২। তেলাওয়াত রহিত; কিন্তু হুকুম বহাল (نسخ التلاوة دون الحكم) : হুকুম বহাল রেখেই কুরআনের কিছু আয়াত মানসুখ করা হয়েছে। যেমন, ব্যভিচারীকে রজম করার বিধান। এর তেলাওয়াত রহিত হয়ে গেছে কিন্তু এর হুকুম বা বিধান জারী আছে। এ ব্যাপারে একাধিক বর্ণনা রয়েছে, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে-

(ক) ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর বক্তব্য। তিনি বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে সত্য দ্বীনসহ পাঠিয়েছেন এবং তাঁর উপর কিতাব (কুরআন) অবতীর্ণ করেছেন। فَكَانَ مِمَّا أُنْزِلَ عَلَيْهِ آيَةُ الرَّجْمِ، قَرَأْنَاهَا وَوَعَيْنَاهَا وَعَقَلْنَاهَا، فَرَجَمَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَرَجَمْنَا بَعْدَهُ، فَأَخْشَى إِنْ طَالَ بِالنَّاسِ زَمَانٌ أَنْ يَقُولَ قَائِلٌ: مَا نَجِدُ الرَّجْمَ فِي كِتَابِ اللهِ فَيَضِلُّوا بِتَرْكِ فَرِيضَةٍ أَنْزَلَهَا اللهُ، وَإِنَّ الرَّجْمَ فِي كِتَابِ اللهِ حَقٌّ عَلَى مَنْ زَنَى إِذَا أَحْصَنَ مِنَ الرِّجَالِ وَالنِّسَاءِ، إِذَا قَامَتِ الْبَيِّنَةُ، أَوْ كَانَ الْحَبَلُ، أَوِ الِاعْتِرَافُ، ‘আল্লাহর নাযিলকৃত বিষয়ের মধ্যে রজমের আয়াত (ব্যভিচারের জন্য পাথর নিক্ষেপের আয়াত) রয়েছে। তা আমরা পাঠ করেছি, স্মরণ রেখেছি এবং হৃদয়ঙ্গম করেছি। সুতরাং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ব্যভিচারের জন্য রজম করার হুকুম বাস্তবায়ন করেছেন। তার পরবর্তী সময়ে আমরাও রজমের হুকুম বাস্তবায়িত করেছি। আমি ভয় করছি যে, দীর্ঘদিন অতিক্রান্ত হওয়ার পর কেউ এ কথা হয়তো বলবে যে, আমরা আল্লাহর কিতাবে রজমের নির্দেশ পাই না। তখন আল্লাহ কর্তৃক নাযিলকৃত এ ফরয কাজটি পরিত্যাগ করে তারা মানুষদেরকে পথভ্রষ্ট করে ফেলবে। নিশ্চয়ই আল্লাহর কিতাবে বিবাহিত নর-নারীর ব্যভিচারের শাস্তি রজম (পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা)-এর হুকুম বিদ্যমান। যখন সাক্ষ্য দ্বারা তা প্রমাণিত হয়, কিংবা গর্ভবতী হয়, অথবা সে নিজে স্বীকার করে’।[1]

(খ) উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ) বলেন,كَانَتْ سُورَةُ الْأَحْزَابِ تُوَازِي سُورَةَ الْبَقَرَةِ، فَكَانَ فِيهَا الشَّيْخُ وَالشَّيْخَةُ إِذَا زَنَيَا فَارْجُمُوهُمَا الْبَتَّةَ، ‘সূরা আহযাব আকারে সূরা বাক্বারার সমান ছিল। সেখানে ছিল ‘বৃদ্ধ নর ও নারী যেনায় লিপ্ত হ’লে তাদের উভয়কে অবশ্যই রজম করে ফেলবে’।[2]

হুকুম রহিত না করে শব্দ রহিত করার হিকমত ও তাৎপর্য হ’ল এই যে, যে আমলের শব্দ কুরআনে পাওয়া যায় না, তদনুযায়ী আমল করার ক্ষেত্রে উম্মাহকে পরীক্ষা করা এবং আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, সে বিষয়ে তাদের ঈমান যাচাই করা।

