ভূমিকা :
মাওলানা আব্দুর রঊফ ঝান্ডানগরী উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাগ্মী ও আলেমে দ্বীন ছিলেন। অনলবর্ষী বাগ্মিতার কারণে তিনি ‘খতীবুল ইসলাম’ (ইসলামের বাগ্মী) ও ‘খতীবুল হিন্দ’ (ভারতের বাগ্মী) উপাধিতে ভূষিত হন। ‘রাবিতাতুল আলাম আল-ইসলামী’র তিনি ছিলেন একমাত্র নেপালী সদস্য। জমঈয়তে আহলেহাদীছ নেপালের আমীর এই প্রখ্যাত বাগ্মী নেপালে আহলেহাদীছ আন্দোলনের প্রচার-প্রসারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
জন্ম :
মাওলানা
আব্দুর রঊফ বিন নে‘মাতুল্লাহ বিন মোতী খান বিন বখতিয়ার খান নেপালের
কপিলবস্ত্ত যেলার ঝান্ডানগর হ’তে ২০ কিলোমিটার উত্তরে কাদারবাটুয়া গ্রামে
এক জমিদার পরিবারে ১৩২৮ হিঃ/১৯১০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন।[1] মাওলানার
পিতা হাজী নে‘মাতুল্লাহ (মৃঃ ১৯৪৬ খ্রিঃ) দেওবন্দী হানাফী আলেম ছিলেন।
নেপালের বিখ্যাত আহলেহাদীছ মাদরাসা ‘জামে‘আ সিরাজুল উলূম আস-সালাফিইয়াহ’-তে
অনুষ্ঠিত এক জালসায় শেরে পাঞ্জাব, ফাতিহে কাদিয়ান মাওলানা ছানাউল্লাহ
অমৃতসরীর (১২৮৭-১৩৬৭ হিঃ/১৮৬৮-১৯৪৮ খ্রিঃ) বক্তৃতা শুনে তিনি প্রভাবিত হন।
পরে বিহারের বিখ্যাত ছাপড়া জালসা শোনার পরে তিনি আহলেহাদীছ হয়ে যান।[2]
শিক্ষাজীবন :
বাল্যকালে
মাওলানা আব্দুর রঊফ অত্যন্ত দুর্বল মেধার অধিকারী ছিলেন। পড়ার ভয়ে তিনি
ঘরের অন্ধকার কোণে লুকিয়ে থাকতেন। পিতা তাকে লেখাপড়া শিখানোর জন্য বস্তী
যেলার খ্যাতনামা শিক্ষক মিয়াঁ মালেক আলীকে গৃহশিক্ষক নিয়োগ করেন। তিনি
ছিলেন অত্যন্ত কঠোর স্বভাবের। ছাত্রমহলে তিনি ‘কসাই’ নামে পরিচিত ছিলেন।
শিশু আবদুর রঊফকে তিনি নির্দয়ভাবে পিটাতেন। লেখাপড়ার স্বার্থে পিতা তা
নীরবে সহ্য করতেন। পরবর্তীতে মাওলানা আব্দুর রঊফ স্বীয় আত্মজীবনীতে স্বীকার
করেছেন যে, শিশুকালে উস্তাদের মারের ভয়ে যেভাবে দিনরাত খেটে পড়া তৈরি
করতাম, বড় হয়ে সেটাই আমার অভ্যাসে পরিণত হয় এবং বলা চলে যে, ছোটবেলায়
উস্তাদের মারের ভীতিই ছিল আমার পরবর্তী জীবনের উন্নতির চাবিকাঠি’।[3]
গৃহশিক্ষকের
নিকট পাঠগ্রহণ শেষে চার বছর বয়সে (১৩৩২ হিঃ/১৯১৪ খ্রিঃ) তিনি পিতার
প্রতিষ্ঠিত জামে‘আ সিরাজুল উলূমে ভর্তি হন। এখানে তিনি দু’বছর লেখাপড়া
করেন। এখানে তিনি মাওলানা খলীল আহমাদ বিসকূহারীর নিকটে মীযান-মুনশা‘আব
পড়েন।[4] অতঃপর তিনি নাদওয়াতুল ওলামা লাক্ষ্ণৌতে চলে যান। তখন খ্যাতনামা
আহলেহাদীছ আলেম মাওলানা হাফীযুল্লাহ নাদভী আ‘যমী নাদওয়ার মুহতামিম ছিলেন।
কিন্তু পদ্ধতিগত কারণে সেখানে ভর্তি হ’তে না পারায় তিনি বেনারসের মদনপুরায়
অবস্থিত জামে‘আ রহমানিয়াতে[5] ভর্তি হন। এখানে তিনি দু’বছর যাবৎ মাওলানা
মুহাম্মাদ মুনীর খাঁ, মাওলানা হাবীবুল্লাহ বিহারী, মাওলানা ফছীহুদ্দীন
বেনারসী প্রমুখের নিকট পড়তে থাকেন।[6] মাওলানা স্বীয় আত্মজীবনীতে বলেন যে, ‘এই সময় আমার তবীয়ত পড়াশুনার কষ্ট সহ্যের জন্য প্রস্ত্তত হয়ে গিয়েছিল’।[7]
বেনারস
থাকাকালীন মায়ের কঠিন অসুখের খবর শুনে তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং
ঝান্ডানগরে বিখ্যাত আরবী সাহিত্যিক মাওলানা আব্দুল গফূর বিসকূহারী (মৃঃ
১৯৮৮) ও অন্যান্য শিক্ষকমন্ডলীর নিকটে পড়তে থাকেন। এখানে ৬ষ্ঠ জামা‘আত শেষ
