সমাজে অপরাধপ্রবণতা হ্রাসে কুরআনে বর্ণিত শাস্তিবিধানের অপরিহার্যতা (৩য় কিস্তি)

পর্ব ১পর্ব ২। 

৬. মুরতাদ ও তার হদ : মুরতাদ বলা হয় দ্বীন ইসলাম ত্যাগকারীকে। আর দ্বীন ইসলাম ত্যাগকে বলা হয় ‘রিদ্দাহ’ ও ‘ইরতিদাদ’। ‘রিদ্দাহ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ, যে পথে আসা সে পথেই ফিরে যাওয়া।[1] শরী‘আতের পরিভাষায় প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থমস্তিষ্ক সম্পন্ন কোন মুসলিমের কারও বল প্রয়োগ ছাড়া স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে দ্বীন ইসলাম ছেড়ে কুফর অবলম্বনকে ‘রিদ্দাহ’ বলে। যে দ্বীন ত্যাগ করে তাকে বলা হয় মুরতাদ। মুরতাদ নারী পুরুষ যে কেউ হ’তে পারে। কোন ব্যক্তিকে জোর করে কুফরী করতে বাধ্য করা হ’লে সে মুরতাদ হবে না। যারা বুঝে শুনে নিজেদের হৃদয়-মন কুফরের জন্য উন্মুক্ত করে দেয় তারাই মুরতাদ বলে গণ্য হবে। আল্লাহ বলেন,مَنْ كَفَرَ بِاللهِ مِنْ بَعْدِ إِيْمَانِهِ إِلَّا مَنْ أُكْرِهَ وَقَلْبُهُ مُطْمَئِنٌّ بِالْإِيْمَانِ وَلَكِنْ مَنْ شَرَحَ بِالْكُفْرِ صَدْرًا فَعَلَيْهِمْ غَضَبٌ مِنَ اللهِ وَلَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ، ‘যার উপরে (কুফরীর জন্য) যবরদস্তি করা হয়, অথচ তার হৃদয় ঈমানের উপর প্রশান্ত থাকে, সে ব্যতীত যে ব্যক্তি ঈমান আনার পরে কুফরী করে এবং কুফরীর জন্য হৃদয়কে উন্মুক্ত করে দেয়, তাদের উপর আপতিত হবে আল্লাহর গযব ও তাদের জন্য রয়েছে ভয়াবহ শাস্তি’ (নাহল ১৬/১০৬)। ইসলাম ত্যাগ করে অন্য যে কোন দ্বীন অবলম্বন করলে কিংবা নাস্তিক হ’লে ইসলামী আইনে তা মোটেও গ্রহণযোগ্য হবে না। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন,وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِيْنًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ، ‘আর যে ব্যক্তি ‘ইসলাম’ ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন তালাশ করে, তার নিকট থেকে তা কখনোই কবুল করা হবে না এবং ঐ ব্যক্তি আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (আলে ইমরান ৩/৮৫)

কিন্তু রিদ্দাহ বা ইসলাম ত্যাগ সুস্পষ্ট রূপে প্রমাণিত হ’তে হবে। কোনভাবে যদি ইসলামে বিদ্যমান থাকার প্রমাণ মেলে তবে কাউকে বিশেষ কোন অপরাধ হেতু মুরতাদ গণ্য করা যাবে না। ইমাম মালেক (রহঃ)-এর এ সম্পর্কিত একটি উক্তি আছে, তিনি বলেছেন,من صدر عنه ما يحتمل الكفر من تسعة وتسعين وجها ويحتمل الايمان من وجه حمل امره علي الايمان، ‘যার থেকে এমন কিছু প্রকাশ পাবে যার নিরানববই ভাগ কুফর হওয়ার সম্ভাবনা এবং এক ভাগ কেবল ঈমানের দিকে থাকার সম্ভাবনা মিলবে তার বিষয়টি ঈমানের পক্ষে সাব্যস্ত করতে হবে’। এখানে কুফর হওয়ার মত রিদ্দাহর কিছু

দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হ’ল :

১. দ্বীন ইসলামের অন্তর্ভুক্ত বলে যা স্বতঃসিদ্ধভাবে জানা রয়েছে তার কোনটি অস্বীকার করা। যেমন আল্লাহর অস্তিত্ব ও একত্বকে অস্বীকার করা, নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর নবুঅতকে অস্বীকার করা, কুরআনকে আল্লাহর অহী হিসাবে স্বীকার না করা, আখেরাতকে অস্বীকার করা, ছালাত, যাকাত, ছিয়াম ও হজ্জের ফরযিয়াত অস্বীকার করা।

২. মুসলমানরা যা হারাম বলে ইজমা করেছে এবং কুরআন হাদীছে যার হারাম হওয়ার প্রমাণ রয়েছে তাকে হালাল গণ্য করা। যেমন- মদ, যেনা, সূদ, ঘুষ, শূকরের গোশতকে হালাল দাবী করা।

৩. শরী‘আতে যা কিছু হালালকরা হয়েছে তাকে হারাম গণ্য করা। যেমন উট ও গরুর গোশত খাওয়াকে হারাম বলা, ব্যবসা ও কৃষি কাজকে হারাম বলা।

৪. নবী করীম (ছাঃ)-কে গালিগালাজ করা, তাঁকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ ও উপহাস করা, তাঁর ব্যঙ্গচিত্র, কার্টুন ইত্যাদি অাঁকা।

