পর্ব ১ । শেষ পর্ব । 

মুমিনের দুনিয়াবী জীবন কুসুমাস্তীর্ণ নয়। বরং তা কণ্টকাকীর্ণ। তার সামনে থাকে শত বাধার দুর্ভেদ্য প্রাচীর। তা জয় করে তাকে জান্নাতের পথে এগিয়ে যেতে হয়, বাঁচার চেষ্টা করতে হয় জাহান্নাম থেকে। তাই দুনিয়াবী জীবনের শত বাধা বিঘ্নকে সে পেরিয়ে যায় হাসিমুখে। বরণ করে নেয় হাযারো নির্যাতন-নিপীড়ন। কারণ বাধার প্রাচীর ডিঙিয়ে তাকে লক্ষ্যপানে পৌঁছতেই হবে। এটাই তার সতত সাধনা ও একান্ত কামনা। ফলে দুনিয়াবী কোন বাধাকে সে ভয় পায় না। মুষড়ে পড়ে না কোন প্রতিকূল পরিবেশে। কারণ তার একমাত্র লক্ষ্য জান্নাত। দুনিয়াতে মুমিন যেসব বাধার সম্মুখীন হয় এবং সে অবস্থায় তার করণীয় কি? সে বিষয়ে আলোচ্য নিবন্ধে আলোচনা করা হ’ল।-

১. অহংকার :

অহংকারের কারণে মানুষ হক গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে। কল্যাণ লাভ থেকে সে বঞ্চিত হয়। আর অহংকার হ’ল সত্যকে অবজ্ঞা করা এবং মানুষকে তুচ্ছ মনে করা।[1] মানব চরিত্রের দুষ্টক্ষত এই অহংকারের কারণে মানুষ হেদায়াতের আলো থেকে দূরে থাকে। হক পথ থেকে বিচ্যুত হয়। আল্লাহ বলেন, سَأَصْرِفُ عَنْ آيَاتِيَ الَّذِيْنَ يَتَكَبَّرُوْنَ فِي الْأَرْضِ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَإِنْ يَرَوْا كُلَّ آيَةٍ لَا يُؤْمِنُوْا بِهَا وَإِنْ يَرَوْا سَبِيْلَ الرُّشْدِ لَا يَتَّخِذُوْهُ سَبِيْلًا وَإِنْ يَرَوْا سَبِيْلَ الْغَيِّ يَتَّخِذُوهُ سَبِيْلًا ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ كَذَّبُوْا بِآيَاتِنَا وَكَانُوْا عَنْهَا غَافِلِيْنَ، ‘এ পৃথিবীতে যারা অন্যায়ভাবে অহংকার করে আমি তাদেরকে আমার আয়াত সমূহ থেকে ফিরিয়ে রাখব। তারা আমার সমস্ত আয়াত (নিদর্শন) দেখলেও তারা তাতে বিশ্বাস স্থাপন করবে না। তারা হেদায়াতের পথ দেখলেও তারা সে পথে যাবে না। কিন্তু যদি ভ্রষ্টতার পথ দেখে তাহ’লে তারা সেটাই গ্রহণ করবে। এটা এ কারণে যে, তারা আমাদের আয়াত সমূহে মিথ্যারোপ করে এবং তারা এ থেকে উদাসীন’ (আ‘রাফ ৭/১৪৫)

অহংকার যে মানুষকে হক গ্রহণে বাধা দেয়, তার প্রথম উদাহরণ হ’ল ইবলীস। তাকে যখন বলা হ’ল আদমকে সিজদা কর, তখন সে অহংকার করল। আল্লাহ বলেন, فَسَجَدَ الْمَلَائِكَةُ كُلُّهُمْ أَجْمَعُوْنَ، إِلَّا إِبْلِيْسَ اسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ الْكَافِرِيْنَ، قَالَ يَاإِبْلِيْسُ مَا مَنَعَكَ أَنْ تَسْجُدَ لِمَا خَلَقْتُ بِيَدَيَّ أَسْتَكْبَرْتَ أَمْ كُنْتَ مِنَ الْعَالِيْنَ، قَالَ أَنَا خَيْرٌ مِنْهُ خَلَقْتَنِيْ مِنْ نَارٍ وَخَلَقْتَهُ مِنْ طِيْنٍ، ‘তখন ফেরেশতারা সবাই একযোগে সিজদা করল। ইবলীস ব্যতীত। সে অহংকার করল এবং কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল। আল্লাহ বললেন, হে ইবলীস! আমি যাকে আমার দু’হাত দিয়ে সৃষ্টি করেছি, তাকে সিজদা করতে তোমাকে কোন বস্ত্ত বাধা দিল? তুমি অহংকার করলে নাকি তুমি তার চাইতে বড়দের অন্তর্ভুক্ত? সে বলল, আমি তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আপনি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন, আর তাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে’ (ছোয়াদ ৩৮/৭৩-৭৬)

ইহুদীদের অহংকারের কথা উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন, أَفَكُلَّمَا جَاءَكُمْ رَسُوْلٌ بِمَا لَا تَهْوَى أَنْفُسُكُمُ اسْتَكْبَرْتُمْ فَفَرِيْقًا كَذَّبْتُمْ وَفَرِيْقًا تَقْتُلُوْنَ، ‘অতঃপর যখনই কোন রাসূল এমন নির্দেশ নিয়ে তোমাদের কাছে এসেছেন, যা তোমাদের মনঃপূত হয়নি, তখনই তোমরা অহংকার করেছ। শেষ পর্যন্ত তোমরা একদলকে মিথ্যা বলেছ এবং একদলকে হত্যা করেছ’ (বাক্বারাহ ২/৮৭)

মুশরিকদের উদাহরণ পেশ করে আল্লাহ বলেন, إِنَّهُمْ كَانُوْا إِذَا قِيْلَ لَهُمْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ يَسْتَكْبِرُوْنَ، ‘যখন তাদেরকে বলা হ’ত, আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই, তখন তারা ঔদ্ধত্য দেখাত’ (ছফফাত ৩৭/৩৫)

