
ভুলক্রমে হত্যা ও তার দন্ড : কোন প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন ব্যক্তি (مكلف) কর্তৃক তার জন্য বৈধ কোন কাজ করতে গিয়ে ঘটনাচক্রে কেউ নিহত হলে তাকে ভুলক্রমে হত্যা বলে। যেমন, শিকারের প্রতি অস্ত্র ছুঁড়ে মেরেছে কিংবা নিশানার প্রতি তাক করেছে কিন্তু তা কোন মানুষের গায়ে লাগায় সে নিহত হয়েছে; কিংবা কূয়া, ড্রেন ইত্যাদি খনন করে রেখেছে, তার মধ্যে পড়ে কেউ মারা গেছে। বেআইনী-ভাবে স্থাপিত বিদ্যুতের তারে স্পৃষ্ট হয়ে নিহত হওয়া, নিষিদ্ধ স্থানে পেতে রাখা জালে জড়িয়ে নিহত হওয়া, চিকিৎসকের ভুল অস্ত্রোপচার কিংবা ভুল চিকিৎসায় রোগীর মারা যাওয়া ইত্যাদিও ভুলক্রমে হত্যার অন্তর্ভুক্ত। শিশু ও পাগলের হাতে ইচ্ছাপূর্বক হত্যাও ভুলক্রমে হত্যার আওতায় পড়বে।[1]
ভুলক্রমে হত্যায় দু’টি হুকুম প্রযোজ্য :
এক. হত্যাকারীকে হত্যার জন্য কাফফারা প্রদান করতে হবে।
দুই. হত্যাকারীর আকেলাকে লঘু রক্তপণ (دية خفيفة) পরিশোধ করতে হবে।
তবে ভুলক্রমে হত্যাকারী মিরাছ থেকে বঞ্চিত হবে না এবং গুনাহগার হবে না। কারণ এ উম্মাত থেকে ভুল ও বিস্মৃতিজনিত গুনাহ তুলে নেওয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,إِنَّ اللهَ تَجَاوَزَ عَنْ أُمَّتِي الْخَطَأَ وَالنِّسْيَانَ وَمَا اسْتُكْرِهُوا عَلَيْهِ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার উম্মাত থেকে ভুল, বিস্মৃতি ও জবরদস্তিজনিত কাজকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।[2]
ভুলক্রমে হত্যার দন্ড সংক্রান্ত মূল দলীল আল্লাহর বাণী :
وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ أَنْ يَقْتُلَ مُؤْمِنًا إِلَّا خَطَأً وَمَنْ قَتَلَ مُؤْمِنًا خَطَأً فَتَحْرِيرُ رَقَبَةٍ مُؤْمِنَةٍ وَدِيَةٌ مُسَلَّمَةٌ إِلَى أَهْلِهِ إِلَّا أَنْ يَصَّدَّقُوا فَإِنْ كَانَ مِنْ قَوْمٍ عَدُوٍّ لَكُمْ وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَتَحْرِيرُ رَقَبَةٍ مُؤْمِنَةٍ وَإِنْ كَانَ مِنْ قَوْمٍ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَهُمْ مِيثَاقٌ فَدِيَةٌ مُسَلَّمَةٌ إِلَى أَهْلِهِ وَتَحْرِيرُ رَقَبَةٍ مُؤْمِنَةٍ فَمَنْ لَمْ يَجِدْ فَصِيَامُ شَهْرَيْنِ مُتَتَابِعَيْنِ تَوْبَةً مِنَ اللهِ وَكَانَ اللهُ عَلِيمًا حَكِيمًا-
‘কোন মুমিনের জন্য সঙ্গত নয় যে, সে কোন মুমিনকে হত্যা করে ভুলক্রমে ব্যতীত। অতএব যদি কোন মুমিন কোন মুমিনকে ভুলক্রমে হত্যা করে ফেলে, তবে সে একজন মুমিন ক্রীতদাসকে মুক্ত করবে এবং তার পরিবারের নিকট রক্তমূল্য সমর্পণ করবে। তবে যদি তারা ক্ষমা করে দেয় (সেকথা স্বতন্ত্র)। আর যদি নিহত ব্যক্তি তোমাদের শত্রুদলের হয়, কিন্তু ঐ ব্যক্তি নিজে মুমিন, তাহ’লে তার বিনিময়ে একজন মুমিন ক্রীতদাসকে মুক্ত করবে। আর যদি সে তোমাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়, তাহ’লে তার পরিবারের নিকট রক্তমূল্য সমর্পণ করবে এবং একটি মুমিন ক্রীতদাস মুক্ত করবে। কিন্তু যদি সে তা না পায়, তাহ’লে আল্লাহর নিকট থেকে ক্ষমাপ্রাপ্তির জন্য একটানা দু’মাস ছিয়াম পালন করবে। আল্লাহ মহাবিজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়’ (নিসা ৪/৯২)।