৩। তেলাওয়াত ও হুকুম উভয়টি রহিত হওয়া (نسخ التلاوة والحكم معًا) : আল কুরআনে এমন কিছু আয়াত ছিল যার তেলাওয়াত এবং হুকুম উভয়টি রহিত হয়ে গেছে। যেমন আয়েশা (রাঃ) বলেন,كَانَ فِيمَا أُنْزِلَ مِنَ الْقُرْآنِ: عَشْرُ رَضَعَاتٍ مَعْلُومَاتٍ يُحَرِّمْنَ، ثُمَّ نُسِخْنَ، بِخَمْسٍ مَعْلُومَاتٍ، فَتُوُفِّيَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَهُنَّ فِيمَا يُقْرَأُ مِنَ الْقُرْآنِ، ‘কুরআনে এ আয়াতটি নাযিল হয়েছিল ‘দশবার দুধপানে হারাম সাব্যস্ত হয়’। অতঃপর তা রহিত হয়ে যায় ‘পাঁচবার পান দ্বারা হারাম সাব্যস্ত হয়’ এর দ্বারা। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মৃত্যুবরণ করেন অথচ ঐ আয়াতটি কুরআনের আয়াত হিসাবে তেলাওয়াত করা হ’ত’।[3]

নাসেখ তথা রহিতকারী দলীলের দিক দিয়ে বিদ্বানগণ নাসখের আরো চারটি প্রকারভেদ বর্ণনা করেছেন। যেমন :

(১) ‘কুরআন দ্বারা কুরআনের বিধান রহিত করা’ (نسخ القرآن بالقرآن)। আল কুরআনের একটি আয়াত দ্বারা অন্য আরেকটি আয়াত বা একাধিক আয়াতের বিধান রহিত হওয়ার বিষয়টি বিদ্বানগণের নিকট স্বীকৃত। যেমন, (ক) আল্লাহ বলেন, وَإِنْ تُبْدُوا مَا فِي أَنْفُسِكُمْ أَوْ تُخْفُوْهُ يُحَاسِبْكُمْ بِهِ اللهُ، ‘তোমরা তোমাদের মনের কথা প্রকাশ কর বা গোপন রাখ, আল্লাহ তোমাদের কাছ থেকে তার হিসাব নিবেন’ (বাক্বারাহ ২/২৮৪)। পরে এটির হুকুম রহিত করে বলা হয়, لاَ يُكَلِّفُ اللهُ نَفْسًا إِلاَّ وُسْعَهَا ‘আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের বাইরে কষ্ট দেন না’ (বাক্বারাহ ২/২৮৬)

(খ) আল্লাহ বলেন,إِنْ يَكُنْ مِنْكُمْ عِشْرُوْنَ صَابِرُوْنَ يَغْلِبُوْا مِائَتَيْنِ، ‘যদি তোমাদের মধ্যে বিশজন দৃঢ়চিত্ত ব্যক্তি থাকে, তবে তারা দু’শোর মোকাবিলায় জয়ী হবে’ (আন‘ফাল ৮/৬৫)। পরবর্তীতে আল্লাহ বলেন, ‘এখন আল্লাহ তোমাদের উপর বোঝা হাল্কা করে দিয়েছেন এবং তিনি জেনে নিয়েছেন যে, তোমাদের মধ্যে দুর্বলতা এসে গেছে। অতএব এখন তোমাদের মধ্যে যদি একশ’ দৃঢ়চিত্ত ব্যক্তি থাকে তবে তারা দু’শোর উপরে জয়ী হবে। আর যদি এক হাযার থাকে, তবে জয়ী হবে দু’হাযারের উপরে আল্লাহর হুকুমে। আর আল্লাহ দৃঢ়চিত্ত লোকদের সাথে থাকেন’ (আনফাল ৮/৬৬)