কাফেরদের বিষয় উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন, إِنَّ الَّذِيْنَ يُجَادِلُوْنَ فِيْ آيَاتِ اللهِ بِغَيْرِ سُلْطَانٍ أَتَاهُمْ إِنْ فِيْ صُدُوْرِهِمْ إِلَّا كِبْرٌ مَا هُمْ بِبَالِغِيْهِ فَاسْتَعِذْ بِاللهِ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيْعُ الْبَصِيْرُ، ‘নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর আয়াত সমূহ নিয়ে বিতর্ক করে, নিজেদের কাছে কোন প্রমাণ না আসা সত্ত্বেও, তাদের অন্তরে রয়েছে কেবলি অহংকার; যা অর্জনে তারা সফল হবে না। অতএব তুমি আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই তিনি সবকিছু শোনেন ও দেখেন’ (মুমিন ৪০/৫৬)

২. হিংসা-বিদ্বেষ :

হিংসা-বিদ্বেষ মানুষকে দুনিয়াতে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত করে, তেমনি তার আমল নষ্ট করে দিয়ে তাকে পরকালে জাহান্নামী করে। মানুষ সাধারণত ভালোর প্রতি হিংসা করে থাকে। যেমন আল্লাহ বলেন, أَمْ يَحْسُدُوْنَ النَّاسَ عَلَى مَا آتَاهُمُ اللهُ مِنْ فَضْلِهِ فَقَدْ آتَيْنَا آلَ إِبْرَاهِيْمَ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَآتَيْنَاهُمْ مُلْكًا عَظِيْمًا، ‘তবে কি তারা লোকদের (মুসলমানদের) প্রতি এজন্য হিংসা করে যে, আল্লাহ স্বীয় অনুগ্রহ থেকে তাদের কিছু দান করেছেন। আর আমরা তো ইবরাহীমের বংশধরগণকে কিতাব ও হিকমত দান করেছিলাম এবং তাদেরকে দান করেছিলাম বিশাল সাম্রাজ্য’ (নিসা ৪/৫৪)

ইবলীসের হিংসার উদাহরণ পেশ করে আল্লাহ বলেন, وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوْا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيْسَ قَالَ أَأَسْجُدُ لِمَنْ خَلَقْتَ طِينًا، قَالَ أَرَأَيْتَكَ هَذَا الَّذِيْ كَرَّمْتَ عَلَيَّ لَئِنْ أَخَّرْتَنِ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ لَأَحْتَنِكَنَّ ذُرِّيَّتَهُ إِلَّا قَلِيْلًا، ‘(স্মরণ কর) যখন আমরা ফেরেশতাদের বলেছিলাম, তোমরা আদমকে সিজদা কর। তখন সবাই সিজদা করল ইবলীস ব্যতীত। সে বলল, আমি কি তাকে সিজদা করব যাকে আপনি কাদামাটি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন? সে আরও বলল, দেখুন তো একে আপনি আমার উপরে মর্যাদা দান করলেন! অতএব যদি আপনি আমাকে ক্বিয়ামত দিবস পর্যন্ত অবকাশ দেন, তাহ’লে তার বংশধর সবাইকে সমূলে পথভ্রষ্ট করে ফেলব কিছু সংখ্যক ব্যতীত’ (বনী ইসরাঈল ১৭/৬১-৬২)

আদম (আঃ)-এর দু’পুত্রের উদাহরণ পেশ করে আল্লাহ বলেন, وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ ابْنَيْ آدَمَ بِالْحَقِّ إِذْ قَرَّبَا قُرْبَانًا فَتُقُبِّلَ مِنْ أَحَدِهِمَا وَلَمْ يُتَقَبَّلْ مِنَ الْآخَرِ قَالَ لَأَقْتُلَنَّكَ قَالَ إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللهُ مِنَ الْمُتَّقِيْنَ، ‘তুমি তাদের নিকট বর্ণনা কর আদম পুত্রদ্বয়ের ঘটনা সত্য সহকারে। যখন তারা উভয়ে কুরবানী পেশ করল। অতঃপর তাদের একজনের কুরবানী কবুল হ’ল, কিন্তু অন্যেরটা কবুল হ’ল না। তখন সে বলল, আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করব। জবাবে অপরজন বলল, নিশ্চয়ই আল্লাহ কেবল মুত্তাক্বীদের আমলই কবুল করে থাকেন’ (মায়েদাহ ৫/২৭)। এভাবে ভালোর প্রতি হিংসা আবহমান কালের। আর এই হিংসা-দ্বেষ মানুষকে হক থেকে দূরে রাখে।

৩. প্রবৃত্তির অনুসরণ :

প্রবৃত্তির অনুসরণ মানুষকে হক গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখে। এমনকি প্রবৃত্তির অনুসরণের ফলে অনেকে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে। আল্লাহ বলেন, وَلَا تَتَّبِعِ الْهَوَى فَيُضِلَّكَ عَنْ سَبِيلِ اللهِ إِنَّ الَّذِينَ يَضِلُّوْنَ عَنْ سَبِيْلِ اللهِ لَهُمْ عَذَابٌ شَدِيْدٌ بِمَا نَسُوْا يَوْمَ الْحِسَابِ، ‘এ বিষয়ে প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। তাহ’লে তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। নিশ্চয়ই যারা আললাহর পথ থেকে বিচ্যুত হয়, তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। এ কারণে যে, তারা বিচার দিবসকে ভুলে গেছে’ (ছোয়াদ ৩৮/২৬)

