পর্ব ১। পর্ব ২। পর্ব ৩। পর্ব ৪।

মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধীর সাক্ষ্য :

বিগত বর্ণনা থেকে যদিও মাওলানা বেলায়েত আলী, মাওলানা এনায়েত আলী ও তাদের গোটা পরিবারের আহলেহাদীছ হওয়ার বিষয়টি দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে গেছে। তারপরেও বিপক্ষ দলের সাক্ষ্যের একটা আলাদা মূল্য রয়েছে। সেই হিসাবে মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধীর স্বীকারোক্তিও লক্ষণীয়। মাওলানা সিন্ধী লিখেছেন, ‘যখন মাওলানা মুহাম্মাদ ইসমাঈল শহীদ ইমাম আব্দুল আযীযের নিকট ‘হুজ্জাতুল্লাহ’ অধ্যয়ন করেন, তখন তাঁর সম্মানিত দাদা শাহ অলিউল্লাহ-এর তরীকার উপরে আমল শুরু করে দেন। তিনি নিজস্ব এমন একটি খাছ জামা‘আত তৈরি করেন, যারা ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ’ অনুসারে আমল করতেন। এরা শাফেঈদের মতো রাফ‘ঊল ইয়াদায়েন করতেন এবং সশব্দে আমীন বলতেন, যেমনটা সুনান (হাদীছ) গ্রন্থগুলিতে বর্ণিত আছে’।[1] আরেকটু সামনে অগ্রসর হয়ে তিনি লিখেছেন, ‘মাওলানা বেলায়েত আলীর আন্দোলন সম্পর্কে আমাদের ব্যক্তিগত অভিমত এই যে, তিনি মাওলানা ইসমাঈল শহীদের ঐ খাছ জামা‘আতকে, যার কথা ইতিপূর্বে বলা হয়েছে, পুনর্জীবিত করার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করতেন। এজন্যই মাওলানা নাযীর হুসাইন ও নওয়াব ছিদ্দীক হাসান খানের মতো আলেমরাও তাঁর সাথে থাকতেন’।[2]

তিনি আরো বলেন, ‘মাওলানা নাযীর হুসাইন দেহলভী এবং মাওলানা আব্দুল্লাহ গযনভীও মাওলানা বেলায়েত আলীর দলের সাথে বিশেষ সম্পর্ক রাখতেন’।[3]

মাওলানা ইসমাঈল শহীদ (রহঃ)-এর উক্ত জামা‘আত, যেটি হাদীছ অনুযায়ী আমলে অগ্রণী এবং তাক্বলীদের বন্ধন থেকে মুক্ত ছিল, তার কথা এক ইংরেজ স্যার জেম্স উকেন্লিও (ঔধসবং ঙড়শবহষু) উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন যে, এই জামা‘আতের লোকেরা নিজেদেরকে ‘মুহাম্মাদী’ বলত।[4]

ছাদেকপুরী পরিবার ও তাদের অনুসারীরা যে নিজেদেরকে ‘মুহাম্মাদী’ বলতেন তা ইতিপূর্বে স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে।

এই হ’ল মাওলানা বেলায়েত আলীর মাসলাক। জিহাদ আন্দোলনের সঙ্গে যার সম্পর্ক ও বিশাল অবদান সম্পর্কে মাওলানা মাস‘ঊদ আলম নাদভী লিখেছেন, ‘বালাকোটের বেদনাদায়ক ঘটনার পর সমগ্র দেশ জুড়ে উদাসীনতা ছেয়ে গিয়েছিল। জামা‘আত ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। ভাল ভাল ব্যক্তিদের পা পর্যন্ত নড়বড়ে হয়ে পড়েছিল। জিহাদের সকল কর্মতৎপরতা এলোমেলো হয়ে পড়েছিল। এসময় আযীমাবাদ পাটনার ছাদেকপুর মহল্লার এক ব্যক্তি পতনোন্মুখ এই পতাকাকে নিজ হাতে উঁচিয়ে ধরেন এবং জীবনভর নিজের বুকের সাথে আগলে রাখেন। সেই মহামানবের পরে তার ভাই-ভাতিজা, বন্ধু-বান্ধব, প্রিয়জন ও অনুসারীগণ যেভাবে নিজেদের রক্ত দিয়ে এই পাতাঝরা বাগিচাকে সিঞ্চন করেছেন, ভারতের সামগ্রিক ইতিহাসে তার তুলনা কেবল তাঁরাই’।[5]

মাওলানা গোলাম রসূল মেহের লিখেছেন, ‘মাওলানা বেলায়েত আলী রায়বেরেলীতে শিক্ষা লাভের পর তাঁর জন্মস্থানে ফিরে যান এবং জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ওয়ায ও তাবলীগের জন্য উৎসর্গ করে দেন। তাঁরই চেষ্টায় তার পরিবার এবং অন্যান্য প্রিয়জন ও আত্মীয়-স্বজন সাইয়েদ (আহমাদ) ছাহেবের সাথে সম্পৃক্ত হন। যেমন মাওলানার পিতা মৌলভী ফতেহ আলী, তার ভাই মাওলানা এনায়েত আলী, মাওলানা ত্বালেব আলী, মাওলানা ফারহাত হুসাইন, তাদের আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে মাওলানা শাহ মুহাম্মাদ হুসাইন, মৌলভী ইলাহী বখশ, মাওলানা আহমাদুল্লাহ, মাওলানা ইয়াহ্ইয়া আলী, মাওলানা ফাইয়ায আলী, মৌলভী কমরুদ্দীন, মৌলভী বাকের আলীসহ যারাই তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন তাদের একজনও সাইয়েদ ছাহেবের চিন্তাধারার গন্ডীতে শামিল হতে বাকী ছিলেন না। এসব মনীষীর ত্যাগ-তিতিক্ষা জিহাদ আন্দোলনের ইতিহাসে অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল এক অধ্যায়’।[6]

এই ছাদেকপুরী পরিবার পুরোটাই ছিলেন আহলেহাদীছ অর্থাৎ হাদীছ অনুযায়ী আমলকারী। তাদের জীবনীগ্রন্থ, তাদের রচনাবলী এবং তাদের দাওয়াতী প্রচেষ্টা থেকে যা স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়।

আহলেহাদীছ আলেম-ওলামা ও আহলেহাদীছ জনসাধারণের এই জিহাদী অবদান মাওলানা গোলাম রসূল মেহেরের সারগুযাশ্তে মুজাহিদীন[7] গ্রন্থে দেখা যেতে পারে। এ গ্রন্থে তিনি এক শতাব্দীর জিহাদ আন্দোলনের ইতিবৃত্ত লিপিবদ্ধ করেছেন। তাতে অধিকাংশই এমন সব আলেম ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের আলোচনা আপনি দেখতে পাবেন, যারা আহলেহাদীছ ছিলেন। যারা জিহাদের সাথে সাথে আহলেহাদীছ মাসলাকের প্রচার-প্রসারে সারা জীবন ব্যয় করেছেন। এতে কাযীকোট (গুজরানওয়ালা, পাকিস্তান)-এর ঐ সকল মুজাহিদের আলোচনাও স্থান পেয়েছে, যাদেরকে ১৯২১ সালের বোমাবাজির মামলায় সাজা দেওয়া হয়েছিল। এই পরিবারও ছিল আহলেহাদীছ। কাযী আব্দুর রহীম গুজরানওয়ালাও ছিলেন এই পরিবারের এক দ্যুতিময় মুক্তা- যিনি হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ ইসমাঈল সালাফী শায়খুল হাদীছ গুজরানওয়ালার বিশ্বস্ত সঙ্গী, বিশিষ্ট আহলেহাদীছ আলেম ও লেখক এবং জিহাদ আন্দোলনের অবশিষ্ট পূর্বসূরীদের সোনালী ধারার সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি আমীরুল মুজাহিদীন মাওলানা ফযলে ইলাহী ওয়াযীরাবাদীর হাতে জিহাদের বায়‘আত নিয়েছিলেন এবং সারা জীবন মুজাহিদদের খিদমতে ও ইংরেজদের বিরোধিতায় কাটিয়ে দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারী ৮৮ বছর বয়সে তিনি গুজরানওয়ালায় মৃত্যুবরণ করেন।

