পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ । পর্ব ৬ ।

(৩) মতভেদকৃত বিষয়ে তোমার (ইমামের চেয়ে বেশী বিদ্বান হওয়ার এবং তার নিকটে বিশেষ কোন দলীল থাকার) এ দাবী অবশ্যই তোমার কোন উপকার দিবে না। কেননা মতভেদটা করেছেন তোমার তাক্বলীদকৃত ইমাম এবং তোমার বিপক্ষজনের তাক্বলীদকৃত ইমাম। আর তোমার বিপক্ষজন যার তাক্বলীদ করছে তার কথার সাথে আবুবকর, ওমর, আলী, ইবনু আববাস, আয়েশা (রাঃ) ও অন্যদের কথার মিল পাওয়া যায়, কিন্তু তোমার তাক্বলীদকৃত ইমামের পক্ষে কোন ছাহাবীর কথার মিল পাওয়া যায় না। এমতাবস্থায় তুমি কেন নিজেকে এ উপদেশ দাও না এবং কেন সঠিক পথের তালাশে বল না যে, এরা দু’জনই বড় আলেম, কিন্তু একজনের সংগে উল্লিখিত ছাহাবীরা যখন রয়েছেন, তখন তিনিই আমার তাক্বলীদের জন্য বেশী উপযুক্ত?

(৪) মতভেদের দরুন ইমামে ইমামে কাটাকাটি হ’ল, অক্ষত থাকল ছাহাবীর কথা। এমতাবস্থায় ঐ ছাহাবীই তো তাক্বলীদের বেশী উপযুক্ত।

(৫) তোমার তাক্বলীদকৃত ইমামের যখন ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব, আলী ইবনু আবী তালিব, আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ ও তাদের সমতুল্য ছাহাবীদের উপর এমন কোন বিদ্যার জোরে জয়যুক্ত হওয়া বৈধ, যা তাদের অজানা থেকে গিয়েছিল, তখন তার সমকালীন অথবা পরবর্তীকালের ইমামদেরও তো এমন বিদ্যা জানা থাকা খুবই জোরালো ভাবে বৈধ, যা তোমার ইমামের কাছে অজ্ঞাত থেকে গেছে। কেননা তোমার তাক্বলীদকৃত ইমাম ও ছাহাবীদের আমলের মাঝের সাদৃশ্য অপেক্ষা তোমার ইমামের সমকালীন অথবা পরবর্তীকালের ইমামদের ও ছাহাবীদের আমলের মাঝের সাদৃশ্য বেশী লক্ষ্য করা যায়। আর ছাহাবীদের অজানার তুলনায় তোমার ইমামের অজানার পরিমাণ বেশী হওয়া স্বাভাবিক।

(৬) যখন তুমি নিজের পক্ষে অপেক্ষাকৃত নিম্নস্তরের লোকের কথামতো শ্রেষ্ঠতর ও বিজ্ঞতর ব্যক্তির বিরোধিতা জায়েয করে নিলে তখন ঐ নিম্নস্তরের লোকটির বিরোধিতা করে অপেক্ষাকৃত বিজ্ঞজনের কথা মান্য করা নিজের জন্য কেন জায়েজ করলে না? উচিত ও আবশ্যিক তো ছিল তুমি যা করছ তার বিপরীতটা। আসলেও তাই নয় কি?

(৭) তুমি কি তোমার ইমামের তাক্বলীদের ক্ষেত্রে কিভাবে যৌন সম্পর্ক বৈধ হয়, কোন ক্ষেত্রে রক্তপাত হালাল হয়, কোনভাবে সম্পদ মুবাহ হয় এবং মালিকানা হস্তান্তরের বৈধ নীতিই বা কী সে সম্পর্কে আল্লাহ অথবা তার রাসূলের আদেশের  কিংবা  উম্মতের  ইজমার  অথবা  কোন  একজন

ছাহাবীর কথার সাথে মিল রেখে চল? যদি সে বলে, হ্যঁা তাহ’লে সে এমন কথা বলল, যা আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও সকল আলেম বাতিল বলে জানেন। (কেননা মুক্বাল্লিদ হিসাবে তার তাক্বলীদের পক্ষে আল্লাহ ও রাসূলের যেমন আদেশ নেই, তেমনি অজ্ঞ হিসাবে তার যৌন সম্পর্ক ইত্যাদির বৈধতার নিয়মাবলী জানার কথা নয়। কাজেই তার এ কথা স্বভাবতই বাতিল।) আর যদি সে বলে, না, তাহ’লে সে তার নিজের বিরুদ্ধে সেই সাক্ষ্যই তুলে ধরল, যা তার বিরুদ্ধে আল্লাহ, তার রাসূল ও আলেমকুল দিয়েছেন।

