ভূমিকা : পৃথিবীর সবকিছুর চাইতে এমনকি নিজের, নিজ পরিবারের ও সন্তান-সন্ততির চাইতেও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে সর্বাধিক ভালবাসা প্রত্যেক মুসলমানের উপর অবশ্য কর্তব্য। আর রাসূল (ছাঃ)-কে ভালবাসার দাবী হ’ল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল প্রদত্ত সকল বাণী ও বিধানকে মেনে নেওয়া এবং এগুলির কোন একটিকেও উপেক্ষা না করা। অথচ রাসূল (ছাঃ)-এর উপর পবিত্র এই ভালবাসার ক্ষেত্রে কতিপয় মুসলমান অতিভক্তির আতিশয্যে বিভিন্ন রকম শিরক-বিদ‘আতে লিপ্ত হয়ে থাকে। নিম্নে এ বিষয়ে আলোচনা পেশ করার প্রয়াস পাব।-

রাসূল (ছাঃ)-কে ভালবাসার উদ্দেশ্য : রাসূল (ছাঃ)-কে ভালবাসার কতিপয় বিশেষ ও মহান উদ্দেশ্য রয়েছে। যেমন- (১) আল্লাহর ভালবাসাকে গুরুত্ব দেওয়া। কেননা রাসূল (ছাঃ)-কে ভালাবাসা আল্লাহর ভালবাসা অর্জনেরই অন্যতম উপায়। (২) রাসূল (ছাঃ) সকল নবী-রাসূলগণের মধ্যে সর্বশেষ নবী ও রাসূল এবং তিনি ক্বিয়ামতের দিন সমস্ত আদম সন্তান থেকে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হবেন। (৩) তিনি আল্লাহ প্রদত্ত দ্বীনকে যথাযথভাবে প্রচার করেছিলেন। (৪) শরী‘আতের বিধানের ক্ষেত্রে তিনি স্বীয় উম্মতের উপর রহমদিল ছিলেন। (৫) তিনি তাঁর উম্মতকে যথাসাধ্য নছীহত করেছেন এবং আল্লাহর পথে দাওয়াত প্রদানের ক্ষেত্রে সম্ভবপর ধৈর্যধারণকারী ছিলেন। (৬) তিনি মহান চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। (৭) রাসূল (ছাঃ)-কে ভালবাসা দুনিয়া এবং আখেরাতে ছওয়াব লাভের অন্যতম মাধ্যম। তাই তাঁকে ভালবাসার জন্য আমাদেরকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে চেষ্টা করতে হবে।

রাসূল (ছাঃ)-কে ভালবাসার ঈমানী আলামত

রাসূল (ছাঃ)-কে ভালবাসার বেশকিছু ঈমানী আলামত বা নিদর্শন রয়েছে। নিম্নে কতিপয় আলামত উল্লেখ করা হ’ল।-

(১) সৃষ্টির সকলের চাইতে রাসূল (ছাঃ)-এর ভালবাসাকে প্রধান্য দেওয়া : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হ’লেন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ট নবী ও রাসূল এবং তিনি পৃথিবীবাসীর প্রতি প্রেরিত রহমত স্বরূপ। তাই তাঁকে যথাসাধ্য ভালবাসতে হবে। যেমন আল্লাহ বলেন,قُلْ إِنْ كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌنِ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُمْ مِّنَ اللهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّى يَأْتِيَ اللهُ بِأَمْرِهِ، وَاللهُ لاَ يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ- ‘তুমি বল, তোমাদের পিতা, পুত্র, ভাই, স্ত্রী, নিজ বংশ ও ধন-সম্পদ সমূহ তোমরা যা আয় কর, ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা হওয়ার আশংকা কর এবং বাসস্থান, তোমরা যাকে ভালবাস, আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর পথে জিহাদ করার চাইতেও যদি এগুলি অধিক প্রিয় হয়; তাহ’লে তোমরা আল্লাহর শাস্তি আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর। আর আল্লাহ ফাসেক সম্প্রদায়কে হেদায়াত দান করেন না’ (তওবা ৯/২৪)

(ক) নিজের পিতা-পুত্রের চাইতে রাসূল (ছাঃ)-কে অধিক ভালবাসা : এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন,اَلنَّبِيُّ أَوْلَى بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنْفُسِهِمْ وَأَزْوَاجُهُ أُمَّهَاتُهُمْ، وَأُولُو الْأَرْحَامِ بَعْضُهُمْ أَوْلَى بِبَعْضٍ فِي كِتَابِ اللهِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُهَاجِرِينَ، إِلَّآ أَنْ تَفْعَلُوآ إِلَى أَوْلِيَآئِكُمْ مَّعْرُوفًا، كَانَ ذَالِكَ فِي الْكِتَابِ مَسْطُورًا- ‘নবী (মুহাম্মাদ) মুমিনদের নিকট তাদের নিজেদের অপেক্ষা অধিক ঘনিষ্ট এবং তাঁর স্ত্রীগণ মুমিনদের মা। আর আল্লাহর কিতাবে রক্ত সম্পর্কীয়গণ পরস্পরের অধিক নিকটবর্তী অন্যান্য মুমিন ও মুহাজিরদের চাইতে। তবে তোমরা যদি তাদের প্রতি সদাচরণ কর সেটা স্বতন্ত্র বিষয়। আর এটাই মূল কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে’ (আহযাব ৩৩/৬)

আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছঃ) এরশাদ করেন,لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَّالِدِهِ وَوَلَدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ- ‘তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত মুমিন হ’তে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার নিকটে সর্বাধিক প্রিয় হব তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও সকল মানুষ হ’তে’।[1]

(খ) নিজের পরিবার এবং ধন-সম্পদের চাইতে রাসূল (ছাঃ)-কে অধিক ভালবাসা : আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেন,لاَ يُؤْمِنُ عَبْدٌ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ أَهْلِهِ وَمَالِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ- ‘কোন ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত মুমিন হ’তে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার নিকটে সর্বাধিক প্রিয় হব তার পরিবার, ধন-সম্পদ ও সকল মানুষ হ’তে’।[2]

(গ) নিজের জীবনের চাইতেও রাসূল (ছাঃ)-কে সর্বাধিক ভালবাসা : আব্দুল্লাহ বিন হিশাম (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমরা নবী করীম (ছাঃ)-এর সাথে ছিলাম এমতাবস্থায় যে, তিনি তখন ওমরের হাত ধরেছিলেন। ওমর (রাঃ) তাঁকে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার নিজের জীবন ব্যতীত আপনি আমার কাছে সকল কিছুর চাইতে অধিক প্রিয়। তখন নবী করীম (ছাঃ) বললেন,لاَ وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْكَ مِنْ نَفْسِكَ، فَقَالَ لَهُ عُمَرُ فَإِنَّهُ الآنَ وَاللهِ لأَنْتَ أَحَبُّ إِلَىَّ مِنْ نَفْسِى، فَقَالَ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- الآنَ يَا عُمَرُ- ‘না। যাঁর হাতে আমার প্রাণ ঐ সত্তার কসম! যতক্ষণ না আমি তোমার নিকটে তোমার জীবনের চাইতে প্রিয় হবো (ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি পূর্ণ মমিন হ’তে পারবে না)। একথাশুনে ওমর (রাঃ) তাঁকে বললেন, আল্লাহর কসম! এখন আপনি আমার কাছে আমার নিজের জীবনের চাইতেও অধিক প্রিয়। তখন নবী করীম (ছাঃ) বললেন, হে ওমর তুমি এখন প্রকৃত ঈমানদার হ’তে পারলে!’।[3]

(২) রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত সমূহকে যথাযথভাবে ভালবাসা : তাঁর নির্দেশিত যেকোন বিষয় মেনে নেওয়া এবং সে বিষয়ে কোনরূপ ওযর-আপত্তি পেশ না করা। সেই সাথে রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাহগুলির কোন একটি নিয়েও ঠাট্টা-বিদ্রূপ না করা। যেমন আল্লাহ বলেন,إِنَّمَا كَانَ قَوْلَ الْمُؤْمِنِينَ إِذَا دُعُوآ إِلَى اللهِ وَرَسُولِهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ أَنْ يَّقُولُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ- ‘মুমিনদের কথা তো কেবল এটাই হবে, যখন তাদেরকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে আহবান করা হয় তাদের মধ্যে মীমাংসা করার জন্য, তখন তারা বলবে আমরা শুনলাম ও মেনে নিলাম। আর তারাই হবে সফলকাম’ (নূর ২৪/৫১)

(৩) রাসূল (ছাঃ)-এর সীরাত গুরুত্বের সাথে অধ্যয়ন করা : রাসূল (ছাঃ)-এর জীবন চরিত গুরুত্বের সাথে অধ্যয়ন করা এবং তাঁর আদর্শে মুমিনের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনকে সাধ্যমত ঢেলে সাজানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখা।

(৪) রাসূল (ছাঃ)-এর উপর অধিকহারে দরূদ ও সালাম প্রেরণ করা : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মর্যাদা স্বয়ং আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত। তাই তাঁর উপর অধিকহারে দরূদ ও সালাম প্রেরণ করা মুমিনের জন্য আবশ্যক। যেমন আল্লাহ বলেন,إِنَّ اللهَ وَمَلَآئِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ، يَآأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি দরূদ প্রেরণ করেন। হে মুমিনগণ! তোমরা তার প্রতি দরূদ ও যথাযথভাবে সালাম প্রেরণ কর’ (আহযাব ৩৩/৫৬)

