পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ । পর্ব ৬ । পর্ব ৭ ।  শেষ পর্ব । 

(৩) আমলের ক্ষেত্রে সীমালংঘন :

মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য হচ্ছে মহান আল্লাহর ইবাদত করা (যারিয়াত ৫১/৫৬)। মানুষ শিরক বিমুক্ত তাওহীদে বিশ্বাসী হবে, বহু উপাস্য পরিত্যাগ করে কেবলমাত্র এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর ইবাদত করবে, তাঁর পক্ষ থেকে প্রেরিত জীবন বিধান অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করবে এটিই মহান আল্লাহর হক বা অধিকার। অপরদিকে আল্লাহর নিকটে বান্দার হক হচ্ছে যারা শিরকমুক্তভাবে তাঁর ইবাদত করবে, তাদেরকে তিনি শাস্তি দিবেন না তথা জাহান্নামের জ্বলন্ত হুতাশনে নিক্ষেপ করবেন না।[1]

মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে জাহান্নাম থেকে বাঁচানোর জন্য যুগে যুগে নবী ও রাসূলগণকে পথপ্রদর্শক হিসাবে প্রেরণ করেছেন। যাঁরা স্ব স্ব যুগের মানুষকে জাহেলিয়াতের অমানিশা থেকে বের করে ঈমানের নূরে আলোকিত করার প্রাণান্ত চেষ্টা করেছেন। মার খেয়েছেন, সামাজিকভাবে বয়কটের শিকার হয়েছেন, চূড়ান্ত নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছেন, তারপরও সামান্য পরিমাণ বিচলিত হননি। হিমদ্রিসম দৃঢ়তা নিয়ে সকল প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করেছেন অল্পসংখ্যক দ্বীনদার মুমিনকে সাথে নিয়ে। আর সেই অল্পসংখ্যক মুমিনের জন্যই জান্নাতের সুসংবাদ। তারাই সফলকাম।[2] পক্ষান্তরে যারা তাঁদের অবাধ্যতা করে দুনিয়াতে স্বাধীনভাবে চলবে তারা হবে ব্যর্থকাম। পরকালে তাদের কোন সাহায্যকারী থাকবে না। জাহান্নামের অনলে পুড়বে অনন্তকাল। সুতরাং মুমিনের পরজীবনের একমাত্র সাথী হচ্ছে তার আমল।[3] যার আমল যত সুন্দর হবে, তার আখেরাত তত সুখময় হবে। সেকারণ আমল হ’তে হবে মহান আল্লাহর নির্দেশমত ও তাঁর রাসূলের তরীকা অনুযায়ী। হ’তে হবে ইখলাছে পরিপূর্ণ। অন্যথা আমল যদি নিজের মন মত হয়, এতে যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ না থাকে, যদি সুন্নাহ মোতাবেক না হয় এবং ইখলাছশূন্য হয়, তবে সে আমল যত সুন্দর, আবেগময় ও দরদমাখাই হোক না কেন তা কশ্মিণকালেও কবুলযোগ্য নয়। আমলের ক্ষেত্রে সীমালংঘনের কারণে তার ফলাফল হবে অন্তসারশূন্য। নিম্নে এ সম্পর্কিত কতিপয় দিক তুলে ধরা হ’ল।-

(ক) আমলে কমবেশী করা : ইসলামের প্রতিটি আমল তাওক্বীফী তথা কুরআন-সুন্নাহ কর্তৃক নির্ধারিত। এখানে কমবেশী করার কোন সুযোগ নেই। স্বেচ্ছায় ইবাদত কমানোর যেমন কোন ফুসরত নেই, তেমনি নেকী মনে করে অতিরিক্ত করারও কোন অনুমোদন নেই।

