পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ । পর্ব ৬ । শেষ পর্ব 

[২০০৫ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারী থেকে ২০০৬ সালের ৮ই জুলাই। ১ বছর ৪ মাস ১৪ দিন]

আব্দুল মজীদের সাথে নওগাঁ কারাগারে আরো একজন ফাঁসির আসামী ছিল; নাম হামীদুল ইসলাম। সে তার ৮/১০ বছর বয়সী সৎ ভাইকে হত্যার অপরাধে ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত। হামীদুলের জ্ঞান-গরিমাও আব্দুল মজীদের মত। কারাগারে এসে কোন রকমে কুরআন মাজীদ পড়া শিখেছে। আব্দুল মজীদ এবং হামীদুলের ফাঁসির দন্ড ছাড়াও মামলা ছিল। কোন ফাঁসির আসামীকে সাধারণত জেলা কারাগারে না রেখে কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। যেহেতু তাদের আরো মামলা ছিল, সে কারণে তাদেরকে নওগাঁয় রাখা হয়েছিল। অনেকে আপন জনের সাথে নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ করার সুবিধার্থে জেলা কারাগারে থাকার কৌশল হিসাবে ইচ্ছা করেই নিজে থেকে যেকোন মামলা দিয়ে রাখে।

আব্দুল জববার বিহারীর ক্রন্দন :

নওগাঁ জেলখানায় চৌকাতে কাজ করত আব্দুল জববার বিহারী। সাত বছর বয়সে অভাবের তাড়নায় বিহার প্রদেশ থেকে নদী পথে নৌকায় ভাসতে ভাসতে এসে নওগাঁ যেলার আত্রাই রেল ষ্টেশনে আশ্রয় নিয়েছিল। ধান উৎপাদনের এলাকা। মাঠে ধান কুড়িয়ে তা দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করত সে। এভাবেই সে  ধীরে ধীরে বড় হয়। সে মসজিদে ছালাত আদায় করতে যায়। একদা এলাকার একজন প্রভাবশালী ধনী পরিবারের লোকের নযরে পড়ে যায়। তিনি তাকে বাড়ীতে নিয়ে যান। সেখানেই সে প্রতিপালিত হয়। তার মুখে কিছু কথা শুনা যাক-

প্রশ্ন : আপনি আহলেহাদীছ হ’লেন কিভাবে?

উত্তর : আমি তো জন্ম থেকেই আহলেহাদীছ। ভারতের বিহার রাজ্যের কলমিতলা আমার জন্মস্থান। আববা বড় মসজিদের ইমাম। একবার যারা আমীন বলে না, তাদের সাথে আববার বাহাছ হ’ল। প্রতিপক্ষের বড় বড় হুযূর বিরাট পাগড়ী-জুববা পরে মহিষের গাড়ী বোঝাই করে কিতাব নিয়ে হাযির হ’লেন। আববা তাদের সামনে ছোট্ট একটি ব্যাগে মাত্র তিনটি বই নিয়ে হাযির হ’লেন। বাহাছ আরম্ভ হ’ল। বিচারক ছিলেন হিন্দু জজ। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, আপনাদের ধর্মের নাম কি? জবাব আসল, ইসলাম। জজ: আপনাদের ধর্মীয় কিতাব কি কি? উত্তর : পবিত্র কুরআন ও হাদীছ। জজ : আচ্ছা আপনাদের ধর্মীয় গ্রন্থ কুরআন ও হাদীছগুলি ইংরেজীতে নাম লিখে আমার কাছে জমা দিন। আমার আববা লিখলেন, (১) দি হলি কুরআন (২) দি হাদীছ বুখারী শরীফ (৩) দি হাদীছ মুসলিম শরীফ।

প্রতিপক্ষ জমা দিল : (১) দি হেদায়া (২) দি শরহে বেকায়া (৩) দি কুদূরী (৪) দি বেহেশতী জেওর ইত্যাদি।

জজ : আপনাদের ধর্মীয় কিতাব জমা দিন। উত্তর : স্যার এইগুলিই তো ধর্মীয় কিতাব। জজ : আপনারা কিছুক্ষণ আগেই বললেন, ধর্মীয় কিতাবের নাম কুরআন ও হাদীছ। এসব তো বলেননি। কুরআন ও হাদীছ জমা দিন। উত্তর স্যার এগুলিতো কুরআন ও হাদীছের ব্যাখ্যা গ্রন্থ। জজ : আমি তো ব্যাখ্যা চাইনি, আমি মূল কিতাব চেয়েছি।

অতঃপর আববার দিকে তাকিয়ে জজ ছাহেব বললেন, আচ্ছা মওলানা ছাহেব! আপনি আপনার মূল কিতাব কুরআন শরীফ থেকে আমীন বলা দেখান। সঙ্গে সঙ্গে কুরআন শরীফ হাতে নিয়ে সূরা ফাতেহা বের করে দেখালেন যে তার শেষে আমীন লেখা আছে এবং উচ্চৈঃস্বরে পাঠ করতে হবে তা দেখালেন বুখারী ও মুসলিম থেকে। জজ ছাহেব আববার পক্ষে রায় দিয়ে নিরাপত্তা প্রহরী দিয়ে আববাকে মসজিদে পৌঁছে দিলেন। তখন ঐ পাগড়ীধারী হুযূরগণ আববার উপরে ক্ষিপ্ত হ’ল। কিছু দিন পর কৌশলে আববাকে দাওয়াত দিয়ে রসগোল্লার মধ্যে বিষ প্রয়োগ করে তারা আববাকে মেরে ফেলল।

প্রশ্ন : আপনি ড. গালিব স্যারকে চিনলেন কিভাবে?

