পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ । পর্ব ৬ । পর্ব ৭ । শেষ পর্ব ।
দুনিয়া মুমিনের জন্য কয়েদখানা ও কাফেরের জন্য জান্নাত : দুনিয়া সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ)-এর বাণীচিত্রের এই পর্যায়ে আমরা তাঁর নিম্নোক্ত বাণী স্মরণ করতে পারি, যেখানে তিনি ভোগবিলাসেপূর্ণ এই দুনিয়াকে মুমিনদের জন্য কয়েদখানা বলে উল্লেখ করেছেন।
আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, الدُّنْيَا سِجْنُ الْمُؤْمِنِ وَجَنَّةُ الْكَافِرِ দুনিয়া মুমিনদের জন্য জেলখানা এবং কাফেরদের জন্য জান্নাত’।[1]
আলোচ্য হাদীছের ব্যাখ্যায় ইবনে তায়মিয়া (রহ.) বলেন, فَأَما مَا وعد بِهِ الْمُؤمن بعد الْمَوْت من كَرَامَة الله فَإِنَّهُ تكون الدُّنْيَا بِالنِّسْبَةِ إِلَيْهِ سجنا وَمَا للْكَافِرِ بعد الْمَوْت من عَذَاب الله فَإِنَّهُ تكون الدُّنْيَا جنَّة بِالنِّسْبَةِ إِلَى ذَلِك ‘মৃত্যুর পর মুমিনকে আল্লাহর পক্ষ থেকে যে অফুরন্ত নে‘মতের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে সে তুলনায় দুনিয়া তার কাছে কারাগারের মত। অন্যদিকে মৃত্যুর পর কাফেরের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে যে আযাবের প্রতিশ্রুতি রয়েছে, সে তুলনায় দুনিয়া তার কাছে জান্নাতের মত। অর্থাৎ পরকালের অফুরন্ত সুখ বা দুঃখের বিবেচনায় দুনিয়ার জীবন মানুষের জন্য কারাগার বা জান্নাত হবে’।[2]
ইমাম নববী (রহ.) বলেন,مَعْنَاهُ أَنَّ كُلَّ مُؤْمِنٍ مَسْجُونٌ مَمْنُوعٌ فِي الدُّنْيَا مِنَ الشَّهَوَاتِ الْمُحَرَّمَةِ وَالْمَكْرُوهَةِ مُكَلَّفٌ بِفِعْلِ الطَّاعَاتِ الشَّاقَّةِ فَإِذَا مَاتَ اسْتَرَاحَ مِنْ هَذَا وَانْقَلَبَ إِلَى مَا أَعَدَّ اللَّهُ تَعَالَى لَهُ مِنَ النَّعِيمِ الدَّائِمِ وَالرَّاحَةُ الْخَالِصَةُ مِنَ النُّقْصَانِ وَأَمَّا الْكَافِرُ فَإِنَّمَا لَهُ مِنْ ذَلِكَ مَا حَصَّلَ فِي الدُّنْيَا مَعَ قِلَّتِهِ وَتَكْدِيرِهِ بِالْمُنَغِّصَاتِ فَإِذَا مَاتَ صَارَ إِلَى الْعَذَابِ الدَّائِمِ وَشَقَاءِ الْأَبَدِ ‘এর অর্থ হচ্ছে- প্রত্যেক