তিনি আরো বলেন, وَلَا تُطِعْ مَنْ أَغْفَلْنَا قَلْبَهُ عَنْ ذِكْرِنَا وَاتَّبَعَ هَوَاهُ وَكَانَ أَمْرُهُ فُرُطًا ‘আর তুমি ঐ ব্যক্তির আনুগত্য করো না যার অন্তরকে আমরা আমাদের স্মরণ থেকে গাফেল করে দিয়েছি এবং সে তার খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে ও তার কার্যকলাপ সীমা অতিক্রম করে গেছে’ (কাহাফ ১৮/২৮)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,فَلَا يَصُدَّنَّكَ عَنْهَا مَنْ لَا يُؤْمِنُ بِهَا وَاتَّبَعَ هَوَاهُ فَتَرْدَى ‘সুতরাং যে ব্যক্তি ক্বিয়ামতে বিশ্বাস করে না ও নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, সে যেন তোমাকে উক্ত বিশ্বাস থেকে নিবৃত্ত না করে। তাহ’লে তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে’ (ত্বোয়াহা ২০/১৬)। অতএব প্রবৃত্তিপরায়ণ মানুষ হক গ্রহণ করতে পারে না।

৪. আল্লাহ ব্যতীত সৃষ্টিকে আঁকড়ে ধরা : 

আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে বাদ দিয়ে কোন মানুষকে কিংবা পূর্ব পুরুষকে আঁকড়ে ধরা বা তাদের আচার-আচরণের অনুসারী হ’লে হক পথ থেকে বিচ্যুত হ’তে হয়। কারণ মানুষের স্রষ্টা ও নিয়ন্তা হিসাবে তাদেরকে আল্লাহ কল্যাণের পথ প্রদর্শন করেন তাঁর নবী-রাসূলের মাধ্যমে। সুতরাং কেউ আল্লাহকে বাদ দিয়ে কোন সৃষ্টিকে আঁকড়ে ধরলে পথভ্রষ্ট হবে। আল্লাহ বলেন,وَإِذَا قِيْلَ لَهُمْ تَعَالَوْا إِلَى مَا أَنْزَلَ اللهُ وَإِلَى الرَّسُوْلِ قَالُوْا حَسْبُنَا مَا وَجَدْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا أَوَلَوْ كَانَ آبَاؤُهُمْ لَا يَعْلَمُوْنَ شَيْئًا وَلَا يَهْتَدُوْنَ، ‘আর যখন তাদের বলা হয়, তোমরা আল্লাহ যা নাযিল করেছেন সেদিকে এবং রাসূলের দিকে এসো, তখন তারা বলে, আমাদের জন্য তাই-ই যথেষ্ট, যার উপরে আমরা আমাদের বাপ-দাদাদের পেয়েছি। যদিও তাদের বাপ-দাদারা কোন জ্ঞান রাখত না বা তারা সুপথপ্রাপ্ত ছিল না’ (মায়েদাহ ৫/১০৪)

এভাবে মানুষ পূর্বপুরুষের অনুসরণ করে নবী-রাসূলগণের অনুসরণ করে না। আল্লাহ বলেন, إِنَّهُمْ أَلْفَوْا آبَاءَهُمْ ضَالِّيْنَ، فَهُمْ عَلَى آثَارِهِمْ يُهْرَعُوْنَ، وَلَقَدْ ضَلَّ قَبْلَهُمْ أَكْثَرُ الْأَوَّلِيْنَ، ‘তারা তাদের বাপ-দাদাদের পেয়েছিল পথভ্রষ্ট রূপে। ফলে তারা তাদের পদাংক অনুসরণের প্রতি দ্রুত ধাবিত ছিল। তাদের পূর্বেকার অধিকাংশ পূর্বসূরিগণ বিপথগামী ছিল’ (ছফ্ফাত ৩৭/৬৯-৭১)

আর বংশধররা স্বাভাবিকভাবে তাদের পূর্বসূরিদের পাপকর্মের অনুসরণ করে থাকে। আল্লাহ বলেন, وَإِذَا فَعَلُوا فَاحِشَةً قَالُوا وَجَدْنَا عَلَيْهَا آبَاءَنَا وَاللهُ أَمَرَنَا بِهَا قُلْ إِنَّ اللهَ لَا يَأْمُرُ بِالْفَحْشَاءِ أَتَقُولُونَ عَلَى اللهِ مَا لَا تَعْلَمُوْنَ، ‘যখন তারা কোন অশ্লীল কর্ম করে তখন বলে, আমরা আমাদের পূর্ব পুরুষদের এরূপ করতে দেখেছি এবং আল্লাহ আমাদের এরূপ করার নির্দেশ দিয়েছেন। বলে দাও যে, আল্লাহ কখনো অশ্লীল কাজের নির্দেশ দেন না। তোমরা কি আল্লাহ সম্পর্কে এমন কথা বলছ, যা তোমরা জান না’? (আ‘রাফ ৭/২৮)

কোন কোন ক্ষেত্রে পূর্বসূরিদের শিরকেরও অনুসরণ করে থাকে পরবর্তী বংশধররা। আল্লাহ বলেন, إِذْ قَالَ لِأَبِيهِ وَقَوْمِهِ مَا هَذِهِ التَّمَاثِيلُ الَّتِي أَنْتُمْ لَهَا عَاكِفُونَ، قَالُوْا وَجَدْنَا آبَاءَنَا لَهَا عَابِدِيْنَ، ‘যখন সে তার পিতা ও সম্প্রদায়কে বলল, এই মূর্তিগুলি কী, যাদের পূজায় তোমরা রত আছ? তারা বলল, আমরা আমাদের বাপ-দাদাদেরকে এদের পূজারী হিসাবে পেয়েছি’ (আম্বিয়া ২১/৫২-৫৩)। বংশধররা পূর্ববর্তীদের কর্মের অনুসারী হয়। আল্লাহ বলেন,قَالُوْا بَلْ وَجَدْنَا آبَاءَنَا كَذَلِكَ يَفْعَلُوْنَ، ‘তারা বলল, না। তবে আমরা আমাদের বাপ-দাদাদের পেয়েছি তারা এরূপই করত’ (শু‘আরা ২৬/৭৪)

