয়েছিলেন। তখন ওমর (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বিষয়টি
সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। তিনি তাকে বলেন, তাকে তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে বল
এবং ঘরে রেখে দিতে বল। সে তার বর্তমান মাসিক থেকে পবিত্র হবে, পুনরায় তার
মাসিক হবে। তারপর আবার পবিত্র হবে। এবার সে ইচ্ছে করলে স্ত্রীকে রেখে দেবে,
আবার চাইলে সহবাসের পূর্বেই তাকে তালাক দেবে। এটাই ইদ্দত, যা লক্ষ্য রেখে
আল্লাহ নারীদের তালাক দিতে আদেশ দিয়েছেন’।[2]
মুসলিমের
এক বর্ণনায় এসেছে, নবী করীম (ছাঃ) ওমর (রাঃ)-কে বলেছিলেন, তাকে তার স্ত্রী
ফেরত নিতে আদেশ দাও। তারপর সে তাকে তালাক দেবে পবিত্র অবস্থায় অথবা
গর্ভবতী অবস্থায়।[3]
যে স্ত্রীর সাথে স্বামী সহবাস করেছে তার উপর স্বামী তিনবার তালাক দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। এক সাথে তিন তালাক দেওয়া কিংবা পরপর ভিন্ন ভিন্ন বাক্যে একই পবিত্রতায় তিন তালাক দেওয়া স্বামীর উপর হারাম।
সহবাস কিংবা নির্জন বাসের পূর্বেই স্ত্রীকে তালাক প্রদান :
বিবাহের পর যদি স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সহবাস না হয় কিংবা দু’জনে নির্জনেও একত্রিত না হয় তাহ’লে স্বামী মাত্র এক তালাক দিলেই স্ত্রী পৃথক হয়ে যাবে। এ ধরনের সহবাসহীন স্ত্রীকে তিন তালাক দেওয়ার সুযোগ নেই। পরে যদি তারা আবার বিয়ে করতে চায় তবে অন্যের সাথে বিবাহ ছাড়াই বিয়ে করতে পারবে। উল্লেখ্য, উক্ত এক তালাক বায়েন তালাক বলে গণ্য হবে। সুতরাং নতুন করে বিয়ে করা ব্যতীত স্বামী ঐ স্ত্রীকে গ্রহণ করতে পারবে না। আবার যেহেতু স্ত্রীকে কোন ইদ্দত পালন করতে হবে না সেহেতু সে তৎক্ষণাৎ অন্য পুরুষকেও বিয়ে করতে পারবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, يَاأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا إِذَا نَكَحْتُمُ الْمُؤْمِنَاتِ ثُمَّ طَلَّقْتُمُوْهُنَّ مِنْ قَبْلِ أَنْ تَمَسُّوْهُنَّ فَمَا لَكُمْ عَلَيْهِنَّ مِنْ عِدَّةٍ تَعْتَدُّوْنَهَا- ‘হে মুমিনগণ! যখন তোমরা মুমিন নারীদের বিয়ে করবে অতঃপর তাদেরকে স্পর্শ করার পূর্বে তালাক দেবে, তখন তাদেরকে তোমাদের জন্য কোন ইদ্দত পালন করতে হবে না’ (আহযাব ৩৩/৪৯)।
মাসিক হয়নি কিংবা মাসিক বন্ধ হয়ে গেছে এমন স্ত্রীকে তালাক প্রদান :
বয়সের স্বল্পতা হেতু মাসিক শুরু না হ’লে কিংবা বেশি বয়সের কারণে সহবাসকৃত স্ত্রীর মাসিক বন্ধ হয়ে গেলে সুন্নাত মুতাবেক তাকে তালাক দিতে চাইলে মাত্র এক তালাক দিতে হবে। এক্ষেত্রে সহবাসের পূর্বে তালাক দেয়া হবে, না পরে তালাক দেয়া হবে তা বিবেচ্য বিষয় নয়। এরূপ স্ত্রীকে তালাকের পর থেকে ত্রিশ দিন হিসাবে তিন মাস বা ৯০ দিন ইদ্দত পালন করতে হবে। এই তিন মাসের মধ্যে স্বামী তাকে ফিরিয়ে নিতে চাইলে বিবাহ ছাড়াই ফিরিয়ে নিতে পারবে। ইদ্দত পার হয়ে গেলে স্ত্রী বায়েন বা বিচ্ছিন্ন হবে। এবারে সে অন্য পুরুষকে বিয়ে করতে পারবে। আবার চাইলে প্রথম স্বামীকেও বিয়ে করতে পারবে। এক্ষেত্রে প্রথম স্বামী দুই তালাকের মালিক থাকবে।