কাযী আব্দুর রহীম (রহঃ) ও জিহাদ আন্দোলন :

মরহূম হাকীম আব্দুল্লাহ খাঁ নছর সোহরাওয়ার্দী ছিলেন কাযী আব্দুর রহীমের শিষ্য এবং জিহাদ আন্দোলনে তাঁর বিশ্বস্ত সাথী। তিনি কাযী আব্দুর রহীমের ব্যক্তিত্ব ও অবদানের উপর একটি ধারাবাহিক প্রবন্ধ ‘আল-ই‘তিছাম’ পত্রিকায় লেখা শুরু করেছিলেন। কিন্তু দুঃখজনক হ’ল তিনি তা শেষ করতে পারেননি। প্রবন্ধটির মাত্র সাত কিস্তি ছাপা হয়েছিল। যাই হোক, উক্ত প্রবন্ধে জিহাদ আন্দোলনে তাঁর যোগদান এবং এক্ষেত্রে তাঁর অবদানের একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা চলে এসেছে। আমরা তার কিছু প্রয়োজনীয় উদ্ধৃতি এখানে তুলে ধরছি। এতে জানা যাবে যে, আহলেহাদীছ আলেমগণ ছাদেকপুরী আলেমদের পরে কিভাবে এই জিহাদ আন্দোলনকে গোপনে জীবিত রাখেন এবং অতুলনীয় এখলাছ ও জাযবা নিয়ে এ পথের কঠিন কষ্ট ও বিপদ সমূহের মুকাবিলা করেন।

হাকীম আব্দল্লাহ খাঁ নছর (মৃ. জানুয়ারী ১৯৭৮) স্বীয় আহলেহাদীছ শিক্ষকবৃন্দ ও সহপাঠীদের আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘অবস্থা এই যে, যখনই এই পরিবার এবং সরলমনা মুজাহিদদের আত্মত্যাগ ও তোপের মুখে মাথা পেতে দেওয়া, ইসলামের চিরন্তন দুশমন ইংরেজদের প্রতি তাদের আন্তরিক ঘৃণা এবং তাদের বিরুদ্ধে মুজাহিদসুলভ ভূমিকা পালনের দৃশ্য আমার চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয় এবং এ পথের বিপদাপদ ও জেল-যুলুম সহ্য করার ঘটনাবলী স্মরণে আসে তখন অনুভূত হয়, এ জামা‘আত কেমন ছিল? সৃষ্টিজগতের সারনির্যাস ছিল। যাদের আল্লাহ পাক সেই মনোবল ও সাহস প্রদান করেছিলেন, যা তিনি নবীদের উত্তরাধিকারীদের দিয়ে থাকেন। হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর পবিত্র শিক্ষার বদৌলতে তাদের এসব সৌভাগ্য পূর্ণমাত্রায় হাছিল হয়েছিল। তারা পরিস্থিতি প্রতিকূল হওয়া সত্ত্বেও ইংরেজদের নাভিশ্বাস উঠিয়ে ছেড়েছিলেন। তাদের জিহাদী কর্মকান্ডের বিবরণ এতই হৃদয়গ্রাহী যে, প্রতি মুহূর্তে তা ঈমানকে তাযা রাখে’।[8]

তারপর তিনি লিখেছেন, ‘যখন আমি হাফেয আব্দুল মান্নান ওয়াযীরাবাদী ছাহেবের মাদ্রাসা ছেড়ে গুজরানওয়ালা যাচ্ছিলাম তখন আমীরুল মুজাহিদীন মাওলানা ফযলে ইলাহী আমাকে বলেন, ওখানে গিয়ে কাযী আব্দুর রহীম ছাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করবে, তিনি জামা‘আতে মুজাহিদীনের লোক। ... এদিকে কাযী ছাহেবকেও জানানো হয়েছিল যে, ‘এক কড়া স্বভাবের নবাগত’ যাচ্ছে, তাকে গড়ে তুলবে। ... সেকালে যে মসজিদে মাওলানা ইসমাঈল সালাফীর মাদ্রাসা ছিল এবং নছর ছাহেব ওয়াযীরাবাদ থেকে গিয়ে তথায় শিক্ষা গ্রহণ করছিলেন, সেই মসজিদের দোকানে বসে কাযী ছাহেব চিকিৎসা করতেন। এ ব্যবস্থা একটি পরিকল্পনার অধীনে ছিল। কেননা এভাবে মুজাহিদদের যারা কর্মী হতেন তাদের মসজিদে অবস্থান করা সহজ হ’ত এবং কাযী ছাহেবের সাথে তাদের যোগাযোগ আসান হ’ত। সেকালে মুজাহিদ আন্দোলনে শরীক হওয়া যে শাহাদাতের পেয়ালা পানের সমার্থক ছিল তা জনৈক কবির একটি পংক্তিতে ফুটে উঠেছে।

يہ شهادت گہ ميدان مىں قدم ركهناہے

لوگ آساں سمجهتے ہىں مسلماں ہونا

‘এ তো শহীদী ময়দানে পদচারণা অথচ লোকে ভাবে, মুসলমান হওয়া না জানি কত সহজ’।

ইংরেজ সরকার এবং তার কর্মচারীরা মুজাহিদদের উপর খুব কড়া নযরদারী করত। দেশে যতগুলি আহলেহাদীছ মসজিদ ও মাদ্রাসা ছিল তার সব ক’টিতে সিআইডি বা গোয়েন্দা বিভাগ নিজেদের লোকদের শিক্ষক, ছাত্র, মুওয়ায্যিন, খাদেম ইত্যাদি হিসাবে নিযুক্ত করে রাখত। এরূপ ঘেরা টোপে আবদ্ধ থেকেও আল্লাহর সেই শত্রুদের চোখে ধুলো দিয়ে ইসলামের এই স্বাধীনচেতা মুজাহিদগণ যে গৌরবময় কাজ আঞ্জাম দিয়ে গেছেন তা এক কথায় অতুলনীয়। কবি বলেন, প্রত্যেক দাবীদারের জন্য বাস্তব দৃষ্টান্ত কোথায়?

তারা এই উপমহাদেশের দূর-দূরান্তের অঞ্চল হ’তে এবং দেশের আনাচে-কানাচে থেকে কোটি কোটি টাকা সংগ্রহ করে মুজাহিদ বাহিনীর এ হাত ও হাত ঘুরে তা ইয়াগিস্তানে মুজাহিদদের কেন্দ্র আসমাস্ত ও চামারকান্দে পৌঁছে দিতেন। ইংরেজদের সকল ব্যবস্থাপনা এবং সীমান্তে তাদের বিশেষভাবে নিযুক্ত কর্মচারীরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেত যে, কিভাবে আমাদের চোখে ধুলো দিয়ে আমাদের পাতা জাল ছিন্ন করে সীমান্ত পেরিয়ে তারা নিজেদের কেন্দ্রে পৌঁছে যায়! কেননা যখনই কোন নতুন বাহিনী সেখানে পৌঁছত, তখনই খোদ মুজাহিদদের মাঝে সরকার যেসব সিআইডি-র অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে রাখত এবং যারা সেই কেন্দ্রগুলিতে সদাসর্বদা অবস্থান করত তারা এখানকার সরকারকে অবহিত করত যে, এত জন সৈন্য, এত এত টাকা ও রসদপত্র নিয়ে অমুক তারিখে এখানে এসে পৌঁছেছে। তারপর এদিকের সরকার ঐ রাস্তায় মোতায়েন করা তাদের লোকদের জিজ্ঞেস করত এবং নযরদারী আগের থেকে আরো কঠিন করে দিত। কিন্তু মুজাহিদদের তীব্র বন্যাস্রোত সেসব প্রতিবন্ধককে ভেঙেচুরে খড়কুটোর মতো ভাসিয়ে নিয়ে যেত। কবি কতই না সত্য বলেছেন :