দিয়াত : হত্যার দন্ড হিসাবে কুরআন ও হাদীছে দিয়াতের উল্লেখ রয়েছে। দিয়াতকে বাংলায় রক্তপণ, রক্তমূল্য ইত্যাদি বলা হয়। যার জীবন সংহার করা হয়েছে তার রক্তের বিনিময় স্বরূপ এ দিয়াত। দিয়াত দুই প্রকার। دية مغلظة ও دية مخففة বা গুরু রক্তপণ ও লঘু রক্তপণ।[3]
গুরু রক্তপণ ইচ্ছাসদৃশ হত্যায় প্রযোজ্য এবং তা তিন বছর ধরে পরিশোধযোগ্য। এ রক্তপণ শরী‘আতে নির্ধারিত এক শত উট। তা আবার হবে তিন শ্রেণীর। ত্রিশটি তিন বছর বয়সী, ত্রিশটি চার বছর বয়সী এবং চল্লিশটির পেটে বাচ্চা থাকতে হবে। মূল্য হিসাব করলে তা নির্ধারিত হবে উটের ভিত্তিতে এবং নির্ধারণ করবে শারঈ আদালত। আর উটের মূল্য হ্রাস-বৃদ্ধির সাথে টাকার অঙ্কেরও হ্রাস-বৃদ্ধি হবে। সৌদি আরবে ভুলক্রমে হত্যার বর্তমান দিয়াত তিন লক্ষ রিয়াল এবং ইচ্ছাকৃত হত্যা ও ইচ্ছাসদৃশ হত্যার বর্তমান দিয়াত চার লক্ষ রিয়াল।[4]
লঘু রক্ত রক্তপণ ভুলক্রমে হত্যায় প্রযোজ্য। এই হত্যায় রক্তপণও এক শত উট। তবে তার ধরণ গুরু রক্তপণ থেকে একটু পৃথক। ইমাম খারকী হাম্বলী বলেছেন, ভুলক্রমে হত্যায় হত্যাকারীর আকেলার উপর একশত উট প্রদান আবশ্যিক হবে, যা তিন বছর ধরে পাঁচ কিস্তিতে পরিশোধযোগ্য। একশটির মধ্যে বিশটি দু’বছরে পদার্পণকারী উষ্ট্রী, বিশটি দু’বছরে পদার্পণকারী উট, বিশটি তিন বছরে পদার্পণকারী উষ্ট্রী, বিশটি চার বছরে পদার্পণকারী উষ্ট্রী ও বিশটি পাঁচ বছরে পদার্পণকারী উষ্ট্রী।[5] আমর বিন শু‘আইব কর্তৃক তার পিতার মাধ্যমে তার দাদা থেকে বর্ণিত এক হাদীছে এসেছে, أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَضَى أَنَّ مَنْ قُتِلَ خَطَأً فَدِيَتُهُ مِائَةٌ مِنَ الإِبِلِ ثَلاَثُونَ بِنْتَ مَخَاضٍ وَثَلاَثُونَ بِنْتَ لَبُونٍ وَثَلاَثُونَ حِقَّةً وَعَشْرَةٌ بَنِي لَبُونٍ ذَكَرٍ- ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) রায় দিয়েছেন যে, ভুলক্রমে যে নিহত হবে তার দিয়াত একশ উট। তন্মধ্যে ত্রিশটি দু’বছরে পদার্পণকারী উষ্ট্রী, ত্রিশটি তিন বছরে পদার্পণকারী উষ্ট্রী, ত্রিশটি চার বছরে পদার্পণকারী উষ্ট্রী এবং দশটি তিন বছরে পদার্পণকারী উট।[6]