৫. দ্বীন ইসলাম তুলে গালাগালি করা, কুরআন ও সুন্নাহর প্রতি বিষোদগার করা, কুরআন ও সুন্নাহর বিচার ফায়ছালাকে অমান্য করা, মানব রচিত আইনকে কুরআন ও সুন্নাহর আইনের উপর প্রাধান্য দেওয়া ইত্যাদি।

৬. নবুঅত দাবী করা কিংবা খতমে নবুঅতকে অস্বীকার করা।

৭. কুরআন ও হাদীছের কিতাবকে অবমাননার উদ্দেশ্যে ময়লার ভাগাড় বা ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করা।

৮. আল্লাহর কোন নাম কিংবা তাঁর আদেশ ও নিষেধকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা, তাঁর কোন প্রতিশ্রুতিকে পাত্তা না দেওয়া।

অবশ্য ইসলামে নতুন দাখিল হেতু অজ্ঞতাবশত কেউ এরূপ করলে সে কাফের-মুরতাদ হবে না।

মুরতাদকে তওবার সুযোগ দান : কারও মুরতাদ হওয়ার প্রমাণ মিললে তার কারণ জেনে তা দূর করার পদক্ষেপ নিতে হবে এবং ইসলামে ফিরে আসার জন্য তাকে সুযোগ দিতে হবে। সাধারণত মনে নানাবিধ সন্দেহ ও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দানা বাঁধার ফলে ইসলামের প্রতি অবিশ্বাস তৈরি হয়। মুরতাদের নিকট দলীল-প্রমাণ তুলে ধরতে পারলে তার ইসলামের পথে ফিরে আসা অসম্ভব নয়। সন্দেহ কেটে গিয়ে যদি সে তওবা করে এবং শাহাদাহ পাঠ করে তবে তাকে মুসলিম গণ্য করতে হবে। তার উপর ইরতিদাদের হদ জারী হবে না। আর যদি ইসলাম অস্বীকারে অটল থাকে তাহ’লে হদ কায়েম করতে হবে। কোন কোন আইনবিদ বলেছেন, জানাবোঝার জন্য তাকে তিন দিন সময় দিতে হবে।

মুরতাদের হদ : কোন মুসলিম মুরতাদ হওয়ার পর ইসলামে ফিরে না আসলে তাকে গ্রেফতার করে শারঈ আদালতে তুলতে হবে। বিচারকের নিকট তার ইসলাম ত্যাগ প্রমাণিত হ’লে তওবার সুযোগ শেষে তাকে মৃত্যুদন্ড দিতে হবে। মুরতাদের মৃত্যুদন্ডের বিধান হাদীছ দ্বারা সাব্যস্ত। ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ بَدَّلَ دِيْنَهُ فَاقْتُلُوْهُ ‘যে লোক তার দ্বীন বদলে ফেলে তাকে তোমরা হত্যা করো’।[2] ইবনু মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,لاَ يَحِلُّ دَمُ امْرِئٍ مُسْلِمٍ يَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلٰهَ إِلاَّ اللهُ وَأَنِّي رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِلاَّ بِإِحْدَى ثَلاَثٍ النَّفْسُ بِالنَّفْسِ وَالثَّيِّبُ الزَّانِي وَالْمَارِقُ مِنْ الدِّينِ التَّارِكُ لِلْجَمَاعَةِ، ‘কোন মুসলিম যদি সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল, তিনটি কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করা বৈধ নয়। যথা- জানের বদলে জান, বিবাহিত ব্যভিচারী, আর নিজের দ্বীন ত্যাগকারী মুসলিম জাম‘আত থেকে পৃথক হয়ে যাওয়া ব্যক্তি’।[3]

মুরতাদকে সর্বোচ্চ শাস্তিদানের হেকমত : ইসলাম থেকে বের হয়ে যাওয়া মূলত ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। মানব রচিত সকল দেশের আইনেই দেশের প্রচলিত আইন অস্বীকার ও তার বিরোধিতা বিদ্রোহের শামিল বলে গণ্য এবং বিদ্রোহের সর্বোচ্চ শাস্তি সকল দেশের আইনেই মৃত্যুদন্ড। পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক উভয় শ্রেণীর দেশেই স্ব স্ব দেশে বলবৎ আইনের বিরোধিতা করলে তাকে রাষ্ট্রদ্রোহ বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চরম বিশ্বাসঘাতকতা বলে গণ্য করা হয়। আর এ ধরনের চরম বিশ্বাসঘাতকতার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড।

ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। তা একাধারে দ্বীন ও রাষ্ট্র, নেতৃত্ব ও আনুগত্য, জ্ঞান ও শক্তি, বস্ত্ত ও আত্মা, দুনিয়া ও আখেরাত সবকিছুকে শামিল করে। বুদ্ধি ও যুক্তি তার ভিত্তি, দলীল ও প্রমাণের উপর সে দন্ডায়মান। মানুষের প্রকৃতি ও স্বভাবের সাথে ইসলামের আক্বীদা-বিশ্বাস ও শারঈ আইন-কানূনের কোন সংঘর্ষ নেই। দৈহিক ও নৈতিক উৎকর্ষের ক্ষেত্রেও ইসলাম কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। যে ইসলামে প্রবেশ করবে সে-ই তার তাৎপর্য ও বাস্তবতা জানতে পারবে এবং তার স্বাদ আস্বাদন করতে পারবে। এসব জেনে-বুঝেও যে ইসলাম থেকে বের হয়ে যায় প্রকৃতপক্ষে সে হক থেকে সরে দাঁড়ায় এবং দলীল-প্রমাণকে অস্বীকার করে। সুস্থ বিবেক ও সরল প্রকৃতি তার মধ্যে কাজ করে না। এমন পর্যায়ে যে পৌঁছায় সে তো পতনের অতল গহবরে তলিয়ে যায়। এ ধরনের মানুষের বেঁচে থাকা মোটেও সমীচীন নয়। তার জীবনের তো উত্তম কোন লক্ষ্য নেই এবং মহৎ কোন আদর্শও নেই। কাজেই তার মরে যাওয়ায় মানবতারই কল্যাণ হবে। সুতরাং মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদন্ড ইসলামের নিজস্ব বিধানের আলোকে যেমন যৌক্তিক, তেমনি অপরাপর আইনের সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ।

৭. বিদ্রোহ ও তার হদ : মুসলিম জামা‘আত সব সময় দ্বীনের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ থাকবে। তাদের হুকুমত থাকবে একজন আমীরের নেতৃত্বাধীন। যিনি পরামর্শের ভিত্তিতে হুকুমত পরিচালনা করবেন। হুকুমত পরিচালনায় ভুল-ভ্রান্তি হ’লে শাসকদের শুধরাতে চেষ্টা করতে হবে। কথায় কথায় তাদের বিরোধিতা করতে হাদীছে নিষেধ করা হয়েছে। উবাদাহ বিন ছামেত (রাঃ) বলেন,دَعَانَا النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم فَبَايَعْنَاهُ فَقَالَ فِيمَا أَخَذَ عَلَيْنَا أَنْ بَايَعَنَا عَلَى السَّمْعِ وَالطَّاعَةِ، فِي مَنْشَطِنَا وَمَكْرَهِنَا، وَعُسْرِنَا، وَيُسْرِنَا، وَأَثَرَةٍ عَلَيْنَا، وَأَنْ لاَ نُنَازِعَ الأَمْرَ أَهْلَهُ، إِلاَّ أَنْ تَرَوْا كُفْرًا بَوَاحًا، عِنْدَكُمْ مِنَ الل‏‏‏‏‏‏‏‏‏‏‏‏‏‏‏‏‏‏‏‏‏ ‘নবী করীম (ছাঃ) আমাদের ডেকে নিলেন। আমরা তাঁর কাছে বায়‘আত করলাম। এরপর তিনি (উবাদাহ) বললেন, আমাদের থেকে যে অঙ্গীকার তিনি নিয়েছিলেন তাতে ছিল যে, আমরা আমাদের সুখে-দুঃখে, সচ্ছলতায়-অসচ্ছলতায় এবং আমাদের উপর অন্যদের প্রাধান্য প্রদান সত্ত্বেও আমরা আমীরের কথা শোনব ও মান্য করব। আরও বায়‘আত হ’লাম যে, আমরা নেতৃত্ব নিয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হব না। কিন্তু যদি তোমরা (আমীর বা খলীফার মধ্যে) এমন স্পষ্ট কুফরী দেখ, যে বিষয়ে তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণ বিদ্যমান আছে (তবে তখন বিরোধিতা করলে তা হবে ভিন্ন কথা)’।[4]

এতদসত্ত্বেও মুসলিম ঐক্যকে ছিন্নভিন্ন করার উদ্দেশ্যে কোন ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠী যদি মুসলিম শাসকের বিরোধিতায় নামে এবং বিদ্রোহ করে তবে প্রথমে মীমাংসার উদ্যোগ নিতে হবে। সে চেষ্টা ফলপ্রসূ না হ’লে ঐ ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠীকে গ্রেপ্তার করতে হবে এবং বিচার করতে হবে। বিচারে বিদ্রোহ প্রমাণিত হ’লে তার শাস্তি হবে মৃত্যুদন্ড। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّهُ سَتَكُونُ هَنَاتٌ وَهَنَاتٌ، فَمَنْ أَرَادَ أَنْ يُفَرِّقَ أَمْرَ هَذِهِ الْأُمَّةِ وَهِيَ جَمِيعٌ، فَاضْرِبُوهُ بِالسَّيْفِ كَائِنًا مَنْ كَانَ، ‘অচিরেই নানা রকম ফেতনা দেখা দেবে। সে সময়ে এই উম্মাহর ঐক্যবদ্ধ থাকাকালে যে তাদের ঐক্যে ফাটল ধরাতে চাইবে তোমরা তাকে তলোয়ারের আঘাতে হত্যা করবে তা সে যেই হোক না কেন’।[5] বিদ্রোহীরা যুদ্ধ শুরু করলে যুদ্ধ করে হ’লেও তাদের পরাস্ত করতে হবে এবং ন্যায় বিচারের মাধ্যমে তাদের বিষয়ের সমাধান করতে হবে। আল্লাহ বলেছেন,

وَإِنْ طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا فَإِنْ بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الْأُخْرَى فَقَاتِلُوا الَّتِي تَبْغِي حَتَّى تَفِيءَ إِلَى أَمْرِ اللهِ فَإِنْ فَاءَتْ فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا بِالْعَدْلِ وَأَقْسِطُوا إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ،