وه چنگارى خس و خا شاك سے كس طرح دب جائے

جسے حق نے كيا ہو نيستاں كے واسطے پيدا

‘সে স্ফুলিঙ্গ কিভাবে আবর্জনার চাপে দমে যাবে যাকে আল্লাহ পয়দা করেছেন বাঁশঝাড়ে আগুন লাগানোর জন্য’।[9]

তারপর হাকীম ছাহেব লিখেছেন, ‘নির্দেশ অনুযায়ী আমি কাযী আব্দুর রহীম ছাহেবের সাথে দেখা করতে উন্মুখ ছিলাম। একইভাবে তিনিও আমার সাথে মিলিত হতে খুব আকাঙ্ক্ষী ছিলেন। মনে মনে পরস্পরের মধ্যে মিলনের তীব্র আগ্রহ ছিল। কিন্তু জনসম্মুখে কেউ কারো নাম জিজ্ঞেস করার অনুমতি ছিল না। এটা আন্দোলনের রীতি বিরোধী ছিল। কারণ তাতে গোপনীয়তা ফাঁস হওয়ার আশঙ্কা থাকত। আর মুজাহিদদের আন্দোলনও ছিল আন্ডারগ্রাউন্ড পর্যায়ে। মোটকথা, কিছুদিন পর আমি জানতে পারলাম, ইনি কাযী আব্দুর রহীম এবং তিনিও পরিচয় পেয়ে গেলেন যে, ইনি আব্দুল্লাহ খাঁ নছর। পরিচয়ের পর যদিও তখন পর্যন্ত সরাসরি কথা হয়নি, তবুও কবির ভাষায় :

آنكهوں آنكهوں مىں اشارے ہو چكے

ہم تمہارے تم ہمارے ہو چكے

 ‘চোখে চোখে ভাব বিনিময় হয়ে গেছে

আমি তোমার, তুমি আমার হয়ে গেছ’।

... একদিন আমি এশার ছালাতের পর কাযী ছাহেবের পিছু নিলাম এবং আমরা দু’জনেই দাওয়াখানায় প্রবেশ করলাম। তখন সেখানে কেউ ছিল না। কাযী ছাহেব বললেন, ‘আমি সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম যে, আপনার সাথে নির্জনে কোথাও সাক্ষাৎ হ’লে মন খুলে কথা বলব এবং ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা প্রস্ত্তত করব। আপনি তো জানেন যে, মুজাহিদদের এই আন্দোলন এখন গুপ্তভাবে (under ground) চলছে। ১৮৩১ সালে খিলাফতে রাশেদার নবরূপায়নকারী হযরত সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভী (রহঃ)-এর বালাকোট যুদ্ধে শাহাদাত লাভের পর জিহাদ আন্দোলন ও তাবলীগের কেন্দ্র পাটনায় স্থানান্তরিত হয় এবং বাংলা থেকে ইয়াগিস্তান পর্যন্ত পুরো অঞ্চলে আন্ডারগ্রাউন্ড সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই জামা‘আত ইংরেজ ও হিন্দুদের আধিপত্য মেনে নিতে অস্বীকার করে। হিন্দুস্থানকে ‘দারুল হারব’ (যুদ্ধক্ষেত্র) ঘোষণা করা হয় এবং এই দারুল হারবকে ‘দারুল ইসলামে’ (ইসলামী রাষ্ট্রে) রূপান্তরিত করা জামা‘আতের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়।

(তারপর আমীরুল মুজাহিদীন মাওলানা ফযলে এলাহী, আমীরুল মুজাহিদীন আমীর আব্দুল করীম ও হাফেয আব্দুল মান্নান মুহাদ্দিছ ওয়াযীরাবাদীর জিহাদী কার্যক্রম সমূহ তুলে ধরা হয়।) আমীর আব্দুল করীম ছাহেব ১৯০২ সালে আমীর নিযুক্ত হওয়ার পর তার কেন্দ্র আসমাস্ত নামক স্থানে প্রতিষ্ঠা করেন। স্থানটি ইয়াগিস্তানের (বর্তমানে কাশ্মীরের) স্বাধীন অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। তিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি আঞ্জাম দেন তা হ’ল, হিন্দুস্থানের মুসলমানদের ও এখানকার রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেন।

হিন্দুস্থানের এই কেন্দ্রগুলিকে একসূত্রে গাঁথা এবং এগুলিকে কর্মমুখর রাখার স্বার্থে হযরত মাওলানা ফযলে ইলাহীকে ১৯০৬ সালে আমীরুল মুজাহিদীন হিন্দ পদে আসীন করার সিদ্ধান্ত হয়। এরপর মাওলানা ফযলে ইলাহী হিন্দুস্থানে আন্দোলনের কাজ চালাতে থাকেন। এরই মধ্যে ৭ই নভেম্বর ১৯১৫ সালে গ্রেফতার হ’লে তাঁকে জলন্ধর কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। জেলের মধ্যেও মাওলানা তার দায়িত্ব চালিয়ে যেতে থাকেন। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে কিছুদিন পর ১৭ই আগস্ট ১৯২০ সালে হিজরত করে তিনি চামারকান্দে (ইয়াগিস্তান) পৌঁছেন। মাওলানা আব্দুল করীম কন্নেŠজী একজন বয়োবৃদ্ধ মানুষ ছিলেন। ঐ বয়সেও তিনি চামারকান্দ কেন্দ্রের আমীর ছিলেন। ১৯১৫ সাল থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত তিনি এ পদে আসীন ছিলেন। মাওলানা ফযলে ইলাহীর চামারকান্দ পৌঁছার অল্প কিছুদিন পর মাওলানা আব্দুল করীম ৫ই ফেব্রুয়ারী ১৯২১ সালে ইমারতের দায়িত্ব মাওলানা ফযলে ইলাহীর হাতে অর্পণ করেন। কাযী ছাহেব বললেন, এই হ’ল জামা‘আতের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, যা আপনার জানা থাকা আবশ্যক ছিল। আর আমরা এখন এই আমীরের নেতৃত্বে কাজ করছি। ... ইতিমধ্যে সেখানে একজন রোগী আসে এবং আলোচনা স্থগিত হয়ে যায়’।[10]

‘কিছুদিন পর পুনরায় একবার মিলিত হওয়ার সুযোগ হ’লে কাযী ছাহেব বলেন, সেদিন আমি আপনাকে মুজাহিদ আন্দোলন সম্পর্কে কিছু বলেছিলাম। এ বিষয়ে এ কথাও মাথায় রাখতে হবে যে, এ আন্দোলন বৃটিশ রাজত্বের চরম জাঁকজমকপূর্ণ ও প্রতিপত্তিশালী শাসনের মুখে অস্তিত্ব লাভ করেছিল, যা তাদের অহংবোধের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ স্বরূপ ছিল। যদিও এ আন্দোলন গুপ্ত ও আন্ডারগ্রাউন্ড ছিল, তারপরেও ইংরেজ সরকার তার অনুসন্ধানে স্বতন্ত্র একটি পুলিশ বিভাগ গঠন করেছে। তাদের জাল আমাদের চারিদিকে পাতা আছে। আমাদের ডানে-বাঁয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম রয়েছে। তাদের লোকজন আমাদের সাথে মিলেমিশে এমনভাবে একাকার হয়ে আছে যে, তাদেরকে অপরিচিত কিংবা স্পাই জাতীয় কিছু একটা সন্দেহ করাও আমাদের অপরাধ মনে হয়। (এরপর তিনি এতদসংক্রান্ত দু-তিনটা উদাহরণ পেশ করেন)।[11]