মুমিন (দুনিয়াতে) কয়েদী বা জেলখানায় বন্দী। কেননা দুনিয়াতে তার জন্য মাকরূহ বা অপসন্দনীয়, হারাম ও প্রবৃত্তিপূজা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। কষ্টকর বিষয়গুলোতেও আনুগত্য করতে সে বাধ্য। অতঃপর যখন সে মারা যায় তখন এই বাধ্যবাধকতা থেকে সে স্বস্তি লাভ করে এবং মহান আল্লাহ তার জন্য যে অফুরন্ত সুখ-শান্তি প্রস্ত্তত করে রেখেছেন তার দিকে ধাবিত হয়। পক্ষান্তরে কাফের দুনিয়ায় সে যা (ভাল কিছু) অর্জন করে তার প্রতিদান খুব সামান্যই পেয়ে থাকে (যার বিনিময়ে সে দুনিয়ায় ভাল থাকে)। অতঃপর যখন মৃত্যুবরণ করে তখন চিরস্থায়ী আযাব ও অনন্ত দুর্ভাগ্যের দিকে এগিয়ে যায়’।[3]
জেলখানায় আসামী যেমন পরাধীন, সীমিত আহার ও সঙ্কুচিত পরিসরে অবস্থান করতে হয়, ইচ্ছে করলেই স্বাধীনভাবে কিছু করা যায় না, শৃংখলিত ও কষ্টকর জীবন যাপন করতে হয়; তেমনি মুমিন ব্যক্তিও এলাহী বিধানের অধীনে দুনিয়াতে সুশৃংখল জীবন যাপন করতে বাধ্য, সে নির্ধারিত সীমারেখা অতিক্রম করতে পারে না, যাচ্ছেতাই করে বেড়ানো যায় না, শরী‘আত অননুমোদিত কোন কর্মসূচীতে সে সম্পৃক্ত হ’তে পারে না। সেকারণ দুনিয়াটা মুমিনের জন্য কয়েদখানা। কিন্তু আখেরাতের অনন্ত জীবনে তার জন্য অপেক্ষা করছে চিরন্তন সুখ-শান্তি ও কল্পনাতীত বিলাসিতা। আসমান-যমীন বিস্তৃত জান্নাতে সুসজ্জিত আসনে হেলান দিয়ে সে তার জন্য নির্ধারিত নে‘মতরাজি অবলোকন করবে আর মহান রবের কৃতজ্ঞতায় নতজানু হবে। জান্নাতের অকল্পনীয় নে‘মত সম্ভার দেখে সে বিমোহিত হবে। ইতিপূর্বে দুনিয়াতে সে হাদীছে কুদসীর মাধ্যমে মহান আল্লাহর ঘোষণা শুনেছিল যে, أَعْدَدْتُ لِعِبَادِى الصَّالِحِينَ مَا لاَ عَيْنَ رَأَت وَلاَ أُذُنَ سَمِعَتْ وَلاَ خَطَرَ عَلَى قَلْبِ بَشَرٍ ‘আমি আমার নেককার বান্দাদের জন্য জান্নাতে এমন সব নে‘মত প্রস্ত্তত করে রেখেছি, যা তার চোখ কোনদিন দেখেনি, কান কোনদিন শুনেনি এবং হৃদয় দিয়ে কল্পনাও করতে পারেনি’।[4] এখন তার বাস্তবতা সে দেখতে পাচ্ছে। কতইনা আনন্দঘন মুহূর্ত এটি। মহান আল্লাহ আমাদেরকে জান্নাতের বাসিন্দা হিসাবে কবুল করুন-আমীন!
