
(৮) আল্লাহর পথে জিহাদ করা :
মর্যাদাপূর্ণ জীবন লাভের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হ’ল আল্লাহর পথে জিহাদ। জিহাদ মানে কেবল সশস্ত্র যুদ্ধ নয়; বরং আল্লাহর দ্বীনকে সমুচ্চ করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানোর নাম হ’ল জিহাদ। আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, রাসুলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন,يَا أَبَا سَعِيدٍ، مَنْ رَضِيَ بِاللهِ رَبًّا، وَبِالْإِسْلَامِ دِينًا، وَبِمُحَمَّدٍ نَبِيًّا، وَجَبَتْ لَهُ الْجَنَّةُ، ‘হে আবূ সাঈদ! যে ব্যক্তি আল্লাহকে রব হিসাবে, ইসলামকে দ্বীন হিসাবে এবং মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে নবী হিসাবে পেয়ে সন্তুষ্ট হ’ল, তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে গেল। কথাটি শুনে আবূ সাঈদ (রাঃ) আশ্চর্য হয়ে বললেন, أَعِدْهَا عَلَيَّ يَا رَسُولَ اللهِ، ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমার জন্যে কথাটি আবার বলুন’। তিনি তাই করলেন, তারপর বললেন, وَأُخْرَى يُرْفَعُ بِهَا الْعَبْدُ مِائَةَ دَرَجَةٍ فِي الْجَنَّةِ، مَا بَيْنَ كُلِّ دَرَجَتَيْنِ كَمَا بَيْنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ، ‘আরও একটি আমল আছে, যার মাধ্যমে বান্দা এমন একশটি মর্যাদার স্তর লাভ করবে, যার দু’টো স্তরের মধ্যে ব্যবধান হবে আসমান ও যমীনের ব্যবধানের সমান। তখন তিনি বললেন, সেটি কি হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন, الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللهِ، الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللهِ ‘আল্লাহর পথে জিহাদ, আল্লাহর পথে জিহাদ’।[1]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ارْمُوا مَنْ بَلَغَ الْعَدُوَّ بِسَهْمٍ رَفَعَهُ اللهُ بِهِ دَرَجَةً، ‘তোমরা তীর নিক্ষেপ করবে। যে ব্যক্তি শত্রুর প্রতি একটি তীর নিক্ষেপ করবে, আল্লাহ এর বিনিময়ে তার একটি স্তর বৃদ্ধি করবেন। ইবনু নাহহাম (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! মর্যাদা কিরূপ? তিনি বললেন,أَمَا إِنَّهَا لَيْسَتْ بِعَتَبَةِ أُمِّكَ، وَلَكِنْ مَا بَيْنَ الدَّرَجَتَيْنِ مِائَةُ عَامٍ، ‘তা তোমার মায়ের ঘরের চৌকাঠ নয়; এর দু’টি স্তরের মধ্যে পার্থক্য হবে একশত বছর’।[2] আল্লাহ বলেন, وَفَضَّلَ اللهُ الْمُجَاهِدِينَ عَلَى الْقَاعِدِينَ أَجْرًا عَظِيمًا، دَرَجَاتٍ مِنْهُ وَمَغْفِرَةً وَرَحْمَةً وَكَانَ اللهُ غَفُورًا رَحِيمًا، ‘আল্লাহ মুজাহিদগণকে ঘরে বসা মুমিনদের উপর মহা পুরস্কারের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। আর তাঁর পক্ষ হ’তে রয়েছে উচ্চ মর্যাদা সমূহ এবং ক্ষমা ও দয়া। বস্ত্ততঃ আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (নিসা ৪/৯৫-৯৫)।
(৯) দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করা :
যারা একনিষ্ঠভাবে দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করে এবং সেই ইলম তাদের সার্বিক জীবনে বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে আল্লাহ তাদেরকে জগতবাসির কাছে সম্মানিত করে তোলেন এবং পরকালেও তাদের জন্য সম্মানিত হওয়ার ব্যবস্থা করেন। আল্লাহ বলেন,يَرْفَعِ اللهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا العِلْمَ دَرَجَاتٍ وَاللهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ، ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদেরকে উচ্চ মর্যাদা দান করবেন। আর তোমরা যা কর আল্লাহ তা ভালভাবে খবর রাখেন’ (মুজাদালা ৫৮/১১)। অন্যত্র তিনি বলেন, نَرْفَعُ دَرَجَاتٍ مَّنْ نَّشَاءُ ‘আমরা যাকে ইচ্ছা মর্যাদায় উন্নত করি’ (আন‘আম ৬/৮৩)। অত্র আয়াতের ব্যাখ্যায় প্রখ্যাত তাবেঈ যায়েদ ইবনে আসলাম (রহঃ) বলেন, আল্লাহ জ্ঞানের মাধ্যমে মানুষের মর্যাদা উন্নীত করেন।[3]