(২) হাদীছ দ্বারা হাদীছের বিধান রহিত করা(نسخ السنة بالسنة)। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,نَهَيْتُكُمْ عَنْ زِيَارَةِ الْقُبُورِ فَزُورُوهَا، وَنَهَيْتُكُمْ عَنْ لُحُومِ الْأَضَاحِيِّ فَوْقَ ثَلَاثٍ، فَأَمْسِكُوا مَا بَدَا لَكُمْ، وَنَهَيْتُكُمْ عَنِ النَّبِيذِ إِلَّا فِي سِقَاءٍ، فَاشْرَبُوا فِي الْأَسْقِيَةِ كُلِّهَا، وَلَا تَشْرَبُوا مُسْكِرًا، ‘আমি তোমাদেরকে কবর বিয়ারত করতে নিষেধ করতাম। (এখন অনুমতি দিচ্ছি) তোমরা কবর যিয়ারত করতে পার। আমি ইতিপূর্বে তিনদিনের বেশী কুরবানীর গোশত রাখার ব্যাপারে তোমাদেরকে নিষেধ করতাম। এখন তোমাদের যতদিন ইচ্ছা রাখতে পার। এছাড়া আমি তোমাদেরকে পানির পাত্রে নাবীয তৈরি করতে নিষেধ করেছিলাম, এখন তোমরা যে কোন পানির পাত্রে তা তৈরি করতে পার। তবে নেশার বস্ত্ত (মাদকদ্রব্য) পান করো না’।[4] অত্র হাদীছে নাসেখ ও মানসূখ একত্রিত হয়েছে। এছাড়াও প্রথমে গৃহপালিত গাধার গোশত হালাল ছিল। পরবর্তীতে হাদীছের মাধ্যমে হারাম করা হয়েছে। আবার ঘোড়ার গোশত প্রথমে হারাম করা হয়েছিল। খায়বারের যুদ্ধের দিন ঘোড়ার গোশত হালাল করা হয়’।[5] অন্য দিকে মুত‘আ বিয়ে প্রথমে হালাল ছিল। খায়বার বিজয়ের দিন তা সম্পূর্ণরূপে হারাম করে দেওয়া হয়।[6] এরূপ বহু উদাহরণ রয়েছে।

(৩) কুরআন দ্বারা সুন্নাহর বিধান রহিত হওয়া (نسخ السنة بالقرآن)। কুরআন দ্বারা হাদীছ বা সুন্নাহর বিধান রহিত হওয়ার বিষয়টি প্রসিদ্ধ। যেমন, (ক) মদীনায় হিজরতের পর বায়তুল মুক্বাদ্দাসের দিকে মুখ ফিরিয়ে ছালাত আদায় করার হুকুমটি ছিল রাসূলের নির্দেশ তথা সুন্নাহ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু প্রায় ১৭ মাস পর এটা রহিত করে আয়াত নাযিল হয় এবং কা‘বা গৃহের দিকে মুখ করে ছালাত আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়। যেমন আল্লাহ স্বীয় নবীকে বলেন,قَدْ نَرَى تَقَلُّبَ وَجْهِكَ فِي السَّمَاءِ فَلَنُوَلِّيَنَّكَ قِبْلَةً تَرْضَاهَا فَوَلِّ وَجْهَكَ شَطْرَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَحَيْثُ مَا كُنْتُمْ فَوَلُّوا وُجُوْهَكُمْ شَطْرَهُ، ‘নিশ্চয়ই আমরা তোমাকে বারবার আকাশের দিকে তাকাতে দেখি। অতএব আমরা অবশ্যই তোমাকে সেই কেবলার দিকে ফিরিয়ে দেব, যাকে তুমি পসন্দ কর। এখন তুমি মাসজিদুল হারামের দিকে মুখ ফিরাও এবং তোমরা যেখানেই থাক তোমাদের চেহারাগুলিকে সেদিকেই ফিরিয়ে দাও’ (বাক্বারাহ ২/১৪৪)

