শাহ ইসমাঈল শহীদ (১৭৭৯-১৮৩১) ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশে আহলেহাদীছ আন্দোলনের বীর সিপাহসালার। ৩০ হাযার হাদীছের হাফেয এই বরেণ্য আলেমে দ্বীন ও মুজাহিদ ভারতগুরু শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভীর (১৭০৩-১৭৬২) পৌত্র, শাহ আব্দুল গনীর (১৭৫৮-১৮১২) পুত্র, শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিছ দেহলভী (১৭৪৭-১৮২৪), শাহ আব্দুল কাদের (১৭৫৫-১৮৩৮) ও শাহ রফীউদ্দীনের (১৭৫০-১৮১৮) প্রাণাধিক প্রিয় ভাতিজা ছিলেন। শাহ ওয়ালীউল্লাহ পরিবারের গৌরব এই কর্মবীর ছিলেন শিরক-বিদ‘আতের বিরুদ্ধে আপোষহীন ব্যক্তিত্ব। দাওয়াত ও জিহাদের মাধ্যমে আহলেহাদীছ আন্দোলনের প্রচার-প্রসারে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।

জন্ম ও শৈশব :

দ্বিতীয় খলীফা ওমর ফারূক (রাঃ)-এর ৩৩তম অধঃস্তন পুরুষ শাহ মুহাম্মাদ ইসমাঈল বিন শাহ আব্দুল গনী বিন শাহ ওয়ালীউল্লাহ বিন আব্দুর রহীম দেহলভী ১১৯৩ হিজরীর ১২ই রবীউছ ছানী মোতাবেক ১৭৭৯ সালের ২৯শে এপ্রিল মুযাফ্ফর নগর যেলার ফুলাতে তাঁর মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মাতার নাম ফাতিমা।

শাহ ইসমাঈল দিল্লীর যে ঐতিহ্যবাহী আলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সে পরিবারের সদস্যদের কর্ণকুহরে শৈশব থেকেই ক্বালাল্লাহ ও ক্বালার রাসূল (ছাঃ) ধ্বনি গুঞ্জরিত হত। জীবনীকার আবুল হাসান নাদভী বলেন, ‘যেসব ইলমী কথা, মাসআলা-মাসায়েল, হালাল-হারাম ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়াবলী ধর্মপ্রাণ লোকদেরকে বই-পত্র পড়ে জানতে হয়, সেগুলো শাহ ইসমাঈল পারিবারিক আলাপ-আলোচনা ও কিসসা-কাহিনীর মাধ্যমেই অবগত হয়ে যান। শিক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে এই শিক্ষা খুবই পূর্ণাঙ্গ ছিল, যা খুব কম সৌভাগ্যবানের কপালেই জোটে’ (সীরাতে সাইয়িদ আহমাদ শহীদ, পৃঃ ৩৭৩)

শিক্ষা-দীক্ষা :

মাত্র ৬ বছর বয়সে পিতা শাহ আব্দুল গনীর কাছে তাঁর শিক্ষাজীবনের শুভ সূচনা হয়। ৮ বছর বয়সে তিনি কুরআন মাজীদ হিফয (মুখস্থ) সমাপ্ত করেন। জীবনীকার মিরযা হায়রাত দেহলভী বলেন, ‘এই হিফয তোতাপাখির মতো ছিল না; বরং তাকে পুরা কুরআন মাজীদের অর্থও পড়ানো হয়েছিল’ (হায়াতে তাইয়িবা, পৃঃ ৩৭)। ১১ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি নাহু-ছরফের প্রাথমিক গ্রন্থসমূহ অধ্যয়ন করেন। মাত্র ১০ বছর বয়সে শাহ ইসমাঈলের পিতা মৃত্যুবরণ করেন। পিতার মৃত্যুর পর চাচা শাহ আব্দুল কাদের-এর নিকট তিনি নিজের সন্তানের মতো লালিত-পালিত হন ও তাঁর তত্ত্বাবধানে পড়াশোনা অব্যাহত থাকে। এরপর বড় চাচা শাহ আব্দুল আযীয-এর নিকটে মা‘কূলাত ও মানকূলাত-এর পাঠ গ্রহণ করেন। শাহ রফীউদ্দীনের নিকটও তিনি জ্ঞানার্জন করেন।

বাল্যকাল থেকেই শাহ ইসমাঈল তীক্ষ্ম ধীশক্তির অধিকারী ছিলেন। নওয়াব ছিদ্দীক হাসান খান ভূপালী বলেন, ‘তাঁর মেধা ছিল অত্যন্ত তীক্ষ্ম এবং তাঁর প্রখর প্রতিভা ও বুদ্ধিবৃত্তির কাহিনী আজো সুধীমহলে আলোচনার বিষয়বস্ত্ত হয়ে রয়েছে’। আবুল হাসান নাদভী বলেন, ‘তিনি মাদরাসা সমূহের মধ্যম মানের বা মেধাবী ছাত্রদের মতো ছিলেন না, পাঠ্যপুস্তকের মর্ম বুঝাই যাদের মেধার বড় পরিচয় ছিল। তিনি গবেষণাধর্মী মেধার অধিকারী ছিলেন এবং অনেক পাঠ্যপুস্তকের লেখক ও ব্যাখ্যাকারদের চেয়ে বেশি মেধা ও ইলমী যোগ্যতা রাখতেন’ (সীরাতে সাইয়িদ আহমাদ শহীদ, পৃঃ ৩৭৪)। চাচা শাহ আব্দুল কাদেরের কাছে তিনি ‘আল-উফুকুল মুবীন’ নামক উঁচু স্তরের কিতাব পড়তেন। দু’চার পাতা পড়ার পর তিনি শাহ আব্দুল কাদেরকে কোন বিষয়ে জিজ্ঞেস করতেন এবং তিনি তা বলে দিতেন। অন্যথা ঐভাবেই পড়তে থাকতেন। ঐ সময় প্রখ্যাত হানাফী আলেম ফযলে হক খায়রাবাদী একদা দিল্লী এসে শাহ আব্দুল কাদেরের দারসে বসেন। তিনি শাহ ইসমাঈলকে উক্ত গ্রন্থ থেকে কিছু জিজ্ঞেস করতে বললে খায়রাবাদী একটি বিষয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করেন। ইসমাঈল তাকে সঠিক জবাব প্রদান করেন। ফযলে হক তার প্রত্যুত্তর প্রদান করেন। পাল্টা শাহ ইসমাঈল তাঁকে যুক্তিপূর্ণ জবাব দিয়ে নিরুত্তর করে দেন।