৬ষ্ঠ কিস্তিতে হাকীম আব্দুল্লাহ খাঁ নছর মরহূম এই কবিতার লাইন উদ্ধৃত করে নিজের কিছু খিদমতের উল্লেখ করেছেন, যা তিনি কাযী আব্দুর রহীম মরহূমের নেতৃত্বে ইংরেজ ও তাদের টিকটিকিদের বিরুদ্ধে গুজরানওয়ালায় আঞ্জাম দিয়েছিলেন।[12]

دريں دريا ئے بے پاياں، در يں طوفانِ موج افزا

دل انگنديم بِسْمِ اللهِ مَجْرِهَا وَمُرْسَاهَا

(এই কুল-কিনারাহীন সমুদ্রে, এই উত্তরোত্তর বেড়ে চলা সাইক্লোনের ঢেউয়ের মাঝে ব্যথিত চিত্তে ‘বিসমিল্লাহি মাজরেহা ওয়া মুরসাহা’ (আল্লাহর নামে এ তরীর যাত্রা ও গন্তব্য) বলে যাত্রা করছি)। মহান আল্লাহ তাদের দু’জনের উপর অজস্র ধারায় রহমত বর্ষণ করুন এবং দু’জনকে ক্ষমা করুন!

মাওলানা গোলাম রসূল মেহেরও কাযী আব্দুর রহীম কর্তৃক প্রস্ত্ততকৃত জিহাদ আন্দোলন সম্পর্কিত বর্ণনা থেকে কিছু তথ্য লাভ করেছেন এবং তা তার রচনাবলীর বরাতসহ উল্লেখ করেছেন।[13]

মাওলানা মাস‘ঊদ আলম নাদভী মরহূম জিহাদ আন্দোলন ও মুজাহিদদের ব্যথাতুর বিবরণের উপর লিখিত কিছু বইয়ের নাম উল্লেখ করার পর লিখেছেন, ‘কিন্তু অশ্রুর এই কয় ফোঁটা দিয়ে ঐ পাক-পবিত্র রক্তের হক আদায় হবার নয়, যা বাংলার পূর্বাঞ্চলের যেলাগুলি থেকে নিয়ে সীমান্ত ও সীমান্তের পিছনের পাথুরে ও পিপাসার্ত যমীনে দ্বিধাহীনচিত্তে বইয়ে দেওয়া হয়েছিল। সত্য তো এই যে, এই দিশাহীন পথের দৃঢ়মনা পথিকদের ন্যূনতম হকও আজ পর্যন্ত আদায় করা সম্ভব হয়নি’।[14]

বাস্তবতা এই যে, শহীদায়েনের বেদনাবিধুর শাহাদাতের পর অর্থাৎ ১৮৩১-১৯৩৪ খৃ. পর্যন্ত শতবর্ষে এই রক্ত বিসর্জন- কারীরা আহলেহাদীছই ছিলেন এবং এই পুরো সময়কালে, বরং তারও পরে জিহাদ আন্দোলনের নেতৃত্ব আহলেহাদীছ আলেমদের হাতেই ছিল। এ সকল আহলেহাদীছ আলেম, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, তাদের সাধারণ লোকজন ও ব্যবসায়ীদের জিহাদের সাথে অভাবিত যোগ এবং জান-মালের সীমাহীন কুরবানীর ফলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদের এই সজীব বৃক্ষ উত্তরোত্তর ডাল-পালা ছড়াতে থাকে। যার ঘন ছায়ায় ও পরিণামে পরবর্তীতে দেশের মুক্তির জন্য সেসব আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে, যাতে অবিভক্ত ভারতের সকল শ্রেণীর মানুষ নানা পর্যায়ে অংশগ্রহণ করে। এই পুরো শতাব্দীর (১৮৩১-১৯৩৪) আত্মদান ও আত্মত্যাগের হৃদয়বিদারক কাহিনী, অপরের জন্য ত্যাগ স্বীকার ও দৃঢ়চিত্ততার অবিস্মরণীয় এই ব্যথাতুর দীর্ঘ বিবরণ মাওলানা গোলাম রসূল মেহেরের ‘সারগুযাশ্তে মুজাহিদীন’ বইয়ে বিস্তারিত জানতে পারবেন। তাতে যদিও তিনি সাধারণত তাদের মাযহাবী নিদর্শন সমূহের উল্লেখ এড়িয়ে গেছেন। কিন্তু কবি বলেছেন:

ابهى اس راه سے گزرا ہے كو ئى

كہے ديتى ہےشوخى نقش كفِ پاكى

‘এইমাত্র এ রাস্তা দিয়ে কেউ একজন হেঁটে গেছেন।

তার পবিত্র পায়ের উন্মুক্ত ছাপ নিজেই সে কথা বলে দিচ্ছে’।

এই পংক্তির স্বাক্ষর হিসাবে তাদের ইবাদত-বন্দেগীর পদ্ধতি ও কর্মকান্ডের ধরন, তাদের হাদীছ অনুযায়ী আমল তথা আহলেহাদীছ হওয়ার স্পষ্ট সাক্ষ্য বহন করছে। শেষতক তাকেও স্বীকার করতে হয়েছে যে, ‘আমি খুব চেষ্টা করেছি যে, এই নীতি-আদর্শের সাথে যুক্ত সকল সদস্যের জীবনের ইতিবৃত্ত জানা যাক বা না যাক, অন্তত বিশিষ্টজনদের পুরো কাজের ধারা তো সামনে নিয়ে আসা দরকার। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও দশ-বিশজনের বেশী কারো সম্পর্কে কিছুই জানা সম্ভব হয়নি। আবার তাদের সম্পর্কেও বেশীর থেকে বেশী এতটুকু বলা হয়েছে যে, তারা এই নীতি-আদর্শের সাথে যুক্ত ছিলেন। যেমন বিহারে মাওলানা আব্দুল আযীয রহীমাবাদী, মাওলানা আব্দুল্লাহ গাযীপুরী, পাঞ্জাবে মাওলানা আব্দুল ক্বাদের ক্বাছূরী, মৌলভী অলি মুহাম্মাদ ফতূহীওয়ালা, মৌলভী ফযলে ইলাহী ওয়াযীরাবাদী, হাফেয মুহাম্মাদ ছিদ্দীক্ব, রতলাম ও বোম্বেতে হাফেয আব্দুল গফূর, মাদ্রাজে কাকা ওমর, দিল্লীতে পাঞ্জাবী আহলেহাদীছ, কলকাতায় হার্ডওয়ার ও কাপড় ব্যবসায়ী আহলেহাদীছ প্রমুখ। বস্ত্ততঃ পরবর্তীকালে মুজাহিদদের সাহায্য-সহযোগিতার বেশীরভাগ কাজ আহলেহাদীছরাই আঞ্জাম দিয়েছেন’।[15]