রাসূল (ছাঃ)-এর দশ বছরের খাদেম আনাস বিন মালেক (রাঃ) বলেন, ‘তিনজন ছাহাবী রাসূল (ছাঃ)-এর ইবাদত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার জন্য তাঁর বিবিগণের গৃহে আগমন করল। যখন তাদেরকে রাসূল (ছাঃ)-এর ইবাদত সম্পর্কে অবহিত করা হ’ল, তখন তারা এটিকে কম মনে করল এবং বলল, আমরা রাসূল (ছাঃ)-এর সমকক্ষ হ’তে পারি না। কারণ তাঁর আগের ও পরের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়েছে। তখন তাদের মধ্য থেকে একজন বলল, আমি সারা জীবন রাতে ছালাত আদায় করতে থাকব। অপরজন বলল, আমি সারা বছর ছিয়াম পালন করব এবং কখনও বিরতি দিব না। আরেকজন বলল, আমি নারী সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকব, কখনও বিবাহ করব না। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) তাদের নিকটে আসলেন এবং বললেন,أَنْتُمُ الَّذِينَ قُلْتُمْ كَذَا وَكَذَا أَمَا وَاللهِ إِنِّى لأَخْشَاكُمْ لِلَّهِ وَأَتْقَاكُمْ لَهُ، لَكِنِّى أَصُومُ وَأُفْطِرُ، وَأُصَلِّى وَأَرْقُدُ وَأَتَزَوَّجُ النِّسَاءَ، فَمَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِى فَلَيْسَ مِنِّى- ‘তোমরা কি ঐ সকল লোক, যারা এরূপ এরূপ বলেছ? আল্লাহর কসম! আমি আল্লাহকে তোমাদের চেয়ে বেশী ভয় করি এবং তোমাদের চেয়ে তাঁর প্রতি আমি বেশী আনুগত্যশীল। অথচ আমি ছিয়াম পালন করি, আবার ছিয়াম ছেড়েও দেই। ছালাত আদায় করি, আবার ঘুমাই এবং আমি বিবাহ করেছি। সুতরাং যে ব্যক্তি আমার সুন্নাতের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করবে, সে আমার দলভুক্ত নয়’।[4] আলোচ্য হাদীছে রাসূল (ছাঃ) ভাল কাজও অতিরিক্ত করার অনুমতি দিলেন না। তিনি বুঝাতে চাইলেন শরী‘আত কর্তৃক যতটুকু অনুমোদিত ঠিক ততটুকুই করতে হবে। কমবেশী করা যাবে না।

আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন এক বেদুঈন রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে এসে আরয করল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমাকে এমন একটি আমল বলে দিন, যা করলে আমি জান্নাতে যেতে পারব। তখন তিনি বললেন,تَعْبُدُ اللهَ لَا تُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا، وَتُقِيمُ الصَّلَاةَ الْمَكْتُوبَةَ، وَتُؤَدِّي الزَّكَاةَ الْمَفْرُوضَةَ، وَتَصُومُ رَمَضَانَ، قَالَ: وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ، لَا أَزِيدُ عَلَى هَذَا شَيْئًا أَبَدًا، وَلَا أَنْقُصُ مِنْهُ، فَلَمَّا وَلَّى قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ سَرَّهُ أَنَّ يَنْظُرَ إِلَى رَجُلٍ مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ، فَلْيَنْظُرْ إِلَى هَذَا- ‘তুমি আল্লাহর ইবাদত করবে, তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করবে না, ফরয ছালাত কায়েম করবে, নির্ধারিত যাকাত আদায় করবে এবং রামাযানের ছিয়াম পালন করবে। অতঃপর লোকটি বলল, যার হাতে আমার প্রাণ তাঁর কসম! আমি এর চেয়ে কিছু বৃদ্ধি করব না এবং তা থেকে কিছু কমও করব না। লোকটি চলে গেলে রাসূল (ছাঃ) বললেন, যে কেউ কোন জান্নাতী ব্যক্তিকে দেখে খুশি হ’তে চায়, সে যেন এই ব্যক্তির দিকে দেখে’।[5]

উক্ত হাদীছে জান্নাতী আমল সম্পর্কে ছাহাবীর দৃঢ়তাপূর্ণ স্বীকৃতি শুনে রাসূল (ছাঃ) তাকে জান্নাতী বলে ঘোষণা করলেন। যে স্বীকৃতির মধ্যে ছিল অটুট আনুগত্যের নিশ্চয়তা। ছিল ইবাদতে কমবেশী না করার প্রত্যয়দৃঢ় অঙ্গীকার।

আমর ইবনু শু‘আয়ব হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! পবিত্রতা কিরূপ? তখন তিনি একপাত্র পানি চাইলেন এবং দুই হাতের কব্জি পর্যন্ত তিনবার ধেŠত করলেন। অতঃপর তাঁর মুখমন্ডল তিনবার ধেŠত করলেন। তারপর দুই হাতের কনুই পর্যন্ত তিনবার ধেŠত করলেন। এরপর মাথা মাসাহ করলেন এবং উভয় হাতের তর্জনীদ্বয়কে উভয় কানে প্রবেশ করালেন এবং উভয় বৃদ্ধাঙ্গুলি দ্বারা কানের বহিরাংশ মাসাহ করলেন। এরপর পদযুগল তিনবার করে ধেŠত করলেন। অতঃপর তিনি বলেন, هَكَذَا الْوُضُوءُ فَمَنْ زَادَ عَلَى هَذَا أَوْ نَقَصَ فَقَدْ أَسَاءَ وَظَلَمَ، ‘এটাই পরিপূর্ণভাবে ওযূ করার নমুনা। অতঃপর যে ব্যক্তি এর চেয়ে বেশী বা কম করল, সে অবশ্যই অন্যায় করল ও যুলুম করল’।[6] অন্য বর্ণনায় আছে, هَكَذَا الْوُضُوءُ فَمَنْ زَادَ عَلَى هَذَا فَقَدْ أَسَاءَ وَتَعَدَّى وَظَلَمَ، ‘এটাই পরিপূর্ণ ওযূ। যে ব্যক্তি এরচেয়ে বেশী করল, সে অন্যায় করল, সীমালংঘন করল ও যুলম করল’।[7] আলোচ্য হাদীছ থেকে স্পষ্টভাবে জানা যায় যে, ইবাদতে কম-বেশী করা স্পষ্ট সীমালংঘন।