(৮) তোমার অনুসরণীয় ইমামের তাক্বলীদই তোমার উপর তাক্বলীদ হারাম করেছে। কেননা তোমার ইমামই তোমাকে তাক্বলীদ করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন,لاَ يَحِلُّ لَك أَنْ تَقُولَ بِقَوْلِهِ حَتَّى تَعْلَمَ مِنْ أَيْنَ قَالَهُ- ‘তোমার জন্য তার কথা দ্বারা কথা বলা ততক্ষণ পর্যন্ত হালাল হবে না, যতক্ষণ তিনি কোত্থেকে তা বলেছেন তুমি তা না জানবে’। আর তিনি তোমাকে তার তাক্বলীদ করতে এবং অন্য আলেমদের তাক্বলীদ করতে নিষেধ করেছেন। অতএব তুমি যদি তার সমগ্র মাযহাবের তাক্বলীদকারী হও তবে এ কথাও তো তার মাযহাবের অংশ। এখানে কেন তুমি তার তাক্বলীদ করছ না?

(৯) তোমার কাছে এমন কোন প্রমাণ আছে কি যার বদৌলতে তুমি ধরতে পারছ যে, তোমার তাক্বলীদকৃত ইমাম তোমার দ্বারা উপেক্ষিত পূর্বাপর সকল যুগের আলেম-ওলামার তুলনায় সঠিক পথে থাকার অধিকতর যোগ্য? নাকি তোমার কাছে এমন কোন প্রমাণ নেই? যদি সে বলে, আমার কাছে এমন প্রমাণ আছে, তবে সে এমন কথা বলছে, যার বাতিল হওয়া সুবিদিত। আর যদি সে বলে, আমার কাছে এমন প্রমাণ নেই এবং সেটাই সত্য, তাহ’লে তাকে বলা হবে, ক্বিয়ামতের দিন তুমি যখন আল্লাহর সামনে দাঁড়াবে তখন তুমি কী অজুহাত পেশ করবে; যখন তোমার তাক্বলীদকৃত ইমাম তোমাকে একটি নেকী দিয়েও উপকার করবে না এবং তোমার একটি পাপও বহন করবে না? অথচ আজ যার সঠিকতা-বেঠিকতার বিষয়ে তোমার নিশ্চিত জানা নেই তার কথার ভিত্তিতে তুমি দুনিয়াতে আল্লাহর সৃষ্টিকুলের মধ্যে বিচার করছ, আর ফৎওয়া দিচ্ছ!

(১০) তুমি কি তোমার অনুসৃত ইমামের নিষ্পাপত্ব দাবী কর? নাকি তার ভুল হ’তে পারে বলে স্বীকার কর? প্রথমটা তো হওয়ার কোনই উপায় নেই। তুমিও তা বাতিল হওয়া স্বীকার কর। অতএব দ্বিতীয়টা হওয়া স্থির হয়ে গেল। আর যখন তুমি তার ভুল হওয়া স্বীকার করছ তখন যার ভুলকারী হওয়ার বৈধতা তুমি মেনে নিচ্ছ তার কথা মতো কিভাবে তুমি হালাল করছ, হারাম করছ, ফরয করছ, রক্তপাত করছ, জননক্রিয়া হালাল করছ, মালিকানা বদলে দিচ্ছ এবং সুন্দরকে মলিন করছ?