দ্বীনের জ্ঞান অর্জনকারী ও অন্বেষণকারীদের মর্যাদা এতটাই বেশী যে, তাদের সম্মানে আকাশের ফেরেশতারা পর্যন্ত তাদের ডানা বিছিয়ে দেন, পানির মাছ ও গর্তের পিপীলিকা তাদের জন্য দো‘আ করে; এমনকি আকাশ ও যমীনের সকল সৃষ্টিকূল তাদের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করে।[4] আবূ তালেব মাক্কী (রহঃ) বলেন,الإيمان عريان ولباسه التقوى وحليته الورع وثمرته العلم، ففيه دليل أنّ من لا تقوى له فلا لبس لإيمانه ومن لا ورع له فلا زينة لإيمانه ومن لا علم له فلا ثمرة لإيمانه ‘ঈমান অনাবৃত বিষয়, তার পোষাক হ’ল তাক্বওয়া, অলংকার হ’ল দ্বীনদারী, আর ফলাফল হ’ল ইলম (জ্ঞান)। অতএব যে ব্যক্তির তাক্বওয়া নেই, তার ঈমানের কোন পোষাক নেই; যার দ্বীনদারী নেই, তার ঈমানের কোন সৌন্দর্য নেই; আর যার জ্ঞান নেই, তার ঈমানের কোন ফল নেই’।[5]
(১০) তাহাজ্জুদ ছালাত আদায় করা :
তাহাজ্জুদ ছালাত কেবল একটি নফল ইবাদত নয়; বরং এটি এক রূহানী সফর, যা বান্দাকে পৌঁছে দেয় আল্লাহর নৈকট্যে। দিনের ব্যস্ততা ও জাগতিক কোলাহল থেকে মুক্ত হয়ে রাত্রির নিস্তব্ধতায় যখন মুমিন তার রবের সামনে দাঁড়ায়, তখন সেটাই তার সর্বোচ্চ সম্মানের মঞ্চ হয়ে ওঠে। সাহল বিন সা‘দ (রাঃ) বলেন, জিব্রীল এসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বললেন,يَا مُحَمَّدُ شَرَفُ الْمُؤْمِنِ قِيَامُ اللَّيْلِ وَعِزُّهُ اسْتِغْنَاؤُهُ عَنِ النَّاسِ، ‘হে মুহাম্মাদ! মুমিনের মর্যাদা হ’ল ইবাদতে রাত্রি জাগরণে এবং তার সম্মান হ’ল মানুষের মুখাপেক্ষী না হওয়ার মধ্যে’।[6] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,وَالدَّرَجَاتُ إِفْشَاءُ السَّلَامِ، وَإِطْعَامُ الطَّعَامِ، وَالصَّلَاةُ بِاللَّيْلِ وَالنَّاسُ نِيَامٌ، ‘মর্যাদা লাভের মাধ্যম হ’ল- সালাম দেওয়া, (অপরকে) খাদ্য খাওয়ানো এবং মানুষ যখন রাতে ঘুমিয়ে পড়ে তখন (তাহাজ্জুদ) ছালাত আদায় করা’।[7] অত্র হাদীছদ্বয়ে মর্যাদাপূর্ণ ও সম্মানিত জীবন লাভের চারটি উপায় বলে দেওয়া হয়েছে- (১) তাহাজ্জুদ ছালাত, (২) মানুষের মুখাপেক্ষী না হয়ে আল্লাহর উপর ভরসা করা, (৩) পরিচিত-অপরিচিত সকল মুসলমিকে সালাম দেওয়া এবং (৪) অপরকে খাবার খাওয়ানো।
এই চারটি কাজ এমন নয় যে, এগুলোর জন্য কেবল আখিরাতের পুরস্কার বরাদ্দ। বরং এগুলোর সুফল এ দুনিয়াতেও প্রত্যক্ষ করা যায়। কোন মুসলিম যদি এই চারটি গুণ অর্জন করেন, তবে তিনি সত্যিকার অর্থেই যেমন দুনিয়ায় সম্মানিত হবেন, মানুষ ও সৃষ্টিকুলের ভালবাসায় সিক্ত হবেন; ঠিক তেমনি আখেরাতের জীবনেও তিনি জান্নাতের সম্মানিত মেহমানে পরিণত হবেন।
(১১) পিতামাতার জন্য সন্তানের দো‘আ :
জীবনের প্রতিটি ধাপেই আমরা মর্যাদা অন্বেষণে ছুটে চলি। কখনো তা জ্ঞানের মাধ্যমে, কখনো ইবাদতের মাধ্যমে, আবার কখনো মানুষকে উপকার করে। তবে এমন একটি মর্যাদা আছে, যা মৃত্যুর পরেও বৃদ্ধি পেতে থাকে- জীবনের সব কর্ম থেমে গেলেও। আর সেটা হ’ল নেক সন্তানের দো‘আ। পিতামাতা যদি কোন পরহেযগার সন্তান দুনিয়ায় রেখে যান আর সে তার পিতা-মাতার জন্য দো‘আ করে বা ক্ষমাপ্রার্থনা করে, তবে সেই দো‘আর বদৌলতে আল্লাহ জান্নাতে পিতামাতার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ لَيَرْفَعُ الدَّرَجَةَ لِلْعَبْدِ الصَّالِحِ فِى الْجَنَّةِ فَيَقُولُ يَارَبِّ أَنَّى لِى هَذِهِ فَيَقُولُ بِاسْتِغْفَارِ وَلَدِكَ لَكَ، ‘আল্লাহ জান্নাতে তাঁর কোন নেক বান্দার মর্যাদা বাড়িয়ে দিবেন। এ অবস্থা দেখে সে (নেক বান্দা) বলবে, হে আমার রব! আমার এ মর্যাদা কিভাবে বৃদ্ধি পেল? তখন আল্লাহ বলবেন, তোমার জন্য তোমার সন্তান-সন্ততির ক্ষমাপ্রার্থনা করার কারণে’।