তবে এভাবে তিন তালাক পূর্ণ হ’লে স্ত্রীকে আর ফেরত নেওয়া যাবে না। সে তখন অন্য পুরুষকে বিয়ে করবে। তার পর যদি সেই পুরুষ কখনো তাকে তালাক দেয় কিংবা তাকে রেখে মারা যায়, তবে ইদ্দত শেষে সে প্রথম স্বামীকে বিয়ে করতে পারবে। মাসিক হয়নি বা বন্ধ হয়ে গেছে এরূপ নারীর ইদ্দত সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,وَاللَّائِيْ يَئِسْنَ مِنَ الْمَحِيْضِ مِنْ نِسَائِكُمْ إِنِ ارْتَبْتُمْ فَعِدَّتُهُنَّ ثَلاَثَةُ أَشْهُرٍ وَاللَّائِيْ لَمْ يَحِضْنَ- ‘তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যাদের মাসিক হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে তোমাদের ধারণা, তাদের ইদ্দত তিন মাস। আর এখনো যাদের মাসিক শুরু হয়নি তাদেরও ইদ্দত তিন মাস’ (তালাক্ব ৬৫/৪)।
গর্ভবতীর তালাক :
স্ত্রী গর্ভবতী হ’লেও তাকে তালাক দেয়া বৈধ। তাকেও সুন্নাত মোতাবেক এক তালাক দিতে হবে। গর্ভবতী মহিলার ইদ্দত সন্তান প্রসবকাল পর্যন্ত। প্রসবের সাথে সাথেই তার ইদ্দত শেষ হয়ে যাবে। এবার সে নতুন করে অন্যত্র বিয়ে করতে পারবে। আর নিয়ম মাফিক এক কিংবা দুই তালাক দেওয়া থাকলে প্রথম স্বামীকেও বিয়ে করতে পারবে। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন, وَأُوْلاَتُ الْأَحْمَالِ أَجَلُهُنَّ أَنْ يَّضَعْنَ حَمْلَهُنَّ ‘আর গর্ভবতীদের ইদ্দত সন্তান প্রসব পর্যন্ত’ (তালাক্ব ৬৫/৪)।
ঋতুবতী স্ত্রীর তালাক :
যে স্ত্রীর মাসিক জারি রয়েছে তাকে মাসিক চলাকালে তালাক প্রদান বিধেয় নয় বরং এমতাবস্থায় তাকে ফিরিয়ে নিতে হবে। আবার পবিত্রতা কালে তাকে তালাক দেওয়ার সময় যেন ঐ পবিত্রতার মেয়াদকাল সহবাসশূন্য হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। কেননা গর্ভাশয় সন্তানমুক্ত রাখা ইদ্দত পালনের অন্যতম লক্ষ্য। ইতিপূর্বে ইবনু ওমর (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদীছে মাসিক অবস্থায় তালাক না দিতে ও সহবাসমুক্ত পবিত্রতার মেয়াদে তালাক দিতে রাসূল (ছাঃ) নির্দেশ দিয়েছে। এরূপ স্ত্রীকে সুন্নাত মোতাবেক দু’ভাবে তালাক দেওয়া যায়।
১) স্ত্রীর মাসিক শেষ হওয়ার পর পবিত্র অবস্থার শুরুতে মিলন ছাড়াই স্বামী স্ত্রীকে এক তালাক দেবে। অতঃপর সহবাসহীন অবস্থায় স্ত্রী তিন মাসিক পর্যন্ত ইদ্দত পালন করবে। ইদ্দতকালে স্ত্রী স্বামীর গৃহে থাকবে এবং খোরপোষ পাবে। তিন মাসিকের মধ্যে স্বামী রাজ‘আত বা স্ত্রীকে ফেরত নিতে চাইলে নিতে পারবে। ইদ্দত পার হয়ে গেলে স্ত্রী এক তালাক বায়েন হয়ে যাবে এবং উভয়ে চাইলে নতুন বিবাহের মাধ্যমে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করতে পারবে। এক্ষেত্রে স্বামী দুই তালাকের মালিক থাকবে। স্ত্রী অবশ্য তখন ইচ্ছা করলে অন্যত্রও বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হ’তে পারবে।
