শায়খ আব্দুর রহমান ইবনুু নাছির আস-সা‘দী (রহ.) (১৩০৭-১৩৭৬ হি.) বিংশ শতাব্দীর একজন মুফাসসির, মুহাদ্দিছ, ফক্বীহ, দাঈ, গবেষক, লেখক, চিন্তাবিদ, আইনবিদ, বিচারক এবং আধুনিক যুগের একজন মুজতাহিদ ও সমাজ সংস্কারক। তিনি তাঁর রচনায় কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামের প্রকৃত রূপরেখা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তুলে ধরেছেন। তিনি গোঁড়ামি ও অন্ধ তাক্বলীদের বেড়াজাল থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে স্বাধীন চিন্তার অনুশীলন করেছেন। ইজতিহাদ তথা গবেষণা করে মাসআলা চয়নে তিনি ছিলেন পারদর্শী। ইসলামী আইন শাস্ত্রে তাঁর ছিল বিশেষ পান্ডিত্য। শিরক, বিদ‘আত ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ছিলেন আপোষহীন। তিনি এগুলোর বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বহু মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। আলোচ্য প্রবন্ধে ‘আব্দুর রহমান আস-সা‘দীর জীবনী আলোচনা করা হ’ল।-

নাম ও বংশ পরিচয় :

তাঁর নাম আব্দুর রহমান, কুনিয়াত আবূ আব্দিল্লাহ, পিতার নাম নাছির, দাদার নাম আব্দুল্লাহ, প্রপিতামহের নাম নাছির ইবনুু হামদ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে হামদ আস-সা‘দী (রহ.)।[1] তিনি ‘আল্লামাতুল কাসীম’ নামেও প্রসিদ্ধ। আরবের প্রসিদ্ধ তামীম গোত্রের বনু আমর বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষগণ ‘হায়িল’-এর নিকটবর্তী ‘মুসতাজাদাহ’ অথবা ‘কাফার’ নামক স্থানে বসবাস করতেন। সেখান থেকে তারা ১১২০ হিজরীতে আল-কাসীম প্রদেশের ‘উনায়যাহ’ নামক স্থানে হিজরত করেন।[2] তাঁর মাতার নাম ফাতিমা বিনতু আব্দিল্লাহ ইবনে আব্দুর রহমান ইবনে ওছমান। তিনিও আরবের প্রসিদ্ধ তামীম গোত্রের উছায়মীন শাখায় জন্মগ্রহণ করেন।[3]

জন্ম :

আব্দুর রহমান ইবনুু নাছির আস-সা‘দী (রহ.) ১২ই মুহাররম ১৩০৭ হিজরী, ২৪শে জানুয়ারী ১৮৮৯ খৃষ্টাব্দে সঊদী আরবের আল-কাসীম প্রদেশের উনায়যাহ নামক স্থানে এক উচ্চশিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।[4]

শৈশবকাল ও প্রাথমিক শিক্ষা :

আব্দুর রহমান ইবনুু নাছির আস-সা‘দী (রহ.) ১৩১০ হিজরীতে মাত্র ৪ বছর বয়সে মা এবং ১৩১৩ হিজরীতে ৭ বছর বয়সে পিতাকে হারিয়ে উভয় দিক থেকে ইয়াতীম হিসাবে লালিত-পালিত হন।[5] পিতা-মাতার মৃত্যুর পর সর্বপ্রথম লালন-পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তাঁর সৎ মা। যখন তিনি যৌবনে পদার্পণ করেন তখন তাঁর পিতার পূর্ব অছিয়ত অনুযায়ী দেখা শুনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন আপন বড় ভাই হামদ ইবনু নাছির, যিনি সে সময়ের একজন বিখ্যাত আলেম ছিলেন। শায়খ সা‘দী (রহ.) (১৩০৭-১৩৭৬ হি.) শৈশবকাল থেকেই অত্যন্ত মেধাবী ও প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন। তিনি অতি অল্প বয়সে লেখা-পড়া শুরু করেন এবং পিতার নিকট থেকেই প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ‘উনায়যাহ’-এর ‘মাসুকুফ’ মসজিদের সম্মানিত ইমাম ছিলেন। কুরআনুল কারীম হিফযের মাধ্যমে তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু হয়। তিনি মাত্র ১১ বছর বয়সে কুরআনুল কারীম হিফয সম্পন্ন করেন।[6] বাল্যকাল থেকেই তিনি ইলম অর্জন ও ইসলামের যাবতীয় বিধি-বিধান পালনে গভীর মনোযোগী ছিলেন। ইলম অর্জনে প্রচুর আগ্রহের মাধ্যমেই তিনি তাফসীর, হাদীছ, ফিক্বহ ও আরবী ভাষা-সাহিত্যে খ্যাতি অর্জন করেন।[7]