অপরদিকে কোন ধর্মগুরু বা আলেমের অন্ধ অনুসরণ মানুষকে হক থেকে ফিরিয়ে রাখে। আল্লাহ বলেন,اتَّخَذُوْا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُوْنِ اللهِ، ‘তারা আল্লাহকে ছেড়ে নিজেদের আলেম-ওলামা ও পোপ-পাদ্রীদেরকে ‘রব’ হিসাবে গ্রহণ করেছে’ (তওবা ৯/৩১)। অন্যত্র পাপীদের বক্তব্য উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন,وَقَالُوْا رَبَّنَا إِنَّا أَطَعْنَا سَادَتَنَا وَكُبَرَاءَنَا فَأَضَلُّوْنَا السَّبِيْلَا، رَبَّنَا آتِهِمْ ضِعْفَيْنِ مِنَ الْعَذَابِ وَالْعَنْهُمْ لَعْنًا كَبِيْرًا، ‘তারা আরও বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের নেতাদের ও বড়দের আনুগত্য করতাম। অতঃপর তারাই আমাদের পথভ্রষ্ট করেছিল। হে আমাদের প্রতিপালক! তাদেরকে তুমি দ্বিগুণ শাস্তি দাও এবং তাদেরকে মহা অভিশাপ দাও’ (আহযাব ৩৩/৬৭-৬৮)

অনুরূপভাবে মানুষ হক ব্যতিরেকে সৃষ্টির অনুসরণে গোঁড়ামি ও বাড়াবাড়ি করে থাকে। অর্থাৎ ব্যক্তি, বংশ-গোত্র, এলাকা ও মাযহাব ইত্যাদির অন্ধ অনুসরণ করার ফলে হক গ্রহণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ قَاتَلَ تَحْتَ رَايَةٍ عُمِّيَّةٍ يُقَاتِلُ عَصَبِيَّةً وَيَغْضَبُ لِعَصَبِيَّةٍ فَقِتْلَتُهُ جَاهِلِيَّةٌ، ‘যে ব্যক্তি লোকেদেরকে গোত্রবাদের দিকে আহবান করে অথবা গোত্রবাদে উন্মত্ত হয়ে ভ্রষ্টতার পতাকাতলে যুদ্ধ করে নিহত হ’লে সে জাহেলিয়াতের মৃত্যুবরণ করল’।[2]

৫. আত্মসম্মান ও আত্মগর্ব :

আত্মসম্মান ও আত্মঅহংকার হক গ্রহণের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আল্লাহ বলেন,وَإِذَا قِيلَ لَهُ اتَّقِ اللهَ أَخَذَتْهُ الْعِزَّةُ بِالْإِثْمِ فَحَسْبُهُ جَهَنَّمُ وَلَبِئْسَ الْمِهَادُ، ‘আর যখন তাকে বলা হয়, আল্লাহকে ভয় কর, তখন তার মর্যাদার অহংকার তাকে পাপে স্ফীত করে তোলে। অতএব তার জন্য জাহান্নামই যথেষ্ট। আর নিশ্চিতভাবেই সেটা নিকৃষ্টতম ঠিকানা’ (বাক্বারাহ ২/২০৬)। আত্মগর্বই মক্কার কুরাইশদেরকে ইসলাম গ্রহণে বিরত রেখেছিল। আল্লাহ বলেন,إِذْ جَعَلَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا فِيْ قُلُوْبِهِمُ الْحَمِيَّةَ حَمِيَّةَ الْجَاهِلِيَّةِ، ‘যখন কাফেরদের অন্তরে ছিল জাহেলিয়াতের উত্তেজনা’ (ফাতাহ ২/২০৬)। অর্থাৎ জাহেলিয়াতের অহংকার। জাহেলী অহমিকা আবু জাহল, ওৎবাহ, শায়বাহ সহ কুরাইশ নেতাদেরকে হক থেকে দূরে রেখেছিল। বর্তমানেও অনেক নেতাকে হক থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে তাদের আত্ম অহমিকা।

৬. নিফাক বা কপটতা :

নিফাক বা কপটতা এমন এক দোষ, যার কারণে মানুষের ভিতর ও বাহির থাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাহ্যিক চাল-চলন তার সুন্দর হ’লেও অভ্যন্তরীণ কর্মকান্ড থাকে কলুষিত। এই মানসিকতা তাকে হক থেকে দূরে রাখে। আল্লাহ বলেন, وَإِذَا قِيْلَ لَهُمْ تَعَالَوْا إِلَى مَا أَنْزَلَ اللهُ وَإِلَى الرَّسُوْلِ رَأَيْتَ الْمُنَافِقِيْنَ يَصُدُّوْنَ عَنْكَ صُدُوْدًا، ‘যখন তাদেরকে বলা হয়, এসো আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তার দিকে এবং রাসূলের দিকে, তখন তুমি কপট বিশ্বাসীদের দেখবে যে, তারা তোমার থেকে একেবারেই মুখ ফিরিয়ে নেবে’ (নিসা ৪/৬১)। যেমন আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই। মুসলমানদের সাথে সে ছালাত-ছিয়াম আদায় করলেও, সে ইসলাম থেকে ছিল বহু যোজন দূরে। বর্তমানেও অনেক তথাকথিত আলেম ও কপট বিশ্বাসীকে হক থেকে দূরে রাখছে তাদের অন্তরের নিফাক বা কপটতা।

৭. ক্রোধ-রাগ :

মানুষের ভিতরের ক্রোধ অনেক সময় তাকে হক থেকে দূরে রাখে। অন্তরের এ ব্যাধির কারণে সে হক থেকে বঞ্চিত হয়। যেমন হাদীছে এসেছে, সুলায়মান ইবনু ছুরাদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত,

اسْتَبَّ رَجُلاَنِ عِنْدَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم وَنَحْنُ عِنْدَهُ جُلُوْسٌ، وَأَحَدُهُمَا يَسُبُّ صَاحِبَهُ مُغْضَبًا قَدِ احْمَرَّ وَجْهُهُ فَقَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم إِنِّى لأَعْلَمُ كَلِمَةً لَوْ قَالَهَا لَذَهَبَ عَنْهُ مَا يَجِدُ لَوْ قَالَ أَعُوذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ. فَقَالُوا لِلرَّجُلِ أَلاَ تَسْمَعُ مَا يَقُوْلُ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِنِّىْ لَسْتُ بِمَجْنُوْنٍ.

