পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ । পর্ব ৬ । পর্ব ৭ । শেষ পর্ব ।
দুই- দুনিয়াপূজা
সূরা নাযে‘আত ৩৭-৩৯ আয়াতের আলোকে আলোচ্য নিবন্ধে উল্লিখিত জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হওয়ার দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে দুনিয়াপূজা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর যে সীমালংঘন করেছে এবং পার্থিব জীবনকে অগ্রাধিকার দিয়েছে, তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম’ (ঐ)। ইতিপূর্বে সীমালংঘনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এক্ষণে জাহান্নামীদের দ্বিতীয় প্রধান বৈশিষ্ট্য দুনিয়াপূজা বা দুনিয়ার মোহ এবং এ থেকে পরিত্রাণের উপায় সম্পর্কে আলোচনা করা হ’ল।-
দুনিয়া সম্পর্কেদুনিয়ার সৃষ্টিকর্তার বক্তব্য : আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়াকে খুবই আকর্ষণীয় করে সৃষ্টি করেছেন। হাদীছের ভাষায় ‘হুলওয়াতুন খাযিরাহ’ অর্থাৎ ‘সুমিষ্ট ও শ্যামল-সবুজ’ করে সৃষ্টি করা হয়েছে।[1] কিন্তু এই দুনিয়া একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। নির্ধারিত সময়ে মহান আল্লাহর নির্দেশে ইসরাফীলের শিঙ্গায় ফুঁৎকারে আসমান-যমীন সব ভেঙ্গে মিছমার হয়ে যাবে। এরপর হাশরের ময়দান হবে। সেখানে সবাইকে একত্রিত করা হবে। বিচার কার্য শুরু পর্যন্ত দীর্ঘ প্রতীক্ষার প্রহর গুণতে হবে। অতঃপর বিচার হবে এবং দুনিয়ার কর্ম অনুযায়ী প্রতিফল নির্ধারিত হবে। অর্থাৎ নেককাররা চিরশান্তির আবাস, কল্পনাতীত সুখের নিবাস জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং অবাধ্য পাপিষ্ঠরা জ্বলন্ত হুতাশন জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।
যে দুনিয়াকে ঘিরে এত আয়োজন, এত প্রস্ত্ততি, গগণচুম্বী সব টাওয়ার, যার জন্য পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা, দম্ভ-অহংকার, সেই দুনিয়া নিমিষে ধ্বংস হয়ে যাবে। যে ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার মোহে পড়ে মানুষ চিরস্থায়ী আখেরাতকে ভুলে যায়, সে দুনিয়া সম্পর্কে এর সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআন মাজীদে সুস্পষ্ট বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। তুলে ধরেছেন জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য বোধগম্য দৃষ্টান্ত। নিম্নে এ সম্পর্কিত মহান আল্লাহর বাণীচিত্র বিধৃত হ’ল।-
১. ধোঁকার উপকরণ : পার্থিব জীবনকে আল্লাহ খেল-তামাশা ও ধোঁকার উপকরণ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন, فَمَنْ زُحْزِحَ عَنِ النَّارِ وَأُدْخِلَ الْجَنَّةَ فَقَدْ فَازَ وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا مَتَاعُ الْغُرُورِ، ‘অতঃপর যাকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে ও জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, সেই-ই হবে সফলকাম। বস্ত্ততঃ পার্থিব জীবন ধোঁকার