(১১) যখন তুমি তোমার তাক্বলীদকৃত ইমামের কথা অনুযায়ী ফৎওয়া দাও কিংবা বিচার কর তখন কি তুমি বলবে, নিশ্চয়ই এটাই আল্লাহর সেই বিধান যা দিয়ে তিনি তার রাসূলকে পাঠিয়েছিলেন, যা দিয়ে তিনি তার কিতাব অবতীর্ণ করেছিলেন এবং যা তার বান্দাদের জন্য বিধিবদ্ধ করে দিয়েছিলেন, এই বিধানের বাইরে তার আর কোন বিধান নেই? নাকি তুমি বলবে, আল্লাহ তার বান্দাদের জন্য যে দ্বীন প্রবর্তন করেছেন এটা তার বিপরীত? নাকি তুমি বলবে, আমি জানি না। তোমাকে এসব কথার একটা বলতে হবে। অবশ্য প্রথম কথাটা বলার সুযোগ তোমার একেবারেই নাই। কেননা আল্লাহর যেই বিধানের (দ্বীনের) বাইরে আল্লাহর আর কোন বিধান (দ্বীন) নেই সেই বিধানের (দ্বীনের) বিরুদ্ধাচরণ করা বৈধ হ’তে পারে না। তার বিরোধিতাকারী কমসেকম পাপী হবেই। দ্বিতীয় কথাও তুমি দাবী করতে পারবে না। সুতরাং তোমার জন্য তৃতীয় কথা বলা ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। হায় আল্লাহ! কি অবাক করা কথা! তুমি জননক্রিয়া, রক্তপাত, মালদৌলত ও নানা অধিকার মুবাহ বা আইনসিদ্ধ গণ্য করছ, এটা হালাল, ওটা হারাম ঠাওরাচ্ছ এমন বিধান বলে, যার সুন্দরতম ও শ্রেষ্ঠতম ভিত্তি হল, আমি জানি না। কবি বলেন,

فَإِنْ كُنْت لَا تَدْرِي فَتِلْكَ مُصِيبَةٌ * وَإِنْ كُنْت تَدْرِي فَالْمُصِيبَةُ أَعْظَمُ

‘যদি তুমি সত্যিই না জান তাহ’লে তা এক বিপদ; আর যদি জেনে বল, তাহ’লে তা মহাবিপদ’।

(১২) অমুক, অমুক যাদের তোমরা তাক্বলীদ কর এবং যাদের কথাকে শরী‘আত প্রণেতার বক্তব্যের পর্যায়ে গণ্য কর, তাদের জন্মের পূর্বের লোকেরা কোন মতের উপর ছিলেন? আফসোস ! তোমরা যদি এতটুকুতেই ক্ষ্যান্ত হ’তে তাহ’লেও হ’ত! বরং তোমরা আরও এক ধাপ এগিয়ে অনুসরণের ক্ষেত্রে তাদের কথাকে শরী‘আত প্রণেতার বক্তব্যের থেকে শ্রেয় গণ্য করছ। এদের জন্মের আগের লোকগুলো কি সঠিক পথে ছিলেন, না ভ্রান্ত পথে ছিলেন? তোমাদেরকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, তারা সঠিক পথে ছিলেন।  এবার তাদের নিকটে জিজ্ঞাসা, তারা যে মতের উপর ছিলেন তা হল : কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণ; আল্লাহ, রাসূল ও তার ছাহাবীদের বক্তব্যগুলিকে তাদের বিরোধী বক্তব্যের উপর অগ্রাধিকার দান এবং কোন ব্যক্তির কথা কিংবা সিদ্ধান্ত নয়; বরং কুরআন-সুন্নাহর ফায়ছালা গ্রহণ। তারা অন্য কোন মতের উপর ছিলেন না। এটাই যদি সঠিক পথ হয় তাহ’লে সঠিক পথের পরে ভ্রান্ত পথ ছাড়া আর কী থাকতে পারে? তাহ’লে তোমরা উল্টো কোন দিকে ছুটছ? যদি তারা বলে, আমাদের ইমাম ছাহেব সহ মুক্বাল্লিদদের সকল দল সেই আদর্শের উপর রয়েছে, যার উপর পূর্বসূরী সালাফগণ ছিলেন; তারা তাদের মানহাজ (জীবনধারা) অনুসরণ করেছেন এবং তাদেরই রাস্তায় হেঁটেছেন; তাহ’লে তাদের কাছে জিজ্ঞাসা, তোমাদের ইমাম ছাহেবের সাথে অন্যান্য ইমামরাও কি সেই মানহাজে অংশীদার, নাকি তোমাদের ইমাম ছাহেব একাই তা অনুসরণ করেছেন এবং অন্যরা তা থেকে বঞ্চিত থেকে গেছেন? দু’টির একটিই কেবল এখানে সঠিক হবে। যদি তারা দ্বিতীয় কথায় সায় দেয় তাহ’লে তারা চতুষ্পদ প্রাণী থেকেও গুমরাহ গণ্য হবে। আর যদি প্রথম কথায় সায় দেয় তবে বলব, তাহ’লে কিভাবে তোমরা তোমাদের ইমাম ছাহেবের কথা পুরোটাই গ্রহণ করলে এবং তার থেকে বেশী জাননেওয়ালা কিংবা তার সমতুল্য জনের কথা পুরোটাই ছুঁড়ে ফেলে দিলে? এখন তার একটা কথাও প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে না এবং বিপক্ষের ইমামের একটা কথাও গ্রহণ করা হচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেন, সঠিক যা তা সব তোমাদের ইমামের ভাগে, আর ভুল-ভ্রান্তি যা তার বিপক্ষের ঘাড়ে। একারণেই তিনি যা বলেছেন তার সবটুকুতেই তোমরা সমর্থন দাও এবং তার বিপক্ষের কথা পুরোটাই প্রত্যাখ্যান কর। অন্যরাও আবার তোমাদের সাথে একই আচরণ করে।