‘যদি মুমিনদের দুই দল পরস্পরে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তাহ’লে তোমরা তাদের মধ্যে সন্ধি করে দাও। অতঃপর যদি তাদের একদল অপর দলের উপর সীমালংঘন করে, তাহ’লে তোমরা ঐ দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর, যে দল সীমালংঘন করে। যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের (সন্ধির) দিকে ফিরে আসে। অতঃপর যদি তারা ফিরে আসে, তাহ’লে তোমরা উভয় দলের মধ্যে ন্যায়ানুগভাবে মীমাংসা করে দাও এবং ন্যায়বিচার কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়নিষ্ঠদের ভালবাসেন’ (হুজুরাত ৪৯/৯)

বিদ্রোহ দেখভালের বিষয়টি প্রশাসনের সাথে জড়িত। দেশে কোথাও যাতে বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিয়ে না ওঠে সেজন্য সরকারের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা বাহিনী, সামরিক বাহিনী ইত্যাদি থাকে। জনগণ সরকারকে এজন্য প্রয়োজনে সাহায্য করবে। তথাপি দেশে কোথাও বিদ্রোহ দেখা দিলে সাথে সাথে কঠোর পদক্ষেপে যেতে হবে। কোন রকম শিথিলতা দেখানোর সুযোগ এক্ষেত্রে মোটেও কাম্য নয়। তাতে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলাবিনষ্ট হবে এবং জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। এমনকি দেশের স্বাধীনতাও হুমকির মুখে পড়তে পারে। তাই বিদ্রোহকে কোন সরকারই মেনে নেয় না। প্রায় প্রত্যেক আইনেই বিদ্রোহের শাস্তি হয় মৃত্যুদন্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদন্ড।

ইসলাম বিদ্রোহের ক্ষেত্রে হত্যার মতো কঠোর শাস্তির পক্ষে। যাতে শাস্তি জানার পর বিদ্রোহের পথে পা বাড়াতে মানুষ ভাবনা-চিন্তা করে পা ফেলে। তবে সরকারের উচিত হবে দেশে আইনের শাসন ও সুবিচার কায়েম রাখা, যুলুম ও দুর্নীতি প্রতিহত করা এবং জনগণের সমস্যার প্রতি তীক্ষ্ণ নযর রাখা। তাদের কষ্ট লাঘব ও সার্বিক উন্নয়নে সরকার সদা তৎপর থাকবে।[6]

যে সকল অপরাধের শাস্তি ক্বিছাছ, দিয়াত ইত্যাদি :

যে সকল অপরাধে ক্বিছাছ, দিয়াত ও অন্যান্য শাস্তি প্রযোজ্য তার সংখ্যা পাঁচ। যথা: ১. ইচ্ছাকৃত হত্যা (قتل عمد), ২. ইচ্ছাসদৃশ হত্যা (قتل شبه عمد), ৩. ভুলক্রমে হত্যা (قتل خطاء), ৪. ইচ্ছাপূর্বক আহত করা (جرح عمد), ৫. ভুলক্রমে আহত করা (جرح خطاء)।[7]

আবার ক্বিছাছ ও তার স্থলাভিষিক্ত শাস্তিও পাঁচ প্রকার। যথা: ১. ক্বিছাছ, ২. দিয়াত, ৩. কাফফারাহ, ৪. উত্তরাধিকার বা মিরাছ থেকে বঞ্চিত হওয়া, ৫. অছিয়ত থেকে বঞ্চিত হওয়া। অনেকে ভুলক্রমে হত্যাকে দু’ভাগে ভাগ করেছেন। কাজের মাঝে ভুল (خطاء في الفعل) ও ইচ্ছার মাঝে ভুল (خطاء في القصد)। তারা ‘ভুলের স্থলাভিষিক্ত হত্যা’ (ما اجري مجري) الخطاء ও ‘কারণঘটিত হত্যা’ (قتل بالسبب) নামে আরও দুই প্রকার হত্যার কথা বলেন।[8]

ইচ্ছাকৃত হত্যা ও তার দন্ড : ইচ্ছাকৃত হত্যা বলতে বুঝায়, কোন প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন ব্যক্তি (مكلف) কর্তৃক কোন নিরপরাধ ব্যক্তিকে অন্যের দ্বারা বাধ্য না হয়ে স্বেচ্ছায় এমন জিনিস দ্বারা হত্যা করা, যা সচরাচর হত্যার কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন আগ্নেয়াস্ত্র কিংবা ধারাল অস্ত্রের সাহায্যে হত্যা, বড় ভারী পাথরের আঘাতে হত্যা, আগুনে পুড়িয়ে হত্যা, পানিতে ডুবিয়ে হত্যা, উপর থেকে নীচে ফেলে দিয়ে হত্যা, প্রাচীর চাপা দিয়ে হত্যা, শ্বাসরোধ করে হত্যা, খাদ্য-পানীয় বন্ধ করে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় হত্যা, বিষ প্রয়োগে হত্যা ইত্যাদি।