করার পর তিনি ‘দারুল হাদীছ রহমানিয়া’ দিল্লী গমন করেন এবং ৭ম জামা‘আতে
ভর্তি হন। এখানে তিনি শায়খুল হাদীছ মাওলানা আহমাদুল্লাহ প্রতাপগড়হী,
মিশকাতের আরবী ভাষ্য মির‘আতুল মাফাতীহ-এর রচয়িতা আল্লামা ওবায়দুল্লাহ
মুবারকপুরী, মাওলানা নাযীর আহমাদ রহমানী আমলুবী, মাওলানা আব্দুস সালাম
দুর্রানী, আব্দুর রহমান নাহভী প্রমুখ খ্যাতনামা শিক্ষকদের নিকট জ্ঞানার্জন
করেন। অতঃপর ১৩৫৪ হিঃ/১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ফারেগ হন। তিনি সর্বদা ক্লাসে
প্রথম হতেন। ফারেগের বছরেও তিনি এ মর্যাদায় অভিষিক্ত হন এবং বিভিন্ন
পুরস্কার লাভ করেন।[8] মাওলানা আব্দুর রঊফ শেষ বছরে পুরস্কার প্রাপ্তির
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘ঐ বছরের সব পুরস্কার আমি পেয়েছিলাম। ঘড়িও
পেয়েছিলাম। যখন আমি জুববা ও অন্যান্য জিনিস পরে এসেছিলাম’। তিনি আরো বলেন,
‘আমাদের রহমানিয়া মাদরাসায় ছাত্রদেরকে নগদ অর্থ পুরস্কার প্রদানেরও নিয়ম
ছিল। পরীক্ষার ফলাফল শুনানো হ’ত এবং নগদ অর্থ, ঘড়ি, জুববা ও পাগড়ী পুরস্কার
দেয়া হ’ত। আমিও আমার সময়ে ক্লাসে প্রথম হ’তাম এবং পুরস্কৃত হ’তাম’।[9]
কর্মজীবন :
দারুল
হাদীছ রহমানিয়া দিল্লী থেকে ফারেগ হওয়ার সাথে সাথে মাদরাসার দায়িত্বশীলগণ
তাঁর ইলমী যোগ্যতার প্রতি লক্ষ্য করে তাঁকে উক্ত মাদরাসার শিক্ষক হিসাবে
নিযুক্ত করেন। তিনি এখানে এক বছর শিক্ষকতা করেন।[10] পঞ্চম জামা‘আত পর্যন্ত
পড়ানো সত্ত্বেও বিলাতী, পাঞ্জাবী, বিহারী, বাঙ্গালী সকল এলাকার ছাত্র তাঁর
প্রতি সন্তুষ্ট ছিল। কিন্তু বছর না পেরোতেই মাদরাসাতে সংঘটিত এক দুঃখজনক
ঘটনায় ইউ.পি.র সকল ছাত্র চলে যায়। ফলে তিনিও তাদের সাথে মাদরাসা ত্যাগ করতে
বাধ্য হন।[11]
দারুল হাদীছ রহমানিয়া,
দিল্লীতে শিক্ষকতা প্রসঙ্গে তিনি স্বীয় আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘আমার
শিক্ষকতার যুগ দারুল হাদীছ রহমানিয়া দিল্লী থেকে শুরু হয়। আমি ওখান থেকে ২২
বছর বয়সে ফারেগ হই এবং ২৩ বছর বয়সে ওখানেই শিক্ষক নিযুক্ত হই। সে সময় আমার
মাসিক বেতন ছিল ৩০ রূপিয়া। সে যুগে বড় বড় আলেমদেরও বেতন ১০০ রূপিয়ার বেশী
ছিল না। আমি ঐ সময় পঞ্চম জামা‘আত পর্যন্ত পাঁচ ঘণ্টা ক্লাস নিয়েছিলাম’। এক
জায়গায় তিনি তাঁর পাঠদান পদ্ধতি সম্পর্কে লিখেছেন, ‘আমি যে দরস দিতাম
পরিপূর্ণভাবে সামনের ৭ দিনের সবক মুতালা‘আহ করে নিতাম। হয়ত সামনে আগত কোন
জিনিস এমন থাকতে পারে, যার পূর্ববর্তী পাঠের সাথে কোন সম্পর্ক রয়েছে’। তিনি
আরেক জায়গায় লিখেছেন, ‘আমার পাঠদানের এই পদ্ধতি ছিল যে, শরহ আক্বায়েদ
অধ্যয়ন করতাম এবং সাত দিন পর্যন্ত সামনে আগত পাঠগুলোর উপর নযর বুলিয়ে
নিতাম। শরহে আক্বায়েদের শরাহ খিয়ালী পড়তাম। অতঃপর মোল্লা আফগানীর শরহে
রামাযান আফেন্দী পড়তাম। আমি এমন বিস্তারিতভাবে সবক পড়াতাম যে, সব ছাত্র
সন্তুষ্ট হয়ে উঠত’।[12]
অতঃপর তিনি
ঝান্ডানগরের সিরাজুল উলূম মাদরাসায় নিয়োগপ্রাপ্ত হন। সেখানে দু’বছর
অবস্থানের পর সাবেক শিক্ষাস্থল জামে‘আ রহমানিয়া মদনপুরা, বেনারসে আহূত হন।
সেখানে তিন বছর থাকার পর পিতার আহবানে বাধ্য হয়ে তিনি পুনরায় ঝান্ডানগরে
ফিরে আসেন।[13] ১৯৪৬ সালে পিতার মৃত্যুর পর এ মাদরাসাকে কেন্দ্র করেই তাঁর
