পর্ব ১। পর্ব ২ । পর্ব ৩ । শেষ পর্ব । 

স্ত্রী-সন্তান :

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী যৌবনের ঊষালগ্নে জুনাগড়ের আমেনা নাম্নী এক মহিলাকে প্রথম বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুতে তাঁর জীবনে গভীর অমানিশা নেমে এসেছিল। এরপর তিনি স্বীয় শিক্ষক আব্দুল ওয়াহ্হাব মুহাদ্দিছ দেহলভীর শ্যালিকা রাবে‘আকে বিয়ে করেন। বিয়ের কিছুদিন পর তার সাথে জুনাগড়ীর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। তারপর জুনাগড়ের হালীমা নাম্নী আরেক মহিলার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার গর্ভে কন্যা খাদীজা এবং পুত্র আহমাদ, হামিদ, সুলায়মান ও মুহাম্মাদ ইয়াকুব জন্মগ্রহণ করে। আহমাদের জন্মের সময় তিনি একটি সুন্দর কবিতা লিখেছিলেন। দুই স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে তিনি দিল্লীর আজমিরী গেটের সন্নিকটে একটি ভাড়া বাড়ীতে থাকতেন। কিছুদিন পর বাড়ির আসবাবপত্র, টাকা-পয়সা, স্বর্ণালংকার প্রভৃতি চুরি হয়ে যায়। এর ফলে তিনি একটি পাকা বাড়ী তৈরীর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এবং দারুল হাদীছ রহমানিয়া মাদরাসার পাশে তা নির্মাণ করেন। দোতলা বাড়ীর উপরতলায় তিনি স্বপরিবারে থাকতেন। নীচতলায় প্রেস ও লাইব্রেরী ছিল।[1]

মিয়াঁ নাযীর হুসাইন মুহাদ্দিছ দেহলভীর বাঙ্গালী ছাত্র মাওলানা আব্দুর রহীম মুহাম্মাদীর[2] কন্যা কুলছূমকে তিনি সর্বশেষে বিয়ে করেছিলেন। এ বিয়ের ক্ষেত্রে তাঁকে মাওলানা আব্দুল্লাহ নাদভী[3] উৎসাহিত করেছিলেন। তিনি জুনাগড়ীকে বলেছিলেন, ‘বাঙ্গালী মেয়েরা দারুণ স্বামীভক্ত হয়। স্বামীদেরকে তারা খুব ভালবাসে ও যত্ন করে’। তাঁর গর্ভে একমাত্র পুত্র সেলিম মায়মান এবং কন্যা বিলকিস ও সালমা মুরতায জন্মগ্রহণ করেছিলেন। জামে‘আ সালাফিইয়াহ, বেনারসের দ্বিতীয় শায়খুল হাদীছ মাওলানা শামসুল হক সালাফী (বিশিষ্ট মুহাক্কিক্ব উযাইর শামসের পিতা), মাওলানা আব্দুল্লাহ নাদভী ও মাওলানা জুনাগড়ী পরস্পর ভাইরা ভাই ছিলেন।[4] উপরোক্ত ৪টি বিয়েরই ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপট ছিল, যা এখানে বর্ণনা করা সম্ভব নয়।

মাওলানা জুনাগড়ীর সর্বমোট সন্তান সংখ্যা ১৭ জন। তন্মধ্যে ৯ জন ছেলে ও ৮ জন মেয়ে। ছেলেদের মধ্যে বর্তমানে মাওলানা সেলিম মায়মান জুনাগড়ী (৭৭) ও মেয়েদের মধ্যে বিলকীস বেগম (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ও প্রফেসর, তাফসীর ইবনে কাছীরের বঙ্গানুবাদক ড. মুহাম্মাদ মুজীবুর রহমান স্যারের স্ত্রী) জীবিত আছেন। পুত্রদের মধ্যে মাওলানা সেলিম মায়মান জুনাগড়ী ১৯৬৫ সালে দিল্লীর রিয়াযুল উলূম মাদরাসা থেকে ফারেগ হন। মাওলানা তাকরীয আহমাদ সাহসোয়ানী ও মাওলানা আব্দুস সালাম বাস্তাবী তাঁর অন্যতম শিক্ষক।[5]

অপরদিকে মাওলানা সুলায়মান জুনাগড়ী ১৯২৩ সালে দিল্লীতে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে তিনি মাদরাসা ইসলামিয়া, করাচী থেকে ফারেগ হন। মাওলানা আব্দুস সাত্তার সালাফী, মাওলানা আব্দুল গাফফার সালাফী, মাওলানা আব্দুল জববার সালাফী, মাওলানা মুহাম্মাদ ইউনুস দেহলভী তাঁর অন্যতম শিক্ষক। ফারেগ হওয়ার পর তাঁকে জামা‘আতে গোরাবায়ে আহলেহাদীছ, করাচীর দাওয়াহ বিভাগের প্রধান নিযুক্ত করা হয়। তিনি জামে মসজিদ আওরঙ্গী টাউন, করাচীতে দরস ও জুম‘আর খুৎবা দিতেন। তিনি ভারত, সঊদী আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে দাওয়াতী সফর করেছেন। ১৯৯৭ সালে তিনি করাচীতে মৃত্যুবরণ করেন।[6]

আহলেহাদীছ আন্দোলনে অবদান :

মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী আহলেহাদীছ আন্দোলনের প্রচার-প্রসারে ও আহলেহাদীছ জামা‘আতের উন্নতি-অগ্রগতি সাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। দাওয়াত ও তাবলীগের জন্য তিনি ভারতের বিভিন্ন শহরে-নগরে গিয়েছেন। ১৩৫২ হিঃ/১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে মাওলানা আব্দুল মজীদ খাদেম সোহদারাভী (১৯০১-১৯৫৯) সোহদারায় তিনদিন ব্যাপী আহলেহাদীছ কনফারেন্সের আয়োজন করেন। উক্ত কনফারেন্সে মাওলানা জুনাগড়ী অংশগ্রহণ করে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য পেশ করেন। তাছাড়া শায়খুল ইসলাম মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী, মাওলানা হাফেয মুহাম্মাদ ইবরাহীম মীর শিয়ালকোটী, মাওলানা আবুল কাসেম সায়েফ বেনারসী, মাওলানা মুহাম্মাদ ইসমাঈল সালাফী, মাওলানা নূর হুসাইন ঘরজাখী, মাওলানা আহমাদুদ্দীন গাখড়ুবী, মাওলানা মীর মুহাম্মাদ ভানবেটরীও উক্ত কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করেছিলেন।[7] ১১-১৩ই রবীউল আউয়াল ১৩৫৬ হিঃ মোতাবেক ২২-২৪শে মে ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে শুকরাওয়ায় অনুষ্ঠিত ‘অল ইন্ডিয়া আহলেহাদীছ কনফারেন্স’-এর বার্ষিক জালসায় জুনাগড়ী সভাপতিত্ব করেন।[8] এটা তাঁর জন্য অনেক বড় সম্মানের বিষয় ছিল। কারণ সে সময়ের খ্যাতিমান আলেম-ওলামা ও সম্মানিত ব্যক্তিদেরকে উক্ত কনফারেন্সের বার্ষিক জালসার সভাপতি মনোনীত করা হত। উল্লেখ্য যে, অবিভক্ত ভারতের বিভিন্ন স্থানে সর্বভারতীয় আহলেহাদীছ সংগঠন ‘অল ইন্ডিয়া আহলেহাদীছ কনফারেন্স’-এর সর্বমোট ২৪টি বার্ষিক জালসা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সর্বশেষ জালসাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ৭-৯ই মার্চ ১৯৪৪ সালে দিল্লীতে। এতে সভাপতিত্ব করেন মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী।[9]

আহলেহাদীছ মাসলাকের প্রচার-প্রসারের জন্য যেমন তিনি ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে চষে বেড়িয়েছেন, তেমনি তার সত্যতা প্রমাণের জন্য বিভিন্ন স্থানে বাহাছ-মুনাযারাতেও অংশগ্রহণ করেছেন। এসব মুনাযারায় তিনি কুরআন ও হাদীছের অকাট্য দলীল এবং বলিষ্ঠ যুক্তির মাধ্যমে বিরোধীদেরকে নাকানি-চুবানি খাইয়েছেন। তাছাড়া পাক্ষিক ‘আখবারে মুহাম্মাদী’ এবং তাঁর রচিত বই-পুস্তকের মাধ্যমেও তিনি আহলেহাদীছ আন্দোলনের প্রচার-প্রসারে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছেন।

সঊদী সরকারের শিরক-বিদ‘আত বিরোধী ভূমিকা সমর্থন :

সঊদী বাদশাহ আব্দুল আযীয (রহঃ) সঊদী আরবে প্রশাসনিক সংস্কার সাধন ও শিরক-বিদ‘আত উৎখাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী তাঁর এসব কর্মকান্ডকে পূর্ণভাবে সমর্থন করে বইপত্র ও প্রবন্ধ লিখেন। এক্ষেত্রে ভারতবর্ষে মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী ছাড়া অন্য কেউ তাঁর সমকক্ষ ছিল না। ১৯২৪ সালে সঊদী সরকার সেদেশের মাযারগুলি ভেঙ্গে ফেললে[10] ভারতের মাযারপূজারীরা যখন তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় তোলে এবং নানামুখী মিথ্যা প্রপাগান্ডা চালায়, তখন জুনাগড়ী ১৩৪৪ হিজরীতে ‘তাওহীদে মুহাম্মাদী’ শীর্ষক গ্রন্থ লিখে তাঁর জবাব দেন। এছাড়া তিনি আনছারে মুহাম্মাদী, কাবীলায়ে মুহাম্মাদী, মামলাকাতে মুহাম্মাদী, হজ্জে মুহাম্মাদী, বারাআতে মুহাম্মাদী প্রভৃতি গ্রন্থ লিখে বিপ্লবী সমাজ সংস্কারক মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব (রহঃ)-এর সংস্কার আন্দোলন ও সঊদী সরকারকে  সমর্থন জানান।[11]

‘আখবারে মুহাম্মাদী’ পত্রিকায় তিনি এক্ষেত্রে যেসব প্রবন্ধ লিখেন ও প্রকাশ করেন সেগুলি নিম্নরূপ :

১. আলী বেরাদারান এন্ড কোম্পানী আওর হজ্জ (আলী ভ্রাতৃদ্বয় গং ও হজ্জ) : সঊদী বাদশাহ আব্দুল আযীয যখন হিজাযে সরকার প্রতিষ্ঠা করেন তখন ভারতে তাঁর বিরুদ্ধে এ মর্মে আন্দোলন জোরদার  করা হয় যে, যতদিন হিজাযে তাঁর শাসন প্রতিষ্ঠিত থাকবে ততদিন মুসলমানেরা হজ্জ করার জন্য মক্কায় যাবে না। এ আন্দোলনে ‘আঞ্জুমানে খুদ্দামুল হারামাইন’-এর সদস্যরা এবং আলী ভ্রাতৃদ্বয় (মুহাম্মাদ আলী ও শওকত আলী) অংশগ্রহণ করেন। এ আন্দোলনের নিন্দা জ্ঞাপন এবং বাদশাহ আব্দুল আযীয সরকারের সমর্থনে উক্ত শিরোনামে জুনাগড়ী আখবারে মুহাম্মাদী পত্রিকায় একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেন। যেটি দুই কিস্তিতে প্রকাশিত হয়।[12]  পরবর্তীতে তা ‘হজ্জে মুহাম্মাদী’ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এতে কুরআন ও হাদীছের আলোকে হজ্জের ফরযিয়াত, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ্জ সম্পাদন না কারীদের ব্যাপারে হাদীছের ধমকি এবং হজ্জে যেতে নিষেধকারীদের তীব্র নিন্দা করা হয়েছে। অতঃপর শেষের দিকে বাদশাহ আব্দুল আযীয ও নাজদবাসীদের উপর আরোপিত কতিপয় মিথ্যা অপবাদ উল্লেখ করতঃ সেগুলির জবাব দেয়া হয়েছে।