এর পূর্বে আমলনামা হাতে পেয়েই সে খুশীতে আত্মহারা হয়ে সবাইকে ডেকে বলেছিল, ‘এসো তোমরা আমার আমলনামা পড়ে দেখ! আমি নিশ্চিতভাবে জানতাম যে, আমি অবশ্যই হিসাবের সম্মুখীন হব। অতঃপর সে সুখী জীবন যাপন করবে। সুউচ্চ জান্নাতে। যার ফলমূল সমূহ থাকবে নাগালের মধ্যে। (বলা হবে) খুশী মনে খাও ও পান কর বিগত দিনে যেসব সৎকর্ম তোমরা অগ্রিম প্রেরণ করেছিলে, তার প্রতিদান হিসাবে’ (হা-ক্কাহ ৬৯/১৯-২৪)।
পক্ষান্তরে অবিশ্বাসী কাফেরের অবস্থা হবে ঠিক এর বিপরীত। দুনিয়াতে তার সবকিছু ছিল। নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব, পাহাড় সম অর্থ-সম্পদ, বিলাসী জীবন, বাড়ী-গাড়ী-নারী, বিনোদনের হাযারো উপকরণ সবই ছিল। ক্ষমতার দাপট এতদূর পৌঁছেছিল যে, তার টিকিটি স্পর্শ করার ক্ষমতাও কারও ছিলনা। দুনিয়াটা যেন ছিল তার জন্য জান্নাত সদৃশ। কিন্তু আখেরাতে সে শূন্য হাতে উত্থিত হবে। মন্দ আমলনামা হাতে পেয়ে পাগলের প্রলাপ বকতে থাকবে। সীমাহীন আফসোস সহকারে বলবে, ‘হায়! যদি আমাকে এ আমলনামা না দেওয়া হত! যদি আমি আমার হিসাব না জানতাম! হায়! মৃত্যুই যদি আমার শেষ পরিণতি হত! আমার ধন-সম্পদ আমার কোন কাজে আসল না। আমার ক্ষমতা বরবাদ হয়ে গেছে। (তখন ফেরেশতাদের বলা হবে) ওকে শক্তভাবে ধরো। গলায় বেড়ী পরাও। এরপর জাহান্নামে প্রবেশ করাও। অতঃপর সত্তর হাত দীর্ঘ শিকলে পেঁচিয়ে বাঁধ’ (হা-ক্কাহ ৬৯/২৫-৩২)। অর্থাৎ কাফেরদের জন্য দুনিয়াটা জান্নাত সদৃশ হ’লেও আখেরাতে সে হবে সবচেয় বড় অসহায়। আর মুমিনের জন্য দুনিয়া কয়েদখানা সদৃশ হ’লেও আখেরাতে সে হবে সবচেয়ে বড় সুখী। হযরত জাবের (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, يَوَدُّ أَهْلُ العَافِيَةِ يَوْمَ القِيَامَةِ حِينَ يُعْطَى أَهْلُ البَلَاءِ الثَّوَابَ لَوْ أَنَّ جُلُودَهُمْ كَانَتْ قُرِضَتْ فِي الدُّنْيَا بِالمَقَارِيضِ ‘ক্বিয়ামত দিবসে (দুনিয়ায়) বিপদে পতিত (ধৈর্যশীল) লোকদের যখন প্রতিদান দেয়া হবে, তখন (দুনিয়াতে) বিপদমুক্ত লোকেরা আফসোস করবে, হায়! দুনিয়াতে যদি কাঁচি দ্বারা তাদের শরীরের চামড়া কেটে টুকরা টুকরা করে দেয়া হ’ত’।[5] অর্থাৎ আখেরাতের তোলনায় দুনিয়ার শাস্তি অতি নগন্য। তাই তারা আফসোস করে এ কথা বলতে থাকবে।
আল্লাহ বলেন, مَنْ كَانَ يُرِيدُ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَزِينَتَهَا نُوَفِّ إِلَيْهِمْ أَعْمَالَهُمْ فِيهَا وَهُمْ فِيهَا لَا يُبْخَسُونَ- أُولَئِكَ الَّذِينَ لَيْسَ لَهُمْ فِي الْآخِرَةِ إِلَّا النَّارُ وَحَبِطَ مَا صَنَعُوا فِيهَا وَبَاطِلٌ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ- ‘যে ব্যক্তি পার্থিব জীবন ও তার জাঁকজমক কামনা করে, আমরা তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের ফল দুনিয়াতেই পূর্ণভাবে দিয়ে দিব। সেখানে তাদের কোনই কমতি করা হবে না। এরা হ’ল সেইসব লোক যাদের জন্য পরকালে জাহান্নাম ছাড়া কিছুই নেই। দুনিয়াতে তারা যা কিছু (সৎকর্ম) করেছিল আখেরাতে তা সবটাই বরবাদ হবে এবং যা কিছু উপার্জন তারা করেছিল সবটুকুই বিনষ্ট হবে’ (হূদ ১১/১৫, ১৬)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,مَنْ كَانَ يُرِيدُ حَرْثَ الْآخِرَةِ نَزِدْ لَهُ فِي حَرْثِهِ وَمَنْ كَانَ يُرِيدُ حَرْثَ الدُّنْيَا نُؤْتِهِ مِنْهَا وَمَا لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِنْ نَصِيبٍ- ‘যে ব্যক্তি আখেরাতের ফসল কামনা করে আমরা তার জন্য তার ফসল বাড়িয়ে দেই। আর যে ব্যক্তি দুনিয়ার ফসল কামনা করে, আমরা তাকে তা থেকে কিছু দিয়ে থাকি। কিন্তু আখেরাতে তার কোন অংশ থাকে না’ (শূরা ৪২/২০)। এ প্রসঙ্গে ছহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّ اللهَ لَا يَظْلِمُ مُؤْمِنًا حَسَنَةً، يُعْطَى بِهَا فِي الدُّنْيَا وَيُجْزَى بِهَا فِي الْآخِرَةِ، وَأَمَّا الْكَافِرُ فَيُطْعَمُ بِحَسَنَاتِ مَا عَمِلَ بِهَا لِلَّهِ فِي الدُّنْيَا، حَتَّى إِذَا أَفْضَى إِلَى الْآخِرَةِ، لَمْ تَكُنْ لَهُ حَسَنَةٌ يُجْزَى بِهَا-
‘আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, আল্লাহ তা‘আলা কোন মুমিনের নেক কাজকে বিনষ্ট করেন না। দুনিয়াতেও তার বিনিময় প্রদান করেন আবার আখেরাতেও তার প্রতিদান দেন। আর কাফের আল্লাহর জন্য যে সকল ভাল কাজ করে দুনিয়াতে সে তার বিনিময় ভোগ করে, অবশেষে যখন সে আখেরাতে পৌঁছবে, তখন তার (আমলনামায়) কোন ভাল কাজ থাকবে না, যার প্রতিদান সে পেতে পারে’।[6] বুখারী মুসলিমে বর্ণিত নিম্নোক্ত হাদীছটিও এ প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য-
عَنْ أَبِى قَتَادَةَ أَنَّهُ كَانَ يُحَدِّثُ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم مُرَّ عَلَيْهِ بِجِنَازَةٍ فَقَالَ مُسْتَرِيحٌ، وَمُسْتَرَاحٌ مِنْهُ قَالُوا يَا رَسُولَ اللهِ مَا الْمُسْتَرِيحُ وَالْمُسْتَرَاحُ مِنْهُ قَالَ الْعَبْدُ الْمُؤْمِنُ يَسْتَرِيحُ مِنْ نَصَبِ الدُّنْيَا وَأَذَاهَا إِلَى رَحْمَةِ اللهِ، وَالْعَبْدُ الْفَاجِرُ يَسْتَرِيحُ مِنْهُ الْعِبَادُ وَالْبِلاَدُ وَالشَّجَرُ وَالدَّوَابُّ-
‘আবূ কাতাদা (রাঃ) বর্ণনা করেন, একবার রাসূল (ছাঃ)-এর পাশ দিয়ে একটি জানাযা নিয়ে যাওয়া হ’ল। তিনি তা দেখে বললেন, সে শান্তিপ্রাপ্ত অথবা তার থেকে শান্তিপ্রাপ্ত। লোকেরা জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! ‘মুস্তারিহ’ ও ‘মুস্তারাহ মিনহু’-এর অর্থ কি? তিনি বললেন, মুমিন বান্দা মৃত্যুবরণের পর দুনিয়ার কষ্ট ও যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়ে আল্লাহর রহমতের দিকে পৌঁছে শান্তিপ্রাপ্ত হয়। আর গুনাহগার বান্দা মৃত্যুবরণের পর তার আচার-আচরণ থেকে সকল মানুষ, শহর-বন্দর, গাছ-পালা ও প্রাণীকূল শান্তিপ্রাপ্ত হয়’।