[8]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِذَا مَاتَ الْإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلَّا مِنْ ثَلَاثَةٍ: إِلَّا مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ، أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ، أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ، ‘মানুষ যখন মারা যায়, তখন তার আমলের পথ বন্ধ হয়ে যায়, তিনটি আমল ছাড়া- (তা হল) ছাদাক্বায়ে জারিয়া, এমন ইলম যার দ্বারা উপকৃত হওয়া যায় এবং পুণ্যবান সন্তান যে তার জন্য দো‘আ করে’।[9]
মুমিন পিতামাতা ও নেক সন্তান জান্নাতে একে অপরের মাধ্যমে উপকৃত হবে। দো‘আ, ইস্তিগফার তাদের মর্যাদা বাড়িয়ে দিবে। আল্লাহ বলেন,وَالَّذِينَ آمَنُوا وَاتَّبَعَتْهُمْ ذُرِّيَّتُهُمْ بِإِيمَانٍ أَلْحَقْنَا بِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ وَمَا أَلَتْنَاهُمْ مِنْ عَمَلِهِمْ مِنْ شَيْءٍ كُلُّ امْرِئٍ بِمَا كَسَبَ رَهِينٌ، ‘যারা ঈমানদার এবং যাদের সন্তান-সন্ততি ঈমানে তাদের অনুগামী, আমরা তাদেরকে তাদের সন্তানদের সাথে মিলিয়ে দেব। আর আমরা তাদের কর্মফল দানে আদৌ কমতি করব না। বস্ত্ততঃ প্রত্যেক ব্যক্তি স্ব স্ব কৃতকর্মের নিকট দায়বদ্ধ’ (তূর ৫১/২১)। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন,إن الله تبارك وتعالى ليرفع ذرّية المؤمن في درجته، وإن كانوا دونه في العمل، ليقرَّ بهم عينه، ‘মুমিনের বংশধর যদি আমলে নীচু স্তরেরও হয়, তবুও আল্লাহ তাদের মর্যাদা বাড়িয়ে দিবেন, যেন (জান্নাতের মধ্যে স্বীয় বংশধরের সম্মান দেখে) তার চক্ষু শীতল হয়’।[10] তবে এর শর্ত হ’ল- সন্তানদেরও মুমিন হ’তে হবে। সুতরাং এটি কেবল তাদের জন্য প্রযোজ্য, যাদের সন্তান-সন্ততি ঈমানের বিশেষণে বিশেষিত।[11]
সুতরাং মর্যাদা শুধু নিজে ইবাদত করে অর্জন করতে হয় না। কখনো আল্লাহ এমন সন্তানের মাধ্যমে মর্যাদা দেন, যার হৃদয়ে পিতা-মাতার প্রতি ভালোবাসা ও ইহসান বিদ্যমান থাকে।
(১২) কুরআনের ধারক-বাহক হওয়া :
কুরআন এমন এক আলোকবর্তিকা, এর সাথে যে সম্পর্ক গড়েছে, আল্লাহ তাকে উঁচু মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন; আর যে এর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, সে নিপতিত হয়েছে লাঞ্ছনার অন্ধকারে। সালাফদের জীবনে কুরআনের প্রতি যে গভীর ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও নিরন্তর অনুশীলন ছিল, তার অনন্য উদাহরণ আমরা পাই ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর সেই ঘটনা থেকে, যা বর্ণনা করেছেন প্রখ্যাত তাবেঈ ও মুহাদ্দিছ আব্দুর রহমান ইবনে আবু লায়লা (মৃ. ৮৩হি.)। তিনি বলেন, আমি একবার ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর সাথে মক্কার দিকে রওয়ানা হয়েছিলাম। তখন মক্কার আমীর (শাসক) নাফে‘ ইবনু আলকামা আমাদের সামনে এলেন। তিনি তাঁর এক চাচার নামে পরিচিত ছিলেন, যাঁর নামও ছিল নাফে‘। ওমর (রাঃ) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি মক্কার দায়িত্ব কাকে দিয়ে এসেছ?’ তিনি বললেন, ‘আমি সেখানে আব্দুর রহমান ইবনে আবযা (عَبْد الرَّحْمَنِ بْنَ أَبْزَى)-কে রেখে এসেছি’। ওমর (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি সেখানে একজন মুক্তদাসকে রেখে এসেছ? অথচ সেখানে কুরায়শের লোকজন এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণ উপস্থিত?’