উত্তর : জেলখানায় আসার আগে তাঁর সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়নি। তবে তাঁর নামের সাথে পরিচিত ১৯৯৮ সাল থেকে। এক শুক্রবারে আমি নলডাঙ্গা হাটের মসজিদে জুম‘আর ছালাত আদায় করে বসে তাসবীহ-তাহলীল করছি। এমন সময় ইমামের সাথে মুছল্লীদের কিছুটা বাক-বিতন্ডা শুনে এগিয়ে গেলাম। দেখি ছালাতুর রাসূল (ছাঃ) নামক একটি বই হাতে নিয়ে ইমাম ছাহেব উচ্চৈঃস্বরে বলছেন, দেখুন এই বইটা কোন আজেবাজে লেখকের লেখা নয়। লেখক একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর। তিনি আহলেহাদীছদের আমীর। এতদিন আমাদের আমীর ছিল না। এখন আমাদের আমীর হয়েছেন। সুতরাং তাঁর কথা শুনতে হবে এবং মানতে হবে। এই বইয়ের নির্দেশ মোতাবেক আমি মোনাজাত করিনি। আমার ইমামতি থাক বা যাক আমি হাদীছের বিপরীত আমল করতে পারব না। ইমাম ছাহেবের দৃঢ় মনোবল দেখে মনে হ’ল তার পিছনে শক্ত খুঁটি আছে। লোকজন চলে যাওয়ার পরে আমি ইমাম ছাহেবের কাছে গিয়ে বইটি হাতে নিয়ে দেখি বইটি ড. আসাদুল্লাহ আল-গালিবের লেখা। তাঁর একটি সংগঠন আছে, যার নাম ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’। শাখারীপাড়ার মুযযাম্মেল মাওলানা তার সভাপতি ইত্যাদি শুনে গালিব স্যারের সাথে দেখা করার আগ্রহ হ’ল। পরের বাড়ী কাজ করার কারণে সময় হয়নি। তবে মনে বাসনা ছিল প্রবল। তাই জেলখানায় তাঁর খেদমত করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছিলাম। কিন্তু আজ তিনি চলে গেলে সেই নেকী থেকে বঞ্চিত হব। তাই সহ্য করতে না পেরে কাঁদছি। শুনেছি তিনি নাকি বই লিখে বিক্রি করে তার দাম নেন না। সভা করে, ওয়ায করে টাকা নেন না। ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তিনি নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের সামনে পাঁচ তলা বিল্ডিং করে হাদীছ ফাউন্ডেশন নাম দিয়ে এক বিরাট ছাপাখানা তৈরী করেছেন। সেখান থেকে শিরক ও বিদ‘আতের বিরুদ্ধে বিভিন্ন বই-পত্রিকা প্রকাশিত হয়।

ড. গালিব স্যার রাজশাহীর নওদাপাড়াতে এক মাদরাসা করেছেন। সেখানে লেখা-পড়া শিখে বড় আলেম হওয়া যায়। ছাত্ররা ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী আমল করে। সেখানে একটি বড় ইয়াতীমখানাও আছে। ঐ মাদরাসায় লেখাপড়া শিখে ছাত্ররা বড় আলেম হ’তে মদীনায় যায়। এত বড় গুণী ব্যক্তির সাথে জেলখানায় আমার সাক্ষাৎ! এটা আমার জন্য বড় সৌভাগ্যের বিষয়। আজ থেকে তা হারিয়ে ফেললাম। তাঁর সাথে বসে মনের কথাগুলি বলার সময়ও হ’ল না। যাওয়ার সময় দো‘আ চাইব, কিন্তু মনের ব্যথায় মুখে কথা বের হচ্ছিল না। এই বলে আকাশের দিকে দুই হাত তুলে কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, হে আল্লাহ! তাঁকে মুক্তি দাও! তাঁর মান-সম্মান বৃদ্ধি কর, তাঁকে হেফাযত কর।

১৭ই আগষ্ট দেশব্যাপী বোমা হামলা :