শিক্ষা জীবন :

শায়খ সা‘দী (রহ.) তাঁর পিতার নিকট থেকে অক্ষর জ্ঞান অর্জন করেন। পিতার মৃত্যুর পর আপন বড় ভাই হাম্দ ইবনু নাছিরের নিকট লালিত পালিত হন, যিনি ছিলেন অত্যন্ত পরহেযগার এবং কুরআনুল কারীম সংরক্ষণের ক্ষেত্রে অগ্রগামী ভূমিকা পালনকারী। যার ফলশ্রুতিতে কুরআনুল কারীম হিফযের মাধ্যমে তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু হয়। শায়খ আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহমান স্বীয় উলামাউ নাজদ খিলাল ছামানিয়াতা কুরূন’ গ্রন্থে বলেন,فحفظ القران الكريم عن ظهر قلب قبل أن يتجاوز الثانية عشرة من عمره ‘তাঁর বয়স ১২ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পূর্বেই তিনি কুরআনুল কারীমের হিফয শেষ করেন’।[8]

শায়খ আস-সা‘দী (রহ.)-এর জ্ঞানার্জনের প্রতি গভীর অনুরাগ ও অদম্য স্পৃহা বাল্যকালেই তাঁর মধ্যে ফুটে ওঠে। যা অবলোকন করে তাঁর বড় ভাই উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য তাঁকে তৎকালীন স্থানীয় আলেমগণের দারসে প্রেরণ করেন। তিনি বিখ্যাত মুফাসসির ও মুহাদ্দিছ শায়খ ইব্রাহীম ইবনু হামদ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনেু জাসির (১২৪১-১৩৩৮ হি.)-এর নিকট তাফসীর, উছূলে তাফসীর, হাদীছ ও উছূলে হাদীছ,[9] শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল কারীম ইবনেু ইবরাহীম ইবনে ছালিহ আশ-শুবুল (১২৫৭-১৩৪৩ হি.)-এর নিকট ফিক্বহ, উছূলে ফিক্বহ ও নাহু-ছরফ, শায়খ আব্দুল্লাহ ইবনু আয়েয আল-হারবী (১২৪৯-১৩২২হি.)-এর নিকট ফিক্বহ ও আরবী ভাষা ও সাহিত্য এবং শায়খ ছালিহ ইবনু ওছমান ইবনে হামদ ইবনে ইবরাহীম আল-কাযীর (১২৮২-১৩৫১হি.) নিকট তাওহীদ, তাফসীর, ফিক্বহ, উছূলে ফিক্বহ ও আরবী ভাষা ও সাহিত্য, শায়খ মুহাম্মাদ ইবনুু আব্দুল্লাহ ইবনে হামদ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে ছালিম (১২৪০-১৩২৩হি.)-এর নিকট তাওহীদ, শায়খ আলী ইবনুু নাছির ইবনে মুহাম্মাদ আবূ ওয়াদী (১২৭৩-১৩৬১হি.)-এর নিকট হাদীছ, উছূলে হাদীছ, তাফসীর ও উছূলে তাফসীর শিক্ষা লাভ করেন।[10]

অল্প সময়ের মধ্যে চারদিকে তাঁর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তিনি অল্প সময়ে কুরআন, হাদীছ, উছূলে হাদীছ, ফিক্বহ, উছূলে ফিক্বহ, তাওহীদ, তাফসীর, উছূলে তাফসীর, আরবী ভাষা ও সাহিত্যে পারদর্শিতা অর্জন করেন। তিনি অনেক ‘মুতুন’ মুখস্থ করেন। আল-কুরআনের তাফসীরের প্রতি তাঁর আর্কষণ ছিল সবচেয়ে বেশী।[11] পড়াশুনার ক্ষেত্রে তিনি সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন। তাফসীর, হাদীছ, তাওহীদ, ফিক্বহ হাম্বলী এবং শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনুু তাইমিয়াহ (রহ.) ও তাঁর ছাত্র ইমাম ইবনুুল ক্বাইয়িম (রহ.) রচিত গ্রন্থের প্রতি।[12]