অপ্রাপ্তবয়স্ক ও বিকৃত মস্তিষ্কের কেউ ইচ্ছা করে হত্যা করলেও তাদের উপর ক্বিছাছ প্রযোজ্য হবে না। তারা শরী‘আতের আইনে আদিষ্ট নয়। ঊর্ধ্বতন পুরুষ যেমন পিতা ও দাদা অধস্তন পুরুষ যেমন ছেলে ও নাতিকে হত্যা করলে হত্যাকারীর উপর ক্বিছাছ প্রযোজ্য হবে না। নিহত ব্যক্তি অমুসলিম এবং হত্যাকারী মুসলিম হ’লে সেক্ষেত্রেও ক্বিছাছ প্রযোজ্য হবে না। অন্য কোন শাস্তি প্রযোজ্য হবে। হত্যাকারী সন্তানসম্ভবা হ’লে সন্তানের জন্ম পর্যন্ত তার ক্বিছাছ বিলম্বিত হবে।

ইচ্ছাকৃত হত্যার ফলে চারটি বিষয় আবশ্যিক হবে। ক. ইচ্ছাকৃত হত্যার ফলে হত্যাকারী কবীরা গুনাহগার হবে। খ. নিহতের অভিভাবগণ হত্যাকারীকে ক্ষমা করবে, নতুবা হত্যাকারীর উপর ক্বিছাছ বলবৎ হবে। গ. নিহত ব্যক্তির মীরাছ ও অছিয়ত হ’তে হত্যাকারী বঞ্চিত হবে। ঘ. হত্যাকারী কর্তৃক হত্যার কাফফারা প্রদান করতে হবে।[9]

এ ধরনের হত্যা প্রমাণের জন্য হত্যাকারীর স্বেচ্ছায় স্বীকৃতি অথবা দু’জন ন্যায়পরায়ণ মুসলিম পুরুষের সাক্ষ্য আবশ্যক হবে। প্রমাণ হিসাবে হাদীছে এসেছে যে, আনছারদের এক ব্যক্তি খায়বারে নিহত হ’লে তার অভিভাবকরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে বিষয়টি উত্থাপন করে। তিনি তাদের বলেন,لَكُمْ شَاهِدَانِ يَشْهَدَانِ عَلَى قَتْلِ صَاحِبِكُمْ؟ قَالُوا : يَا رَسُولَ اللهِ، لَمْ يَكُنْ ثَمَّ أَحَدٌ مِنَ الْمُسْلِمِينَ، وَإِنَّمَا هُمْ يَهُودُ وَقَدْ يَجْتَرِئُونَ عَلَى أَعْظَمَ مِنْ هَذَا، قَالَ: فَاخْتَارُوا مِنْهُمْ خَمْسِينَ فَاسْتَحْلَفُوهُمْ فَأَبَوْا، فَوَدَاهُ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنْ عِنْدِهِ ‘তোমাদের কি এমন দু’জন সাক্ষী আছে, যারা তোমাদের সাথীর হত্যার বিষয়ে সাক্ষ্য দিবে? তারা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! সেখানে তো কোন মুসলিম নেই। ওরা সকলেই ইহূদী। ওরা তো এর চেয়েও জঘন্য অপকর্মের জন্য কুখ্যাত। তিনি বললেন, তাহ’লে তোমরা তাদের পঞ্চাশজন লোককে বাছাই করে নিয়ে তাদের থেকে কসম নাও। তারা এতে রাজী না হওয়ায় নবী করীম (ছাঃ) নিজের পক্ষ থেকে তার দিয়াত দিয়ে দিলেন।[10]

শরী‘আতে ইচ্ছাকৃত হত্যা ও ইচ্ছাপূর্বক আহত করার মূল শাস্তি ক্বিছাছ। ক্বিছাছ অর্থ বদলা। অপরাধী যেরূপ অপরাধ করেছে তাকে তদ্রূপ শাস্তি দেওয়ার নাম ক্বিছাছ। সুতরাং সে যেভাবে হত্যা করেছে, যেভাবে আহত করেছে সেভাবে তাকে হত্যা কিংবা আহত করা হ’ল ক্বিছাছ। ক্বিছাছ কুরআন ও সুন্নাহ থেকে সাব্যস্ত। আল্লাহ বলেন, يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِصَاصُ فِي الْقَتْلَى الْحُرُّ بِالْحُرِّ وَالْعَبْدُ بِالْعَبْدِ وَالْأُنْثَى بِالْأُنْثَى فَمَنْ عُفِيَ لَهُ مِنْ أَخِيهِ شَيْءٌ فَاتِّبَاعٌ بِالْمَعْرُوفِ وَأَدَاءٌ إِلَيْهِ بِإِحْسَانٍ ذَلِكَ تَخْفِيفٌ مِنْ رَبِّكُمْ وَرَحْمَةٌ فَمَنِ اعْتَدَى بَعْدَ ذَلِكَ فَلَهُ عَذَابٌ أَلِيمٌ ‘হে বিশ্বাসীগণ! নিহতদের বদলা গ্রহণের বিষয়টি তোমাদের উপর বিধিবদ্ধ করা হ’ল। স্বাধীনের বদলে স্বাধীন, দাসের বদলে দাস ও নারীর বদলে নারী। এক্ষণে যদি তার (নিহত) ভাইয়ের পক্ষ হ’তে তাকে কিছু মাফ করা হয়, তবে তাকে যেন ন্যায়সঙ্গতভাবে তাগাদা করা হয় এবং সঙ্গতভাবে সেটি পরিশোধ করা হয়। এটি তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ হ’তে লঘু বিধান ও বিশেষ অনুগ্রহ। অতঃপর যদি কেউ এর পরে সীমালংঘন করে, তবে তার জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি’ (বাক্বারাহ ২/১৭৮)। আল্লাহ বলেন,