১৭ই আগষ্ট সকাল বেলা অন্য দিনের মত লকাপ খুললে আমরা ব্যায়াম ও গোসল শেষ করে নাশতা খাচ্ছি, এমন সময় পাগলা ঘণ্টা বেজে উঠল। সেল তালাবদ্ধ করে দেওয়া হ’ল। কিছুক্ষণ পর সুবেদার এসে বললেন, সর্বনাশ হয়ে গেছে। গোটা দেশে ৬৩টি যেলায় এক সাথে বোমা ফাটিয়েছে। হতাহতের তেমন খবর পাওয়া যায়নি। তবে সারা দেশে আতংক বিরাজ করছে। জেলখানায় পাহারা জোরদার করা হয়েছে। আপনারা বের হবেন না। কখন যে কি হয়? কার ঘাড়ে দোষ যায়, বলা যায় না। বিকালের দিকে সুবেদার ছাহেব একটি লিফলেট হাতে এসে বললেন, ‘জামা‘আতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ’ উক্ত বোমা ফাটানোর দায়িত্ব স্বীকার করেছে এবং ইতিমধ্যে দুই/একটি যেলায় তারা ধরা পড়েছে। তখন জে.এম.বি. শব্দটি ছিল আমাদের কাছে নতুন। আমরা বলাবলি করছিলাম, তারা কোন দল, তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কি? সালাফী ছাহেব বললেন, মুহতারাম আমীরে জামা‘আত আগেই সতর্ক করে দিয়েছেন যে, বাংলাদেশে উগ্র ইসলামপন্থী একটি দল ইসলাম ধ্বংস করার জন্য তৈরী হচ্ছে। তাদের থেকে আপনারা সাবধান থাকুন। বোমা ফাটিয়েছে সেই দল। আমাদের নানা রকম মন্তব্য ও দুশ্চিন্তা করতে করতে দিন কেটে গেল। পরের দিন সকাল বেলা সুবেদার ছাহেব একটি কাগজে নিম্নের কোটেশন লিখে আমাদের শুনিয়ে বললেন, বলুন তো কে লিখেছেন? কোথায় লিখেছেন? ‘জিহাদের অপব্যাখ্যা করে শান্ত একটি দেশে বুলেটের মাধ্যমে রক্ত গংগা বইয়ে রাতারাতি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রঙিন স্বপ্ন দেখানো জিহাদের নামে স্রেফ প্রতারণা বৈ কিছুই নয়। অনুরূপভাবে দ্বীন কায়েমের জন্য জিহাদের প্রস্ত্ততির ধোঁকা দিয়ে রাতের অন্ধকারে কোন নিরাপদ পরিবেশে অস্ত্র চালনা ও বোমা তৈরীর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা জিহাদী জোশে উদ্বুদ্ধ সরলমনা তরুণদের ইসলামের শত্রুদের পাতানো ফাঁদে আটকিয়ে ধ্বংস করার চক্রান্ত মাত্র। আযীযুল্লাহ উচ্চৈঃস্বরে বলে উঠল, আমি পারব, মুহতারাম আমীরে জামা‘আত তাঁর ‘ইক্বামতে দ্বীন : পথ ও পদ্ধতি’ বইয়ে উক্ত কথা লিখেছেন। সুবেদার ছাহেব হেসে বললেন, শাববাশ! আপনি ড. হ’তে পারবেন। আমীরে জামা‘আতের এই লেখনীই আপনাদের মুক্তির পথ সহজ করবে ইনশাআল্লাহ।

আযীযুল্লাহ বলল, আমি আমীরে জামা‘আতের আরো অনেক বক্তৃতার কথা শুনাতে পারি। যেমন তিনি বলেন, ‘বর্তমানে জিহাদের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে কিছু তরুণকে সশস্ত্র যুদ্ধে উস্কে দেওয়া হচ্ছে। বাপ-মা, ঘর-বাড়ী, এমনকি লেখা-পড়া ছেড়ে তারা বনে-জঙ্গলে ঘুরছে। তাদের বুঝানো হচ্ছে ছাহাবীগণ লেখাপড়া না করেই যদি জিহাদের মাধ্যমে জান্নাত পেতে পারেন, তবে আমরাও লেখাপড়া না করে জিহাদের মাধ্যমে জান্নাত লাভ করব। কি চমৎকার ধোঁকাবাজি! ইহুদী-খৃষ্টান ও ব্রাহ্মণ্যবাদী গোষ্ঠী আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে এগিয়ে যাক আর অশিক্ষিত মুসলিম তরুণেরা তাদের বোমার অসহায় খোরাক হউক এটাই কি শত্রুদের উদ্দেশ্য নয়?

সুবেদার ছাহেব বললেন, তাহ’লে আমীরে জামা‘আতের অনুরূপ বক্তব্যগুলি এক জায়গায় করে প্রচার করা আপনাদের কর্তব্য। আমরা বললাম, আমাদের দেখা আসলে পরামর্শ দেব।

একদিন সুবেদার ছাহেব এসে বললেন, আপনারা যে, জি.এম.বি, নন, তার প্রমাণ সরকার পেয়ে গেছে। কারণ গোয়েন্দাদের হাতে একটি চিঠি ধরা পড়েছে তাতে লেখা আছে, ড. গালিবকে যেখানে পাও, সেখানেই বাধা দাও। বাড়াবাড়ি করলে একদম বাঁধ ভেঙ্গে দিও। তিনি আমাদের প্রধান শত্রু’। চিঠিটি লেখা ছিল আরবীতে। সুবেদার ছাহেব বললেন, আমার ধারণা আপনারা অতি দ্রুত ছাড়া পাবেন। আমরা বললাম, আল্লাহ আপনার মুখের কথা কবুল করুন।

জেএমবি আসামী : ১৭ই আগষ্ট ২০০৫ জামা‘আতুল মুজাহিদীন কর্তৃক সারাদেশে একযোগে বোমা হামলায় নওগাঁ যেলাও বাদ পড়েনি। নওগাঁ শহরে আদালত পাড়া, মুক্তির মোড়, বাস স্ট্যান্ডসহ মোট ৫টি পয়েন্টে সেদিন বোমা ফাটানো হয়। তবে সে হামলায় নওগাঁয় কেউ আহত হয়নি। উক্ত হামলার পর নওগাঁ যেলায় প্রথমে মাত্র একটি ছেলে ধরা পড়ে। ছেলেটির নাম আব্দুল কাইয়ূম। বয়স ২০-এর আশেপাশে। গায়ের রং ফর্সা, হালকা পাতলা গড়ন। তেমন মেধাবী মনে হ’ল না। কিন্তু ইবাদত-বন্দেগীতে যাথেষ্ট অগ্রগামী। আমরা রুম থেকে বের হয়ে তার রুমের সামনে আসার সাথে সাথেই সুন্দর করে সালাম দেয়। মাঝে-মধ্যে তার সাথে আলোচনা করে জেএমবির কার্যকলাপ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করতাম। আমরা তাকে রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের যুগের বিভিন্ন ঘটনা উল্লেখ করে বুঝাতাম যে, ইসলামে চরমপন্থার কোন স্থান নেই। মুহতারাম আমীরে জামা‘আত যখন নওগাঁ কারাগারে আসতেন ও থাকতেন, তখন আব্দুল কাইয়ূমকে তিনি খুব সুন্দর করে এসব বিষয়ে বুঝাতেন। আব্দুল কাইয়ূম মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের কথা মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতো। বিশেষ করে কুরআনের যে আয়াতগুলো তারা অপব্যাখ্যা করে থাকে, সেই আয়াতগুলো তাকে বেশী বেশী বুঝানোর চেষ্টা করতেন।

