পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ । পর্ব ৬ । পর্ব ৭ । শেষ পর্ব ।
দুনিয়া সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ)-এর বাণী :
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রিয় হাবীব মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে ওহীর বার্তাসহ প্রেরণ করেছেন। তিনি আসমানী জ্ঞানের বাইরে কোনকিছুই বলতেন না (নাজম ৫৩/৩-৪)। দুনিয়াসক্ত মানুষগুলোকে আখেরাতমুখী করাই ছিল তাঁর দিন-রাতের সাধনা। যারা দুনিয়া অর্জনে ব্যতিব্যস্ত, দুনিয়ার ভোগ-বিলাসে মুহ্যমান তিনি তাদেরকে উপদেশ-নছীহত ও শাসন দ্বারা এবং নানাবিধ উপমা উপস্থাপেনের মাধ্যমে আখেরাতের চিরন্তন পথে নিয়ে আসার প্রাণান্ত চেষ্টা করেছেন। তিনি আক্ষেপ করে বলেছেন, وَالَّذِى نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لَوْ تَعْلَمُونَ مَا أَعْلَمُ لَبَكَيْتُمْ كَثِيرًا، وَلَضَحِكْتُمْ قَلِيلاً، ‘ঐ মহান সত্তার কসম, যাঁর হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ! আমি যা জানি তোমরা যদি তা জানতে, তাহ’লে তোমরা অবশ্যই অধিক কাঁদতে আর অল্প হাসতে’।[1] বাস্তবিকই এলাহী জ্ঞানের পরশে তিনি দু’জাহানের অনেক অজানা তথ্য জানতেন। জানতেন দুনিয়ার এই ক্ষণিক জীবন সম্পর্কে। আর সে আলোকেই তিনি সতর্ক করেছেন উম্মাহকে। নিম্নে দুনিয়া সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ)-এর বাণীচিত্র তুলে ধরা হ’ল।-
দুনিয়া মুসাফিরখানা বা পথচারীদের বিশ্রামাগার :
দুনিয়া স্থায়ী বসবাসের জায়গা নয়। এটি মুসাফিরখানা সদৃশ। যেখানে মুসাফিররা আসবে যাবে, কিন্তু কেউ স্থায়ীভাবে থাকবে না। অথবা পথচারীদের জন্য ক্লান্তিদূরকারী সাময়িক বিশ্রামের জায়গা মাত্র। বিশ্রাম শেষে তারা আপন গন্তব্যে ছুটে যাবে। এ মর্মে নিম্নোক্ত হাদীছ প্রণিধানযোগ্য।-
‘আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) একদা আমার কাঁধ ধরলেন, অতঃপর বললেন, كُنْ فِى الدُّنْيَا كَأَنَّكَ غَرِيبٌ، أَوْ عَابِرُ سَبِيلٍ (হে আব্দুল্লাহ!) তুমি দুনিয়াতে একজন মুসাফির অথবা একজন পথযাত্রীর মত অবস্থান করবে। (এই উপদেশ শ্রবণের পর থেকে) ইবনু ওমর (রাঃ) বলতেন, তুমি সন্ধ্যায় উপনীত হ’লে সকালের অপেক্ষা কর না (অর্থাৎ সকাল পর্যন্ত বেঁচে থাকার আশা কর না) এবং সকালে উপনীত হ’লে সন্ধ্যার অপেক্ষা কর না। তোমার সুস্থতা থেকে তোমার অসুস্থ অবস্থার জন্য পাথেয় সঞ্চয় কর এবং জীবিত অবস্থা থেকে তোমার মৃত্যুর জন্য পাথেয় সঞ্চয় কর’।[2] মুসাফির বা পথযাত্রী যেমন কোন জায়গায় স্থায়ী হয় না, সামান্য বিশ্রাম নিয়ে গন্তব্যপানে ছুটে চলে, ঠিক তেমনি দুনিয়ার এই বিশ্রামাগারেও আমরা কিছুসময়ের জন্য অবস্থানের পর আমাদের আসল গন্তব্য আখেরাতে ফিরে যাব। এটাই মহান স্রষ্টার সৃষ্টিবিধি।
