মানুষ পরস্পরের উপর নির্ভরশীল সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করলেও সামাজিক অবস্থান সবার একই রূপ নয়। কেউ ধনী, কেউ গরীব, কেউ উঁচু বংশের, কেউ নীচু বংশের, কেউ দক্ষ, কেউ অদক্ষ। আবার এক একজন এক এক বিষয়ে পারদর্শী। ফলে বিভিন্ন পেশায় তারা নিয়োজিত। ইসলাম সকল বৈধ পেশাকে উৎসাহিত করে এবং সকল পেশার মানুষকে সমান সম্মান করে। সম্পদ, বংশ ও পেশার কারণে মানুষের মর্যাদা নিরূপিত হয় না। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা নিরূপিত হয় নৈতিকতা, নিষ্ঠা ও তাক্বওয়ার ভিত্তিতে (হুজুরাত ৪৯/১৩)। কাজেই যে কোন পেশার লোক সম্মানের পাত্র। কেননা সমাজ জীবনে তথা দৈনন্দিন জীবনে আমরা বিভিন্ন পেশার লোকের মুখাপেক্ষী হই। এমনকি শ্রমিক-মজুর, দাস-দাসী, শিক্ষক, জেলে, তাঁতী ও ব্যবসায়ী প্রত্যেকেরই সমাজ বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। কাজেই প্রত্যেক পেশাজীবির অধিকারের প্রতি আমাদের সমান যত্নবান হওয়া এবং সমান সম্মান প্রদর্শন করা উচিৎ।
প্রত্যেক ব্যক্তির নিজস্ব দৈহিক, মানসিক ও কৌশলগত শক্তি আছে। এগুলি কাজে বিনিয়োগ করার নাম শ্রম। শ্রমের বিনিময়ে অর্থ উপার্জনকারী ব্যক্তি শ্রমিক। শ্রমের দ্বারা মানুষ তার ভাগ্যের দ্বার উন্মোচন করতে সক্ষম হয়। পৃথিবীর সব মহৎ কাজের পিছনে অজস্র মানুষের শ্রম জড়িত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘মানুষ যতটুকু চেষ্টা করবে, ততটুকু সে পাবে’ (নাজম ৫৩/৩৯)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) শ্রম দিয়ে জীবিকার্জন করার প্রতি গুরুত্ব প্রদান করে বলেন,
مَا أَكَلَ أَحَدٌ طَعَامًا قَطُّ خَيْرًا مِنْ أَنْ يَأْكُلَ مِنْ عَمَلِ يَدَيْهِ، وَإِنَّ نَبِىَّ اللهِ دَاودَ عَلَيْهِ السَّلاَمُ كَانَ يَأْكُلُ مِنْ عَمَلِ يَدَيْهِ-
‘কারও জন্য নিজ হাতের উপার্জন অপেক্ষা উত্তম আহার্য বা খাদ্য আর নেই। আল্লাহর নবী দাঊদ (আঃ) নিজ হাতের কামাই খেতেন’।[1]
উন্নয়নের জন্য শ্রমের বিকল্প নেই। তাই শুধু ইবাদত-বন্দেগী নিয়ে মশগূল না থেকে ছালাত শেষে জীবিকার্জনের জন্য পৃথিবীতে বের হয়ে পড়ার কথা আল্লাহ বলেছেন (জুম‘আহ ৬২/১০)।
কারও অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় তার উপর অর্পিত দায়িত্ব আদায়ের পর। অধিকার প্রাপক ও অধিকারদাতা উভয়ের সুসম্পর্ক ও সদিচ্ছার উপর নির্ভর করে অধিকার প্রতিষ্ঠা। পারস্পরিক সমঝোতা ছাড়া কোনক্রমেই তা সম্ভব হয় না। শ্রমিক নিজের উপর মালিকের কাজের দায়িত্ব নিয়ে এমন এক নৈতিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয় যে, এ কাজ সে অর্থ উপার্জনের জন্য করে না; বরং এর সাথে পরকালের সফলতা জড়িত বলে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে। চুক্তি পূর্ণ করার ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তোমরা প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করো। নিশ্চয়ই প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে’ (বনী ইসরাঈল ১৭/৩৪)। শ্রমিকের দায়িত্ব চুক্তি মোতাবেক মালিকের প্রদত্ত কাজ অত্যন্ত নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততার সাথে সম্পাদন করা। ইরশাদ হচ্ছে, ‘শ্রমিক হিসাবে সেই ব্যক্তি ভাল, যে শক্তিশালী, বিশ্বস্ত’ (ক্বাছাছ ২৮/২১৬)। শ্রমিক দায়িত্ব গ্রহণের পর কাজে অলসতা প্রদর্শন করলে তার মারাত্মক পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তাদের জন্য দুর্ভোগ, যারা ওযনে কম দেয়। ওযন নেওয়ার সময় পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করে এবং দেওয়ার সময় কম করে দেয়’ (মুতাফফিফীন ৮৩/১-৩)। শ্রমিক তার উপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে আঞ্জাম দিবে এটা তার কর্তব্য। আর এ কর্তব্য সুচারুভাবে পালন করলে তার জন্য দ্বিগুণ পুণ্যের কথা রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘তিন শ্রেণীর লোকের দ্বিগুণ ছওয়াব প্রদান করা হবে। তাদের মধ্যে এক শ্রেণী হ’ল যে নিজের মালিকের হক আদায় করে এবং আল্লাহর হকও আদায় করে’।[2]
শ্রমিক শুধু দায়িত্ব পালন পূর্বক মালিকের মনোরঞ্জন করে চলবে আর তার কোন প্রাপ্যতা থাকবে না এটা হ’তে পারে না। সে যেমন নিজের দেহের রক্ত পানি করে মালিকের কাজের যোগান দিবে, তেমনভাবে তার মালিকের নিকট অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। এ অধিকারের ব্যাপারে ইসলামের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা হ’ল, لاَضَرَرَ وَلاَضِرَارَ ‘কোন ক্ষতি করা চলবে না, ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া যাবে না’।[3]
শ্রমিকের প্রথম দাবী বা অধিকার হ’ল তার শ্রমের যথোপযুক্ত পারিশ্রমিক লাভ করা। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, أَعْطُوا الْأَجِيْرَ أَجْرَهُ قَبْلَ أَنْ يَجِفَّ عَرْقُهُ، ‘শ্রমিকের শরীরের ঘাম শুকাবার আগেই তার মজুরী দিয়ে দাও’।[4] শ্রমজীবি লোকদের মজুরী লাভ করা তার নায্য দাবী সমূহের মধ্যে অন্যতম। এ দাবী পূরণে নানাজন নানাভাবে নির্ধারণের কথা বলে থাকেন। পুঁজিবাদীদের মতে দ্রব্যমূল্য চাহিদা ও যোগানের অনুপাতে শ্রমের মূল্য নির্ণীত করতে হবে।[5] সমাজতান্ত্রিকদের মতে দক্ষতানুসারে কাজ এবং প্রয়োজন অনুযায়ী মজুরী দিতে হবে।[6] এ সমস্ত মতবাদ অনুসারে শ্রমিকের সঠিক মূল্যায়ন হয় না। তাদের পূর্ণ অধিকার আদায় করতে হ’লে শ্রমিকের প্রয়োজন অনুসারে মজুরী নির্ধারণ করতে হবে।[7] ওমর (রাঃ) প্রয়োজন ও দেশের অবস্থার প্রতি দৃষ্টি রেখে বেতন নির্ধারণ করে দিতেন।[8] অনেক সময় শ্রমিকদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মালিকগণ উপযুক্ত মজুরী প্রদান না করে ইচ্ছামত মজুরী দেন এবং শ্রমিকদের প্রবঞ্চিত করেন ও ঠকান। শ্রমিকগণ নীরবে তা সহ্য করে থাকে। এ ধরনের কাজ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘ক্বিয়ামতের দিন তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হবে। তার মধ্যে একজন হ’ল যে শ্রমিকের নিকট থেকে পূর্ণ শ্রম গ্রহণ করে, অথচ তার পূর্ণ মজুরী প্রদান করে না’ (وَرَجُلٌ اَسْتَأْجَرَ أَجِيْرًا فَاسْتَوْفَى مِنْهُ وَلَمْ يُعْطِهِ أَجْرَهُ،) ।[9]