খ্যাতনামা শিক্ষকবৃন্দ :

বিশ্ববরেণ্য এ আলেমে দ্বীন তৎকালীন সময়ের প্রসিদ্ধ আলেমগণের নিকট থেকে কুরআন, হাদীছ, তাফসীর সহ ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে গভীর জ্ঞানার্জন করেন। তাঁর শিক্ষকগণের সংখ্যা সুনির্দিষ্টভাবে বর্ণনা করা কঠিন। তাঁর উল্লেখযোগ্য শিক্ষকবৃন্দ হ’লেন- ১. শায়খ আলী ইবনু মুহাম্মাদ আস-সানানী। ২. শায়খ আলী ইবনু নাছির ইবনু আবু ওয়াদী। ৩. শায়খ ইবরাহীম ইবনু হাম্দ। ৪. শায়খ মুহাম্মাদ আব্দুল কারীম ইবনু ইব্রাহীম ইবনে ছালিহ আশ-শুবুল। ৫. শায়খ মুয়াররিখ ইবরাহীম ইবনু ছালিহ ইবনে ঈসা। ৬. শায়খ আব্দুল্লাহ ইবনু আয়েয আল-হারবী। ৭. শায়খ ছালিহ ইবনু ওছমান ইবনে হামদ ইবনে ইবরাহীম আল-কাযী। ৮. শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনে হাম্দ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে সালীম। ৯. শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল আযীয ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে মানে‘। ১০. শায়খ সা‘ব ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনে সা‘ব আত-তাবী জরী ও ১১. শায়খ মুহাম্মাদ আল-আমীন আশ-শানক্বীতি প্রমুখ।[13]

প্রসিদ্ধ ছাত্রবৃন্দ :

শায়খ আব্দুর রহমান ইবনুু নাছির আস-সা‘দী (রহ.) আধুনিক যুগের প্রসিদ্ধ আলেম ছিলেন। তাঁর সুন্দর পাঠদান পদ্ধতি, ছাত্রদের সাথে উত্তম ব্যবহার ও ক্ষুরধার লেখনির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে অসংখ্য জ্ঞানপিপাসু দূর-দূরান্ত হ’তে এসে তাঁর নিকট থেকে জ্ঞানের অমিয় সুধা পান করে বিদ্যাতৃষ্ণা নিবারণ করত। যারা ইলম অর্জনের পর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ইলমী খিদমত আঞ্জাম দিয়েছেন। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হ’লেন-

১. শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছায়মীন (১৩৪৭-১৪২১হি./১৯২৯-২০০১খৃ.); তিনি শায়খ আস-সা‘দী (রহ.) দ্বারা সর্বাধিক প্রভাবিত হন। ২. শায়খ আব্দুল আযীয ইবনু মুহাম্মাদ আস-সালমান (রহ.), পরবর্তীতে তিনি রিয়াদে শিক্ষকতা করেন। পাঠ দান ও গ্রন্থ প্রণয়নের ক্ষেত্রে তিনি শায়খ দ্বারা সর্বাধিক প্রভাবিত হন ৩. শায়খ আব্দুল্লাহ ইবনু আব্দুর রহমান আল-বাসসাম। ৪. শায়খ আব্দুল্লাহ ইবনু আব্দুল আযীয ইবনে আকীল। ৫. শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু সুলায়মান আল-বাস্সাম। ৬. শায়খ সুলায়মান ইবনু ইবরাহীম আল-বাস্সাম প্রমুখ।[14]

আক্বীদা :

