মাওলানা আব্দুল্লাহ আব্দুত তাউয়াব আল-মাদানী নেপালের একজন প্রসিদ্ধ আহলেহাদীছ আলেম এবং জমঈয়তে আহলেহাদীছ নেপালের আমীর ছিলেন। নেপালে আহলেহাদীছ আন্দোলনের প্রচার-প্রসারে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাসিক ‘নূরে তাওহীদ’, ‘মারকাযুত তাওহীদ’ ও ‘মাদরাসা খাদীজাতুল কুবরা’ নেপালে ইসলামী শিক্ষা ও বিশুদ্ধ আক্বীদার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

জন্ম ও শিক্ষা :

মাওলানা আব্দুল্লাহ মাদানী ১৯৫৫ সালের ২রা জুলাই নেপালের লুম্বানী অঞ্চলের কপিলবস্ত্ত যেলার ঝান্ডানগরে (কৃষ্ণনগর) এক ধার্মিক পরিবারে পিতা আব্দুত তাউয়াবের ঔরসে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর চাচা মাওলানা আব্দুল ওয়াহ্হাব রিয়াযী নেপালের প্রসিদ্ধ আলেম ও আহলেহাদীছ আন্দোলনের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী। দাদা মাওলানা মিয়াঁ মুহাম্মাদ যাকারিয়া ভারতের উত্তর প্রদেশের বস্তী যেলার বেত্নার গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। নেপালের বিখ্যাত আহলেহাদীছ প্রতিষ্ঠান জামে‘আ সিরাজুল উলূমের শিক্ষক হিসাবে তিনি ১৯১৬ সালে নেপালে এসে ঝান্ডানগরে বসতি স্থাপন করেন। দীর্ঘ ৬০ বছর যাবৎ তিনি উক্ত মাদরাসার শিক্ষক ছিলেন এবং ৮২ বছর বয়সে ১৯৮৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় ঝান্ডানগরে বহু মানুষ আহলেহাদীছ হয়েছেন।[1]

মাওলানা আব্দুল্লাহ জামে‘আ সিরাজুল উলূমে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে উত্তর প্রদেশের বস্তী যেলার মাদরাসা ইসলামিয়া আকরাহ্রা-তে তিন বছর পড়াশুনা করার পর ১৯৭০ সালে জামে‘আ সালাফিইয়াহ বেনারসে ভর্তি হন। এখানে তিনি ছয় বছর পড়াশুনা করে ‘আলামিয়াত’ ডিগ্রী অর্জন করেন। অতঃপর আরবী ভাষা ও সাহিত্যে দক্ষতা অর্জনের জন্য তিনি নাদওয়াতুল ওলামা লাক্ষ্ণৌতে ভর্তি হন। এখান থেকে দু’বছরের কোর্স সম্পন্ন করে ১৯৭৭ সালে তিনি ফারেগ হন। অতঃপর উচ্চতর শিক্ষা লাভের জন্য একই বছর মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে গমন করেন। সেখানে ৪ বছরের কোর্স সম্পন্ন করে শরী‘আহ অনুষদের ইসলামী ফিকহ বিভাগ হতে ১৯৮১ সালে লিসান্স ডিগ্রী অর্জন করেন। অতঃপর একই বছরে ‘দারুল ইফতা’র মাবঊছ হিসাবে সঊদী সরকারের চাকুরী নিয়ে দেশে ফিরেন।[2]

কর্মজীবন :

সঊদী মাবঊছ হিসাবে দেশে ফিরে তিনি প্রথমে জামে‘আ সালাফিইয়াহ জনকপুর ধামে চার বছর শিক্ষকতা করেন। অতঃপর ১৯৮৫ সাল থেকে তিন বছর কাঠমান্ডুর নেপালী (দেওবন্দী) জামে মসজিদে রিয়াযুছ ছালেহীন হাদীছ সংকলন  থেকে দৈনিক এক ওয়াক্ত করে দরসে হাদীছ পেশ করতেন। ১৯৮৬ সালে তিনি নেপালে কর্মরত সঊদী মাবঊছদের মুশরিফ বা তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। ১৯৮৮ সালের জানুয়ারী মাসে তিনি কপিলবস্ত্ত যেলার তাওলহুয়া-তে অবস্থিত ‘আল-মা‘হাদ আল-ইসলামী’তে শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হন।[3] এখানেই তিনি মারকাযুল ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল আল-ইসলামীতে পাঁচ বছর কর্মরত ছিলেন।  এরপর প্রচন্ড ব্যস্ততা হেতু শিক্ষকতা সম্পূর্ণরূপে ছেড়ে দেন।[4]