আমর বিন শু‘আইব কর্তৃক তার পিতার মাধ্যমে তার দাদা থেকে বর্ণিত আরেক হাদীছে এসেছে, كَانَتْ قِيمَةُ الدِّيَةِ عَلَى عَهْدِ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم ثَمَانَمِائَةِ دِينَارٍ أَوْ ثَمَانِيَةَ آلاَفِ دِرْهَمٍ وَدِيَةُ أَهْلِ الْكِتاب يَوْمَئِذٍ النِّصْفُ مِنْ دِيَةِ الْمُسْلِمِينَ ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যুগে মুদ্রা হিসাবে দিয়াত ছিল আট শত দীনার অথবা আট হাযার দিরহাম। আর আহলে কিতাবদের দিয়াত সেকালে মুসলিমদের দিয়াতের অর্ধেক ছিল। ব্যবস্থা এমনই চলছিল, পরে ওমর (রাঃ) যখন খলীফা হ’লেন তখন এক খুৎবায় তিনি (দিয়াতের আলোচনায়) বলেন, أَلاَ إِنَّ الإِبِلَ قَدْ غَلَتْ উটের দাম বেড়ে গেছে। ফলে তিনি স্বর্ণের মালিকদের উপর এক হাযার দীনার, রৌপ্যের মালিকদের উপর বার হাযার দিরহাম, গরুর মালিকদের জন্য দুশ’ গরু, ছাগলের মালিকদের জন্য দু’হাযার ছাগল এবং বস্ত্রের কারবারীদের উপর দুশ’ জোড়া বস্ত্র ধার্য করেন। দিয়াতের আলোচনায় তিনি অমুসলিম জিম্মিদের প্রসঙ্গ তোলেননি।[7] এ হাদীছ থেকে বুঝা যায় দেশ-কাল-পাত্রভেদে সরকার একশ’ উটকে ভিত্তি ধরে দিয়াতের মূল্য হ্রাস-বৃদ্ধি করতে পারবে।
আতা বিন আবী রাবাহ (রাঃ) থেকে এ মর্মে একটি দুর্বল হাদীছও বর্ণিত আছে,أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَضَى فِي الدِّيَةِ عَلَى أَهْلِ الإِبِلِ مِائَةً مِنَ الإِبِلِ وَعَلَى أَهْلِ الْبَقَرِ مِائَتَىْ بَقَرَةٍ وَعَلَى أَهْلِ الشَّاءِ أَلْفَىْ شَاةٍ وَعَلَى أَهْلِ الْحُلَلِ مِائَتَىْ حُلَّةٍ- ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) উটের মালিকদের উপর একশত উট, গরুর মালিকদের জন্য দুশ’ গরু, ছাগল মালিকদের জন্য দু’হাযার ছাগল এবং বস্ত্রের কারবারীদের উপর দুশ’ জোড়া বস্ত্র ধার্য করেন।[8]
দিয়াত কে পরিশোধ করবে : ইচ্ছাকৃত হত্যায় নিহতের অভিভাবক ক্বিছাছ ক্ষমা করলে ইমাম শাফেঈ ও আহমাদের মতে তখন গুরু রক্তপণ প্রযোজ্য হবে। হত্যাকারীকে তা নগদে পরিশোধ করতে হবে, বাকি-বকেয়া রাখা চলবে না। ইমাম আবু হানিফার মতে ইচ্ছাকৃত হত্যায় কোন দিয়াত নেই, বরং দু’পক্ষ যে অঙ্কে সম্মত হবে তাই পরিশোধ করতে হবে।
সম্মতির এ পরিমাণ একশত উটের থেকে কম কিংবা বেশীও হ’তে পারে। এমনকি নিহতের অভিভাবক সমুদয় দিয়াত মাফও করে দিতে পারে। হানাফী মতে নির্ধারিত এ পরিমাণ পরিশোধে হত্যাকারী তিন বছর সময় পাবে। সকল ইমামের মতেই ইচ্ছাকৃত হত্যায় স্বয়ং হত্যাকারীকে দিয়াত পরিশোধ করতে হবে। কেননা সে বা তারাই স্বেচ্ছায় এহেন অপরাধ করেছে। আকেলার উপর তা বর্তাবে না। তবে তারা নিজেরা ইচ্ছে করে সহযোগিতার হাত বাড়ালে তাতে কোন নিষেধ নেই।[9]
ইচ্ছাসদৃশ হত্যা ও ভুলক্রমে হত্যার দিয়াত সর্বসম্মতিক্রমে হত্যাকারীর আকেলা পরিশোধ করবে। এ প্রসঙ্গে মূল দলিল হুযাইল গোত্রের দুই মহিলার ঝগড়ায় একজনের হত্যাকান্ড।