শ্রমিকদের গুরুত্বপূর্ণ অধিকার কাজের সময় নির্ধারণ। পুঁজিবাদী দেশগুলিতে মালিক যতক্ষণ ইচ্ছা কাজ করে নিত। এতে শ্রমিকদের অত্যাচারের সীমা থাকত না। এ অত্যাচারের বিরুদ্ধে নির্যাতিত শ্রমিকগণ ১৯৮০ সালে মে মাসে শিকাগো শহরে আট ঘণ্টা কাজ করার দাবীতে ধর্মঘটের ডাক দেয়। শেষ পর্যন্ত দাবীর মুখে তা গৃহীত হয়।[10] তবে এ নির্ধারণটাও যুক্তিসংগত নয়। সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মত হ’ল- শ্রমিকের নিকট হ’তে ততক্ষণ কাজ করে নেয়া যাবে, যতক্ষণ সে স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে সক্ষম।[11] আল্লাহ তা‘আলা বলেন, لاَيُكَلِّفُ اللهُ نَفْسًا إِلاَّ وُسْعَهَا ‘কাউকে আল্লাহ তার সাধ্যের অতীত কাজের দায়িত্ব দেন না’ (বাক্বারাহ ২/২৮৬)।
কাজ করে নেয়ার আগে শ্রমিককে তার কাজের ধরন সম্পর্কে অবগত করাতে হবে। তাকে এক কাজে নিয়োগ করে তার অনুমতি ছাড়া অন্য কাজে লাগানো উচিত নয়। এমনকি তার সম্মতি ব্যতীত যেকোন কাজে নিয়োগ দান সমীচীন নয়। শ্রমিক দিয়ে এমন ধরনের কাজ করানো আদৌ সঙ্গত হবে না যা তার জন্য অতি কষ্টকর বা সাধ্যাতীত। সর্বদা মনে রাখতে হবে শ্রমিক মালিকের হাতের ক্রীড়নক নয়, বরং সে তারই সমমর্যাদার অধিকারী স্বাধীন এক সত্তা।[12]
শ্রমিকের পেশা পরিবর্তন বা কর্মস্থল পরিবর্তনে অধিকার থাকবে। এতে কারও হস্তক্ষেপ অর্থই তার স্বাধীন সত্তায় বাধা দানের শামিল। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মানুষের ব্যক্তিত্বকে এমনভাবে ক্ষুণ্ণ করা হয়েছে যে, শ্রমিককে তার এই মানবিক স্বাধীনতা হ’তে বঞ্চিত করা হয়েছে। এ ব্যবস্থায় শ্রমিক ইচ্ছামত কাজ নির্বাচন করে নিতে বা এক স্থান হ’তে অন্য স্থানে গমন করতে পারে না। ১৯৪০ সালের ২৬ জুন তারিখে স্টালিনের আমলে শ্রমিকদের স্থানান্তরের অধিকার হ’তে বঞ্চিত করা হয়।[13]
শ্রমিকের আরেকটি প্রণিধানযোগ্য অধিকার হ’ল লভ্যাংশের ভিত্তিতে অংশীদারিত্ব লাভ করা। আমরা দেখতে পাই শ্রমিকশ্রেণী উৎপাদনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করলেও মুনাফা লুটে নেয় মালিক শ্রেণী। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এই অমানবিক ব্যবস্থার মূলে কুঠারাগাত হেনে ঘোষণা করেন, ‘শ্রমিকদেরকে তাদের শ্রমার্জিত সম্পদ হ’তেও অংশ দিও। কারণ আল্লাহর মজুরকে বঞ্চিত করা যায় না’।[14]
সমাজের সদস্য হিসাবে অন্যসব মানুষের ন্যায় শ্রমিকেরও মৌলিক অধিকার রয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও বাসস্থানের ক্ষেত্রে। এ অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করা মালিকদের একান্ত কর্তব্য। শ্রমিকের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটবে এমন ধরনের কাজ তাদের নিকট হ’তে গ্রহণ করা অনুচিত। এ সম্পর্কে প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ইবনে হাযম (রহঃ) বলেন, ‘মালিকের জন্য উচিৎ শ্রমিকের নিকট থেকে ততটুকু কাজ নেওয়া, যতটুকু সে সামর্থ্য অনুযায়ী অনায়াসে সুষ্ঠুভাবে করতে পারে। এমন কোন কাজ করতে তাকে বাধ্য করা যাবে না, যার ফলে তার স্বাস্থ্যহানি ঘটে অথবা তার ক্ষতি হয়।[15]
শ্রমিকদেরকে সুদক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা মালিক পক্ষের কর্তব্য। অনুরূপভাবে সমাজের অন্যান্য লোকের সন্তানের ন্যায় তাদের সন্তানরাও যেন উপযুক্ত শিক্ষা লাভ করে জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে সে সুযোগ করে দেওয়াও কর্তব্য।