উপকরণ ছাড়া কিছুই নয়’ (আলে ইমরান ৩/১৮৫)। পার্থিব জীবনের ধোঁকা থেকে সতর্ক করে মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন, يَاأَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمْ وَاخْشَوْا يَوْمًا لَا يَجْزِي وَالِدٌ عَنْ وَلَدِهِ وَلَا مَوْلُودٌ هُوَ جَازٍ عَنْ وَالِدِهِ شَيْئًا إِنَّ وَعْدَ اللَّهِ حَقٌّ فَلَا تَغُرَّنَّكُمُ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا وَلَا يَغُرَّنَّكُمْ بِاللَّهِ الْغَرُورُ، ‘হে মানবজাতি! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর এবং ভয় কর সেই দিনকে, যেদিন পিতা তার পুত্রের কোন কাজে আসবে না এবং পুত্র তার পিতার কোন কাজে আসবে না। নিঃসন্দেহে আল্লাহর ওয়াদা সত্য। অতএব পার্থিব জীবন যেন তোমাদেরকে ধোঁকায় না ফেলে এবং শয়তান যেন তোমাদেরকে প্রতারিত না করে’ (লোকমান ৩১/৩৩; ফাতির ৩৫/৫))।
২. খেল-তামাশা : তিনি বলেন,وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا لَعِبٌ وَلَهْوٌ وَلَلدَّارُ الْآخِرَةُ خَيْرٌ لِلَّذِينَ يَتَّقُونَ أَفَلَا تَعْقِلُونَ ‘পার্থিব জীবন খেল-তামাশা বৈ কিছুই নয়। আর নিঃসেন্দেহে আল্লাহভীরুদের জন্য পরকালীন জীবনই উত্তম। এরপরেও কি তোমরা বুঝবে না’ (আন‘আম ৬/৩২)। অন্য আয়াতে তিনি বলেন,وَمَا هَذِهِ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا لَهْوٌ وَلَعِبٌ وَإِنَّ الدَّارَ الْآخِرَةَ لَهِيَ الْحَيَوَانُ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ ‘এই পার্থিব জীবন তো খেল-তামাশা ব্যতীত কিছু নয়। আর পরকালীন জীবন হ’ল চিরস্থায়ী, যদি তারা জানত’ (আনকাবূত ২৯/৬৪)। আল্লাহ বলেন,إِنَّمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا لَعِبٌ وَلَهْوٌ وَإِنْ تُؤْمِنُوا وَتَتَّقُوا يُؤْتِكُمْ أُجُورَكُمْ وَلَا يَسْأَلْكُمْ أَمْوَالَكُمْ، ‘পার্থিব জীবন খেল-তামাশা বৈ কিছুই নয়। তবে যদি তোমরা ঈমান আনো ও আল্লাহভীরু হও, তাহ’লে তিনি তোমাদের পূর্ণ প্রতিদান দিবেন। তিনি তোমাদের ধন-সম্পদ চান না’ (মুহাম্মাদ ৪৭/৩৬)। অন্য আয়াতে তিনি বলেন, ‘তোমরা জেনে রাখ যে, পার্থিব জীবন খেল-তামাশা, সাজ-সজ্জা, পারস্পরিক অহমিকা, ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির প্রাচুর্য লাভের প্রতিযোগিতা ছাড়া কিছুই নয়। যার উপমা বৃষ্টির ন্যায়। যার উৎপাদন কৃষককে চমৎকৃত করে। অতঃপর তা শুকিয়ে যায়। যাকে তুমি হলুদ দেখতে পাও। অতঃপর তা খড়-কুটায় পরিণত হয়। আর পরকালে রয়েছে (কাফেরদের জন্য) কঠিন শাস্তি এবং (মুমিনদের জন্য) আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। বস্ত্ততঃ পার্থিব জীবন ধোঁকার উপকরণ ছাড়া কিছু নয়’ (হাদীদ ৫৭/২০)।