ইমামগণ তাদের তাক্বলীদ করতে নিষেধ করেছেন

(১৩) তোমরা যেসব ইমামের তাক্বলীদ কর তারা কিন্তু তোমাদেরকে তাদের তাক্বলীদ করতে নিষেধ করেছেন। সুতরাং তাক্বলীদের ফলে তোমরাই তাদের প্রথম বিরোধিতাকারী হচ্ছ। ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেছেন, مَثَلُ الَّذِي يَطْلُبُ الْعِلْمَ بِلَا حُجَّةٍ كَمَثَلِ حَاطِبِ لَيْلٍ، يَحْمِلُ حُزْمَةَ حَطَبٍ، وَفِيهِ أَفْعَى تَلْدَغُهُ، وَهُوَ لَا يَدْرِي ‘দলীল-প্রমাণ ছাড়া যে বিদ্যা অন্বেষণ করে সে রাতে কাঠ সংগ্রহকারীর মত; সে কাঠের বোঝা মাথায় বহন করে, অথচ তার মধ্যে রয়েছে সাপ, যা তার অজান্তে তাকে দংশন করবে’।[1] ইমাম আবু হানীফা ও আবু ইউসুফ (রহঃ) বলেছেন, لَا يَحِلُّ لِأَحَدٍ أَنْ يَقُولَ بِقَوْلِنَا، حَتَّى يَعْلَمَ مِنْ أَيْنَ قُلْنَاهُ ‘কারও জন্য আমাদের কথা দ্বারা উদ্ধৃতি দেওয়া ততক্ষণ জায়েয হবে না যতক্ষণ না সে আমরা কোত্থেকে কথাটি বলেছি তা না জানবে’। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) বলেছেন, لَا تُقَلِّدْ دِيْنَك أَحَدًا ‘তোমার দ্বীনের ক্ষেত্রে তুমি কারও তাক্বালীদ কর না’।

