পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ ।

চরিত্র-মাধুর্য :

শায়খ আলবানী ছিলেন বিনয়ী, পরহেযগার, সচ্চরিত্রবান, সহনশীল ও প্রশস্ত হৃদয়ের অধিকারী। যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ হওয়া সত্বেও জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি নিজেকে একজন ‘তালিবুল ইলম’ হিসাবেই গণ্য করতেন। ছোট-বড়, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব শ্রেণীর মানুষের নিকট থেকে উপদেশ গ্রহণ করতেন। কারো সাথে বড়ত্ব প্রদর্শন করতেন না। বিনয়-নম্রতা ও তাক্বওয়া-পরহেযগারিতায় তিনি ছিলেন সালাফে ছালেহীনের একনিষ্ঠ অনুসারী। নিম্নে তাঁর চরিত্রের কয়েকটি দিক সম্পর্কে আলোকপাত করা হ’ল :

পরহেযগারিতা :

জীবনের সর্বক্ষেত্রে তিনি ছহীহ সুন্নাহর পূর্ণ অনুসরণের প্রতি ছিলেন তীব্র আকাঙ্ক্ষী। যেকোন আমলের সঠিক নিয়ম, সঠিক সময় ও সঠিক সংখ্যার প্রতি যেমন পূর্ণ নযর রাখতেন; তেমনি খাদ্য-পানীয় ও পোষাকাদি পরিধান থেকে শুরু করে সকল বৈষয়িক ক্ষেত্রে শারঈ নীতিমালা বাস্তবায়নের প্রতি পূর্ণ সতর্ক থাকতেন।[1] শায়খ মুহাম্মাদ ছালেহ আল-উছায়মীন তাঁর ব্যাপারে বলেন, ‘আলবানীর সাথে স্বল্প সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে আমি বুঝেছি, আক্বীদা-আমল উভয় ক্ষেত্রে সুন্নাহ ভিত্তিক আমল ও বিদ‘আতের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ব্যাপারে তিনি খুবই একাগ্রচিত্ত’।[2]

কুরআন তেলাওয়াত এবং পরকালীন পুরস্কার ও শাস্তির বিবরণ সম্বলিত হাদীছসমূহ শ্রবণকালে তিনি কেঁদে ফেলতেন। একইভাবে কোন আলেমের মৃত্যুসংবাদ শ্রবণে তিনি অশ্রুসিক্ত হ’তেন। তিনি বেশী বেশী নফল ছালাত ও ছিয়ামে অভ্যস্ত ছিলেন। সোমবার ও বৃহস্পতিবার নিয়মিত নফল ছিয়াম পালন করতেন। জুম‘আর দিন সময়ের অনেক পূর্বেই মসজিদে গমন করে দীর্ঘ সময় নফল ছালাত আদায় করতেন। প্রতিবছর হজ্জ ও ওমরাহ পালন করতেন। কোন কোন বছর একাধিকবার ওমরাহ করতেন। তিনি ত্রিশ বারেরও বেশী হজ্জব্রত পালন করেন।[3] এছাড়া বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে তাঁর পরহেযগারিতা ফুটে ওঠে। যেমন-

(১) শায়খ মুহাম্মাদ ঈদ আববাসী বলেন, ‘আমরা কয়েকজন দ্বীনী ভাই শায়খ আলবানীর সাথে তারাবীহর ছালাত আদায় করতাম। তিনি দীর্ঘ রুকূ ও সিজদাসহ সুন্নাহর সূক্ষ্ম অনুসরণের মাধ্যমে প্রায় তিন ঘন্টা ব্যাপী ছালাত আদায় করতেন। প্রত্যেক রুকূতে তিনি ৮-৯ মিনিট ব্যয় করতেন। একবার শায়খ আলী খাশান তারাবীহর ছালাতের মধ্যবর্তী সময়ে কোন একটি মাসআলা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন ইবাদতের সময়। জ্ঞানার্জনের সময় নয়।[4]

(২) মরক্কোর রাষ্ট্রীয় শিক্ষা বিভাগের সদস্য, লেখক, ঐতিহাসিক ও বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বপালনকারী প্রফেসর আব্দুল হাদী আত-তাযী (১৯২১-২০১৫ খৃ.) বলেন, ‘শায়খ নাছিরুদ্দীন আলবানী যখন মরক্কো সফরের এরাদা করলেন, তখন আমি তাঁকে রাষ্ট্রীয় আতিথ্য দানের ব্যাপারে তৎকালীন বাদশাহ হাসান দ্বিতীয়-এর সাথে আলাপ করলাম। তাঁর নিকটে আলবানীর মর্যাদা ও ইলমী অবস্থান তুলে ধরলাম। ফলে বাদশাহ তাঁর জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় তিনটি গাড়ির বহর ও পাঁচ তারকা হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিলেন। সাথে সাথে রাষ্ট্রীয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত পান্ডুলিপির ভান্ডার তাঁর ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করার নির্দেশ দিলেন। আমি অত্যন্ত খুশী হয়ে বাদশাহকে এরূপ ব্যবস্থা করার জন্য ধন্যবাদ জানালাম এবং আলবানীর সাথে যোগাযোগ করে তাঁকে এই সুসংবাদ শুনালাম।

কিন্তু আমাকে বিস্মিত করে তিনি এতে অসন্তুষ্ট ও রাগান্বিত হ’লেন এবং রাষ্ট্রীয় গ্রন্থাগার ব্যবহারের বিষয়টি ব্যতীত সকল রাষ্ট্রীয় মর্যাদা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালেন। অতঃপর বললেন, যদি আপনি আমাকে সম্মান জানাতে চান, তবে আপনার নিজস্ব গাড়িটি আমাকে দিবেন। আর আমি সফরকালে শহরের কয়েকজন আলেমের সান্নিধ্যে অবস্থান করব।