‘একবার নবী করীম (ছাঃ)-এর সম্মুখেই দু’ব্যক্তি গালাগালি করছিল। আমরাও তাঁর কাছেই উপবিষ্ট ছিলাম, তাদের একজন অপরজনকে এত রেগে গিয়ে গালি দিচ্ছিল যে, তার চেহারা রক্তিম হয়ে গিয়েছিল। তখন নবী করীম (ছাঃ) বললেন, আমি একটি কালিমা জানি, যদি এ লোকটি তা পড়ত, তবে তার রাগ দূর হয়ে যেত। অর্থাৎ যদি লোকটি ‘আঊযু বিল্লা-হি মিনাশশাইত্ব-নির রাজীম’ পড়ত। তখন লোকেরা সে ব্যক্তিকে বলল, নবী করীম (ছাঃ) কী বলেছেন, তা কি তুমি শুনছ না? সে বলল, আমি নিশ্চয়ই পাগল নই’।[3] অর্থাৎ তার রাগ তাকে রাসূলের নির্দেশ পালন থেকে বিরত রাখল। এভাবে মানব মনের সীমাহীন ক্রোধ তাকে অন্ধ করে দেয়। ফলে তা তাকে হক থেকে বিরত রাখে।

৮. অসৎ সঙ্গী-সাথী :

মানুষ সঙ্গী-সাথীর কর্মকান্ড দ্বারা অনেক ক্ষেত্রে প্রভাবিত হয়। এজন্য রাসূল (ছাঃ) বলেন,الرَّجُلُ عَلَى دِيْنِ خَلِيْلِهِ فَلْيَنْظُرْ أَحَدُكُمْ مَنْ يُخَالِلُ، ‘মানুষ তার বন্ধুর রীতিনীতির অনুসারী হয়। কাজেই তোমাদের প্রত্যেকেই যেন লক্ষ্য করে, সে কার

সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে’।[4] সঙ্গী-সাথী তাকে অনেক ক্ষেত্রে সৎপথ থেকে বিচ্যুত করে দেয়। যা সে ইহকালে বুঝতে পারে না। অবশেষে পরকালে যখন সে বুঝতে পারবে তখন শুধু আফসোস ব্যতীত কোন উপায় থাকবে না। আল্লাহ বলেন, وَيَوْمَ يَعَضُّ الظَّالِمُ عَلَى يَدَيْهِ يَقُوْلُ يَالَيْتَنِيْ اتَّخَذْتُ مَعَ الرَّسُوْلِ سَبِيْلًا، يَاوَيْلَتَا لَيْتَنِيْ لَمْ أَتَّخِذْ فُلَانًا خَلِيْلًا، لَقَدْ أَضَلَّنِيْ عَنِ الذِّكْرِ بَعْدَ إِذْ جَاءَنِيْ وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِلْإِنْسَانِ خَذُوْلًا، ‘যালেম সেদিন নিজের দু’হাত কামড়ে বলবে, হায়! যদি (দুনিয়াতে) রাসূলের পথ অবলম্বন করতাম। হায় দুর্ভোগ আমার! যদি আমি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম। আমার কাছে উপদেশ (কুরআন) আসার পর সে আমাকে পথভ্রষ্ট করেছিল। বস্ত্ততঃ শয়তান মানুষের জন্য পথভ্রষ্টকারী’ (ফুরক্বান ২৫/২৭-২৯)

অসৎ বন্ধুর খারাপ পরিণতি সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَثَلُ الْجَلِيسِ الصَّالِحِ وَالسَّوْءِ كَحَامِلِ الْمِسْكِ وَنَافِخِ الْكِيرِ، فَحَامِلُ الْمِسْكِ إِمَّا أَنْ يُحْذِيَكَ، وَإِمَّا أَنْ تَبْتَاعَ مِنْهُ، وَإِمَّا أَنْ تَجِدَ مِنْهُ رِيحًا طَيِّبَةً، وَنَافِخُ الْكِيرِ إِمَّا أَنْ يُحْرِقَ ثِيَابَكَ، وَإِمَّا أَنْ تَجِدَ رِيحًا خَبِيثَةً. ‘সৎসঙ্গী ও অসৎ সঙ্গীর দৃষ্টান্ত হ’ল, কস্ত্তরীওয়ালা ও কামারের হাপরের ন্যায়। কস্ত্তরীওয়ালা হয়তো তোমাকে কিছু দান করবে কিংবা তার নিকট হ’তে তুমি কিছু খরিদ করবে কিংবা তার নিকট হ’তে তুমি সুবাস পাবে। আর কামারের হাপর হয়তো তোমার কাপড় পুড়িয়ে দিবে কিংবা তুমি তার নিকট হ’তে দুর্গন্ধ পাবে’।[5]

৯. ক্ষমতা, সম্মান ও অনুসারী হারানোর ভয় :