অন্য বর্ণনায় মুজাহিদ থেকে বর্ণিত, ইবনে ওমর বলেন,أَخَذَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم بِبَعْضِ جَسَدِى فَقَالَ يَا عَبْدَ اللَّهِ كُنْ فِى الدُّنْيَا كَأَنَّكَ غَرِيبٌ أَوْ كَأَنَّكَ عَابِرُ سَبِيلٍ وَعُدَّ نَفْسَكَ مِنْ أَهْلِ الْقُبُورِ- ‘রাসূল (ছাঃ) আমার শরীরের কোন অংশ ধরে বললেন, দুনিয়াতে এমনভাবে বসবাস করবে যেন তুমি একজন মুসাফির অথবা পথযাত্রী। আর নিজেকে তুমি কবরবাসীদের মধ্যে গণ্য করবে’।[3] অর্থাৎ তুমি মূলতঃ কবরের বাসিন্দা। দুনিয়াতে তোমাকে পাঠানো হয়েছে সাময়িক সময়ের জন্য। এখন তুমি ভূপৃষ্ঠে আছ, নির্ধারিত সময়ের পরে তোমাকে ভূগর্ভে চলে যেতে হবে। এখন তুমি মানুষ, রূহ বের হয়ে গেলে তুমি হয়ে যাবে ‘লাশ’। তখন তোমাকে আর কেউ নাম ধরে ডাকবে না বা মানুষ বলেও পরিচয় দিবে না। তখন তোমার একটাই পরিচয় হবে ‘লাশ’।
রাসূল (ছাঃ) একদিন একটি খালি চাটাইয়ের উপর ঘুমিয়ে ছিলেন। ঘুম থেকে উঠলে দেখা গেল তাঁর শরীরে চাটাইয়ের দাগ লেগে গেছে। আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) এ দৃশ্য দেখে রাসূল (ছাঃ) সমীপে আরয করলেন, يَا رَسُولَ اللَّهِ لَوِ اتَّخَذْنَا لَكَ وِطَاءً فَقَالَ مَا لِي وَلِلدُّنْيَا، مَا أَنَا فِي الدُّنْيَا إِلَّا كَرَاكِبٍ اسْتَظَلَّ تَحْتَ شَجَرَةٍ ثُمَّ رَاحَ وَتَرَكَهَا- ‘হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! যদি আপনি আমাদেরকে নির্দেশ দিতেন তবে আমরা আপনার জন্য একখানা বিছানা তৈরি করে বিছিয়ে দিতাম। (এ কথা শুনে) রাসূল (ছাঃ) বললেন, দুনিয়ার সাথে আমার কি সম্পর্ক? বস্ত্ততঃ আমার ও দুনিয়ার দৃষ্টান্ত তো হ’ল একজন ঐ আরোহীর ন্যায়, যে একটি গাছের ছায়ায় কিছু সময়ের জন্য বিশ্রাম নেয়, অতঃপর গাছটিকে ছেড়ে চলে যায়’।[4] অন্য বর্ণনায় আছে-مَا مَثَلِى وَمَثَلُ الدُّنْيَا إِلاَّ كَرَاكِبٍ سَارَ فِى يَوْمٍ صَائِفٍ فَاسْتَظَلَّ تَحْتَ شَجَرَةٍ سَاعَةً مِنْ نَهَارٍ ثُمَّ رَاحَ وَتَرَكَهَا، ‘আমার ও দুনিয়ার উদাহরণ হ’ল- কোন মুসাফির গরমের দিনে চলতে চলতে কোন একটি বৃক্ষের ছায়াতলে দিনের কিছু সময় বিশ্রাম নিল, তারপর তা ছেড়ে চলে গেল’। [5]
দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি আল্লাহর ভালবাসা লাভের মাধ্যম:
দুনিয়ার মোহে পড়ে মানুষ আল্লাহকে ভুলে যায়। আল্লাহর ক্ষমা ও ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হয়। শরী‘আতের সীমা-পরিসীমার কোন তোয়াক্কা করে না। দুনিয়াকেই যেন সে চিরস্থায়ী বসবাসের জায়গা মনে করে নেয়। অথচ এই দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তির মাধ্যমেই সম্ভব আল্লাহর ভালবাসা লাভ। এ প্রসঙ্গটিই বিধৃত হয়েছে নিম্নোক্ত হাদীছে।-
وَعَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ قَالَ جَاءَ رَجُلٌ إِلَى اَلنَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ يَا رَسُولَ اَللَّهِ! دُلَّنِي عَلَى عَمَلٍ إِذَا عَمِلْتُهُ أَحَبَّنِي اَللَّهُ وَأَحَبَّنِي اَلنَّاسُ قَالَ اِزْهَدْ فِي اَلدُّنْيَا يُحِبُّكَ اَللَّهُ وَازْهَدْ فِيمَا عِنْدَ اَلنَّاسِ يُحِبُّكَ اَلنَّاسُ-