তাক্বলীদের দাওয়াতদাতাদের সাথে পুনর্বিতর্ক

(১৪) তোমরা কি বিশ্বাস কর যে, আগামীকাল তোমরা মহান আল্লাহর সামনে দাঁড়াবে এবং তিনি তোমাদেরকে জিজ্ঞেস করবেন, তোমরা তার বান্দাদের জীবন, লজ্জাস্থান, দেহ ও সম্পদের বিষয়ে কিসের ভিত্তিতে ফায়ছালা দিয়েছিলে? কোত্থেকে তার দ্বীনী বিষয়ে হালাল-হারাম, ফরয-ওয়াজিব ইত্যাদির ফৎওয়া দিয়েছিলে? তাদের উত্তর তো হবে, হ্যঁা, আমরা তা বিশ্বাস করি। এখন তাদের কাছে জিজ্ঞাসা, যখন তিনি তোমাদের জিজ্ঞেস করবেন, কোত্থেকে তোমরা এ কথা বলেছিলে, তখন তোমাদের উত্তর কী হবে?  তোমরা তখন বলবে, আমাদের উত্তর এই যে, আমরা মুহাম্মাদ বিন হাসান রচিত ‘আল-আছল’ গ্রন্থ অনুসারে হালাল-হারাম গণ্য করেছি এবং বিচার-ফায়ছালা করেছি, যা কিনা তিনি আবু হানীফা ও আবু ইউসুফ থেকে তাদের রায় ও মত হিসাবে বর্ণনা করেছেন; অথবা ‘আল-মুদাওয়ানা’ গ্রন্থে সাহনূনের মাধ্যমে ইবনুল কাসেম কর্তৃক বর্ণিত রায় ও মত অনুসারে করেছি; অথবা ‘আল-উম্ম’ গ্রন্থে রবী কর্তৃক বর্ণিত রায় ও মত অনুসারে করেছি; অথবা এদের বাদে অন্যদের বর্ণিত রায় ও মত অনুসারে করেছি। হায়! তোমরা যদি এতুটুকুতেই থামতে কিংবা এর থেকে ঊর্ধ্বে উঠতে অথবা তোমাদের ইচ্ছে এমনতর কারও পানে ধাবিত হ’ত! তোমরা বরং অনেক নীচু স্তরে নেমে গেছ। যাহোক, তোমাদের যখন জিজ্ঞেস করা হবে, তোমরা কি এ কাজ আমার হুকুমে করেছিলে, নাকি আমার রাসূলের হুকুমে, তখন তোমাদের জবাব কী হবে? যদি তখন তোমাদের এ জবাব দেওয়া সম্ভব হয় যে, তুমি আমাদের যা হুকুম করেছিলে এবং তোমার রাসূল আমাদের যা হুকুম করেছিলেন আমরা তাই করেছিলাম, তাহ’লে তো তোমরা সফল ও নাজাত পেয়ে গেলে। আর যদি তোমাদের তা বলা সম্ভব না হয় তাহ’লে তোমাদের অবশ্যই বলতে হবে, না তুমি হুকুম করেছিলে, না তোমার রাসূল, না আমাদের ইমামগণ। দু’টি জবাবের একটি অবশ্যই দিতে হবে।

(১৫) যখন ঈসা ইবনু মারইয়াম একজন সুশাসক ও ন্যায়বিচারক হিসাবে পৃথিবীতে আবির্ভূত হবেন তখন তিনি  কোন মাযহাব অনুযায়ী হুকুম দিবেন? কার মত অনুযায়ী বিচার করবেন? বিষয়টি কিন্তু সুপরিজ্ঞাত যে, তিনি আমাদের নবীর সেই শরী‘আত অনুযায়ী হুকুম ও বিচার করবেন, যে শরী‘আত আল্লাহ তার বান্দাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন। আল্লাহ যে ফায়ছালা দিয়েছেন তা পালনে ঈসা ইবনু মারইয়াম হবেন তার সবচেয়ে যোগ্যতম ও নিকটতম ব্যক্তি। আল্লাহই তো তাঁর শরী‘আত মোতাবেক বিচার করা ও ফৎওয়া দেওয়া ফরয করেছেন। কারও জন্যই তো এর বিপরীত বিচার করা ও ফৎওয়া দেওয়া বৈধ হবে না। এখন যদি তোমরা বল, এ প্রশ্ন তো আমাদের ও তোমাদের সবার জন্যই সমান প্রযোজ্য, তাহ’লে আমরা বলব, হাঁ, তা বটে; তবে আমাদের উত্তর তোমাদের থেকে