তিনি ‘ছাদরা’র (হিকমত বা দর্শন বিষয়ক গ্রন্থ) মতো কিতাব বিনা মুতালা‘আয় ৮/১০ পৃষ্ঠার কম পড়তেন না। পরে কখনো ঐসব পাঠের পুনরাবৃত্তিও করতেন না (তারাজিম, পৃঃ ৯২)। শৈশবে পড়াশোনার চেয়ে খেলাধূলার প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল বেশি। ছাত্রজীবনে তিনি তীরন্দাযী, গুলী চালানো, শিকার, ঘোড়দৌড়, লাঠিখেলা ও সাঁতার কাটতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। শাহ আব্দুল আযীয একদিন তাকে বললেন, তুমি খেলাধূলায় বেশি সময় অতিবাহিত করছ, পড়াশোনা করছ না। জবাবে শাহ ইসমাঈল বললেন, আমাকে পঠিত বিষয় থেকে কিছু জিজ্ঞেস করুন। শাহ ছাহেব দু’একটি প্রশ্ন করলে তিনি অত্যন্ত সুন্দরভাবে জবাব দিয়ে দেন (তারাজিম, পৃঃ ৯৩; হায়াতে তাইয়িবা, পৃঃ ৪১)। ১৫/১৬ বছর বয়সে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। শিক্ষা সমাপনের পর বিভিন্ন মাসআলার সমাধানকল্পে তাঁর কাছে বড় বড় আলেম-ওলামা পর্যন্ত ছুটে আসতে শুরু করেন। রাস্তাঘাটে বিভিন্ন ধর্মীয় বিষয়ে তাঁরা তাঁকে যেসব জটিল প্রশ্ন করতেন তিনি প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের সাথে সেসবের চমৎকার যুক্তিগ্রাহ্য ও দলীলসম্মত উত্তর প্রদান করতেন। এতে তারা বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়তেন। ফিকহ সংক্রান্ত যেকোন প্রশ্নের উত্তরে তিনি কুরআন ও হাদীছ থেকে দলীল পেশ করতেন। স্যার সৈয়দ আহমাদের মতে শাহ ইসমাঈলের যুক্তিক্ষমতা এ্যারিস্টটলকেও হার মানাতো এবং তাঁর দার্শনিক যুক্তিও শাহ ছাহেবের যুক্তির কাছে মাকড়সার জালের মতোই ছিন্নভিন্ন হয়ে যেত।

দাওয়াত ও তাবলীগ :

সাইয়িদ আহমাদ ব্রেলভীর হাতে বায়‘আত গ্রহণের পর তিনি দ্বীনের পুনরুজ্জীবন ও শিরক-বিদ‘আতের প্রতিরোধ মিশনে সারা জীবনকে উৎসর্গ করে দেন। এক্ষেত্রে বক্তৃতা ছিল তাঁর অন্যতম হাতিয়ার। তিনি ছিলেন অনলবর্ষী বাগ্মী। তাঁর বক্তব্যের মধ্যে যাদুকরী মোহিনী শক্তি নিহিত ছিল। তাঁর হৃদয়গ্রাহী বক্তব্য শুনে মুসলমানদের মনের দর্পণ স্বচ্ছ ও আলোকদীপ্ত হয়ে উঠত। বুধবার ও শুক্রবার তিনি দিল্লীর শাহী জামে মসজিদে ওয়ায-নছীহত করতেন। জুম‘আর দিনে তাঁর বক্তব্য শোনার জন্য মানুষের এতো উপচেপড়া ভীড় হত, যেমন দুই ঈদের ছালাতে হয়ে থাকে। তিনি খুব সহজ-সরলভাবে তাঁর বক্তব্য জনগণের সামনে পেশ করতেন। আলেম ও সাধারণ মানুষ সবার মনেই তাঁর বক্তব্য সমানভাবে দাগ কাটত। কুরআন মাজীদের কয়েকটি আয়াত পড়ে তার তাফসীর শুরু করলে শ্রোতাদের অন্তরে আল্লাহভীতির স্ফূরণ ঘটত। তাদের চোখ হয়ে উঠত অশ্রুসজল। অবিরতধারায় গড়িয়ে পড়ত অশ্রুবন্যা।

দিল্লীর শাহী জামে মসজিদে পবিত্র রামাযান মাসের শেষ জুম‘আর ছালাত সমাপ্ত হয়েছে, কিন্তু তখনো মুছল্লীরা স্ব স্ব স্থানেই বসেছিলেন। সেদিন সেখানে বড় বড় আলেম ও বক্তারা উপস্থিত ছিলেন। প্রথম কাতারে শাহ ইসমাঈল শহীদ বসে ছিলেন। সবাই তাঁর বক্তব্য শোনার জন্য উদগ্রীব ছিলেন। তিনি সামনে উঠে গিয়ে- بسم الله الرحمن الرحيم. لا إله إلا الله وحده لا شريك له له الملك وله الحمد وهو على كل شيئ قدير. (পরম করুণাময় ও দয়ালু আল্লাহ্র নামে শুরু করছি। আল্লাহ ব্যতীত কোন (হক্ব) উপাস্য নেই। তিনি একক। তাঁর কোন শরীক নেই। তাঁর জন্যই সকল রাজত্ব ও সকল প্রশংসা। তিনিই সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাবান) পড়ে তাঁর বক্তব্য শুরু করলেন। তিনি তাওহীদ, শিরক, কবরপূজা, তা‘যিয়া মিছিল এবং গায়রুল্লাহ্র জন্য নযর-নিয়ায পেশ করা প্রভৃতি বিষয়ের অবতারণা করে এক সারগর্ভ বক্তব্য প্রদান করলেন। জুম‘আর ছালাতের পর থেকে আছর ছালাতের সময় পর্যন্ত প্রলম্বিত বক্তৃতা শ্রোতারা পিনপতন নীরবতার সাথে শুনে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়ে। ঐ সময় শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিছ দেহলভীও সেখানে বসা ছিলেন। প্রথমবারের মতো তাওহীদ ও শিরক সম্পর্কে ব্যতিক্রমধর্মী বক্তব্য শুনে সেদিন সবাই স্তম্ভিত হয়েছিল। বিদ‘আতীদের অন্তর্দহন বেড়ে গিয়েছিল (হায়াতে তাইয়িবা, পৃঃ ৬৭-৮২; তারাজিম, পৃঃ ৯৫-৯৬)