মারকাযুত তাওহীদ প্রতিষ্ঠা :

মাওলানা আব্দুল্লাহ মাদানী দ্বীনী শিক্ষার বিকাশ এবং দাওয়াতী ও সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ১৯৮৯ সালে তাঁর জন্মস্থান কৃষ্ণনগরে ‘মারকাযুত তাওহীদ’ প্রতিষ্ঠা করেন। অতঃপর মেয়েদেরকে ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য এই মারকাযের অধীনে ‘মাদরাসা খাদীজাতুল কুবরা’ নামে একটি মহিলা মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এটি নেপালের একমাত্র মহিলা মাদরাসা। এখানে ইবতেদায়ী থেকে দাওরায়ে হাদীছ পর্যন্ত পাঠ দান করা হয়। তিনি আমৃত্যু মারকাযুত তাওহীদ-এর সভাপতি ও মাদরাসা খাদীজাতুল কুবরার সেক্রেটারী রূপে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সর্বদা মাদরাসার উন্নতিকল্পে চিন্তা-ভাবনা করতেন, যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকা খুঁজতেন এবং শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টিতে সচেষ্ট থাকতেন। তাঁর একনিষ্ঠ চেষ্টায় নেপালের শত শত মেয়ে ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে পরিবার, সমাজ ও জাতির খিদমতে নিয়োজিত হয়। তাদরীসী ও দাওয়াতী ময়দানেও তারা অগ্রণী ভূমিকা পালন  করে।

উক্ত মারকায কুরআন মাজীদ ও হাদীছ মুখস্থ প্রতিযোগিতার আয়োজন, ইমাম ও দাঈদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, সেমিনার -সিম্পোজিয়াম, ইয়াতীম, মিসকীন ও দুর্গতদের সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান প্রভৃতি কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।[5]

দাওয়াতের ময়দানে মাদানী :

মাওলানা আব্দুল্লাহ মাদানী একজন উদ্যমী, কর্মঠ ও নিবেদিতপ্রাণ দাঈ ছিলেন। তিনি ইসলামের প্রচার-প্রসার ও সমাজ সংস্কারে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। তিনি সারাজীবন কনফারেন্স, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, বিভিন্ন দাওয়াতী প্রোগ্রাম ও জালসায় অংশগ্রহণ করে দাওয়াতী খিদমত আঞ্জাম দিতে থাকেন। তিনি বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, ব্রিটেন, মালদ্বীপ, শ্রীলংকা, সঊদী আরব, কুয়েত, দুবাই প্রভৃতি দেশে দাওয়াতী সফর করেছেন।[6]

উল্লেখ্য, তিনি ১৯৯৭ ও ১৯৯৮ সালে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর বার্ষিক জাতীয় সম্মেলন ও তাবলীগী ইজতেমায় মেহমান হিসাবে উপস্থিত ছিলেন। প্রথমটিতে তিনি ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রতি ভালবাসা ও তাঁর আনুগত্য’ এবং দ্বিতীয়টিতে ‘ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা’ বিষয়ে বক্তব্য প্রদান করেছিলেন।[7]

তিনি পিস টিভি উর্দূসহ বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেলে আলোচনার মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহকে কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী জীবন গড়ার আহবান জানান। তিনি নেপালের দুর্গম পাহাড়ী এলাকাতেও দাওয়াতী সফর করতেন।