২. আযমাতুস সুলতান, জালালাতুল মালেক, শাহে নাজদ ওয়া হিজায, খাদেমুল হারামাইন, ইমাম ইবনে সঊদ-আইয়াদাহুল্লাহু-আওর মুফসিদ ফিদ-দ্বীন আলী বেরাদারান এন্ড কোম্পানী : উক্ত শিরোনামে লিখিত প্রবন্ধে তিনি হজ্জ মুলতবি আন্দোলনের নিন্দা, বাদশাহ আব্দুল আযীয (রহঃ)-এর বিরুদ্ধে উত্থাপিত কিছু অভিযোগের জবাব, তাঁর সুন্দর রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি বিষয় আলোচনা করা হয়েছে (দ্রঃ আখবারে মুহাম্মাদী, ১৫ই নভেম্বর ১৯২৬)

৩. হুরমাতুল বিনা ‘আলা কুবূরিল মাশায়েখ ওয়াল ওলামা (ওলামা-মাশায়েখের কবর পাকা করার নিষিদ্ধতা) : এ শিরোনামে মাওলানা আহমাদুদ্দীন একটি বিস্তারিত ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখেন। যেটি জুনাগড়ী আখবারে মুহাম্মাদী পত্রিকায় পাঁচ কিস্তিতে (১লা নভেম্বর ১৯২৭ থেকে ১লা জানুয়ারী ১৯২৮) প্রকাশ করেন। উক্ত প্রবন্ধটি মূলত মৌলভী আবু ইউসুফ মুহাম্মাদ শরীফ নকশাবন্দী শিয়ালকোটী লিখিত ‘ইবাহাতুস সালাফ আল-বিনা ‘আলা কুবূরিল মাশায়েখ ওয়াল ওলামা’ (পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩২) পুস্তিকার জবাব।

৪. নাজদ সে কারনুস শয়তান কী তা‘য়ীন :  মাওলানা আব্দুল হাকীম নাছিরাবাদী লিখিত উক্ত প্রবন্ধটি  আখবারে মুহাম্মাদী পত্রিকায় ছয় কিস্তিতে (১লা নভেম্বর ১৯২৭ থেকে ১লা ফেব্রুয়ারী ১৯২৮) প্রকাশিত হয়। এতে তিনি হাদীছ, আছার, হাদীছ ব্যাখ্যাকারদের মতামত, ঘটনাবলী ও বাস্তবতার আলোকে হাদীছে[13] বর্ণিত নাজদ দ্বারা যে ইরাকের নাজদ উদ্দেশ্য তা বর্ণনা করেছেন।

৫. হিজাযের অবস্থা সম্পর্কে ‘আখবারে মুহাম্মাদী’র বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ : বাদশাহ আব্দুল আযীযের সময়ে সঊদী আরবে কৃত সংস্কারসমূহ, শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন, হাজীদের আরাম-আয়েশ এবং নাজদ ও হিজাযের সকল এলাকায় শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য গৃহীত পদক্ষেপ সমূহ প্রভৃতি বিষয়ে মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী ‘হালাতে হিজায নম্বর’ শিরোনামে আখবারে মুহাম্মাদী-এর বিশেষ সংখ্যা (১৫ই আগস্ট ১৯২৬) বের করেন। যাতে ভারতের মুসলমানেরা বাদশাহ আব্দুল আযীয ও তাঁর সরকারের কার্যক্রম সম্পর্কে অবগত হতে পারে এবং বিরোধীদের মিথ্যা প্রপাগান্ডায় বিভ্রান্ত না হয়।

৬. খাজা হাসান নিযামী আওর সুলতান ইবনে সঊদ (খাজা হাসান নিযামী ও বাদশাহ ইবনে সঊদ) : ১৯৩৩ সালের শেষের দিকে খাজা হাসান নিযামী তার পত্রিকায় প্রকাশ করেন যে, সুলতান ইবনে সঊদ আহলে বায়তের কবর সমূহের উপর লাঙল চালিয়েছেন, ফাতেমা (রাঃ)-এর কবরকে অসম্মান করেছেন এবং জনৈক আলেমকে হত্যা করেছেন। অন্যদিকে খাজার মুরীদ আব্দুস সাত্তার ‘আকাইদে নাজদিয়াহ’ শিরোনামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। এতে তিনি নাজদের তাওহীদবাদী মুসলমানগণ এবং ভারতের আহলেহাদীছ জামা‘আতের উপর নানাবিধ মিথ্যা অপবাদ আরোপ করেন এবং সেগুলিকে ১৬টি আক্বীদা আকারে বর্ণনা করেন। খাজা হাসান নিযামী তা যাচাই-বাছাই না করেই তার পত্রিকার ৮ই অক্টোবর ১৯৩৩ সংখ্যায় প্রকাশ করেন। এ প্রেক্ষিতে মাওলানা মুহাম্মাদ ইউনুস দেহলভী (শিক্ষক, মাদরাসা মিয়াঁ নাযীর হুসাইন মুহাদ্দিছ দেহলভী, দিল্লী) খাজা হাসান নিযামী ও তার মুরীদ আব্দুস সাত্তারের লেখনীর জবাবে উক্ত প্রবন্ধ লিখে তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করেন (দ্রঃ আখবারে মুহাম্মাদী, ১৫ই ডিসেম্বর ১৯৩৩)