একবার মুহাররম মাসে দিল্লীর কেল্লায় তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হল। বাদশাহ দ্বিতীয় আকবর শাহও মজলিসে উপস্থিত ছিলেন। শাহ ইসমাঈল একটি আয়াত পাঠ করে হুসাইন (রাঃ)-এর ধৈর্যের কাহিনী এমন সুন্দরভাবে বর্ণনা করলেন যে, তাঁর মহান চরিত্র শ্রোতাদের সামনে একটি নিখুঁত চিত্রের মতো ভেসে উঠল (আহলেহাদীছ আওর সিয়াসাত, পৃঃ ৯৭)। শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিছ দেহলভী তাইতো বলতেন, ‘আমার বক্তব্যের স্টাইল ইসমাঈল এবং লেখনী রশীদুদ্দীন নিয়ে নিয়েছে’।

খ্যাতিমান হানাফী আলেম ও বাগ্মী মুফতী ছদরুদ্দীন খাঁ পূর্ব প্রস্ত্ততি নিয়ে আয়াত সংখ্যা উল্লেখপূর্বক বক্তৃতা করতেন। কিন্তু এতদসত্ত্বেও শাহ ইসমাঈল শহীদের কুরআন মাজীদের সূক্ষ্ম তাফসীর তাঁকে বিস্ময়াভিভূত করে দিত। একবার শাহ ইসমাঈল কোন এক জালসায় কুরআন মাজীদের একটি রুকূ সম্পর্কে বক্তৃতা করছিলেন। সেই জালসায় মৌলবী ইমাম বখশ সাহবায়ী, মৌলভী আব্দুল্লাহ খান ও মুফতী ছদরুদ্দীন উপস্থিত ছিলেন। শাহ ছাহেবের বক্তৃতা শুনে তাঁরা এতটাই প্রভাবিত ও মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, অন্য এক উপলক্ষে ঐ জালসায় তাফসীরকৃত রুকূর পুনঃতাফসীর করার অনুরোধ জানান। শাহ ইসমাঈল পূর্বোক্ত রুকূ পড়ে তাফসীর করেন। কিন্তু পূর্বের চেয়ে তা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদের। তিনি অত্যন্ত সুন্দরভাবে পঠিত রুকূর এমন হৃদয়গ্রাহী তাফসীর করেন যে, শ্রোতারা প্রথম দিনের চেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়। তৃতীয় দফায় ঐ রুকূরই ব্যাখ্যা করার অনুরোধ জানানো হলে পূর্বের দু’বারের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে তাফসীর করেন। ফলে তাঁর চমৎকার বর্ণনাভঙ্গি নতুন রূপে ঔজ্জ্বল্য ছড়াতে থাকে।

তিনি একদা দিল্লীর জামে মসজিদের পার্শ্বস্থ বাজারে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করছিলেন। ইত্যবসরে হেদায়াতুল্লাহ নামে এক হিজড়া হাতে মেহেদী ও চুড়ি, পায়ে মল এবং শরীরে লাল কাপড় পরিধান করে শাহ ছাহেবের নিকটে এসে দাঁড়িয়ে তাঁর বক্তব্য শুনতে লাগে। তিনি তাকে দেখে নারী সাজ গ্রহণের জন্য আল্লাহ্র পাকড়াও এবং আখিরাতের শাস্তির কথা এমন জোরালোভাবে বর্ণনা করেন যে, হিজড়া তৎক্ষণাৎ ওখানে বসেই চুড়ি চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়, গহনা খুলে ফেলে দূরে নিক্ষেপ করে এবং হাত-পায়ের মেহেদীর রং দূর করার জন্য এমনভাবে ঘর্ষণ করে যে, শরীর থেকে রক্ত বের হতে থাকে। বক্তব্য শেষে সে তওবা করে তাঁর খাদেমে পরিণত হয় এবং আকূড়াহ-এর যুদ্ধে ৭/৮ জন শিখকে হত্যা করে শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করে।

একবার তিনি দিল্লীর মাদরাসা রহীমিয়ার দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। সে সময় কিছু সুসজ্জিত যুবতীকে বিনা পর্দায় কোথাও যেতে দেখলেন। জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পারলেন যে, এরা পতিতা। তিনি বললেন, এরা আমাদের মুসলমান বোন। এদেরকে নছীহত না করলে আল্লাহ আমাকে পরকালে জিজ্ঞেস করবেন, ওদেরকে পাপাচারে লিপ্ত দেখে তুমি কেন নছীহত করনি। একথা বলে তিনি পততা পল্লীতে যাওয়ার সংকল্প ব্যক্ত করেন। বন্ধুরা তাঁকে সেখানে যেতে চরমভাবে নিষেধ করেন। কিন্তু তিনি সবার নিষেধকে উপেক্ষা করে রাতের বেলায় ফকীরের বেশে দরজায় গিয়ে কড়া নাড়েন। একজন পতিতা এসে জিজ্ঞেস করে, আপনি কে? উত্তরে তিনি বলেন, আমি ফকীর। আমি তোমাদের গান শুনাব ও তামাশা দেখাব। সে তাঁকে ভিতরে নিয়ে যায়। তিনি জানতে পারেন যে, পতিতা সর্দারনী বালাখানায় আগত লোকদের সাথে নববর্ষ উদযাপন করছে ও তাদের মনোরঞ্জনে ব্যস্ত আছে। তিনি সেখানে গিয়ে উপস্থিত হন। ছদ্মবেশে থাকলেও দিল্লীর এই মুকুটহীন সম্রাটকে সে চিনে ফেলে এবং সসম্মানে চেয়ারে বসতে দেয়। অন্য মহিলারা বিছানায় বসে পড়ে। তিনি পকেট থেকে ছোট্ট কুরআন শরীফ বের করে পড়তে শুরু করেন। এরপর দুনিয়াবী ভোগ-বিলাসের ক্ষণস্থায়িত্ব, কবরের আযাব, কিয়ামতের ভয়াবহতা, ব্যভিচারের কঠিন শাস্তি সম্পর্কে এমন তেজোদীপ্ত বক্তব্য প্রদান করেন যে, চতুর্দিকে কান্নার রোল পড়ে যায়। তাদেরকে তওবার কথা বলে সান্ত্বনা দিয়ে বিবাহের ফযীলত বর্ণনা করেন। তাঁর বক্তব্যের ফলে ২৯ জন যুবতী পতিতা বেশ্যাবৃত্তি পরিত্যাগ করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় এবং বয়ষ্ক পতিতারা পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কথিত আছে যে, পরবর্তীতে ঐ পতিতালয়ের সর্দারনী কোহেস্তানে গাযীদের ঘোড়ার জন্য দানা পিষত (হায়াতে তাইয়িবা, পৃঃ ১৫১-১৫৪; তারাজিম, পৃঃ ৯৭-৯৮)