বাকী কর্মজীবন আবর্তিত হতে থাকে। তিনি এ মাদরাসার পরিচালক হিসাবে অত্যন্ত
আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। তাঁর দক্ষ পরিচালনায়
প্রতিষ্ঠানটি ক্রমান্বয়ে উন্নতির উচ্চশিখরে আরোহণ করে এবং নেপালের
সর্বশ্রেষ্ঠ মাদরাসায় পরিণত হয়। পিতার লাগানো বাগানে উপযুক্ত পরিচর্যার ফলে
ছাত্ররূপ বৃক্ষগুলো ফুলে ফলে সুশোভিত হয়ে ওঠে।[14]
বাগ্মিতা :
বেনারসের মদনপুরায় ছাত্রজীবনে সাপ্তাহিক ‘আঞ্জুমান’ থেকেই তাঁর মধ্যে বাগ্মিতার স্ফুরণ ঘটে। ‘চরিত্র’ বিষয়ক কথিকার উপরে প্রথম বক্তৃতা দিতে দাঁড়ালে ভয়ে তাঁর দেহ কাঁপতে থাকে। এক পর্যায়ে তাঁর হাতে ধরে রাখা নোট কপিগুলি অজান্তে পড়ে যায়। কিন্তু তিনি মুখ ফুটে কোন কথা বলতে পারেননি। স্বীয় আত্মজীবনীতে তিনি বলেন, ‘এটাই ছিল সেই ব্যক্তির জীবনে প্রথম বক্তৃতার অভিজ্ঞতা যিনি পরবর্তীতে দেড় লক্ষ লোকের বিরাট সমাবেশে নির্ভয়ে বক্তৃতা করে শ্রোতাদেরকে মন্ত্রমুগ্ধের মত বসিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন’। ছাত্রজীবনে তিনি নিয়মিত অধ্যবসায়ের মাধ্যমে বক্তৃতার অনুশীলন করতেন, যা তাঁকে পরবর্তীতে উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাগ্মী হ’তে সাহায্য করে। দারুল হাদীছ রহমানিয়া থেকে ভারতবর্ষের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য যে ছাত্র প্রতিনিধিদল পাঠানো হ’ত, তাতে প্রায়ই তিনি প্রথম স্থান অধিকার করতেন। দারুল হাদীছ রহমানিয়াতে প্রদত্ত তাঁর শিক্ষাজীবনের সর্বশেষ বক্তৃতা ছিল সত্যিই স্মরণীয়। উক্ত মজলিসে উপস্থিত ছিলেন দিল্লীর জামে‘আ মিল্লিয়ার প্রধান ড. যাকির হুসাইন (পরবর্তীতে ভারতের প্রেসিডেন্ট), উক্ত জামে‘আর অন্যতম অধ্যাপক হাফেয আসলাম জয়রাজপুরী (মুনকিরে হাদীছ), তাফসীরের অধ্যাপক মাওলানা আব্দুল হাই, তিরমিযীর খ্যাতনামা আরবী ভাষ্যকার আল্লামা আবদুর রহমান মুবারকপুরী (১২৮৩-১৩৫৩/১৮৬৫-১৯৩৫) সহ দিল্লীর আশপাশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামকরা উস্তায ও ওলামায়ে কেরাম। উক্ত মজলিসের সভাপতি ছিলেন মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী (১৮৯০-১৯৪১ খ্রিঃ)। ‘খতমে নবুঅতের দার্শনিক তাৎপর্য’ শীর্ষক উক্ত বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় বাছাই করা তিনজন ছাত্রকে শিক্ষকগণ মনোনীত করেন- (১) আবদুর রঊফ নেপালী (২) আব্দুল লতীফ পাঞ্জাবী (৩) আব্দুল ওয়াজেদ মাদ্রাজী। শেষোক্ত দু’জনকে ২০ মিনিট করে সময় দিলেও মাওলানা আবদুর রঊফকে দেওয়া হয় মাত্র পাঁচ মিনিট সময়। আল্লাহর রহমতে মাত্র দু’মিনিটে সমস্ত হলঘর না‘রায়ে তাকবীর ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে। অতঃপর পাঁচ মিনিট শেষ হ’তেই সমস্ত হল যেন আনন্দে ফেটে পড়ে। শেষ নবীর মাহাত্ম্য বর্ণনায় দু’লাইনের কবিতা দিয়েই তিনি সেদিনের বক্তৃতা শেষ করেছিলেন- যা সকল শ্রোতাকে বিমুগ্ধ করেছিল-
هرطرف فكر كو دوڑا كے تهكاياهم نے + كوئى دين دين محمد سا ﻨﮧ ﭘايا هم نے
هم هوئے خير امم تجه سے هى اے خير رسل + تيرے بڑهنے سے قدم آگے بڑهايا هم نے
‘চারিদিকে চিন্তার ঘোড়া দৌড়ে থেমে গেছি মোরা,
কোন দ্বীন দ্বীনে মুহাম্মাদীর চেয়ে উত্তম পাইনি মোরা।
তোমার কারণেই মোরা শ্রেষ্ঠ উম্মত হে শ্রেষ্ঠ রাসূল!