তিনি উত্তরে বললেন, ‘হ্যাঁ! (আমি একজন মুক্তদাসকে এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অপর্ণ করেছি), কারণ আমি তাঁকে কুরআন শিক্ষায় সবচেয়ে পারদর্শী হিসাবে পেয়েছি। আর মক্কা এমন একটি জায়গা যেখানে অনেক মানুষ জমায়েত হয়, তাই আমি চেয়েছি, লোকেরা যেন একজন সুন্দর কণ্ঠে কুরআন তেলাওয়াতকারী ব্যক্তির কাছ থেকেই আল্লাহর কিতাব শ্রবণ করে’। তখন ওমর (রাঃ) বললে,نِعْمَ مَا رَأَيْتَ، إِنَّ اللهَ يَرْفَعُ بِالْقُرْآنِ أَقْوَامًا، وَيَضَعُ بِالْقُرْآنِ أَقْوَامًا، وَإِنَّ عَبْدَ الرَّحْمَنِ بْنَ أَبْزَى مِمَّنْ رَفَعَهُ اللهُ بِالْقُرْآنِ، ‘তুমি কতই না চমৎকার সিদ্ধান্ত নিয়েছ! নিশ্চয়ই আল্লাহ কুরআনের মাধ্যমে কিছু লোককে মর্যাদা দেন, আবার কুরআনের মাধ্যমেই কিছু লোককে নীচু করে দেন। আর আব্দুর রহমান ইবনে আবযা হচ্ছেন সেইসব লোকদের একজন, যাঁকে আল্লাহ কুরআনের মাধ্যমে সম্মানিত করেছেন’।[12]
একজন মুক্তদাস, যে সামাজিক দৃষ্টিতে নীচু শ্রেণীভুক্ত, অথচ তিনিই কুরআনের মাধ্যমে মক্কার মত পবিত্র নগরীর দায়িত্ব পেয়ে গেলেন। এর কারণ ছিল একটাই- আল্লাহর কালামের প্রতি তার একনিষ্ট ভালোবাসা ও আমলের আন্তরিকতা। সুতরাং কুরআন শুধু শেখা নয়; বরং এর বিধান সার্বিক জীবনে বাস্তবায়ন করার আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে। আর মনে রাখতে হবে জাতি, বংশ, সহায়-সম্পদ ও ক্ষমতার মাধ্যমে নয়; বরং প্রকৃত মর্যাদা আসে কুরআনের বিধান বাস্তবায়নের মাধ্যমে।
(১৩) মানুষের ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করা :
মর্যাদা মানুষ নিজ চেষ্টায় অর্জন করে না, বরং আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সম্মানিত করেন। তবে কিছু গুণাবলী রয়েছে, যেগুলো আল্লাহর নিকট এতই প্রিয় যে, বান্দা এগুলোর মাধ্যমে ধীরে ধীরে সম্মান ও গ্রহণযোগ্যতার চূড়ায় উপনীত হয়। মানুষের চোখে সে হয়ে ওঠে শ্রদ্ধার পাত্র, সমাজে তার কথার ওযন বাড়ে, অন্তরে প্রশান্তি নামে। এই গুণাবলীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য তিনটি হ’ল- দান-ছাদাক্বা, ক্ষমা-উদারতা ও বিনয়। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَا نَقَصَتْ صَدَقَةٌ مِنْ مَالٍ، وَمَا زَادَ اللهُ عَبْدًا بِعَفْوٍ، إِلَّا عِزًّا، وَمَا تَوَاضَعَ أَحَدٌ لِلَّهِ إِلَّا رَفَعَهُ اللهُ، ‘দান-ছাদাক্বার মাধ্যমে ধন-সম্পদ কমে যায় না। ক্ষমা-উদারতার মাধ্যমে আল্লাহ (বান্দার) মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য বিনয়ী হয়, আল্লাহ তার সম্মান বাড়িয়ে দেন’।[13] নবী-রাসূল ও সালাফে ছালেহীন ছিলেন ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার মূর্ত প্রতীক। বিশেষ করে ইউসুফ (আঃ) ও মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর জীবনে আমরা এর অসংখ্য নযীর দেখতে পাই।
সুতরাং ক্ষমা করা কোন অপমান নয়, বরং তা আত্মমর্যাদার স্বীকৃতি। যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ক্ষমাশীল হয়, আল্লাহ তাকে দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মানিত করেন। সমাজে তার গ্রহণযোগ্যতা হয় সুদৃঢ়। সম্মান ও মর্যাদার বটবৃক্ষ তার জীবনকে সর্বদা ছায়া দিয়ে রাখে।
(১৪) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রতি দরূদ পাঠ করা :