শায়খ সা‘দী (রহ.) আক্বীদার ক্ষেত্রে সালাফে ছালেহীন তথা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অনুসারী ছিলেন। তাঁর লিখিত গ্রন্থগুলো পর্যালোচনা করলে তা স্পষ্টভাবে বুঝা যায়। তিনি শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (মৃ. ৭২৮ হি.) ও মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহহাব (মৃ. ১২০৬ হি.)-এর আক্বীদাহ বিষয়ে লিখিত গ্রন্থের ব্যাখ্যা করেছেন। ভ্রান্ত আক্বীদাহ পোষণকারী ‘আল-কাসেমী’ সহ অন্য যারা ভ্রান্ত আক্বীদায় বিশ্বাসী তাদেরকে ‘রদ’ করেছেন।[15] শায়খ স্বীয় লিখিত ‘কাওলুস সাদীদ শারহু কিতাবিত তাওহীদ’ গ্রন্থের ভূমিকায় বলেন,وفي هذه المرة بدأ لي أن أقدم أمام ذلك مقدمة مختصرة تحتوي علي مجملات عقائد أهل السنة في الاصول و توابعها. ‘এবার আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের সংক্ষিপ্ত আক্বীদাহ এবং এর মৌলিক ও আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো ভূমিকায় পেশ করার বিষয়টি আমার কাছে উচিত বলে মনে হচ্ছে’।[16]

মাযহাব :

ফিক্বহী মাসআলার ক্ষেত্রে প্রথম দিকে তিনি হাম্বলী মাযহাবের পূর্ণ অনুসারী ছিলেন। পরবর্তীতে তাঁর জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধির সাথে সাথে মাযহাবের মতামতকে উপেক্ষা করে দলীলের অনুসরণ করেছেন। এ বিষয়ে তিনি ‘আল-মুখতারাতুল জাল্লিয়্যাহ মিনাল মাসাইলিল ফিক্বহিয়্যাহ’ নামক একটি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। যেখানে তিনি হাম্বলী মাযহাবের বিপরীতে দলীলের পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ (মৃ. ৭২৮ হি.) ও ইবনুুল ক্বাইয়িম (মৃ. ৭৫১ হি.) দ্বারা অধিক প্রভাবিত হয়েছেন।[17]

চরিত্র :

তিনি ছিলেন নম্র, ভদ্র, মিষ্টভাষী। তাঁর আচার-ব্যবহার ছিল সহজ-সরল ও অন্তর ছিল অত্যধিক নরম। কেউ ভুল করলে তাকে ধমক দিতেন না এবং তার সাথে দুর্ব্যবহার করতেন না। তিনি গরীব অসহায়দের সাহায্যে ছিলেন মুক্তহস্ত। আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী সকলের সাথে ছিল গভীর ভালোবাসা। তাঁর চেহারায় কোন অবস্থায় রাগ কিংবা বিরক্তির ছাপ পরিলক্ষিত হ’ত না। পরিচিত-অপরিচিত, ছোট-বড়, সকলের সাথে মিষ্টভাষায় কুশল বিনিময় করতেন। ছোট-বড় সকলের সাথে সাক্ষাতে মুচকি হেসে সালাম দিতেন। তিনি মেহমানের আপ্যায়নে কার্পণ্য করতেন না। তাঁর ছাত্র আব্দুল্লাহ বাসসাম এভাবেই তাঁর উন্নত চরিত্রের বর্ণনা দিয়েছেন।[18]

অসুস্থতা ও রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা লাভ :

১৩৭১ হিজরীতে শায়খ ব্লাডপ্রেসারে বা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হন। মাঝে মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের ফলে তিনি কথা বলতে পারতেন না। ১৩৭৩ হিজরীতে বিশ্ববরেণ্য এ মুফাসসিরের করুণ অবস্থার কথা তৎকালীন সঊদী বাদশাহ মালিক সাঊদ (রহ.) অবগত হ’লে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁর উন্নত চিকিৎসার নির্দেশ দেন। তাঁর উন্নত চিকিৎসার জন্য দুই জন ডাক্তার সহ শায়খকে বিমানে লেবাননের রাজধানী বৈরূতে পাঠানো হয়।[19]

পরবর্তীতে ১৩৭৬ হিজরী মোতাবেক ২২ জুমাদাল আখিরাহ রোজ বুধবার রাত্রে তাঁর ব্রেইনে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। সঊদী আরবের তৎকালীন ‘বাদশা’ মালিক ফায়ছাল (রহ.)-কে বিষয়টি জানানো হ’লে তিনি রাজধানী রিয়াদ থেকে বিমানযোগে ডাক্তার প্রেরণ করেন। কিন্তু আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় বিমান পুনরায় রিয়াদে ফিরে যায়।[20]