তুমি আগে বেড়েছ তাই মোরা বেড়েছি আগে হে রাসূল![15]
মাওলানা
আব্দুর রঊফ অত্যন্ত উঁচুদরের বাগ্মী ছিলেন। আল্লাহ তাঁকে সুমধুর কণ্ঠের
সাথে সাথে চমৎকার ভঙ্গিতে বক্তব্য প্রদানের ক্ষমতা দিয়েছিলেন। তাঁর বক্তব্য
অত্যন্ত সারগর্ভ ও দলীলভিত্তিক হ’ত। কুরআন মাজীদের আয়াত ও হাদীছ উদ্ধৃত
করে অত্যন্ত চমৎকারভাবে বক্তব্য উপস্থাপনের কারণে তা শ্রোতাদের হৃদয় ছুঁয়ে
যেত। নওগড় কনফারেন্সে (নভেম্বর ১৯৬১) প্রদত্ত তাঁর স্বাগত ভাষণ পুরা
ভারতবর্ষে তাঁর বিদ্যাবত্তা ও বাগ্মিতার খ্যাতি ছড়িয়ে দেয়। এজন্য তাঁকে
‘খতীবুল হিন্দ’ (ভারতের বাগ্মী) এবং ‘খতীবুল ইসলাম’ (ইসলামের বাগ্মী)
উপাধিতে ভূষিত করা হয়।[16]
প্রবন্ধ রচনা :
মাওলানা
আব্দুর রঊফ ছাত্রজীবনেই লেখার অভ্যাস গড়ে তোলেন এবং অধিকাংশ সময়
পাঠ্যসূচীর বাইরের বই লাইব্রেরী থেকে নিয়ে পড়তেন। মাওলানা মুহাম্মাদ
জুনাগড়ী (১৮৯০-১৯৪১) সম্পাদিত আখবারে মুহাম্মাদী (দিল্লী), মাওলানা
ছানাউল্লাহ অমৃতসরী সম্পাদিত আখবারে আহলেহাদীছ (অমৃতসর), তারজুমান
(দিল্লী), আহলেহাদীছ গেজেট (ঐ), আখবারে দাওয়াত (ঐ), আল-হুদা (দারভাঙ্গা),
মুসলিম (শ্রীনগর), মিছবাহ (বাস্তী), তানযীমে আহলেহাদীছ (রোপাড়), আল-ই‘তিছাম
(লাহোর), আল-ইরশাদ জাদীদ (করাচী), আল-মু’তামার (ঐ), ছিদক (লাক্ষ্ণেŠ),
দারুল উলূম (দেওবন্দ), তাজাল্লী (ঐ), আছ-ছিদ্দীক (মুলতান), হাকীকাতে ইসলাম
(লাহোর), তা‘মীরে হায়াত (লাক্ষ্ণেŠ), মিনহাজ (লাহোর), আর-রাহীক্ব (ঐ),
মুহাদ্দিছ (বেনারস) প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় তাঁর বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত
হয়েছে।[17] ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত তাঁর হিসাব মতে উপমহাদেশের ২০টি পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধসমূহের পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩ হাযারেরও বেশী হবে।[18]
পত্রিকা প্রকাশ :
মাওলানা আব্দুর রঊফ ১৪১৫ হিঃ/১৯৯৪ সালের জুন মাসে ঝান্ডানগর থেকে ‘আস-সিরাজ’ নামে একটি উর্দূ মাসিক পত্রিকা বের করেন। তিনি ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা ও তত্ত্বাবধায়ক। বর্তমানে এর সম্পাদক মাওলানা আব্দুল মান্নান সালাফী ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাওলানা শামীম আহমাদ
নাদভী।[19]
সাংগঠনিক জীবন :
আহলেহাদীছ
আন্দোলনের জন্য তাঁর উদ্যম, প্রচেষ্টা ও আন্তরিকতা ছিল অপরিসীম। দেশ
বিভাগের পর ভারতবর্ষে আহলেহাদীছ জামা‘আতকে সুসংগঠিত করার ব্যাপারে তাঁর
ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। তিনি নেপালে এর প্রচার-প্রসারে নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন।
১৯৯১ সালের ৫ই নভেম্বর নেপালে সর্বপ্রথম আহলেহাদীছ সংগঠন হিসাবে ‘জমঈয়তে
আহলেহাদীছ নেপাল’ গঠিত হলে মাওলানা আব্দুর রঊফ ঝান্ডানগরী আমীর ও মাওলানা
আব্দুল্লাহ মাদানী ঝান্ডানগরী (১৯৫৫-২০১৫) নায়েবে আমীর নিযুক্ত হন। তিনি
আমৃত্যু এ সংগঠনের আমীর হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মারকাযী জমঈয়তে
আহলেহাদীছ, হিন্দেরও সম্মানিত সদস্য ছিলেন।[20]
মারকাযুত তাওহীদ কর্তৃক সম্মাননা প্রদান :
মাওলানা
আব্দুর রঊফ রহমানীর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ মাওলানা আব্দুল্লাহ মাদানী
ঝান্ডানগরী প্রতিষ্ঠিত মারকাযুত তাওহীদ তাঁকে ১৯৯৮ সালে সম্মানসূচক পদক
প্রদান করে।[21]
রচনাবলী :