একবার বাদশাহ দ্বিতীয় আকবর শাহ তাঁকে শাহী দরবারে তলব করেন। তিন দরবারে গিয়ে বাদশাহর হাতে সোনার আংটি দেখে তাঁকে উপদেশের স্বরে বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পুরুষদের জন্য সোনা ব্যবহার হারাম ঘোষণা করেছেন। তাঁর কথা শুনে বাদশাহ আংটি খুলে ফেলে মানতের জন্য পেশ করেন। কিন্তু শাহ ইসমাঈল উহার মূল্য মিসকীনদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়ার জন্য বলেন। এভাবে তাঁর ওয়ায-নছীহতে বহু লোক শিরক-বিদ‘আত ও হারাম বর্জন করে হেদায়াতের আলোয় উদ্ভাসিত হয়। জীবনীকার মিরযা হায়রাত দেহলভী লিখেছেন, ‘এমন কোনদিন অতিবাহিত হত না যেদিন তাঁর বক্তৃতা শুনে ৫/১০ জন হিন্দু মুসলমান হত না ও ডজন ডজন বিদ‘আতী তওবা করত না’ (হায়াতে তাইয়িবা, পৃঃ ১৪১)

শাহ ইসমাঈল শহীদ বক্তৃতা জগতে পদার্পণের কিছুদিন পরে সাইয়িদ আহমাদ শহীদের ইঙ্গিতে বক্তৃতায় জিহাদের প্রসঙ্গ অবতারণা করা শুরু করেন। তাঁর জিহাদী বক্তব্য শুনে সবাই জিহাদী জোশে উদ্বুদ্ধ হত এবং প্রত্যেকেই আল্লাহ্র পথে শহীদ হতে ব্যাকুল হয়ে উঠত।

প্রতিক্রিয়া ও ষড়যন্ত্র :

শাহ ইসমাঈল শহীদের বক্তব্য বিদ‘আতী, কবরপূজারী ও ভন্ড ছূফীদের অন্তর্জ্বালার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। খ্যাতিমান হানাফী আলেম ফযলে হক খায়রাবাদী তাঁর সাথে এক বিতর্কে পরাজিত হয়ে তাঁর বাগ্মী প্রতিভাকে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য ১৫০০ মুসলমানের সই নিয়ে ‘রেসিডেন্টে’র (ভারতে নিযুক্ত বৃটেনের রাণীর প্রতিনিধি) নিকট পেশ করেন। ফলে তাঁর বক্তব্য প্রদানের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। দিল্লীর শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিছ দেহলভীকে বলেন, আপনি মৌলভী ইসমাঈলকে এমন বক্তব্য প্রদান করতে নিষেধ করেন যার কারণে পরবর্তীতে তাকে এমন লাঞ্ছনার শিকার না হতে হয়। প্রত্যুত্তরে তিনি সবাইকে সাফ জানিয়ে দেন, যতক্ষণ পর্যন্ত ইসমাঈলের নিকট থেকে শরী‘আত বিরোধী কোন কাজ সংঘটিত না হয়, ততক্ষণ আমি তাকে কিভাবে বাধা দিতে পারি? সে কোন বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী বক্তব্য প্রদান করে না যে, আমি তাকে বাধা প্রদান করব। এভাবে ৪০ দিন বক্তব্য প্রদান বন্ধ থাকে। বক্তব্য প্রদানে নিষেধাজ্ঞা জারি থাকলে কি কি সমস্যার সৃ©র্ষ্ট হবে সে সম্পর্কে ৮০টি কারণ উল্লেখ করে শাহ ইসমাঈল রেসিডেন্টকে একটি পত্র লেখেন। তিনি ব্যাপারটি বুঝতে পেরে অবশেষে তাঁকে বক্তব্য প্রদানের লিখিত অনুমতি প্রদান করেন।

বিদ‘আতীরা তাকে নানাভাবে কুপোকাত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করে। এতদুদ্দেশ্যে অমৃতসর থেকে ২ জন পাহলোয়ানকে ভাড়া করে নিয়ে আসা হয়। তাদের দু’জনকে কয়েক মাস পাল্কীর মধ্যে লুকিয়ে রেখে শহরের সব রাস্তা চিনিয়ে দেওয়া হয়। যাতে হত্যা করার সময় ধরা পড়লে পালানোর রাস্তা বের করতে পারে। একদিন দ্বিপ্রহরে শাহ ছাহেব ফতেহপুরী মসজিদের আঙ্গিনায় খালি পায়ে হাঁটার অনুশীলন করছিলেন। প্রশিক্ষিত পাহলোয়ানদ্বয় সেখানে গিয়ে তাঁর উপর ছুরি চালাতে উদ্যত হয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে থমকে দাঁড়ায়। তিনি তাদেরকে নছীহত করেন। দু’জনে তাঁর হাতে বায়‘আত করে জিহাদে অংশগ্রহণ করে শাহাদাত বরণ করে। এভাবে আল্লাহ তাকে স্বীয় রহমতে কুচক্রীদের হাত থেকে রক্ষা করেন। দীনা বেগ খাঁ নামে এক বিদ‘আতী তাঁর মৃত্যুর গুজবে দিল্লীতে শিরনী পর্যন্ত বিতরণ করে। তাঁকে কাফের আখ্যা দেয়া হয়। এমনকি মু‘তাযিলা ও খারিজীও বলা হয় (তারীখে আহলেহাদীছ, পৃঃ ২৯১)