(খ) ছহীহ হাদীছ উপক্ষো করে জাল-যঈফ হাদীছ অনুযায়ী আমল করা : যেকোন আমল ছহীহ হাদীছভিত্তিক হ’তে হবে। জাল বা বানাওয়াট অথবা যঈফ বা দুর্বল হাদীছের ভিত্তিতে নয়। কেননা একটা ছহীহ হাদীছের মোকাবেলায় শত জাল-যঈফ হাদীছও যথেষ্ট নয়। বর্ণনাসূত্রের বিচ্ছিন্নতা, রাবীর ‘আদালত ও যাবত তথা ন্যাপরায়ণতা ও ধী-শক্তির ঘাটতি ইত্যাদি নানা কারণে হাদীছ যঈফ হয়। আর জাল হাদীছ তো রাসূল (ছাঃ)-এর নামে সরাসরি মিথ্যাচার। যার পরিণাম ভায়াবহ। আলী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন,لاَ تَكْذِبُوْا عَلَىَّ فَإِنَّهُ مَنْ كَذَبَ عَلَىَّ فَلْيَلِجِ النَّارَ، ‘তোমরা আমার উপর মিথ্যারোপ কর না। কেননা যে ব্যক্তি আমার উপর মিথ্যারোপ করবে, সে জাহান্নামে যাবে’।[8] মুগীরা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِنَّ كَذِبًا عَلَىَّ لَيْسَ كَكَذِبٍ عَلَى أَحَدٍ، مَنْ كَذَبَ عَلَىَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ ‘নিশ্চয়ই আমার উপর মিথ্যারোপ করা অন্য কারো উপর মিথ্যারোপ করার মত নয়। যে ব্যক্তি আমার উপর মিথ্যারোপ করে সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নামে নির্ধারণ করে নেয়’।[9]

উক্ত হাদীছ থেকে রাসূল (ছাঃ)-এর নামে মিথ্যা হাদীছ রচনার ভবিষ্যৎ ইঙ্গিত পাওয়া যায়। যা মূলতঃ ৩৭ হিজরীর পর ফিৎনার যামানা শুরু হ’লে ব্যাপকহারে দেখা দেয়। ইমাম শা‘বী (২২-১০৪ হি.)-এর বক্তব্য থেকে এর সমর্থন পাওয়া যায়। তিনি বলেন,لَوِ اسْتَقْبَلْتُ مِنْ أَمْرِىْ مَا اسْتَدْبَرْتُ مَا حَدَّثْتُ إِلاَّ مَا أَجْمَعَ عَلَيْهِ أَهْلُ الْحَدِيْثِ- ‘এখন যেসব ঘটছে, তা আগে জানলে আমি কোন হাদীছ বর্ণনা করতাম না, কেবল ঐ হাদীছ ব্যতীত, যার উপরে আহলুল হাদীছগণ অর্থাৎ ছাহাবীগণ একমত হয়েছেন’।[10] একইভাবে খ্যাতনামা তাবেঈ মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন (৩৩-১১০ হি.) বলেন,لَمْ يَكُوْنُوْا يَسْأَلُوْنَ عَنِ الْإِسْنَادِ، فَلَمَّا وَقَعَتِ الْفِتْنَةُ قَالُوْا سَمُّوْا لَنَا رِجَالَكُمْ، فَيُنْظَرُ إِلَى أَهْلِ السُّنَّةِ فَيُؤْخَذُ حَدِيْثُهُمْ وَيُنْظَرُ إِلَى أَهْلِ الْبِدْعِ فَلاَ يُؤْخَذُ حَدِيْثُهُمْ- ‘লোকেরা ইতিপূর্বে কখনো হাদীছের সনদ বা সূত্র সম্পর্কে জিজ্ঞেস করত না। কিন্তু যখন ফিৎনার যুগ এল, তখন তারা বলতে লাগল আগে তোমরা বর্ণনাকারীদের পরিচয় বল। অতঃপর যদি দেখা যেত যে, বর্ণনাকারী ‘আহলে সুন্নাত’ দলভুক্ত, তাহ’লে তাঁদের বর্ণিত হাদীছ গ্রহণ করা হ’ত। কিন্তু ‘আহলে বিদ‘আত’ দলভুক্ত হ’লে তাদের বর্ণিত হাদীছ গ্রহণ করা হ’ত না’।[11]