মৃত্যু :

১৩৭৬ হিজরীর ২৩শে জুমাদাল আখিরাহ রোজ বৃহস্পতিবার ফজরের কিছুক্ষণ পূর্বে সঊদী আরবের আল-কাসীম প্রদেশের ‘উনায়যাহ’ নামক স্থানে নিজ বাড়ীতে বিশ্ববরেণ্য এ মুফাসসির মুহাদ্দিছ, ফক্বীহ, মুজতাহিদ, সাহিত্যিক, লেখক, গবেষক পরলোকগমণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর। ঐ দিন যোহর ছালাত পরে তাঁর জানাযা ছালাত ‘উনায়যাহ’-এর জামে মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়। জানাযার ছালাতে ইমামতি করেন, শায়খ আব্দুল আযীয ইবনু মুহাম্মাদ আল-বাসসাম (রহ.)। ‘উনায়যাহ’-এর উত্তরে ‘শাহওয়ানিয়্যাহ’ নামক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।[21]

কর্মজীবন :

শায়খের কর্মময় জীবন বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজে অতিবাহিত হয়। তাঁর দ্বারা সমাজের প্রতিটি ব্যক্তি ও পরিবার উপকৃত হয়েছে। আল্লাহ ও জনগণের হক আদায়ে তিনি তাঁর জীবনের সকল সুখ-শান্তি ত্যাগ করে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। নিমেণ তাঁর কর্মজীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো তুলে ধরা হ’ল।

১. তিনি আজীবন দেশ ও জনগণের আশা-ভরসার আশ্রয়স্থল হিসাবে বিবেচিত হ’তেন। তিনি ছিলেন জ্ঞান অন্বেষণকারীদের শিক্ষক, সাধারণ জনগণের উপদেশদাতা, জামে মসজিদের ইমাম ও খত্বীব, গুরুত্বপূর্ণ দলীল ও দানপত্রের লেখক। তিনি ছিলেন কাযী ও দেশের নির্ভরযোগ্য মুফতী। তাঁর এ সকল কাজের পিছনে একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহর সন্তুষ্টি।[22]

২. ১৩৫৯-১৩৬০ হিজরীতে মন্ত্রী ইবনু হামদান এর অর্থায়নে সঊদী আরবের প্রসিদ্ধ অঞ্চল আল-কাসীমের উনায়যাহ নামক স্থানে ‘আল-মাকতাবাতুল ইলমিয়্যাহ’ নামে একটি লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করেন। যা সকল বিষয়ের ইলম অর্জনের নির্ভরযোগ্য মারকায হিসাবে সারা দেশে পরিচিতি লাভ করে।[23] সমাজিক কর্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি তিনি নানা দায়িত্ব পালন করেন।

. ১৩৬০ হিজরীতে তিনি উনায়যার কাযী নির্বাচিত হন। কিন্তু এর বিনিময়ে তিনি কোন পারিশ্রমিক গ্রহণ করতে না।[24]

৪. ১৩৬১ হিজরীর রামাযান মাসে উনায়যার শাসনকর্তা তাঁকে কেন্দ্রীয় মসজিদের ইমাম ও খত্বীব নিযুক্ত করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন।[25]

৫. ১৩৬২-১৩৬৩ হিজরীতে উনায়যার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ সম্প্রসারণের জন্য ‘জামঈয়্যাহ খায়রিয়্যাহ’ নামক একটি সংস্থা গঠন করেন। ১৩৭৩ হিজরীতে আবারও এ সংস্থার মাধ্যমে অর্থ কালেকশন করে নতুন করে মসজিদ সম্প্রসারণ ও পুনঃনির্মাণ করেন। তাঁর এ কঠোর পরিশ্রম সকলের নিকট প্রশংসিত হয়ে আছে।[26]