২) সহবাসহীন পবিত্রতাকালে প্রথম তালাক দিয়ে ইদ্দতের মধ্যে পরবর্তী পবিত্রতাকালে দ্বিতীয় তালাক দেবে এবং ইদ্দত গণনা করবে। অতঃপর পরবর্তী পবিত্রতাকালের শুরুতে তৃতীয় তালাক দেবে এবং পরবর্তী মাসিকের শেষ পর্যন্ত ইদ্দত পালন করবে। এভাবে তিন তালাক দেওয়ার পর স্ত্রীকে আর ফেরত নেওয়া যাবে না। ইদ্দতকালে সে স্বামীর বাড়িতে থাকা-খাওয়ার সুযোগ পাবে। ইদ্দত শেষে স্ত্রী নিজ দায়িত্বে চলে যাবে এবং চাইলে অন্যত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে। এরূপ তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী যে তিন মাসিক পর্যন্ত ইদ্দত পালন করবে তা কুরআনে বলা হয়েছে,وَالْمُطَلَّقَاتُ يَتَرَبَّصْنَ بِأَنْفُسِهِنَّ ثَلاَثَةَ قُرُوْءٍ- ‘আর (সহবাসকৃত) তালাকপ্রাপ্তাগণ তিন ঋতু পর্যন্ত অপেক্ষা করবে’ (বাক্বারাহ ২/২২৮)।
উক্ত
নিয়মে তিন তালাক হয়ে গেলে অন্যের সাথে বিবাহ ও মিলন ছাড়া প্রথম স্বামী
স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে পারবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,فَإِنْ طَلَّقَهَا
فَلاَ تَحِلُّ لَهُ مِنْ بَعْدُ حَتَّى تَنْكِحَ زَوْجًا غَيْرَهُ ‘অতঃপর
যদি সে স্ত্রীকে (তৃতীয়) তালাক দেয়, তাহ’লে সে যতক্ষণ তাকে ব্যতীত অন্য
স্বামী গ্রহণ না করে’ (বাক্বারাহ ২/২৩০)। রিফা‘আ (রাঃ)-এর স্ত্রীর হাদীছ থেকে মেলামেশা করার শর্ত পাওয়া যায়।[4]
এদেশে একত্রে তিন তালাক দেওয়ার কারণ :
এক সাথে তিন তালাক দেওয়া সুনণাত বিরোধী ও অবৈধ। তারপরও এভাবে তালাক দেয়ার রেওয়াজ আমাদের সমাজে ব্যাপকভাবে চালু আছে। এর কিছু কারণ নিচে তুলে ধরা হ’ল-
১. বাপ-দাদার রেওয়াজ অনুসরণ : তিন তালাক একসাথে একবারে দেওয়ার নিয়ম বহুকাল ধরে এ দেশে চলে আসছে। তালাক মানেই একবারে তিন তালাক; তার কমে তালাক দিলে সে তালাক হয় না- এমন বিশ্বাসই এ দেশের জনমানুষের মনে বদ্ধমূল হয়ে আছে। সমাজের কেউই সচরাচর তিন তালাকের কমে তালাক দেয় না। কাজেই কাউকে তালাক দেওয়ার প্রয়োজন পড়লে সে বাপ-দাদার রেওয়াজ মেনে তিন তালাকই দেয়। মানুষের উপর বাপ-দাদার রেওয়াজ-রীতির অনুসরণের প্রভাব অত্যধিক। তাই সঠিক ও সত্য জানার পরও মানুষ তা ছাড়তে পারে না। ফলে বাপ-দাদার রীতি অনুসরণ করেই সে একসাথে তিন তালাক দিয়ে বসে।
২. অজ্ঞতা : তালাক দেওয়ার শারঈ বা সুন্নাতী পদ্ধতি কি তা এদেশের অনেক মুসলমান জানে না। ফলে তারা তালাক দান কালে সুন্নাতী পদ্ধতি মানলে স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেওয়ার যে সহজ সুযোগ পেত তা হাতছাড়া করে ফেলে। তারা তিন তালাক একসাথে দিয়ে পরিস্থিতি জটিল করে ফেলে। অথচ শারঈ বিধান জেনে তালাক দিলে এ জটিলতা তৈরি হ’ত না। তালাক প্রদানের সুন্নাতী পদ্ধতি সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা এতদূর বিস্তৃত যে, এ দেশের আইনজীবীরা পর্যন্ত এফিডেভিটকৃত তালাকনামায় স্বামী কিংবা স্ত্রী একে অপরকে এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক বায়েন দিয়েছে বলে লিখে দেয়। নোটারি পাবলিকের লিখিত তালাকনামা দেখলে এ কথার সত্যতা মেলে।