৩. গযবে ধ্বংসপ্রাপ্ত শস্যক্ষেতের ন্যায় : দুনিয়াকে আল্লাহ বৃষ্টির পানিতে উৎপন্ন ফসলভরা মাঠ এবং আল্লাহর হুকুমে নিমিষে তা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সাথে তুলনা করেছেন। আল্লাহ বলেন, إِنَّمَا مَثَلُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا كَمَاءٍ أَنْزَلْنَاهُ مِنَ السَّمَاءِ فَاخْتَلَطَ بِهِ نَبَاتُ الْأَرْضِ مِمَّا يَأْكُلُ النَّاسُ وَالْأَنْعَامُ حَتَّى إِذَا أَخَذَتِ الْأَرْضُ زُخْرُفَهَا وَازَّيَّنَتْ وَظَنَّ أَهْلُهَا أَنَّهُمْ قَادِرُونَ عَلَيْهَا أَتَاهَا أَمْرُنَا لَيْلًا أَوْ نَهَارًا فَجَعَلْنَاهَا حَصِيدًا كَأَنْ لَمْ تَغْنَ بِالْأَمْسِ كَذَلِكَ نُفَصِّلُ الْآيَاتِ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ، ‘দুনিয়ার জীবনের দৃষ্টান্ত যেমন বৃষ্টির পানি, যা আমরা আকাশ থেকে বর্ষণ করি। অতঃপর যমীনের উদ্ভিদ সমূহ তার সাথে মিশ্রিত হয়, যা থেকে মানুষ ও গবাদিপশু ভক্ষণ করে। অবশেষে যখন যমীন শস্য-শ্যামল ও সুশোভিত হয় এবং ক্ষেতের মালিক মনে করে যে, এবার তারা ফসল ঘরে তুলতে সক্ষম হবে। এমন সময় হঠাৎ রাত্রিতে বা দিনের বেলায় ঐ ক্ষেতের উপর আমাদের (শাস্তির) নির্দেশ এসে যায়। অতঃপর সেটিকে আমরা খড়-কুটোয় পরিণত করে ফেলি, যেন গতকাল সেখানে কিছুই ছিল না। এভাবে আমরা আয়াতসমূহকে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করি চিন্তাশীল লোকদের জন্য’ (ইউনুস ১০/২৪)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, وَاضْرِبْ لَهُمْ مَثَلَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا كَمَاءٍ أَنْزَلْنَاهُ مِنَ السَّمَاءِ فَاخْتَلَطَ بِهِ نَبَاتُ الْأَرْضِ فَأَصْبَحَ هَشِيمًا تَذْرُوهُ الرِّيَاحُ وَكَانَ اللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ مُقْتَدِرًا، ‘তুমি তাদের কাছে পার্থিব জীবনের উপমা বর্ণনা কর যে, এটি হ’ল বৃষ্টির পানির মত, যা আমরা আকাশ থেকে বর্ষণ করি। অতঃপর তার মিশ্রণে উদ্ভিদ সমূহ উৎপন্ন হয়। পরে তা এমন শুষ্ক হয় যে, বায়ুপ্রবাহ তাকে উড়িয়ে নিয়ে যায়। বস্ত্ততঃ আল্লাহ সকল কিছুর উপরে ক্ষমতাবান’ (কাহফ ১৮/৪৫)।
৪. সাময়িক ভোগ্যবস্ত্ত : মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّمَا هَذِهِ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا مَتَاعٌ وَإِنَّ الْآخِرَةَ هِيَ دَارُ الْقَرَارِ، ‘দুনিয়ার এ জীবন সাময়িক ভোগ্যবস্ত্ত বৈ কিছুই নয়। আর নিশ্চয়ই আখেরাত হল চিরস্থায়ী নিবাস’ (মুমিন ৪০/৩৯)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, زُيِّنَ لِلنَّاسِ حُبُّ الشَّهَوَاتِ مِنَ النِّسَاءِ وَالْبَنِينَ وَالْقَنَاطِيرِ الْمُقَنْطَرَةِ مِنَ الذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ وَالْخَيْلِ الْمُسَوَّمَةِ وَالْأَنْعَامِ وَالْحَرْثِ ذَلِكَ مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَاللَّهُ عِنْدَهُ حُسْنُ الْمَآبِ ‘মানুষের জন্য শোভনীয় করা হয়েছে তাদের আসক্তি সমূহকে তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের প্রতি, স্বর্ণ ও রৌপ্যের রাশিকৃত সঞ্চয় সমূহের প্রতি, চিহ্নিত অশ্বরাজি, গবাদিপশু ও শস্যক্ষেত সমূহের প্রতি। এসবই