(৫) রাসূল (ছাঃ)-এর ছাহাবী ও পরিবারবর্গকে ভালবাসা : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছাহাবায়ে কেরাম এবং পরিবারবর্গকে ভালবাসা প্রতিটি মুমিনের ঈমানী দায়িত্ব। অথচ মুসলিম নামধারী শী‘আরা হাতে গোণা কয়েকজন ছাহাবী ব্যতীত বাকীদেরকে ‘কাফের’ গণ্য করার ধৃষ্টতা দেখাতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি। এবিষয়ে প্রকৃত মুমিনদের কর্তব্য সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,وَالَّذِينَ جَآءُوا مِنْم بَعْدِهِمْ يَقُولُونَ رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيمَانِ، وَلاَ تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلاَّ لِّلَّذِينَ آمَنُوا رَبَّنَآ إِنَّكَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ- ‘যারা পরে ইসলামের ছায়াতলে এসেছে তারা বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে ও আমাদের ভাইদেরকে ক্ষমা কর, যারা ঈমানের ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রবর্তী। আর যারা ঈমান এনেছে তাদের ব্যাপারে আমাদের অন্তরে কোনরূপ হিংসা-বিদ্বেষ রেখো না। হে আমাদের প্রতিপালক! নিশ্চয়ই তুমি অতিশয় করুণাময়, পরম দয়ালু’ (হাশর ৫৯/১০)

যায়েদ বিন আরক্বাম (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) একদা আলোচনায় দাঁড়িয়ে বললেন,...وَأَهْلُ بَيْتِي أُذَكِّرُكُمُ اللهَ فِي أَهْلِ بَيْتِي، ‘আর আমার পরিবারবর্গের বিষয়ে আমি তোমাদের আল্লাহর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছি’।[4] অর্থাৎ রাসূল (ছাঃ)-এর পরিবারবর্গের যথাযথ সম্মান বজায় রাখতে হবে।

অথচ এই ভালবাসার অপব্যবহার করে আমাদের দেশে ‘আওলাদে রাসূল’ বা রাসূলের বংশধর হওয়ার দাবীদারগণ ধর্মপ্রাণ জনগণের নযর-নেয়াযের প্রতি প্রলুব্ধ হয়ে স্ব-ঘোষিত ‘আওলাদে রাসূল’-এর মিথ্যা ফযীলত বর্ণনা করে থাকেন। অথচ প্রকৃতপক্ষে তারা বংশপরম্পরায় রাসূল (ছাঃ)-এর বংশের সাথে মিলেও যায়নি অথবা তারা রাসূল (ছাঃ)-এর পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ-অনুকরণও করেন না। বরং তাদের কর্মকান্ড সমূহ বিভিন্ন শিরক-বিদ‘আতে ভরপুর।

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেন,لاَ تَسُبُّوا أَصْحَابِي، فَلَوْ أَنَّ أَحَدَكُمْ أَنْفَقَ مِثْلَ أُحُدٍ ذَهَبًا، مَا بَلَغَ مُدَّ أَحَدِهِمْ وَلاَ نَصِيفَهُ- ‘তোমরা আমার ছাহাবীদের গালি দিও না। তোমাদের মধ্যে যদি কেউ ওহোদ পর্বতের ন্যায় স্বর্ণ দান করে, তবুও তাদের কারুর এক মুদ (৬২৫ গ্রাম) কিংবা অর্ধ মুদ আমলের সমপরিমাণ হ’তে পারবে না’।[5] অতএব ছাহাবায়ে কেরাম, রাসূল (ছাঃ)-এর পরিবারবর্গ থেকে শুরু করে পরবর্তী যুগের সৎকর্মশীল দাঈ ও কর্মীগণকে নিঃস্বার্থভাবে ভালবাসা মুমিনগণের জন্য অবশ্য কর্তব্য।

(৬) রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে সাক্ষাতের উদগ্র বাসনা : রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে জান্নাতবাসী হওয়ার জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা চালানো এবং তাঁর সাথে সাক্ষাতের উদগ্র বাসনা সদা জাগ্রত রাখা। সেই সাথে ফরয ও সুন্নাত সমূহের প্রতি পূর্ণভাবে যত্নশীল হওয়া আবশ্যক। যেমন (ক) রাসূল (ছাঃ) বলেন,مِنْ أَشَدِّ أُمَّتِي لِي حُبًّا نَاسٌ يَكُونُونَ بَعْدِي، يَوَدُّ أَحَدُهُمْ لَوْ رَآنِي بِأَهْلِهِ وَمَالِهِ- ‘আমার উম্মতের মধ্যে আমাকে অত্যধিক ভালবাসবে কতিপয় ব্যক্তি, যারা আমার বিগত হওয়ার পর আসবে। তাদের মধ্যে কেউ এমন আকাঙ্ক্ষা পোষণ করবে যে, যদি সে তার পরিবার-পরিজন এবং ধন-সম্পদের বিনিময়েও আমাকে দেখতে পেত!’[6] (খ) আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন,وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ فِي يَدِهِ لَيَأْتِيَنَّ عَلَى أَحَدِكُمْ يَوْمٌ وَلاَ يَرَانِي، ثُمَّ لَأَنْ يَّرَانِي أَحَبُّ إِلَيْهِ مَنْ أَهْلِهِ وَمَالِهِ مَعَهُمْ- ‘যাঁর হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ তার কসম করে বলছি, তোমাদের উপর এমন এক সময় আসবে, যখন তোমরা আমার সাক্ষাৎ পাবে না। অথচ আমার সাক্ষাৎ লাভ তোমাদের নিকট তখন তোমাদের ধন-সম্পদ ও পরিবার-পরিজনের চেয়েও অধিক প্রিয় হবে’।[7]