আকাশবাসী ও যমীনবাসীর কাছে নিজের মর্যাদা ও সম্মান বৃদ্ধি করার একটি বড় মাধ্যম হ’ল দরূদ। যারা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রতি বেশী বেশী দরূদ পাঠ করে, প্রতি দরূদে আল্লাহ তাদের মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেল,مَنْ صَلَّى عَلَيَّ صَلَاةً وَاحِدَةً صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ عَشْرَ صَلَوَاتٍ وَحُطَّتْ عَنْهُ عَشْرُ خَطِيئَاتٍ وَرُفِعَتْ لَهُ عَشْرُ دَرَجَاتٍ، ‘যে ব্যক্তি আমার ওপর একবার দরূদ পাঠ করবে, আল্লাহ তার প্রতি দশবার রহমত নাযিল করবেন। তার দশটি গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে, আর তার জন্য দশটি মর্যাদা বাড়িয়ে দেওয়া হবে’।[14]
অত্র হাদীছের ব্যাখ্যায় আল্লামা ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (রহঃ) বলেন,ورفعت له عشر درجات في الدنيا بتوفيق الطاعات، وفي القيامة بتثقيل الحسنات، وفي الجنة بزيادة الكرامات ‘তার মর্যাদা দশ ধাপ বাড়িয়ে দেওয়া হবে- দুনিয়াতে আল্লাহর আনুগত্যের তাওফীক্ব দিয়ে; ক্বিয়ামতের দিন নেক আমলের পাল্লা ভারী করে দিয়ে এবং জান্নাতে তাকে বাড়তি সম্মান ও অনুগ্রহ প্রদান করে’।[15] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রতি দরূদ পাঠ করা শুধু একটি ইবাদতই নয়; বরং এটি দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মান অর্জনের এক মহামূল্যবান সোপান।
(১৫) কল্যাণকর ও উত্তম কথা বলা :
উত্তম কথা বলা ইবাদত। এটি বান্দার মর্যাদা বাড়ায় এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের পথ সহজ করে দেয়। আবূ হুরায়রাহ বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّ العَبْدَ لَيَتَكَلَّمُ بِالكَلِمَةِ مِنْ رِضْوَانِ اللهِ، لاَ يُلْقِي لَهَا بَالًا، يَرْفَعُهُ اللهُ بِهَا دَرَجَاتٍ، وَإِنَّ العَبْدَ لَيَتَكَلَّمُ بِالكَلِمَةِ مِنْ سَخَطِ اللهِ، لاَ يُلْقِي لَهَا بَالًا، يَهْوِي بِهَا فِي جَهَنَّمَ، ‘নিশ্চয়ই বান্দা কোন কোন সময় আল্লাহর সন্তুষ্টিমূলক এমন কথা বলে ফেলে, যে কথা সম্পর্কে তার চেতনা নেই। অথচ এ কথার দ্বারা আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। আবার বান্দা কখনও কখনও আল্লাহর অসন্তুষ্টিমূলক এমন কথা বলে ফেলে, যার পরিণতি সম্পর্কে তার ধারণা নেই। অথচ সে কথার কারণে সে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে’।[16] অত্র হাদীছটি মুমিনের জন্য সতর্ককারী। মানুষের মুখ থেকে বেরিয়ে যাওয়া কথা যদি তা আল্লাহর সন্তুষ্টিমূলক হয়- তবে তা তাকে এমন উচ্চ মর্যাদায় পৌঁছে দিতে পারে, যা সে নিজেও কল্পনা করেনি। অন্যদিকে অসতর্কভাবে উচ্চারিত একটি ক্ষতিকর বাক্য আল্লাহর ক্রোধের কারণ হয়ে জাহান্নামের দিকে ঠেলে দিতে পারে, যদিও তা বান্দার দৃষ্টিতে তুচ্ছ ছিল। মহান আল্লাহ আমাদের জিহবাকে উত্তম ও কল্যাণকর কথায় অভ্যস্ত করুন।
(১৬) ইসলামের ছায়াতলে চুল-দাড়ি পাকা :
মুসলিম ব্যক্তির চুল-দাড়ি সাদা হওয়া বা পেকে যাওয়া তার মর্যাদা বেড়ে যাওয়ার লক্ষণ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,لَا تَنْتِفُوا الشَّيْبَ فَإِنَّهُ نُورٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَمَنْ شَابَ شَيْبَةً فِي الْإِسْلَامِ كُتِبَ لَهُ بِهَا حَسَنَةٌ وَحُطَّ عَنْهُ بِهَا خَطِيئَةٌ وَرُفِعَ له بها درجة، ‘তোমরা শুভ্র কেশ বা পাকা চুল তুলে ফেল না। কেননা তা ক্বিয়ামতের দিন নূর (জ্যোতি) হবে। ইসলামে যে ব্যক্তির একটি চুল সাদা হবে, সে ব্যক্তির প্রত্যেক সাদা চুলের বিনিময়ে আল্লাহ তার জন্য একটি করে নেকী লিপিবদ্ধ করবেন, একটি করে গোনাহ মুছে দিবেন এবং একটি করে মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন’।