উল্লেখ্য যে, সময়ের ব্যবধানে হাদীছ শাস্ত্রে বহু জাল-যঈফ হাদীছের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। একশ্রেণীর অসাধু ব্যক্তি হীন স্বার্থে অথবা ইসলাম বিদ্বষীদের মদদপুষ্ট হয়ে বা নিজেদের স্বার্থদ্বন্দ্বের ফাঁদে পড়ে হাদীছ শাস্ত্রকে কালিমালিপ্ত করার এই অপপ্রয়াস চালিয়েছে। যা সংশয়বাদীদের মনস্ত্তষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কেবলমাত্র শী‘আরাই তিন লক্ষাধিক হাদীছ জাল করেছে মর্মে প্রসিদ্ধি রয়েছে। এক মাযহাবের অনুসারীরা অন্য মাযহাবের বিরুদ্ধে জাল হাদীছ রচনা করেছে। আবার কেউ ব্যবসায়িক স্বার্থে পণ্যের কাটতি বৃদ্ধির জন্য, কেউবা রাজা-বাদশাহদের খুশি করার জন্য তাদের কোন ক্রিয়া-কর্মের পক্ষে জাল হাদীছ রচনা করেছে। এইভাবে ইলমে হাদীছের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করে আছে মওযূ বা জাল হাদীছ। যা বর্তমানে মুহাদ্দেছীনে কেরামের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে বাছাই হয়ে পৃথকভাবে গ্রন্থাবদ্ধ হয়েছে। প্রসিদ্ধ হাদীছ গ্রন্থাবলীর মধ্যে ছড়িয়ে-ছিঁটিয়ে থাকা যঈফ ও মওযূ হাদীছগুলোও তাহক্বীক্ব করে কারণ সহ চিহ্নিত করা হয়েছে। এখন সবকিছুই দিবালোকের ন্যায় স্বচ্ছ ও পরিষ্কার। এরপরও এ যুগে এসে কেউ যদি বলে, ‘হাদীছ তো হাদীছই, হাদীছ কি আবার জাল হয় নাকি’? তাদের ব্যাপারে কি মন্তব্য করা চলে তা বিবেকবান পাঠকদের উপরই ছেড়ে দিলাম।

এক্ষণে কেউ যদি ছহীহ হাদীছকে উপেক্ষা করে জাল-যঈফ হাদীছ অনুযায়ী আমল করে, তবে সেটা হবে আমলের ক্ষেত্রে সীমালংঘন। কেননা আমলের ক্ষেত্রে একমাত্র অনুসরণীয় হচ্ছেন মুহাম্মাদ (ছাঃ)। তাঁর দেখানো-শিখানো বা সমর্থিত পদ্ধতি ছহীহ হাদীছে পাওয়া সত্ত্বেও নিজেদের আচরিত মাযহাব, মতবাদ ও তরীকাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যদি জাল হাদীছ বা ভিত্তিহীন কোন আমল করা হয়, তবে এই আমল দ্বারা আর যাই হোক নাজাত পাওয়া সম্ভব নয়। আল্লাহ বলেন,قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُمْ بِالْأَخْسَرِينَ أَعْمَالًا- الَّذِينَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُونَ صُنْعًا، ‘বল, আমরা কি তোমাদেরকে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত আমলকারীদের সম্পর্কে খবর দিব? যাদের সকল প্রচেষ্টা পার্থিব জীবনে বিফলে গেছে। অথচ তারা ভেবেছে যে, তারা সৎকর্ম করছে’ (কাহফ ১৮/১০৩-১০৪)। জাল হাদীছের ভিত্তিতে আমলকারীদের জন্য অত্র আয়াতটি প্রণিধানযোগ্য। এই জাতীয় আমলই ক্ষতিগ্রস্ত আমল। এটিই আমলের ক্ষেত্রে সীমালংঘন।

(গ) ভিত্তিহীন আমল : সমাজে এমন অনেক আমল চালু আছে, ছহীহ হাদীছে তো দূরের কথা জাল-যঈফ হাদীছেও যার কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। যেমন- ছালাতের শুরুতে আরবীতে নিয়ত পাঠ করা। যার কোন ভিত্তি নেই। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তাফসীর ক্লাসে আমরা প্রচলিত একটি প্রসিদ্ধ মাযহাবের অনুসারী আমাদের একজন শিক্ষককে প্রসঙ্গক্রমে আরবী নিয়তের অস্তিত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি কিছুটা রসিকতার ভঙ্গিতে বলেছিলেন, ‘এটি কায়দায়ে বোগদাদীতে আছে’। অনুরূপভাবে মীলাদ-ক্বিয়াম, কুরআনখানী, চল্লিশা এরকম বহু আমলকে ধর্মীয় লেবাস পরিয়ে সমাজে চালু করা হয়েছে, যার কোন ভিত্তি নেই। এসবই আমলের ক্ষেত্রে সীমালংঘন। এরকম অস্তিত্বহীন আমলের ফলাফল শূন্য।