প্রফেসর তাযী বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমি খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম। বাদশাহর নিকটে এখন আমি কি ওযর পেশ করব? কি বলব তাঁকে? তারপর বাদশাহর সাথে যোগাযোগ করে বললাম, আলবানী আপনার প্রতি শুকরিয়া জ্ঞাপন করেছেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় আতিথেয়তা গ্রহণে ওযর পেশ করেছেন। বাদশাহ বিস্মিত হয়ে বললেন, অস্বীকৃতি জানিয়েছেন! আমি বললাম, অস্বীকৃতি নয়, তবে...। বাদশাহ আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, না কোন অসুবিধা নেই। তিনি সত্যিই একজন ঈমানদার আলেম। প্রফেসর তাযী বলেন, এ ঘটনার ফলে আলবানীর প্রতি আমার ভালোবাসা যোজন যোজন বৃদ্ধি পায়’।[5]

(৩) রিয়াদের দারুছ ছুমাই‘ঈর প্রধান আব্দুললাহ ইবনু হাসান আছ-ছুমাই‘ঈ বলেন, ‘শায়খ আলবানী বাদশাহ ফায়ছাল পুরস্কার লাভের পর আমি খুবই আনন্দিত হয়ে তাকে স্বাগত জানানোর জন্য গেলাম। তখন তিনি বললেন, ‘আল্লাহ আপনাকে আরো কল্যাণের সুসংবাদ দিন! আপনি আল্লাহর নিকটে দো‘আ করুন! তিনি যেন আমাদেরকে জান্নাতে প্রবেশের সুসংবাদ দান করেন’।[6]

(৪) ঈদ আববাসী বলেন, ‘দাওয়াতী সফর, শিক্ষাদান বা কারো সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে সঊদী আরব ও জর্দানের বিভিন্ন শহরে আমরা তাঁর সাথী হয়েছি। সেক্ষেত্রে গাড়ির প্রয়োজন হ’লে তিনি তাতে গ্যাস ভরে নিতেন এবং নিজে তাঁর মূল্য পরিশোধ করতেন। আমরা তাঁর আগেই তা পরিশোধের চেষ্টা করলে তিনি অনুমতি দিতেন না। বরং বলতেন, যানবাহনের খরচ আমার উপরেই ছেড়ে দাও। এ সফরটি যেন শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য ও তাঁর দ্বীনের খেদমতে কবুলযোগ্য হয়’।[7] 

(৫) একবার আলবানী জর্দানের মাফরাক শারকী শহরের শুওয়াইকা এলাকায় আয়োজিত একটি ইলমী বৈঠকে আলোচনা পেশ করার জন্য গমন করলে তাঁর বক্তব্যের পূর্বে স্থানীয় বিদ্বান প্রফেসর ইবরাহীম স্বাগত ভাষণে বলেন, ‘...এক্ষণে আমরা আমাদের শায়খ, বিশিষ্ট আলেম ও মহান শিক্ষাগুরু মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানীর সাথে মিলিত হব এবং সুন্দর একটি সময় অতিবাহিত করব। আমি শুওয়াইকা এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে বিশেষত এখানকার তালিবে ইলমদের পক্ষ থেকে তাঁকে স্বাগত জানাচ্ছি। যারা সবাই আজকের দিনটি সম্মানিত উস্তাদের সাথে কাটাতে এবং তাঁর ইলম ও হিকমতের মণি-মুক্তা থেকে কিছু শ্রবণের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে’। 

অতঃপর আলবানী তাঁর বক্তব্য শুরু করেন এবং হামদ ও ছানা পাঠের পর তিনি বলেন, ‘প্রিয় ভাই প্রফেসর ইবরাহীমকে তাঁর বক্তব্য ও স্ত্ততিবাদের জন্য ধন্যবাদ। এরূপ ক্ষেত্রে রাসূল (ছাঃ)-এর পর ইসলামের প্রথম খলীফা আবূ বকর ছিদ্দীক (রাঃ)-এর অনুসরণ ব্যতীত আমার কিছুই বলার নেই। যখন তিনি কাউকে তাঁর প্রশংসা করতে শুনতেন... আমার মনে হয় বিশেষত যখন কেউ তাঁর প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করে ফেলতো, যদিও তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর যথার্থ প্রতিনিধি ছিলেন...। একথা বলে আলবানী কেঁদে ফেলেন এবং ক্রন্দনের আধিক্যে অল্পক্ষণের জন্য বক্তব্য বন্ধ হয়ে যায়। অতঃপর তিনি বলেন, আবূবকর (রাঃ) বলতেন, اللهُمَّ لَا تُؤَاخِذْنِي بِمَا يَقُولُونَ، وَاغْفِرْ لِي مَا لَا يَعْلَمُونَ، وَاجْعَلْنِي خَيْرًا مِمَّا يَظُنُّونَ، ‘হে আল্লাহ! তারা যা বলছে সে ব্যাপারে তুমি আমাকে পাকড়াও করো না। আমার যেসব পাপ সম্পর্কে তারা জানে না, তা ক্ষমা করে দাও। তুমি আমাকে তাদের ধারণার চেয়ে উত্তম বানাও’।[8] এটাই বলতেন মহান সত্যবাদী আবূবকর (রাঃ)! তাহ’লে আমরা কিইবা বলতে পারি? 

সত্য সত্যই আমি বলছি। একটু আগে আমার সম্মানিত ভাই ইবরাহীমের নিকট থেকে আমি যা শুনলাম, আমি সেসব গুণের অধিকারী নই। আমি একজন জ্ঞানান্বেষী বৈ কিছুই নই। আর প্রত্যেক জ্ঞানান্বেষীর উচিত রাসূল (ছাঃ)-এর ঐ বাণীর অনুসারী হওয়া, যেখানে তিনি বলেছেন, ‘তুমি আমার পক্ষ থেকে একটি আয়াত হ’লেও তা প্রচার কর’।[9]

(৬) ১৯৮৪ খৃষ্টাব্দে সঊদী আরব সফরকালে তাঁর এক সঊদী সাথী তাঁকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান এবং বলেন যে, আপনার আগমনে সেখানে ত্রিশ লক্ষাধিক মানুষ উপস্থিত হবে ইনশাআল্লাহ। একথা শুনে আলবানী অস্বীকৃতি জানালেন। বারংবার নিবেদন এমনকি একদিনের জন্য যাওয়ার আবেদনেও তিনি রাযী হ’লেন না। বাসায় ফিরে আসার পর তাঁর একনিষ্ঠ সাথী আবূ লাইলা দাওয়াত কবুল না করার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, إني أخشي علي نفسي الفةنة ‘আমি আমার নিজের উপর ফিৎনার আশংকা করছি’।