দু’তিন মাস পরের কথা। জানতে পারলাম, আমাদের পিছনের সেলে ৭/৮ জন নতুন আসামী এসেছে। তারা সবাই নাকি জেএমবির সদস্য। পরে জানা গেল তাদের সকলের যামিন হয়ে গেছে। কারণ তাদেরকে নিতান্তই সন্দেহের বশে ধরা হয়েছিল। এর কিছুদিন পর জেএমবির পরিচয়ে আবার কয়েকজন নতুন আসামী কারাগারে আসল। তারা নাকি নওগাঁর কোন প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাঁশ বাগানে বসে হামলার পরিকল্পনা করছিল। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ সেখানে গিয়ে তাদেরকে বিস্ফোরক দ্রব্যসহ গ্রেফতার করে। তারা সবাই হানাফী মাযহাবের অনুসারী, তবে শিক্ষিত। দু’একজন বাদে সকলেই ছিলেন মাদ্রাসার শিক্ষক। এক পর্যায় তাদেরকে আমাদের সেলের একটি কক্ষে রাখা হ’ল। ফলে তাদের সঙ্গে আমাদের সরাসরি সাক্ষাতের সুযোগ হ’ল। আব্দুল কাইয়ূমের মত তাদের কাছেও আমাদের দাওয়াতী কাজ শুরু হয়ে গেল। কিন্তু আলেম মানুষতো, এ কারণে অন্যের মত তারা সহজে বুঝতে চাইতো না। এক পর্যায় তাদের নামে ৪/৫টি মামলা দেওয়া হয়। আমরা বের হওয়ার পরে জানতে পারি তাদের প্রত্যেকের কোন মামলায় ৩০ বছর, কোন মামলায় ১৪ বছর, কোন মামলায় ১০ বছর এমনি করে প্রত্যেকের ৮৫/৯০ বছর করে কারাদন্ড হয়েছে।

এরপর জেএমবির আরেক সদস্য আসল। নাম হাফেয মিনহাজ। বাড়ি বগুড়া, বয়স ২০-এর কম। ছেলেটির পরিবারের আর্থিক অবস্থা তেমন ভাল ছিল না। নওগাঁয় একটি হাফেযী মাদ্রাসায় থাকতো। সে জেএমবির সক্রিয় সদস্য ছিল। কপাল দোষে ছেলেটি গ্রেফতার হয় ও সাজা ভোগ করে। মিনহাজ বলেছে, একদিন সে তার এক সাথী ভাইকে ফোন করে। সে তখন রাজশাহীতে র‌্যাবের হাতে বন্দী সেটা মিনহাজ জানতো না। র‌্যাব তাকে বলে, তুমি যে আমাদের কাছে বন্দী আছো তা ওকে বলবে না। তুমি স্বাভাবিক কথা বলে কৌশলে ও এখন কোথায় আছে সেটা জেনে নেও। মোবাইলে তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, মিনহাজ তুমি এখন কোথায়? সে বলে, আমি আমার মাদ্রাসায় আছি। তখন তাকে বলা হয়, তুমি থাকো আমি আসছি। র‌্যাব তখন রাজশাহী থেকে ঐ ছেলেটিকে সঙ্গে নিয়ে দ্রুত নওগাঁয় এসে সেই মাদরাসা থেকে মিনহাজকে গ্রেফতার করে সরাসরি রাজশাহী নিয়ে চলে যায়। সেখানে তাকে নানাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে স্বীকারোক্তি আদায় করে নওগাঁর সদর থানায় হস্তান্তর করে। কিন্তু বাইরের যোগাযোগের কারণে হোক অথবা ভুল করে হোক নওগাঁ থানা মিনহাজের নামে কোন মামলা না দিয়ে ৫৪ ধারায় তাকে কারাগারে প্রেরণ করে। কোন দিন তাকে কোর্টেও নেয় না, আবার তার যামিনও হয় না। এমনিভাবে কয়েক মাস কেটে গেল। এমতাবস্থায় একদিন কারাগার পরিদর্শনে গেলেন নওগাঁর পুলিশ সুপার মহোদয়। কেউ কারাগার পরিদর্শনে গেলে সেদিন কারা অভ্যন্তরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নসহ সর্বস্তরে অন্য রকম সাড়া পড়ে যায়। আর কে পরিদর্শনে আসছেন তাও আগে থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়। এদিন মিনহাজ মনে মনে ঠিক করে রেখেছে, আমার রুমের সামনে এসপি ছাহেব আসলে আমার বিষয়টা তাঁকে সরাসরি বলব। যথারীতি এসপি ছাহেব কারাগারে প্রবেশ করলেন, ঘণ্টা বাজার শব্দ শুনে আমরা বুঝতে পারলাম। এক পর্যায়ে তিনি আমাদের সেলে ঢুকলেন। আমাদের সাথে বিশেষ করে মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের সাথে অনেকক্ষণ খোশগল্পের মত আলাপ করলেন। এরপর মিনহাজের পালা। এসপি ছাহেব যখন তার রুমের সামনে গেলেন, তখন সে তাঁকে সালাম দিয়ে বলল, স্যার আমি বিনা বিচার এভাবে কতদিন জেলের ভিতরে পঁচবো? এসপি ছাহেব বললেন, কেন, তোমার কি মামলা? সে বলল, আমার কোন মামলা নেই, ৫৪ ধারায় আটক দেখানো হয়েছে। এসপি ছাহেব বললেন, তোমার সমস্যা কি? মিনহাজ বলল, আমাকে জেএমবি সন্দেহে ধরা হয়েছে। তখন এসপি ছাহেব বললেন, আমার জেলায় কোন জেএমবি তো ৫৪ ধারায় থাকার কথা না। তখন তিনি তাঁর সঙ্গীকে বিষয়টির নোট নিতে বললেন।