(ঘ) রাসূল (ছাঃ) প্রদর্শিত পদ্ধতি ব্যতীত মনগড়া পদ্ধতিতে আমল করা : মহান আল্লাহ বলেন, وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا وَاتَّقُوا اللهَ إِنَّ اللهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ ‘রাসূল তোমাদেরকে যা দেন তা গ্রহণ কর, আর যা থেকে নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ শাস্তি প্রদানে কঠোর’ (হাশর ৫৯/৭)। অন্যত্র তিনি বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللهِ وَالرَّسُولِ، ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আনুগত্য কর রাসূলের ও তোমাদের নেতৃবৃন্দের। অতঃপর যদি কোন বিষয়ে তোমরা বিতন্ডা কর, তাহ’লে বিষয়টি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও’ (নিসা ৪/৫৯)

উপরোক্ত আয়াতদ্বয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর অনুসরণের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। শেষোক্ত আয়াতে সমস্যাসঙ্কুল পরিস্থিতিতে সমাধানের সুন্দর পথ দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ আমলের ক্ষেত্রে হোক বা মু‘আমালাতের ক্ষেত্রে হোক, যদি কোন বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দেয় তখন এর সমাধান নিতে হবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট থেকে তথা এলাহী বিধান থেকে। কোন পীর, মুরববী, বুযুর্গ, ইমাম বা নেতার কাছ থেকে নয়। নয় কোন মাযহাব, মতবাদ, ইজম বা তরীকার কাছ থেকে। কেননা রাসূল (ছাঃ) হচ্ছেন আমাদের পথপ্রদর্শক। তিনি আসমানী নির্দেশনা ব্যতীত কোন কথা বলতেন না (নাজম ৫৩/৩-৪)। তিনি উম্মাতকে আসমানী বার্তা শুনিয়েছেন, ইলমে শরী‘আত শিক্ষা দিয়েছেন, ইবাদতের যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। যেমনটি কুরআন মাজীদে ঘোষিত হয়েছে,هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولًا مِنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِنْ كَانُوا مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُبِينٍ، ‘তিনিই সেই সত্তা যিনি নিরক্ষরদের মধ্যে তাদের মধ্য থেকেই একজনকে রাসূল হিসাবে প্রেরণ করেছেন। যিনি তাদের নিকটে তাঁর আয়াত সমূহ পাঠ করেন ও তাদের পবিত্র করেন। আর তাদেরকে কিতাব ও সুন্নাহ শিক্ষা দেন’ (জুম‘আ ৬২/২)

আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, كُلُّ أُمَّتِى يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ إِلاَّ مَنْ أَبَى قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ وَمَنْ يَأْبَى قَالَ مَنْ أَطَاعَنِى دَخَلَ الْجَنَّةَ وَمَنْ عَصَانِى فَقَدْ أَبَى- ‘আমার সকল উম্মতই জান্নাতে প্রবেশ করবে, তবে যে ‘আবা’ বা অসম্মত সে ব্যতীত। ছাহাবীগণ বললেন, কে অসম্মত হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)? তিনি বললেন, যে আমার অনুসরণ করে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে, আর যে আমার অবাধ্যতা করবে, সেই ‘আবা’ বা অসম্মত’।[12] অন্যত্র তিনি বলেন,مَنْ أَطَاعَنِى فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ وَمَنْ عَصَانِى فَقَدْ عَصَى اللهَ ‘যে আমার আনুগত্য করল, সে আল্লাহরই আনুগত্য করল। আর যে আমার অবাধ্যতা করল, সে আল্লাহরই অবাধ্যতা করল’।[13]

সুতরাং ইবাদতের পরতে পরতে তাঁর যথাযথ অনুসরণ অত্যাবশ্যক। তাঁর তরীকা ব্যতীত অন্য তরীকায় ইবাদত করলে তা কবুল হবে না। তাইতো তিনি ছালাতের ক্ষেত্রে দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে বলে দিয়েছেন, صَلُّوا كَمَا رَأَيْتُمُونِى أُصَلِّى ‘তোমরা ছালাত আদায় কর সেভাবে, যেভাবে আমাকে ছালাত আদায় করতে দেখেছ’।[14] হজ্জের বিধান জানার নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, خُذُوا عَنِّى مَنَاسِكَكُمْ فَإِنِّى لاَ أَدْرِى لَعَلِّى أَنْ لاَ أَحُجَّ بَعْدَ حَجَّتِى هَذِهِ، ‘তোমরা আমার নিকট থেকে হজ্জের নিময়-কানূন শিখে নাও। কারণ এ বছরের পর হয়তবা আমার পক্ষে আর হজ্জ করা সম্ভব হবে না’।[15]