পার্থিব জীবনের ভোগ্যবস্ত্ত মাত্র। আর আল্লাহর নিকটেই রয়েছে সুন্দরতম ঠিকানা’ (আলে ইমরান ৩/১৫)। তিনি আরো বলেন,مَتَاعٌ فِي الدُّنْيَا ثُمَّ إِلَيْنَا مَرْجِعُهُمْ ثُمَّ نُذِيقُهُمُ الْعَذَابَ الشَّدِيدَ بِمَا كَانُوا يَكْفُرُونَ، ‘এসব দুনিয়ার ভোগ্যবস্ত্ত মাত্র। অঃপর আমাদের কাছেই তাদের প্রত্যাবর্তন। আর তাদের কুফরীর বদলা হিসাবে আমরা তাদেরকে কঠিন শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করাব’ (ইউনুস ১০/৭০)।
উপরোক্ত কুরআনী বিবরণ থেকে বুঝা যায় যে, দুনিয়া মানুষকে ধোঁকা দেয়। এর মধ্যে রয়েছে এমন সব উপকরণ, যার মোহে পড়ে মানুষ তার আসল ঠিকানা তথা আখেরাতের কথা ভুলে যায়। দ্বিতীয়ত: দুনিয়াটা হচ্ছে খেল-তামাশার বস্ত্ত। খেল-তামাশ যেমন সাময়িক তেমনি দুনিয়াটাও সাময়িক।
কৃষকের হাসি ফুটে ফসলভরা মাঠ দেখে। আনন্দাপ্লুত মনে যখন সে পূর্ণ প্রস্ত্তত ফসল কাটার জন্য, নিজেকে সে ফসলের মালিক মনে করে, ঠিক তখনই নেমে আসে আসমানী গযব, যে গযবে ফসলের মাঠ এমনভাবে ধ্বংস হয় যে, মনে হয় গতকাল এখানে কোন ফসলের চিহ্নও ছিল না। তেমনি এই অনিন্দ্য সুন্দর পৃথিবীও একদিন এমনভাবে ধ্বংস হবে যে, মনে হবে এরকম পৃথিবীর কোন অস্তিত্বও ছিল না।
একশ্রেণীর মানুষ দুনিয়াকে ভোগের জন্য নির্ধারণ করে নিয়েছে। দুনিয়ার বিলাসিতাই তাদের কাছে মুখ্য। ‘নগদ যা পাও হাত পেতে নাও, বাকীর খাতা শূন্য থাক’ এই শ্লোক যেন এদের বাস্তব জীবনের নিত্যসঙ্গী। যেকোন মূল্যে দুনিয়া কামাই করাই এদের প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়। হালাল-হারামের কোন তোয়াক্কাই এরা করে না। যুলম-নির্যাতনের স্টীম রোলার চালায় অধীনস্তদের উপর। ক্ষমতাসীনরা মামলা-হামলা চালায় ক্ষমতহীনদের উপর। বুভুক্ষু মানবতার আর্তচিৎকারে আকাশ-বাতাস ভারী হ’লেও মোড়ল-নেতাদের পাষাণ হৃদয়ে সামান্যতম অঁাচড় কাটে না। এসব দুরাচারদের জন্যই তো মহান আল্লাহ প্রস্ত্তত করে রেখেছেন মর্মন্তুদ শাস্তির চিরন্তন ঠিকানা জাহান্নাম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
صِنْفَانِ مِنْ أَهْلِ النَّارِ لَمْ أَرَهُمَا، قَوْمٌ مَعَهُمْ سِيَاطٌ كَأَذْنَابِ الْبَقَرِ يَضْرِبُونَ بِهَا النَّاسَ، وَنِسَاءٌ كَاسِيَاتٌ عَارِيَاتٌ مُمِيلَاتٌ مَائِلَاتٌ، رُءُوسُهُنَّ كَأَسْنِمَةِ الْبُخْتِ الْمَائِلَةِ، لَا يَدْخُلْنَ الْجَنَّةَ، وَلَا يَجِدْنَ رِيحَهَا، وَإِنَّ رِيحَهَا لَيُوجَدُ مِنْ مَسِيرَةِ كَذَا وَكَذَا-
‘জাহানণামীদের দু’শ্রেণীর লোক, যাদের আমি এখনও দেখিনি একদল হ’ল, যাদের সাথে গরুর লেজের ন্যায় চাবুক থাকবে, তা দিয়ে তারা লোকজনকে পিটাবে। অর্থাৎ অত্যাচার-নির্যাতন করবে। আর একদল হ’ল- ঐ সমস্ত স্ত্রীলোক, যারা পোষাক পরিধান করেও বিবস্ত্র থাকবে। এরা অন্যদেরকে নিজেদের দিকে আকৃষ্ট করবে এবং নিজেরাও অন্যদের প্রতি আকৃষ্ট হবে। তাদের মাথার চুল উটের হেলে পড়া কূঁজের ন্যায় হবে। অর্থাৎ মাথার উপরে উচু করে খোঁপা বাঁধবে। এরা জানণাতে প্রবেশ করবে না, এমনকি জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না। অথচ এত এত দূর থেকে জান্নাতের সুগন্ধি পাওয়া যায়’।[2] অতএব দেশী ও বিশ্ব মোড়লরা এবং আঁটসাঁট পোষাক পরিধানকারিণী বেপর্দা রমনীরা সাবধান।