এক অথবা দুইদিন পর মিনহাজের আদালতে ডাক পড়ল। যথারীতি তাকে পরপর দু’বারে সম্ভবত ৮ বা ১০ দিনের পুলিশ রিমান্ড নিল। রিমান্ড শেষে মিনহাজ ফিরে আসলে জানতে পারলাম, স্বীকারোক্তিতো আদায় করেছেই, সেই সাথে যথেষ্ট অত্যাচার করেছে। অবশেষে মিনহাজ আব্দুল কাইয়ূমের কেস পার্টনার হয়ে গেল। অর্থাৎ তাকে আব্দুল কাইয়ূমের মামলায় ‘শোন এ্যারেষ্ট’ আসামী করা হ’ল। উক্ত মামলায় উভয়কে নিম্ন আদালত ফাঁসির দন্ড প্রদান করে। পরে উচ্চ আদালতে আপিল করলে তাদের সাজা কমিয়ে ১০ বছর কারাদন্ড প্রদান করে। উক্ত সাজা ভোগের পর বর্তমানে তারা মুক্ত।

নেশাখোর আসামী : একদিন এক আসামীকে হাতে-পায়ে বেড়ী ও দড়ি বেঁধে আমাদের সেলে আনা হ’ল। লোকটি যেমন স্বাস্থ্যবান, তেমনি শক্তিশালী। একতলা ভবনের প্রতিটি সেলে ৫টি করে রুম। আমরা এক প্রান্তের পাশাপাশি দু’টি রুমে আছি। ছেলেটিকে অপর প্রান্তের শেষ রুমে একা রাখা হ’ল। জানতে পারলাম, লোকটিকে গাজা বা হেরোইন খেতে বাধা দেওয়ার কারণে নিজের স্ত্রীকে দরজার হাক (যা দিয়ে দরজা আটকানো হয়) দিয়ে বাড়ি মেরে আহত করেছে। স্ত্রী চিৎকার করতে করতে বাথরুমে গিয়ে দরজা আটকে দিয়ে প্রাণে রক্ষা পায়। বৌমার চিৎকার শুনে নেশাগ্রস্ত ছেলেকে বকাঝকা করতে করতে মা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে থাকেন। ছেলে তখন নেশার ঘোরে হাতে থাকা সে হাক দিয়ে সজোরে মায়ের মাথায় বাড়ি মারে। এক বাড়িতে মা মাথা ফেটে ওখানেই মারা যান। মায়ের এই অবস্থা দেখে বাবা ছুটে আসেন, বাবাকেও অনুরূপ এক বাড়ি মারে। বাবাও ঐ জায়গায় শেষ। এরপর সে উন্মাদের মত বাড়ির ছাদের উপরে উঠে আবোল-তাবোল বকতে থাকে। এ অবস্থা দেখে পাশের বাড়ির লোকজন পুলিশে খবর দেয়। পুলিশ ঘরের দরজা ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকে দেখে এই পরিস্থিতি। পুলিশ ও জনগণ এসে তাকে বাড়ির ছাদ থেকে গ্রেফতার করে এবং তার আহত স্ত্রীকে বাথরুম থেকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করে।

ঘটনা জানতে পেরে আমরা সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। তখন মুহতারাম আমীরে জামা‘আত আমাদেরকে বললেন, আল্লাহ কি জন্য নেশাকে হারাম করেছেন, তার বাস্তব প্রতিফল দেখে নাও। একথা বলে তিনি আমাদের উদ্দেশ্যে নেশার কুফলের উপর নাতিদীর্ঘ ও জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য দিলেন।

এই ছেলেকে কারাগারে আনার পর থেকে সে অদ্ভূত অদ্ভূত আচরণ করছে। কারাগারের ম্যাট-পাহারা সবাই তার কাছে যেতে ভয় পাচ্ছে। তাকে খাবার দেওয়ার সময় খুব সতর্কভাবে দিচ্ছে। যাতে করে সে তাদের উপর আক্রমণ করতে না পারে। রাত গভীর হয়েছে, আমরা সবাই যে যার মত ঘুমিয়ে পড়েছি। আমরা তিনজন এক রুমে, মুহতারাম আমীরে জামা‘আত একা অন্য রুমে। হঠাৎ দেখি প্রচন্ড ঝাঁকুনিতে গোটা ভবন কাঁপছে। ঘুম ঘেঙে গেল। ভাবলাম ভূমিকম্প হচ্ছে নাকি? কিন্তু না, পরক্ষণে বুঝতে পারলাম ঐ ছেলেটা তার সেলের লোহার দরজা ধরে নিজের যথাশক্তি প্রয়োগ করে সজোরে ঝাঁকি দিচ্ছে। বাবু (কারারক্ষী) বলছে, স্যার, ও কোন কথাই শুনছে না। সারা রাত আমাদের কারো আর ঘুম হ’ল না। সকালে উঠে মুহতারাম আমীরে জামা‘আত বললেন, নূরুল ইসলাম! আমার তো সন্দেহ হচ্ছে। এই ছেলেকে এভাবে আমাদের সেলে রাখা কোন ষড়যন্ত্র নয়তো? ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, যুগে যুগে বহু মনীষীকে কারাগারে নানা কৌশলে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে। যাতে তারা আস্তে আস্তে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হ’তে বাধ্য হয়। বাস্তবতা এই যে, ঐ ছেলেটা যতদিন আমাদের সেলে ছিল, তত দিন তার অত্যাচারে আমরা কেউই ঠিক মত ঘুমাতে পারিনি।