৩. রাগ : তালাকের ঘটনা সাধারণতঃ স্বামী স্ত্রীর মধ্যে মনকষাকষি, রাগারাগি, ঝগড়াঝাটি ইত্যাদির ফলে ঘটে থাকে। আর রাগ যখন চরমে ওঠে তখন স্বামী তার অমোঘ অস্ত্র একবারে ছুঁড়ে দিয়ে সম্পর্ক চিরতরে ছিন্ন করতে চায়। ফলে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়- তোকে এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক বায়েন দিলাম ইত্যাদি। কিন্তু এভাবে বলার পরিণতি কি হবে তখন তা আর তার হুঁশে থাকে না।
৪. অভিভাবকদের চাপ : অনেক সময় ছেলে-মেয়েরা নিজে নিজে বিয়ে করে, অভিভাবকরা হয়ত জানে না। আবার জানলেও ছেলে কিংবা মেয়ে পক্ষ বিয়ে ভেঙে দেওয়ার জন্য ছেলে অথবা মেয়ের উপর চাপ সৃষ্টি করে। ফলে তারা সম্পর্ক চিরতরে ছেদ করার জন্য একবারে তিন তালাক দেয়।
৫. যৌতুক : বিয়েতে শর্তকৃত যৌতুকের অর্থ না পেলে স্বামী ও তার পরিবার স্ত্রীর উপর যে দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন চালায় তা এদেশের মানুষের নিকট মোটেও অপরিচিত নয়। এই অত্যাচারেরই এক পর্যায়ে এক সাথে তিন তালাকের ঘটনা ঘটে। এছাড়া তালাক দানের এমন আরো অনেক কারণ থাকতে পারে। তবে বাপদাদার রেওয়াজ অনুসরণ ও অজ্ঞতার ফলেই এ সমাজে তিন তালাক এক সাথে দেওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছে।
একত্রিত তিন তালাকের শারঈ ভিত্তি :
ইসলামী শরী‘আতে বৈবাহিক বন্ধনকে অক্ষুণ্ণ রাখার প্রতি অধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। তাই এই বন্ধন যেন ঝটিকার ন্যায় ছিন্ন-ভিন্ন না হয়ে যায় বরং চিন্তা ভাবনা ও পরামর্শের মাধ্যমে এ বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে সে সুযোগ রেখে চূড়ান্ত বিচ্ছেদের বিষয়টিকে ইসলাম ইদ্দতের সাথে সম্পৃক্ত করে শেষ সময়কাল পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত রেখেছে। ইদ্দতের সময়কাল হ’ল তিন তুহুর, তিন ঋতু বা তিন মাস (বাক্বারাহ ২/২২৮)।
উল্লিখিত সময়কালের চেয়ে আরো কম সময়ের মধ্যে চূড়ান্ত বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানোর শারঈ বিধান ইসলামী শরী‘আতে নেই। চাই এক তালাকের ক্ষেত্রে হৌক অথবা দুই তালাক ও তিন তালাকের ক্ষেত্রে হৌক। অর্থাৎ এক তালাকের মাধ্যমে চূড়ান্ত বিবাহ বিচ্ছেদ হ’তে হ’লে এক তালাক প্রদানের পর তালাক অবস্থায় পূর্ণ ইদ্দত অতিক্রম করতে হবে। দুই তালাকের মাধ্যমে চূড়ান্ত বিবাহ বিচ্ছেদ হ’তে হ’লে দুই তুহুরে পর পর দুই তালাক প্রদান করে বাকী ইদ্দত পূর্ণ করতে হবে এবং এর মধ্যে রাজ‘আত করবে না। তবেই সবচেয়ে কম সময়ে চূড়ান্ত বিবাহ বিচ্ছেদ হবে। উক্ত তালাককে শারঈ পরিভাষায় ‘রাজঈ’ তালাক বলা হয়। আর তিন তালাকের মাধ্যমে সর্বনিম্ন সময়ে বিবাহ বিচ্ছেদ চূড়ান্ত করতে হ’লে কোন তালাকের মধ্যে রাজ‘আত (ফিরিয়ে নেওয়া) না করে এক ইদ্দতের প্রতি তুহুরে একটি করে পর পর তিন তুহুরে তিন তালাক প্রদান করলেই বিবাহ বিচ্ছেদ একেবারে চূড়ান্ত হয়ে যাবে।