৬. ১৩৭৩ হিজরীতে উনায়যার ‘আল-মা‘আহাদুল ইলমী’-এর পরিচালক নিযুক্ত হন। তাঁর বেতন নির্ধারণ করা হয় ১ হাযার রিয়াল। এ কথা জানার পর শায়খ ‘আল-মা‘আহাদুল ইলমী’-এর সভাপতির নিকট পত্র প্রেরণ করে জানিয়ে দেন যে, তিনি কোন পারিশ্রমিক গ্রহণ না করে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য খিদমত করে যাবেন। তিনি সপ্তাহে প্রতি মঙ্গলবার প্রতিটি ক্লাসে প্রবেশ করে শেষ লাইনে বসে ছাত্রদের মত দারস শ্রবণ করতেন। তাঁর দারসে অংশগ্রহণ শিক্ষার গুণগতমান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত।[27]

৭. উনায়যার মসজিদে তিনি সর্বপ্রথম মাইক্রোফোনের ব্যবহার চালু করেন। যা সে সময় অনেকে অপসন্দ করেছিল। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘এটি দূরবর্তী স্থানে উপকারী কথা পৌঁছানোর একটি মাধ্যম মাত্র’ যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ। এটি সত্য দ্বীন মানুষের নিকটে পৌঁছে দেয়ার কাজে সহযোগিতা করে।[28]

৮. এছাড়াও তাঁর অনেক গোপনীয় জনকল্যাণমূলক কাজ ছিল। যেমন বিধবা নারীদের জন্য আবাসন ব্যবস্থা, গরীব অসহায়দের অর্থনৈতিক সহযোগিতা, জনগণের জন্য সামাজিক, পারিবারিক ও অর্থনৈতিকসহ বিভিন্ন সমস্যা বিচারকের নিকট পৌঁছানোর পূর্বেই সমাধান করা ইত্যাদি।[29]

রচনাবলী :

ইলমের বিভিন্ন শাখায় তিনি অবদানের স্বর্ণস্বাক্ষর রেখে গেছেন। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর প্রণীত গ্রন্থাবলী নিম্নে উল্লেখ করা হ’ল-

ক. কুরআন ও উলূমুল কুরআন বিষয়ক গ্রন্থ : ১. তায়সীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিল মান্নান ২. তায়সীরুল লাতিফিল মান্নান ফী খুলাছাতি তাফসীরিল কুরআন ৩. আল-কাওয়ায়িদুল হাসসান লি-তাফসীরিল কুরআন ৪. আল-মাওয়াহিবুর রববানিয়্যাহ মিনাল আয়াতিল কুরআনিয়্যাহ ৫. ফাওয়াইদুম মুসতামবাতাহ মিন কিছছাতি ইউসুফ (আ.) ৬. আদ-দালায়িলুল কুরআনিয়্যাহ ফী আন্নাল উলূমান-নাফিয়্যাহ আল-‘আছরিয়্যাহ দাখিলাতুন ফীদ-দ্বীনিল ইসলামী ৭. ফাৎহুর রাহিমিল মালিকিল ‘আল্লাম ফী ইলমিল আক্বাঈদি ওয়াত-তাওহীদি ওয়াল-আখলাকি ওয়াল আহকামিল মুসতামবাতি মিনাল কুরআন।

খ. তাওহীদ ও আক্বীদাহ বিষয়ক গ্রন্থ : ১. আত-তাওযীহ ওয়াল বায়ান লিশাজারাতিল ঈমান ২. আল-হাক্কুল ওয়াযিহ আল-মুবীন ফী শারহি তাওহীদিল আম্বিয়াই ওয়াল মুরসালীন মিনাল কাফিয়াতিশ শাফিয়্যাহ ৩. আল-কাওলুস সাদীদ ফী মাক্বাছিদিত তাওহীদ ৪. তাওযীহুল কাফিয়াতিশ শাফিয়াহ ৫. দুররাতুল বাহিয়্যাহ শারহুল কাছীদাতিত তা-ইয়্যাহ ফী হাল্লিল মুশকিলাতিল ক্বাদারিয়্যাহ ৬. শাওয়াল ওয়া জাওয়াব ফী আহাম্মিল মুহিম্মাত ৭. আত-তানবীহাতুল লাতীফাহ ফী-মা ইহতাওয়াত আলাইহিল ওয়াসিতিয়্যাহ মিনাল মাবাহিছিল মুনিফাহ ৮. ফাৎহুর রবিবল হামীদ ফী উছূলিল আক্বায়িদ ওয়াত-