আল্লাহ তাঁকে যে অপূর্ব বাগ্মিতাশক্তি প্রদান করেছিলেন সেটিকে তিনি দাওয়াতী কাজে ব্যয় করেন। তাঁর বক্তব্য কুরআন মাজীদ ও হাদীছের দলীল দ্বারা সুসজ্জিত থাকত। ফলে শ্রোতার মনে তা দারুণভাবে রেখাপাত করত। নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে কুরআন ও সুন্নাহর নাম শোনার মত কেউ ছিল না। এখন সেখানে আব্দুল্লাহ মাদানী ও তাঁর সাথী আহলেহাদীছ আলেমদের প্রচেষ্টায় আহলেহাদীছদের একটি জামা‘আত কায়েম হয়ে গেছে।

ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমেও তিনি দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ আঞ্জাম দিতেন। বড় বড় মানুষদের সাথে তাঁর যোগাযোগ ছিল। তাঁর গাম্ভীর্যপূর্ণ ব্যক্তিত্বের দ্বারা বড় বড় ব্যবসায়ী, উচ্চপদে সমাসীন ব্যক্তিবর্গ, রাজনীতিবিদ ও নেতৃবৃন্দ প্রভাবিত ছিলেন। তিনি তাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পেশ করতেন এবং আহলেহাদীছের মানহাজ তুলে ধরতেন। মাদরাসা খাদীজাতুল কুবরায় তিনি দাওয়াতী প্রোগ্রামে খ্যাতিমান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, ডাক্তার, পত্র-পত্রিকার সম্পাদক, মুসলিম -অমুসলিম জ্ঞানী-গুণী এবং সব ধরনের মানুষকে দাওয়াত দিয়ে তাদের সামনে ইসলামের শিক্ষাসমূহ ব্যাখ্যা করতেন।[8]

পত্রিকা প্রকাশ :

১৯৮৮ সালের মে মাসে তিনি ‘নূরে তাওহীদ’ (نور توحيد) নামে নেপালে সর্বপ্রথম একটি উর্দূ মাসিক ইসলামী পত্রিকা বের করেন।[9] নেপাল ও পার্শ্ববর্তী দেশ সমূহে আহলেহাদীছ মানহাজের প্রচার-প্রসারে পত্রিকাটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এ পত্রিকায় তিনি ‘শুউর ওয়া আগাহী’ (شعور وآﮜﮩﯽ) শিরোনামে নিয়মিত সম্পাদকীয় লিখতেন। এ পত্রিকার জানুয়ারী’১৬ সংখ্যায় প্রকাশিত তাঁর জীবনের সর্বশেষ সম্পাদকীয়ের শিরোনাম ছিল ‘মাক্বামে রিসালাত’ (রিসালাতের মর্যাদা)।[10] তিনি তাঁর জীবদ্দশায় উক্ত সম্পাদকীয়গুলোকে গ্রন্থের রূপ প্রদান করেন। যা এখনো প্রকাশিত হয়নি। তাছাড়া তিনি খাঁটি নেপালী ভাষাভাষী মুসলিম-অমুসলিম সকলের জন্য নেপালী ভাষায় ‘হামরো সওগাত’ (ہامرو سوغات) নামেও একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন।[11]

লেখনী : দাওয়াতী কাজে এবং মারকাযুত তাওহীদ ও মাদরাসা খাদীজাতুল কুবরা পরিচালনায় ব্যস্ততার কারণে তিনি গ্রন্থ রচনার দিকে খুব বেশী মনোযোগ দিতে পারেননি। ‘সূয়ে হারাম’ (হারামের পানে) শিরোনামে তাঁর হজ্জ সফরের কাহিনী সংবলিত গ্রন্থটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ও প্রসিদ্ধ। এছাড়া তিনি কিছু বই-পুস্তক আরবী থেকে অনুবাদ করেছেন এবং কয়েকটি বই অন্যদের মাধ্যমে অনুবাদ করিয়ে প্রকাশ করেছেন।[12]

সাংগঠনিক জীবন :