৭. হিজায মেঁ হুদূদে শারঈ কা ইজরা (হিজাযে শারঈ দন্ডবিধি জারি) : ১৩৫২ হিজরীতে হজ্জের সময় এক ব্যক্তি জনৈক হাজীর মাল চুরি করলে সঊদী সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী জনসম্মুখে তার হাত কেটে একটি লম্বা বাঁশে লটকিয়ে দেয়া হয়। যাতে লোকজন এ থেকে শিক্ষা অর্জন করে। মাওলানা জুনাগড়ী উক্ত শিরোনামে আখবারে মুহাম্মাদী পত্রিকায় এ খবর প্রকাশ করেন এবং ইসলামী দন্ডবিধি চালু করার জন্য বাদশাহ আব্দুল আযীয (রহঃ)-এর রাজত্বে বরকত ও সমৃদ্ধি দানের জন্য দো‘আ করেন (দ্রঃ আখবারে মুহাম্মাদী, ১৫ই মে ১৯৩৪)

৮. জালালাতুল মালেক ইবনে সঊদ পর বুহতান (মহামান্য বাদশাহ ইবনে সঊদ-এর উপর মিথ্যা অপবাদ) : ১৯৩৮ সালে মিসরে হজ্জ সম্পর্কে একটি সিনেমা তৈরী করা হয়। এর ফলে সঊদী বিরোধীরা জনগণের মাঝে এ মিথ্যা প্রচারণা চালায় যে, বাদশাহ আব্দুল আযীযের সম্মতি ও অনুমতি সাপেক্ষেই এ সিনেমা তৈরী করা হয়েছে। আখবারে মুহাম্মাদী পত্রিকায় এ অভিযোগ খন্ডন করে মূল ঘটনা বর্ণনা করা হয়। তাতে বলা হয়, মিসরের কিছু সাংবাদিক বিভিন্ন সময় হজ্জে গিয়ে তাদের পত্রিকার জন্য মক্কার বিভিন্ন স্থানের বিভিন্ন দৃশ্যের ছবি তোলে। তারপর মিসরের এক সিনেমা কোম্পানী সেই ছবিগুলি নিয়ে স্টুডিওতে সিনেমা তৈরী করে। বাদশাহ ঘুণাক্ষরেও এ ব্যাপারে অবগত ছিলেন না। এর পূর্বেও একজন মিসরীয় হজ্জ নিয়ে সিনেমা তৈরী করতে চাইলে বাদশাহ আব্দুল আযীয তাকে অনুমতি দেননি (দ্রঃ আখবারে মুহাম্মাদী, ১লা মার্চ ১৯৩৯)

তাছাড়া নিম্নোক্ত প্রবন্ধগুলোও আখবারে মুহাম্মাদী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

৯. সুলতান ইবনে সঊদ আওর উনকা আহদে হুকূমত (১লা জুন ১৯২৬)।

১০. আযমাতুস সুলতান জালালাতুল মালেক ইবনে সঊদ (১লা আগস্ট ১৯২৬)।

১১. সুলতান ইবনে সঊদ কী এক তকরীর কে চান্দে ইকতেবাসাত (১লা সেপ্টেম্বর ১৯২৬)।

১২. আত-তাসলীম মা‘আল ইকরাম- আরবী কবিতা (১৫ই সেপ্টেম্বর ১৯২৬)।

১৩. বারাকাতে ইবনে সঊদ (১৫ই ডিসেম্বর ১৯২৬ ও ১লা জানুয়ারী ১৯২৭)।

১৪. ফাযায়েলে ইবনে সঊদ আহাদীছ কী রোশনী মেঁ (১৫ই জানুয়ারী ১৯২৭)।

১৫. জমঈয়তে আহলেহাদীছ রেঙ্গুন আওর সুলতান ইবনে সঊদ (১৫ই ফেব্রুয়ারী ১৯২৭)।

১৬. সুলতান ইবনে সঊদ পর আখবারে ‘আদেল’ দিহলী কি ইফতেরা পরদাযিয়া (১৫ই মে ১৯৩৩)।

১৭. সুলতান ইবনে সঊদ পর হোনেওয়ালে দো ই‘তেরাযূঁ কা জওয়াব (১লা জুলাই ১৯৩৫)।

১৮. ইমাম ইবনে সঊদ কী হক্বপসন্দী (১লা নভেম্বর ১৯৩৫)।

১৯. সুলতান ইবনে  সঊদ কা মাকতূব ‘আখবারে মুহাম্মাদী’ কে নাম (১৫ই জুন ১৯৩৭)।

২০. ফাযায়েলে বনী তামীম আহাদীছ কী রোশনী মেঁ (১৫ই জুলাই ১৯৩৮)।[14]

উল্লেখ্য যে, বাদশাহ আব্দুল আযীযের হিজায বিজয় উপলক্ষে ১লা অক্টোবর ১৯২৯ সংখ্যার ‘আখবারে মুহাম্মাদী’ পত্রিকায় (৭ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা) বাদশাহ্র প্রশংসায় আহলেহাদীছ কবি ই‘জায আহমাদ সাহসোয়ানী রচিত একটি দীর্ঘ আরবী কবিতা প্রকাশিত হয়।[15]

মৃত্যু :

১৯৪১ সালের শুরুতে মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ীর পিতা মুহাম্মাদ ইবরাহীম এবং বোন আয়েশা কিছুদিনের ব্যবধানে জুনাগড়ে মৃত্যুবরণ করেন। পিতা ও বোনের মৃত্যুতে তিনি মুষড়ে পড়েন। তাদের মৃত্যুর পর দিল্লীতে মোটেই তাঁর মন টিকছিল না। এজন্য পাক্ষিক ‘আখবারে মুহাম্মাদী’ পত্রিকার সকল দায়-দায়িত্ব প্রিয় ছাত্র মাওলানা তাকরীয আহমাদ সাহসোয়ানীকে দিয়ে তিনি মাতৃভূমি জুনাগড়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। সেখানে পৌঁছে তিনি তাদের কবর যিয়ারত করেন এবং তাদের রূহের মাগফিরাতের জন্য দো‘আ ও দান-ছাদাক্বাহ করেন। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত একটি বাড়ির অসম্পূর্ণ কাজ সমাপ্ত করার জন্য তিনি প্রায় দুই মাস জুনাগড়ে অবস্থান করেন। বাড়ীটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হলে তিনি আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও গরীব-দুঃখীদের দাওয়াত দেন। এ উপলক্ষে তিনি তার তিন মেয়ে মরিয়ম, ফাতেমা ও যয়নব এবং তাদের স্বামী যথাক্রমে আব্দুল কাদীর মায়মান, আব্দুল কাদীর হালাঈ ও আব্দুল হান্নান রূয়ীওয়ালাকেও ডেকে পাঠান।

সেদিন মাওলানা জুনাগড়ী ঘরে প্রবেশ করে মেয়েদেরকে সম্বোধন করে বলেন, ‘তোমরা কি কি রান্না করেছ? আজকে আমার খুব ক্ষুধা লেগেছে’। মেয়েরা জবাব দেয়, আজ আমরা নানা পদের খাবার রান্না করেছি। আপনার মন যা চায় তা গ্রহণ করুন!