[17] অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَنْ شَابَ شَيْبَةً فِى سَبِيلِ اللهِ كَانَتْ نُوراً يَوْمَ الْقِيَامَةِ. فَقَالَ رَجُلٌ عِنْدَ ذَلِكَ فَإِنَّ رِجَالاً يَنْتِفُونَ الشَّيْبَ فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم مَنْ شَاءَ فَلْيَنْتِفْ نُورَهُ ‘আল্লাহর পথে বা মুসলিম অবস্থায় যে ব্যক্তির কিছু চুল সাদা হবে, ক্বিয়ামতের দিন (সেই চুলগুলো) তার জন্য বিশেষ প্রকারের নূর হবে। তখন জনৈক ছাহাবী বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! লোকেরাতো সাদা চুল তুলে ফেলে। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, যে ব্যক্তি পসন্দ করে সে তার নূর বা জ্যোতিকে উপড়ে ফেলুক’।[18]
(১৭) আল্লাহর যিকির করা :
আকাশবাসী ও যমীনবাসীর কাছে মর্যাদাবান ও সম্মানিত হওয়ার একটি বড় মাধ্যম হ’ল আল্লাহর স্মরণ বা যিকর। আল্লাহকে স্মরণ করিয়ে দেয় এমন প্রত্যেক বিষয়ই যিকরের অন্তর্ভুক্ত। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে অসংখ্য যিকিরের বর্ণনা এসেছে, যা সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধি করে। আব্দুর রহমান ইবনু গানব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী কারীম (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ফজর ও মাগরিবের ছালাত শেষে জায়গা থেকে উঠার ও পা ঘুরানোর আগে এ দো‘আ দশবার পড়ে, لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ، وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ، بِيَدِهِ الْخَيْرُ، يُحْيِي وَيُمِيتُ، وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ، ‘উচ্চারণ : লা- ইলা-হা ইল্লাল্লাহ-হু ওয়াহদাহূ লা-শারীকা লাহূ লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু বিয়াদিহিল খায়রু, ইউহয়ী ওয়া ইউমীতু, ওয়াহুয়া ’আলা- কুল্লি শাইয়্যিন ক্বদীর’। (অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন ইলাহ নেই, তাঁর কোন শরীক নেই, রাজত্ব একমাত্র তাঁরই, সমস্ত প্রশংসা তাঁরই, তাঁর হাতেই যাবতীয় কল্যাণ রয়েছে, তিনি জীবন ও মৃত্যু দান করেন, তিনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।) তাহ’লে প্রতিবারের বিনিময়ে তার জন্য দশটি নেকী লেখা হয়, দশটি গুনাহ মিটিয়ে দেয়া হয় এবং তার দশটি মর্যাদার স্তরে উন্নীত করা হয়। আর দো‘আ তাকে যাবতীয় অপসন্দনীয় ও বিতাড়িত শয়তান থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। শিরক ছাড়া অন্য কোন গুনাহের কারণে তাকে পাকড়াও করা হবে না। আমলের দিক দিয়ে সে হবে অন্য লোকের চেয়ে উত্তম; তবে সেই ব্যক্তি ব্যতীত, যে এর চেয়ে আরো উত্তম আমল করবে’।[19]
একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছাহাবায়ে কেরামকে বললেন,أَلَا أُنَبِّئُكُمْ بِخَيْرِ أَعْمَالِكُمْ وَأَزْكَاهَا عِنْدَ مَلِيكِكُمْ؟ وَأَرْفَعِهَا فِي دَرَجَاتِكُمْ؟ وَخَيْرٍ لَكُمْ مِنْ إِنْفَاقِ الذهبِ والوَرِقِ؟ وخيرٍ لكم مِنْ أَنْ تَلْقَوْا عَدُوَّكُمْ فَتَضْرِبُوا أَعْنَاقَهُمْ وَيَضْرِبُوا أَعْنَاقَكُمْ؟ ‘আমি কি তোমাদেরকে সর্বোত্তম আমল সম্পর্কে অবহিত করব না? যে আমল তোমাদের মালিকের কাছে অতীব পবিত্র এবং তোমাদের মর্যাদা বৃদ্ধির ব্যাপারে অধিক কার্যকর। আমলটি তোমাদের জন্য সোনা-রূপা দান করার চেয়েও শ্রেষ্ঠ। এমনকি এমন যুদ্ধের চেয়েও উত্তম যেখানে তোমরা শত্রুর মুকাবিলা করে তাদের গর্দানে আঘাত হানবে আর তারাও তোমাদের গর্দানে আঘাত হানবে’। ছাহাবায়ে কেরাম উত্তরে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আপনি বলুন! সেই আমলটি কী? তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ذِكْرُ اللهِ ‘আল্লাহর যিক্র’।[20]