আহলেহাদীছ আন্দোলনের জন্য তাঁর উদ্যম ও প্রচেষ্টা ছিল অন্তহীন। তিনি নেপালে এর প্রচার-প্রসারে অন্তঃপ্রাণ ছিলেন। ১৯৯১ সালের ৫ই নভেম্বর নেপালে সর্বপ্রথম আহলেহাদীছ সংগঠন হিসাবে ‘জমঈয়তে আহলেহাদীছ নেপাল’ গঠিত হলে মাওলানা আব্দুর রঊফ ঝান্ডানগরী (১৯১০-১৯৯৯) আমীর ও তিনি নায়েবে আমীর নিযুক্ত হন।[13] পরবর্তীতে তিনি আমৃত্যু এ সংগঠনের আমীর হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।

আরবী ভাষা ও সাহিত্যে দক্ষতা :

জামে‘আ সালাফিইয়াহ থেকে ফারেগ হওয়ার পর তিনি নাদওয়াতুল ওলামা লাক্ষ্ণেŠতে আরবী ভাষা ও সাহিত্যের দু’বছরের বিশেষ কোর্স সম্পন্ন করেন। অতঃপর মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে আরবী ভাষা ও সাহিত্যে দক্ষতা অর্জন করেন। তিনি উর্দূ ও আরবীতে অনর্গল কথা বলতেন ও বক্তৃতা দিতেন। উপসাগরীয় দেশগুলোর কতিপয় আরবী পত্রিকায় তিনি আরবীতে সাক্ষাৎকার প্রদান করেন। যেগুলো ঐসব পত্রিকা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে ছাপে। আরব দেশগুলোতে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন প্রোগ্রামে তিনি আরবীতে প্রবন্ধ পাঠ করেন। নেপালের মুসলমানদের প্রতিনিধি হিসাবে আরব দেশগুলোতে গমন করে তিনি আরবীতে নেপালের ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত অবস্থা সম্পর্কে তাদেরকে অবহিত করেন।[14]

কাব্যচর্চা :

তিনি উর্দূ ভাষার একজন ভাল কবি ছিলেন। কাব্যজগতে তিনি ‘হামিদ সিরাজী’ নামে পরিচিত ছিলেন। ‘নূরে তাওহীদ’ পত্রিকায় তাঁর অনেক কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। যেমন মাওলানা আব্দুল মতীন সালাফীর (১৯৫৪-২০১০) মৃত্যুতে তিনি হামিদ সিরাজী (حامد سراجى) ছদ্মনামে উক্ত পত্রিকায় ‘ভাঈ আব্দুল মতীন সালাফী কী ইয়াদ মেঁ’ (ভাই আব্দুল মতীন সালাফীর স্মরণে) শিরোনামে ১৩ লাইনের একটি কবিতা লিখেন।[15] তাঁর কবিতাগুলো কুরআন-সুন্নাহ, আহলেহাদীছ আক্বীদা এবং ইসলামী নৈতিকতা ও শিষ্টাচারের মুখপত্র ছিল।[16]

জনকল্যাণমূলক কাজ :

উপসাগরীয় আরব দেশের অনেক সংস্থা তাঁর মাধ্যমে নেপালে বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়ন করত। তিনি নেপালী জনগণ বিশেষতঃ পাহাড়ী এলাকার সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের কল্যাণে অনেক কাজ করেছেন। মসজিদ নির্মাণ, গরীব-দুঃখীদের বাসস্থানের ব্যবস্থা এবং অসুস্থ ও বিপদগ্রস্ত লোকদের জন্য খাদ্য, পানীয়, চিকিৎসা ও অন্যান্য প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা করেন। কোন এলাকায় দুর্যোগ দেখা দিলে তিনি তাঁর টিম নিয়ে সেখানে উপস্থিত হতেন এবং দল-মত ও ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে সাহায্য করতেন।

চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য :