শেষ যুগের জিহাদ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী আলেম ও নেতৃবৃন্দের আহলেহাদীছ হওয়া এ কারণেও স্পষ্ট যে, বেরাদারানে ইউসুফের (হিংসুকদের) একটি দল দেওবন্দ মাদ্রাসা থেকে তৈরি হয়েছিলেন। যারা হাদীছ অনুযায়ী আমল করার আন্দোলনের বিরোধিতায় তাদের পুরো সাজ-সরঞ্জাম নিয়ে ময়দানে নেমেছিলেন। তারা জিহাদ আন্দোলনের সাথে সাথে হাদীছ অনুযায়ী আমলের বিরোধিতায় সমান ভাবে অগ্রসর হচ্ছিলেন। ফলে শেষ যুগে জিহাদ আন্দোলনের সাথে সাথে আহলেহাদীছদের তাক্বলীদী জড়তার বিরুদ্ধেও সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়েছে, যেখানে কি-না জিহাদ আন্দোলনের ২য় যুগের[16] সূচনালগ্নে তাক্বলীদী জড়তা মওজুদ থাকলেও তার আহবায়ক ও হেফাযতকারীদের ঐ জামা‘আত মওজুদ ছিল না, যারা দেওবন্দ মাদ্রাসার ওলামা-মাশায়েখ আকারে আত্মপ্রকাশ করে। এজন্য ২য় যুগের সূচনালগ্নের নেতৃবৃন্দের (ছাদেকপুরের আলেম-ওলামা ও অন্যান্যদের) তাক্বলীদী জড়তার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ নিয়ে ময়দানে নামতে হয়নি। নতুবা বাস্তব সত্য এই যে, ২য় যুগের প্রথমদিকের নেতৃবৃন্দ (মাওলানা বেলায়েত আলী, মাওলানা এনায়েত আলী, তাদের সন্তান-সন্ততি, বন্ধু-বান্ধব, শিক্ষার্থীবৃন্দ, অনুসারীবর্গ ও ছাদেকপুরী পরিবারের অন্যান্য সদস্যবন্দ) আহলেহাদীছ ছিলেন এবং ফিক্বহ ও তাক্বলীদী জড়তার প্রতি অসন্তুষ্ট ও

তার বিরোধী ছিলেন।

ইতিহাসবিদদের স্বীকারোক্তি :

আহলেহাদীছ জামা‘আতের এই জিহাদী ভূমিকা ও কীর্তি এতই স্পষ্ট যে, ইতিহাস রচনা কিংবা পাঠের সাথে সম্পর্ক রাখেন এমন মনীষীগণ খোলামেলা তা স্বীকার করেছেন। এতদসংক্রান্ত কিছু উদ্ধৃতি আমরা এখানে তুলে ধরছি।

১. মাওলানা সাইয়েদ সুলায়মান নাদভী (১৮৫৪-১৯৫৩ খৃ.) বলেন, ‘আহলেহাদীছ-এর নামে এখনও দেশে যে আন্দোলন চলছে বাস্তবে তা নতুন কোন বিষয় নয় বরং পুরনো পদচিহ্নের অনুসরণ মাত্র। মাওলানা ইসমাঈল শহীদ (রহঃ) যে আন্দোলন নিয়ে উত্থান করেছিলেন, তা ফিক্বহের কয়েকটি মাসআলা মাত্র ছিল না বরং ইমামতে কুব্রা (রাষ্ট্রীয় শাসন ক্ষমতা অর্জন), খালেছ তাওহীদ এবং ইত্তেবায়ে নববীর বুনিয়াদী শিক্ষার উপরে ভিত্তিশীল ছিল। কিন্তু আফসোস! বন্যা নেমে গেছে। এখন যা বাকী রয়ে গেছে তা নেমে যাওয়া পানির চিহ্ন মাত্র।

যা হোক, এ আন্দোলনের যে প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে এবং সেকাল থেকে নিয়ে আমাদের এই পশ্চাৎপদ নীরব-নিথর যুগের বুকে তা যে ঝাঁকুনি দিয়ে গেছে, তা আমাদের জন্য অনেক কল্যাণবহ ও ধন্যবাদার্হ। এর ফলে বহু বিদ‘আত দূরীভূত হয়েছে, তাওহীদের স্বরূপ উদ্ভাসিত হয়েছে, কুরআন মাজীদ শিক্ষাদান ও তা অনুধাবনের সূচনা হয়েছে, কুরআন মাজীদের সাথে সরাসরি আমাদের সংযোগ পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, হাদীছে নববীর শিক্ষাদান, পঠন-পাঠন, সংকলন ও প্রচার-প্রকাশের চেষ্টা সফল হয়েছে। তাই দাবী করা যেতে পারে যে, সারা মুসলিম বিশ্বে শুধু হিন্দুস্থানের ভাগ্যেই এই আন্দোলনের কল্যাণে উক্ত সৌভাগ্য জুটেছে। এছাড়াও ফিক্বহের বহু মাসআলা-মাসায়েলের আলোচনা-পর্যালোচনা হয়েছে। (এটা অন্য প্রসঙ্গ যে, কিছু লোকের থেকে তাতে ভুল-ভ্রান্তিও হয়েছে।) কিন্তু এই আন্দোলনের সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি তা হ’ল মানুষের অন্তর থেকে ইত্তেবায়ে নববীর যে জায্বা হারিয়ে গিয়েছিল, তা বছরের পর বছরের জন্য পুনরায় সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু আফসোস! এখন সে জায্বাও হারিয়ে যেতে বসেছে। এ আন্দোলনের সর্বব্যাপী প্রভাব এটাও ছিল যে, জিহাদের যে আগুন ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল, তা পুনরায় জ্বলে উঠেছে। এমনকি একটা সময় এমনও গিয়েছে যখন ‘ওহাবী’ ও ‘বিদ্রোহী’ সমার্থক ভাবা হ’ত। কতজনের মাথা কাটা হয়েছে, কতজনকে শূলে চড়ানো হয়েছে, কতজনকে দ্বীপান্তর দেওয়া হয়েছে, কতজনকে কয়েদখানার অন্ধ কুঠরীতে দম বন্ধ করে মারা হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। এখন তো বিষয়টা এতই পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, বলা হয়, মাওলানা আব্দুল আযীয রহীমাবাদীর (মৃত্যু ১৯১৮ খৃ.) মতো মানুষের জীবনও এই আন্দোলনের ঝান্ডাবাহীদের মাঝে জিহাদের আত্মার ভূমিকা পালন করেছে।...

এ আন্দোলনের ভিত্তি ছিল তিনটি। (১) ইমারত (ইসলামী শাসন ব্যবস্থা) প্রতিষ্ঠা (২) কেন্দ্রীয়ভাবে যাকাত আদায় ও বণ্টন এবং (৩) যাবতীয় বৈদেশিক প্রভাব থেকে ইসলামকে মুক্ত করে তার আসল রূপে ফিরিয়ে আনা ...। আহলেহাদীছ আলেমদের শিক্ষকতা ও গ্রন্থ প্রণয়নের খিদমতও কদর করার মতো। (অতঃপর তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করেন)।[17]