(খ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) খন্দকের যুদ্ধের দিন ব্যস্ততার কারণে প্রায় পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত বিলম্ব করে আদায় করেন। পরবর্তীতে ‘ছালাতুল খাওফ’-এর আয়াত নাযিলের মাধ্যমে তা রহিত করা হয় এবং যুদ্ধের ময়দানেই ছালাত আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয় (বাক্বারাহ ২/২৩৯; নিসা ৪/১০৬)

(গ) অনুরূপভাবে ইতিপূর্বে আবশ্যিকভাবে পালিত আশূরার ছিয়াম ২য় হিজরী সনে রামাযানের ছিয়াম ফরয হওয়ার পর নফলে পরিণত হয়।[7]

(ঘ) রামাযানে দিনের পাশাপাশি রাতেও স্ত্রী সঙ্গম করা হাদীছে নিষেধ ছিল।[8] একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে আল্লাহ তা‘আলা এই বিধান রহিত করে রাতে স্ত্রী সঙ্গমের অনুমতি প্রদান করেন (বাক্বারাহ ২/১৮৭)

(৪) হাদীছ দ্বারা কুরআনের বিধান রহিত করা(نسخ القرآن بالسنة)। হাদীছ দ্বারা কুরআনের বিধান রহিত হওয়ার ব্যাপারে বিদ্বানগণ মতপার্থক্য করেছেন। ইমাম শাফেঈ, আহলে যাহের এবং ইমাম আহমাদ একটি বর্ণনায় এটিকে নাজায়েয বলেছেন। কেননা সুন্নাহ কুরআনের চাইতে উত্তম বা তার সমান নয়। অথচ আল্লাহ বলেছেন, ‘আমরা কোন আয়াত রহিত করলে বা ভুলিয়ে দিলে তার চেয়ে উত্তম বা তার সমমানের আয়াত আনয়ন করি’ (বাক্বারাহ ২/১০৬)

পক্ষান্তরে জমহুর ঊছূলবিদ, ইমাম মালেক, আবু হানীফা ও আহমাদ (রহঃ) অন্য একটি বর্ণনায় এবং ইমাম শানক্বীতী (রহঃ) এটাকে জায়েয বলেছেন। কেননা তারা বলেন যে, কুরআন ও হাদীছ দু’টিই আল্লাহর অহী। আর আল্লাহ বলেছেন, وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى- إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوْحَى، ‘তিনি নিজ খেয়াল-খুশীমতে কোন কথা বলেন না। যা বলেন অহি মোতাবেক বলেন’ (নাজম ৫৩/৩-৪)। তিনি আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন,وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُوْلُ فَخُذُوْهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوْا، ‘রাসূল তোমাদের যা নির্দেশ দেন তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন তা থেকে বিরত হও’ (হাশর ৫৯/৭)। তিনি স্বীয় রাসূলকে বলেন,قُلْ مَا يَكُوْنُ لِيْ أَنْ أُبَدِّلَهُ مِنْ تِلْقَاءِ نَفْسِي إِنْ أَتَّبِعُ إِلَّا مَا يُوْحَى إِلَيَّ ‘তুমি তাদের বলে দাও একে (কুরআনকে) নিজের পক্ষ থেকে পরিবর্তন করা আমার কাজ নয়। আমি কেবল তারই অনুসরণ করি যা আমাকে অহী করা হয়’ (ইউনুস ১০/১৫)