যারা দুনিয়াকে ভোগের সামগ্রী মনে করে তারা হয় আখেরাতে অবিশ্বাসী নতুবা আখেরাতকে তুচ্ছজ্ঞান করে। অথচ দুনিয়ার আরাম-আয়েশ ও ভোগ-বিলাসিতার তুলনায় আখেরাতের আরাম-আয়েশ, সুখ-শান্তি, ভোগ-বিলাস যোজন যোজন বেশী। কি পরিমাণ বেশী তা পরিমাপ করার ক্ষমতাও মহান আল্লাহ আমাদেরকে দেননি। কুরআন-হাদীছের পরিভাষা থেকে যতটুকু জানা যায়, তা হচ্ছে আমাদের দেখা ও শুনা সকল বিলাসিতার উর্ধ্বে। এমনকি আমাদের কল্পনারও বাইরে। আল্লাহ বলেন, فَلَا تَعْلَمُ نَفْسٌ مَا أُخْفِيَ لَهُمْ مِنْ قُرَّةِ أَعْيُنٍ جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ، ‘অতঃপর কেউ জানে না তাদের জন্য চক্ষু শীতলকারী কি কি লুক্কায়িত আছে তাদের কতকর্মের পুরস্কার স্বরূপ’ (সাজদাহ ৩২/১৭)।
আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, أَعْدَدْتُ لِعِبَادِى الصَّالِحِينَ مَا لاَ عَيْنَ رَأَتْ، وَلاَ أُذُنَ سَمِعَتْ، وَلاَ خَطَرَ عَلَى قَلْبِ بَشَرٍ، ‘আমি আমার নেককার বান্দাদের জন্য (জান্নাতে) এমন সব সামগ্রী প্রস্ত্তত করে রেখেছি, যা কোন চোখ কখনো দেখেনি, কান কখনো শুনেনি এবং কোন মানুষের অন্তরে কল্পনায়ও আসেনি’।[3]
অন্যত্র আল্লাহ বলেন, قُلْ أَؤُنَبِّئُكُمْ بِخَيْرٍ مِنْ ذَلِكُمْ لِلَّذِينَ اتَّقَوْا عِنْدَ رَبِّهِمْ جَنَّاتٌ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَأَزْوَاجٌ مُطَهَّرَةٌ وَرِضْوَانٌ مِنَ اللهِ وَاللهُ بَصِيرٌ بِالْعِبَادِ ‘তুমি বল, আমি কি তোমাদেরকে এসবের চাইতে উত্তম বস্ত্তর খবর দিব? (আর তা হ’ল) যারা আল্লাহভীরুতা অবলম্বন করে, তাদের জন্য তাদের পালনকর্তার নিকট রয়েছে জান্নাত। যার তলদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত। সেখানে তারা থাকবে অনন্তকাল এবং থাকবে পবিত্রা স্ত্রীগণ ও আল্লাহর সন্তুষ্টি। আর আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি সার্বক্ষণিক দ্রষ্টা’ (আলে ইমরান ৩/১৫)। তিনি আরো বলেন أَرَضِيتُمْ بِالْحَيَاةِ الدُّنْيَا مِنَ الْآخِرَةِ فَمَا مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا فِي الْآخِرَةِ إِلَّا قَلِيلٌ ‘তোমরা কি আখেরাতের বিনিময়ে দুনিয়াবী জীবনের উপর সন্তুষ্ট হয়ে গেলে? অথচ আখেরাতের তুলনায় দুনিয়ার ভোগবিলাস অতীব নগন্য’ (তওবা ৯/৩৮)।
যারা আখেরাতের তুলনায় দুনিয়াবী জীবনকে অগ্রাধিকার দেয় তারা পথভ্রষ্টতার মধ্যে নিমজ্জিত। আল্লাহ বলেন,الَّذِينَ يَسْتَحِبُّونَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا عَلَى الْآخِرَةِ وَيَصُدُّونَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ وَيَبْغُونَهَا عِوَجًا أُولَئِكَ فِي ضَلَالٍ بَعِيدٍ ‘যারা আখেরাতের তুলনায় দুনিয়াবী জীবনকে অগ্রাধিকার দেয় এবং আল্লাহর পথে মানুষকে বাধা দেয় ও সেখানে বক্রতা তালাশ করে, তারা দূরবর্তী ভ্রান্তির মধ্যে রয়েছে’ (ইবরাহীম ১৪/৩)।