২. মাওলানা আবুল হাসান আলী নাদভী (১৯১৪-১৯৯৯ খৃ.) আহলেহাদীছদের বিভিন্ন সম্মেলনে অংশ নিয়ে এই জামা‘আতের উল্লেখিত বৈশিষ্ট্য সমূহ স্বীকার করে বক্তব্য রেখেছেন। দারুল উলূম আহমাদিয়া সালাফিইয়াহ (দারভাঙ্গা, বিহার, ভারত)-এর এক সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘খালেছ তাওহীদী আক্বীদা, ইত্তেবায়ে সুন্নাত, জিহাদী জায্বা এবং আল্লাহর প্রতি বিনীত হওয়া- এই চারটি বুনিয়াদের উপর হিন্দুস্থানে আহলেহাদীছ আন্দোলন প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। এই জামা‘আত উক্ত চারটি বিষয়ের সমষ্টি ছিল। অন্যান্য দলগুলির কারো কাছে তাওহীদ আছে তো ইত্তেবায়ে সুন্নাতে অলসতা আছে, ইত্তেবায়ে সুন্নাতের জায্বা আছে তো জিহাদী জোশ নেই। কারু কাছে যিক্র ও ফিক্র আছে তো ইত্তেবায়ে সুন্নাত নেই। ফলকথা বিভিন্ন ইসলামী আন্দোলন ওগুলির কোন না কোন একটি নিয়ে উত্থিত হয়েছে। কিন্তু জামা‘আতে আহলেহাদীছ-এর মধ্যে উপরোক্ত চারটি বৈশিষ্ট্য একত্রিত হয়ে শহীদায়েনের ছূরতে আত্মপ্রকাশ করেছে। পরবর্তীতে ছাদেকপুরী (আহলেহাদীছ) জামা‘আত উক্ত চারটি বৈশিষ্ট্য একই সঙ্গে প্রদর্শন করেছে। তাদের খুলূছিয়াত ও আল্লাহর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক সকল সন্দেহের ঊর্ধ্বে। বাস্তব কথা এই যে, উক্ত চারটি বৈশিষ্ট্যের একত্র সমাহার ব্যতীত বড় কোন অবদান রাখা সম্ভব নয় এবং বৃহৎ থেকে বৃহৎ কোন আন্দোলনও এ সকল বৈশিষ্ট্য ছাড়া সফলতা লাভ করতে পারে না, যা তারা করতে পেরেছেন। অভ্যাস বদলানো, রসম-রেওয়াজ পাল্টানো এবং অন্তরকে ঈমানী উষ্ণতায় ভরে দেওয়া শুধু মেŠখিক ঘোষণা কিংবা অন্য কিছু দিয়ে হয় না। এটা কেবল সেই গুণ চর্চার ফলে হয় যার সম্বন্ধে বলা হয়েছে هُمْ بِاللَّيْلِ رُهْبَانٌ وَبِالنَّهَارِ فُرْسَانٌ ‘তারা রাতের বেলায় ইবাদতগুযার ও দিনের বেলায় ঘোড় সওয়ার’। মানুষের মধ্যে যতক্ষণ পর্যন্ত এ বৈশিষ্ট্যের ঝলক দৃষ্টিগোচর না হবে ততক্ষণ কিচ্ছু হবে না। সাইয়েদ ছাহেবের জামা‘আতের মধ্যে দাওয়াত ও দৃঢ়চিত্ততার সেই বিশেষ ব্যবস্থাই ছিল যা শত শত বছর আগের (ছাহাবা ও তাবেঈদের) যামানার মুসলমানদের বৈশিষ্ট্য ছিল ...’।

(এরপর মাওলানা ছাহেব দৃষ্টান্ত হিসাবে ছাদেকপুরী আলেমদের কিছু ঘটনা তুলে ধরেন)।[18]

৩. মাওলানা আবুল কালাম আযাদ (১৮৮৮-১৯৫৮ খৃ.) আহলেহাদীছ জামা‘আতের এই রাজনৈতিক ও জিহাদী দিক এভাবে স্পষ্ট করেছেন, ‘সে সময় হিন্দুস্থানে ওহাবীদের উপর বৃটিশ সরকার প্রচন্ড ক্ষুব্ধ ছিল এবং এ জামা‘আতকে একটি ভয়ংকর রাজনৈতিক দল হিসাবে গণ্য করা হ’ত। তার অন্যতম কারণ ছিল এই যে, এই জামা‘আতটিকে ইসমাঈল শহীদ প্রতিষ্ঠিত জামা‘আত মনে করা হ’ত। যিনি জিহাদের উপরে এই আন্দোলনের ভিত রচনা করেছিলেন এবং শিখদের বিরুদ্ধে বাস্তবে জিহাদ করেছিলেন। মাওলানা ইসমাঈল শহীদের পরে সাইয়েদ ছাহেবের যে জামা‘আত সীমান্ত এলাকায় রয়ে গিয়েছিল তা মাওলানা ছাদেকপুরীর নেতৃত্বে নতুনভাবে ঢেলে সাজানো হয় এবং ইংরেজদের সাথে তাদের দু’তিনবার যুদ্ধও হয়েছিল। ফলে ব্রিটিশ সরকারের বিশ্বাস জন্মেছিল যে, এখন এ দলটি ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চায়। আরেকটি কারণ এটাও ছিল যে, সিপাহী বিদ্রোহকালে যে ফৎওয়া প্রস্ত্তত ও সংকলন করা হয়েছিল, তাতে কিছু ওহাবী আলেমের স্বাক্ষর ও সীলমোহর ছিল। আরেকটা বড় কারণ এই ছিল যে, দেশে এ জামা‘আত ছিল সংখ্যালঘু এবং সংখ্যাগুরু গোষ্ঠীর (হানাফীদের) সঙ্গে তাদের কঠোর মাযহাবী বিরোধ স্থায়ীরূপ নিয়েছিল। বিরোধীরা তাদের ক্ষতি করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করত। একটা বড় চেষ্টা ছিল এই যে, তারা গভর্ণমেন্টকে বিশ্বাস করাতে চাইত যে, এ জামা‘আত সরকার বিরোধী এবং সরকারের বিরুদ্ধে এরা যুদ্ধ করতে চায়। এ কথার প্রতীতি জন্মাতে গভর্ণমেন্টকে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। কেননা বাংলা ও পাটনা থেকে ওহাবীদের যে বিখ্যাত পরিবারগুলি গ্রেপ্তার হয়েছিল এবং তাদের ওখানে যে এক বিরাট সংখ্যক বই-পুস্তক ও লেখালেখি উদ্ধার করা হয়েছিল তাতে ইংরেজ বিরোধিতার আহবান জানানো হয়েছিল। এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, এই জামা‘আত সাধারণত এরূপ বিরোধিতার ঘোষণা দিয়ে রেখেছিল এবং এ বিষয়ে কিছু বই-পুস্তকও লেখা হয়েছিল।

এসব কারণে সে সময় কাউকে ‘ওহাবী’ সন্দেহ করলেই বৃটিশ সরকার তৎক্ষণাৎ তাকে গ্রেফতার করত এবং মিথ্যা মামলা, ফাঁসি, দ্বীপান্তর অথবা যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিত। এই জামা‘আতের শত শত আলেম, নেতৃবৃন্দ ও ব্যবসায়ীকে কালাপানিতে নির্বাসন দেওয়া হয়েছিল। শুধু তাই নয়, যাদের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনা করা হ’ত, তাদের পরিবার-পরিজন পর্যন্ত ধ্বংস হয়ে যেত। কেননা হয় তাদেরও গ্রেফতার করা হ’ত অথবা সম্পত্তি বাযেয়াফ্ত করা হ’ত। ফলে আপনা থেকেই তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। বাংলার ওহাবীদের এবং ছাদেকপুরী পরিবারের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত প্রসিদ্ধ মামলা সমূহের পরিণাম এমনই দাঁড়িয়েছিল, যারা ছিলেন অত্যন্ত ধনী। একইভাবে কলকাতার প্রসিদ্ধ চামড়া ব্যবসায়ী আমীর খান ও হাশমত খানের পরিবারও ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল’।[19]

৪. মাওলানা আবুল হাসান আলী নাদভীর গ্রন্থ ‘হিনদুস্তানী মুসলমান’ আরবীতে প্রদত্ত তাঁর কিছু বক্তৃতার উর্দূ অনুবাদের সমষ্টি। মাসিক ‘মা‘আরিফ’ (আযমগড়, ভারত) পত্রিকা উক্ত গ্রন্থের উপর পর্যালোচনা করতে গিয়ে এই অবহেলা ও উপেক্ষার সমালোচনা করেছেন যে, এ গ্রন্থে আহলেহাদীছ জামা‘আতের ধর্মীয় ও শিক্ষা কেন্দ্রসমূহের কথা উল্লেখ করা হয়নি। অথচ সাইয়েদ আহমাদ ছাহেবের পরে এই জামা‘আতই তার আন্দোলনকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। পত্রিকাটি লিখেছে, ‘ধর্মীয় ও শিক্ষা কেন্দ্রের আলোচনা প্রসঙ্গে ‘আঞ্জুমানে তারাক্কিয়ে উর্দূ’ (উর্দূ উন্নয়ন পরিষদ) এবং আহলেহাদীছ জামা‘আত ও তাদের প্রতিষ্ঠানগুলির কথা উল্লেখ না করা বড়ই আশ্চর্য মনে হয়েছে। অথচ সাইয়েদ আহমাদের পরে এই আন্দোলনকে বাস্তবে এ জামা‘আতের লোকজনই জীবিত রেখেছিল’।[20]