শ্রমিক শ্রেণীর লোকজন সাধারণতঃ দারিদ্র্যসীমার একেবারেই নীচে বসবাস করে। তাই তাদের অধিকাংশের মাথা গুজার ঠাঁই পর্যন্ত থাকে না। যদিও কিছু লোকের বাসস্থান থাকে, তবে তাদের কাজের তাকীদে নিজ জায়গা ছেড়ে অন্যত্র পাড়ি জমাতে হয়। ফলে তারা হয় উদ্বাস্ত্ত। তারা যেন নিদ্রা ও বিশ্রামসহ সুস্থ থেকে মনযোগের সঙ্গে কাজ করতে পারে, সে ব্যবস্থা করার দায়িত্ব মালিকের উপর বর্তায়। মালিকের পক্ষ থেকে এটি এক ধরনের অনুগ্রহ মনে হ’লেও প্রকৃতপক্ষে এটি তাদের প্রাপ্য অধিকার। ওমর (রাঃ) সরকারী কর্মচারীদেরকে নির্দেশ দিতে গিয়ে বলতেন, ‘সবচেয়ে ভাল এবং সৎ শাসনকর্তা সে-ই যার অধীনে সাধারণ মানুষ স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তার সাথে থাকে। আর সবচেয়ে খারাপ শাসনকর্তা সেই, যার প্রজা-সাধারণ অভাব ও অশান্তিতে দিন যাপন করে।[16]
মিল-কারখানা বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে কাজ করলে সেখানে মুনাফা হবার সাথে সাথে লোকসানের সম্ভাবনা থাকে। অনেক সময় যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল বা মালিকের সম্পদের ক্ষতি সাধিত হ’তে পারে। এতে অর্থপিপাসু ও আত্মসর্বস্ব মালিকগণ জঘন্য লালসার বশবর্তী হয়ে শ্রমিকগণের কাজ খারাপের অভিযোগ এনে ক্ষতিপূরণের নামে শোষণ করতে তৎপর হয়ে উঠে। এটা যথারীতি শ্রমিকের অধিকার হরণ। তাদের শ্রমের যতকিঞ্চিত অবমূল্যায়ন করা যেন না হয় সেদিকে মালিকগণের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। ইমাম ইবনে হাযম (রহঃ) বলেন, ‘যাকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য শ্রমিক হিসাবে রাখা হয়েছে, তার হাতে যদি ক্ষতি বা কোন কিছু নষ্ট হয়ে যায়, তবে ক্ষতি পূরণের দায়িত্ব শ্রমিকের উপর বর্তায় না। হ্যাঁ, সে যদি ক্ষতি করার ইচ্ছা নিয়ে তা করে তবে অন্য কথা। আর এই ব্যাপারে কোন সাক্ষী না থাকলে মজুরের কথাই গ্রহণযোগ্য হবে কসম সহ’।[17]
কোন কোন মালিক কৃত্রিম ঘাটতি সৃষ্টি করে শ্রমিকের পারিশ্রমিক কমিয়ে দেয়ার অপপ্রয়াস চালায়। এটি একেবারে অমানবিক কাজ। শ্রমিককে নির্দিষ্ট মজুরীর বিনিময়ে নিয়োগ করার পর, উৎপাদন ঘাটতি হ’লেও তাদের মতামত ব্যতীত সামান্যতম পারিশ্রমিক কম করা যাবে না। ঘাটতির লোকসান মালিককেই বহন করতে হবে।[18]
শ্রমিকগণের চাকুরীর নিরাপত্তা বিধান করা তাদের অন্যতম অধিকার হিসাবে গণ্য। মালিকগণ ইচ্ছামত শ্রমিককে চাকুরীচ্যুত করবে কিংবা কথায় কথায় চাকুরী ছাড়ার নোটিশ দিবে এটা মানবতা বিরোধী। তাই শ্রমিকগণ যাতে নিশ্চিন্ত মনে চাকুরী করতে পারে এ ব্যাপারে নিয়োগকারী সংস্থা অভয়বাণী প্রদান করবে। অপরপক্ষে শ্রমিকগণ অসুবিধার কারণে চাকুরী ছাড়তে চাইলে সে সুযোগ তাদের দিতে হবে। এমনিভাবে নিয়োগকারী সংস্থার মারাত্মক অসুবিধা দেখা দিলে সে শ্রমিকের সাথে কৃতচুক্তি বাতিল করতে পারে। এই সকল পরিস্থিতিতে সবকিছু ন্যায়নীতির ভিত্তিতে হচ্ছে কি-না সে দিকে অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় সতর্ক দৃষ্টি রাখবে মালিকগণ, যাতে কোন রকমের বিপর্যয় সৃষ্টি না হয়।[19]