[7] অর্থাৎ দুনিয়ার কয়েদী জীবন থেকে মুমিন ব্যক্তি মুক্তিলাভ করে। আর কাফের ব্যক্তি দুনিয়ার বিলাসী জীবন থেকে আখেরাতে তার জন্য অপেক্ষমান কয়েদী জীবনে প্রবেশ করে এবং তার দ্বারা নির্যাতিত, বঞ্চিত মানবতা স্বস্তি বা প্রশান্তি লাভ করে।
উল্লেখ্য যে, এই দুনিয়া মুমিনদের জন্য যেমন কয়েদখানা তেমনি পরীক্ষাকেন্দ্রও বটে। যে পরীক্ষা জাহান্নাম থেকে মুক্তির পরীক্ষা, জান্নাত লাভের পরীক্ষা; যে পরীক্ষা কষ্টের পর প্রশান্তির পরীক্ষা, ত্যাগের বিনিময়ে নিশ্চিত ভোগের পরীক্ষা। মহান আল্লাহ বলেন,الَّذِي خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا ‘যিনি মৃত্য ও জীবনকে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের পরীক্ষা করার জন্য যে, কে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক সুন্দর আমলকারী?’ (মুল্ক ৬৭/২)।
এছাড়াও মহান আল্লাহ মুমিন বান্দাকে ক্ষুধা-মন্দা, অসুখ-বিসুখ, দুঃখ-দুর্দশা, বিপদ-মুছীবত দিয়ে পরীক্ষা করে থাকেন। তিনি বলেন, وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِنَ الْخَوْفِ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِنَ الْأَمْوَالِ وَالْأَنْفُسِ وَالثَّمَرَاتِ وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ- الَّذِينَ إِذَا أَصَابَتْهُمْ مُصِيبَةٌ قَالُوا إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ- ‘অবশ্যই আমরা তোমাদের পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল, জান ও ফল-ফসলের ক্ষতি দ্বারা। আর তুমি সুসংবাদ দাও ধৈর্যশীলদের। যাদের উপর কোন বিপদ আসলে তারা বলে, নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চয়ই আমরা তার দিকেই ফিরে যাব’ (বাক্বারাহ ২/১৫৫-১৫৬)। তবে এই পরীক্ষা ঈমানের দিকে যারা যত মযবূত তাদের উপর তত বেশী হয়। দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশী বিদপগ্রস্থ বা সর্বাধিক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন কারা? এমন প্রশ্নের জবাব রাসূল (ছাঃ) বলেন, الأَنْبِيَاءُ ثُمَّ الأَمْثَلُ فَالأَمْثَلُ، فَيُبْتَلَى الرَّجُلُ عَلَى حَسَبِ دِينِهِ، فَإِنْ كَانَ دِينُهُ صُلْبًا اشْتَدَّ بَلَاؤُهُ، وَإِنْ كَانَ فِي دِينِهِ رِقَّةٌ ابْتُلِيَ عَلَى حَسَبِ دِينِهِ، فَمَا يَبْرَحُ البَلَاءُ بِالعَبْدِ حَتَّى يَتْرُكَهُ يَمْشِي عَلَى الأَرْضِ مَا عَلَيْهِ خَطِيئَةٌ ‘(সর্বাধিক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হন) নবীগণ। অতঃপর মর্যাদার দিক থেকে তাদের