ইত্যবসরে এশার আযানের সময় হয়ে যায়। তিনি তার তিন জামাই এবং ভগ্নিপতি উছমান গান্ধীকে বলেন, ‘তোমরা দ্রুত খাওয়া শেষ করে মসজিদে চলে এসো এবং আযানের পর আমার জন্য অপেক্ষা করো। আমি এখুনি ওযূ করে আসছি। আমি এখনই এই কাপড় বদলাব। আমাকে সাদা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কাপড় দাও’। একথা বলার পরপরই তিনি প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হন এবং দাঁড়ানোর শক্তি হারিয়ে ফেলেন। কন্যাদেরকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, দ্রুত জায়নামায বিছাও। এভাবে দ্রুত এশার ছালাত আদায়ের পর তিনি ক্ষীণকণ্ঠে বলেন, তোমরা আমাকে কালেমার তালকীন দাও। আমার বিদায়ের সময় ঘনিয়ে এসেছে। আমার উপর তোমাদের কোন অভিযোগ থাকলে আমাকে খুশিমনে ক্ষমা করে দিও এবং টেলিফোন করে দিল্লীতে বসবাসরত পরিবারের সবাইকে মাফ করতে বলো। যদি কারো কাছে আমার ঋণ থাকে তাহলে দ্রুত বল। আমি এখনি তা পরিশোধের ব্যবস্থা করছি। আমার মনে হচ্ছে আমি বেশীক্ষণ বাঁচব না। নেইয়ী সড়ক, ঘণ্টাঘরের বাশিন্দা হাজী ছালেহ বিন হাজী আলী জান-এর নিকটে আমার স্ত্রী ও সন্তানদের জন্য ১৬/১৭ হাযার টাকা আমানত রাখা আছে। পাক্ষিক ‘আখবারে মুহাম্মাদী’-এর সব দায়-দায়িত্ব আমার প্রিয় ছাত্র মাওলানা সাইয়িদ তাকরীয আহমাদ সামলে নিবেন। আমি আমার মৃত পিতার কবর যিয়ারত করার জন্য এসেছিলাম। এখন আমাকেও ঐ কবরের পাশেই চিরনিদ্রায় শায়িত থাকতে হবে। তোমরা আমার লাশ দাফন করতে বিলম্ব করবে না। দ্রুত দিল্লী শহরে মিয়াঁ ছাহেব (আতাউর রহমান), হাজী আব্দুর রহমান এবং আমার পরিবার-পরিজনকে যরূরী টেলিগ্রাম করে দিবে।[16]

এসব অছিয়তের পর তাঁর হার্ট এ্যাটাক হয়। ১৩৬০ হিজরীর ১লা ছফর মোতাবেক ২৮শে ফেব্রুয়ারী ১৯৪১ সালে শুক্রবার রাত ১১-টার সময় শিরক ও বিদ‘আতের বিরুদ্ধে আমৃত্যু লড়াকু সৈনিক ও আহলেহাদীছ মাসলাকের এই অতন্দ্র প্রহরী নশ্বর পৃথিবীর কুহকী মায়াজাল ছিন্ন করে না ফেরার দেশে চলে যান। জুনাগড়ে তাঁকে দাফন করা হয়।[17]

মৃত্যুর পূর্বের জুম‘আয় জুনাগড়ের জামে মসজিদে তিনি ‘মৃত্যু ও ইয়াতীম’ সম্পর্কে বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আজ আমি সুস্থ হালতে আপনাদের সামনে জীবিত আছি। হয়ত আগামী জুম‘আয় নাও থাকতে পারি। সাধারণভাবে গোটা পৃথিবীতে এবং বিশেষভাবে মুসলিম সমাজে ইয়াতীম ও বিধবাদের সংখ্যা অনেক বেশী। আল্লাহ্র ওয়াস্তে আপনারা তাদের প্রতি খেয়াল রাখবেন। তাদের রোনাজারিতে আসমানও বিদীর্ণ হয়ে যায়। আগামী শুক্রবারে আমার স্ত্রীরা বিধবা ও সন্তানরা ইয়াতীম হতে পারে’। পরের শুক্রবারে তাঁর আশংকা সত্যে পরিণত হয়েছিল। সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে তিনি চলে গিয়েছিলেন অনন্তলোকে।[18]

তাঁর মৃত্যুতে সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে। বহু কবি-সাহিত্যিক উর্দূ ও আরবীতে শোকগাঁথা ও প্রবন্ধ লিখেন। তন্মধ্যে মাওলানা খলীল বিন মুহাম্মাদ ইয়ামানী লিখিত একটি দীর্ঘ আরবী কবিতা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। উক্ত কবিতায় তিনি বলেন,