(১৮) গোপন আমলে অভ্যস্ত হওয়া :
গোপন নেক আমল বান্দার মর্যাদা ও সম্মান বৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। এটি কুরআন, হাদীছ এবং সালাফদের বাণীতে সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। জুবায়ের ইবনুল আওয়াম (রাঃ) বলেন,مَنِ اسْتَطَاعَ مِنْكُمْ أَنْ تَكُونَ لَهُ خَبِيئَةٌ مِنْ عَمَلٍ صَالِحٍ، فَلْيَفْعَلْ، ‘কেউ যদি কোন গোপন নেক আমল করতে সক্ষম হয়, তবে সে যেন তা করে’।[21] কারণ গোপন আমল যতটা একনিষ্ঠ নিয়তে করা যায়, প্রকাশ্যে সেই একনিষ্ঠ নিয়ত ধরে রাখা সহজ হয় না; ক্ষেত্রবিশেষে সম্ভব হয় না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,صَدَقَةُ السِّرِّ تُطْفِئُ غَضَبَ الرَّبِّ، وَصِلَةُ الرَّحِمِ تَزِيدُ فِي الْعُمُرِ، وَفِعْلُ الْمَعْرُوفِ يَقِي مَصَارِعَ السُّوءِ، ‘গোপন ছাদাক্বাহ প্রতিপালকের রাগকে প্রশমিত করে। আত্মীয়তার সম্পর্ক বয়স বৃদ্ধি করে। আর নেকীর কাজ পাপের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করে’।[22] ছান‘আনী (রহঃ) বলেন, ‘বান্দা যখন গুনাহের মাধ্যমে আল্লাহর ক্রোধের শিকার হয়, তখন গোপন দান-ছাদাক্বাহ সেই ক্রোধ প্রশমিত করে দেয়’।[23]
গোপন ইবাদত শুধুমাত্র বান্দা ও তার রবের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। এতে আল্লাহর প্রতি বান্দার একনিষ্ঠতা ও সততা প্রকাশ পায় এবং রিয়া বা লৌকিকতা থেকে মুক্ত থাকা যায়। সালাফগণ চাইতেন তাদের নেক আমল তাদের স্ত্রী বা অন্যদের থেকেও গোপন থাকুক। ইবনে দাঊদ আল-খুরাইবী (রহঃ) বলেন,كَانُوا يستحبون أَن يَكُون للرجل خبيئة من عمل صَالِح لا تعلم بِهِ زوجته، ولا غيرها، ‘সালাফগণ প্রত্যেকে পসন্দ করতেন যে, তার এমন কোন গোপন নেক আমল থাকবে যা তার স্ত্রী বা অন্য কেউ জানবে না’।[24] যায়েদ ইবনে আসলাম (রহঃ) বলেন, مَنِ اتَّقَى اللهَ حَبَّهُ النَّاسُ وَإِنْ كَرِهُوا، ‘যে আল্লাহকে ভয় করে, মানুষ তাকে অন্তর থেকে ভালোবাসে; যদিও বাহিক্যভাবে তাকে অপসন্দ করে’।[25] ফুযাইল ইবনে ইয়ায (রহঃ) বলেন,خَيْرُ الْعَمَلِ أَخْفَاهُ، أَمْنَعُهُ مِنَ الشَّيْطَانِ وَأَبْعَدُهُ مِنَ الرِّيَاءِ، ‘সর্বোত্তম আমল হচ্ছে গোপন আমল। এটা শয়তান থেকে সবচেয়ে বেশী নিরাপদে রাখে এবং রিয়া থেকে বেশী দূরে রাখে’।[26] সুতরাং বান্দা যখন গোপন আমলে অভ্যস্ত হবে, তখন আল্লাহ তার উপর রাযী-খুশি থাকবেন। ফলে স্বীয় রবের কাছে তার মর্যাদা বাড়বে এবং আকাশবাসী ও যমীনবাসীর কাছেও তার সম্মান বৃদ্ধি পাবে।
আব্দুর রহমান ইবনুল মুবারক (রহঃ) বলেন,ما رأيت رجلا ارتفع مثل مالك بن أنس، ليس له كثير صلاة ولا صيام، إلا أن تكون له سريرة، ‘আমি মালেক ইবনে আনাসের মতো এত মর্যাদাবান মানুষ আর কাউকে দেখিনি। তার এত বেশী নফল ছালাত ও ছিয়ামের আমল ছিল না, তবে যা ছিল সবই গোপন ছিল’।[27] ইবনুল মুবারক (রহঃ)ও ছিলেন একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। তার যুগে মানুষ খলীফার চেয়েও ইবনুল মুবারককে বেশী সম্মান ও শ্রদ্ধা করতো। তাঁর ছিল দিগন্তজোড়া খ্যাতি ও সুনাম। এটা ছিল ইবনুল মুবারক (রহঃ)-এর পার্থিব পুরষ্কার। তিনি ছিলেন একাধারে মুহাদ্দিছ, ফক্বীহ্, আলেম, মুজতাহিদ, কবি, সাহিত্যিক, দানশীল এবং একজন সাহসী বীর মুজাহিদ। তিনি ছিলেন গোপন আমলের রাজপথে এক নিভৃতচারী। তিনি যুদ্ধের সময় মুখ ঢেকে রেখে যুদ্ধ করতেন, যেন কেউ তাকে চিনতে না পারে। তিনি ঋণগ্রস্তের ঋণ পরিশোধ করে দিতেন, অথচ ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি সেটা বুঝতে পারত না। তিনি ছিলেন নির্জনে পরিশ্রমী তাহাজ্জুদগুযার। তার ব্যাপারে আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহঃ) বলেন, ما رفع الله ابن المبارك إلا بخبيئة كانت له، ‘গোপন নেক আমলের কারণেই আল্লাহ ইবনুল মুবারককে এতোটা মর্যাদামন্ডিত করেছেন’।[28]