সূরা বাক্বারার ১০৬নং আয়াতে نَأْتِ بِخَيْرٍ مِنْهَا ‘তার চেয়ে উত্তম আনয়ন করি’ অর্থ উত্তম বিধান ও কল্যাণকর আদেশ নাযিল করি। আর এ ব্যাপারে সুন্নাহ কুরআনের সমপর্যায়ভুক্ত।[9] যেমন পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের জন্য অছিয়ত করে যাওয়ার হুকুম কুরআনে এসেছে, كُتِبَ عَلَيْكُمْ إِذَا حَضَرَ أَحَدَكُمُ الْمَوْتُ إِنْ تَرَكَ خَيْرًا الْوَصِيَّةُ لِلْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِيْنَ بِالْمَعْرُوْفِ حَقًّا عَلَى الْمُتَّقِيْنَ، ‘যখন তোমাদের কারও মৃত্যু এসে যায় এবং সে যদি কোন ধন-সম্পদ ছেড়ে যায়, তাহ’লে তার উপর অছিয়ত বিধিবদ্ধ করা হ’ল স্বীয় পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের জন্য ইনছাফের সাথে। মুত্তাক্বীদের জন্য এ নির্দেশ অবশ্য পালনীয়’ (বাক্বারাহ ২/১৮০)। পরে বিদায় হজ্জের ভাষণে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ওয়ারিছদের জন্য অছিয়ত নিষিদ্ধ করে যান এবং বলেন,إِنَّ اللهَ قَدْ أَعْطَى كُلَّ ذِىْ حَقٍّ حَقَّهُ فَلاَ وَصِيَّةَ لِوَارِثٍ، ‘আল্লাহ প্রত্যেক হকদারের হক নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। অতএব এখন থেকে কোন ওয়ারিছের জন্য কোন অছিয়ত নেই’।[10] উল্লেখ্য যে, ইতিপূর্বে মীরাছ বণ্টনের আয়াত সমূহ নাযিল হয় (নিসা ৪/১১-১২)। অতএব আল্লাহর রাসূলের যবানে যা আমাদের নিকটে এসেছে, তা আল্লাহর নিকট থেকে আসার মতই। কেননা সেটাও আল্লাহর অহী। অমনিভাবে কুরআনের কোন আয়াত মানসূখ হয়ে গেছে। কিন্তু তার হুকুম বাকী আছে সুন্নাহর মাধ্যমে। যেমন, الشَّيْخُ وَالشَّيْخَةُ إِذَا زَنَيَا فَارْجُمُوْهُمَا الْبَتَّةَ، ‘বৃদ্ধ-বৃদ্ধা যখন যেনা করবে, তখন তাদের উভয়কে অবশ্যই ‘রজম’ করবে। এ আয়াতটির তেলাওয়াত রহিত করা হয়েছে। কিন্তু হুকুম বাকী রাখা হয়েছে সুন্নাহর মাধ্যমে। যেমন ওবাদাহ বিন ছামেত (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, وَالثَّيِّبُ بِالثَّيِّبِ جَلْدُ مِائَةٍ وَالرَّجْمُ، ‘বিবাহিত দু’জনে ব্যভিচার করলে তাদের একশত বেত্রাঘাত এবং রজম’।[11]

নাসখের হিকমত ও উপকারিতা :

রহিতকরণ এর অনেক হিকমত ও তাৎপর্য রয়েছে। তন্মধ্যে অন্যতম হ’ল-

(১) বান্দার দ্বীন-দুনিয়ার জন্য অধিকতর উপকারী শরী‘আত প্রণয়নের মাধ্যমে তাদের কল্যাণের দিকে লক্ষ্য রাখা।

(২) আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে তাঁর সৃষ্টির প্রতি করুণা, তাদের জন্য শরী‘আতের বিধান হালকাকরণ এবং তাদের জন্য প্রশস্ততা। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ চান তোমাদের উপর বোঝা হাল্কা করতে’ (নিসা ৪/২৮)

(৩) মুমিনদের জন্য পুরস্কার বৃদ্ধি করা এবং তাদের জন্য তা আরও বাড়িয়ে দেওয়া। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘নিঃসন্দেহে ধৈর্যশীলগণ তাদের পুরস্কার পাবে অপরিমিত ভাবে’ (যুমার ৩৯/১০)