(৭) একবার তিনি গাড়িতে বসেছিলেন। হঠাৎ এক ব্যক্তি তাঁকে চিনতে পেরে ছুটে এসে বলল, আপনিই কি শায়খ আলবানী? একথা শুনে আলবানী কেঁদে ফেললেন। পরে তাঁকে কাঁদার কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, ينبغي للمرء أن يجاهد نفسه وأن لا يغتر بإشارة الناس إليه ‘প্রত্যেক মানুষেরই উচিৎ স্বীয় নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ করা এবং তাঁর প্রতি মানুষের কৌতুহলের কারণে ধোঁকায় না পড়া’।[10]

বিনয় ও নম্রতা :

(১) শায়খ আবূ ইসহাক্ব আল-হুওয়াইনী বলেন, ‘একদিন আমরা কয়েকজন তাঁর বাড়িতে গেলে তিনি নিজেই দরজা খুললেন এবং সহাস্যবদনে আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানালেন। আমরা সবাই তাঁর বাড়ীর বাগানে গিয়ে বসলাম। অতঃপর তিনি আমাদেরকে নাশতা করতে বাধ্য করলেন। এসময় তিনি নিজ হাতে খাবার এনে আমাদের মাঝে পরিবেশন করছিলেন। আমি উঠে সাহায্য করতে চাইলাম। কিন্তু তিনি অস্বীকৃতি জানিয়ে আমাকে বসার নির্দেশ দিলেন। বিব্রত হয়ে আমি বললাম, শায়খ! আমি বসে থাকব আর আপনি আমার খেদমত করবেন, এটা তো আমার জন্য খুবই অভদ্রতার পরিচয়। উত্তরে তিনি মনে রাখার মত যে কথাটি বললেন তা হ’ল, ‘নির্দেশ মান্য করাই প্রকৃত আদব, বরং তা আদব রক্ষার চেয়েও উত্তম’।[11]

(২) আলবানীর প্রিয় ছাত্র আলী হালাবী বলেন, ‘একদিন আমি শায়খকে জিজ্ঞেস করলাম যে, আপনার মৃত্যুর পর আমরা ইলমে হাদীছে কার উপর নির্ভর করব? তিনি বললেন, ‘তোমরা নিজেদের উপরেই নির্ভরশীল হও। আমি কামনা করি তোমরা আলবানীর চেয়েও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করবে’।

(৩) ইছাম হাদী বলেন, ‘একদিন আমি তাঁকে একটি মাসআলা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, এটা আমার জানা নেই। আগামীকাল আমাকে জিজ্ঞেস করো। হয়তো আল্লাহ তা‘আলা এ ব্যাপারে আমার হৃদয়ে কিছু উদ্ভাসিত করবেন। কিন্তু পরের দিন আমি জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আল্লাহ আমার মধ্যে এ ব্যাপারে কিছুই খুলে দেননি’।

(৪) তিনি প্রায়ই বলতেন, أنا طُوَيْلِبُ العلم ‘আমি নগণ্য জ্ঞানান্বেষী মাত্র’। তাঁর ঘনিষ্ঠ ছাত্র ইছাম হাদী একদিন তাঁকে বললেন, ‘আপনি যদি নিজেকে নগণ্য জ্ঞান না করে কেবল طالب العلم বা ‘জ্ঞানান্বেষী’ বলতেন, তাহ’লে আমাদের মত ছাত্ররা নিজেদেরকে طويلب العلم বলতে পারতাম! আলবানী হেসে ফেললেন এবং পুনরায় বললেন, না আমি طويلب العلم বা ‘নগণ্য জ্ঞানান্বেষী’।[12]

(৫) শায়খ আব্দুললাহ ‘আলূশ বলেন, শায়খ আলবানী ছিলেন সচ্চরিত্রবান, সহনশীল, প্রজ্ঞাবান ও প্রশস্ত হৃদয়ের অধিকারী। ...তিনি ছিলেন সংযমী হৃদয়ের মানুষ। স্বীয় উপার্জন দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। ট্রাম বা যানবাহনে তাঁর যাতায়াতের ভাড়া আমাদের দেওয়ার সুযোগ দিতেন না। বরং তাঁর সঙ্গী-শুভাকাঙ্ক্ষীদের ভাড়া নিজেই পরিশোধ করতেন। তিনি বলতেন, ‘আমি ঐ শায়খদের বিরোধিতা করি, যারা তাদের ভক্ত-অনুরক্তদের মাল-সম্পদের উপর কর্তৃত্ব করেন’। তিনি কোন হুকুম পেশ করার ক্ষেত্রে তার দলীল জেনে নেওয়ার ব্যাপারে আমাদের প্রশিক্ষণ দিতেন। বলতেন, ‘তোমার কি হয়েছে! তুমি এর দলীল ও তার বিশুদ্ধতার ব্যাপারে আমাকে প্রশ্ন করছো না!’ ... তিনি সবসময় আমাদেরকে ইবাদতের ক্ষেত্রে খুশূ-খুযূ বজায় রাখার নির্দেশনা দিতেন।[13]

ভুল-ত্রুটি স্বীকারে দ্ব্যর্থহীন :

ভুল স্বীকারের ব্যাপারে আলবানী ছিলেন সালাফে ছালেহীনের একনিষ্ঠ অনুসারী। কেউ তাঁর কোন ভুল ধরিয়ে দিলে সেটাকে তিনি নিজের জন্য মর্যাদাহানিকর মনে করতেন না। বরং নির্দ্বিধায় মেনে নিতেন এবং তার জন্য দো‘আ করতেন। এমনকি তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থে অনেক স্থানে তিনি এরূপ ভুল সংশোধনের জন্য ভুল ধরিয়ে দেওয়া ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছেন।[14] যেমন-