মানুষের জীবনে চাহিদার অন্ত নেই। চাহিদা বহুল জীবনের প্রয়োজন মেটানোর জন্য অর্থের প্রয়োজন। শ্রমিকদের অর্থ-উপার্জনের একমাত্র পথ শ্রমের বিনিময় গ্রহণ। মালিকগণ শ্রমিকদের যে অর্থ প্রদান করে থাকে, এতে যদি তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ না হয়, তবে সে স্বীয় প্রয়োজন পূরণার্থে মালিকের নিকট দাবী-দাওয়া পেশ করার অধিকার রাখে। তাদের যথোপযুক্ত দাবী পূরণের কথা উল্লেখ করে মহানবী (ছাঃ) বলেন, ‘শ্রমিকদেরকে যথারীতি খাদ্য ও পোষাক দিতে হবে’।[20]
বৃদ্ধ বা অসুস্থকালীন ভাতা ও সামাজিক নিরাপত্তা লাভ শ্রমিকগণের সবচেয়ে বড় প্রাণের দাবী। শ্রমই শ্রমিকগণের একমাত্র পুঁজি। শ্রমিক বৃদ্ধ বা অসুস্থ হয়ে পড়লে তার জীবিকা নির্বাহের কোন পথই থাকে না, যা দিয়ে সে অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থা করবে। সে তখন একেবারে অসহায় দিশেহারা হয়ে পড়ে। খাদ্যের জন্য সে তার যৌবনের উষ্ণ রক্ত ও শক্তি-সামর্থ্য ব্যয় করে আজ সে নিঃস্ব ও রিক্ত অথচ মালিকগণ ভুলেও তার করুণ দৈন্যদশার দিকে ফিরে তাকায় না। তাই বৃদ্ধ, পঙ্গু, অসুস্থ, অসহায় ও দুর্বল লোকদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব মালিক তথা সরকারের। সরকার রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে তাদের সমস্ত প্রয়োজন পূরণ করবে, প্রয়োজন অনুপাতে ভাতা নির্ধারণ এবং তাদের সামাজিক নিরাপত্তা বিধান করবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
أَنَا أَوْلَى بِالْمُؤْمِنِيْنَ مِنْ أَنْفُسِهِمْ، فَمَنْ مَاتَ وَعَلَيْهِ دَيْنٌ وَلَمْ يَتْرُكْ وَفَاءً: فَعَلَىَّ قَضَؤُهُ وَمَنْ تَرَكَ مَالاً فَلِوَرثَتِهِ-
‘আমি মুমিনের অভিভাবক। তাদের মধ্যে হ’তে কেউ মৃত্যুবরণ করলে এবং তার উপর কর্য (দেনা) থাকলে আর তা পরিশোধের কোন ব্যবস্থা না থাকে তবে তা পরিশোধের দায়-দায়িত্ব আমার উপর। আর যদি সে সম্পদ রেখে যায়, তবে তার অংশীদারগণ এ সম্পদের অধিকারী হবে’।[21]
ড. মুহাম্মাদ শফীকুল আলম
প্রভাষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী কোর্ট কলেজ, রাজশাহী।
[1]. বুখারী, মিশকাত হা/২৭৫৯।
[2]. বুখারী ও মুসলিম; মিশকাত হা/১১।
[3]. ছহীহ ইবনু মাজাহ হা/১৮৯৬।
[4]. ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/২৯৮৭, হাদীছ ছহীহ, ‘ক্রয়-বিক্রয়’ অধ্যায়।
[5]. ফরীদ উদ্দীন মাসউদ, ইসলামে শ্রমিকের অধিকার (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৮৬), পৃঃ ১০৯।
[6]. ঐ।
[7]. ঐ, পৃঃ ১১১।
[8]. মাওলানা হিফজুর রহমান, ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, অনু: মাওলানা আবদুল আউয়াল (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, তৃতীয় প্রকাশ, ২০০০ খৃঃ), পৃঃ ৭৮।
[9]. বুখারী; মিশকাত হা/২৯৮৪।
[10]. ইসলামে শ্রমিকের অধিকার, পৃঃ ১১৩।
[11]. ঐ।
[12]. ইসলামে শ্রমিকের অধিকার, পৃঃ ১১৪।
[13]. ঐ, পৃঃ ১১৫।
[14]. ঐ, পৃঃ ১১৬।
[15]. ঐ।
[16]. ইসলামে শ্রমিকের অধিকার, পৃঃ ১১৭-১১৮।
[17]. ঐ।
[18]. ঐ।
[19]. ঐ।
[20]. মুসলিম, মিশকাত হা/৩৩৪৪।
[21]. বুখারী ও মুসলিম; মিশকাত হা/৩০৪৪।