(৪) নাসখ বা রহিতকরণের মধ্যে একটি বহির্মুখী হিকমত জড়িত। সেটি হ’ল যদি রহিতকরণের সাথে রহিতকারীর সাদৃশ্য থাকে, যেমন পবিত্র বায়তুল্লাহর দিকে মুখ করে ছালাত আদায়ের বিধানের মাধ্যমে বায়তুল মুক্বাদ্দাসের দিকে মুখ করে ছালাত আদায়ের বিধান রহিত করা। দু’টি দিক, উভয় দিকই একে অপরের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ এবং তাদের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই, তবে রহিতকরণের সাথে (আল্লাহর পবিত্র ঘরের দিকে মুখ করা), একটি গভীর হিকমত জড়িত, যা নবী করীম (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে ইহূদীদের যুক্তি ও মুশরিকদের যুক্তিকে খন্ডন করে। ইহূদীরা তাদের বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়ে বলেছিল, তুমি আমাদের ধর্মের সমালোচনা করছো এবং আমাদের কিবলার দিকে মুখ করে ছালাত আদায় করছ। তারা আরও বলে যে, তাদের কিতাবে আছে যে, তিনি বায়তুল মুক্বাদ্দাসের দিকে মুখ করে ছালাত আদায় করার নির্দেশ দেন। অতঃপর আল্লাহর পবিত্র কা‘বা ঘরের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বলা হয়েছিল।

আর মুশরিকরা বলে, তোমরা দাবী করো যে তোমরা ইব্রাহীম (আঃ)-এর ধর্ম অনুসরণ করো এবং তাঁর ক্বিবলা বাদ দিয়ে অন্য দিকে মুখ করে ছালাত পড়ছ। আল্লাহ তা‘আলা এই বিধানটি এভাবে নির্দেশ করেছেন যে, ‘যাতে মানুষের তোমাদের বিরুদ্ধে কোন যুক্তি না থাকে’ (বাক্বারাহ ২/১৫০)

(৫) এর আরেকটি হিকমত হ’ল, শক্তিশালী এবং দুর্বল ঈমান দারের মধ্যে পার্থক্য করা। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আর যে ক্বিবলার উপরে তুমি ছিলে, সেটাকে আমরা এজন্যেই নির্ধারণ করেছিলাম যাতে আমরা জানতে পারি, কে এই রাসূলের অনুসরণ করে, আর কে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে’ (বাক্বারাহ ২/১৪৩)

(৬) সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের ব্যাপারে পরীক্ষা এবং বান্দাকে মেনে চলার উদ্যোগ নেওয়ার ব্যাপারে যাচাই করা। এটা তখনই হয় যখন আল্লাহ তাঁর বান্দাকে কিছু করার নির্দেশ দেন এবং সে তা মেনে চলে, তারপর তাকে সেই কাজের বিপরীত কাজ করার নির্দেশ দেন এবং সে তাও মেনে চলে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা ইব্রাহীম (আঃ)-কে আদেশ দিয়েছিলেন, তাঁর পুত্রকে যবেহ করার জন্য। তারপর তিনি তা করার আগেই মহান কুরবানীর মাধ্যমে তাকে মুক্ত করে এই বিধানটি বাতিল করেছিলেন। এই নির্দেশের পিছনে হিকমত হ’ল বান্দাকে পরীক্ষা করা। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই, এটিই স্পষ্ট পরীক্ষা’ (আছ-ছাফফাত ৩৭/১০৬)। তাই আল্লাহ তাঁর নবীকে তাঁর প্রতি ভালোবাসার মাধ্যমে পরীক্ষা করলেন। উদ্দেশ্য ছিল পরীক্ষা, কর্ম বাস্তবায়ন নয়।

(৭) এক হুকুম থেকে পরিবর্তন করে অন্য হুকুম গ্রহণ করতে প্রস্ত্তত থাকা এবং তাতে সন্তুষ্ট থাকার ব্যাপারে মুকাল্লাফ তথা শরী‘আতের হুকুম পালনে দায়িত্বপ্রাপ্তদের পরীক্ষা করা।

(৮) রহিতকরণ সাধিত হয়ে তুলনামূলক সহজ বিধান আসলে শুকরিয়া আদায় করা এবং তুলনামূলক কঠিন বিধান আসলে তাতে ধৈর্য ধারণ করার ব্যাপারে মুকাল্লাফদের পরীক্ষা করা।