প্রথম দু’টি তালাকে ইদ্দত পূর্ণ হওয়ার পূর্বে সাধারণভাবে ইচ্ছা করলে ফিরিয়ে নেওয়া যায় এবং ইদ্দত পূর্ণ হয়ে গেলে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে যাওয়ার পর অন্যের সাথে বিবাহ না হয়েও সরাসরি নতুন বিবাহের মাধ্যমে ফিরিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু তৃতীয় তালাক প্রদান করা মাত্র কোনভাবেই সেই তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেওয়া যাবে না, যতক্ষণ না তার অন্যত্র স্বেচ্ছায় বিবাহ ও স্বেচ্ছায় আবারো তালাক ঘটে যায় (বাক্বারাহ ২/২৩০)।
এটাই হ’ল সর্বনিম্ন সময়ে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানোর কিতাব ও সুন্নাহ ভিত্তিক একমাত্র শারঈ বিধান। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, ‘তালাকের রাজঈ দু’বার’ (বাক্বারাহ ২/২২৯)। অতঃপর রাজ‘আত করার অথবা বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়ার সর্বনিম্ন সময়ের বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘তারা যখন ইদ্দতের শেষ সময়ের নিকট পৌঁছবে, তখন হয় তাকে রাজ‘আত কর, নইলে (ইদ্দতের চূড়ান্ত সীমা অতিক্রম করিয়ে অথবা তৃতীয় তুহুরে তৃতীয় তালাক প্রদানের মাধ্যমে) তোমরা বিবাহ বন্ধন থেকে মুক্ত করে দাও’ (বাক্বারাহ ২/২৩১)।
উল্লিখিত আয়াতে রাজ‘আত করার সর্বশেষ সময় ও বিবাহ বিচ্ছেদের সর্বনিম্ন সময় একটি ইদ্দতের তৃতীয় তুহুরকে নির্ধারিত করা হয়েছে। তবে আল্লাহ পাক স্বামী-স্ত্রীর পুনঃমিলনকেই বেশী পসন্দ করেন। আর সেজন্যই তিনি এরশাদ করেন, ‘যখন তোমরা কোন মহিলাকে তালাক দিবে এবং সে ইদ্দত শেষ হওয়ার নিকটবর্তী অবস্থায় পৌঁছে যাবে, তখন তাদেরকে তাদের স্বামীদের সাথে পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হ’তে বাধা দিয়ো না, যখন তারা আপোষে সুন্দরভাবে রাযী হয়’ (বাক্বারাহ ২/২৩২)।
এক্ষণে যদি একই সাথে একই তুহুরে তিন তালাক প্রদান কার্যকর করা হয়, তবে এক দিকে স্বামীকে যে রাজ‘আত করার অধিকার দেওয়া হয়েছে, তা যেমন খর্ব করা হবে, অন্য দিকে তেমনি সর্বনিম্ন সময়ে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানোর সীমালংঘন করা হবে। কেননা তৃতীয় তালাক কার্যকর হওয়ার অর্থই হ’ল অবিলম্বে চূড়ান্ত বিবাহ বিচ্ছেদ। এক সাথে তিন বা ততোধিক তালাক প্রদান করলে এক তালাকে পরিণত হবে। এ মর্মে হাদীছ নিম্নরূপ :
(১) হযরত আব্দুল্লাহ বিন আববাস (রাঃ) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) হযরত আবুবকর (রাঃ) ও হযরত ওমর (রাঃ)-এর খিলাফতের প্রথম দুই বছর
পর্যন্ত এক মজলিসে তিন তালাক প্রদানকে একটি (রাজঈ) তালাক গণ্য করা হ’ত’।[5]
পরবর্তীতে হযরত ওমর (রাঃ) এক মজলিসে তিন তালাক প্রদানকে যে তিন তালাক
হিসাবেই কার্যকর করেছিলেন সেটি ছিল উদ্ভূত সমস্যার প্রেক্ষাপটে একটি সাময়িক