জান্নাতের অফুরান নে‘মত ও জাহান্নামে মর্মন্তুদ শাস্তি সম্পর্কে নিম্নোক্ত হাদীছ থেকেও অনুমান করা যায়। আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,
لَمَّا خَلَقَ اللهُ الْجَنَّةَ قَالَ لِجِبْرِيلَ: اذْهَبْ فَانْظُرْ إِلَيْهَا، فَذَهَبَ فَنَظَرَ إِلَيْهَا، ثُمَّ جَاءَ، فَقَالَ: أَيْ رَبِّ وَعِزَّتِكَ لَا يَسْمَعُ بِهَا أَحَدٌ إِلَّا دَخَلَهَا، ثُمَّ حَفَّهَا بِالْمَكَارِهِ، ثُمَّ قَالَ: يَا جِبْرِيلُ اذْهَبْ فَانْظُرْ إِلَيْهَا، فَذَهَبَ فَنَظَرَ إِلَيْهَا، ثُمَّ جَاءَ فَقَالَ: أَيْ رَبِّ وَعِزَّتِكَ لَقَدْ خَشِيتُ أَنْ لَا يَدْخُلَهَا أَحَدٌ قَالَ: فَلَمَّا خَلَقَ اللهُ النَّارَ قَالَ: يَا جِبْرِيلُ اذْهَبْ فَانْظُرْ إِلَيْهَا، فَذَهَبَ فَنَظَرَ إِلَيْهَا، ثُمَّ جَاءَ فَقَالَ: أَيْ رَبِّ وَعِزَّتِكَ لَا يَسْمَعُ بِهَا أَحَدٌ فَيَدْخُلُهَا، فَحَفَّهَا بِالشَّهَوَاتِ ثُمَّ قَالَ: يَا جِبْرِيلُ اذْهَبْ فَانْظُرْ إِلَيْهَا، فَذَهَبَ فَنَظَرَ إِلَيْهَا، ثُمَّ جَاءَ فَقَالَ: أَيْ رَبِّ وَعِزَّتِكَ لَقَدْ خَشِيتُ أَنْ لَا يَبْقَى أَحَدٌ إِلَّا دَخَلَهَا-
‘মহান আল্লাহ যখন জান্নাত সৃষ্টি করলেন, তখন জিবরীল (আঃ)-কে বললেন, জিবরীল যাও জান্নাত দেখে এসো। তিনি জান্নাত দেখতে গেলেন (এবং জান্নাতের অধিবাসীদের জন্য যেসমস্ত জিনিস আল্লাহ প্রস্ত্তত করে রেখেছেন) তা দেখলেন। অতঃপর ফিরে এসে বলেন, হে আমার রব! আপনার ইয্যতের কসম, যে কেউ এ জান্নাতের কথা শুনবে, সে-ই এতে প্রবেশ করবে (প্রবেশের আকাঙ্ক্ষা করবে)। অতঃপর আল্লাহ জান্নাতকে অপসন্দনীয় বস্ত্ত দ্বারা বেষ্টন করে দিলেন। এরপর পুনরায় জিবরীলকে বললেন, হে জিবরীল আবার যাও, জান্নাত দেখে এসো। জিবরীল (দ্বিতীয়বার) জান্নাত দেখতে গেলেন এবং দেখলেন। অতঃপর ফিরে এসে বললেন, হে আমার রব! তোমার ইযযতের কসম, (আপনি জান্নাতে প্রবেশ এমন কষ্টকর করে দিয়েছেন) আমার আশংকা হয় যে, হয়তো কেউ এতে প্রবেশ করতে পারবে না। অতঃপর আল্লাহ যখন জাহান্নাম সৃষ্টি করলেন তখন জিবরীলকে বললেন, জিবরীল যাও জাহান্নাম দেখে এসো। জিবরীল গেলেন এবং জাহান্নাম (ও এর ভয়াবহ শাস্তি) দেখলেন। ফিরে এসে বললেন, হে আমার রব! আপনার ইয্যতের কসম, যে কেউ এই জাহান্নামের কথা শুনবে, সে কখনো এতে প্রবেশ করবে না (প্রত্যেকেই জাহান্নামের আযাব থেকে বঁাচতে চাইবে)। অতঃপর আল্লাহ জাহান্নামকে প্রবৃত্তি দ্বারা বেষ্টন করে দিলেন এবং জিবরীলকে পুনরায় বললেন, জিবরীল আবার জাহান্নাম দেখে এসো। জিবরীল (দ্বিতীয়বার) জাহান্নাম পরিদর্শন করতে গেলেন। এবার ফিরে বললেন, হে আমার রব! তোমার সম্মানের কসম, আমার ভয় হয় যে, একজন লোকও জাহান্নামে প্রবেশ করা থেকে বাকী থাকবে না’।[4]
আল্লাহ আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করুন এবং জান্নাতুল ফেরদাঊসের বাসিন্দা হিসাবে কবুল করুন-আমীন!