বেলাল (রাঃ) শাম দেশে ছিলেন। ওমর (রাঃ) সফরে শামের ‘জাবিয়া’তে গেলে লোকেরা ওমর (রাঃ)-এর নিকট জানতে চাইলেন যে, বেলাল (রাঃ) আযান দিবেন কি-না? কারণ রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুবরণের পর বেলাল (রাঃ) আর কখনো আযান দেননি।-فَأَذَّنَ يَوْماً، فَلَمْ يُرَ يَوْماً كَانَ أَكْثَرَ بَاكِياً مِنْ يَوْمَئِذٍ، ذِكْراً مِنْهُم لِلنَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- ‘অতঃপর তিনি একদিন আযান দিলেন এবং ঐদিন এমন অঝোরে কান্নাকাটি করলেন যে, ইতিপূর্বে বেলাল আর কখনো এরূপ কান্না করেননি। কেননা আযানে রাসূল (ছাঃ)-এর ভালবাসার স্মৃতি তাঁর মনে পড়ে গিয়েছিল।[8]

(৭) আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের শত্রুদের সাথে বিদ্বেষ পোষণ করা : যারা ইসলামের শত্রু, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের শত্রু, তাদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করা নিষিদ্ধ। যেমন আল্লাহ বলেন,لاَ تَجِدُ قَوْمًا يُّؤْمِنُونَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ يُوَآدُّونَ مَنْ حَآدَّ اللهَ وَرَسُولَهُ وَلَوْ كَانُوآ آبَاءَهُمْ أَوْ أَبْنَآءَهُمْ أَوْ إِخْوَانَهُمْ أَوْ عَشِيرَتَهُمْ، ‘যারা আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসী তাদের কাউকে তুমি এমন পাবে না যে, তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতাকারীদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করে। যদিও তারা তাদের পিতৃপুরুষ, সন্তানাদি, ভ্রাতৃমন্ডলী অথবা নিকটাত্মীয় হয়’ (মুজাদালাহ ৫৮/২২)। অতএব শুধুমাত্র দাওয়াত পৌঁছানোর লক্ষ্যে বাহ্যিক সদাচরণ ব্যতীত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের শত্রুদের সাথে বিদ্বেষ পোষণ করা প্রতিটি মুমিনের ঈমানী দায়িত্ব।

রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি ভালবাসার কতিপয় আমলী নিদর্শন

উপরে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ)-কে ভালবাসার ক্ষেত্রে ঈমানী আলামত আলোচনার পর এক্ষণে তাঁকে ভালবাসার কতিপয় আমলী নিদর্শন আলোকপাতের প্রয়াস পাব ইনশআল্লাহ।-

(১)রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশ দ্রুততার সাথে ও যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা : এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনের কয়েকটি আয়াত ও ছাহাবায়ে কেরামের বাস্তব জীবনে সংঘটিত ঘটনার প্রেক্ষিতে বর্ণিত ছহীহ হাদীছ নিম্নে তুলে ধরা হ’ল।- যেমন (ক) আল্লাহ বলেন,اَلَّذِينَ اسْتَجَابُوا لِلَّهِ وَالرَّسُولِ مِنْم بَعْدِ مَآ أَصَابَهُمُ الْقَرْحُ، لِلَّذِينَ أَحْسَنُوا مِنْهُمْ وَاتَّقَوْا أَجْرٌ عَظِيمٌ- ‘যারা আল্লাহ ও রাসূলের আহবানে সাড়া দিয়েছে নিজেরা আহত হওয়ার পরও, তাদের মধ্যে যারা সৎকর্ম করেছে ও তাক্বওয়া অবলম্বন করেছে, তাদের জন্য রয়েছে মহা প্রতিদান’ (আলে ইমরান ৩/১৭২)

(খ) আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, মদ হারামের আয়াত (মায়েদাহ ৫/৯১) নাযিল হওয়ার পর এক ব্যক্তি এসে বলল, আপনাদের কাছে এ সংবাদ এসে পৌঁছেছে কি? তারা বললেন, কি সংবাদ? অতঃপর সে বলল, মদ হারাম করা হয়েছে। তারা বললেন, হে আনাস! এই পাত্র সমূহের মদ ফেলে দাও। আনাস (রাঃ) বললেন যে,فَمَا سَأَلُوا عَنْهَا وَلاَ رَاجَعُوهَا بَعْدَ خَبَرِ الرَّجُلِ- ‘তারা এ বিষয়ে কোন প্রশ্নও করেননি এবং ঐ ব্যক্তির সংবাদে প্রশ্নের পৃনরাবৃত্তি-ও করেননি’ (বুখারী হা/৬১৭)। কেননা আল্লাহ বলেন,وَمَآ آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا، ‘আর রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত হও’ (হাশর ৫৯/৭)। তিনি আরও বলেন,مَنْ يُّطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ، وَمَنْ تَوَلَّى فَمَآ أَرْسَلْنَاكَ عَلَيْهِمْ حَفِيظًا- ‘যে রাসূলের আনুগত্য করে, সে আল্লাহরই আনুগত্য করে। আর যে বিমুখ হয়, তবে আমি তোমাকে তাদের উপর সংরক্ষকরূপে প্রেরণ করিনি’ (নিসা ৪/৮০)। অন্যত্র তিনি বলেন,يَآأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوآ أَطِيعُوا اللهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ، ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর ও রাসূলের আনুগত্য কর এবং তোমাদের মধ্যকার নেতৃবর্গের’ (নিসা ৪/৫৯)