ইজতেহাদী ও প্রশাসনিক ফরমান মাত্র। তালাকের আধিক্য বন্ধ করার উদ্দেশ্যে
তিনি এই কঠোরতা আরোপ করেছিলেন। অবশ্য এই ইজতেহাদী ভুলের জন্য তিনি শেষ
জীবনে দারুণভাবে লজ্জিত ও অনুতপ্ত হন। কারণ এতে কোন ফায়দা হয়নি।[6] এ বিষয়ে ইবনু আববাস (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বলেন, তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মধ্যেই উত্তম দৃষ্টান্ত নিহিত রয়েছে’।[7]
(২)
মাহমূদ বিন লাবীদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে খবর দেওয়া হ’ল যে,
জনৈক ব্যক্তি এক সাথে তিন তালাক দিয়েছে। একথা শুনে তিনি রাগে অগ্নিশর্মা
হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন ও বললেন, আল্লাহর কিতাবের বিধান (বাক্বারাহ ২/২২৯-৩০) নিয়ে এখনি খেলা শুরু হয়েছে? অথচ আমি তোমাদের মাঝে আছি? তখন আরেকজন দাঁড়িয়ে বলল : হে রাসূল! আমি কি লোকটিকে হত্য করব না?[8]
(৩)
ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন যে, আব্দু ইয়াযীদ তার স্ত্রী উম্মে রূকানাকে তালাক
দেন। পরবর্তীতে তিনি দারুণভাবে মর্মাহত হন। তখন রাসূল (ছাঃ) তাকে জিজ্ঞেস
করেন, ‘তুমি তোমার স্ত্রীকে কিভাবে তালাক দিয়েছ? তিনি উত্তরে বলেন, এক
মজলিসে তিন তালাক দিয়েছি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, উহা এক তালাকই হয়েছে।
তুমি স্ত্রীকে ফেরত নাও’।[9]
উপরন্তু এক মজলিসে তিন তালাক কার্যকর হওয়ার কোন স্পষ্ট হাদীছ নেই। অতএব এক সাথে এক তুহুরে শতাধিক তালাক প্রদান করলেও মাত্র একটি রাজঈ তালাকই কার্যকর হবে।
হিল্লা বিবাহ :
আমাদের সমাজে তিন তালাকের ব্যাপক অপব্যবহার হচ্ছে। উপরে বর্ণিত শারঈ নিয়মে বলতে গেলে শতকরা দু’টি তালাক হয় কি-না সন্দেহ। এদেশে অধিকাংশ তালাকদাতা একত্রে তিন তালাক দেয়। কিন্তু তালাক দেওয়ার পর উদ্ভূত পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল হওয়ায় তারা পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হ’তে চায়।
কিন্তু এক্ষেত্রে একত্রে প্রদত্ত তিন তালাকের রায়ে তিন তালাকই কার্যকর করায় তাদের চাওয়া পাওয়া পূরণ হয় না। অথচ সম্পর্ক পুনঃস্থাপন না হ’লেই নয়। তাই যারা একত্রে প্রদত্ত তিন তালাককে তিন তালাক পতিত হয়েছে বলে গণ্য করেন তারা স্ত্রীর জন্য نكاح التحليل বা প্রচলিত হিল্লা বিবাহের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান দেন। অথচ হিল্লা বিবাহ হারাম।[10] বিবাহের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনুসারে এটি আসলে কোন বিবাহই নয়। এহেন সমাধান নারীর জন্য যেমন অবমাননাকর, তেমনি ইসলামের নামে এক জঘন্য অপবাদ। সুতরাং দ্বিতীয়বারও প্রথম বারের মত বিয়ে হবে। তারপর যদি শারঈ নিয়মে পুনরায় তালাকের ঘটনা ঘটে, কিংবা দ্বিতীয় স্বামীর মৃত্যু হয়, তবেই প্রথম স্বামী তাকে বিয়ে করতে পারবে।
তালাকে বায়েন-এর পর এক
রাত্রির জন্য অন্য একজন পুরুষের নিকটে সাময়িক বিবাহ দিয়ে তার নিকট থেকে