জানতে পারলাম, ছেলেটি বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। নওগাঁ শহরেই দোতলা বাড়ি, বেশ ধনী লোক। সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে ওর নিকটাত্মীয়রা তাকে মানসিক রোগী সাজিয়ে মামলা থেকে মুক্তির চেষ্টা করে। সেই সূত্র ধরে তাকে নওগাঁ কারাগার থেকে চিকিৎসার অজুহাতে পাবনা মেন্টাল হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ছেলেটি সেল থেকে বিদায় হওয়ায় আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে আমরা সকলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।

সার্জন নূরুল ইসলামের ‘আহলেহাদীছ’ আক্বীদা গ্রহণ :

সিভিল সার্জন নূরুল ইসলাম নওগাঁ শহরের একজন সুপরিচিত বিজ্ঞ ডাক্তার। বয়স ৮১ বৎসর। জমি-জমার দখল নিয়ে প্রতিপক্ষের সাথে মারামারিতে তার জমির উপরে এক চেয়ারম্যান নিহত হয়। উক্ত মামলায় তার ফাঁসির রায় হয়। আমরা বিকালে সেলের বারান্দায় বসে খবরের কাগজ পড়ছি। এমন সময় দেখি আমাদের সেলের পাশের রুমে ডাঃ নূরুল ইসলাম ছাহেবকে নিয়ে হাযির। ডাক্তার ছাহেব কাঁদছেন আর আল্লাহকে ও জজ ছাহেবকে বেপরোয়াভাবে ফাহেশা কথায় গালি দিচ্ছেন। তার কান্না দেখে এগিয়ে গিয়ে তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলাম। তিনি তো আমাদের দেখে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে আলেম-ওলামাকে গালি দিতে লাগলেন। কিছুক্ষণ কথা বলার পর শান্ত হ’লে তার খাবার ব্যবস্থা ও অন্যান্য সেবা-যত্নের মাধ্যমে তাকে সান্ত্বনা দিয়ে লকাপ বন্ধ হ’লে চলে আসলাম। পরের দিন ভোরে লকাপ খুললেই তার কাছে গিয়ে ছালাতের কথা বলতেই তিনি ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে ছালাতী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নানা রকম মন্তব্য করতে লাগলেন। এক পর্যায়ে  আল্লাহ নেই বলে মত প্রকাশ করতে থাকলেন। সেদিন আমরা তার কথার প্রতিবাদ না করে তাঁকে শান্ত থাকার আবেদন জানিয়ে চলে আসলাম। পরের দিন ঠান্ডা পরিবেশ দেখে তার কাছে গিয়ে দাদু বলে ডেকে গল্পের সূচনা করলাম। এক পর্যায়ে তার ফাঁসির রায়ের কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বিস্তারিত ঘটনা বললেন।

যার সারসংক্ষেপ হ’ল, ২২ বিঘা জমি এক হিন্দু প্রথমে ডাক্তার ছাহেবের কাছে বিক্রি কবলা করে। তার তিন মাস পরে গ্রামের চেয়ারম্যানের কাছে পুনরায় বিক্রি করে ভারতে পালিয়ে যায়। ঐ জমি দখল নিয়ে মারামারি হয়। প্রতিপক্ষ তাকে হত্যা করার জন্য ফালা উত্তোলন করতেই তিনি লাইসেন্স করা বন্দুক দিয়ে আত্মরক্ষা মূলক গুলি করেন। গুলিটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে চেয়ারম্যানের বুকে লাগে এবং তিনি নিহত হন। এই সময় সমস্ত লোক জন পালিয়ে যায়। তখন আমার কোট খুলে চেয়ারম্যানের গায়ে পরায়ে দেওয়া হয়। ডাক্তারি রিপোর্টে প্রমাণ করা হয় যে, শরীরের গুলির আঘাত কিন্তু কোট ছিদ্র হয়নি। এটা কি করে হয়? সুতরাং সে নিজেই আত্মহত্যা করেছে অথবা তার নিজের লোকেরা তাকে হত্যা করে ফেলে রেখে গেছে। কেস চলতে থাকে থানা, কোর্ট, সাক্ষী, উকিল, জজ সবার সঙ্গে কথা বলা সব ঠিক করা হয়। কিন্তু রায়ের দিন নতুন জজ এসে হঠাৎ ফাঁসির রায় ঘোষণা করে। একেই বলে তকদীর। একেই বলে কপালের লিখন। বললাম, আচ্ছা ডাক্তার ছাহেব! আপনিই বললেন যে আল্লাহ বলতে কিছু নেই। আবার আপনিই বলছেন তকদীর? বললেন, শুনুন! আমি তো হুযূরদের উপর রাগ করে বলেছি। আচ্ছা বলুন তো যে মারা যায় তার রূহ আবার কিভাবে মীলাদের মাহফিলে হাযির হয়? আর তার সম্মানে আমাদের দাঁড়াতে হবে? আচ্ছা মীলাদে যদি এত বরকত হয়, তাহ’লে হুযূরের বাড়ীতে মীলাদ হয় না কেন? হুযূর বলেন, ছালাত মানুষকে খারাপ ও অশ্লীল কাজ থেকে দূরে রাখে। তাহ’লে যে হুযূর ২২ বছর ধরে আমার মসজিদে ইমামতি করল, সে আবার কি করে ক্যাশ বাক্স ভেঙ্গে টাকা নিয়ে পালিয়ে গেল? সেদিন খেদু তার বউয়ের উপর রাগ করে বউকে তিন তালাক দিল। আর হুযূর তাকে হিল্লা করার জন্য তাকে বিয়ে করে বউ নিয়ে পালালো। এইগুলি যদি ইসলাম হয়, তো সে ইসলাম আমি মানি না।