আহলেহাদীছ আন্দোলনে অবদান :

পাঞ্জাবে মুসলমানদের উপরে শিখদের লোমহর্ষক নির্যাতনের খবর শুনে ও দীর্ঘ দু’বছর যাবত পাঞ্জাবের গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে বাস্তব অভিজ্ঞতা হাছিলের পর দিল্লী ফিরে এসে শাহ ইসমাঈল গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হন। অবশেষে সশস্ত্র প্রতিরোধই এর একমাত্র পথ হিসাবে তিনি সাব্যস্ত করেন ও সেলক্ষ্যে মানসিক প্রস্ত্ততি গ্রহণ করতে থাকেন। ১৮১৬ সালে সাইয়িদ আহমাদ ব্রেলভী দিল্লী আগমন করলে চাচা শাহ আব্দুল আযীযের ইঙ্গিতে তিনি ও মাওলানা আব্দুল হাই (মৃঃ ১২৪৩/১৮২৮ খৃঃ) সাইয়িদ আহমাদ ব্রেলভীর হাতে জিহাদের বায়‘আত গ্রহণ করেন। বায়‘আতের পর ১৮১৮ সালে শাহ ইসমাঈল শহীদ, মাওলানা আব্দুল হাইসহ প্রায় বিশজন খ্যাতিমান আলেম ও বন্ধু-বান্ধবসহ সাইয়িদ আহমাদ ব্রেলভী দিল্লী হতে সারা ভারতবর্ষে ব্যাপক তাবলীগী সফরে বের হন। তেজস্বী বাগ্মী শাহ ইসমাঈলের ওয়ায-নছীহতে বিমুগ্ধ-বিমোহিত হয়ে লোকেরা শিরক-বিদ‘আত ও কুসংস্কার হতে তওবা করে এবং দলে দলে সাইয়িদ আহমাদের নিকট বায়‘আত করতে থাকে। ১৮১৬-২১ সাল পর্যন্ত মোট পাঁচ বছর তাঁদের ব্যাপক দাওয়াত ও তাবলীগী কর্মসূচী অব্যাহত থাকে।

এরপর ১৮২১ সালে শাহ ইসমাঈল শহীদ আমীর সাইয়িদ আহমাদের সাথে ৭৫৩ জন হাজী নিয়ে কলকাতা থেকে জেদ্দার পথে হজ্জ আদায়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। সেখানে পৌঁছে ৭/৮ মাস হারামাইন শরীফাইনে অবস্থান করে ২ বছর ১০ মাস ২৮ দিন পর ২৯শে শা‘বান ১২৩৯ মোতাবেক ১৮২৪ সালের ৩০শে এপ্রিল তারিখে রামাযানের একদিন পূর্বে রায়বেরেলী ফিরে আসেন। অতঃপর সর্বত্র জোরেশোরে জিহাদের দাওয়াতের কাজ শুরু হয়ে যায়। ভারতের বিভিন্ন জায়গায় শাহ ইসমাঈল ব্যাপক তাবলীগী সফর করেন।

কুরআন ও হাদীছভিত্তিক জীবনগঠন, সমাজসংগঠন, মুসলমানদের উপরে অমুসলিম শাসকদের ব্যাপক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নির্যাতনের বিরুদ্ধে জিহাদী জাযবা পুনরুদ্ধার ইত্যাদিই ছিল তাঁর বক্তব্যের মূল বিষয়বস্ত্ত। শাহ ইসমাঈল তাঁর সকল বক্তব্যে একথা সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেন যে, মুসলমানদের সামনে এখন তিনটি পথ খোলা রয়েছে। ১. তাকে ‘হক’ ছেড়ে বাতিলকে আঁকড়ে ধরতে হবে। ২. হক-এর উপরে দৃঢ় থাকার কারণে বাতিলপন্থীদের হামলায় ধৈর্য ধারণ করতে হবে। ৩. অথবা বাতিলকে সাহসের সঙ্গে মুকাবিলা করে হক-এর সার্বিক বিজয়লাভের পথ সুগম করতে হবে। তিনি জাতিকে স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেন যে, প্রথমটি কোন বাঁচার রাস্তা নয় বরং ওটাই প্রকৃতপ্রস্তাবে মরণের রাস্তা। দ্বিতীয়টির পরিণতি বেশির বেশি এটাই হবে যে, তিলে তিলে মরতে হবে। কেবলমাত্র তৃতীয় পথটিই এখন আমাদের জন্য খোলা রয়েছে। আর সেটা হল সরাসরি সম্মুখ মোকাবিলা বা জিহাদ। জিহাদ ত্যাগ করার কারণেই আজ মুসলমান সর্বত্র মার খাচ্ছে। দশ হাযার মাইল দূর থেকে নৌকা চালিয়ে বণিকের বেশে মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোক এদেশে এসে যুগ যুগ ধরে বসবাসকারী মুসলিম শক্তিকে আসমুদ্র হিমাচলব্যাপী বিশাল ভারতীয় ভূখন্ডের শাসন ক্ষমতা হতে উৎখাত করল। অথচ মুসলমানরা শিক্ষা-দীক্ষা, অর্থে-বিত্তে, অভিজ্ঞতায় ও অস্ত্রশক্তিতে সেরা হওয়া সত্ত্বেও নির্বিবাদে মার খেয়ে যাচ্ছে। কেউ আপোষ করছে, কেউ এটাকে কপালের লিখন ধরে নিয়েছে, কেউ আপোষ করতে না পেরে ধুকে ধুকে মরছে। আর মুষ্টিমেয় কিছু লোক আত্মমর্যাদায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এর বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদের পরিকল্পনা করছে। তিনি সাইয়িদ আহমাদের নেতৃত্বে জানমাল দিয়ে জিহাদে অংশ গ্রহণের জন্য সকল ভারতীয় মুসলমানের প্রতি উদাত্ত আহবান জানান। দেশব্যাপী এই প্রচারণার ফলে একদিকে যেমন মুসলমানরা জিহাদে উদ্বুদ্ধ হতে থাকেন, অন্যদিকে শাহ ইসমাঈলের আপোষহীন ব্যক্তিত্বের প্রভাবে এবং কুরআন ও হাদীছের প্রতি দাওয়াতের ফলে সর্বত্র আহলেহাদীছ আন্দোলন জোরদার হতে থাকে।