وَلَكُمْ فِي الْقِصَاصِ حَيَاةٌ يَاأُولِي الْأَلْبَابِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ

‘আর হে জ্ঞানীগণ! হত্যার বদলে হত্যার মধ্যে তোমাদের জীবন নিহিত রয়েছে, যাতে তোমরা সতর্ক হও’ (বাক্বারাহ ২/১৭৯)

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,ان من اعتبط مومنا قتلا عن بينة فانه قود الا ان يرضي اولياء المقتول ‘কেউ যদি কোন মুমিনকে বিনা অপরাধে হত্যা করে এবং ঐ হত্যাকান্ড প্রমাণিত হয়, তবে তাতে ক্বিছাছ বা প্রাণদন্ড প্রযোজ্য হবে। তবে নিহত ব্যক্তির অভিভাবকগণ (দিয়াত গ্রহণে) রাজী হ’লে সে ক্বিছাছ থেকে মুক্তি পাবে’।[11] তিনি আরও বলেছেন,وَمَنْ قُتِلَ لَهُ قَتِيلٌ فَهُوَ بِخَيْرِ النَّظَرَيْنِ إِمَّا أَنْ يُفْدَى وَإِمَّا أَنْ يُقِيدَ ‘যার কোন লোক নিহত হবে দু’টি বিধির মধ্যে তার কাছে যা ভাল বলে বিবেচিত হবে, তা সে গ্রহণ করবে। ফিদইয়া (দিয়াত বা রক্তমূল্য) অথবা ক্বিছাছ।[12] এক হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,لاَ يُقْتَلُ مُؤْمِنٌ بِكَافِرٍ وَمَنْ قَتَلَ مُؤْمِنًا مُتَعَمِّدًا دُفِعَ إِلَى أَوْلِيَاءِ الْمَقْتُولِ فَإِنْ شَاءُوا قَتَلُوهُ وَإِنْ شَاءُوا أَخَذُوا الدِّيَةَ ‘কাফেরকে হত্যার দরুন কোন মুমিনকে হত্যা করা হবে না। আর যে কোন মুমিনকে ইচ্ছা করে হত্যা করবে তাকে নিহত ব্যক্তির অভিভাকদের হাতে অর্পণ করা হবে। চাইলে তারা তাকে হত্যা করবে, আবার চাইলে দিয়াত নেবে’।[13]

আয়াত ও হাদীছ থেকে বুঝা যায়, ক্বিছাছ নিহতের উত্তরাধিকারীদের অধিকার। তাদেরও আবার প্রাপ্তবয়স্ক ও সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন হ’তে হবে। প্রাপ্তবয়স্ক ও সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন হ’লে তারা ক্বিছাছ দাবী করবে, না ক্ষমা করবে, না দিয়াত নেবে, সে ঘোষণা তারা বিচারকের নিকটে উত্থাপন করবে। আর তিনি তা কার্যকর করবেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ أُصِيبَ بِقَتْلٍ أَوْ خَبْلٍ فَإِنَّهُ يَخْتَارُ إِحْدَى ثَلاَثٍ إِمَّا أَنْ يَقْتَصَّ وَإِمَّا أَنْ يَعْفُوَ وَإِمَّا أَنْ يَأْخُذَ الدِّيَةَ فَإِنْ أَرَادَ الرَّابِعَةَ فَخُذُوا عَلَى يَدَيْهِ وَمَنِ اعْتَدَى بَعْدَ ذَلِكَ فَلَهُ عَذَابٌ أَلِيمٌ، ‘যে ব্যক্তির কেউ নিহত হবে অথবা তার অঙ্গচ্ছেদ ঘটবে, সে তিনটি বিধানের মধ্যে যে কোন একটি গ্রহণের সুযোগ পাবে। হয়তো ক্বিছাছ নেবে, নয়তো মাফ করে দেবে অথবা রক্তপণ নেবে। তা বাদে যদি সে চতুর্থ কোন বিষয়ের আকাঙ্ক্ষা করে, তবে তার হাত ধরে তা থেকে বিরত রাখতে হবে। আর যে তারপরও বাড়াবাড়ি করবে তার জন্য ভীষণ আযাব নির্ধারিত আছে।[14]

কারও উপর ক্বিছাছ বিচার্য হ’লে বিচারক, রাষ্ট্রপ্রধান এবং অন্য যেকোন জনের জন্য নিহতের উত্তরাধিকারীদের নিকট ক্বিছাছ ক্ষমা করে দেওয়ার সুপারিশ করা বৈধ।

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، قَالَ مَا رَأَيْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم رُفِعَ إِلَيْهِ شَىْءٌ فِيهِ قِصَاصٌ إِلاَّ أَمَرَ فِيهِ بِالْعَفْوِ

‘আনাস বিন মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি দেখেছি যে, নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট ক্বিছাছ সংক্রান্ত এমন কোন মামলা উত্থাপিত হয়নি, যাতে তিনি ক্ষমা করার ফরমান শুনাননি’।[15]