‘আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, হুযাইল গোত্রের দু’জন মহিলা ঝগড়া করছিল। তখন তাদের একজন অন্যজনের প্রতি পাথর ছুঁড়ে মারে। এভাবে সে তাকে এবং তার গর্ভস্থ শিশুকে হত্যা করে। নিহতের উত্তরাধিকারীরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট মামলা করে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তখন রায় দেন যে, أَنَّ دِيَةَ جَنِينِهَا غُرَّةٌ عَبْدٌ أَوْ وَلِيدَةٌ وَقَضَى بِدِيَةِ الْمَرْأَةِ عَلَى عَاقِلَتِهَا وَوَرَّثَهَا وَلَدَهَا وَمَنْ مَعَهُمْ গর্ভস্থ শিশুর দিয়াত একজন দাস অথবা দাসী এবং তিনি মহিলার দিয়াত পরিশোধের দায়িত্ব তার আকেলার উপর অর্পণ করেন এবং দিয়াতের ওয়ারিছ করেন নিহতের ছেলে এবং তাদের সঙ্গে যুক্ত অন্যান্যদের।[10]
আকেলা শব্দটি ‘আকেল’ শব্দের বহুবচন। এটি ‘আকল’ শব্দ থেকে নির্গত। আকল শব্দের অন্যান্য অর্থের মধ্যে একটি অর্থ দিয়াত। এ সূত্রে ‘আকেলা’ অর্থ দিয়াত পরিশোধকারীবৃন্দ। আকেলার মধ্যে পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা (تناصروتمانع)-র রীতি প্রচলিত রয়েছে। তারা পরস্পরের বিপদে সাহায্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এজন্য সহযোগিতা সূত্রে ইসলাম আকেলার উপর দিয়াত ধার্য করেছে। আর ভুলক্রমে হত্যাকারী তো আসলে একজন মাযুর। তার অনিচ্ছাকৃত হত্যায় আকেলারা যে এগিয়ে আসবে তা খুবই স্বাভাবিক। ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর মতে এক পেশাভুক্ত লোকেরা পরস্পরের আকেলা। হযরত ওমর (রাঃ) যখন ১৫ হিজরীতে বাইতুল মুক্বাদ্দাস জয়ের পর খেলাফতে বিভিন্ন দপ্তর প্রতিষ্ঠা করেন তখন প্রতিটি দপ্তরে কর্মচারীর তালিকা করেন। তাদের মধ্যে পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা (تناصروتمانع) বিদ্যমান থাকায় তিনি তাদের আকেলা ধার্য করেন এবং ভুলক্রমে হত্যা সংঘটিত হ’লে তাদের দিয়াত পরিশোধের ফরমান জারী করেন। তবে কেউ দপ্তরভুক্ত না থাকলে তার গোত্র তার আকেলা হবে। গোত্র না থাকলে আত্মীয়-স্বজন আকেলা হবে। তারা অক্ষম হ’লে মহল্লাবাসী আকেলা হবে।[11] আর যদি আকেলা না থাকে তাহ’লে দিয়াতের দায়িত্ব বাইতুল মালে বর্তাবে। যদি বাইতুল মাল না থাকে তা হ’লে হত্যাকারীর সম্পদ থেকে দিয়াত পরিশোধ করতে হবে।[12]
ইমাম মালেক, শাফেঈ ও আহমাদের মতে ব্যক্তির আকেলা তার কাবিলা বা গোত্র। সুতরাং তার দিয়াত তার গোত্রের উপর বর্তাবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যুগে এবং আবুবকর (রাঃ)-এর খিলাফতকালে ব্যক্তির গোত্রকে তার আকেলা গণ্য করা হ’ত। ওমর (রাঃ)-এর আমল এ ব্যবস্থাকে রহিত করতে পারেনি।[13] ইবনু আবী শায়বা ইমাম শাবীর বরাতে বর্ণনা করেছেন, নবী করীম (ছাঃ) কুরাইশের আকেলা কুরাইশ এবং আনছারের আকেলা আনছারদের নির্ধারণ করেন।جعل النبي صلي الله عليه و سلم عقل قريش علي قريش وعقل الانصل رعلي الانصار[14] সাইয়্যেদ সাবেক বলেছেন, ব্যক্তির যারা আছাবা তারাই তার আকেলা। তবে তারা হবে পিতার পক্ষীয় প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থমস্তিষ্কসম্পন্ন ও সচ্ছল পুরুষ আত্মীয়। অন্ধ, বৃদ্ধ ও চিররোগী ধনী হ’লে তারাও আকেলাভুক্ত হবে। মহিলা, দরিদ্র, অপ্রাপ্তবয়স্ক, বিকৃত মস্তিষ্ক হ’লে এবং হত্যাকারী ও তার আত্মীয়দের মধ্যে দ্বীনগত পার্থক্য থাকলে তারা আছাবাভুক্ত হবে না। কেননা আকেলার ভিত্তি পারস্পরিক আর্থিক সহযোগিতা। অথচ উল্লিখিত ব্যক্তিগণ সাহায্য করার যোগ্য নয়।