(গ) ইরবায বিন সারিয়া (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেন,...فَإِنَّهُ من يَّعش مِنْكُم فَسَيَرَى اخْتِلاَفًا كَثِيرًا، فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّينَ، تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ- ...‘কেননা আমার পরে তোমাদের মধ্যে যারা জীবিত থাকবে, তারা অতিসত্বর বহুবিধ মতভেদ দেখতে পাবে। তখন তোমরা আমার সুন্নাতকে এবং আমার হেদায়াতপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে দৃঢ়ভাবে অাঁকড়ে ধরবে। তাকে মযবূতভাবে ধারণ করবে এবং মাড়ির দাঁত সমূহ দিয়ে কামড়ে ধরে থাকবে। সাবধান! দ্বীনের মধ্যে নতুন উদ্ভাবন থেকে বিরত থাকবে। কারণ দ্বীনের ব্যাপারে প্রত্যেক নতুন উদ্ভাবন হ’ল বিদ‘আত এবং প্রত্যেক বিদ‘আতই হ’ল গোমরাহী’।[9]

(ঘ) আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা (রাঃ) একদা খুৎবা চলাকালীন সময়ে নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট আগমন করলেন। তিনি তাঁকে বলতে শুনলেন, اِجْلِسُوا ‘তোমরা বসে পড়’। তখন তিনি মসজিদের বাইরে যেখানে ছিলেন, সেখানেই বসে পড়লেন। এভাবে নবী করীম (ছাঃ) তাঁর খুৎবা সমাপ্ত করলেন। আর এই ঘটনাটি তিনি জানতে পারলেন। অতঃপর তিনি দো‘আ করে বললেন,زَادَكَ اللهُ حِرْصًا عَلَى طَوَاعِيَةِ اللهِ وَطَوَاعِيَةِ رَسُولِهِ- ‘আল্লাহ তোমার আগ্রহ বৃদ্ধি করুন আল্লাহর আনুগত্যে ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যে’।[10]

(ঙ) মুগীরা বিন শো‘বা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট এসে জনৈকা আনছার মেয়েকে বিবাহের বিষয়ে তাঁর সাথে পরামর্শ করি। তিনি বললেন, اِذْهَبْ فَانْظُرْ إِلَيْهَا، فَإِنَّهُ أَجْدَرُ أَنْ يُّؤْدَمَ بَيْنَكُمَا، ‘তুমি যাও এবং তাকে দেখে নাও। কেননা তাতে তোমাদের উভয়ের মধ্যে ভালবাসার সৃষ্টি হবে’। অতএব আমি উক্ত আনছার মেয়ের পিতার নিকটে এসে তাকে বিবাহের প্রস্তাব দিলাম এবং সেই সাথে নবী করীম (ছাঃ)-এর কথাটিও তাদেরকে অবহিত করলাম। কিন্তু আমার মনে হ’ল যে, তারা এটা অপসন্দ করলেন। রাবী বলেন, মেয়েটি পর্দার আড়াল থেকে উক্ত বর্ণনা শুনে বলল, যদি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আপনাকে পাত্রী দেখার আদেশ দিয়ে থাকেন, তবে আপনি দেখে নিন। অন্যথায় আল্লাহর দোহাই (আমাকে দেখবেন না)। মুগীরা (রাঃ) বলেন, আমি তাকে দেখে নিলাম এবং বিবাহ করলাম। পরবর্তীতে মুগীরা (রাঃ) তার সাংসারিক সুখ ও সুসম্পর্কের বিষয়টি উল্লেখ করে কৃতজ্ঞ হ’তেন’।[11] অতএব সার্বিক জীবনে রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশ দ্রুততার সাথে ও যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা প্রতিটি মুমিনের অবশ্য কর্তব্য।

(২)রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতকে রক্ষার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করা : চতুর্থ হিজরীতে রাসূল (ছাঃ) কর্তৃক প্রেরিত ‘বিরে মাঊনা’র দাওয়াতী কাফেলার অন্যতম সদস্য হারাম বিন মিলহান (রাঃ)-কে যখন পিছন থেকে বর্শা নিক্ষেপ করা হয়, তখন তিনি নিজ দেহের ফিনকি দেওয়া রক্ত দু’হাতে নিজের চেহারা এবং মাথায় মেখে বলে উঠলেন,اَللهُ أَكْبَرُ، فُزْتُ وَرَبِّ الْكَعْبَةِ- ‘আল্লাহু আকবার! কা‘বার রবের কসম!! আমি সফলকাম হয়েছি’।[12] অতঃপর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। অর্থাৎ রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশে দাওয়াত প্রদান ও সুন্নাতকে প্রতিষ্ঠিত করার আন্দোলনের জন্য তিনি সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। আর শাহাদত লাভের মাধ্যমে তিনি সফলকাম হয়েছেন।[13]