(১) একদিন জনৈক ছাত্র শায়খ আলবানীর একটি ভুল ধরিয়ে দিলে তিনি তার জন্য দো‘আ করে বললেন, ‘এর জন্য আল্লাহ তোমাকে উত্তম জাযা দান করুন এবং আমাদের পারস্পরিক মহববতকে এমন মহববতে পরিণত করুন, যা পরস্পরকে উপদেশ প্রদান এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম হয়। কেননা অনেক মানুষ অপরকে বলে থাকে যে, আমি তোমাকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসি। কিন্তু যখনই ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় সে কোন দোষ-ত্রুটি করে ফেলে, তখন তাকে দূরে ঠেলে দেয় ও তার মর্যাদাহানি করে। এটা কখনোই ‘আল্লাহর জন্য ভালোবাসা’র নিদর্শন নয়। বরং যখন আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পরস্পরকে উপদেশ দেওয়া হবে তখনই তা প্রকৃত ভ্রাতৃত্ব বলে গণ্য হবে। সুতরাং যখন তুমি আমার কোন ভুল-ত্রুটি দেখবে, তখন অবশ্যই আমাকে সংশোধন করে দিবে’।[15] তিনি বলতেন, السَّعيد من وُعظ بغيره ‘সৌভাগ্যবান সেই যে অন্যের দ্বারা উপদেশ প্রাপ্ত হয়’।

(২) জনৈক ব্যক্তি শায়খ আলবানীকে তাখরীজের ক্ষেত্রে তাঁর যেসব ভুল হয়েছে এবং পরবর্তীতে সংশোধন করেছেন সে ব্যাপারে জিজ্ঞেস করল। উত্তরে তিনি বললেন, ‘যদি তুমি জিজ্ঞেস কর যে, আলবানী কি তাঁর কোন কিতাবে ভুল করেছেন এবং পরে তা শুদ্ধ করেছেন? তাহ’লে আমি স্বীকার করব যে, সেখানে আমি কিছু ভুল করেছিলাম, যা পরে সংশোধন করেছি। কেননা ইমাম শাফেঈ বলেছেন, أبي الله أن يتم إلا كتابه، بس كتاب الله هو التمام- ‘আল্লাহ তাঁর নিজের কিতাব ব্যতীত অন্য কোন কিতাব পূর্ণাঙ্গ হওয়াকে অস্বীকার করেছেন। সুতরাং কেবলমাত্র আল্লাহর কিতাবই পূর্ণাঙ্গ’।

(৩) ইবনু কুতায়বা থেকে বর্ণিত হাদীছ الأنبياء صلوات الله عليهم أحياء في قبورهم يصلون، -এর ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘ইমাম বায়হাক্বীর বক্তব্য অনুযায়ী ইবনু কুতায়বা হাদীছটি এককভাবে বর্ণনা করেছেন মনে করে কিছুকাল আমি একে যঈফ বলে ধারণা করতাম। অতঃপর আমি মুসনাদে আবী ইয়া‘লা এবং আখবারে ইস্ফাহান গ্রন্থদ্বয়ে উল্লেখিত সনদ তদন্ত করে নিশ্চিত হ’লাম যে, এর সনদ ‘শক্তিশালী’। ইবনু কুতায়বা কর্তৃক একক সনদে বর্ণিত বলে ধারণা করা সঠিক নয়। সেকারণে ইলমী আমানত আদায় ও দায়মুক্তির লক্ষ্যে আমি হাদীছটি সিলসিলা ছহীহায় সংকলন করলাম। যদিও এটা অজ্ঞ ও বিদ্বেষপরায়ণদের অন্যায় আক্রমণ, কুৎসা ও কটাক্ষের পথ খুলে দেবে। তবে যেহেতু আমি দ্বীনী আবশ্যকীয় দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি, তাই আমি এসব সমালোচনার কোন পরওয়া করি না। বরং আমি আল্লাহর নিকট নেকীর আশা করি মাত্র। সুতরাং হে সম্মানিত পাঠক! আমার কোন রচনায় যদি এই তাহক্বীক্বের বিপরীত দেখতে পাও, তবে তা পরিত্যাগ কর। অতঃপর এই তাহক্বীক্বের উপর নির্ভর কর’।[16]

শত্রুদের সম্পর্কে ইনছাফপূর্ণ নীতি :

শত্রুদের ব্যাপারে তিনি সর্বদা ইনছাফপূর্ণ নীতি অবলম্বন করতেন। কেউ তাঁর প্রতি শত্রুতা পোষণ করলেও তিনি তার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করতেন না বা কাউকে করার পরামর্শও দিতেন না। যেমন-

(১) একদিন জনৈক ছাত্র আলবানীকে বলেন, এক ব্যক্তি আপনার প্রতি শত্রুতা পোষণ করে এবং আপনার বিরুদ্ধে বিভিন্ন কথা বলে থাকে। আমরা কি তার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করব? আলবানী বলেন, ‘সে কি আলবানীর সাথে ব্যক্তিগত শত্রুতা পোষণ করে, না আলবানী কিতাব ও সুন্নাহ মোতাবেক যে আক্বীদা পোষণ করে এবং যার প্রতি মানুষকে আহবান করে, সে ব্যাপারে শত্রুতা পোষণ করে? যদি সে কিতাব ও সুন্নাহর আক্বীদার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে, তাহ’লে তার কথার জবাব দিতে হবে এবং তার ব্যাপারে ধৈর্যধারণ করতে হবে। এরপর যদি মনে কর যে, তার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করাই অধিক কল্যাণকর ও উপকারী, তাহ’লে তাই করতে হবে। আর যদি আলবানীর প্রতি সে ব্যক্তিগত শত্রুতা পোষণ করে, কিন্তু কিতাব ও সুন্নাহর সীমারেখার ব্যাপারে আমাদের সাথে একমত থাকে, তাহ’লে তার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করা যাবে না’।[17]

(২) আরেকদিন এক যুবক তাঁকে সালাম দিয়ে বলল, হে শায়খ! আমি শরী‘আ অনুষদের ছাত্র। আমাদের কয়েকজন ডক্টরেট ডিগ্রীধারী শিক্ষক আপনার সমালোচনা করেন ও কটূ কথা বলেন, বিশেষত অমুক অমুক ব্যক্তি। জবাবে আলবানী বললেন, ‘হে ভাই! কোন ব্যক্তির মিথ্যা বলার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে যা কিছু শ্রবণ করে, তা-ই মানুষের নিকট বলে বেড়ায়। অতএব জ্ঞানার্জনের সুযোগ পেলে তা কাজে লাগাও এবং তোমার দ্বীনী উপকারে আসতে পারে এমন কিছু জানার থাকলে প্রশ্ন কর!’ [18]

মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ :

তাঁর কোন কর্মের পিছনে কারো অবদান থাকলে তিনি তার শুকরিয়া আদায়ে ছিলেন সদা তৎপর। স্বীয় গ্রন্থসমূহের বিভিন্ন স্থানে নাম উল্লেখসহ অনেকের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। যেমন-

(১) ‘আল-আয়াতুল বাইয়িনাত’ বইয়ের ভূমিকায় তিনি বলেন, ‘জামে‘আ ইসলামিয়াহ মদীনা’য় অন্যান্যবারের সফরের ন্যায় শেষ সফরকালেও আমি জামে‘আর লাইব্রেরীতে বিশ্বের বিভিন্ন লাইব্রেরী থেকে সংরক্ষিত হাদীছ বিষয়ক ও অন্যান্য বিরল পান্ডুলিপিসমূহের গুরুত্বপূর্ণ কপি অধ্যয়নের জন্য যাওয়া-আসা করি। এটা ছিল জামে‘আ ইসলামিয়াহর বর্তমান ভাইস চ্যান্সেলর সম্মানিত শায়খ আব্দুল মুহসিন আল-‘আববাদ ও সঊদী আরবের গবেষণা ও ফাতাওয়া বিভাগের প্রধান সম্মানিত শায়খ আব্দুল আযীয বিন আব্দুললাহ বিন বায-এর প্রচেষ্টা ও ইচ্ছার ফল। আল্লাহ তা‘আলা তাদের উভয়কে উত্তম জাযা দান করুন এবং তাদেরকে ও অন্যান্য দায়িত্বশীলবৃন্দকে এই গুরুত্বপূর্ণ ও মহান কার্যক্রম ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত রাখার তাওফীক দিন’।[19]

(২) ‘ইরওয়াউল গালীল’ গ্রন্থটির ভূমিকায় তিনি বলেন, ‘গ্রন্থটি রচনার পিছনে পুরো অবদান মহান ভাই প্রফেসর যুহাইর শাবীশের। তিনি গ্রন্থটি মানুষের মাঝে প্রকাশের ব্যাপারে খুবই আগ্রহী ছিলেন’।[20]

ওলামায়ে কেরামের প্রতি সম্মান :

আলেম-ওলামার প্রতি সম্মান প্রদর্শনে আলবানী সবসময় ছিলেন অগ্রগামী। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিদ্বানগণ তাঁর সাথে সাক্ষাতের জন্য আগমন করতেন। নিজ গৃহে তিনি তাদের যাবতীয় মেহমানদারীর ব্যবস্থা করতেন। নিজেই গাড়ী চালিয়ে তাঁদেরকে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যেতেন। তাঁদের মর্যাদার প্রতি পূর্ণ দৃষ্টি রাখতেন। যেমন-

(১) শায়খ আহমাদ সালেক শানক্বীত্বী (১৯২৮-২০১০ খৃ.)-কে শায়খ আলবানী খুবই সম্মান করতেন। তাঁর কাছে কোন ফৎওয়া আসলে কোন কোন সময় তিনি শায়খ শানক্বীত্বীর নিকট থেকে জেনে নিতেন। একবার তিনি বলেছিলেন, ‘আমি শায়খ সালেকের মজলিসকে স্বর্ণের বিনিময়ে ক্রয় করব’। এছাড়াও তিনি তাঁকে জর্দানের সবচেয়ে প্রাজ্ঞ ফক্বীহ বলে আখ্যায়িত করতেন।

(২) ইছাম হাদী বলেন, ‘আমি একদিন শায়খ আলবানীকে শায়খ আরনাউত্বের নাম উচ্চারণ না করে তাঁকে ‘الإحسان في تقرير صحيح ابن حبان-এর তা‘লীক্ব প্রদানকারী’ বলার কারণ জিজ্ঞেস করলাম। উত্তরে তিনি বললেন, ‘আমি শায়খ শু‘আইব আরনাউত্ব সম্পর্কে যে উচ্চ ধারণা পোষণ করি, তাতে তিনি এরূপ ভুল করতে পারেন না। আমার বিশ্বাস এটা তাঁর অধীনে যারা কাজ করে তাদের ভুল। তবে যখনই আমার ধারণা হবে যে, এটা শু‘আইব আরনাউত্বেরই ভুল, কেবল তখনই আমি তাঁর নাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ করব’।[21]

(৩) ‘মারকাযী জমঈয়তে আহলেহাদীছ হিন্দ’-এর সাবেক আমীর ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম মাওলানা মুখতার আহমাদ নদভী বলেন, ‘১৯৭২ খৃষ্টাব্দে আমি যখন দামেশকে শায়খ আলবানীর দরসগাহে তাঁর সাথে সাক্ষাতের জন্য যাই, তখন ছাত্রদের ভিড়ের মধ্যে তিনি বসেছিলেন। হঠাৎ আমাকে দেখতে পেয়ে তিনি অত্যন্ত আগ্রহের সাথে আমাকে আহবান করলেন এবং নিজ গৃহে খাদ্যগ্রহণের দাওয়াত দিয়ে বললেন, এটা ব্যতীত আমাদের এ সাক্ষাৎ পূর্ণতা পাবে না। অতঃপর তিনি যোহরের ছালাতের পর নিজ গাড়ীতে করে আমাকে তাঁর বাড়ীতে নিয়ে গেলেন। পথিমধ্যে দামেশকের প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থানসমূহ দেখালেন। হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ)-এর কবর দেখালেন। দূর থেকে সেই দূর্গ দেখিয়ে দিলেন, যে দূর্গে ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ)-কে বন্দী করে রাখা হয়েছিল এবং যেখানে তাঁর কবরও রয়েছে। খাদ্যগ্রহণের পর তিনি আমাকে দামেশকের প্রখ্যাত আলেম শায়খ মুহাম্মাদ বাহজা বাইতারের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য তাঁর বাড়ীতে নিয়ে গেলেন। সেখানে গিয়ে সিরিয়ার আরো অনেক বিদ্বানের সাথে সাক্ষাৎ হ’ল’।[22]