خُطَبٌ قَدْ مَحَتْ عَنِ الْقَلْبِ رَيْنًا + وَبِهَا قَدْ تَنَوَّرَ الْأَبْصَارُ

تَرْجَمَ الضَّخِيْمَ مِنْ تَآلِيْفِ سَلَفٍ + بِتَآلِيْفِهِ اهْتَدَى الْجَبَّارُ

لَكَ مِنْ رَبِّنَا رِضًا وَجَنَّا + تٍ جَرَتْ تَحْتَ غُرَفِهَا الْأَنْهَارُ

‘তাঁর (জুনাগড়ী) বক্তব্যগুলি মনের কালিমা দূর করেছে এবং সেগুলির মাধ্যমে চক্ষুগুলি আলোকিত হয়েছে। সালাফে ছালেহীনের বড় বড় কিতাব তিনি অনুবাদ করেছেন। আর তাঁর গ্রন্থাবলীর মাধ্যমে বহু দাম্ভিক ব্যক্তিও হেদায়াত লাভ করেছে। হে জুনাগড়ী! আপনি রবের সন্তুষ্টি ও জান্নাত লাভ করুন! যার কক্ষসমূহের নীচ দিয়ে নহরসমূহ প্রবাহিত হয়’।[19]

রচনাবলী :

মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী শিক্ষকতা, বক্তব্য প্রদান ও পত্রিকা সম্পাদনার পাশাপাশি গ্রন্থ রচনা ও অনুবাদেও দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর রচিত ও অনূদিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় দেড়শ। তাঁর জীবদ্দশাতেই এসব গ্রন্থের অন্ততঃ দশটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর মৃত্যুর পৌনে এক শতাব্দী অতিবাহিত হলেও এসব গ্রন্থের গ্রহণযোগ্যতা ও আবেদন কমেনি। তাঁর মৃত্যুর পর পাক-ভারত ও বাংলাদেশে তাঁর গ্রন্থসমূহের একাধিক সংস্করণ প্রকাশিত ও কয়েকটি গ্রন্থ অনূদিত হয়েছে। আলেম-ওলামা ও সাধারণ মানুষ সবার কাছেই এগুলি সমানভাবে জনপ্রিয়।[20]

মারকাযী জমঈয়তে আহলেহাদীছ, হিন্দ-এর সাবেক আমীর এবং ছহীহ বুখারীর উর্দূ অনুবাদক ও ভাষ্যকার মাওলানা মুহাম্মাদ দাঊদ রায লিখেছেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে কলমী জিহাদের ময়দানে এমন উৎসাহ-উদ্দীপনা দান করেছিলেন যে, কুরআন মাজীদ ও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সুন্নাহ্র প্রচারের জন্য তিনি বহু গ্রন্থ লিখেছেন এবং প্রত্যেকটি গ্রন্থকে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর পবিত্র নামের দিকে সম্পর্কিত করেছেন। যেমন- ঈমানে মুহাম্মাদী, তাওহীদে মুহাম্মাদী, আক্বীদায়ে মুহাম্মাদী, সীরাতে মুহাম্মাদী, ছালাতে মুহাম্মাদী, ছিয়ামে মুহাম্মাদী, যাকাতে মুহাম্মাদী, হজ্জে মুহাম্মাদী প্রভৃতি। যদিও তাঁর সব গ্রন্থই অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য। কিন্তু ‘তাফসীরে মুহাম্মাদী’ নামে তাফসীর ইবনে কাছীরের উর্দূ অনুবাদ তাঁর এক অমূল্য দ্বীনী খিদমত। যার কারণে উর্দূভাষী মুসলমানদের তাফসীর ইবনে কাছীরের মতো ঈমান জাগানিয়া গ্রন্থের দ্বারা উপকৃত হওয়ার সুযোগ মিলেছে। অনুরূপভাবে আল্লামা ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ)-এর বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ ‘ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন’-কে ‘দ্বীনে মুহাম্মাদী’ নামে উর্দূতে অনুবাদ করে মুসলিম যুবকদের জন্য তিনি ধর্মীয় চিন্তা ও গবেষণার দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছেন’।[21]

মারকাযী জমঈয়তে আহলেহাদীছ, হিন্দ-এর সাবেক আমীর মাওলানা মুখতার আহমাদ নাদভী বলেছেন, ‘তিনি শিরক ও বিদ‘আতের মূলোৎপাটনের জন্য তাঁর কলম দ্বারা তরবারির কাজ নিয়েছেন এবং ভারতের দূর-দূরান্তে বিস্তৃত শিরকী রসম-রেওয়াজ ও তাক্বলীদী জড়তাকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছেন। হকের এই বীর সৈনিক তাওহীদ ও সুন্নাতের সব ময়দান থেকে দ্বীনে হকের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত হয়েছেন এবং শিরক ও বিদ‘আতের সকল দুর্গের উপর কথা ও কলমের গোলা বর্ষণ করেছেন। তাঁর সত্যসেবী কলম থেকে যেসব গুরুত্বপূর্ণ ও গবেষণালব্ধ পুস্তিকা ও উন্নত মানের গ্রন্থাবলী লিখিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলি উর্দূ ভাষায় দ্বীনী জ্ঞানের অত্যন্ত গর্বের ধন। যার ইহসান উর্দূ জগত কখনো অস্বীকার করতে পারবে না’।[22]

(ক্রমশঃ)


[1]. মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী : হায়াত ওয়া খিদমাত, পৃঃ ৩৩-৩৪।

[2]. মাওলানা আব্দুর রহীম মুহাম্মাদী পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম যেলার আমভূয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মিয়াঁ নাযীর হুসাইন মুহাদ্দিছ দেহলভীর নিকট তিনি হাদীছের গ্রন্থ সমূহ অধ্যয়ন করেন। তারপর পূর্ব পাঞ্জাবের প্রসিদ্ধ মাদরাসা ‘মারকাযুল ইসলাম’ (লাখোকে, যেলা ফিরোযপুর) থেকে ফারেগ হন। বিভিন্ন মাদরাসায় শিক্ষকতা করার পর তিনি নিজেই একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। আজীবন তিনি এর মুহতামিম ছিলেন। দরস-তাদরীস ও ফৎওয়া প্রদানে তাঁর সারাজীবন কেটেছে। তিনি বাংলা ভাষায় বেশকিছু গ্রন্থও রচনা করেন। জামা‘আতে মুজাহিদীন-এর সাথে তাঁর গভীর সম্পর্ক ছিল। ১৯৬০ সালে তিনি প্রায় ১০০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন (ড. মাহমূদুল হাসান আরিফ ও মেজর (অবঃ) যুবায়ের কাইয়ূম সংকলিত, মাক্বালাতে প্রফেসর আব্দুল কাইয়ূম (লাহোর : আল-মাকতাবাতুস সালাফিইয়াহ, ১৯৯৭), ২য় খন্ড, পৃঃ ২৬৫-২৬৬)