তিনি বললেন, হুযূরদের আল্লাহ ধরতে পারে না, শুধু আমাকে দেখতে পায়? আমি বললাম, দাদু আল্লাহর শানে এসব কথা বলতে হয় না। আমাদের দেশে ইসলাম দুই প্রকার। এক. পপুলার ইসলাম, দুই. পিওর ইসলাম। পিওর ইসলামে মীলাদ নেই, হিল্লা নেই। আমরা সেই পিওর ইসলামে বিশ্বাসী। বললেন, আচ্ছা! পিওর ইসলাম কেমন? বললাম, পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে যেমন আছে, আমরা তেমনভাবেই ইসলাম মেনে চলি। আমরা মনে করি আল্লাহ সমস্ত ক্ষমতার উৎস। তিনি আপনাকে ফাঁসিও দিতে পারেন, তিনি আপনাকে বাঁচাতেও পারেন। অতীতে এরকম বহু ঘটনা ঘটেছে। এমনকি ফাঁসির দড়ি পর্যন্ত ছিঁড়ে গেছে। আমীরে জামা‘আতের থিসিসের মধ্যে পড়েছি ‘সাতক্ষীরার মর্জুম হোসেনের ফাঁসির দড়ি তিনবার ছিঁড়ে গেলে ইংরেজ বিচারক ফাঁসির রায় বদলিয়ে তাকে মুক্তি দেয় (থিসিস পৃঃ ৪২১)। তখন উনি বললেন, মাওলানা ছাহেব আমাকে ছহীহ শুদ্ধভাবে নামায শিখিয়ে দিন। বললাম, আমরা নামায বলি না, আমরা ছালাত বলি। নামায অর্থ কুর্ণিশ করা। আর ছালাত অর্থ আল্লাহর শিখানো পদ্ধতিতে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা। মৌলভীদের কাছে যা শিখেছি সবই ভুল। আমরা ডাক্তার ছাহেবকে ছালাত আদায়ের সঠিক পদ্ধতি শিক্ষা দিলাম। তিনি ছালাত সহ যাবতীয় আহকাম মাঝে-মধ্যে জিজ্ঞেস করে শুদ্ধ করে নিতেন। তিনি রাজনীতির বিষয়টি নিয়ে সালাফী ছাহেব ও আযীযুল্লাহর সাথে তর্ক করতেন। সবশেষে তিনি প্রচলিত রাজনীতিকে ঘৃণার চোখে দেখতেন। তিনি বলতেন, ‘আল্লাহর রহমতে আপনাদের সাথে আমার সাক্ষাৎ হ’ল। নইলে আমি নাস্তিক হয়েই মারা যেতাম। তাকে জেলখানায় রেখেই আমাদের বিদায় নিতে হ’ল। বিদায় ক্ষণে তিনি অঝোর নয়নে কেঁদে কেঁদে মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের জন্য ও আমাদের জন্য দো‘আ করলেন এবং তাঁর মুক্তির জন্য দো‘আ চাইলেন। বর্তমানে আপিলের মাধ্যমে তিনি মুক্তি পেয়ে ছহীহ আক্বীদার উপরে টিকে আছেন।

ম্যাট-পাহারা : কারা বিধি অনুযায়ী যারা সশ্রম সাজাপ্রাপ্ত আসামী তাদের অন্যতম প্রধান কাজ হ’ল কারাগারের বন্দীদের সার্বিক তত্ত্বাবধান করা। তাদের তিন বেলার খাদ্য প্রস্ত্তত করা, সময় মত তা বন্দীদের মাঝে সরবরাহ করা, সকাল-সন্ধ্যা দরজা খোলা ও বন্ধ করা, কারাগারের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, বন্দীদের কারা অভ্যন্তরে সুশৃঙ্খলভাবে রাখা ইত্যাদি। আমরা যখন নওগাঁ কারাগারে গেলাম, তখন আমাদের সেলের কাজ-কর্মের দায়িত্বে ছিল একজন বিহারীর, যার নাম মোঃ আব্দুল জববার, বয়স ৫০-এর উপরে। তার বাড়ি নওগাঁ রাণীনগর থানায়। লোকটি খুব সুন্দর এবং নির্ভুলভাবে উর্দূ ভাষায় কথা বলতে পারতেন। লোকটি যেমন বুদ্ধিমান, তেমনি বিচক্ষণ। সেলের ম্যাট-পাহারা হিসাবে আর যারা আসতো প্রতি মাসেই তারা পরিবর্তন হয়ে নতুন নতুন লোক আসতো। কিন্তু বিহারীর পরিবর্তন হ’ত না। তার বিষয়ে ইতিপূর্বে বলেছি।