(৪) ইছাম হাদী বলেন, ‘আলবানীর কুর্দী বংশোদ্ভূত ছাত্র ইরাকের প্রখ্যাত মুহাদ্দিছ হামদী আব্দুল মাজীদ সালাফী (১৯৩১-২০১২ খৃ.) একবার জর্দানে আগমন করলে তিনি তাঁর সম্মানে কয়েকটি ইলমী মজলিসের আয়োজন করেন। অতঃপর বিদায়ের পূর্বে সর্বশেষ মজলিস সমাপ্ত হ’ল। আলবানী তাঁর সাথে বিদায়ী কোলাকুলির সময়ে উভয়ে এমনভাবে অশ্রুপাত করলেন, যা আমরা কখনো দেখিনি। অতঃপর তাঁকে নিজ গাড়িতে উঠিয়ে আমার মামা ইবরাহীম শাকরাহ-এর বাসায় রেখে আসলেন এবং পরদিন সকালে তাঁকে নিজের গাড়িতে করে বিমানবন্দরে রেখে আসবেন বলে ওয়াদা করলেন’।[23]

(৫) হিন্দুস্থানী বিদ্বান শায়খ হাবীবুর রহমান আ‘যমী শায়খ আলবানীর বিরুদ্ধে ‘আলবানী : শুযূযুহূ ওয়া আখত্বাউহূ’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। যেখানে আলবানীর বিরুদ্ধে অনেক অসত্য বিবরণ ও নিন্দাবাদ করা হয়েছে। একবার শায়খ আ‘যমী সিরিয়া সফরে এসে দামেশকে গমন করেন এবং আলবানীর আতিথেয়তায় তাঁর বাসায় কয়েকদিন অবস্থান করেন। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আলবানী মেহমানের সম্মান, বয়োজ্যেষ্ঠতা এবং তাঁর প্রতি সুধারণাবশত উক্ত বইয়ের ব্যাপারে কিছুই বলেননি। অতঃপর শায়খ আ‘যমী সিরিয়ার হালবে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলে আলবানী নিজ গাড়ীতে তাঁকে রেখে আসেন। এসময় শায়খ ঈদ আববাসী ও প্রফেসর আলী খাশানও তাদের সাথী হন। চলার পথে তাঁরা শায়খ আ‘যমীর নিকটে বিরোধপূর্ণ বিভিন্ন মাসআলা সম্পর্কে জানতে চান। কিন্তু সকল প্রশ্নে তাঁর উত্তর ছিল, শায়খ আলবানীকে জিজ্ঞেস করুন। অতঃপর এক পর্যায়ে বললেন, ইমাম মালিক তো মদীনায় উপস্থিত, তাই তিনি ফৎওয়া দিবেন না। অতঃপর আলবানী সেগুলোর জবাব দেওয়া শুরু করলেন। আর তিনি প্রত্যেক উত্তরে কেবল মাথা নাড়িয়ে এবং ‘ছহীহ’ বলে সম্মতি জ্ঞাপন করছিলেন।[24]

অনুসৃত মানহাজ :

শারঈ বিষয়ে আলবানীর অনুসৃত মানহাজ ছিল জীবনের সর্বক্ষেত্রে সালাফে ছালেহীনের বুঝ মোতাবেক কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণ এবং নির্দিষ্ট কোন মাযহাবকে অগ্রাধিকার না দিয়ে সুন্নাতে রাসূল (ছাঃ)-এর অনুসরণ। স্বীয় মানহাজের ক্ষেত্রে মূলত তিনি শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (৬৬১-৭২৮ হি.), তাঁর জগদ্বিখ্যাত ছাত্র হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম আল-জাওযিইয়াহ (৬৯১-৯৫১ হি.) ও মুহাম্মাদ ইবনু আব্দিল ওয়াহহাব (১১১৫-১২০৬ হি.)-এর অনুসৃত মানহাজ দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তবে অনেক মাসআলার ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে তাঁদের বিরোধিতা করেছেন। তাঁর নিকটে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত দলীলের ভিত্তিতে প্রয়োজনমত কোন মাসআলাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন, কখনো সমালোচনাও করেছেন। যেমন তিনি বলেন,

‘আমাদের মানহাজ সালাফে ছালেহীনের বুঝ মোতাবেক কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণের উপর প্রতিষ্ঠিত। আমার বিশ্বাস বর্তমান সঊদী আরবে বহু ওলামায়ে কেরাম এ নীতির উপর রয়েছেন। আমাদের ন্যায় তারাও প্রথমত শায়খুল ইসলাম আহমাদ ইবনু তায়মিয়াহর দ্বারা, অতঃপর তাঁর ছাত্র ইবনুল ক্বাইয়িম আল-জাওযিয়াহ এবং পরবর্তীতে তাদের নীতি ও পদ্ধতির উপর পরিচালিত যেমন শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দিল ওয়াহহাব-এর দ্বারা প্রভাবিত, যিনি নজদ অঞ্চলে তাওহীদের দাওয়াতকে প্রথমবারের মত পুনর্জীবিত করার ক্ষেত্রে বিশেষ কৃতিত্বের অধিকারী’।[25]