অতএব রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশ ও সুন্নাত সমূহকে রক্ষার জন্য ছাহাবায়ে কেরাম যেভাবে সোচ্চার ছিলেন, আমাদেরকেও সেভাবে সুন্নাত রক্ষায় সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করার আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

(৩) শরী‘আতের সর্বোচ্চ ধারক হিসাবে রাসূল (ছাঃ)-কে মেনে নেওয়া : রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি ভালবাসার অন্যতম নিদর্শন হ’ল, রাসূল (ছাঃ) কর্তৃক প্রদত্ত বিধান সর্বান্তকরণে মেনে নেওয়া। যেমন আল্লাহ বলেন,فَلاَ وَرَبِّكَ لاَ يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لاَ يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا- ‘অতএব তোমার প্রতিপালকের কসম! তারা ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণ মুমিন হ’তে পারে না, যতক্ষণ তারা তাদের মীমাংসার বিষয়ে তোমাকে ফায়ছালাকারী হিসাবে মেনে না নিবে। অতঃপর তোমার প্রদত্ত সিদ্ধান্তে তাদের অন্তরে কোনরূপ কুটিলতা রাখবে না এবং সম্পূর্ণরূপে তা মেনে নিবে’ (নিসা ৪/৬৫)। অতএব রাসূল (ছাঃ)-কে দ্বীন ও শরী‘আতের সর্বোচ্চ ধারক ও বাহক হিসাবে গণ্য করতে হবে এবং সর্বান্তকরণে রাসূল (ছাঃ)-এর ছহীহ হাদীছ সমূহ বাস্তব জীবনে মেনে নিতে হবে।

(৪) রাসূল (ছাঃ)-এর ভালবাসায় বাড়াবাড়ি না করা : পূর্ববর্তী নবী-রাসূলদের নিয়ে তাদের উম্মতের অতিভক্তি, মতানৈক্য ও বাড়াবাড়িতে তারা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল’।[14] তাদের উক্ত বিষয়ে সাবধান করে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,لاَ تُطْرُونِى كَمَا أَطْرَتِ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ، فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ، فَقُولُوا عَبْدُ اللهِ وَرَسُولُهُ- ‘তোমরা আমার বিষয়ে বাড়াবাড়ি করো না, যেমনটি খৃস্টানরা মরিয়ম তনয় ঈসাকে নিয়ে করেছে। আমি তো আল্লাহর বান্দা মাত্র। অতএব তোমরা আমাকে আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূলই বল’।[15]

আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ)-এর মৃত্যুপীড়া শুরু হ’লে তিনি একটা চাদরে নিজের মুখমন্ডল ঢেকে নিলেন। যখন নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হ’ল, তখন মুখমন্ডল হ’তে চাদর সরিয়ে দিয়ে বললেন,لَعْنَةُ اللهِ عَلَى الْيَهُودِ وَالنَّصَارَى اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ- ‘আল্লাহর লা‘নত ইহূদী ও খৃষ্টানদের প্রতি, যারা তাদের নবীগণের কবর সমূহকে সিজদার স্থানে পরিণত করেছে’।[16] এ কথা বলে তিনি মুসলমানদেরকে ভক্তির আতিশয্যে কবর পূজার শিরকে লিপ্ত হওয়া থেকে সতর্ক করেছিলেন।

আব্দুল্লাহ বিন আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে এসে আলাপচারিতার সময় বলল, مَا شَاءَ اللهُ وَشِئْتَ، ‘যা আল্লাহ ও আপনি ইচ্ছা করেন’। জবাবে রাসূল (ছাঃ) বললেন,جَعَلْتَنِى لِلَّهِ عَدْلاً، مَا شَاءَ اللهُ وَحْدَهُ- ‘তুমি তো আমাকে আল্লাহর সমতুল্য গণ্য করলে। বরং (বল) একমাত্র আল্লাহ ইচ্ছা করেন’।[17]

আনাস বিন মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-কে বলল,يَا مُحَمَّدُ يَا سَيِّدَنَا وَابْنَ سَيِّدِنَا وَخَيْرَنَا وَابْنَ خَيْرِنَا، ‘হে মুহাম্মাদ, হে আমাদের নেতা এবং আমাদের নেতার পুত্র। আমাদের মধ্যে সর্বোত্তম এবং আমাদের সর্বোত্তম ব্যক্তির সন্তান’। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন,أَيُّهَا النَّاسُ عَلَيْكُمْ بِتَقْوَاكُمْ، وَلاَ يَسْتَهْوِيَنَّكمُ الشَّيْطَانُ، أَنَا مُحَمَّدُ بْنُ عَبْدِ اللهِ عَبْدُ اللهِ وَرَسُولُهُ، وَاللهِ مَا أُحِبُّ أَنْ تَرْفَعُونِى فَوْقَ مَنْزِلَتِى الَّتِى أَنْزَلَنِى اللهُ عَزَّ وَجَلَّ- ‘হে জনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। শয়তান যেন তোমাদেরকে বিভ্রান্ত না করে। বরং আমি আব্দুল্লাহর পুত্র ‘মুহাম্মাদ’। আমি আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। আল্লাহর কসম! আমি পসন্দ করিনা যে, মহান আল্লাহ আমাকে যে মর্যাদা প্রদান করেছেন, তোমরা অতিরঞ্জিত করে আমাকে তার ঊর্ধ্বে উঠাবে’।[18]