তাওহীদ ৯. ফিতানুদ দাজ্জাল ১০. ইয়াজূজ ওয়া মাজূজ।

গ. হাদীছ বিষয়ক গ্রন্থ : ১. বাহজাতু কুলূবিল আবরার ওয়া কুররাতি উয়ূনিল আখয়ার ফী শারহি জাওয়ামি‘ইল আখবার ২. আহাদিছ ফীল হজ্জ ৩. আল-আহাদীছুল মুখতারাহ ৪. কিত‘আতুম মিন শারহি বুলূগিল মারাম ৫. আত-তা‘লীকাত ‘আলা ‘উমদাতিল আহকাম।

ঘ. ফিক্বহ ও উছূলে ফিক্বহ বিষয়ক গ্রন্থ : ১. আল-মুখতারাতুল জাল্লিয়াহ ফিল মাসায়িলিল ফিক্বহিয়্যাহ ২. আল-মুনাযারাতুল ফিক্বহিয়্যাহ ৩. মানহাজুস ছালিকিন ওয়া তাওযীহুল ফিক্বহী ফীদ-দ্বীন ৪. মানযুমাতু ফী আহকামিল ফিক্বহ ৫. আল-ইরশাদ ইলা মা‘রিফাতিল আহকাম : ৬. তুহফাতু আহলিত ত্বলাব ফী তাজরীদি উছূলে কাওয়াইদি রজব ৭. হুকমু শারবিদ-দুখখান ৮. আল-ফাতাওয়া আস-সা‘দীয়্যাহ ৯. নূরুল বাছায়ির ওয়াল আলবাব ফী আহকামিল ইবাদাত ওয়াল মু‘আমালাত ওয়াল হুকূক ওয়াল আদাব ১০. আল-কাওয়াঈদ ওয়াল উছূলুল জামি‘আ ওয়াল ফুরূক ওয়াত তাকাসিমুল বাদি‘আতুন নাফি‘আ ১১. রিসালাহ লাতীফাহ জামি‘আহ ফী উছূলিল ফিক্বহিল মুহিম্মাহ ১২. রিসালাতুন ফীল কাওয়াঈদিল ফিক্বহিয়্যাহ ১২. তারিকুল উলুস ইলাল ইলমিল মা‘মূল বি মা‘রিফাতিল কাওয়াদ ওয়ায যাওয়াবিত ওয়াল উছূল।

দাওয়াত ও উপদেশ বিষয়ক গ্রন্থ : ১. ইনতিছারুল হক ২. উজূবুত তা‘আউন বায়নাল মুসলিমীন ওয়া মাওযূ‘উল জিহাদ আদ-দ্বীনি ওয়া বায়ানু কুল্লিয়াতি মিন বারাহিনিদ দ্বীনি ৩. আল-ওয়াসাইলিল মুফিদাহ লিল হায়াতিস সা‘ঈদাহ ৪. মানযুমাতু ফিস সিয়ারি ইলাল্লাহ ওয়াদ দারুল আখিরাহ ৫. তানযীহুদ দ্বীন ওয়া হামালাতুহু ওয়া রিজালাহু মিম্মা ইফতারাহু আল-কাসিমী ফী আগলালিহি ৬. মাজমু‘উল খুতাব ফিল মাওয়াযী‘উন নাফিয়্যাহ ৭. আল-ফাওয়াক্বিহুশ শাহিয়্যাহ ফিল খুতাবিল মিমবারিয়্যাহ ৮. আদিল্লাতুল কাওয়াতি‘ ওয়াল বারাহীন ফী ইবতালি উছূলিল মুলহিদীন ৯. আদ-দ্বীনুছ-ছহীহ ওয়া হিল্লুলজামী‘উল মাশাকিল ১০. আর-রিয়াযুন নাযিরাহ ওয়াল হাদায়িকুন নি-রাতুয যাহিরাহ ফীল আক্বাইদ ওয়াল ফুনূনিল মুতানাওয়াতিল ফাখিরাহ। ১৩. আল-খুতাবুল মিমবারিয়্যাহ আলাল মুনাছিবাত ১৪. মাজমূ‘উল ফাওয়ায়িদ ওয়া ইক্বতিনাসুল আওয়াবিদ।