[3]. উপমহাদেশের বিশিষ্ট আরবী সাহিত্যিক মাওলানা আব্দুল্লাহ নাদভী বীরভূম যেলার নূরপুর গ্রামে ১৯০০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষক মাওলানা আব্দুল মান্নান বর্ধমানীর উৎসাহে তিনি তরুণ বয়সেই আরবী কাব্য রচনা শুরু করেন। তিনি দিল্লীর বিখ্যাত রিয়াযুল উলূম ও হাজী আলী জান মাদরাসায় মাওলানা বর্ধমানী, মাওলানা আহমাদুল্লাহ এলাহাবাদী ও মাওলানা আব্দুর রহমান পাঞ্জাবীর নিকট বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষালাভ করেন। শেষোক্ত মাদরাসা থেকে ফারেগ হওয়ার পর তিনি নাদওয়াতুল ওলামা লাক্ষ্মৌয় ভর্তি হন এবং আরবী ভাষা ও সাহিত্যে উচ্চতর ডিগ্রী লাভ করেন। নাদওয়ায় অধ্যয়নের সময় ছাত্র প্রতিনিধিরূপে তিনি মাদ্রাজের এক কনফারেন্সে আরবীতে বক্তৃতা দিয়ে সবাইকে চমকে দেন। নাদওয়ার বার্ষিক পরীক্ষায় তিনি প্রথম হন। তিনি কিছুদিন সেখানে শিক্ষকতাও করেন। এরপর বীরভূমের ইরফানুল উলূম, কলকাতার মিছরীগঞ্জ, মুর্শিদাবাদের ভাবতা প্রভৃতি মাদরাসায় শিক্ষকতা করার পর ১৯৩৪ সালে তিনি দিল্লীর রহমানিয়া মাদরাসায় আরবী সাহিত্যের শিক্ষক নিযুক্ত হন (মাক্বালাতে প্রফেসর আব্দুল কাইয়ূম ২/২৬৭; ড. মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ, বাংলাদেশের খ্যাতনামা আরবীবিদ (ঢাকা : ইফাবা, ১৯৮৬), পৃঃ ৭৬-৭৭)। দারুল হাদীছ রহমানিয়ার খ্যাতিমান ছাত্র ও পরবর্তীতে শিক্ষক এবং মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রফেসর মাওলানা আব্দুল গাফফার হাসান রহমানী বলেন, ‘আরবী সাহিত্যের প্রতি মাওলানা আব্দুল্লাহ নাদভীর দারুণ অনুরাগ ছিল। আমি তাঁর কাছে দীওয়ানুল হামাসাহ পড়েছি। তিনি খুব সুন্দর করে পড়াতেন। কখনো আরবীতে আবার কখনো উর্দূতে কবিতাগুলির ব্যাখ্যা করতেন। তাঁর কাব্যচর্চার অনুরাগ ও যোগ্যতাও ছিল। তিনি কখনো কখনো সুর করে স্বরচিত কবিতা সমূহ শুনাতেন। মাদরাসার মুহতামিম শায়খ আতাউর রহমানও তাঁকে অত্যন্ত সম্মান করতেন এবং তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করতেন। আরবী সাহিত্যের অধিকাংশ বই তাঁর পড়ানোর দায়িত্ব ছিল’ (আস‘আদ আ‘যমী, তারীখ ওয়া তা‘আরুফ মাদরাসা দারুল হাদীছ রহমানিয়া দিল্লী (মৌনাথভঞ্জন : মাকতাবাতুল ফাহীম, ফেব্রুয়ারী ২০১৩), পৃঃ ২২৩)। ১৯৩৯ সালে তিনি কলিকাতা আলিয়া মাদরাসার শিক্ষক নিযুক্ত হন। দেশ ভাগের পর ১৯৪৭ সালে ঢাকা আলিয়ায় যোগদান করেন। ১৯৫৭ সালে সিলেট আলিয়া মাদরাসায় বদলী হন এবং সেখান থেকেই ১৯৬০ সালে অবসর গ্রহণ করেন। এরপর তিনি মাদরাসাতুল হাদীস (নাযির বাজার, ঢাকা) ও দিনাজপুরের চিরিরবন্দরের নান্দেড়াই মাদরাসায় কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। তিনি ১৯৭২ সালের ৩১শে মে বুধবার ৭২ বছর বয়সে টঙ্গীর ফয়দাবাদে মৃত্যুবরণ করেন। ঢাবির উর্দূ ও ফার্সী বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও নাদভীর ছাত্র, বহু গ্রন্থ প্রণেতা, বিশিষ্ট গবেষক ড. মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ বলেন, ‘মাওলানা আব্দুল্লাহ নাদভী ছিলেন একজন বিজ্ঞ আলেম এবং বঙ্গের অন্যতম বিশিষ্ট আরবী কবি। বঙ্গের আরবী কাব্যক্ষেত্রে মাওলানা আব্দুর রহমান কাশগড়ীর পরেই তাঁকে স্থান দেয়া হয়’। ১৯৫৪ সালে তৎকালীন সঊদী বাদশাহ ইবনে সঊদ পূর্ব পাকিস্তানে আগমন করলে পূর্বপাক সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে যে মানপত্রটি দেয়া হয় তা মাওলানা নাদভী রচনা করেছিলেন। মিসরের সুয়েজ খাল আধিপত্যবাদী ইঙ্গ-ফরাসী চক্র করায়ত্ত করলে তিনি ‘নাহরু সুয়েয’ শিরোনামে একটি জ্বালাময়ী আরবী কবিতা রচনা করেন (বাংলাদেশের খ্যাতনামা আরবীবিদ, পৃঃ ৭৭-৭৯)। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাঈল যুদ্ধের প্রেক্ষিতে তিনি ৩২ লাইনের একটি দীর্ঘ আরবী কবিতা রচনা করেন। যা ‘তর্জুমানুল হাদীছ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কবিতাটির শুরু এভাবে-