পরবর্তীগণ, অতঃপর তাদের পরবর্তীগণ। বান্দাকে তার দ্বীনদারির মাত্রা অনুসারে পরীক্ষা করা হয়। যদি সে তার দ্বীনের ক্ষেত্রে দৃঢ় বা আপোষহীন হয় তবে তার পরীক্ষাও ততটা কঠিন হয়। আর যদি সে তার দ্বীনদারিতে নমনীয় হয় তবে তার পরীক্ষাও তদনুপাতে হয়। অতঃপর বান্দা অহরহ বিপদ-আপদ দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে। অবশেষে সে পৃথিবীতে গুনাহমুক্ত হয়ে পাকসাফ অবস্থায় বিচরণ করে’।[8]
অন্য হাদীছে বলা হয়েছে যে, মুমিনের পায়ে একটি কাটাও বিদ্ধ হয় না, যার বিনিময়ে আল্লাহ তার গুনাহ ক্ষমা করেন না।[9] প্রয়োজন শুধু ছবরের। ছবরের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হ’তে পারলে দেখবে, সফলতার সোপান দ্বারপ্রান্তে অপেক্ষমাণ। তাইতো রাসূল (ছাঃ) মুমিনদের বিষয়ে আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলেছেন,عَجَبًا لِأَمْرِ الْمُؤْمِنِ، إِنَّ أَمْرَهُ كُلَّهُ خَيْرٌ، وَلَيْسَ ذَاكَ لِأَحَدٍ إِلَّا لِلْمُؤْمِنِ، إِنْ أَصَابَتْهُ سَرَّاءُ شَكَرَ، فَكَانَ خَيْرًا لَهُ، وَإِنْ أَصَابَتْهُ ضَرَّاءُ، صَبَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ ‘মুমিনের বিষয়টি আশ্চর্যজনক। তার সমস্ত কর্মই তার জন্য কল্যাণকর। মুমিন ব্যতীত অন্য কারো জন্য এ কল্যাণ লাভের ব্যবস্থা নেই। তারা আনন্দ (সুখ-শান্তি) লাভ করলে শুকরিয়া আদায় করে, এটা তার জন্য কল্যাণকর হয়। আবার দুঃখ-কষ্টে আক্রান্ত হলে ধৈর্যধারণ করে, এটাও তার জন্য কল্যাণকর’।[10]
জাহান্নামের শাস্তির পরশে মানুষ দুনিয়ার সকল বিলাসিতা ভুলে যাবে :
যারা দুনিয়াপূজারী, তাদের সকল কর্মকান্ড দুনিয়াকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হয়। দুনিয়াকেই তারা সুখ-শান্তির আধার মনে করে। দুনিয়া হারানোকে তারা সর্বস্ব হারানো মনে করে। ফলে যে কোন ভাবে দুনিয়া কামাই-ই তাদের প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়। কখনো ভাবে না যে, যেকোন সময় জীবনের সুইচ অফ হয়ে যেতে পারে। তখন স্থায়ী নিবাসের পথযাত্রী হ’তে হবে তাকে। পাই টু পাই হিসাব দিতে হবে মহান রবের সম্মুখে। পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এক চুল পরিমাণ কদম নড়াতে পারবে না।[11] জাহান্নামীদের মধ্য থেকে দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশী সুখী ও বিলাসী জীবন যাপনকারী ব্যক্তিকে সেদিন জাহান্নামে নিক্ষেপের সাথে সাথে জাহান্নামের শাস্তির তীব্রতায় সে দুনিয়ার সকল বিলাসিতার কথা ভুলে যাবে। অনুরূপভাবে দুনিয়ায় সর্বাধিক বিপদগ্রস্থ ও দুঃখ-কষ্টে জর্জরিত কোন জান্নাতী ব্যক্তিকে চির শান্তির ঠিকানা জান্নাতে প্রবেশ করানোর সাথে সাথে সেও দুনিয়ার সকল দুঃখ-কষ্ট ও বিপদের কথা ভুলে যাবে। অর্থাৎ আখেরাতের তুলনায় দুনিয়া এতটাই নগন্য যে, আখেরাতের বিশালতার কাছে দুনিয়া হারিয়ে যাবে। আনাস বিন মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেন,