বাগ্মিতার সাথে সাথে আল্লাহপাক তাঁর মধ্যে লেখনীর যোগ্যতা দান করেছিলেন। ছাত্রজীবনেই তিনি লেখার অভ্যাস গড়ে তোলেন এবং অধিকাংশ সময় পাঠ্যসূচীর বাইরের বই লাইব্রেরী থেকে নিয়ে পড়তেন। ১৯৮৭ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থাবলীর সংখ্যা ২৪। যেগুলির কোন কোনটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ৫০০। সর্বমোট পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩,০০০ হাযারের মত হবে। তাঁর অপ্রকাশিত পান্ডুলিপির সংখ্যা ১৭, পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩৫২৫। তন্মধ্যে ‘ঈমান ও আমল’ গ্রন্থটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ১০০০ এবং লেখকের বর্ণনামতে এটি তাঁর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রচনা। এতদ্ব্যতীত তিনি লিখেছেন জামে‘আ সিরাজুল উলূমের প্রতিষ্ঠাকাল ১৯১৪ হ’তে ১৯৮০ পর্যন্ত সময়ের বিস্তারিত ইতিহাস। যার পৃষ্ঠা সংখ্যা ১০০০ হাযার। ‘সীরাতুন্নবী’ শীর্ষক তাঁর ২৫০ পৃষ্ঠার বইটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।[22] নিম্নে তাঁর কয়েকটি গ্রন্থ সম্পর্কে আলোকপাত করা হ’ল।-
১. ছিয়ানাতুল হাদীছ :
‘হাদীছের
পাহারাদার’ নামক এ গ্রন্থটি মাওলানার জীবনের সেরা গ্রন্থ। যেটি মূলতঃ
হাদীছ অস্বীকারকারী ডাঃ গোলাম জীলানী বারক্ব-এর ‘দো ইসলাম’ (দুই ইসলাম)-এর
জবাবে লিখিত। জীলানী উক্ত গ্রন্থে এ অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন যে, আড়াইশ বছর
পর হাদীছ লিখিত হওয়ার কারণে তা নির্ভরযোগ্য নয়। মাওলানা আব্দুর রঊফ
ছিয়ানাতুল হাদীছ গ্রন্থে এ অভিযোগ ও অপবাদের বিস্তারিতভাবে দলীলভিত্তিক
জবাব প্রদান করেছেন। সাথে সাথে হাদীছ অস্বীকারকারীদের আরো বিভিন্ন
সন্দেহ-সংশয়ের জবাব দেয়া হয়েছে। এতে তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যুগ থেকে
শুরু করে ইমাম বুখারী ও মুসলিম (রহঃ)-এর যুগ পর্যন্ত হাদীছ সংরক্ষণ,
লিপিবদ্ধকরণ ও সংকলনে ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈ, তাবে তাবেঈ ও মুহাদ্দিছগণ যে
অবদান রেখেছেন তা সবিস্তার আলোচনা করেছেন। তিনি আশা প্রকাশ করেছেন যে, যদি
কোন হাদীছ অস্বীকারকারী নিরপেক্ষ মনে এ গ্রন্থটি পাঠ করে তাহলে তার উক্ত
সন্দেহ দূরীভূত হয়ে যাবে। ৪০০ পৃষ্ঠায় সমাপ্ত এই বইটি ১৯৬৬ সালে (১৩৮৫ হিঃ)
প্রথম লাক্ষ্ণৌ থেকে প্রকাশিত হয়। ১৯৮৭ সালে এর ২য় সংস্করণ প্রকাশিত
হয়েছে।[23]
২. খিলাফতে রাশেদাহ কা ‘আহদে যররীঁ :
এ
গ্রন্থে খিলাফতে রাশেদার সোনালী যুগের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক
ন্যায়বিচার সম্পর্কে তাত্ত্বিক আলোচনা পেশ করা হয়েছে। তবে এতে তদানীন্তন
সামরিক ব্যবস্থাপনা ও রাজ্যবিজয় সম্পর্কে কোন আলোচনা করা হয়নি। ৫০০ পৃষ্ঠার
এ গ্রন্থটি ১৩৯২ হিঃ/১৯৭২ সালে প্রথম কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। ২০০১ সালে
লাহোরের মাকতাবা কুদ্দূসিয়া থেকে ‘আইয়ামে খিলাফতে রাশেদাহ’ শিরোনামে এর
একটি চমৎকার সংস্করণ বেরিয়েছে।[24]
৩. নুছরাতুল বারী ফী বায়ানে ছিহহাতিল বুখারী :
এ
গ্রন্থে ছহীহুল বুখারীর বিশুদ্ধতা, মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব এবং বৈশিষ্ট্য
সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। সাথে সাথে ছহীহুল বুখারী সম্পর্কে হাদীছ
অস্বীকারকারীদের সন্দেহ ও সংশয়ের দলীল ও যুক্তি ভিত্তিক জবাব প্রদান করা
হয়েছে। এটি ১৩৭৭ হিঃ/১৯৫৮ সালে প্রথম দিল্লী থেকে প্রকাশিত হয়।[25]
৪. আল-ইল্ম ওয়াল ওলামা :
৭২
পৃষ্ঠার এ গ্রন্থে ইলম অন্বেষণে সালাফে ছালেহীনের প্রচেষ্টা ও কষ্ট
স্বীকার সম্পর্কে অত্যন্ত শিক্ষণীয় ও চিত্তাকর্ষক আলোচনা পেশ করা হয়েছে।
ইতিপূর্বে এটি ১৯৩৩-৩৯ সাল পর্যন্ত প্রবন্ধাকারে পাক্ষিক মুহাম্মাদী
(দিল্লী) পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯৪৫ সালে অমৃতসরের ছানাঈ বারকী প্রেস থেকে
‘তাযকেরায়ে আসলাফে কেরাম’ শিরোনামে প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৯৫৫ সালে দিল্লী
থেকে দ্বিতীয়বার এবং ১৯৫৮ সালে ‘আল-ইলম ওয়াল ওলামা’ শিরোনামে বই আকারে
প্রকাশিত হয়।[26]
৫. দালাইলে হাশর ওয়া নাশর :
এ গ্রন্থে কিয়ামতের প্রমান সমূহ এবং সে দিন হাশরের ময়দানে মানুষদের অস্থিরতা ব্যাখ্যা করতঃ কিয়ামতের আলামত ও আখিরাত বিশ্বাসকে বিভিন্ন শিক্ষণীয় ঘটনার মাধ্যমে সাব্যস্ত করা হয়েছে। এটি ১৩৯৫ হিঃ/১৯৭৫ সালে প্রথম পাটনা থেকে প্রকাশিত হয়।