তিনি আরো বলেন, ‘যখন আমি নিজের জন্য ছহীহ সুন্নাহ অাঁকড়ে ধরার এ নীতি নির্ধারণ করলাম এবং এই গ্রন্থসহ অন্যান্য গ্রন্থে নীতির উপরেই পরিচালিত হ’লাম...। আমি জানি যে এই নীতির ক্ষেত্রে সকল দল ও মতবাদের অনুসারীবৃন্দ সন্তুষ্ট হবে না। ...তবে আমার জন্য আমার এ দৃঢ় বিশ্বাসই যথেষ্ট যে, এই পথ সঠিক পথ। আল্লাহ তা‘আলা এ পথে চলার প্রতিই মুমিনদের নির্দেশ দিয়েছেন। নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) এ পথেরই বিবরণ দিয়েছেন। সালাফে ছালেহীন তথা ছাহাবা, তাবেঈন ও তৎপরবর্তীগণ, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন ইমাম চতুষ্টয়; আজকের দিনে অধিকাংশ মুসলমান যাদের সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করে থাকে, প্রত্যেকেই সুন্নাহকে দৃঢ়ভাবে অাঁকড়ে ধরা ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে এবং এর বিপরীত যাবতীয় বক্তব্য যতই মহান হৌক না কেন, তা পরিত্যাগের ব্যাপারে একমত। কারণ রাসূল (ছাঃ)-এর মর্যাদা সর্বাধিক, তাঁর প্রদর্শিত পথই সঠিক। সেকারণে আমি সালাফদের দিক-নির্দেশনা মেনে চলি, তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করি, হাদীছ অাঁকড়ে ধরার ব্যাপারে তাদের নির্দেশ পালন করি, যদিও তা তাদের কোন বক্তব্যের বিপরীত হয়’।[26]

দাওয়াতের সারকথা :

আলবানীর দাওয়াত ছিল বিশুদ্ধ দ্বীনের দাওয়াত। তাওহীদ তথা আল্লাহর একত্বকে সুরক্ষিত রেখে যাবতীয় শিরক ও বিদ‘আত থেকে দূরে থাকার দাওয়াত। জীবনের সর্বক্ষেত্রে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের নিঃশর্ত অনুসরণ এবং শরী‘আত নির্দেশিত আদব-আখলাকে ভূষিত হওয়ার দাওয়াত। নিম্নে তাঁর দাওয়াতের মূল বক্তব্যসমূহ উল্লেখ করা হ’ল- 

(১) পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছকে ইসলামী শরী‘আতের মূল উৎস হিসাবে পরিগ্রহণ এবং সালাফে ছালেহীনের বুঝ মোতাবেক তা অনুধাবন। কেননা কুরআন ও হাদীছ ছাহাবায়ে কেরামের বুঝ ব্যতীত শুধুমাত্র মানবীয় জ্ঞান দ্বারা অনুধাবন করা সম্ভব নয়। ছাহাবীগণের ব্যাখ্যাকে উপেক্ষা করার কারণেই যুগে যুগে খারেজী, মু‘তাযিলা, মুরজিয়া প্রভৃতি বাতিল ফিরক্বাসমূহের উদ্ভব ঘটেছে। দেখা দিয়েছে নানা প্রকার বাড়াবাড়ি ও মতপার্থক্য।

(২) আল্লাহর ওয়াহদানিয়াত বা একত্বের দিকে মানুষকে আহবান করা এবং তাঁর নাম ও গুণাবলীর ক্ষেত্রে সালাফে ছালেহীনের আক্বীদা তুলে ধরা।

(৩) মানব সমাজকে সঠিক দ্বীন সম্পর্কে অবহিত করা, তার

শিক্ষা ও বিধান অনুযায়ী আমলে অভ্যস্ত করে তোলা এবং শরী‘আত প্রদত্ত আদব-আখলাকে ভূষিত হওয়ার প্রতি আহবান করা। যার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং দুনিয়া ও আখেরাতের প্রকৃত সফলতা অর্জিত হবে।

(৪) যুগের পরিক্রমায় দ্বীনের মধ্যে ধর্মের নামে অনুপ্রবিষ্ট নানাবিধ শিরক, বিদ‘আতী রসম-রেওয়াজ এবং ভ্রান্ত মতবাদ থেকে মুসলমানদের সতর্ক করা।

(৫) হাদীছ গ্রন্থসহ বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থাবলীতে সংকলিত যঈফ ও জাল হাদীছসমূহ চিহ্নিত করা এবং মানুষকে তা অবহিত করা। সাথে সাথে ছহীহ সুন্নাহর উপর দৃঢ় থাকার চেতনাকে জাগিয়ে তোলা, ইসলামে সুন্নাহর মর্যাদা তুলে ধরা, আক্বীদা ও আহকামের ক্ষেত্রে রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছের প্রামাণ্যতাকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং পরিত্যক্ত সুন্নাহসমূহ পুনর্জীবিত করা।

(৬) নির্দিষ্ট কোন মাযহাবের অন্ধ অনুসরণ পরিত্যাগ করে শারঈ নীতিমালার সীমানা সুরক্ষিত রেখে স্বাধীন চিন্তা-ভাবনা তথা ইজতিহাদের পথ পুনর্জীবিত করার মাধ্যমে চিন্তাগত স্থবিরতা দূর করা। যা বর্তমান যুগে অধিকাংশ মুসলমানের চিন্তাধারায় পরিলক্ষিত হয় এবং এ স্থবিরতা তাদেরকে কুরআন ও ছহীহ হাদীছের উপর আমল করা থেকে দূরে রেখেছে।

(৭) পরিপূর্ণ ইসলামী জীবন ফিরিয়ে আনা, ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং পৃথিবীর বুকে আল্লাহর হুকুম বাস্তবায়ন করার নিরন্তর প্রচেষ্টা চালানো।

(৮) যুগের পরিক্রমায় দেখা দেওয়া নানাবিধ সমস্যার বাস্তবসম্মত শারঈ সমাধান পেশ করা।[27]

(চলবে)


[1]. আব্দুল আযীম উমরী মাদানী, মুহাদ্দিছে ‘আছর আল্লামা নাছিরুদ্দীন আলবানী (কর্নাটক, ভারত : দারুল হুদা, ১ম প্রকাশ, ২০০৯ খ্রি.), পৃ. ১৭।

[2]. হায়াতুল আলবানী ওয়া আছারুহু, পৃ. ৫৪৩।

[3]. নাছিরুদ্দীন আলবানী; মুহাদ্দিছুল ‘আছর ওয়া নাছিরুস সুন্নাহ, পৃ. ৪৭।

[4]. ইমাম আলবানী : দুরূস ওয়া মাওয়াক্বিফ ওয়া ‘ইবার, পৃ. ৮৮-৮৯।

[5]. শায়খ হানী আল-হারেছীর নিকট সংরক্ষিত প্রফেসর আব্দুল হাদী আত-তাযীর রেকর্ডকৃত বক্তব্য থেকে গৃহীত। ওয়েবলিংক- www. alalbani.info/alalbany_misc_0039.php.10.02.2019.