يُؤْتَى بِأَنْعَمِ أَهْلِ الدُّنْيَا مِنْ أَهْلِ النَّارِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَيُصْبَغُ فِى النَّارِ صَبْغَةً ثُمَّ يُقَالُ يَا ابْنَ آدَمَ هَلْ رَأَيْتَ خَيْرًا قَطُّ هَلْ مَرَّ بِكَ نَعِيمٌ قَطُّ فَيَقُولُ لاَ وَاللهِ يَا رَبِّ. وَيُؤْتَى بِأَشَدِّ النَّاسِ بُؤْسًا فِى الدُّنْيَا مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ فَيُصْبَغُ صَبْغَةً فِى الْجَنَّةِ فَيُقَالُ لَهُ يَا ابْنَ آدَمَ هَلْ رَأَيْتَ بُؤْسًا قَطُّ هَلْ مَرَّ بِكَ شِدَّةٌ قَطُّ فَيَقُولُ لاَ وَاللهِ يَا رَبِّ مَا مَرَّ بِى بُؤُسٌ قَطُّ وَلاَ رَأَيْتُ شِدَّةً قَطُّ-
‘জাহান্নামীদের মধ্য থেকে দুনিয়ায় সর্বাধিক স্বাচ্ছন্দ্য ও প্রাচুর্যের অধিকারী ব্যক্তিকে ক্বিয়ামতের দিন আনা হবে। তারপর তাকে (জাহান্নামের) আগুনে একবার চুবানো হবে। অতঃপর জিজ্ঞেস করা হবে, হে আদম সন্তান! তুমি দুনিয়াতে কখনো কোন আরাম-আয়েশ দেখেছ কি? কখনো সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য অবস্থায় দিনাতিপাত করেছ কি? সে বলবে, আল্লাহর কসম! হে আমার প্রতিপালক! না, আমি কখনো সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দেখিনি। অতঃপর জান্নাতীদের মধ্য থেকে দুনিয়ায় সর্বাধিক খারাপ অবস্থা সম্পন্ন ব্যক্তিকে আনা হবে। তারপর তাকে জান্নাতে একবার অবগাহন করিয়ে জিজ্ঞেস করা হবে, হে আদম সন্তান! তুমি কখনো কষ্ট দেখেছ কি? কঠিন এবং ভয়াবহ অবস্থায় দিনাতিপাত করেছ কি? সে বলবে, আল্লাহর কসম, হে আমার প্রতিপালক! আমি কখনো কষ্টের সাথে দিনাতিপাত করিনি এবং কখনো দুঃখ দেখিনি।[12] অর্থাৎ কাফের যেমন জাহান্নামের শাস্তির তীব্রতায় দুনিয়ার বিলাসিতা ভুলে যাবে, তেমনি জান্নাতী ব্যক্তি জান্নাতের অফুরান সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দেখে তার বিগত দুনিয়াবী জীবনের যাবতীয় কষ্ট-ক্লেশ ভুলে যাবে।
[ক্রমশঃ]
[1]. মুসলিম হা/২৯৫৬; মিশকাত হা/৫১৫৮।
[2]. ইবনু তায়মিয়াহ, জামে‘উর রাসায়েল ২/৩৬২।
[3]. নববী, শরহ মুসলিম ১৮/৯৩।
[4]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫৬১২।
[5]. তিরিমিযী হা/২৪০২ সনদ হাসান।
[6]. মুসলিম হা/২৮০৮; মিশকাত হা/৫১৫৯।
[7]. বুখারী হা/৬৫১২; মুসলিম হা/৯৫০।
[8]. তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, দারেমী, মিশকাত হা/১৫৬২।
[9]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১৫৩৭।
[10]. মুসলিম হা/২৯৯৯; ছহীহ ইবনে হিববান হা/২৮৯৬।
[11]. তিরমিযী হ/২৪১৬।
[12]. মুসলিম হা/২৮০৭; মিশকাত হা/৫৬৬৯।