(৯) মানসূখ তথা রহিত বিধান অপেক্ষা নাসেখ তথা রহিতকারী বিধান উত্তম হওয়ার ব্যাপারে জ্ঞান লাভ করা। আল্লাহ বলেন, আমরা কোন আয়াত রহিত করলে কিংবা তা ভুলিয়ে দিলে তদপেক্ষা উত্তম অথবা অনুরূপ আয়াত আনয়ন করি। তুমি কি জানো না যে, আল্লাহ সকল কিছুর উপরে ক্ষমতাশালী? (বাক্বারাহ ২/১০৬)

উপসংহার :

শরী‘আতের বিধি-বিধান সঠিক পন্থায় জানা এবং আমল করার জন্য নাসেখ ও মানসূখের বিধান জানা অপরিহার্য। কারণ অজ্ঞতার কারণে রহিত বিধানের উপর আমল করলে যেমন আমল বাতিল হয়ে যেতে পারে, তেমনি ঈমান ক্ষতিগ্রস্ত হ’তে পারে। মুত‘আ বিবাহ হালাল হওয়া সম্পর্কিত হাদীছগুলো পড়ে কেউ তদনুযায়ী আমল করলে সে অবশ্যই গুনাহগার হবে। আবার ঘোড়ার গোশত প্রাথমিকভাবে হারাম থাকলেও পরবর্তীতে তথা খায়বারের যুদ্ধের দিন তা হালাল করা হয়েছিল। বিধান না জানার কারণে মুসলিম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অতএব প্রত্যেক মুসলিমের উচিৎ নাসেখ ও মানসূখের বিধান জেনে তদনুযায়ী আমল করা। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন। আমীন!

মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম

* সিনিয়র শিক্ষক, রাজশাহী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ।


[1]. মুসলিম হা/১৬৯১; মিশকাত হা/৩৫৫৭।

[2]. ছহীহাহ হা/২৯১৩।

[3]. মুসলিম হা/১৪৫২; মিশকাত হা/৩১৬৭।

[4]. মুসলিম হা/৯৭৭; মিশকাত হা/১৭৬২।

[5]. বুখারী হা/৫৫২০

[6]. বুখারী হা/৫১১৫

[7]. তিরমিযী হা/৭৫৩; আবূদাঊদ হা/২৪৪৩।

[8]. কুরতুবী ২/৩১৪

[9]. মির‘আত ১/২৯৮।

[10]. তিরমিযী, আবূদাঊদ, সনদ ছহীহ, মিশকাত হা/৩০৭৩।

[11]. মুসলিম হা/১৬৯০; আহমাদ হা/১৫৯৫১।






আদর্শ শিক্ষকের গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
ইখলাছ - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
আল্লাহ যার কল্যাণ চান - আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মীরাছ বণ্টন : শারঈ দৃষ্টিকোণ - ড. শিহাবুদ্দীন আহমাদ, শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, রাজশাহী
ঈদায়নের কতিপয় মাসায়েল - আত-তাহরীক ডেস্ক
বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব ও তাৎপর্য (পূর্বে প্রকাশিতের পর) - ইহসান ইলাহী যহীর
আশূরায়ে মুহাররম - আত-তাহরীক ডেস্ক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় মুসলিম চেতনা - মুহাম্মাদ সিরাজুল ইসলাম, যশোর
মহামনীষীদের পিছনে মায়েদের ভূমিকা (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
আশূরায়ে মুহাররম - আত-তাহরীক ডেস্ক
আহলেহাদীছ জামা‘আতের বিরুদ্ধে কতিপয় মিথ্যা অপবাদ পর্যালোচনা (৪র্থ কিস্তি) - তানযীলুর রহমান - শিক্ষক, বাউটিয়া দাখিল মাদ্রাসা, রাজশাহী
আদর্শ চিকিৎসকের করণীয় ও গুণাবলী - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
আরও
আরও
.