৫. একইভাবে ইংরেজ লেখক ডব্লিউ. ডব্লিউ. হান্টার (১৮৪০-১৯০০ খৃ.) তার The Indian Musalmans গ্রন্থে এ কথা স্বীকার করেছেন যে, তার মতে ‘ওহাবী’ ও ‘বিদ্রোহী’ সমার্থক।[21] তাছাড়া উক্ত গ্রন্থে লেখক এটাই প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, ইংরেজদের বিরুদ্ধে হাঙ্গামা ও বিদ্রোহে হিন্দুস্থানের যেসব মুসলমান সোচ্চার ছিল তাদের তালিকার প্রথমেই ওহাবী জামা‘আত বিশেষ করে পাটনার ছাদেকপুরী পরিবার ও তাদের অনুসারীগণের নাম আসবে। হান্টার ইংরেজদের বিরুদ্ধে ছাদেকপুরী পরিবারের দৃঢ়তা ও অবিচলতা, এ পথে তাদের যে অবর্ণনীয় যুলুম ও বিপদাপদ সহ্য করতে হয়েছে, সেসবের এবং তাদের খুলূছিয়াত ও দূরদর্শিতার স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। এ গ্রন্থের কিছু উদ্ধৃতি লক্ষণীয়। এক স্থানে এই ইংরেজ লেখক বলেছেন, ‘এক সময় এই উন্মাদদের আন্দোলন ধ্বংসের কাছাকাছি বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু পাটনার খলীফাদের তাবলীগী জোশ এবং তাদের আয়ত্তে থাকা ধন-সম্পদ পবিত্র পতাকাকে মাটি থেকে তুলে আরেকবার উড্ডীন করে দিল। তারা সমগ্র ভারতে তাদের মুবাল্লিগ নিয়োগ করল এবং ধর্মীয় ভাবাবেগ এতদূর জাগিয়ে তুলল যে, ইতিপূর্বে আর কখনো এমনটা দৃষ্টিগোচর হয়নি। ঐ দুই খলীফা (মাওলানা বেলায়েত আলী ও মাওলানা এনায়েত আলী ছাদেকপুরী) স্বয়ং বাংলা ও দক্ষিণ ভারত সফর করেন। আর ছোট ছোট মুবাল্লিগ তো ছিল অগণিত ...’।

একটু সামনে অগ্রসর হয়ে তিনি লিখেছেন, ‘ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদের আবশ্যকতার উপরে ওহাবীদের গদ্যে-পদ্যে লেখা ভান্ডার যদি সংক্ষিপ্ত থেকে সংক্ষিপ্ততর ভাবেও লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়, তবুও সেজন্য একটি স্বতন্ত্র দফতরের প্রয়োজন হবে। এই জামা‘আত এমন বহু সাহিত্য সৃষ্টি করেছে, যা ইংরেজ শাসনের অবসান সম্পর্কিত ভবিষ্যদ্বাণীতে ভরা এবং জিহাদের আবশ্যকতার জন্য উৎসর্গিত। ঐসব বইয়ের শুধু নাম থেকেই তাদের পুরো মাত্রায় বিদ্রোহী হওয়ার কথা অবগত হওয়া যায়’।[22]

এছাড়া তিনি জা‘ফর থানেশ্বরী ও মাওলানা ইয়াহ্ইয়া আলীর মতো মুজাহিদদের দৃঢ়তা, অবিচলতা, দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতারও খোলাখুলি প্রশংসা করেছেন, যারা ছিলেন আহলেহাদীছ।[23]

৬. ‘হিন্দুস্তান মেঁ ওহাবী তাহরীক’ (ঞযব ডধযধনর গড়াবসবহঃ রহ ওহফরধ) বইয়ের লেখক ড. ক্বিয়ামুদ্দীন আহমাদ (১৯৩০-১৯৯৮ খৃ.) তার গ্রন্থের বহু স্থানে ছাদেকপুরী পরিবারের জিহাদী খিদমত, তাদের অতুলনীয় দৃঢ়তা ও অবিচলতা এবং জিহাদ আন্দোলনে তাদের আত্মত্যাগ ও অপরিসীম আগ্রহ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। এমনিতে তো এ গ্রন্থের পুরোটাই অধ্যয়নযোগ্য, যা ওহাবীদের আত্মত্যাগের কাহিনী এবং ইংরেজদের বিরুদ্ধে তাদের দৃঢ় ও অনড় মনোভাব এবং উৎসাহ-উদ্দীপনার এক বিস্তারিত আলেখ্য। তারপরেও তা থেকে কিছু উদ্ধৃতি নিচে তুলে ধরা হ’ল।

সম্মানিত লেখক ছাদেকপুরী পরিবার সম্পর্কে বলেন, ‘এটা সেই পরিবার, যাদের চেষ্টা-সাধনা সাইয়েদ আহমাদ শহীদ (রহঃ)-এর শাহাদাতের পর এই আন্দোলনের ইতিহাসে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে আছে। যারা তাদের অতুলনীয় তাবলীগী জোশ দিয়ে এ আন্দোলনকে বাংলা, বিহার ও দাক্ষিণাত্য পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। এই পাটনা-আযীমাবাদই ছিল সেই স্থান, যেখানে সর্বপ্রথম আগামী দিনের লড়াই ও সংঘাত চালিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে মুজাহিদদের ভর্তি এবং অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে একটি স্বতন্ত্র বিভাগের সূচনা হয়েছিল’।[24]

আরেক স্থানে তিনি লিখেছেন,এ এক দৃষ্টিগ্রাহ্য সত্য যে, একটি ক্ষমতাধর বিদেশী শক্তির বিরুদ্ধে অর্ধশতাব্দীকাল অবধি ব্যাপক লড়াইয়ে নেতৃত্বদানের সার্বিক বোঝা বাস্তবিকপক্ষে এই (ছাদিকপুরী) পরিবারের উপরেই ন্যস্ত ছিল। তারা সামরিক ও বেসামরিক উভয় গ্রুপের কাজ তত্ত্বাবধান করেছেন এবং দুই কেন্দ্রেই কাজ চালিয়ে গেছেন। এসব কিছু তারা এমন সময়ে করেছেন যখন স্বদেশীদের নিকট থেকে সাহায্য কামনা তো দূরে থাক, অবদানের স্বীকৃতিটুকুও তারা কখনো কামনা করেননি। এই হচ্ছে স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য তাদের আত্মভোলা জোশ ও আত্মত্যাগ যাচাইয়ের প্রকৃত মাপকাঠি’।[25]

৭. জনৈক বাঙালী (হিন্দু) লেখক অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে হিন্দুস্থানে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আন্দোলন ও হাঙ্গামার ধরন নির্ণয় করতে গিয়ে ওহাবী আন্দোলন সম্পর্কে নিম্নোক্ত অভিমত ব্যক্ত করেছেন, ‘সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য হওয়ার ফলে ঢাকা হ’তে পেশোয়ার পর্যন্ত দেশের সকল প্রান্ত থেকে আর্থিক ও বৈষয়িক সাহায্যাদি প্রাপ্ত হয়ে ওহাবী আন্দোলন তার শিকড় মযবুত করে নেয়। একথা মানতেই হবে যে, বৃটিশ সরকার এদেশে যতগুলি আন্দোলন জন্ম দিয়েছে, তন্মধ্যে ওহাবী আন্দোলনই সর্বাপেক্ষা কঠোর ও রূঢ় ইংরেজ বিরোধী ছিল। তাদের সকল চেষ্টা-সাধনায় তারা এর স্বাক্ষর রেখেছে’।[26]