মাওলানা সুলায়মান নাদভী (১৩০২-১৩৭২/১৮৮৪-১৯৫৩ খৃঃ) বলেন, ‘আহলেহাদীছ-এর নামে দেশে যে আন্দোলন চলছে বাস্তবে তা নতুন কোন বিষয় নয় বরং পুরনো পদচিহ্নের অনুসরণ মাত্র। মাওলানা ইসমাঈল শহীদ (রহঃ) যে আন্দোলন নিয়ে উত্থান করেছিলেন, তা ফিকহের কয়েকটি মাসআলা মাত্র ছিল না বরং ইমামতে কুবরা, খালেছ তাওহীদ এবং ইত্তেবায়ে নববীর বুনিয়াদী শিক্ষার উপরে ভিত্তিশীল ছিল। ...এই আন্দোলনের সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি তা হ’ল ইত্তেবায়ে নববীর যে জাযবা হারিয়ে গিয়েছিল, তা বছরের পর বছরের জন্য পুনরায় সৃষ্টি হয়েছে। জিহাদের যে আগুন ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল, তা পুনরায় জ্বলে উঠেছে। এমনকি এমন একটা সময় গিয়েছে যখন ‘ওয়াহ্হাবী ও বিদ্রোহী’ প্রতিশব্দ হিসাবে বলা হ’ত। কতজনের মাথা কাটা হয়েছে, কতজনকে শূলে চড়ানো হয়েছে, কতজনকে দ্বীপান্তরে দেওয়া হয়েছে, কতজনকে কয়েদখানার অন্ধ কুঠরীতে দম বন্ধ করে মারা হয়েছে, তার ইয়ত্তা কোথায়?’

মিরযা হায়রাত দেহলভী বলেন, ‘মাওলানা শহীদের আন্তরিক কামনা ছিল যে, মুসলমান যাবতীয় মাযহাবী গোঁড়ামী ভুলে নিরপেক্ষভাবে পূর্ণ উদ্দীপনায় কুরআন ও হাদীছের হুকুম অনুযায়ী জীবনযাপন করুক। ... মুসলমান নিজেকে হানাফী, শাফেঈ, মালেকী, হাম্বলী না বলে বরং রাসূলের দিকে সম্বন্ধ করে নিজেকে ‘মুহাম্মাদী’ বলুক। প্রিয় শহীদের অন্যতম কৃতিত্ব এই যে, তিনি লক্ষ লক্ষ মুমিনের মুখ দিয়ে একথা গর্বের সাথে বলাতে পেরেছিলেন যে, ‘আমরা মুহাম্মদী’।

বস্ত্তত ভারতীয় উপমহাদেশে শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী আমল বিল-হাদীছের (হাদীছের প্রতি আমল) যে ধারার সূচনা করেছিলেন, সে ধারাকে উচ্চমার্গে পৌঁছিয়ে দেন তদীয় পৌত্র শাহ ইসমাঈল শহীদ। মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী বলেন, ‘যখন মাওলানা মুহাম্মাদ ইসমাঈল শহীদ ইমাম আব্দুল আযীযের কাছে ‘হুজ্জাতুল্লাহ’ পড়েন, তখনই সম্মানিত দাদার তরীকার উপর আমল শুরু করে দেন। তারা ‘হুজ্জাতুল্লাহ’র উপর আমলকারী একটি খাছ জামা‘আত গড়ে তুলেছিলেন। এরা ছালাতে রাফউল ইয়াদায়েন করত ও জোরে আমীন বলত, যেমনটি হাদীছে বর্ণিত আছে’।

নানা বাধা-বিপত্তি ও প্রতিকূলতা সত্ত্বেও শাহ ওয়ালীউল্লাহ্র শিক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিতে তিনি বদ্ধপরিকর ছিলেন। সাইয়িদ আহমাদ শহীদের হাতে জিহাদের বায়‘আত গ্রহণের পরেও তাঁর আহলেহাদীছ চিন্তাধারার সামান্য ব্যত্যয় ঘটেনি। ইংরেজ লেখক জেম্স উকেনলি (James Ookenly) বলেন, ‘শাহ ইসমাঈল শহীদ (রহঃ)-এর অনুসারীগণ নিজেদেরকে ‘মুহাম্মাদী’ বলতেন’। তিনি বলেন যে, ‘মুজাহিদীন জামা‘আত দু’টি পরস্পর বিরোধী গ্রুপে বিভক্ত ছিল। একটি গ্রুপের নেতা ছিলেন মাওলানা আব্দুল হাই ও মাওলানা কেরামাত আলী জৌনপুরী, যারা আহলেসুন্নাত-এর তরীকা অনুসরণ করতেন। অন্য গ্রুপটির নেতা ছিলেন মৌলবী ইসমাঈল। যিনি চার ইমামের তাকলীদ হতে মুক্ত ছিলেন এবং সরাসরি হাদীছকে দলীলের উৎস গণ্য করতেন। স্বয়ং সাইয়িদ আহমাদ আমলের দিক দিয়ে ‘হানাফী’ হলেও মৌলবী ইসমাঈলের উপর নেতৃত্ব করতেন, যিনি নিজেকে মুহাম্মাদী বলতেন’। এভাবে দাওয়াত ও জিহাদের মাধ্যমে আহলেহাদীছ আন্দোলনের প্রচার-প্রসারে তিনি যে অবদান রেখেছেন তা অতুলনীয়।

শাহাদাত :

১২৪১ হিজরীর ৭ই জমাদিউছ ছানী মোতাবেক ১৮২৬ খৃষ্টাব্দের ১৭ই জানুয়ারী সোমবার সাইয়িদ আহমাদের জন্মস্থান অযোধ্যার রায়বেরেলীর ‘তাকিয়া’ গ্রাম হতে জিহাদী কাফেলা আল্লাহ্র নামে সীমান্ত এলাকার দিকে রওয়ানা হয়। দীর্ঘ ৫ বছর তিন মাস ১৯ দিন ব্যাপী (১৭.১.১৮২৬-৬.৫.১৮৩১) হিজরত ও জিহাদের মাধ্যমে সাইয়িদ আহমাদ ও শাহ ইসমাঈল তাঁদের নিবেদিতপ্রাণ কর্মীবাহিনী নিয়ে আল্লাহ্র পথে জান ও মালের কুরবানী পেশ করেন। পথিমধ্যে উল্লেখযোগ্য ১২টি যুদ্ধে অংশগ্রহণের পর তাঁরা বালাকোটের চূড়ান্ত যুদ্ধে উপনীত হন। ১২৪৬ হিজরীর ২৪ যিলকদ মোতাবেক ১৮৩১ সালের ৬ মে শুক্রবার বেলা ১১-টার সময় শাহ ইসমাঈল বালাকোট ময়দানে শাহাদত বরণ করেন ও সেখানেই সমাহিত হন।