এক দিন রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে একজন পুরাতন কয়েদী বদলী হয়ে নওগাঁ কারাগারে এল। তার নাম বাচ্চু। তাকে প্রথমে আমাদের সেলের একটি রুমে রাখা হয়। বদলী হয়ে আসা কোন আসামীকে আসার পরপরই কোন কাজ দেওয়া হয় না। প্রথমে তাকে কিছুদিন পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। বাচ্চুর ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি।

বাচ্চুর বাড়ি ময়মনসিংহ যেলায়। সে একটি হত্যা মামলার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদী। ঘটনার সময় বাচ্চুর বয়স ১৪ বছরের কম হওয়ায় কিশোর আইনে তাকে ফাঁসি না দিয়ে যাবজ্জীবন অর্থাৎ ৩২ বছরের সশ্রম কারাদন্ড প্রদান করে। বাচ্চু ধবধবে ফর্সা, অত্যন্ত বুদ্ধিমান, চতুর এবং অভিজ্ঞ ম্যাট। অনেক ক্ষেত্রে কারা কর্মকর্তারাও তার বুদ্ধির কাছে হার  মেনে যায়। সে দীর্ঘ দিন রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রধান ম্যাটের দায়িত্ব পালনসহ সিআইডি হিসাবেও দায়িত্ব পালন করে। কারা অভ্যন্তরে কারারক্ষী, জামাদার, সুবেদার প্রভৃতি নিম্ন ও মধ্যম পর্যায়ের কর্মচারী-কর্মকর্তারা ঠিকমত দায়িত্ব পালন করছে কি-না, এ বিষয়ে বাচ্চু সিআইডি হিসাবে জেলার বা সুপার ছাহেবকে রিপোর্ট করত। তার রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে নাকি অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর কমবেশী বিভাগীয় শাস্তিও হয়েছে। কারাগারের পুরাতন কয়েদীর প্রায় সকলেই এক নামে বাচ্চুকে চেনে। কারণ সে দীর্ঘ কারা জীবনে বিভিন্ন মেয়াদে ঢাকা ও রাজশাহী বিভাগের দশটি বড় বড় কারাগারে বদলি হয়েছে। নিজের দীর্ঘ কারাজীবনের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে একদিন বাচ্চু বলে, স্যার! একবার রাজনৈতিক কারণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০/৬০ জন শিবিরের ছাত্রকে ধরে কারাগারে পাঠাল। কারাগারে তাদেরকে এক সাথে রাখা যাবে না। আবার শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য যাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ভাল তাদেরকেও এক ওয়ার্ডে রাখা ঠিক হবে না। কিন্তু এতগুলো ছেলের মধ্যে কিভাবে সেটা বাছাই করা যাবে, এ নিয়ে কারা প্রশাসন খুবই চিন্তিত হয়ে পড়ল। বাচ্চু বলল, স্যার, চিন্তা করবেন না, ও দায়িত্ব আমার উপর ছেড়ে দিন। আমি তখন তাদের কাছে গিয়ে বললাম, দেখেন আপনাদের সকলকে আমরা এক ওয়ার্ডে জায়গা দিতে পারবো না। ৫টি ওয়ার্ডে ভাগ করে রাখব। এখন আপনাদের যার যার সাথে ভাল বন্ধুত্ব আছে, তারা তারা মিলে নিজেরা ৫ ভাগে ভাগ হন। তখন সবাই খুশি হয়ে যার যার বন্ধুর সাথে মিলে ৫ ভাগে ভাগ হয়ে গেল। আমি তখন তাদের প্রত্যেক দল থেকে একজন একজন করে নতুন দল করে আমাদের মত করে সাজিয়ে নিলাম। আমার বাছাই কৌশল দেখে কর্তৃপক্ষ খুব খুশি হয়ে গেল। এক পর্যায় বাচ্চুকে বিহারী ছাহেবের সাথে আমাদের সেলেই কাজের দায়িত্ব দেওয়া হ’ল।

[চলবে]







সুন্নাত উপেক্ষার পরিণাম - লিলবর আল-বারাদী - যশপুর, তানোর, রাজশাহী
ইসলামের দৃষ্টিতে সাহিত্য - আসাদুল্লাহ আল-গালিব (শিক্ষার্থী, ইংরেজী বিভাগ, ২য় বর্ষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)।
জামা‘আতে ছালাত আদায়ের গুরুত্ব, ফযীলত ও হিকমত (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
তাছফিয়াহ ও তারবিয়াহ : মুসলিম জীবনে এর প্রয়োজনীয়তা - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
আল-কুরআনের আলোকে ক্বিয়ামত (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - রফীক আহমাদ - বিরামপুর, দিনাজপুর
অমুসলিমদের নিকটে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সীরাত তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
মুসলিম সমাজে মসজিদের গুরুত্ব (৫ম কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
ফৎওয়া : গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা ও বিকাশ - ড. শিহাবুদ্দীন আহমাদ, শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, রাজশাহী
যাকাত ও ছাদাক্বা : আর্থিক পরিশুদ্ধির অনন্য মাধ্যম - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
বিদ‘আত ও তার ভয়াবহতা (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
আহলেহাদীছ আন্দোলন ও অন্যান্য ইসলামী আন্দোলন : তুলনামূলক আলোচনা - মাওলানা মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম
বিজ্ঞানের আলোকে ছিয়াম - আ.স.ম. ওয়ালীউল্লাহ
আরও
আরও
.