ক্ষমতা, জনবল ও অনুসারীদের হারানোর ভয়ে অনেক ক্ষেত্রে নেতৃবৃন্দ বা ক্ষমতাশীন লোকজন হক গ্রহণ করা থেকে দূরে থাকে। যেমন হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, নবী করীম (ছাঃ) রোম সম্রাট হিরাকলের কাছে পত্র প্রেরণ করলে তিনি রাসূল (ছাঃ) সম্পর্কে জানার জন্য তখন সিরয়িায় অবস্থানকারী আবু সুফিয়ানকে দরবারে ডেকে এনে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। আবু সুফিয়ানের উত্তর শুনে তিনি বলেন, ‘তুমি বলেছ, তিনি তোমাদের এক আল্লাহর ইবাদত করা ও তাঁর সঙ্গে অন্য কিছুর অংশীদার স্থাপন না করার নির্দেশ দেন। তিনি তোমাদের নিষেধ করেন মূর্তিপূজা করতে আর তোমাদের আদেশ করেন ছালাত আদায় করতে, সত্য বলতে ও সচ্চরিত্র অবলম্বন করতে। তুমি যা বলেছ, তা যদি সত্য হয়, তবে শীঘ্রই তিনি আমার এ দু’পায়ের নীচের জায়গার অধিকারী হবেন। আমি নিশ্চিত জানতাম, তাঁর আবির্ভাব হবে। কিন্তু তিনি যে তোমাদের মধ্য হ’তে হবেন, এ কথা ভাবতে পারিনি। যদি জানতাম, আমি তাঁর নিকট পৌঁছতে পারব, তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য আমি যে কোন কষ্ট সহ্য করে নিতাম। আর আমি যদি তাঁর নিকট থাকতাম, তবে অবশ্যই তাঁর দু’খানা পা ধৌত করে দিতাম। অতঃপর তিনি আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর সেই পত্রখানি আনার নির্দেশ দিলেন, যা তিনি দিহইয়াতুল কালবী (রাঃ)-কে দিয়ে বছরার শাসকের মাধ্যমে হিরাক্লিয়াসের নিকট প্রেরণ করেছিলেন। তিনি তা পড়লেন। তাতে (লেখা) ছিল-

বিসমিল্লা-হির রহমা-নির রহীম (পরম করুণাময় দয়ালু আল্লাহর নামে)। আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর পক্ষ হ’তে রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের প্রতি। শান্তি (বর্ষিত হোক) তার প্রতি, যে হিদায়াতের অনুসরণ করে। তারপর আমি আপনাকে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছি। ইসলাম গ্রহণ করুন, শান্তিতে থাকবেন। আল্লাহ আপনাকে দ্বিগুণ প্রতিদান দান করবেন। আর যদি মুখ ফিরিয়ে নেন, তবে সকল প্রজার পাপই আপনার উপর বর্তাবে।

‘হে আহলে কিতাব! এসো সে কথায় যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে এক ও অভিন্ন। তা হ’ল, আমরা যেন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত না করি, কোন কিছুকেই যেন তাঁর শরীক সাব্যস্ত না করি এবং আমাদের কেউ যেন কাউকে পালনকর্তারূপে গ্রহণ না করে আল্লাহকে ত্যাগ করে। যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তোমরা বল, তোমরা সাক্ষী থাক, আমরা তো মুসলিম’ (আলে ইমরান ৩/৬৪)

আবূ সুফিয়ান বলেন, হিরাক্লিয়াস যখন তাঁর বক্তব্য শেষ করলেন এবং পত্র পাঠও শেষ করলেন, তখন সেখানে হট্টগোল শুরু হয়ে গেল, চীৎকার ও হৈ-হল্লা চরমে পৌঁছল এবং আমাদেরকে বের করে দেয়া হ’ল। আমাদেরকে বের করে দিলে আমি আমার সাথীদের বললাম, আবূ কাবশার ছেলের বিষয় তো শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, বনূ আসফার (রোম)-এর বাদশাহও তাকে ভয় পাচ্ছে! তখন থেকে আমি বিশ্বাস রাখতাম, তিনি শীঘ্রই জয়ী হবেন। অবশেষে আল্লাহ তা‘আলা আমাকে ইসলাম গ্রহণের তাওফীক দান করলেন।

ইবনু নাতূর ছিলেন যেরুযালেমের শাসনকর্তা এবং হিরাক্লিয়াসের বন্ধু ও সিরিয়ার খৃস্টানদের পাদ্রী। তিনি বলেন, হিরাক্লিয়াস যখন যেরুযালেম আসেন, তখন একদা তাঁকে অত্যন্ত মলিন দেখাচ্ছিল। তাঁর একজন বিশিষ্ট সহচর বলল, আমরা আপনার চেহারা আজ এত মলিন দেখছি। ইবনু নাতূর বলেন, হিরাক্লিয়াস ছিলেন জ্যোতির্বিদ, জ্যোতির্বিদ্যায় তাঁর দক্ষতা ছিল। তারা জিজ্ঞেস করলে তিনি তাদের বললেন, আজ রাতে আমি তারকারাজির দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলাম, খতনাকারীদের বাদশাহ আবির্ভূত হয়েছেন। বর্তমান যুগে কোন জাতি খাতনা করে? তারা বলল, ইহূদী জাতি ব্যতীত কেউ খাতনা করে না। কিন্তু তাদের ব্যাপারে আপনি মোটেও চিন্তাগ্রস্ত হবেন না। আপনার রাজ্যের শহরগুলোতে লিখে পাঠান, তারা যেন সেখানকার সকল ইহূদীকে হত্যা করে ফেলে। তারা যখন এ ব্যাপারে ব্যতিব্যস্ত ছিল, তখন হিরাক্লিয়াসের নিকট জনৈক ব্যক্তিকে হাযির করা হ’ল, যাকে গাস্সানের শাসনকর্তা পাঠিয়েছিল। সে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) সম্পর্কে খবর দিচ্ছিল। হিরাক্লিয়াস তার কাছ থেকে খবর জেনে নিয়ে বললেন, তোমরা একে নিয়ে গিয়ে দেখ, তার খাতনা হয়েছে কি-না। তারা তাকে নিয়ে গিয়ে দেখে এসে সংবাদ দিল, তার খাতনা হয়েছে।