নেতার প্রতি আনুগত্য :

নেতার প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও অকৃত্রিম আনুগত্যবোধ ছিল। তিনি সাইয়িদ আহমাদ শহীদের সামনে আসলে যেন বাকশক্তিহীন হয়ে পড়তেন এবং অতি কষ্টে তাঁর প্রশ্নের জবাব দিতেন। কিন্তু শরী‘আতের কোন কিছুর বরখেলাফ দেখলে তিনি তাঁকেও ছাড় দিতেন না; বরং তাঁর সামনে নির্ভীকভাবে তাঁর মতামত পেশ করতেন। আমীর সাইয়িদ আহমাদ তাঁকে কোন অভিযানের প্রস্ত্ততি গ্রহণের নির্দেশ দিলে অসুস্থতা সত্ত্বেও তিনি অস্ত্র নিয়ে সিংহের মতো ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তেন।

চরিত্র-মাধুর্য :

শাহ ইসমাঈল শহীদ সালাফে ছালেহীনের উত্তম নমুনা ছিলেন। পানাহার, চলাফেরা, পোষাক-পরিচ্ছদ সবকিছুতেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত সহজ-সরল ও সাধাসিধে। আড়ম্বরতা ও বিলাসিতা কখনো তাঁর কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারেনি। আমীর সাইয়িদ আহমাদ শহীদ তাঁকে আরোহণের জন্য একটি ঘোড়া দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি কখনো তার উপর সওয়ার হননি। সাথীদের মধ্যে কাউকে তিনি ঘোড়ায় চড়িয়ে নিজে পায়ে হেঁটে চলতেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, তিনি আল্লাহ্র পথে যতটা কষ্ট স্বীকার করবেন, ততো বেশি ছওয়াবের ভাগীদার হবেন।

তাকওয়া-পরহেযগারিতা ছিল তাঁর চরিত্রের ভূষণ। দাওয়াত-তাবলীগ ও জিহাদের ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি গভীর রজনীতে তাহাজ্জুদ ছালাতে নিমগ্ন থাকতেন। নিজের দোষ-ত্রুটি বা দুর্বলতা স্বীকার করতে তিনি বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করতেন না।

লেখনী :

দাওয়াত, সমাজ সংস্কার ও জিহাদের কণ্টকাকীর্ণ ও বাধাসঙ্কুল কাজে সর্বদা ব্যস্ত থাকায় কলমী জিহাদে তিনি ততটা সময় ব্যয় করতে পারেননি। তারপরেও যা কিছু লিপিবদ্ধ করেছেন তা ছিল অত্যন্ত সারগর্ভ ও সংস্কারধর্মী। আবুল হাসান নাদভী বলেন, ‘যদি তিনি দরস-তাদরীস ও গ্রন্থ রচনার সুযোগ পেতেন তাহলে সমকালীন অনেক আলেমের চেয়ে অগ্রগণ্য হতেন এবং অনেক বিষয়ে তাঁকে ইমাম বা মুজাদ্দিদের মর্যাদা প্রদান করা হত’ (সীরাতে সাইয়িদ আহমাদ শহীদ, পৃঃ ৩৭৪)। তাঁর রচিত গ্রন্থাবলী হল- ১. তাক্বভিয়াতুল ঈমান-উর্দূ ২. সালকে নূর, তাওহীদী কবিতা- উর্দূ ও ফারসী ৩. এক রোযী- উর্দূ। তাক্বভিয়াতুল ঈমান গ্রন্থ সম্পর্কে ফযলে হক খায়রাবাদী লিখিত সমালোচনার জবাব দিয়ে তিনি একদিনে এই পুস্তক রচনা করে এমন নামকরণ করেছেন। ৪. আবাক্বাত- আরবী ৫. ছিরাতে মুস্তাক্বীম (প্রথমার্ধ)-ফারসী ৬. ঈযাহুল হাকক্বিছ ছারীহ বিআহকামিল মাইয়িত ওয়ায যারীহ- ফারসী ৭. উছূলুল ফিকহ- আরবী ৮. মানছাবে ইমামত- ফারসী ৯. তানভীরুল আইনাইন ফী ইছবাতি রাফ‘ইল ইয়াদায়েন- আরবী ১০. মানতেক-এর উপরে একটি পুস্তিকা।

এছাড়া তিনি বহু গ্রন্থের উপর অত্যন্ত মূল্যবান টীকা-টিপ্পনী লিপিবদ্ধ করেছিলেন। দুঃখজনক যে, সিপাহী বিপ্লবের সময় তার সবই নষ্ট হয়ে গেছে।

মনীষীদের মূল্যায়ন :

১. শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিছ দেহলভী এক পত্রে মাওলানা আব্দুল হাই ও শাহ ইসমাঈলকে ‘তাজুল মুফাসসিরীন’ (মুফাসসিরদের মুকুট), ‘ফাখরুল মুহাদ্দিছীন’ (মুহাদ্দিছদের গর্ব) ও ‘সারআমাদে ওলামায়ে মুহাক্কিকীন’ (মুহাক্কিক আলেমদের সর্দার) বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেছেন যে, তাঁদের দু’জনের কেউই তাফসীর, হাদীছ, ফিকহ, উছূলে ফিকহ, মানতিক প্রভৃতি জ্ঞানে তাঁর চাইতে কম নন। উভয়কেই তিনি আলেমে রববানী বলে গণ্য করতেন (সীরাতে সাইয়িদ আহমাদ শহীদ, পৃঃ ৩৬৫)