তালাক নিয়ে পুনরায় পূর্ব স্বামীর নিকটে ফিরিয়ে দেওয়ার কৌশল অবলম্বন করাকে
এদেশে ‘হীলা’ বিবাহ বা হিল্লা বিয়ে বলা হয়ে থাকে। এ ‘হিল্লা’ একটি জাহেলী
প্রথা। ইসলামে এটা সম্পূর্ণরূপে হারাম। ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেন যে,
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে ভাড়াটে ষাঁড় সম্পর্কে খবর
দিব না? ছাহাবীগণ বললেন, অবশ্যই হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! তখন তিনি বললেন,
সে হ’ল ঐ হালালকারী ব্যক্তি। মনে রেখ, আল্লাহ তা‘আলা লা‘নত করেছেন
হালালকারী এবং যার জন্য হালাল করা হয় উভয়ের উপর’।[11] এ সম্পর্কে ইবনু ওমর
(রাঃ) বলেন, كُنَّا نَعُدُّ هذا سِفَاحًا على عهد رسول الله (ص) ‘আমরা
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যামানায় এটিকে যেনা বলে গণ্য করতাম’। তিনি বলেন, এরা
দু’জনেই ব্যভিচারী। যদিও তারা ২০ বছর যাবৎ স্বামী-স্ত্রী নামে দিন যাপন
করে।[12]
ওমর ফারূক (রাঃ) বলেন, হালালকারী
ব্যক্তি বা যার জন্য হালাল করা হয়েছে, এমন কাউকে আনা হ’লে আমি তাকে স্রেফ
‘রজম’ করব। অথবা ব্যভিচারীর শাস্তির ন্যায় বুক পর্যন্ত মাটিতে পুঁতে পাথর
মেরে মাথা গুঁড়িয়ে শেষ করে দিব।[13]
পরিশেষে বলব, ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান তালাক নিয়ে স্বেচ্ছাচার বন্ধ করে তালাকের ক্ষেত্রে শারঈ পদ্ধতি মেনে চলতে হবে। আর এ সম্পর্কে সকলকে প্রয়োজনীয় জ্ঞানার্জন করতে হবে। অনুরূপভাবে ‘হিল্লা বিবাহ’ নামক জাহেলী প্রথা থেকে সর্বতোভাবে বিরত থাকতে হবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাওফীক দান করুন-আমীন!
[1]. ফিকহুস সুন্নাহ ২/২০০-২০১।
[2]. বুখারী হা/৫২৫১।
[3]. মুসলিম হা/১৪৭১।
[4]. বুখারী হা/২৬৩৯; মুসলিম হা/১৪৩৩; মিশকাত হা/৩২৯৫।
[5]. মুসলিম হা/১৪৭২, পৃঃ ৪৭৮, (দেওবন্দ ছাপা : ১৯৮৬); বুলূগুল মারাম হা/১০৭১ তাহক্বীক্ব : ছফিউর রহমান মুবরকপুরী।
[6]. ইবনুল ক্বাইয়িম, ইগাছাতুল লাহফান (কায়রো : ১৪০৩/১৯৮৩) ১/২৭৬-৭৭।
[7]. মুসলিম পৃঃ ৪৭৮; বুখারী, বুলূগুল মারাম হা/১০৭৯।
[8]. নাসাঈ, বুলূগুল মারাম হা/১০৭২।
[9]. আহমাদ হা/২৩৮৭; আবুদাঊদ হা/২১৯৬; বুলূগুল মারাম, হা/১০৭৪ হাদীছ ছহীহ, আওনুল মা‘বূদ ৬/২৭৯; যাদুল মা‘আদ ৫/২২৯।
[10]. আয়নী, শরহে কানয, ২/১৩৪; ফিক্বহুস সুন্নাহ, ২/৪২-৪৩ পৃঃ।
[11]. ইবনু মাজাহ, বায়হাক্বী, হাকেম, সনদ হাসান, ইরওয়াউল গালীল ৬/৩০৯-১০পৃঃ।
[12]. তাবারাণী, বায়হাক্বী, হাকেম হা/২৮০৬; ইরওয়া হা/১৮৯৮, ৬/৩১১ পৃঃ।
[13]. ইবনুল মুনযির, মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বা, মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক; ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/১৩৪ পৃঃ; বিস্তারিত দেখুন : তালাক ও তাহলীল, ‘হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’, কাজলা, রাজাশাহী প্রকাশিত।