ভিন্ন। আমরা বলব, হে আমাদের প্রভু! নিশ্চয়ই তোমার জানা আছে যে, আমরা কোন ব্যক্তি বিশেষকে তোমার কালামের এবং তোমার রাসূলের কালামের উপর যাচাইকারী নিয়োগ করিনি। যে বিষয়ে আমাদের মতভেদ দেখা দিয়েছিল তা মীমাংসায় আমরা তার দ্বারস্থ হইনি, তার কথাকে ফায়ছালা হিসাবে মানিনি এবং তার কোন কথাকেই তোমার কথা, তোমার রাসূলের কথা ও তোমার রাসূলের ছাহাবীদের কথার উপরে স্থান দেইনি। কোন সৃষ্টির কথা ও মতামতকে তোমার অহীর উপরে স্থান দেওয়া আমাদের নিকট অত্যন্ত ঘৃণ্য ছিল। আমরা বরং তদনুযায়ী ফৎওয়া দিয়েছি যা আমরা তোমার কিতাবে পেয়েছি এবং আমাদের নিকটে আগত তোমার রাসূলের সুন্নাতে পেয়েছি আর যা দিয়ে তোমার নবীর ছাহাবীগণ ফৎওয়া দিয়েছিলেন। যদি আমরা এর ব্যত্যয় করে থাকি তবে তা ছিল ভুলক্রমে, স্বেচ্ছায় নয়। আমরা তোমাকে, তোমার রাসূলকে এবং মুমিনদেরকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধু বানাইনি। আমরা আমাদের দ্বীনকে বিভক্ত করে দলে দলে বিভক্ত হইনি এবং আমাদের দ্বীনী কাজকে নিজেদের মধ্যে ভাগ ভাগ করিনি। আমরা আমাদের ইমামদের আমাদের নেতা মেনেছিলাম এবং আমাদের ও তোমার রাসূলের মাঝে মধ্যবর্তী বানিয়েছিলাম ঐসব বিষয়ে যা তারা তাঁর থেকে বর্ণনা করে আমাদের পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলেন। আমরা ততটুকুতেই তাদের অনুসরণ ও তাক্বলীদ করেছিলাম। তুমি ও তোমার রাসূলও আমাদেরকে এ আদেশ দিয়েছিলে যে, আমরা তাদের কথা শুনব এবং তারা যা তোমার ও তোমার রাসূলের পক্ষ থেকে প্রচার করবে আমরা তা মেনে নেব। তাই তোমার ও তোমার রাসূলের কথা শোনা ও মানার স্বার্থে আমরা তা করেছিলাম। আমরা তাদেরকে আমাদের রব বানাইনি, তাদের কথাকে ফায়ছালা হিসাবে মানিনি, ঐ সব কথার ভিত্তিতে আমরা বিতর্কে লিপ্ত হইনি এবং ঐসব কথার ভিত্তিতে আমরা বন্ধুত্ব ও শত্রুতা গড়িনি, বরং তাদের কথাকে তোমার কথা ও তোমার রাসূলের সুন্নাতের সাথে মিলিয়ে দেখেছিলাম। ঐ দু’টির সঙ্গে মিলে গিয়েছিল তা গ্রহণ করেছিলাম, আর যা মিলেনি তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলাম এবং তা প্রত্যাখ্যান করেছিলাম, যদিও তারা আমাদের থেকে তোমার কিতাব ও তোমার রাসূলের সুন্নাত সম্পর্কে বেশী জ্ঞাত ছিলেন। তাদের মধ্যে কোন মাসআলায় যার কথা তোমার রাসূলের কথার সাথে মিলে গিয়েছিল তিনি ঐ মাসআলায় সবচেয়ে বেশী জ্ঞাত বলে আমরা গণ্য করেছিলাম। ভাইয়েরা, এই হবে আমাদের জবাব। এখন আমরা তোমাদের আল্লাহর কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করছি, তোমরাও কি অনুরূপ যে, এই একই উত্তর তার সামনে দিতে পারবে যার নিকট কথার হেরফের করা যাবে না এবং যার নিকট অলীক-বাতিল কথা চালিয়ে দেওয়া যাবে না?