‘সাহল ইবনু সা‘দ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকটে উপস্থিত হয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমাকে এমন একটি কাজের কথা বলুন, যা করলে আল্লাহ আমাকে ভালোবাসবেন এবং লোকেরাও আমাকে ভালোবাসবে। রাসূল (ছাঃ) বললেন, তুমি দুনিয়ার প্রতি অনাসক্ত হও, তাহ’লে আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসবেন। আর মানুষের নিকট যা আছে, তার প্রতি অনাসক্ত হও, তাহ’লে মানুষও তোমাকে ভালোবাসবে’।[6] আলোচ্য হাদীছ থেকে সুস্পষ্ট হয় যে, যারা দুনিয়ালোভী বা যারা ধর্ম-কর্ম বাদ দিয়ে কেবল দুনিয়া নিয়েই ব্যস্ত থাকে, তারা আল্লাহর ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হবে।
দুনিয়া আকর্ষণীয় বস্ত্ত :
দুনিয়ার প্রতি আকর্ষণ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। গাছ-পালা, নদী-নালা, পাহাড়-পর্বত, নদী-সাগর, ফল-ফসল, স্বর্ণ-রৌপ্যসহ ভূগর্ভস্থ রাশি রাশি সম্পদ, নারী-পুরুষের অটুট বন্ধন, পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, ধন-সম্পদ সবকিছুই আল্লাহ তা‘আলার নে‘মত ও দুনিয়ার আকর্ষণীয় বস্ত্ত। যা তিনি দিয়েছেন বান্দাকে পরীক্ষা করার জন্য। আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেন,إِنَّ الدُّنْيَا حُلْوَةٌ خَضِرَةٌ وَإِنَّ اللهَ مُسْتَخْلِفُكُمْ فِيهَا فَيَنْظُرُ كَيْفَ تَعْمَلُونَ فَاتَّقُوا الدُّنْيَا وَاتَّقُوا النِّسَاءَ فَإِنَّ أَوَّلَ فِتْنَةِ بَنِى إِسْرَائِيلَ كَانَتْ فِى النِّسَاءِ ‘নিশ্চয়ই দুনিয়া সুমিষ্ট শ্যামল-সবুজ। আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের এখানে প্রতিনিধি করে প্রেরণ করেছেন এজন্য যে, তিনি দেখতে চান, তোমরা কেমন আমল কর? অতএব তোমরা দুনিয়া ও নারী জাতি থেকে সাবধান থেক। কেননা বণী ইসরাঈলদের মধ্যে যে প্রথম ফিতনা দেখা দিয়েছিল তা ছিল নারীকে কেন্দ্র করে’। [7]
আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে অপর বর্ণনায় আছে, রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنِّى مِمَّا أَخَافُ عَلَيْكُمْ مِنْ بَعْدِى مَا يُفْتَحُ عَلَيْكُمْ مِنْ زَهْرَةِ الدُّنْيَا وَزِينَتِهَا، ‘আমার পরে তোমাদের ব্যাপারে আমি যা আশংকা করছি তা হ’ল এইযে দুনিয়ার চাকচিক্য ও সেŠন্দর্য (ধন-সম্পদ) তোমাদের সামনে খুলে দেওয়া হবে’।[8]