এভাবে প্রতিটি ইবাদতে তাঁর অনুসরণ অনিবার্য। ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ, যাকাত থেকে শুরু করে বৈষয়িক যে কোন বিষয়ে তাঁর নিকট থেকেই ফায়ছালা নিতে হবে। তিনি যে পদ্ধতিতে, যে সময়ে ও যে পরিমাণে করেছেন, হবহু সেভাবে করতে হবে। নেকীর প্রত্যাশায় অতিরিক্ত করলে সেটি বিদ‘আত হবে। তিনি করেননি, করতে বলেননি এমন কোন আমল আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ عَمِلَ عَمَلاً لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهْوَ رَدٌّ ‘যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করল, যাতে আমার কোন নির্দেশনা নেই, তা প্রত্যখ্যাত’।[16]

ইবাদত সঠিক হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র ‘কায়ফিয়াত’ বা পদ্ধতির ভিন্নতার কারণেও ইবাদত বাতিল হয়ে যায়। রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর কিছুদিন পরে মসজিদে নববীতে কয়েকজন ছাহাবী গোলাকার হয়ে বসে হাতে কাঁকর নিয়ে একজনের নেতৃত্বে ১০০ বার ‘আল্লাহু আকবার’ ১০০ বার ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ ১০০ বার ‘সুবহানাল্লাহ’ এই তাসবীহগুলো সমস্বরে পাঠ করছিলেন। এই খবর জলীলুল ক্বদর ছাহাবী আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ)-কে জানানো হ’লে তিনি তাদের নিকটে গেলেন এবং এসব কি করা হচ্ছে জানতে চাইলেন। তারা বলল, আমরা কাঁকর দিয়ে তাসবীহ, তাহলীল, তাকবীর গণনা করছি। তখন ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বললেন,وَيْحَكُمْ يَا أُمَّةَ مُحَمَّدٍ، مَا أَسْرَعَ هَلَكَتَكُمْ هَؤُلَاءِ صَحَابَةُ نَبِيِّكُمْ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مُتَوَافِرُونَ، وَهَذِهِ ثِيَابُهُ لَمْ تَبْلَ، وَآنِيَتُهُ لَمْ تُكْسَرْ، وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ، إِنَّكُمْ لَعَلَى مِلَّةٍ هِيَ أَهْدَى مِنْ مِلَّةِ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أوْ مُفْتَتِحُو بَابِ ضَلَالَةٍ، ‘হতভাগা হে উম্মতে মুহাম্মাদী! এত দ্রুত তোমাদের ধ্বংস এসে গেল! এখনো নবীর ছাহাবীগণ বিপুল সংখ্যায় জীবিত আছেন। তাঁর পোষাকগুলি এখনো পুরাতন হয়নি। তাঁর ব্যবহৃত আসবাবপত্র এখনো ভেঙ্গে যায়নি। আল্লাহর কসম করে বলছি, তোমরা কি মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর ধর্মের চেয়েও ভাল কোন ধর্মের ওপরে আছ? নাকি তোমরা ভ্রষ্টতার দরজা খুলে দিলে?’ হালকায়ে যিকরে বসা লোকেরা তখন বলল, وَاللَّهِ يَا أَبَا عَبْدِ الرَّحْمَنِ، مَا أَرَدْنَا إِلَّا الْخَيْرَ، ‘হে আবূ আব্দুর রহমান (আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ) এর দ্বারা আমরা কল্যাণ বৈ কিছুই কামনা করি না। তখন আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ বললেন, وَكَمْ مِنْ مُرِيدٍ لِلْخَيْرِ لَنْ يُصِيبَهُ، ‘বহু নেকীর প্রত্যাশী মানুষ আছে, যারা তা পায় না’। কেননা রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّ قَوْمًا يَقْرَءُونَ الْقُرْآنَ لَا يُجَاوِزُ تَرَاقِيَهُمْ، ‘নিশ্চয়ই একদল মানুষ, যারা কুরআন পাঠ করবে কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না’।[17]