ইচ্ছাসদৃশ হত্যা ও ভুলক্রমে হত্যার দিয়াত আকেলার উপর বর্তানো ইসলামের সাধারণ নীতির খেলাফ। কেননা, ইসলামী বিধান অনুসারে মানুষ নিজের জন্য দায়ী, নিজের কার্যাবলীর হিসাব দিতে বাধ্য। অন্যের অপরাধের দায় তার উপর আরোপ করা যাবে না। আল্লাহ বলেছেন, وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَى ‘একের অপরাধের বোঝা অন্যে বহন করবে না’ (ফাতির ৩৫/১৮)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, আমার পরে তোমরা এমন পর্যায়ে যেও না যে, কাফের হয়ে তোমরা একে অপরের গর্দান কাটবে। আর কোন ব্যক্তিকে তার পিতার ও ভাইয়ের অপরাধে গ্রেপ্তার করা যাবে না।[15] তা সত্ত্বেও উক্ত প্রকারের হত্যার দিয়াতে আকেলাকে যুক্ত করা হয়েছে অপরাধী হন্তারকের প্রতি সাহায্যের হাত প্রসারিত করার জন্য। কারণ সে তো ইচ্ছে করে এ অপরাধ করেনি। অপরদিকে আকেলাকে দিয়াতের অংশ দিতে বাধ্য করায় তারাও হত্যার বিষয়ে হুঁশিয়ার থাকবে। ফলে হত্যাকান্ডের মাত্রা কমে আসবে।
কোন স্থানে কোন মুসলিমকে নিহত অবস্থায় পাওয়া গেলে এবং তার হত্যাকারীর সন্ধান পাওয়া না গেলে নিহতের ওয়ারিশগণ বিচারকের নিকট মামলা করতে পারে। তারা সুনির্দিষ্ট আলামত সাপেক্ষে হত্যাকান্ডের এলাকার লোকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারে। সেক্ষেত্রে বিচারক কাসামার ভিত্তিতে বিবাদী পক্ষের পঞ্চাশ জনের কসম করতে বলবেন। তারা হত্যা করেনি বলে কসম করবে। যদি তারা হত্যা করেনি মর্মে কসম করতে রাজী না হয় তাহ’লে তারাই হত্যাকারী বলে আদালত আশ্বস্ত হ’লে তাদের উপর দিয়াত ধার্য হবে। আর যদি বিবাদী পক্ষ কসম করে হত্যার কথা অস্বীকার করে তাহ’লে তার দিয়াত বাইতুল মাল থেকে পরিশোধের জন্য আদালত আদেশ দেবে।[16]
হত্যা ব্যতীত অন্য ক্ষেত্রে ক্বিছাছ :
হত্যার ক্ষেত্রে যেমন ক্বিছাছের বিধান রয়েছে তেমনি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষেত্রেও ক্বিছাছের বিধান রয়েছে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্বিছাছ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেছেন,وَكَتَبْنَا عَلَيْهِمْ فِيهَا أَنَّ النَّفْسَ بِالنَّفْسِ وَالْعَيْنَ بِالْعَيْنِ وَالْأَنْفَ بِالْأَنْفِ وَالْأُذُنَ بِالْأُذُنِ وَالسِّنَّ بِالسِّنِّ وَالْجُرُوحَ قِصَاصٌ فَمَنْ تَصَدَّقَ بِهِ فَهُوَ كَفَّارَةٌ لَهُ وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ- ‘আর আমরা তাদের উপর বিধিবদ্ধ করেছিলাম যে, প্রাণের বদলে প্রাণ, চোখের বদলে চোখ, নাকের বদলে নাক, কানের বদলে কান, দাঁতের বদলে দাঁত এবং যখম সমূহের বদলে যখম। অতঃপর যে ক্ষমা করে, সেটি তার জন্য কাফফারা হয়ে যায়। বস্ত্ততঃ যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী ফায়ছালা করে না, তারাই যালেম’ (মায়েদাহ ৫/৪৫)।
অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের উপর আঘাত দু’ভাবে হ’তে পারে। ইচ্ছাকৃত ও ভুলক্রমে। ইচ্ছাকৃত হত্যায় যেমন ক্বিছাছ রয়েছে তেমনি ইচ্ছাকৃত অঙ্গহানিতেও ক্বিছাছ রয়েছে। তবে তার জন্য বেশ কিছু শর্ত-শরায়েত রয়েছে। সেসব শর্তের ভিত্তিতে কোন অঙ্গহানিতে ক্বিছাছ গ্রহণ সম্ভব না হ’লে ইচ্ছাকৃত অঙ্গহানিতেও দিয়াত প্রযোজ্য হবে। কেননা ক্বিছাছ অর্থ সমপরিমাণ বদলা গ্রহণ। কিন্তু কোন কোন অঙ্গ এমন আছে যে, তার ক্বিছাছ নিতে গেলে বাড়াবাড়ি এমনকি মৃত্যুও ডেকে আনতে পারে। তাই ইচ্ছাকৃত অঙ্গহানিমাত্রই ক্বিছাছযোগ্য নয়। হাদীছ ও ফিক্বহের গ্রন্থগুলোতে এসব বিষয় সবিস্তারে বর্ণিত আছে। ভুলক্রমে অঙ্গহানিতে একইভাবে দিয়াত প্রযোজ্য। কোন অঙ্গের জন্য কী পরিমাণ দিয়াত দিতে হবে তার উল্লেখও হাদীছ ও ফিক্বাহর গ্রন্থগুলোতে সবিস্তারে রয়েছে।[17]
তাযীর : ক্বিছাছ ও হদ ব্যতীত অন্যান্য শাস্তিকে ইসলামের পরিভাষায় তাযীর বলে। তাযীর মৌখিক হোক, আর দৈহিক হোক কিংবা জেল-জরিমানা হোক দেশের শাসনকর্তা অপরাধের মাত্রা বুঝে ইনছাফ মোতাবেক তার মাত্রা নির্ধারণ করবেন। আদালত তদনুসারে তাযীর প্রয়োগ করবে।[18] শাসনকর্তা তার মজলিশে শূরা ও আহলুল হাল্লে ওয়াল আকদ-এর মাধ্যমেও তা নির্ধারণ করতে পারেন। বরং পরামর্শের ভিত্তিতে মজলিশে শূরা ও আহলুল হাল্লে ওয়াল আকদ (أهل الحل والعقد)-এর মাধ্যমে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে অপরাধের তাযীর নির্ধারণ করলে ভুল ও যুলুমের সম্ভাবনা কম হবে।
শেষ কথা : কোন সমাজ-দেশ-রাষ্ট্রই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও বিচার ব্যবস্থার বাইরে নয়। প্রতিটি রাষ্ট্রের জন্যই রয়েছে তাদের আইন ও বিচার ব্যবস্থা। দেশবাসী সে আইন মেনে চলে। আইন প্রয়োগ ও শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য প্রত্যেক দেশেরই থাকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আমাদের দেশের পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, আনসার, গ্রাম পুলিশ ইত্যাদি এ ধরনের বাহিনী। অবশ্য তাদের প্রত্যেকের কর্মপরিধি ভিন্ন ভিন্ন। মানুষের মধ্যে আইন ভঙ্গের একটা প্রবণতা আছে। আইন ভঙ্গের ফলে অনেক সময় অন্য মানুষ ক্ষতির সম্মুখীন হয়। সে বা তারা চায় সেই ক্ষতির প্রতিকার। রাষ্ট্র সে প্রতিকারে এগিয়ে আসে তার বিচার বিভাগ নিয়ে। সে বিচার করা হয় আদালত বা কোর্টের মাধ্যমে। যারা বিচার করেন তারা বিচারক, বিচারপতি, জজ, কাজী, মুনসেফ, ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে পরিচিত। তারা স্ব স্ব দেশের সংবিধান ও প্রচলিত আইনের ভিত্তিতে বিচার করেন এবং বিচারপ্রার্থীর ক্ষতির প্রতিকার করেন। মানব রচিত সেসব আইনে ইনছাফ থেকে যুলুমের পরিমাণ বেশী থাকে। অনেক ক্ষেত্রে অপরাধীর প্রতি অযাচিত সহানুভূতি দেখান হয় এবং নিরপরাধের উপর বাড়াবাড়ি রকমের পীড়ন করা হয়।