ইচ্ছাকৃত হত্যাকারী নিহত ব্যক্তির ওয়ারিছ হয়ে থাকলে সে উত্তরাধিকার হ’তে বঞ্চিত হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,وان لم يكن له وارث فوارثه اقرب الناس اليه ولا يرث القاتل شيئا ليس للقاتل شيئ ‘নিহতের যদি কোন ওয়ারিছ না থাকে তবে তার নিকটতম লোক তার ওয়ারিছ হবে। হত্যাকারী মীরাছ থেকে কিছুই পাবে না। হত্যাকারীর কিছুই মিলবে না’।[16] অনুরূপভাবে নিহত ব্যক্তি তার জীবদ্দশায় হত্যাকারীর জন্য অছিয়ত করে থাকলে সে অছিয়তপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবে।[17]

ইচ্ছাকৃত হত্যাকারী ক্বিছাছের মুখোমুখি হ’লে কারও মতেই তাকে কাফফারা দিতে হবে না। কিন্তু নিহত ব্যক্তির অভিভাবকগণ ক্বিছাছ ক্ষমা করলে তাকে কাফফারা দিতে হবে কি-না সে বিষয়ে মতবিরোধ রয়েছে। একদল আলেমের মতে ভুলক্রমে হত্যাকারীর উপর আল্লাহ কাফফারার কথা বললেও ইচ্ছাকৃত হত্যাকারীকে কাফফারা দেওয়ার কথা বলেননি। আল্লাহ বলেন,وَمَنْ يَقْتُلْ مُؤْمِنًا مُتَعَمِّدًا فَجَزَاؤُهُ جَهَنَّمُ خَالِدًا فِيهَا وَغَضِبَ اللهُ عَلَيْهِ وَلَعَنَهُ وَأَعَدَّ لَهُ عَذَابًا عَظِيمًا ‘যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে কোন মুমিনকে হত্যা করে, তার শাস্তি হ’ল জাহান্নাম। সেখানেই সে চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন, তাকে লা‘নত করেছেন এবং তার জন্য কঠিন শাস্তি প্রস্ত্তত করে রেখেছেন’ (নিসা ৪/৯৩)। সুতরাং ইচ্ছাকৃত হত্যাকারীর উপর হত্যার কাফফারা প্রযোজ্য হবে না।

আরেকদল আলেমের মতে তাকে কাফফারা দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে ইমাম আহমাদ ওয়াছিলাহ বিন আসক্বা (রহঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, বনু সুলাইম গোত্রের একদল লোক নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকটে এসে বলল, আমাদের এক সাথী ভাই (জাহান্নাম) ওয়াজিব করে নিয়েছে। তিনি বললেন, সে একটি দাস মুক্ত করে দিক, তাহ’লে আল্লাহ তার প্রতি অঙ্গের বদলে একটা করে অঙ্গ জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে দিবেন। ইমাম শাওকানী তার নায়লুল আওত্বার গ্রন্থে বলেছেন, ওয়াছিলার হাদীছে ইচ্ছাকৃত হত্যায় কাফফারার প্রমাণ বিদ্যমান।[18]

সর্বোপরি ইচ্ছাকৃত হত্যাকারী তওবা করে আল্লাহর নিকট ক্ষমা না পেলে তাকে ইহকালীন শাস্তির সাথে পরকালীন শাস্তির মুখোমুখি হ’তে হবে। যেমনটা সূরা নিসার পূর্বোল্লিখিত আয়াতে বলা হয়েছে।

ইচ্ছাসদৃশ হত্যা ও তার দন্ড : ইচ্ছাসদৃশ হত্যা করা বলতে বুঝায়, কোন প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন ব্যক্তি (مكلف) কর্তৃক কোন নিরপরাধ ব্যক্তিকে ইচ্ছা করে এমন জিনিস দ্বারা হত্যা করা, যা সচরাচর হত্যার কাজে ব্যবহৃত হয় না। যেমন ছোট্ট লাঠি, ছড়ি কিংবা চাবুক দিয়ে আঘাত করা, ছোট পাথর ছুড়ে মারা, হাত দিয়ে কিল-থাপ্পড় মারা ইত্যাদি। এই হত্যাকে ইচ্ছাসদৃশ নাম দেওয়া হয়েছে এজন্য যে, এ হত্যা ইচ্ছা ও ভুলের মাঝে দোদুল্যমান। কেননা এক্ষেত্রে মারা ইচ্ছাকৃত কিন্তু হত্যা ইচ্ছাকৃত নয়। এজন্য তার উপর ‘ইচ্ছাসদৃশ’ শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে। এ হত্যা না নীরেট ইচ্ছাকৃত, না নীরেট ভুল।

ইচ্ছাসদৃশ হত্যার ফলেও চারটি বিষয় আবশ্যিক হবে। ক. হত্যাকারী গুনাহগার হবে। খ. হত্যাকারীর আকেলার উপর গুরু দিয়াত প্রদান ফরয হবে। গ. নিহত ব্যক্তির মীরাছ ও অছিয়ত হ’তে হত্যাকারী বঞ্চিত হবে। ঘ. হত্যাকারী কর্তৃক হত্যার কাফফারা প্রদান করতে হবে।