হিরাক্লিয়াস তাকে আরবদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে সে জওয়াব দিল, তারা খাতনা করে। অতঃপর হিরাক্লিয়াস তাদের বললেন, ইনি [আল্লাহর রাসূল] এ উম্মতের বাদশাহ। তিনি আবির্ভূত হয়েছেন। অতঃপর হিরাক্লিয়াস রোমে তাঁর বন্ধুর নিকট লিখলেন। তিনি জ্ঞানে তাঁর সমকক্ষ ছিলেন। পরে হিরাক্লিয়াস হিমসে চলে গেলেন। হিমসে থাকতেই তাঁর নিকট তাঁর বন্ধুর চিঠি এলো, যা নবী করীম (ছাঃ)-এর আবির্ভাব এবং তিনিই যে প্রকৃত নবী, এ ব্যাপারে হিরাক্লিয়াসের মতকে সমর্থন করেছিল। তারপর হিরাক্লিয়াস তাঁর হিমসের প্রাসাদে রোমের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের ডাকলেন এবং প্রাসাদের সকল দরজা বন্ধ করার আদেশ দিলে দরজা বন্ধ করা হ’ল। অতঃপর তিনি সম্মুখে এসে বললেন, হে রোমের অধিবাসী! তোমরা কি মঙ্গল, হিদায়াত এবং তোমাদের রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব চাও? তাহ’লে এই নবীর বায়‘আত গ্রহণ কর। এ কথা শুনে তারা বন্য গাধার ন্যায় দ্রুত নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে দরজার দিকে ছুটল, কিন্তু তারা তা বন্ধ দেখতে পেল।

হিরাক্লিয়াস যখন তাদের অনীহা লক্ষ্য করলেন এবং তাদের ঈমান থেকে নিরাশ হয়ে গেলেন, তখন বললেন, ওদেরকে আমার নিকট ফিরিয়ে আন। তিনি বললেন, আমি একটু পূর্বে যে কথা বলেছি, তার মাধ্যমে তোমরা তোমাদের দ্বীনের উপর কতটুকু অটল, কেবল তার পরীক্ষা করছিলাম। এখন তা দেখে নিলাম। একথা শুনে তারা তাঁকে সিজদা করল এবং তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হ’ল। এটাই ছিল হিরাক্লিয়াসের সর্বশেষ অবস্থা।[6]

এভাবে যুগে যুগে মানুষ সম্মান, প্রতিপত্তি ও রাজত্ব হারানোর ভয়ে হককে বুঝতে পেরেও তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে, আজো করছে।

১০. ভ্রান্ত আবেগ-অনুভূতি :

মানুষের ভিতরের ভুল আবেগ-অনুভূতি ও ভ্রান্ত চেতনা তাকে হক গ্রহণে বাধা দেয়। যেমন হাদীছে এসেছে, সাঈদ ইবনু মুসাইয়াব (রহ.) স্বীয় পিতা হ’তে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আবূ তালিবের মৃত্যুর সময় উপস্থিত হ’লে, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তার নিকট আসলেন। তিনি সেখানে আবূ জাহল ইবনু হিশাম ও আব্দুল্লাহ ইবনু আবূ উমাইয়া ইবনে মুগীরাকে উপস্থিত দেখতে পেলেন।

(রাবী বলেন) আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আবূ তালিবকে লক্ষ্য করে বললেন, চাচাজান! ‘লা- ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ কালিমা পাঠ করুন, তাহলে এর অসীলায় আমি আল্লাহর সমীপে আপনার জন্য সাক্ষ্য দিতে পারব। আবূ জাহল ও আব্দুল্লাহ ইবনু আবূ উমাইয়া বলে উঠল, ওহে আবূ তালিব! তুমি কি আব্দুল মুত্তালিবের ধর্ম হ’তে বিমুখ হবে? অতঃপর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তার নিকট কালিমা পেশ করতে থাকেন, আর তারা দু’জনও তাদের উক্তি পুনরাবৃত্তি করতে থাকে। অবশেষে আবূ তালিব তাদের সামনে শেষ কথাটি যা বলল, তা এই যে, সে আব্দুল মুত্তালিবের ধর্মের উপর অবিচল রয়েছে, সে ‘লা- ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ বলতে অস্বীকার করল।

আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বললেন, আল্লাহর কসম! তবুও আমি আপনার জন্য মাগফিরাত কামনা করতে থাকব, যতক্ষণ না আমাকে তা হ’তে নিষেধ করা হয়’।[7] এভাবে ভ্রান্ত আবেগ মানুষকে হক গ্রহণ থেকে বিরত রাখে।

১১. অজ্ঞতা ও মূর্খতা :

কোন বিষয় সম্পর্কে অজ্ঞতা মানুষকে সে বিষয়ের ভাল-মন্দ দিক সম্পর্কে বাছ-বিচার করা থেকে এবং তা গ্রহণ-বর্জনে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে বাধা দেয়। তাই জ্ঞানার্জন করার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ) নির্দেশ দিয়েছেন। কেননা জ্ঞানের দ্বারাই অজ্ঞতার অন্ধকার দূরীভূত হয়। হক-বাতিলের পার্থক্য করার ক্ষমতা অর্জিত হয়। আর এই জ্ঞান না থাকলে মানুষ হককেও বাতিল জ্ঞান করে তাকে প্রত্যাখ্যান করে। যেমন আল্লাহ বলেন, بَلْ كَذَّبُوْا بِمَا لَمْ يُحِيْطُوْا بِعِلْمِهِ وَلَمَّا يَأْتِهِمْ تَأْوِيْلُهُ كَذَلِكَ كَذَّبَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَانْظُرْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الظَّالِمِيْنَ، ‘বরং তারা এমন বিষয়কে মিথ্যা সাব্যস্ত করেছে, যে বিষয়ে তাদের কোন জ্ঞান নেই এবং যার কোন ব্যাখ্যাও তাদের কাছে এখনো আসেনি। এমনিভাবে তাদের পূর্বের লোকেরাও মিথ্যারোপ করেছিল। অতএব তুমি দেখ ঐসব যালেমদের পরিণতি কিরূপ হয়েছিল’ (ইউনুস ১০/৩৯)