(৫) রাসূল (ছাঃ)-এর সম্মান যথাযথভাবে বজায় রাখা : পৃথিবীর দিকে দিকে নাস্তিক-মুরতাদরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের শান-মান হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য সদা অপতৎপর থাকে। তাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উচ্চ সম্মান যথাযথভাবে বজায় রাখার জন্য মুমিনদেরকে সজাগ থাকতে হবে। আল্লাহ বলেন,اَلَّذِينَ يَتَّبِعُونَ الرَّسُولَ النَّبِيَّ الْأُمِّيَّ الَّذِي يَجِدُونَهُ مَكْتُوبًا عِنْدَهُمْ فِي التَّوْرَاةِ وَالْإِنْجِيلِ، يَأْمُرُهُمْ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَاهُمْ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَائِثَ وَيَضَعُ عَنْهُمْ إِصْرَهُمْ وَالْأَغْلاَلَ الَّتِي كَانَتْ عَلَيْهِمْ، فَالَّذِينَ آمَنُوا بِهِ وَعَزَّرُوهُ وَنَصَرُوهُ وَاتَّبَعُوا النُّورَ الَّذِي أُنْزِلَ مَعَهُ أُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ- ‘যারা আনুগত্য করে এই রাসূলের যিনি নিরক্ষর নবী, এ বিষয়ে তারা তাদের কিতাব তাওরাত ও ইনজীলে লিখিত পেয়েছে। যিনি তাদেরকে সৎকর্মের নির্দেশ দেন ও অসৎকর্ম থেকে নিষেধ করেন। তিনি তাদের জন্য পবিত্রগুলি হালাল করেন ও অপবিত্রগুলো নিষিদ্ধ করেন এবং তাদের উপর থেকে বোঝা ও শৃংখল সমূহ নামিয়ে দেন যা তাদের উপরে ছিল। অতএব যারা তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছে, তাকে সম্মান করেছে ও সাহায্য করেছে এবং সেই জ্যোতির্ময় কুরআনের অনুসরণ করেছে যা তার সাথে নাযিল হয়েছে, তারাই হ’ল প্রকৃত সফলকাম’ (আ‘রাফ ৭/১৫৭)

(৬) রাসূল (ছাঃ)-এর বাণীকে উপেক্ষা না করা : রাসূল (ছাঃ)-এর কোন নির্দেশ, হাদীছ অথবা বিধান পেলে মাথা পেতে মেনে নেওয়া যরূরী। যেমন আল্লাহ বলেন,وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَّلاَ مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَّكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ، وَمَنْ يَّعْصِ اللهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلالاً مُّبِينًا- ‘কোন মুমিন পুরুষ বা মুমিনা নারীর সে বিষয়ে নিজস্ব কোন অধিকার নেই, যে বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন নির্দেশ প্রদান করেন। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যতা করবে, সে সুস্পষ্টভাবে পথভ্রষ্ট হবে’ (আহযাব ৩৩/৩৬)। অতএব রাসূল (ছাঃ)-কে ভালবাসার দাবী হ’ল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল প্রদত্ত কোন বাণী ও বিধানকে উপেক্ষা না করা এবং যথাযথভাবে কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে সার্বিক জীবন পরিচালনা করা।

(৭) রাসূল (ছাঃ)-এর আনীত বিধানকে বাস্তবায়ন করা :

বিভিন্ন তন্ত্র-মন্ত্র, ইযম-তরীকা, জাতীয় ও বিজাতীয় মতবাদ সমূহকে পরিহার করে আল্লাহ প্রেরিত অহি-র আলোকে ঈমান আনয়ন করা প্রতিটি মুমিনের যরূরী কর্তব্য। কেননা রাসূল (ছাঃ)-এর আনীত বিধান আল্লাহর-ই প্রেরিত অহি। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন,وَالنَّجْمِ إِذَا هَوَى- مَا ضَلَّ صَاحِبُكُمْ وَمَا غَوَى- وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى- إِنْ هُوَ إِلاَّ وَحْيٌ يُّوحَى- ‘কসম নক্ষত্ররাজির যখন সেগুলি অস্ত যায়’। ‘তোমাদের সাথী ভ্রষ্ট হয়নি এবং ভ্রান্তও হয়নি’। ‘আর সে খেয়াল-খুশীমত মনগড়া কোন কথাও বলে না’। ‘সেটিতো কেবলমাত্র অহি ব্যতীত নয়, যা তার নিকট প্রেরণ করা হয়’ (নাজ্ম ৫৩/১-৪)