তিনি যিন্দাদিল, ভদ্র ও মিশুক মানুষ ছিলেন। সর্বদা হাস্যোজ্জ্বল থাকতেন। প্রথম সাক্ষাতেই সাক্ষাৎকারী তাঁর ভক্ত হয়ে যেত। তিনি ছিলেন অতিথিপরায়ণ। বড়দেরকে সম্মান ও ছোটদেরকে স্নেহ করতেন। তিনি নরম মেযাজের অধিকারী ছিলেন। কিন্তু হক প্রকাশে ছিলেন নির্ভীক ও কঠোর। হকের পথে তিনি কোন নিন্দুকের নিন্দাকে বিন্দুমাত্র পরোয়া করতেন না। কোন মজলিস ও প্রোগ্রামে হকের বিপক্ষে কোন কথা উচ্চারিত হলে তিনি দ্রুত দাঁড়িয়ে যেতেন ও জোরালো বক্তব্যের মাধ্যমে তা খন্ডন করতেন এবং নির্ভীকচিত্তে সত্য প্রকাশ করতেন। তিনি সকল ধর্ম ও মাযহাবের মানুষের সাথে মিশতেন। তাদের কথা শুনতেন এবং তাদেরকে নিজের বক্তব্য শুনাতেন। কিন্তু কখনো কোন বাতিল চিন্তাধারায় প্রভাবিত হতেন না।[17]

মৃত্যু ও দাফন :

মাওলানা আব্দুল্লাহ মাদানী হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ২০১৫ সালের ২২শে ডিসেম্বর রোজ মঙ্গলবার সকাল ১০-টায় কাঠমান্ডুর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। পরদিন ২৩শে ডিসেম্বর বুধবার বাদ যোহর কৃষ্ণনগরে তাঁর জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। এতে নেপাল ও ভারতের কয়েক হাযার মুছল্লী অংশগ্রহণ করেন। জানাযায় ইমামতি করেন মাওলানা আব্দুর রহমান মুবারকপুরী।[18] জানাযায় জামে‘আ সালাফিইয়াহ বেনারস থেকে শায়খুল জামে‘আহ নাঈমুদ্দীন মাদানী, সাবেক শায়খুল জামে‘আহ মুহাম্মাদ মুস্তাক্বীম সালাফী, আরবী মাসিক ‘ছওতুল উম্মাহ’ পত্রিকার সম্পাদক আস‘আদ আ‘যমী, শিক্ষক দিল মুহাম্মাদ সালাফী ও হাফেয আব্দুল হাকীম অংশগ্রহণ করেন।[19] অতঃপর তাঁকে ঝান্ডানগর কবরস্থানে দাফন করা হয়।[20]

স্থলাভিষিক্ত নির্বাচন :

মাওলানা মাদানীর মৃত্যুর তিনদিন পর ২৪শে ডিসেম্বর’১৬ বৃহস্পতিবার সকাল ৯-টায় মাওলানার পরিবারের সদস্যবৃন্দ, দীর্ঘ দিনের সাথীবৃন্দ ও হিতাকাংখী ওলামায়ে কেরাম একত্রে বসে পরামর্শের পর মাদরাসা খাদীজাতুল কুবরা-র মুহতামিম ডাঃ সাঈদ আহমাদ আছারী মাওলানার স্থলাভিষিক্ত হিসাবে তাঁর ছোট ভাই এবং দীর্ঘ ১০ বছরের সার্বক্ষণিক সাথী মাওলানা আব্দুল আযীম মাদানীর নাম ঘোষণা করেন এবং সকলে তাকে সানন্দে বরণ করে নেন। তিনি একই সাথে মাসিক নূরে তাওহীদেরও সম্পাদক মনোনীত হন।[21]

কে কি বলেন :

৩০শে ডিসেম্বর’১৫ বৃহস্পতিবার বাদ আছর অনুষ্ঠিত সভা কুরআন তেলাওয়াতের পর মাওলানা মাদানী লিখিত দু’লাইন কবিতা পাঠের মাধ্যমে শুরু হয়। যেখানে তিনি বলেন,

جو علم بھى ہم نے سيكھا ہے وه ياد ہميشہہ ركھيں گے

مسكن ہو كہيں٬  اس علم كى ہی بنياد  ہميشہ ركھيں گے

‘যে ইলম আমরা শিখেছি, তা সর্বদা স্মরণ রাখব

যেখানেই হৌক বাড়ী মোদের এই ইলমের বুনিয়াদ মোরা রাখব’।

উক্ত সভায় জামে‘আ সিরাজুল উলূমের পরিচালক আব্দুল মান্নান সালাফী ছাড়াও মাওলানা আব্দুর রহীম মাদানী, শায়খুল জামে‘আ মাওলানা খোরশেদ আহমাদ সালাফী, মাওলানা আসলাম মাদানী, মাওলানা আব্দুন্নূর সিরাজী প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।