তিনি আরো বলেন, وَقَالَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا لِلَّذِيْنَ آمَنُوْا لَوْ كَانَ خَيْرًا مَا سَبَقُونَا إِلَيْهِ وَإِذْ لَمْ يَهْتَدُوْا بِهِ فَسَيَقُوْلُوْنَ هَذَا إِفْكٌ قَدِيْمٌ، ‘আর কাফেররা মুমিনদের বলে, যদি এটা ভাল হ’ত, তাহ’লে তারা আমাদের আগে এটা গ্রহণ করতে পারত না। (আল্লাহ বলেন,) যেহেতু তারা এর মাধ্যমে সুপথ পায়নি, সেহেতু ওরা এখন বলবে, এটা সেই পুরানো মিথ্যা বৈ কিছু নয়’ (আহক্বাফ ৪৬/১১)

১২. ভীরুতা-কাপুরুষতা :

ভীরুতা-কাপুরুষতা মানুষকে হক থেকে ফিরিয়ে রাখে। মানুষের ভয়, সমাজের ভয় ও লোকলজ্জার ভয় ইত্যাদি কারণে মানুষকে আল্লাহ থেকে দূরে রাখে এবং হক থেকে ফিরিয়ে রাখে। অথচ কেবল আল্লাহভীতি মানুষকে হক গ্রহণে সহায়তা করে। যার কারণে আল্লাহ মুত্তাক্বী ও পরহেযগার মানুষের প্রশংসা করেছেন। আল্লাহ বলেন, الَّذِيْنَ يُبَلِّغُوْنَ رِسَالَاتِ اللهِ وَيَخْشَوْنَهُ وَلاَ يَخْشَوْنَ أَحَدًا إِلاَّ اللهَ وَكَفَى بِاللهِ حَسِيْبًا، ‘যারা আল্লাহর রিসালাত প্রচার করত ও তাঁকে ভয় করত। আল্লাহ ব্যতীত তারা অন্য কাউকে ভয় করত না। আর হিসাব গ্রহণের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট’ (আহযাব ৩৩/৩৯)

শক্তিশালী মুমিনের প্রশংসা করে রাসূল (ছাঃ) বলেন, الْمُؤْمِنُ الْقَوِىُّ خَيْرٌ وَأَحَبُّ إِلَى اللهِ مِنَ الْمُؤْمِنِ الضَّعِيْفِ، ‘শক্তিশালী মুমিন দুর্বল মুমিনের চাইতে উত্তম এবং আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়’।[8]

রাসূল (ছাঃ) ভীরুতা-কাপুরুষতা হ’তে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। তিনি এভাবে দো‘আ করতেন, اللَّهُمَّ إِنِّى أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْهَمِّ وَالْحَزَنِ، وَالْعَجْزِ وَالْكَسَلِ، وَالْبُخْلِ وَالْجُبْنِ وَضَلَعِ الدَّيْنِ، وَغَلَبَةِ الرِّجَالِ، ‘হে আল্লাহ! আমি দুশ্চিন্তা ও পেরেশানী থেকে, অক্ষমতা ও অলসতা থেকে, কৃপণতা ও ভীরুতা থেকে, ঋণের বোঝা ও লোকজনের প্রাধান্য থেকে আপনার নিকট পানাহ চাচ্ছি’।[9]

যারা আল্লাহকে ভয় করে তারা যে কোন মূল্যে হক গ্রহণে তৎপর হয়। পক্ষান্তরে যারা আল্লাহকে ভয় করে না, তারা হক গ্রহণ করতে পারে না।

[ক্রমশঃ]


[1]. মুসলিম হা/৯১; আবূদাঊদ হা/৪০৯২; মিশকাত হা/৫১০৮।

[2]. মুসলিম হা/১৮৪৮; নাসাঈ হা/৪১১৪; ইবনু মাজাহ হা/৩৯৪৮; ছহীহাহ হা/৪৩৩, ৯৮৩।

[3]. বুখারী হা/৬১১৫, ৩২৮২; মিশকাত হা/২৪১৮।

[4]. আবূদাঊদ হা/৪৮৩৩; তিরমিযী হা/২৩৭৮; মিশকাত হা/৫০১৯; ছহীহাহ হা/৯২৭।

[5]. বুখারী হা/৫৫৩৪, ২১০১; মুসলিম হা/২৬২৮; মিশকাত হা/৫০১০।

[6]. বুখারী হা/৭, ৪৫৫৩; মুসলিম হা/১৭৭৩; মিশকাত হা/৫৮৬১।

[7]. বুখারী হা/১৩৬০; মুসলিম হা/২৪।

[8]. মুসলিম হা/২৬৬৪; ইবনু মাজাহ হা/৭৯; মিশকাত হা/৫২৯৮।

[9]. বুখারী হা/২৮৯৩, ৫৪২৫; আবূ দাউদ হা/১৫৫৫।






মানুষের সাথে আচার-ব্যবহারের আদব সমূহ - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
সমাজ সংস্কারে আত-তাহরীক-এর ফৎওয়া সমূহের ভূমিকা - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
আদর্শ পরিবার গঠনে করণীয় (২য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
চিন্তার ইবাদত (৪র্থ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
লায়লাতুল ক্বদর : ফযীলত ও করণীয় - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধের বিধান (শেষ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত পরিচিতি (৬ষ্ঠ কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
আশূরায়ে মুহাররম - আত-তাহরীক ডেস্ক
সার্ভকোয়াল মডেলের আলোকে শিক্ষা পরিষেবার গুণমান নির্ণয় - প্রফেসর ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া
জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছালাত - মুযাফফর বিন মুহসিন
আহলেহাদীছ জামা‘আতের বিরুদ্ধে কতিপয় মিথ্যা অপবাদ পর্যালোচনা (২য় কিস্তি) - তানযীলুর রহমান - শিক্ষক, বাউটিয়া দাখিল মাদ্রাসা, রাজশাহী
তওবা (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
আরও
আরও
.