পক্ষান্তরে ইসলাম আল্লাহর দেওয়া হুকুম মোতাবেক মানব সমাজে আদল ও ইনছাফ প্রতিষ্ঠার আদেশ দিয়েছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ইসলামী দেশগুলোতো বটেই বরং সারা বিশ্বে ইসলামী আইনের ভিত্তিতে আদল-ইনছাফ কায়েম করা কুরআনের দাবী, সময়ের দাবী। অনেকে ইসলাম প্রদত্ত শাস্তি কঠিন বলে অভিযোগ করে থাকে। বাহ্যত তা কঠিন বলেই অপরাধী অপরাধ করতে শতবার ভাবে। ফলে সমাজে অপরাধের মাত্রা কম থাকে। নচেৎ ইসলাম মানুষের প্রতি নম্র আচরণ ও কোমল ব্যবহার করতে আদেশ দেয়; কর্কশ ও বাজে ব্যবহার করতে কঠিনভাবে নিষেধ করে। সমাজে অপরাধ যাতে কম হয়, মানুষ যাতে শিষ্ট আচরণ করে সেজন্য কুরআন ও হাদীছ তাদের উদাত্ত আহবান জানায়। কুরআন ও হাদীছের সেসব নির্দেশ মেনে চললে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা আপনা থেকেই বেশীর ভাগ প্রতিষ্ঠিত থাকবে। তা সত্ত্বেও কিছু মানুষ অপরাধপ্রবণ থাকবে। তারাও অপরাধের শাস্তির কথা ভেবে অপরাধ করা থেকে নিরস্ত থাকবে। কেউ অপরাধ করে বসলে তখন তার উপর ইসলামী আইন কার্যকর হ’লে সে দ্বিতীয় বার অপরাধ করতে শত বার চিন্তা করবে। ফলে ইসলামী আইনের কড়াকড়ি হেতু সমাজ যথেষ্ট অপরাধমুক্ত থাকবে ইনশাআল্লাহ। আর আইন ও বিচারের মূল লক্ষ্য তো অপরাধীদের শাস্তি প্রদান নয়, বরং সামাজিক শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বিধানই তার মূল লক্ষ্য। যে আইন ও বিচার সে লক্ষ্য অর্জনে বেশী অনুকূল নিঃসন্দেহে সে আইন হবে শ্রেষ্ঠ আইন।
[1]. ফিকহুস সুন্নাহ ২/৪৬৭।
[2]. ইবনু মাজাহ হা/২০৪৩।
[3]. ফিকহুস সুন্নাহ ২/৫০০-৫০১।
[4]. (المحامي الجنايء) العنوان: مقدار دية القتل شبه العمد في السعودية hd-criminal-law.com.sa.
[5]. ইসলাম সাওয়াল ও জাওয়াব, শায়খ মুহাম্মাদ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ। প্রশ্ন নং ৩০৯৩৩৮। শিরোনাম : মিকদারু দিয়াতিল কাতলিল খাতায়ি। عنوان: مقدار دية القتل الخطاء।
[6]. আবূদাঊদ হা/৪৫৪১।
[7]. আবূদাঊদ হা/৪৫৪২।
[8]. আবূদাঊদ হা/৪৫৪৩।
[9]. ফিকহুস সুন্নাহ ২/৫০০-৫০১।
[10]. নাসাঈ হা/৪৮১৮; আবূদাঊদ হা/৪৫৭৬।
[11]. তানযীমুল আশতাত ৪/২৯।
[12]. ফিকহুস সুন্নাহ ২/৫০৫।
[13]. ফিকহুস সুন্নাহ ২/৫০৩।
[14]. আদ্দিরায়া লিতাখরিজি আহাদিছিল হিদায়াহ। তানযীমুল আশতাত ৪/২৯।
[15]. নাসাঈ হা/৪১২৬।
[16]. আবূদাউদ হা/৪৫২৪; ফিকহুস সুন্নাহ ২/৫২৭।
[17]. ফিকহুস সুন্নাহ ২/৪৮৬-৫৩১।
[18]. ফিকহুস সুন্নাহ ২/৫৩১।