[6]. আলবানী, ছহীহ মাওয়ারিদিয যামআন ইলা যাওয়াইদি ইবনি হিববান (রিয়াদ : দারুছ ছুমাই‘ঈ, ১ম প্রকাশ, ২০০২ খ্রি.), পৃ. ৩।

[7]. মাক্বালাতুল আলবানী, পৃ. ১৭৬।

[8]. আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৭৬১।

[9]. বুখারী হা/৩২৭৪; সিলসিলাতুল হূদা ওয়ান নূর, ৬৪০-৬৪২ নং টেপ, আবূ লাইলা আছারী কর্তৃক রেকর্ডকৃত, https://archive.org /details/Silsilat_Al-Huda_Wan-Noor, 17.03.2019

[10]. ইমাম আলবানী : দুরূস ওয়া মাওয়াক্বিফ ওয়া ‘ইবার, পৃ. ১২৬।

[11]. আবূ ইসহাক্ব আল-হুওয়াইনী, বাদরুত তামাম ফী তারজামাতিশ শায়খ আল-ইমাম (অডিও টেপ), https://audio.islamweb.net/audio/ index.php?page=FullContent&audioid=87871#227577

[12]. মুহাদ্দিছুল ‘আছর ইমাম আলবানী কামা ‘আরাফতুহ, পৃ. ২১।

[13]. নূরুদ্দীন ত্বালেব, মাক্বালাতুল আলবানী, পৃ. ১১।

[14]. আলবানী, সিলসিলাতুল আহাদীছিয যঈফাহ, ১/৬।

[15]. নাছিরুদ্দীন আলবানী, সিলসিলাতুল হুদা ওয়ান নূর, অডিও রেকর্ড নং ৮২/৩:৭, https://live.islamweb.net /audio/index.php? page=audioinfo&audioid=117570, 10.05.2019

[16]. আলবানী, সিলসিলাতুল আহাদীছিছ ছহীহাহ, ২/১৯০, হা/৬২১।

[17]. ‘ইছাম মূসা হাদী, মুহাদ্দিছুল ‘আছর ইমাম মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী কামা ‘আরাফতুহূ (জুবাইল : দারুছ ছিদ্দীক, ১ম প্রকাশ, ২০০৩ খ্রি.), পৃ. ৯৪।

[18]. ঐ, পৃ. ২০।

[19]. নূ‘মান মাহমূদ আল-আলূসী, আল-আয়াতুল বাইয়িনাত ফী ‘আদমি সিমাইল আমওয়াতি ‘আলা মাযহাবিল হানাফিইয়াহ আস-সাদাত, তাহক্বীক্ব আলবানী (রিয়াদ : মাকতাবাতুল মা‘আরিফ, ১ম প্রকাশ, ২০০৫ খ্রি.), পৃ. ১৭-১৮।

[20]. আলবানী, ইরওয়াউল গালীল (বৈরূত : মাকতাবাতুল ইসলামিয়াহ, ১ম প্রকাশ, ১৯৭৯ খ্রি.), ১/৮।

[21]. মুহাদ্দিছুল ‘আছর নাছিরুদ্দীন আলবানী কামা ‘আরাফতুহূ, পৃ. ১১০।

[22]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, প্রবন্ধ : মুহাম্মাদ নাছেরুদ্দীন আলবানী (রাজশাহী : মাসিক আত-তাহরীক, ৩য় বর্ষ, ৩য় সংখ্যা, ডিসেম্বর, ১৯৯৯ খ্রি.), পৃ. ৩১।

[23]. মুহাদ্দিছুল ‘আছর নাছিরুদ্দীন আলবানী কামা ‘আরাফতুহূ, পৃ. ২৪।

[24]. ইমাম আলবানী হায়াতুহু ওয়া দাওয়াতুহু, পৃ. ১৮৪-৮৫।

[25]. সিলসিলাতুল হূদা ওয়ান নূর, অডিও টেপ নং ৮৮০; ইমাম আলবানী হায়াতুহু ওয়া দাওয়াতুহু, পৃ. ৪৩।

[26]. আলবানী, আছলু ছিফাতি ছালাতিন্নবী (রিয়াদ : মাকতাবাতুল মা‘আরিফ, ১ম প্রকাশ, ২০০৬ খ্রি.), ভূমিকা দ্রষ্টব্য, পৃ. ২২-২৩।

[27]. আব্দুল্লাহ আল-‘আক্বীল, আ‘লামুদ দাওয়াহ ওয়াল হারাকাতিল ইসলামিয়াহ, ২য় খন্ড (কায়রো : দারুল বাশীর, ৮ম প্রকাশ, ২০০৮ খ্রি.), পৃ. ১০৬৩; নাছিরুদ্দীন আলবানী; মুহাদ্দিছুল ‘আছর ওয়া নাছিরুস সুন্নাহ, পৃ. ৪৮-৪৯।






মাওলানা আব্দুর রঊফ ঝান্ডানগরী - ড. নূরুল ইসলাম
মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ)-এর ব্যাপারেকিছু আপত্তি পর্যালোচনা (শেষ কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী (রহঃ) - ড. নূরুল ইসলাম
ইবনু মাজাহ (রহঃ) (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
শেরে পাঞ্জাব, ফাতিহে কাদিয়ান মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী (রহঃ) (২য় কিস্তি) - ড. নূরুল ইসলাম
ইবনু মাজাহ (রহঃ) - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) (শেষ কিস্তি) - ড. নূরুল ইসলাম
ইমাম নাসাঈ (রহঃ) (শেষ কিস্তি) - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর (শেষ কিস্তি) - ড. নূরুল ইসলাম
যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) (১০ম কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
মাওলানা আব্দুল ওয়াহ্হাব মুহাদ্দিছ দেহলভী - ড. নূরুল ইসলাম
ইমাম নাসাঈ (রহঃ) (২য় কিস্তি) - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
আরও
আরও
.