(১৬) হে বিভিন্ন দলের মুক্বাল্লিদরা! তোমরা তোমাদের তাক্বলীদকৃত ইমামদের বাদে ছাহাবীদের প্রথমজন থেকে শেষজন পর্যন্ত, তাবেঈদের প্রথমজন থেকে শেষজন পর্যন্ত এবং উম্মতের আলেমকুলের প্রথমজন থেকে শেষজন পর্যন্ত সকলকে এমন ব্যক্তির পর্যায়ে নামিয়ে এনেছ যার কথা গণনাতে নেওয়া যায় না, যার ফৎওয়া নযর দেওয়ার মত নয়,  ঐসব ফৎওয়ায় মশগূল হওয়া সময়ের অপচয় মাত্র, যা ধর্তব্যও নয় আবার ভাবনা-চিন্তারও যোগ্য নয়। কেবল যখন তাদের কথা তোমাদের অনুসৃত ইমামের কথার বিপরীতে দাঁড়ায় তখন শুধুই তা রদ করার মানসে তোমরা যা একটুখানি নযর দিয়ে থাক। অথচ চিন্তাকে এভাবে কাজে লাগানো মতলববাজি ছাড়া আর কিছুই নয়।

প্রতিপক্ষের কথা এরূপ উদ্দেশ্য নিয়ে রদ করা তারা জায়েয বানিয়ে নিয়েছে। তাই যখন আল্লাহ জাল্লা শানুহু ও তার রাসূলের কোন সুস্পষ্ট কথা (নছ) তাদের অনুসৃত ইমামের কথার বিপরীতে দাঁড়ায় তখন তাদের অনুসৃত ইমামের কথা যাতে বজায় থাকে সেজন্য ঐ সুস্পষ্ট কথাকে তাৎপর্যহীন করতে যত রকম হিলা-বাহানা করা আবশ্যক তা তারা করে। হায় আল্লাহ! তাঁর দ্বীন, তাঁর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নাতে এ কেমন বিদ‘আত ঢুকে পড়ল যে, মহান আল্লাহ যদি এই দ্বীনের মধ্যে এমন একজন মুখপাত্র না রাখতেন যিনি দ্বীনের নিশান বরদারি করবেন এবং তার বিরোধিতাকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন তাহ’লে তা ঈমানের আসন পর্যন্ত টলিয়ে দিত! তার স্তম্ভ পর্যন্ত ধ্বসিয়ে দিত! তাই যারা তাদের অনুসৃত ইমাম ব্যতীত ছাহাবা, তাবেঈন এবং মুসলিম আলেমদের কোন একজনের কথা ও ফৎওয়ার প্রতি ভ্রূক্ষেপমাত্র করে না, বরং নিজেদের ইমামকে যারা আল্লাহ ও তার রাসূলকে ছেড়ে অন্তরঙ্গজন বানিয়ে নেয় তাদের থেকে  ছাহাবা, তাবেঈন ও মুসলিম আলেমদের প্রশংসায় এত বেশী অনুদারতা আর কেউ দেখায় না; তাদের অধিকারকে আর কেউ এতটা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে না; তাদের প্রতি কর্তব্য পালনে এত কম গুরুত্ব আর কেউ দেয় না এবং তাদের প্রতি এত বড় অশ্রদ্ধা আর কেউ পোষণ করে না।

(১৭) হে মুক্বাল্লিদগণ! এ বড়ই আজব তামাশা যে, তোমরা নিজেদের বেলায় স্বীকার কর যে, আল্লাহর কালাম ও রাসূলের কালাম থেকে দলীল-প্রমাণসহ সঠিক বিধান বের করার ক্ষমতা তোমাদের নেই। যদিও আল্লাহর কালাম সহজবোধ্য, তার উৎস কাছাকাছি, তার বর্ণনা চূড়ান্তভাবে স্পষ্ট এবং তার মধ্যে বিরোধ ও দ্বন্দ্ব থাকা অসম্ভব। তা একজন নিষ্পাপ মানুষ থেকে বর্ণিত সত্য বর্ণনা। আর আল্লাহ তা‘আলা সত্যের পক্ষে প্রকাশ্য প্রমাণাদি দাঁড় করিয়ে রেখেছেন এবং মানবমন্ডলী কিসের থেকে সাবধান থাকবে তা খোলামেলা বলে দিয়েছেন। অথচ আল্লাহ যে দলীল-প্রমাণ খাড়া করলেন এবং নিজে তা বর্ণনার ভার নিলেন তোমরা তা বুঝতে অক্ষমতার দাবী তুললে, কিন্তু অন্য দিকে দলিল-প্রমাণসহ বুঝে ফেললে যে, তোমাদের ইমাম তাক্বলীদের জন্য অন্যদের তুলনায় বেশী যোগ্য এবং তিনি তার কালে মুসলিম জাতির সবচেয়ে জ্ঞানী ও সবার সেরা মানুষ ছিলেন। এমনিতর আরও অনেক গুণে তিনি বিভূষিত।

তাক্বলীদকারী প্রতিটি দলেরই কট্টরপন্থীরা আবার নিজেদের ইমামের অনুসরণ ফরয এবং অন্য ইমামদের অনুসরণ হারাম গণ্য করে থাকে। তাদের উছূলের গ্রন্থাসমূহে এমনটা বলা আছে। কী বিস্ময়কর যে, আল্লাহ তা‘আলা সত্যের পক্ষে যে প্রমাণাদি খাড়া করলেন তারা তার মধ্যে অগ্রাধিকার দানের রাস্তা খুঁজে পেল না, খুঁজে পেল যে, তাদের ইমাম অন্য ইমামদের তুলনায় নির্ভুল পথে থাকার বেশী হকদার ও বেশী যোগ্য। অথচ আল্লাহ তা‘আলা এ কথার সমর্থনে একটি দলীলও প্রদান করেননি।