৮. দারুল উলূম দেওবন্দে শিক্ষাপ্রাপ্ত এক নামকরা ব্যক্তিত্ব মাওলানা সাঈদ আহমাদ আকবরাবাদী (১৯০৮-১৯৮৫ খৃ.) যিনি দিল্লী থেকে প্রকাশিত ‘বুরহান’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন এবং ১৯৮৫ সালের মে মাসে করাচীতে ইন্তিকাল করেন, তার এক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘হিন্দুস্থানের আহলেহাদীছ জামা‘আতের আলেমগণও বড়ই গুরুত্বের অধিকারী। হিন্দুস্থানের শারঈ মর্যাদা নিরূপণে এ জামা‘আতের আলেমদের মতামত এজন্যও বিশেষভাবে মনোযোগ আকর্ষণের দাবী রাখে যে, এই জামা‘আতই সবচেয়ে বেশী উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে সাইয়েদ আহমাদ শহীদ (রহঃ)-এর নেতৃত্বে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। আর এ কারণেই ইংরেজরা বদনাম ছড়ানোর উদ্দেশ্যে তাদেরকে ওহাবী বলত’।[27]

[ক্রমশঃ]

মূল (উর্দূ): হাফেয ছালাহুদ্দীন ইউসুফ

 পাকিস্তান কেন্দ্রীয় শারঈ আদালতের আজীবন উপদেষ্টা, প্রখ্যাত আহলেহাদীছ আলেম, লেখক ও গবেষক; সাবেক সম্পাদক, সাপ্তাহিক আল-ই‘তিছাম, লাহোর, পাকিস্তান। জন্ম : ১৯৪৫ জয়পুর, রাজস্থান, ভারত; মৃত্যু : ১২ই জুলাই ২০২০ লাহোর, পাকিস্তান।

অনুবাদ : মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

ঝিনাইদহ।

[1]. শাহ অলিউল্লাহ আওর উন কী সিয়াসী তাহরীক, পৃ. ১০৫, ১৩০

[2]. ঐ, পৃ. ১৩৩

[3]. ঐ, পৃ. ১৩২

[4]. সাইয়েদ তোফায়েল আহমাদ মোঙ্গলোরী, মুসলমানূঁ কা রওশন মুস্তাক্ববেল, পৃ. ৮৭।

[5]. হিন্দুস্তান কি পহেলী ইসলামী তাহরীক, পৃ. ৫৬

[6]. সারগুযাশ্তে মুজাহিদীন, ২২৬, ২২৭ পৃ. (মূল উর্দূ মোট পৃ. সংখ্যা ৬৬৪)

[7]. ‘মুজাহিদ বাহিনীর ইতিবৃত্ত’ নামে বইটি ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ থেকে ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয়েছে।-সম্পাদক।

[8]. আল-ই‘তিছাম, লাহোর, ৯ই এপ্রিল ১৯৭১, পৃ. ৫

[9]. সাপ্তাহিক আল-ই‘তিছাম, লাহোর, ১৬ই এপ্রিল ১৯৭১

[10]. ঐ, ২০শে এপ্রিল ১৯৭১

[11]. ঐ, ২৮শে মে-৪ঠা জুন, ১৯৭১

[12]. ঐ, ১৬ই জুলাই ১৯৭১

[13]. দ্র. সারগুযাশ্তে মুজাহিদীন, পৃ. ৬০৭, ৬১৩, ৬১৫, ৬১৬

[14]. হিন্দুস্তান কী পহেলী ইসলামী তাহরীক, পৃ. ৫০-৫১, নতুন সংস্করণ, লাহোর

[15]. সারগুযাশ্তে মুজাহিদীন, পৃ. ৬১২।

[16]. স্মরণ রাখা দরকার যে, ১৮৩১ সালের ৬ই মে বালাকোটের হৃদয়বিদারক ঘটনা পর্যন্ত সময়কালকে জিহাদ আন্দোলনের প্রথম যুগ এবং তৎপরবর্তী সময়কালকে ২য় যুগ বলা হয়। এই ২য় যুগ এক শতাব্দী বা তার চেয়েও বেশী সময় পরিব্যাপ্ত ছিল

[17]. তারাজিমে ওলামায়ে হাদীছ হিন্দ-এর ভূমিকা, পৃ. ৩১-৩২, ২য় সংস্করণ

[18]. আল-হুদা, দারভাঙ্গা, ১৬ই জুলাই ১৯৬১ খৃ.। এই একই মাদ্রাসা আহমাদিয়া সালাফিইয়াহ (আহলেহাদীছ)-এর দিস্তারবন্দী বা পাগড়ী প্রদান অনুষ্ঠানে মাওলানা আলী নাদভী ১৯৮৪ সালের মার্চেও ভাষণ দেন এবং তাতেও তিনি আহলেহাদীছ জামা‘আত সম্পর্কে একই স্বীকারোক্তি দেন ও তাদের এই বৈশিষ্ট্যগুলিই উল্লেখ করেন। মুহতারাম মাওলানার এ ভাষণ দারুল উলূম নাদওয়াতুল ওলামা, লাক্ষ্ণৌ-এর মুখপত্র পাক্ষিক ‘তা‘মীরে হায়াত’ পত্রিকার (২৫শে মে ১৯৮৪ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়

[19]. মাওলানা আযাদ কি কাহানী, খোদ আযাদ কি যবানী, দিল্লী, হালী পাবলিশিং, পৃ. ৮৪, ৮৫

[20]. মাসিক মা‘আরিফ, আযমগড়, উপি, ভারত, ডিসেম্বর ১৯৬১, পৃ. ৪৭৮

[21]. হামারে হিন্দুস্তানী মুসলমান, পৃ. ১১৩, উর্দূ অনুবাদ: ড. ছাদেক হুসাইন, কওমী কুতুবখানা, লাহোর, পাকিস্তান

[22]. ঐ, পৃ. ৭৭, ৭৮, ১০৩ ও ১১২

[23]. ঐ, পৃ. ১৩৫, ১৪৩, ১৪৪, ১৪৭

[24]. হিন্দুস্তান মেঁ ওহাবী তাহরীক, পৃ. ৬৫ ও ২৬৩

[25]. তদেব

[26]. এস. বি. চৌধুরী, Civil disturbances during the British rule in India, কলকাতা, ১৯৫৫, পৃ. ৫০। গৃহীত : হিন্দুস্তান মেঁ ওহাবী তাহরীক, পৃ. ৩৫৮, ৩৫৯

[27]. বুরহান, দিল্লী, আগস্ট ১৯৬৬, পৃ. ৫, প্রবন্ধ: ‘হিন্দুস্তান কী শারঈ হায়ছিয়াত’






বিষয়সমূহ: সংগঠন
মুসলিম সমাজে মসজিদের গুরুত্ব (৩য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
নিয়মের রাজত্ব (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - রফীক আহমাদ - বিরামপুর, দিনাজপুর
ইসলামের দৃষ্টিতে সাহিত্য - আসাদুল্লাহ আল-গালিব (শিক্ষার্থী, ইংরেজী বিভাগ, ২য় বর্ষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)।
রামাযানকে আমরা কিভাবে অতিবাহিত করব? - ড. মুহাম্মাদ আব্দুল হালীম
পিতা-মাতার উপর সন্তানের অধিকার - মুহাম্মাদ শফীকুল ইসলাম
তাহরীকে জিহাদ : আহলেহাদীছ ও আহনাফ (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
যাকাত ও ছাদাক্বা - আত-তাহরীক ডেস্ক
লায়লাতুল ক্বদর : ফযীলত ও করণীয় - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
সুন্নাত আঁকড়ে ধরার ফযীলত (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ মীযানুর রহমান
তাক্বদীরে বিশ্বাস - মুহাম্মাদ আবু তাহের, পরিচালক, কিউসেট ইনস্টিটিউট, সিলেট।
ইসলামে তাক্বলীদের বিধান (শেষ কিস্তি) - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
ইসলামে দাড়ি রাখার বিধান (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
আরও
আরও
.