৬. ইসলাম আওর সাইন্স :
এ
গ্রন্থে ইসলাম ও বিজ্ঞানের মধ্যকার সম্পর্ক বর্ণিত হয়েছে এবং কুরআন ও
হাদীছের আলোকে প্রমাণ করা হয়েছে যে, সৃষ্টিজগতের প্রত্যেকটি বস্ত্ত আল্লাহর
ইচ্ছার অনুগামী। ইসলামের শিক্ষা সমূহ এবং বিজ্ঞানের মধ্যে কোন বৈপরীত্য
নেই। আর ইসলাম বিজ্ঞান শিক্ষা করার বিরোধীও নয়। ১৪১০ হিঃ/১৯৮৯ সালে এটি
প্রথম দিল্লী থেকে প্রকাশিত হয়।[27]
৭. হুকূক ওয়া মু‘আমালাত :
‘অধিকার
ও আচরণ’ নামের ২৬৩ পৃষ্ঠার এ গ্রন্থে কুরআন, হাদীছ ও ইতিহাসের আলোকে
পিতা-মাতা, প্রতিবেশী, ইয়াতীম, মেহমান, আলেম-ওলামা, দাস, ন্যায়বিচারক শাসক,
অমুসলিম, জীব-জন্তুর অধিকার ও পারস্পরিক আচরণ সম্পর্কে অত্যন্ত চমৎকার
আলোচনা পেশ করা হয়েছে। ১৩৯৮ হিঃ/১৯৭৮ সালে এটি প্রথম দিল্লী থেকে প্রকাশিত
হয়।[28]
৮. দালাইলে হাসতী বারী তা‘আলা :
৭১ পৃষ্ঠার এ গ্রন্থে আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। সাথে সাথে নাস্তিকদের বিভিন্ন সংশয়ের জবাব দেয়া হয়েছে।[29]
৯. ওলামায়ে দ্বীন আওর উমারায়ে ইসলাম :
১১১ পৃষ্ঠার এ গ্রন্থে জ্ঞানের মর্যাদা, ওলামায়ে কেরামের দুনিয়াবিমুখতা এবং শাসকগণ কর্তৃক আলেমদেরকে সম্মান করা প্রভৃতি বিষয় আলোচিত হয়েছে। এতে তিনি মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরীর জীবনের একটি শিক্ষণীয় ঘটনা উল্লেখ করেছেন। যা নিম্নরূপ :
একবার অমৃতসরী হায়দারাবাদে অনুষ্ঠিত এক জালসায় বক্তব্য
প্রদানের জন্য আমন্ত্রিত হন। ঐ জালসায় হায়দারাবাদের গভর্ণর নওয়াব মীর ওছমান
আলী খাঁও উপস্থিত ছিলেন। মাওলানা অমৃতসরী কাদিয়ানীদের বই-পুস্তক থেকে
উদ্ধৃতি প্রদান করে যখন তাদের ভ্রান্ত মতবাদ খন্ডন করতে শুরু করেন, তখন
নওয়াব ছাহেব অত্যন্ত আনন্দিত হন। তিনি মাওলানার সাথে সাক্ষাতের আগ্রহ
প্রকাশ করেন। বিষয়টি অবগত হয়ে অমৃতসরী নওয়াব ছাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করতে
যান। তিনি তাঁকে সালাম দিয়ে من نيز حاضر مى شوم تفسير قرآن دربغل কবিতাটি
আবৃত্তি করেন এবং নওয়াবকে তাঁর রচিত ‘তাফসীরুল কুরআন বিকালামির রহমান’
গ্রন্থটি হাদিয়া দেন। বিদায়ের সময় নওয়াব ছাহেব নিজ স্থান থেকে উঠে এসে
মাওলানার সাথে কোলাকুলি করেন এবং তাকে অনেক হাদিয়া দেন। সাথে সাথে ২০০ টাকা
মাসিক বেতনে তাঁর জন্য একটি চাকুরীরও ব্যবস্থা করেন।[30]
মৃত্যু :
মাওলানা
আব্দুর রঊফ ঝান্ডানগরী ২১শে শা‘বান ১৪২০ হিজরী মোতাবেক ৩০শে নভেম্বর ১৯৯৯
সালে প্রায় ৯০ বছর বয়সে সন্ধ্যা সোয়া ৬-টায় ঝান্ডানগরে ইন্তেকাল করেন। ১৯৯৯
সালের ১লা ডিসেম্বর বিবিসি লন্ডন সকাল ও সন্ধ্যার সংবাদে তাঁর মৃত্যুর খবর
প্রচার করে এবং তাঁর জীবন ও কর্মের উপর আলোকপাত করে।[31]
স্মৃতিচারণ :
তাঁর স্মরণে মুহতারাম আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব বলেন, আহলেহাদীছ আন্দোলন-এর উপরে পিএইচ.ডি. থিসিসের তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে আমার ৫২ দিনের পাকিস্তান, ভারত ও নেপাল সফরকালে লাহোর থেকে দিল্লী আসার পর ঐতিহাসিক ফতেহপুর সিক্রী জামে মসজিদের মেহমানখানায় মাওলানা আব্দুর রঊফ ঝান্ডানগরীর সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। কিন্তু উনি তখন বের হচ্ছিলেন বলে তেমন কথা বলার সুযোগ হয়নি। ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র ১৯৮৭ সালের জাতীয় সম্মেলনে তাঁকে দাওয়াতনামা পাঠানোর কারণে তিনি আমাকে নামে চিনতেন। ফলে পরিচয় পেয়েই তিনি সহজে আপন করে নিলেন। অতঃপর মাসাধিককাল ভারত সফর শেষে নেপাল গিয়ে ১৯৮৯ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারী তাউলিয়া মারকাযে তাঁর সঙ্গে দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ হয়। এখানে তাঁকে সহ নেপালের শ্রেষ্ঠ আলেমদের পেয়ে আমার নেপাল ভ্রমণ সার্থক হ’ল। তাঁদের সকলের কাছ থেকে সাধ্যমত তথ্যাদি নিলাম। সেখানে মারকাযের শিক্ষক-ছাত্র ও উপস্থিত ওলামায়ে কেরামের সামনে আমার উর্দূ বক্তৃতা শুনে এই অশীতিপর বৃদ্ধ মানুষটি আনন্দে উঠে দাঁড়িয়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বক্তব্য রাখেন এবং সুযোগ পেলে আগামীতে অবশ্যই বাংলাদেশ সফর করবেন বলে আশ্বাস দেন।