আখেরাতের তুলনায় দুনিয়ার সময়সীমা : আখেরাতের তুলনায় দুনিয়ার সময়সীমা অতীব নগণ্য। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, وَيَوْمَ يَحْشُرُهُمْ كَأَنْ لَمْ يَلْبَثُوا إِلَّا سَاعَةً مِنَ النَّهَارِ يَتَعَارَفُونَ بَيْنَهُمْ قَدْ خَسِرَ الَّذِينَ كَذَّبُوا بِلِقَاءِ اللهِ وَمَا كَانُوا مُهْتَدِينَ-‘আর যেদিন তিনি তাদের একত্রিক করবেন (সেদিন তারা মনে করবে), যেন তারা পৃথিবীতে কেবল দিনের একটা মুহূর্ত অবস্থান করেছিল। সেদিন তারা পরস্পরকে চিনবে। নিশ্চয়ই সেদিন তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যারা আল্লাহর সাক্ষাৎকে মিথ্যা বলেছিল এবং যারা সুপথপ্রাপ্ত ছিল না’ (ইউনুস ১০/৪৫)। অন্যত্র এসেছে, قَالَ كَمْ لَبِثْتُمْ فِي الْأَرْضِ عَدَدَ سِنِينَ- قَالُوا لَبِثْنَا يَوْمًا أَوْ بَعْضَ يَوْمٍ فَاسْأَلِ الْعَادِّينَ- قَالَ إِنْ لَبِثْتُمْ إِلَّا قَلِيلًا لَوْ أَنَّكُمْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ- ‘আল্লাহ বলবেন, বছরের হিসাবে তোমরা পৃথিবীতে কতদিন
ছিলে? তারা বলবে, আমরা ছিলাম একদিন বা তার কিছু অংশ। অতএব গণনাকারীদের (ফেরেশতাদের) জিজ্ঞেস করুন! আল্লাহ বলবেন, তোমরা সেখানে ছিলে মাত্র অল্প সময়। যদি তোমরা জানতে’ (মুমিনূন ২৩/১১২-১১৪)।
রাসূল (ছাঃ) বলেন, وَاللهِ مَا الدُّنْيَا فِي الْآخِرَةِ إِلَّا مِثْلُ مَا يَجْعَلُ أَحَدُكُمْ إِصْبَعَهُ هَذِهِ وَأَشَارَ يَحْيَى بِالسَّبَّابَةِ فِي الْيَمِّ، فَلْيَنْظُرْ بِمَ تَرْجِعُ؟ ‘আল্লাহর শপথ! আখেরাতের তুলনায় দুনিয়ার দৃষ্টান্ত হ’ল, যেমন তোমাদের কেউ মহাসমুদ্রের মধ্যে নিজের একটি আঙ্গুল ডুবিয়ে দেয়। এরপর সে লক্ষ্য করে দেখুক যে, তা কি (পরিমাণ পানি) নিয়ে আসলো’।[5] অর্থাৎ আঙ্গুলের সাথে আসা এক বা দুই ফোটা পানি পরিমাণ সময়সীমা হচ্ছে পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত সময়, আর মহা সমুদ্রের বেহিসাব পানিরাশি হচ্ছে আখেরাতের জীবন। যা অনন্ত, চিরস্থায়ী। [ক্রমশঃ]
[1]. মুসলিম হা/২৭৪২।
[2]. মুসলিম, মিশকাত হা/৩৫২৪।
[3]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫৬১২।
[4]. তিরমিযী হা/২৫৬০; আবূদাঊদ হা/৪৭৪৪; মিশকাত হা/৫৬৯৬ সনদ হাসান।
[5]. মুসলিম হা/২৮৫৮; মিশকাত হা/৫১৫৬।