যেহেতু এ হত্যা নীরেট ইচ্ছাকৃত হত্যা নয় সেহেতু এক্ষেত্রে ক্বিছাছ প্রযোজ্য হবে না। কেননা মূলনীতি হ’ল ‘জীবন বাঁচিয়ে রাখা’। সুতরাং সুস্পষ্ট প্রমাণ ব্যতিরেকে জীবনহানি অনুমোদিত নয়। আবার স্রেফ ভুলও এখানে হয়নি, কেননা কার্যত উদ্দেশ্য ছিল প্রহার, কিন্তু ঘটে গেছে মৃত্যু। তাই এক্ষেত্রে গুরু রক্তপণ (دية مغلظة) প্রযোজ্য হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এ সম্পর্কে বলেন,عَقْلُ شِبْهِ الْعَمْدِ مُغَلَّظٌ مِثْلُ عَقْلِ الْعَمْدِ، وَلَا يُقْتَلُ صَاحِبُهُ قَالَ: وَزَادَنَا خَلِيلٌ، عَنِ ابْنِ رَاشِدٍ، وَذَلِكَ أَنْ يَنْزُوَ الشَّيْطَانُ بَيْنَ النَّاسِ، فَتَكُونُ دِمَاءٌ فِي عِمِّيَّا فِي غَيْرِ ضَغِينَةٍ، وَلَا حَمْلِ سِلَاحٍ ‘ইচ্ছাসদৃশ হত্যার দিয়াত ইচ্ছাকৃত হত্যার মতোই কঠোর হবে; অবশ্য ঘাতককে হত্যা করা যাবে না। বর্ণনাকারী বলেন, খলীল আমাদেরকে ইবনু রাশিদ সূত্রে আরো বলেছেন, শয়তান মানুষের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে, ফলে অন্যের ক্ষতিসাধনের ইচ্ছা হয় এবং অস্ত্র ছাড়াই অসতর্কভাবে প্রাণহানি ঘটে’।[19] আরেকটি হাদীছে এসেছে,أَلاَ إِنَّ دِيَةَ الْخَطَإِ شِبْهِ الْعَمْدِ مَا كَانَ بِالسَّوْطِ وَالْعَصَا مِائَةٌ مِنَ الإِبِلِ مِنْهَا أَرْبَعُونَ فِي بُطُونِهَا أَوْلاَدُهَا ‘জেনে রাখো! ইচ্ছাসদৃশ হত্যা যা চাবুক বা লাঠির আঘাতে হয়ে থাকে, এজন্য দিয়াত হিসাবে একশো উট দিবে, যার মধ্যে চল্লিশটি উট হবে গর্ভবতী’।[20] ইচ্ছাসদৃশ হত্যাকারীও ইচ্ছাকৃত হত্যাকারীর ন্যায় নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকার ও অছিয়ত লাভ হ’তে বঞ্চিত হবে। [ক্রমশঃ]


[1]. ফিক্বহুস সুন্নাহ, ২/৪০৩।

[2]. বুখারী হা/৩০১৭, ৬৯২২।

[3]. বুখারী হা/৬৮৭৮।

[4]. বুখারী হা/৭০৫৫।

[5]. মুসলিম হা/১৮৫২।

[6]. আল-ইসলাম ৩/১৮০।

[7]. আল-ইসলাম ৩/১৮১; ফিক্বহুস সুনণাহ ২/৪৬৪।

[8]. হিদায়ার বরাতে তানযীমুল আশতাত ৪/২৪ (ইছলাহী কুতুবখানা, দেওবন্দ)।

[9]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/৪৬৮।

[10]. আবূদাঊদ হা/৪৫২৪।

[11]. বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা ৪/৮৯; বুলুগুল মারাম ১১৭৭।

[12]. বুখারী হা/২৪৩৪; মুসলিম হা/৩১৯৬।

[13]. আবূদাঊদ হা/৪৫০৬।

[14]. আবূদাঊদ হা/৪৪৯৬।

[15]. আবূদাঊদ হা/৪৪৯৭।

[16]. আবূদাঊদ হা/৪৫৬৪।

[17]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/৪৬৯।

[18]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/৪৭০।

[19]. আবূদাঊদ হা/৪৫৬৫।

[20]. আবূদাঊদ হা/৪৫৪৭; নাসাঈ হা/৪৭৯১; ইবনু মাজাহ হা/২৬২৭।






যাকাত সম্পর্কিত বিবিধ মাসায়েল - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
সুন্নাত উপেক্ষার পরিণাম - লিলবর আল-বারাদী - যশপুর, তানোর, রাজশাহী
কুরআন ও হাদীছের আলোকে ‘সোনামণি’র ৫টি নীতিবাক্য - ড. মুহাম্মাদ আব্দুল হালীম
আদল : মানব জীবনের এক মহৎ গুণ - ড. মুহাম্মাদ আজিবার রহমান
মুহাসাবা (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
ছিয়ামের ফাযায়েল ও মাসায়েল - আত-তাহরীক ডেস্ক
শবেবরাত - আত-তাহরীক ডেস্ক
ঈদায়নের কতিপয় মাসায়েল - আত-তাহরীক ডেস্ক
তাহরীকে জিহাদ : আহলেহাদীছ ও আহনাফ (৪র্থ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
বিদায়ের আগে রেখে যাও কিছু পদচিহ্ন (৪র্থ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
জ্যোতির্বিজ্ঞানের নিরিখে যেলাসমূহের মাঝে সময়ের পার্থক্যের কারণ - তাহসীন আল-মাহী
শারঈ ইমারত - ড. নূরুল ইসলাম
আরও
আরও
.