তখনও তিনি রীতিমত ব্যস্ত মানুষ। বললেন, ‘গত মাসে রাবেতার বৈঠকে যোগদান শেষে সঊদী আরব থেকে দেশে ফিরে একটুও বিশ্রাম নেইনি। ছুটে বেড়াচ্ছি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে জালসা-সেমিনার ইত্যাদিতে’। এই ব্যস্ততার মধ্যেও যে তিনি লেখার সময় পান কখন, সেটাই চিন্তার বিষয়। বলাবাহুল্য তিনি ছিলেন নেপালের সকল আলেমের শিরোমণি, অধিকাংশ আলেমের বুযর্গ উস্তায এবং সকল স্তরের মানুষের নিকট প্রিয়তম বাগ্মী। বলা চলে যে, নেপালে আহলেহাদীছ আন্দোলনের তিনিই ছিলেন একচ্ছত্র অধিনায়ক।
১৯৯৯ সালে একই বছরে সঊদী আরবের গ্রান্ড মুফতী শায়খ বিন বায, সিরিয়ার যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ শায়খ আলবানী ও নেপালের এই খত্বীবুল হিন্দ মৃত্যুবরণ করেন। তখনই আমি তাঁর স্মৃতিচারণে কিছু লিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু হয়ে ওঠেনি। যদিও তাঁর পরিচালিত নেপালের শ্রেষ্ঠ মাদরাসা জামে‘আ সিরাজুল উলূম-এর মুখপত্র মাসিক ‘আস-সিরাজ’ তখন থেকেই এ যাবৎ আমার নামে সৌজন্য কপি আসছে। বিনিময়ে আমরাও উক্ত ঠিকানায় আমাদের মুখপত্র মাসিক ‘আত-তাহরীক’ নিয়মিত সৌজন্য কপি পাঠিয়ে থাকি। যখনই ‘আস-সিরাজ’ হাতে আসে, তখনই তাঁর সদাব্যস্ত সহজ-সরল চেহারা স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে ও মনের অজান্তেই অন্তর খোলা দো‘আ চলে আসে। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতে সর্বোচ্চ স্থান দান করুন- আমীন! দো‘আ করি মাওলানা খোরশেদ আলম, আব্দুল মান্নান সালাফী, শামীম আহমাদ নাদভী প্রমুখ তাঁর যোগ্য উত্তরসুরীদের জন্য, যাদের কারণে তাঁর রেখে যাওয়া স্মৃতিগুলো এখনো বেঁচে আছে এবং শনৈঃশনৈ উন্নতির পথে চলেছে। আল্লাহ সবাইকে হক-এর প্রচার-প্রসারে দৃঢ় থাকার তাওফীক দান করুন-আমীন!! (আরও রিপোর্ট দ্রঃ তাওহীদের ডাক সাক্ষাৎকার কলাম, মার্চ-এপ্রিল ২০১৩, পৃঃ ৩০)।
উপসংহার :
পরিশেষে বলা যায়, মাওলানা আব্দুর রঊফ ঝান্ডানগরী নেপালে আহলেহাদীছ আন্দোলনের একচ্ছত্র অধিনায়ক ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন উচ্চমর্যাদাশীল আলেম, বিদগ্ধ শিক্ষক, সংগঠক, প্রাবন্ধিক ও লেখক। স্বীয় যুগের অদ্বিতীয় বাগ্মী এই মহান আলেম পিতার প্রতিষ্ঠিত নেপালের শতবর্ষী ও সবচেয়ে বড় মাদরাসা (প্রতিষ্ঠা : ১৯১৪) জামে‘আ সিরাজুল উলূম আস-সালাফিইয়াকে ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আহলেহাদীছ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন। নেপালের মত একটি ঘোষিত হিন্দুরাষ্ট্রে দ্বীনী ইলমের প্রচার ও প্রসারে এ প্রতিষ্ঠানটি দিশারীর ভূমিকা পালন করছে।
[1]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, আহলেহাদীছ আন্দোলন (ডক্টরেট থিসিস), পৃঃ ৪৯০; আব্দুর রশীদ ইরাকী, চালীস ওলামায়ে আহলেহাদীছ (লাহোর : নু‘মানী কুতুবখানা, তাবি), পৃঃ ৪১৫।
[2]. আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃঃ ৪৮৪।
[3]. তদেব, পৃঃ ৪৯০।
[4]. চালীস ওলামায়ে আহলেহাদীছ, পৃঃ ৪১৫; আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃঃ ৪৯০।
[5]. ১৮৯৫ সালে হাফেয আব্দুর রহীম, হাফেয মুহাম্মাদ আইয়ূব, হাফেয আব্দুর রহমান, মাওলানা আব্দুল মজীদ হারীরীর পিতা মৌলভী আব্দুল লতীফ, হাজী মুহাম্মাদ ইসমাঈল, মৌলভী আব্দুল হাকীম, মাওলানা মুহাম্মাদ প্রমুখ পরামর্শ করে বেনারসের মদনপুরা এলাকায় ‘মিছবাহুল হুদা’ নামে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। পরে এর নাম রাখা হয় ‘মাদরাসা ইসলামিয়া আরাবিয়াহ’। ১৯৩৩ সালে হাফেয আব্দুর রহমান হজ্জ থেকে ফিরে মাদরাসার নতুন নয়নাভিরাম বিল্ডিং নির্মাণ করে এর নাম দেন জামে‘আ রহমানিয়া। দ্র. মাওলানা মুহাম্মাদ ইসহাক ভাট্টী, বার্রে ছাগীর মেঁ আহলেহাদীছ কী সারগুযাশত (লাহোর : আল-মাকতাবাতুস সালাফিইয়াহ, ১ম প্রকাশ, ১৪৩৩ হিঃ/২০১২ খ্রিঃ), পৃঃ ৩৩৯।