আমর ইবনু আউফ আনছারী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) আবূ উবায়দা ইবনুল জাররাহ (রাঃ)-কে বাহরাইনে জিযিয়া আদায় করার জন্য পাঠালেন।..আবূ উবায়দা (রাঃ) যখন বাহরাইন থেকে অর্থ-সম্পদ নিয়ে ফিরলেন তখন আনছারগণ আবূ উবায়দার আগমনের সংবাদ শুনে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে ফজরের ছালাতে উপস্থিত হ’লেন। রাসূল (ছাঃ) তাদের নিয়ে ফজরের ছালাত আদায় করলেন। অতঃপর ছালাত শেষে হেসে বললেন, আমার মনে হয় তোমরা শুনেছ, আবূ উবায়দা কিছু নিয়ে এসেছেন। তারা বলল, হ্যঁা, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)। তিনি বললেন, সুসংবাদ গ্রহণ কর এবং যা তোমাদেরকে খুশী করে তা আশা রাখ। অতঃপর তিনি বললেন,فَوَاللَّهِ لاَ الْفَقْرَ أَخْشَى عَلَيْكُمْ، وَلَكِنْ أَخْشَى عَلَيْكُمْ أَنْ تُبْسَطَ عَلَيْكُمُ الدُّنْيَا كَمَا بُسِطَتْ عَلَى مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ ، فَتَنَافَسُوهَا كَمَا تَنَافَسُوهَا وَتُهْلِكَكُمْ كَمَا أَهْلَكَتْهُمْ، ‘আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের ব্যাপারে দারিদ্রের আশঙ্কা করি না। কিন্তু তোমাদের ব্যাপারে এ আশঙ্কা করি যে, তোমাদের উপর দুনিয়া এমনভাবে প্রসারিত হবে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর প্রসারিত হয়েছিল। আর তোমরাও দুনিয়ার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়বে, যেমন তারা আকৃষ্ট হয়েছিল। আর তা তোমাদের ধ্বংস করবে, যেমন তাদের ধ্বংস করেছে’।[9]
দুনিয়া মূল্যহীন :
সাহল ইবন সা‘দ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেন,لَوْ كَانَتِ الدُّنْيَا تَعْدِلُ عِنْدَ اللهِ جَنَاحَ بَعُوضَةٍ مَا سَقَى كَافِرًا مِنْهَا شَرْبَةَ مَاءٍ ». ‘যদি আল্লাহর নিকটে এই দুনিয়ার মূল্য একটি মাছির ডানার সমানও হ’ত তবে তিনি এ থেকে কোন কাফিরকে এক ঢোক পানিও পান করতে দিতেন না’।[10] উক্ত হাদীছের সারমর্ম হ’ল এই যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার নিকট দুনিয়ার মূল্য অতি নগণ্য। সামান্য মাছির ডানা পরিমাণও নয়। অর্থাৎ শতাংশের হিসাবে শূন্যেরও নীচে। এজন্য দুনিয়াতে মুমিন মুশরিক সবাই আহার পায় এবং সমানভাবে বিচরণ করতে পারে। পক্ষান্তরে এর মূল্য যদি আল্লাহর কাছে সরিষার দানা পরিমাণও থাকত তবে আল্লাহর অনুগ্রহ শুধু মুমিনরাই ভোগ করত ।[11]
জাবির বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,مَرَّ بِالسُّوقِ دَاخِلاً مِنْ بَعْضِ الْعَالِيَةِ وَالنَّاسُ كَنَفَتَهُ فَمَرَّ بِجَدْىٍ أَسَكَّ مَيِّتٍ فَتَنَاوَلَهُ فَأَخَذَ بِأُذُنِهِ ثُمَّ قَالَ أَيُّكُمْ يُحِبُّ أَنَّ هَذَا لَهُ بِدِرْهَمٍ فَقَالُوا مَا نُحِبُّ أَنَّهُ لَنَا بِشَىْءٍ وَمَا نَصْنَعُ بِهِ قَالَ أَتُحِبُّونَ أَنَّهُ لَكُمْ قَالُوا وَاللهِ لَوْ كَانَ حَيًّا كَانَ عَيْبًا فِيهِ لأَنَّهُ أَسَكُّ فَكَيْفَ وَهُوَ مَيِّتٌ فَقَالَ فَوَاللهِ لَلدُّنْيَا أَهْوَنُ عَلَى اللهِ مِنْ هَذَا عَلَيْكُمْ، ‘একদা রাসূল (ছাঃ) কোন এক এলাকা থেকে মদীনায় আসার পথে এক বাজার অতিক্রম করছিলেন। এ সময় তাঁর উভয় পার্শ্বে বেশ লোকজন ছিল। তিনি কান কাটা বা ক্ষুদ্র কান বিশিষ্ট একটি মৃত বকরীর বাচ্চার নিকট পেঁŠছলেন। অতঃপর