১. কুল্লিয়া আয়েশা ছিদ্দীকা, কৃষ্ণনগর, নেপাল-এর হাদীছের উস্তায মাওলানা অছিউল্লাহ আব্দুল হাকীম মাদানী বলেন, ‘মিয়াঁ মুহাম্মাদ যাকারিয়া (রহঃ)-এর পরিবারের সদা সতেজ পুষ্প, জ্ঞানের আকাশের সূর্য ও চন্দ্র, সালাফী মানহাজ প্রেমিক, জামা‘আত ও জমঈয়তের গর্ব মাওলানা আব্দুল্লাহ ঝান্ডানগরী নেপালের আহলেহাদীছ জামা‘আতের নির্ভরযোগ্য, গ্রহণযোগ্য, পরিচিত ও খ্যাতিমান আলেমে দ্বীন, সূক্ষ্মদৃষ্টিসম্পন্ন ও উৎসাহী দাঈ, নির্ভীক ও যোগ্য ইসলামী সাংবাদিক, উঁচুদরের বাগ্মী, গাম্ভীর্যপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদার অধিকারী এবং অসংখ্য ঈর্ষণীয় গুণ ও প্রশংসিত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন।[22]

২. মারকাযুত তাওহীদ-এর নবনির্বাচিত সভাপতি ও মাদরাসা খাদীজাতুল কুবরা-র সেক্রেটারী মাওলানা আব্দুল আযীম মাদানী ঝান্ডানগরী বলেন, ‘আমার ভাই মাওলানা আব্দুল্লাহ মাদানী ঝান্ডানগরীর জীবন তাক্বওয়ার গুণে গুণান্বিত ছিল। তিনি পুরাপুরি মুমিনের যিন্দেগী যাপন করেন। তিনি অনৈসলামিক রীতিনীতিকে অত্যন্ত অপসন্দ করতেন’।[23]

৩. মাওলানা আনীসুর রহমান মাদানী বলেন, ‘তিনি অত্যন্ত গাম্ভীর্যপূর্ণ আলেমে দ্বীন ছিলেন’।

৪. জামে‘আ সিরাজুল উলূমের শায়খুল জামে‘আহ মাওলানা খুরশীদ আহমাদ সালাফী বলেন, ‘তিনি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ অনুভূতি সম্পন্ন ও জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন। উপরন্তু অত্যন্ত ধীশক্তিসম্পন্ন ও বাস্তববাদী মানুষ ছিলেন’।

পরিশেষে বলা যায়, মাওলানা আব্দুল্লাহ মাদানী বাগ্মিতা, শিক্ষকতা, মাদরাসা প্রতিষ্ঠা, পত্রিকা প্রকাশ এবং দাওয়াতী সফরের মাধ্যমে নেপালে আহলেহাদীছ আন্দোলনে গতি সঞ্চার করেন। আহলেহাদীছ আন্দোলনের জন্য তাঁর উৎসাহ ও আগ্রহ ছিল অতুলনীয়। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন-আমীন!


[1]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, আহলেহাদীছ আন্দোলন (ডক্টরেট থিসিস), পৃ. ৪৮৭, ৪৯৪

[2]. মাওলানা মুহাম্মাদ আইয়ূব সালাফী, ‘মাওলানা আব্দুল্লাহ আব্দুত তাওয়াব মাদানী ঝান্ডানগরী পায়কারে ইলম ওয়া আমল’, মাসিক মুহাদ্দিছ (উর্দূ), জামে‘আ সালাফিইয়াহ, বেনারস, ভারত ৩৪/৪ সংখ্যা, এপ্রিল ২০১৬, পৃ. ২৮; আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃ. ৪৯৪

[3]. আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃ. ৪৯৪

[4]. মাসিক নূরে তাওহীদ, নেপাল ২৮/৯ সংখ্যা, জানুয়ারী’১৬, পৃ. ২৫; মুহাদ্দিছ, পৃ. ২৯; আস‘আদ আ‘যমী, ‘রাহীলুশ শায়খ আব্দুল্লাহ আব্দুত তাওয়াব আল-মাদানী’, মাসিক ছওতুল উম্মাহ (আরবী), জামে‘আ সালাফিইয়াহ, বেনারস, ৪৮/২ সংখ্যা, ফেব্রুয়ারী ২০১৬, পৃ. ৫৮

[5]. মুহাদ্দিছ, পৃ. ২৯; ছওতুল উম্মাহ, পৃ. ৫৮; নূরে তাওহীদ, মার্চ-এপ্রিল ২০১৬, পৃ. ৩৬।

[6]. মুহাদ্দিছ, পৃ. ৩০

[7]. মাসিক আত-তাহরীক, মার্চ’৯৮, পৃ. ৩৯; জানুয়ারী ২০১৬, পৃ. ৪৯

[8]. মুহাদ্দিছ, পৃ. ৩০-৩১; নূরে তাওহীদ, মার্চ-এপ্রিল’১৬, পৃ. ৩৭।

[9]. আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃ. ৪৯৪-৪৯৫

[10]. নূরে তাওহীদ, ২৮/৯ সংখ্যা, জানুয়ারী’১৬, পৃ. ৪।

[11]. মুহাদ্দিছ, পৃ. ৩১; ছওতুল উম্মাহ, পৃ. ৫৯

[12]. মুহাদ্দিছ, পৃ. ৩১; আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃ. ৪৯৫

[13]. আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃ. ৪৯৫

[14]. মুহাদ্দিছ, পৃ. ৩২

[15]. দ্র. মাসিক নূরে তাওহীদ, কৃষ্ণনগর, নেপাল, ২২ বর্ষ, ১১ ও ১২ সংখ্যা, মার্চ-এপ্রিল ২০১০, পৃ. ৫৪

[16]. মুহাদ্দিছ, পৃ. ৩২

[17]. তদেব, পৃ. ৩২-৩৩

[18]. আত-তাহরীক, জানুয়ারী ২০১৬, পৃ. ৪৯; ছওতুল উম্মাহ, পৃ. ৫৮; মুহাদ্দিছ, পৃ. ৩৩; পাক্ষিক তারজুমান, দিল্লী, ১-১৫ই জানুয়ারী’১৬, পৃ. ২৭।

[19]. মুহাদ্দিছ, পৃ. ৩৩।

[20]. নূরে তাওহীদ, জানুয়ারী’১৬, পৃ. ১।

[21]. নূরে তাওহীদ, জানুয়ারী ১৬, পৃ. ২৬ ঈনার কভার পেজ।

[22]. তদেব, মার্চ-এপ্রিল ২০১৬, পৃ. ১।

[23]. তদেব, জানুয়ারী’১৬ পৃ. ২৪-২৫।





মাওলানা আব্দুল্লাহ গযনভী - ড. নূরুল ইসলাম
ড. মুক্তাদা হাসান আযহারী - ড. নূরুল ইসলাম
আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর - ড. নূরুল ইসলাম
মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ)-এর ব্যাপারেকিছু আপত্তি পর্যালোচনা (শেষ কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
ইমাম নাসাঈ (রহঃ) (শেষ কিস্তি) - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
মাওলানা অহীদুয্যামান লক্ষ্মৌভী : তাক্বলীদের বন্ধন ছিন্নকারী খ্যাতিমান মুহাদ্দিছ - ড. নূরুল ইসলাম
যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) (১০ম কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) (৯ম কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
মাওলানা মুহাম্মাদ আবুল কাসেম সায়েফ বেনারসী (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - ড. নূরুল ইসলাম
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) (শেষ কিস্তি) - ড. নূরুল ইসলাম
যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) (৮ম কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী (রহঃ) - ড. নূরুল ইসলাম
আরও
আরও
.