আবু মূসা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা কোন এক সফরে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে ছিলাম। লোকেরা উচ্চৈঃস্বরে তাকবীর পাঠ করছিল। রাসূল (ছাঃ) তখন বললেন,أَيُّهَا النَّاسُ ارْبَعُوا عَلَى أَنْفُسِكُمْ، إِنَّكُمْ لَيْسَ تَدْعُونَ أَصَمَّ وَلَا غَائِبًا، إِنَّكُمْ تَدْعُونَ سَمِيعًا قَرِيبًا، وَهُوَ مَعَكُمْ قَالَ وَأَنَا خَلْفَهُ، وَأَنَا أَقُولُ: لَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللهِ، فَقَالَ يَا عَبْدَ اللهِ بْنَ قَيْسٍ: أَلَا أَدُلُّكَ عَلَى كَنْزٍ مِنْ كُنُوزِ الْجَنَّةِ، فَقُلْتُ: بَلَى يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ: قُلْ لَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللهِ، ‘হে লোক সকল! তোমরা তোমাদের জীবনের উপর সদয় হও। কেননা তোমরা তো কোন বধির অথবা অনুপস্থিত সত্তাকে ডাকছ না। নিশ্চয়ই তোমরা ডাকছ সর্বশ্রোতা, নিকটবর্তী সত্তাকে, যিনি তোমাদের সাথেই আছেন। আবু মূসা (রাঃ) বলেন, আমি তাঁর (সওয়ারীর) পিছনে ছিলাম। তখন আমি বলছিলাম, ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’। রাসূল (ছাঃ) তখন বললেন, হে আব্দুল্লাহ বিন কায়স (আবূ মূসা)! আমি কি তোমাকে জান্নাতের গুপ্ত ধনসমূহের মধ্যে কোন একটি গুপ্তধনের কথা জানিয়ে দিব? আমি বললাম, অবশ্যই হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! অতঃপর তিনি বললেন, তুমি বল, ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’।[18]

অথচ বাংলাদেশের যিকরের হাল-হকিকত যে কতটা ভয়াবহ, কতটা গর্হিত, এর অঙ্গভঙ্গি যে কতটা ব্যঙ্গাত্মক তা পাঠক মাত্রই অবগত আছেন। দেশের মাযারে-ওরসে, খানকা-দরগায়, বড় বড় পীর ও ইসলামী দলের হালাকা ও ওয়ায মাহফিলে চলে যিকরের নামে চরম স্বেচ্ছাচারিতা। গলা ফাটিয়ে চীৎকার করে, অঙ্গ দুলিয়ে, লম্ফ-ঝম্প করে, খুঁটির মাথায় উঠে লাফিয়ে পড়ে, ডিগবাজি খেয়ে উন্মাদনা প্রকাশের মাধ্যমে যে যিকর বাংলাদেশে চলছে তা স্রেফ ভন্ডামী ছাড়া কিছুই নয়। কুরআন-হাদীছের সাথে এ ধরনের যিকরের দূরতম সম্পর্ক নেই। তাছাড়া যিকরের শব্দ ও বাক্যও নিজেদের তৈরী করা। যা সম্পূর্ণ অর্থহীন। আবার অনেক মসজিদে দেখা যায় ফজর ছালাতের পর গোল হয়ে বসে কিছু মুছল্লী সশব্দে সমস্বরে যিকির করে থাকে। উক্ত যিকিরের শব্দগুলোও বানোয়াট। এ ধরনের যিকির সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ যিকরের পদ্ধতি সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,ادْعُوا رَبَّكُمْ تَضَرُّعًا وَخُفْيَةً إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُعْتَدِينَ، ‘তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ডাক বিনীতভাবে ও সঙ্গোপনে। তিনি সীমালংঘনকারীদের পসন্দ করেন না’ (আ‘রাফ ৭/৫৫)। তিনি আরো বলেন, وَاذْكُرْ رَبَّكَ فِي نَفْسِكَ تَضَرُّعًا وَخِيفَةً وَدُونَ الْجَهْرِ مِنَ الْقَوْلِ بِالْغُدُوِّ وَالْآصَالِ وَلَا تَكُنْ مِنَ الْغَافِلِينَ ‘তুমি তোমার প্রতিপালকের যিকির কর, মনে মনে বিনয় ও ভয়-ভীতি সহকারে নীরবে সকাল-সন্ধ্যায়। তুমি গাফেলদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না’ (আ‘রাফ ৭/২০৫)। উক্ত যিকির-পন্থীরা শেষে লম্বা এক মুনাজাত করে বিদায় নেয়। এটাও একটি বিদ‘আতী আমল। শরী‘আতে এর কোন ভিত্তি নেই।