রাসূল (ছাঃ)-এর আনীত বিধানের প্রতি মুশরিকদের সন্দেহের প্রতিবাদে আল্লাহ বলেন,وَمَا كَانَ هَذَا الْقُرْآنُ أَنْ يُّفْتَرَى مِنْ دُونِ اللهِ وَلَكِنْ تَصْدِيقَ الَّذِي بَيْنَ يَدَيْهِ وَتَفْصِيلَ الْكِتَابِ لاَ رَيْبَ فِيهِ مِنْ رَّبِّ الْعَالَمِينَ- ‘আর এই কুরআন তো এমন নয় যে, আল্লাহ ব্যতীত যা অন্যের কাছ থেকে রচিত হয়েছে। বরং এটি পূর্ববর্তী কিতাব সমূহের প্রত্যয়নকারী এবং কিতাবের বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদানকারী। যাতে কোনই সন্দেহ নেই। এটি জগত সমূহের প্রতিপালকের নিকট হ’তে প্রদত্ত’ (ইউনুস ১০/৩৭)। অতএব রাসূল (ছাঃ)-এর আনীত বিধানে ঈমান আনা ও তাঁর নির্দেশ বাস্তবায়ন করা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে ভালবাসার অন্যতম প্রধান শর্ত।

[ক্রমশঃ]

-ইহসান ইলাহী যহীর

* পিএইচ.ডি গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

[1]. বুখারী হা/১৫; মুসলিম হা/৪৪; মিশকাত হা/৭।

[2]. মুসলিম হা/৪৪; বায়হাক্বী শো‘আব হা/১৩১২।

[3]. বুখারী হা/৬৬৩২; হাকেম হা/৫৯২২; আহমাদ হা/১৮০৭৬; ইবনুল মুলাক্কিন (৭২৩-৮০৪ হি. কায়রো, মিসর), আত-তাওযীহু লি শরহিল জামে‘ইছ ছগীর হা/৬২৬৪-এর আলোচনা; ইবনু বাত্ত্বাল কুরতুবী, শরহ ছহীহুল বুখারী ‘মুছাফাহা’ অনুচ্ছেদ ৯/৪৪ পৃ.

[4]. মুসলিম হা/২৪০৮; মিশকাত হা/৬১৩১।

[5]. বুখারী হা/৩৬৭৩; মুসলিম হা/২৫৪০; মিশকাত হা/৬০০৭।

[6]. মুসলিম হা/২৮৩২; মিশকাত হা/৬২৭৫।

[7]. মুসলিম হা/২৩৬৪; মিশকাত হা/৫৯৬৯।

[8]. যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ১/৩৫৭ পৃ.

[9]. আবুদাঊদ হা/৪৬০৭ প্রভৃতি; মিশকাত হা/১৬৫।

[10]. ইবনু হাজার আসক্বালানী, আল-ইছাবাহ ৪/৭৩; ইবনু কাছীর, আস-সীরাতুন নববিইয়াহ ৩/৪৮৭; আল-বিদায়াহ ৪/২৫৮।

[11]. ইবনু মাজাহ হা/১৮৬৬; আহমাদ হা/১৮১৬২; বায়হাক্বী হা/১৩৮৭২; মিশকাত হা/৩১০৭; ছহীহাহ হা/৯৬-এর আলোচনা।

[12]. বুখারী হা/২৮০১, ৪০৯১; আহমাদ হা/১২৪২৫; মুসলিম হা/৬৭৭।

[13]. ফাৎহুল বারী শরহ বুখারী হা/৪০৯০-এর আলোচনা ৭/৩৮৮ পৃ.।

[14]. মুসলিম হা/১৩৩৭; মিশকাত হা/২৫০৫

[15]. বুখারী হা/৩৪৪৫; মিশকাত হা/৪৮৯৭।

[16]. বুখারী হা/৪৩৫-৪৩৬; মুসলিম হা/৫৩১; মিশকাত হা/৭১২।

[17]. আহমাদ হা/৩২৪৭; মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/২৯৫৭৩; ছহীহাহ হা/১০৯৩।

[18]. আহমাদ হা/১৩৫৫৩; নাসাঈ কুবরা হা/১০০০৭; ছহীহাহ হা/১৫৭২।






ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার কতিপয় ক্ষেত্র - ড. মুহাম্মাদ আব্দুল হালীম
নফল ছিয়াম সমূহ - আত-তাহরীক ডেস্ক
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত পরিচিতি - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
কুরবানী : ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
ইসলামের আলোকে সম্পদ বৃদ্ধির উপায় - মুহাম্মাদ আবু তাহের, পরিচালক, কিউসেট ইনস্টিটিউট, সিলেট।
আদালত পাড়ার সেই দিনগুলো (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - শামসুল আলম
যাকাত ও ছাদাক্বা - আত-তাহরীক ডেস্ক
মিথ্যার ধ্বংসাত্মক প্রভাব - ড. মুহাম্মাদ আব্দুল হালীম
মানবাধিকার ও ইসলাম (১৫তম কিস্তি) - শামসুল আলম
গীবত : পরিণাম ও প্রতিকার (শেষ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
আল্লাহ সর্বশক্তিমান - রফীক আহমাদ - বিরামপুর, দিনাজপুর
মানবাধিকার ও ইসলাম (১৩তম কিস্তি) - শামসুল আলম
আরও
আরও
.