২. আব্দুল হাই লক্ষ্ণৌভী বলেন , وكان كالوزير للإمام يحهز الجيوش و يقتحم فى المعارك العظيمة بنفسه حتى استشهد فى بالاكوت. ‘তিনি সাইয়িদ আহমাদ শহীদের জন্য মন্ত্রীর মতো ছিলেন। তিনি সৈন্যবাহিনী প্রস্ত্তত করতেন এবং নিজেই বড় বড় যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। অবশেষে তিনি বালাকোটে শহীন হন (নুযহাতুল খাওয়াতির)

৩. আল্লামা ইকবাল (১৮৭৩-১৯৩৮) বলেন, India has hitherto produced only one Moulavi and that is Moulavi Mohammad Ismail. ‘ভারতবর্ষ এযাবৎ মাত্র একজন মৌলভীর জন্ম দিয়েছে, তিনি হলেন মৌলভী মুহাম্মাদ ইসমাঈল’ (আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃঃ ২৫৮ ও ২৭৮)। তিনি আরো বলেন, ‘তাঁর পরে তাঁর মতো মর্যাদাসম্পন্ন একজন মৌলভীও যদি জন্মগ্রহণ করত, তাহলে আজকে ভারতবর্ষের মুসলমানরা এমন লাঞ্ছনাকর জীবন যাপন করত না’ (তারীখে আহলেহাদীছ, পৃঃ ২৯১)

৪. আবুল হাসান নাদভী বলেন, ‘তিনি এমন এক ব্যক্তি যিনি যে কওম ও যে দেশে জন্মগ্রহণ করেন সে কওম ও সে দেশের গর্বের বস্ত্ত হিসাবে গণ্য হন। তিনি ইসলামের সেইসব দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন, প্রতিভাবান, দুঃসাহসী ও অসাধারণ ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত-শত শত বৎসরেও যাঁদের দু’একজন কদাচিৎ জন্মগ্রহণ করে থাকে’।

৫. নওয়াব ছিদ্দীক হাসান খান ভূপালী বলেন, ‘যে বিষয় নিয়ে তাঁর সাথে আলোচনা করা হত দেখা যেত, তিনিই তার ইমাম এবং কোন বিষয় নিয়ে বিতর্ক করলে দেখা যেত যে, তিনি তার হাফেয। সারাজীবন তিনি অতিবাহিত করে গেছেন আল্লাহ্র কালেমার মর্যাদাকে সমুন্নত করতে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সুন্নাহ্র পুনরুজ্জীবনে, আল্লাহ্র পথে জিহাদ করতে এবং মানুষের হেদায়াতে’।

৬. ফযলে হক খায়রাবাদী বলেন, ‘ইসমাঈলকে আমি মৌলভী বলে জানতাম না, তিনি ছিলেন উম্মাতে মুহাম্মাদীর হাকীম। এমন কোন বিষয় নেই, যার খুঁটিনাটি সবকিছু তাঁর মনের মধ্যে থাকত না’।

৭. ইমাম খান নওশাহরাবী বলেন, ‘যদি আজ খোদ শাহ ওয়ালীউল্লাহ বেঁচে থাকতেন, তবে তাঁকেও ইসমাঈলের পতাকাতলে দেখা যেত’।

উপসংহার :

পরিশেষে বলা যায়, ভারতীয় উপমহাদেশে আহলেহাদীছ আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন শাহ ইসমাঈল শহীদ। তাঁর দাওয়াতের ফলে মানুষের মধ্য থেকে তাক্বলীদী গোঁড়ামি বিদূরিত হয় এবং পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ থেকে মানুষ জীবন সমস্যার সমাধান তালাশে উদ্বুদ্ধ হয়। অনাগত ভবিষ্যতের আহলেহাদীছ সূর্যসারথিদের জন্য তাঁর ত্যাগী জীবন অনুকরণীয় হয়ে থাকবে এবং অহি-র সমাজ কায়েমে নিত্য প্রেরণা যোগাবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাঊস দান করুন! আমীন!!

প্রমাণপঞ্জী :

১. মিরযা হায়রাত দেহলভী, হায়াতে তাইয়িবা।

২. গোলাম রসূল মেহের, সারগুযাশতে মুজাহিদীন।

৩. স্যার সৈয়দ আহমাদ খান, তাযকেরায়ে ওলামায়ে দিহলী।

৪. আবুল হাসান নাদভী, সীরাতে সাইয়িদ আহমাদ শহীদ।

৫. ইমাম খান নওশাহরাবী, তারাজিমে ওলামায়ে হাদীছ হিন্দ।

৬. মাওলানা মুহাম্মাদ ইবরাহীম মীর শিয়ালকোটী, তারীখে আহলেহাদীছ।

৭. মাওলানা নাযীর আহমাদ রহমানী, আহলেহাদীছ আওর সিয়াসাত।

৮. মাওলানা মুহাম্মাদ মিয়াঁ, ওলামায়ে হিন্দ কা শানদার মাযী।

৯. ড. আব্দুর রহমান ফিরিওয়াঈ, জুহূদ মুখলিছাহ।

১০. ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, আহলেহাদীছ আন্দোলন উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষিতসহ (পিএইচ. ডি থিসিস)।






শরী‘আহ আইন বনাম সাধারণ আইন : একটি পর্যালোচনা - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
বৃদ্ধাশ্রম : মানবতার কলঙ্কিত কারাগার (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ খায়রুল ইসলাম
ছিয়ামের ফাযায়েল ও মাসায়েল - আত-তাহরীক ডেস্ক
মানবাধিকার ও ইসলাম (৩য় কিস্তি) - শামসুল আলম
তাক্বলীদের বিরুদ্ধে ৮১টি দলীল (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
নববী চিকিৎসা পদ্ধতি - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
মাদ্রাসার পাঠ্যবই সমূহের অন্তরালে (শেষ কিস্তি) - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
সুন্নাত আঁকড়ে ধরার ফযীলত - মুহাম্মাদ মীযানুর রহমান
মুহাম্মাদ (ছাঃ)-ই সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল (পূর্বে প্রকাশিতের পর) - আব্দুল্লাহ বিন আবদুর রাযযাক
দ্বীনের পথে ত্যাগ স্বীকার (৩য় কিস্তি) - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
ভুল সংশোধনে নববী পদ্ধতি (৭ম কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
পুলছিরাত : আখেরাতের এক ভীতিকর মনযিল - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
আরও
আরও
.