(ঙ) সঠিক সময়ে আমল না করা : ইবাদত যেমন তাওক্বীফী, তেমনি এর স্থান এবং সময়ও তাওক্বীফী। অর্থাৎ কিতাব ও সুন্নাহ দ্বারা নির্ধারিত। ইবাদতে যেমন কমবেশী করার কোন সুযোগ নেই, তেমনি এর স্থান ও সময়ের ক্ষেত্রেও আগপিছ বা কমবেশী করা যাবে না। যে ইবাদত যে সময়ের সাথে সম্পর্কিত সেটি সে সময়েই করতে হবে। এক্ষেত্রেও যদি আমরা কুরআন-সুন্নাহর দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে নিজেদের মন মত সময় নির্ধারণ করে নেই তাহ’লে এটিও সীমালংঘন হিসাবে গণ্য হবে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, চাঁদ উঠার আগেই রামাযানের ছিয়াম পালন শুরু করা ও ঈদ করা, ঈদের ছালাতের আগে খুৎবা দেওয়া ও পরে ছালাত আদায় করা, নিয়মিত সূর্য ডোবার সাথে সাথে ইফতার না করে সময়ক্ষেপণ করা তথা ৩/৪ মিনিট অপেক্ষা করা, নিয়মিত আখের ওয়াক্তে ছালাত আদায় করা, যিলহজ্জ মাসে হজ্জ না করে অন্য মাসে করা, আরাফার ময়দানে ৯ যিলহজ্জ অবস্থান না করে আগের দিন বা পরের দিন অবস্থান করা, মসজিদে ই‘তেকাফ না করে বাড়ীতে করা, রামাযানের শেষ দশকে ই‘তেকাফ না করে প্রথম দশকে করা, শেষ দশকের বেজোড় রাতে লায়লাতুল ক্বদর না তালাশ করে মাঝের দশকে তালাশ করা ইত্যাদি বহু ইবাদত রয়েছে সময়ের সাথে সম্পৃক্ত। কাজেই শরী‘আত কর্তৃক নির্ধারিত সময়েই সুনির্দিষ্ট আমল করতে হবে। ইবাদতের রকমফের, সময়, পরিমাণ ইত্যাদি কোন কিছু পরিবর্তন করার ক্ষমতা কারো নেই। অতএব পরিশ্রম করে নেকীর কাজ করে নেকী থেকে মাহরূম হ’লে এরচেয়ে বড় হতভাগা আর কে হ’তে পারে। অতএব আসুন! আমরা আমলের ক্ষেত্রে সীমালংঘন থেকে বেঁচে থাকি। আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন-আমীন!

[ক্রমশঃ]

[1]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/২৩

[2]. মুসলিম হা/১৪৫; মিশকাত হা/১৫৯

[3]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫১৬৭

[4]. বুখারী হা/৫০৬৩; মুসলিম হা/১৪০১; মিশকাত হা/১৪৫

[5]. বুখারী হা/১৩৯৭; মুসলিম হা/১৪; মিশকাহ হা/১৩

[6]. আবুদাউদ হা/১৩৫, সনদ হাসান

[7]. মুসনাদে আহমাদ হা/৬৬৮৪; নাসাঈ হা/১৪০; ইবনু মাজাহ হা/৪২২; মিশকাত হা/৪১৭, সনদ হাসান

[8]. বুখারী হা/১০৬

[9]. বুখারী হা/১২৯১

[10]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, আহলেহাদীছ আন্দোলন কি ও কেন? (হাফাবা: ৬ষ্ঠ সংস্করণ ২০১৮) পৃ. ৬, গৃহীত: শামসুদ্দীন যাহাবী, তাযকিরাতুল হুফফায (বৈরূত: দারুল কুতুবিল ইলমিইয়াহ, তাবি) ১/৮৩ পৃ.

[11]. আহলেহাদীছ আন্দোলন কি ও কেন?, পৃ. ৩৫, গৃহীত: মুক্বাদ্দামা মুসলিম (বৈরূত: দারুল ফিক্র ১৪০৩/১৯৮৩), পৃ. ১৫

[12]. বুখারী হা/৭২৮০; মিশকাত হা/১৪৫

[13]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৩৬৬১

[14]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৬৮৩

[15]. আহমাদ হা/১৪৭৯৩; ছহীহুল জামে‘ হা/৭৮৮২

[16]. বুখারী হা/২০; মুসলিম হা/১৭১৮

[17]. সুনানুদ দারেমী হা/২০৪; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২০০৫ সনদ জাইয়িদ

[18]. বুখারী হা/৪২০৫, ৬৩৮৪, ৬৬১০; মুসলিম হা/২৭০৪ মিশকাত হা/২৩০৩






বিষয়সমূহ: পরকাল
তাহরীকে জিহাদ : আহলেহাদীছ ও আহনাফ (৭ম কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
পবিত্রতা অর্জন সম্পর্কিত বিবিধ মাসায়েল (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
ছিয়ামের ফাযায়েল ও মাসায়েল - আত-তাহরীক ডেস্ক
শায়খ আলবানীর তাৎপর্যপূর্ণ কিছু মন্তব্য (১ম কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
আহলেহাদীছ একটি বৈশিষ্ট্যগত নাম (৭ম কিস্তি) - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
যাকাত ও ছাদাক্বা - আত-তাহরীক ডেস্ক
পারিবারিক অপরাধ : কারণ ও প্রতিকার (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন
শবেবরাত - আত-তাহরীক ডেস্ক
আশূরায়ে মুহাররম - আত-তাহরীক ডেস্ক
কথাবার্তা বলার আদব বা শিষ্টাচার - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপনের আবশ্যকতা (৪র্থ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
ইসলামে দাড়ি রাখার বিধান (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
আরও
আরও
.