তিনি এর কান ধরে বললেন, তোমাদের কেউ কি এটিকে এক দিরহামের বিনিময়ে নিতে আগ্রহী? উপস্থিত লোকেরা বলল, কোন কিছুর বিনিময়ে আমরা এটি নিতে আগ্রহী নই এবং এটি নিয়ে আমরা কি করব? তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, (কোন কিছুর বিনিময় ছাড়া এমনিতেই) তোমরা কি এটি নিতে আগ্রহী? তারা বলল, এটি যদি জীবিত থাকত তবুও তো এটি ত্রুটিযুক্ত। কেননা এর কান সরু বা কাটা। আর এখন তো এটি মৃত, কিভাবে আমরা তা গ্রহণ করব? এরপর তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! এটি (ক্ষুদ্র কান বিশিষ্ট এই মৃত ছাগলটি) তোমাদের নিকট যতটা তুচ্ছ বা মূল্যহীন, আল্লাহর নিকটে দুনিয়া এর চেয়েও অধিক তুচ্ছ ও মূল্যহীন’।[12]
এ হাদীছ দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল মানুষকে দুনিয়া থেকে নিরুৎসাহিত করা ও পরকালের প্রতি উৎসাহিত করা। কেননা দুনিয়ার প্রতি মুহাববতই হ’ল সকল অন্যায়-অপরাধের মূল। যেমনটি ইমাম বায়হাক্বী (রহ.) হাসান বছরী থেকে মুরসাল সূত্রে বর্ণনা করেছেন। পক্ষান্তরে দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি হ’ল ইবাদতের মূল। কেননা দুনিয়ার প্রতি আসক্ত ব্যক্তি যদিও দ্বীনের কাজে ব্যস্ত থাকে। তবুও অনেক সময় তা দুনিয়া অর্জনের উদ্দেশ্যে সম্পাদন করে। এতে তার ভাল কাজও বিফল হয়ে যায়। অপরদিকে দুনিয়ার প্রতি অনাসক্ত ব্যক্তি যদিও দুনিয়ার বিষয়ে ব্যস্ত থাকে তথাপি সেখানে তার উদ্দেশ্য থাকে পরকালের কল্যাণ লাভ। এজন্যই জনৈক মনীষী বলেছেন,من أحب الدنيا لم يقدر على هداية جميع المرشدين، ومن ترك الدنيا لم يقدر على ضلالته جميع الفاسدين، ‘দুনিয়ার প্রতি আসক্ত ব্যক্তিকে কোন পথপ্রদর্শকই পথ দেখাতে পারে না। আর দুনিয়ার প্রতি অনাসক্ত ব্যক্তিকে দুনিয়ার সকল পথভ্রষ্টের প্রচেষ্টাও পথহারা করতে পারে না।[13]
দুনিয়াসক্ত লোভী মানুষদের সতর্ক করে রাসূল (ছাঃ) বলেন, تَعِسَ عَبْدُ الدِّينَارِ وَالدِّرْهَمِ وَالْقَطِيفَةِ وَالْخَمِيصَةِ، إِنْ أُعْطِىَ رَضِىَ، وَإِنْ لَمْ يُعْطَ لَمْ يَرْضَ، ‘ধ্বংস হোক দীনারের গোলাম, দিরহামের গোলাম ও উত্তম পোষাকের গোলাম (দুনিয়াদার)! যদি তাকে দেওয়া হয়, তাহ’লে সে সন্তুষ্ট হয়। আর না দেওয়া হ’লে অসন্তুষ্ট হয়’।[14] অন্য বর্ণনায় আছে, রাসূল (ছাঃ) বলেন, ..تَعِسَ وَانْتَكَسَ، وَإِذَا شِيكَ فَلاَ انْتَقَشَ ، طُوبَى لِعَبْدٍ آخِذٍ بِعِنَانِ فَرَسِهِ فِى سَبِيلِ اللهِ، أَشْعَثَ رَأْسُهُ مُغْبَرَّةٍ قَدَمَاهُ، إِنْ كَانَ فِى الْحِرَاسَةِ كَانَ فِى الْحِرَاسَةِ ، وَإِنْ كَانَ فِى السَّاقَةِ كَانَ فِى السَّاقَةِ، إِنِ اسْتَأْذَنَ لَمْ يُؤْذَنْ لَهُ، وَإِنْ شَفَعَ لَمْ يُشَفَّعْ ‘..এরা লাঞ্ছিত হোক, অপমানিত হোক। (তাদের পায়ে) কাঁটা বিদ্ধ হ’লে কেউ তা তুলে দিবে না। ঐ ব্যক্তির জন্য সুসংবাদ, যে ঘোড়ার লাগাম ধরে জিহাদের জন্য প্রস্তুত রয়েছে, যার মাথার চুল এলোমেলো এবং পা ধূলিধূসরিত। তাকে পাহারায় নিয়োজিত করলে পাহারায় থাকে আর (সৈন্য দলের) পেছনে রাখলে পেছনেই থাকে। সে কারো সাক্ষাতের অনুমতি চাইলে তাকে অনুমতি দেয়া হয় না এবং কোন বিষয়ে সুফারিশ করলে তার সুফারিশ গ্রহণ করা হয় না’।[15]