[6]. মুহাম্মাদ রামাযান ইউসুফ সালাফী, ‘মাওলানা আব্দুর রঊফ রহমানী ঝান্ডানগরী’, আব্দুর রঊফ রহমানী ঝান্ডানগরী, হুকূক ওয়া মু‘আমালাত (লাহোর : নু‘মানী কুতুবখানা, ১ম প্রকাশ, জানুয়ারী ২০০০), পৃঃ ২, জীবনী অংশ; চালীস ওলামায়ে আহলেহাদীছ, পৃঃ ৪১৫; আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃঃ ৪৯০।
[7]. আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃঃ ৪৯০।
[8]. চালীস ওলামায়ে আহলেহাদীছ, পৃঃ ৪১৫-৪১৬; আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃঃ ৪৯০-৪৯১; ড. আব্দুর রহমান ফিরিওয়াঈ, জুহূদ মুখলিছাহ (বেনারস : জামে‘আ সালাফিইয়াহ, ২য় সংস্করণ, ১৯৮৬ খ্রিঃ), পৃঃ ২৬১।
[9]. আস‘আদ আ‘যমী, তারীখ ওয়া তা‘আরুফ মাদরাসা দারুল হাদীছ রহমানিয়া দিল্লী (মৌনাথভঞ্জন, ইউপি : মাকতাবাতুল ফাহীম, ফেব্রুয়ারী ২০১৩), পৃঃ ১৬৯।
[10]. তদেব, পৃঃ ২১৬।
[11]. আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃঃ ৪৯১।
[12]. তারীখ ওয়া তা‘আরুফ মাদরাসা দারুল হাদীছ রহমানিয়া দিল্লী, পৃঃ ২১৬।
[13]. আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃঃ ৪৯১।
[14]. হুকূক ওয়া মু‘আমালাত, পৃঃ ২; চালীস ওলামায়ে আহলেহাদীছ, পৃঃ ৪১৬।
[15]. আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃঃ ৪৯১-৪৯২।
[16]. হুকূক ওয়া মু‘আমালাত, পৃঃ ৩; তারীখ ওয়া তা‘আরুফ মাদরাসা দারুল হাদীছ রহমানিয়া দিল্লী, পৃঃ ২১৫।
[17]. চালীস ওলামায়ে আহলেহাদীছ, পৃঃ ৪১৬; মাওলানা আব্দুর রঊফ রহমানী ঝান্ডানগরী, আল-ইলম ওয়াল ওলামা (গুজরানওয়ালা, পাকিস্তান : নাদওয়াতুল মুহাদ্দিছীন, ৪র্থ সংস্করণ, ১৯৮২ খ্রিঃ), পৃঃ ৫।
[18]. আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃঃ ৪৯৩।
[19]. মাওলানা মুহাম্মাদ মুস্তাকীম সালাফী, জামা‘আতে আহলেহাদীছ কী ছিহাফাতী খিদমাত (বেনারস, ভারত : আল-ইয্যাহ ইউনিভার্সাল, ২০১৪), পৃঃ ৬৯; চালীস ওলামায়ে আহলেহাদীছ, পৃঃ ৪১৬।
[20]. আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃঃ ৪৯৫; চালীস ওলামায়ে আহলেহাদীছ, পৃঃ ৪১৬; হুকূক ওয়া মু‘আমালাত, পৃঃ ১; মাসিক আস-সিরাজ (উর্দূ), ঝান্ডানগর, নেপাল, ১০/৫-১০ সংখ্যা, অক্টোবর ২০০৩-মার্চ ২০০৪, পৃঃ ১৮৫।
[21]. রাশেদ হাসান মুবারকপুরী, ‘আশ-শায়খ আব্দুল্লাহ আব্দুত তাওয়াব আল-মাদানী হায়াতুহু ওয়া আ‘মালুহু’, মাসিক ছওতুল উম্মাহ, জামে‘আ সালাফিইয়াহ, বেনারস, ৪৮/৪ সংখ্যা, এপ্রিল ২০১৬, পৃঃ ৫৪।
[22]. আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃঃ ৪৯৩।
[23]. মাওলানা আব্দুর রঊফ রহমানী ঝান্ডানগরী, ছিয়ানাতুল হাদীছ (ঝান্ডানগর, নেপাল : জামে‘আ সিরাজুল উলূম, ২য় সংস্করণ, ১৯৮৭ খ্রিঃ), পৃঃ ১৫-১৬; চালীস ওলামায়ে আহলেহাদীছ, পৃঃ ৪১৮-৪১৯।
[24]. মাওলানা আব্দুর রঊফ রহমানী, আইয়ামে খিলাফতে রাশেদা (লাহোর : মাকতাবা কুদ্দূসিয়া, ২০০১ খ্রিঃ), পৃঃ ২৩।
[25]. চালীস ওলামায়ে আহলেহাদীছ, পৃঃ ৪১৮; মাওলানা খুরশীদ আলম মাদানী, ‘ফিতনায়ে ইনকারে হাদীছ আওর আহলেহাদীছ’, পাক্ষিক তারজুমান, দিল্লী, ৩৬/২ সংখ্যা, ১৬-৩১শে জানুয়ারী ২০১৬, পৃঃ ১২।
[26]. আল-ইলম ওয়াল ওলামা, পৃঃ ৪।
[27]. চালীস ওলামায়ে আহলেহাদীছ, পৃঃ ৪১৭-৪১৮।
[28]. চালীস ওলামায়ে আহলেহাদীছ, পৃঃ ৪১৮; হুকূক ওয়া মু‘আমালাত, পৃঃ ৫-১৫।
[29]. মাওলানা আব্দুর রঊফ ঝান্ডানগরী, দালাইলে হাসতী বারী তা‘আলা (লাক্ষ্ণৌ : নিযামী প্রেস, তাবি), পৃঃ ৫-৬।
[30]. মাওলানা আব্দুর রঊফ রহমানী ঝান্ডানগরী, সংকলন ও বিন্যাস : ওবায়দুর রহমান মুহসিন, ওলামায়ে দ্বীন আওর উমারায়ে ইসলাম (উকাড়া : মাকতাবা দারুল হাদীছ জামে‘আ কামালিয়া, আগস্ট ২০০১), পৃঃ ৯৭-৯৮।
[31]. চালীস ওলামায়ে আহলেহাদীছ, পৃঃ ৪১৯; হুকূক ওয়া মু‘আমালাত, পৃঃ ৪।