اِعْدَادُ قُوَّتِكُمْ وَخَوْفُ رَبِّكُمْ + سِوَاهُمَا لاَ تَرَوْا يَا أهْلَ اِيْمَانِ

‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের শক্তি সঞ্চয় ও তোমাদের প্রভুর ভয়- এছাড়া আর কিছুর দিকেই তাকাবে না’ (মাসিক তর্জুমানুল হাদীছ, বর্ষ ১৪, সংখ্যা ১২, জুলাই-আগস্ট ১৯৬৮, পৃঃ ৫৮৮-৯০ ও ৫৯৯)।

[4]. তথ্য : মাওলানা সেলিম মায়মান জুনাগড়ী, বাসা নং ৯৬/১, সাং মির্জাপুর, পোঃ বিনোদপুর বাজার, থানা মতিহার, যেলা- রাজশাহী। তাং ১৫.০৯.২০১৭ইং, মোবাইল নং ০১৭৪৮-৬০৯২৯৮।

[5]. তথ্য : ঐ।

[6]. আব্দুর রশীদ ইরাকী, তাযকিরাতুন নুবালা ফী তারাজুমিল ওলামা (লাহোর : বায়তুল হিকমাহ, ২০০৪), পৃঃ ৩৫৩-৩৫৪।

[7]. আব্দুর রশীদ ইরাকী, তাযকিরাতুল মুহাম্মাদিইয়ীন (সারগোদা : মাকতাবা ছানাইয়াহ, ২০১২), পৃঃ ৮৬।

[8]. ইসহাক ভাট্টী, বার্রে ছাগীর মেঁ আহলেহাদীছ কী সারগুযাশত, পৃঃ ১৭।

[9]. ঐ, পৃঃ ১৫-১৭।

[10]. মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী এ প্রেক্ষিতে ‘মাসআলায়ে হিজায পর এক নযর’ (১৯২৫) ও ‘সুলতান ইবনে সঊদ, আলী বেরাদারান আওর মু’তামার’ (১৯২৬) পুস্তক দু’টি লিপিবদ্ধ করেন (আবুল মুবীন আব্দুল খালেক নাদভী, আশ-শায়খ আল-আল্লামা আবুল অফা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী (বেনারস : জামে‘আ সালাফিইয়াহ, ২০১৬), পৃঃ ৪৭৫

[11]. আবুল মুকাররম আব্দুল জলীল, ইমাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব কী দাওয়াত আওর ওলামায়ে আহলেহাদীছ কী মাসাঈ (বার্মিংহাম, লন্ডন : দারুল কিতাব ওয়াস সুন্নাহ, ১ম প্রকাশ, ১৪২০ হিঃ/১৯৯৯ খ্রিঃ), পৃঃ ৬৪-৬৯।

[12]. আখবারে মুহাম্মাদী, ১৫ই অক্টোবর ও ১লা নভেম্বর ১৯২৬।

[13]. هُنَاكَ الزَّلاَزِلُ وَالْفِتَنُ، وَبِهَا يَطْلُعُ قَرْنُ الشَّيْطَانِ ‘সেখানে (নাজদ) ভূমিকম্প ও ফিৎনা-ফাসাদ দেখা দিবে। আর সেখান থেকেই শয়তানের শিং উদিত হবে (উত্থান ঘটবে)।-বুখারী হা/১০৩৭।

[14]. ইমাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব কী দাওয়াত আওর ওলামায়ে আহলেহাদীছ কী মাসাঈ, পৃঃ ১০৪-১১১।

[15]. ছালাহুদ্দীন মাকবূল আহমাদ ও আরিফ জাবেদ মুহাম্মাদী, আহলুল হাদীছ ফী শিবহিল কার্রাহ আল-হিন্দিয়াহ (বৈরূত : দারুল বাশায়ির আল-ইসলামিয়াহ, ২০১৪), পৃঃ ৫০-৫১।

[16]. মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী, পৃঃ ৭৩-৭৬।

[17]. চালীস ওলামায়ে আহলেহাদীছ, পৃঃ ১৫৯।

[18]. মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী, পৃঃ ৭৭।

[19]. ঐ, পৃঃ ৭৮-৮১।

[20]. ঐ, পৃঃ ৪৩-৪৪।

[21]. ঐ, পৃঃ ৪৪-৪৫।

[22]. খুৎবাতে মুহাম্মাদী, পৃঃ ৮, জীবনী অংশ দ্রঃ।





ইবনু মাজাহ (রহঃ) (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
ইবনু মাজাহ (রহঃ) - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (রহঃ) (৪র্থ কিস্তি) - ড. নূরুল ইসলাম
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) (শেষ কিস্তি) - ড. নূরুল ইসলাম
ইমাম নাসাঈ (রহঃ) (২য় কিস্তি) - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
মাওলানা আব্দুল ওয়াহ্হাব মুহাদ্দিছ দেহলভী (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - ড. নূরুল ইসলাম
মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী (রহঃ) (২য় কিস্তি) - ড. নূরুল ইসলাম
মাওলানা আব্দুল্লাহ মাদানী ঝান্ডানগরী - ড. নূরুল ইসলাম
ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (রহঃ) - ড. নূরুল ইসলাম
শেরে পাঞ্জাব, ফাতিহে কাদিয়ান মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী (রহঃ) (শেষ কিস্তি) - ড. নূরুল ইসলাম
শেরে পাঞ্জাব, ফাতিহে কাদিয়ান মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী (রহঃ) - ড. নূরুল ইসলাম
ইমাম নাসাঈ (রহঃ) (শেষ কিস্তি) - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
আরও
আরও
.