আলোচ্য হাদীছে দুনিয়াদার ও দ্বীনদার মানুষের পার্থক্য ফুটে উঠেছে। দুনিয়াদারের বৈশিষ্ট্য হ’ল আরো চাই, আরো চাই। কোন কিছুতেই তার পেট ভরে না। মাল পেলে খুশী, না পেলে বেজার। ঘুষখোর কর্মকর্তা/কর্মচারীদের দিকে তাকালে এর বাস্তবতা পাওয়া যায়। সুদর্শন চেহারা, মুখে সুন্নাতী দাড়ি, মাথায় টুপি দিয়ে ঘুষ খেতেও এরা কোন দ্বিধা করে না। জনৈক ঘুষখোর অফিসারের বিবরণ শুনে তো রীতিমত হতবাক। ওযূ করে ছালাতের জন্য প্রস্ত্তত হয়েছেন, এমন সময় ঘুষের ব্যাগ নিয়ে হাযির মক্কেল। ছালাতের প্রস্ত্ততি দেখে মক্কেলই বরং বললেন, নামায পড়ে আসেন তারপর দিচ্ছি। কিন্তু লোভী অফিসার থামলেন না, বললেন, এখনই দেন। এরপর ঘুষের ষোলআনা বুঝে নিয়ে ছালাতে গেলেন। ঘটনাটি ভুক্তভোগী এক ভাইয়ের নিকটে শুনা। ঘটনা সঠিক হ’লে আমাদের ঈমানের দীনতা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে চিন্তার বিষয়। তবে রূঢ় বাস্তবতা হচ্ছে বর্তমানে দেশে ঘুষ বিহীন কর্মোদ্ধারই যেন মিরাকল। অপরদিকে দ্বীনদারগণ কখনো দুনিয়ার প্রতি লোভ করেন না। তারা সর্বস্ব খুইয়ে হ’লেও আখেরাতকে অগ্রাধিকার দেন। ঈমান ও সততার উপর টিকে থাকেন আজীবন। অল্পতেই তুষ্ট থাকেন। তাদের হয়তো দুনিয়াবী শান-শওকত নেই, কিন্তু আছে অমূল্য সম্পদ ঈমান ও আমল। তারা আখেরাতের চিরন্তন পুরস্কারের প্রত্যাশী। আলালহ আমাদেরকে আখরাতের জন্য কাজ করার তাওফীক দান করুন-আমীন!
[ক্রমশঃ]
[1]. বুখারী হা/৬৬৩৭; মিশকাত; ৫৩৩৯।
[2]. বুখারী হা/৬৪১৬, মিশকাত হা/১৬০৪ ।
[3]. তিরমিযী হা/২৫০৩; ইবনু মাজাহ হা/৪২৫৩।
[4]. তিরমিযী হা/২৩৭৭, মিশকাত হা/৫১৮৮, সিলসিলা ছহীহাহ হা/৪৩৮।
[5]. আহমাদ হা/২৭৯৬।
[6]. তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৫১৮৭; রিয়ায হা/৪৭৬; ছহীহুত তারগীব ওয়াত তারহীব হা/৩২১৩ সনদ হাসান, ছহীহাহ হা/৯৪৪।
[7]. মুসলিম হা/২৭৪২; মিশকাত হা/৩০৮৬ ‘বিবাহ’ অধ্যায়।
[8]. বুখারী হা/১৪৬৫; মুসলিম হা/১০৫২; মিশকাত হা/৫১৬২।
[9]. বুখারী হা/৩১৫৮,৪০১৫,৬৪২৫; মিশকাত হা/৫১৬৩ ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায়।
[10]. তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৫১৭৭, সনদ ছহীহ; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৯৪৩, ৯৪৬।
[11]. তুহফাতুল আহওয়াযী হা/২৩২০ এর ব্যাখ্যা দ্রঃ।
[12]. মুসলিম হা/২৯৫৭ ‘যুহুদ ও রিক্বাক্ব’ অধ্যায়; মিশকাত হা/৫১৫৭।
[13]. মিরক্বাতুল মাফাতীহ (ভারত, দেওবন্দ: মাকতাবাতুল আশরাফিইয়াহ, তাবি), ৯ম খন্ড, পৃ: ৩৫১, হা/৫১৫৭-এর ব্যাখ্যা দ্রঃ।
[14]. বুখারী হা/২৮৮৬, ৬৪৩৫;, মিশকাত হা/৫১৬১।
[15]. বুখারী হা/২৮৮৭।