(১৮) হে মুক্বাল্লিদ সম্প্রদায়! তোমাদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বিস্ময়কর যে, তোমরা যখন আল্লাহর কিতাবে তোমাদের ইমামের মতের সাথে মিলে যায় এমন কোন আয়াত পাও তখন তোমরা সে আয়াত মেনে চল বলে যাহির কর। কিন্তু আসল কথা হ’ল ইমাম বলেছেন, তাই মানো; খোদ আয়াতের ভিত্তিতে নয়। আবার যখন তার মত একটি আয়াত তোমাদের ইমামের মতের বিরোধী পাও তখন তা মেনে না নিয়ে নানা ব্যাখ্যা হাযির কর এবং ইমামের মতের সাথে মেলেনি বলে তাকে তার প্রকাশ্য অর্থ থেকে খারিজ করে দাও। হাদীছের সুস্পষ্ট কথা (নছ)-এর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। যখন তোমরা তোমাদের ইমামের কথার সমর্থনে কোন একটা ছহীহ হাদীছ  পাও অমনি বলে ওঠো, আমাদের পক্ষে নবী (ছাঃ)-এর এই এই কথা রয়েছে। আর যখন একশ’ বা তারও বেশী ছহীহ হাদীছ তার কথার বিপরীতে মেলে তখন তার একটা হাদীছের প্রতিও তোমরা ভ্রুক্ষেপ কর না। তখন তার থেকে একটা হাদীছও তোমাদের মনোপুত হয় না। তোমরা তখন বলতে থাক, আমাদের পক্ষে নবী (ছাঃ)-এর এই এই ধরনের কথা রয়েছে। আবার যখন কোন মুরসাল হাদীছ তার মতের সমর্থনে মিলে যায় তখন তোমরা তা গ্রহণ করে থাক এবং ঐ জায়গায় মুরসালকে প্রমাণ হিসাবে গণ্য কর। কিন্তু তার মতের বিপরীতে মুরসাল হাদীছের সংখ্যা একশ’ হলেও তোমরা তার সবকটাকেই ছুঁড়ে ফেলে দাও আর বল যে, আমরা মুরসাল হাদীছকে দলীল গণ্য করি না।

[চলবে]

 

সংশোধনী

মাসিক আত-তাহরীক এপ্রিল’১৮ সংখ্যায় ‘তাক্বলীদের বিরুদ্ধে ৮১টি দলীল’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রবন্ধে ৭ পৃষ্ঠায় উল্লিখিত ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ)-এর উক্তিটির শুদ্ধরূপ হবে,وَإِنَّمَا حَدَثَتْ هَذِهِ الْبِدْعَةُ فِي الْقَرْنِ الرَّابِعِ الْمَذْمُومِ عَلَى لِسَانِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‘(তাক্বলীদের) এই বিদ‘আত চতুর্থ শতাব্দীতে সৃষ্টি হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর (পবিত্র) যবানে যেই শতক নিন্দিত’। মুদ্রণ প্রমাদজনিত এই ত্রুটির জন্য আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত।-সম্পাদক




[1]. বায়হাকী, মানাকিবুশ শাফেঈ ২/১৪৩, আল-মাদখাল ২৬৩; হিলয়াতুল আওলিয়া ৯/১২৫।





প্রাক-মাদ্রাসা যুগে ইসলামী শিক্ষা - আসাদুল্লাহ আল-গালিব (শিক্ষার্থী, ইংরেজী বিভাগ, ২য় বর্ষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)।
গীবত : পরিণাম ও প্রতিকার - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে তাক্বলীদ (৪র্থ কিস্তি) - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
মানব জাতির সাফল্য লাভের উপায় (৭ম কিস্তি) - হাফেয আব্দুল মতীন - পিএইচ.ডি গবেষক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া
অভ্যাসকে ইবাদতে পরিণত করার উপায় - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
বিদায়ের আগে রেখে যাও কিছু পদচিহ্ন - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
নফল ছিয়াম সমূহ - আত-তাহরীক ডেস্ক
সফরের আদব (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
গীবত : পরিণাম ও প্রতিকার (শেষ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
দ্বীন প্রচারে ওয়ায-মাহফিল : প্রাসঙ্গিক কিছু কথা - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
যাকাত সম্পর্কিত বিবিধ মাসায়েল (৩য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
পবিত্র রামাযান : আল্লাহর সান্নিধ্যে ফিরে আসার মাস - ড. মুহাম্মাদ নযরুল ইসলাম খান, আমেরিকা
আরও
আরও
.