তাছাড়া গোপন ইবাদতের আরেকটি দিক হ’ল গোপন পাপ থেকে নিজেকে বিরত রাখা। সুযোগ থাকার পরেও যারা পোপন পাপ থেকে নিজেদের বিরত রাখতে পারেন, তারাও আল্লাহর কাছে পোপন আমলকারী হিসাবে গণ্য হবেন ইনশাআল্লাহ।
উপসংহার :
ধন-সম্পদ, পদ-পদবী, দামী গাড়ি-বাড়ি ও পোষাক-পরিচ্ছদ বা বস্ত্তগত কোন বিষয়ের মাধ্যমে প্রকৃত সম্মান অর্জন করা যায় না; সত্যিকারের মর্যাদা পাওয়া যায় কেবল আল্লাহর দাসত্বের মাধ্যমে। যারা নিজেদের জীবনকে আল্লাহর রাহে নিবেদিত করে, দুনিয়া ও আখিরাতের সম্মান-মর্যাদা তাদের পদচুম্বন করে। তাদের জন্য মানুষের হৃদয়ে রচিত হয় ভালবাসার বুনিয়াদ। মহান আল্লাহ আমাদেরকে আলোচিত উপায়গুলো অবলম্বন করে দুনিয়ায় সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার তাওফীক্ব দান করুন এবং পরকালেও মর্যাদার সর্বোচ্চ চূড়ায় আরোহনের তাওফীক্ব নছীব করুন- আমীন!
আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী;
এম.ফিল গবেষক, আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[1]. মুসলিম হা/১৮৮৪; নাসাঈ হা/৩১৩১; মিশকাতা হা/৩৮৫১।
[2]. নাসাঈ হা/২১৪৪, সনদ ছহীহ।
[3]. মুসনাদে আহমাদ, ১/৫০০; ক্রমিক : ৩৩৯।
[4]. আবূদাঊদ হা/৩৬৪১; মিশকাত হা/২১২, সনদ হাসান।
[5]. আবূ তালেব মাক্কী, কূতুল কুলূব ফী মু‘আমালাতিল মাহবূব ২/২২৬।
[6]. হাকেম হা/৭৯২১; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৮৩১।
[7]. তিরমিযী হা/৩২৩৩; ছহীহুত তারগীব হা/৪০৮, সনদ ছহীহ।
[8]. আহমাদ হা/১০৮৯০; ইবনু মাজাহ ৩৬৬০; মিশকাত হা/২৩৫৪, সনদ ছহীহ।
[9]. মুসলিম হা/১৬৩১; আবূদাঊদ হা/২৮৮০; তিরমিযী হা/১৩৭৬; মিশকাত হা/২০৩।
[10]. তাফসীরে তাবারী, ২২/৪৬৭।
[11]. শাওকানী, ফাৎহুল কাদীর ৫/১১৭।
[12]. মুসনাদে আবী ইয়া‘লা মাওছীলী হা/২১১, সনদ ছহীহ; ইবনু জারীর তাবালী, তাহযীবুল আছার হা/১১১০।
[13]. মুসলিম হা/২৫৮৮; তিরমিযী হা/২০২৯; মিশকাত হা/১৮৮৯।
[14]. নাসাঈ হা/১২৯৭; মিশকাত হা/৯২২, সনদ ছহীহ।
[15]. মির‘আতুল মাফাতীহ ৩/২৬০।
[16]. বুখারী হা/৬৪৭৮; মিশকাত হা/৪৮১৩।
[17]. ইবনু হিববান হা/২৯৮৫; ছহীহুত তারগীব হা/২০৯৬, সনদ হাসান।
[18]. আহমাদ হা/২৩৯৯৮; ছহীহাহ হা/৩৩৭১, সনদ হাসান।
[19]. আহমাদ হা/১৭৯৯০; মিশকাত হা/৯৭৫, সনদ হাসান লিগায়রিহী।
[20]. তিরমিযীহা/৩৩৭৭; মিশকাতহা/২২৬৯, সনদ ছহীহ।
[21]. মুসনাদে ইবনিল জা‘দ, পৃ. ১১৩; আবূদাঊদ, আয-যুহদ, পৃঃ ১১৯।
[22]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/৩১৬৮; ছহীহুল জামে‘ হা/৩৭৬০, সনদ ছহীহ। রাবী আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ)।
[23]. ছান‘আনী, আত-তানবীর শারহু জামি‘ইছ ছাগীর ৬/৫৮০।
[24]. হাফেয জামালুদ্দীন মিয্যী, তাহযীবুল কামাল, ১৪/৪৬৪; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৯/৩৪৯।
[25]. আবূ নু‘আইম আস্ফাহানী, হিলয়াতুল আওলিয়া ৩/২২২।
[26]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, ৯/১৯৩।
[27]. আবূ নু‘আইম আস্ফাহানী, হিলয়াতুল আওলিয়া, ৬/৩২০।
[28]. ইবনুল জাওযী, ছিফাতুছ ছাফওয়া ২/৩৩০।