শিষ্টাচার বিষয়ক গ্রন্থ : ১. হুসনুল খুলূক ২. আদ-দুরাতুল ফাখিরাহ ৩. মাকালাতুশ শায়খ সা‘দী ৫. ফাযলুল জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ ৬. আদাবুল মু‘আল্লিমীন ওয়াল মুতা‘আল্লিমীন ৭. বাদী‘আতুল বায়ান ‘আন মাউতিল আইয়ান।

তাফসীর শাস্ত্রে তাঁর অবদান : শায়খ সা‘দী (রহ.) এমন এক ব্যক্তিত্ব যিনি তাঁর লেখনীর মাধ্যমে আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন। বিশেষতঃ তাঁর বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ ‘তায়সীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরে কালামিল মান্নান’ পবিত্র কুরআনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে এক অনন্য মাইলফলক। এটি তাঁর দীর্ঘদিনের একনিষ্ঠ সাধনা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল। আধুনিক তাফসীর জগতে এর কোন জুড়ি নেই। এ গ্রন্থে আল-কুরআনের প্রকৃত ব্যাখ্যা সাবলীল ও সহজ ভাষায় বর্ণিত হওয়ায় জনসমাজে দলমত নির্বিশেষে সকল মহলেই এর পঠন-পাঠন সমভাবে ব্যাপকতা লাভ করেছে। ইংরেজী ও উর্দূ ভাষার পাশাপাশি সম্প্রতি ১০ম খন্ড বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

শায়খ সা‘দী (রহ.) তাফসীর রচনায় আধুনিক গবেষণার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শক্তিশালী দলীল-প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন। তিনি কুরআনের আয়াতের ব্যাখ্যায় অন্যান্য সম্পূরক আয়াত ও ছহীহ হাদীছের আলোকে বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করেছেন। কোন হাদীছ না পেলে ছাহাবীগণের বক্তব্য ও ব্যাখ্যার দিকে মনোনিবেশ করেছেন। তিনি ভিত্তিহীন ও সন্দেহজনক ইসরাঈলী কাহিনীগুলোকে বর্জন করেছেন এবং যারা যাচাই-বাছাই ছাড়া এ ধরনের কাহিনী বর্ণনা করেছেন তাদের সমালোচনা করেছেন। অপ্রয়োজনীয় আলোচনা বর্জন, জটিল শব্দের সহজ অর্থ, বিভিন্ন আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট বর্ণনা, একটি আয়াত থেকে কুরআন-হাদীছের আলোকে একাধিক মাসআলা উদ্ভাবন করা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য তাঁর তাফসীরকে অন্যান্য তাফসীর থেকে পৃথক করেছে।

এছাড়াও ‘আসমাউল-হুসনা’-এর গুরুত্ব বিবেচনা করে পৃথকভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে তাফসীরের শেষাংশে সংযুক্ত করেছেন। মানব জাতিকে উপদেশ ও শিক্ষা প্রদানের জন্য কুরআনে বর্ণিত অসংখ্য কিছছা বা ঘটনাকে সালাফে ছালেহীনের বুঝ ও মানহাজ অনুযায়ী সঠিক তাফসীর করার পরে অত্যন্ত সংক্ষেপে বিভিন্ন নির্দেশনা উল্লেখ করেছেন। ‘জাহমিয়্যাহ’ ও ‘মু‘তাযিলা’ সহ প্রচলিত সকল ভ্রান্ত মতবাদকে সঠিক দলীলের ভিত্তিতে প্রত্যাখ্যান করে ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদাকে প্রাধান্য দিয়েছেন।

এ সমস্ত বৈশিষ্ট্য তাঁর তাফসীরকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। ফলশ্রুতিতে সাম্প্রতিককালে গবেষকগণ এর বিভিন্ন দিক ও বিষয় নিয়ে গবেষণাকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন যা ভবিষ্যতে এ গ্রন্থের মর্যাদা, গুরুত্ব প্রবৃদ্ধি সাধন ও পূর্ণতাদানে অধিক সহায়ক হবে।

মনীষীদের মূল্যায়ন :

শায়খ সা‘দী (রহ.) (মৃ. ১৩৭৬ হি.) ছিলেন আধুনিক যুগের একজন খ্যাতিমান আলেম। পরবর্তী যুগের সকল বিদ্বানগণ তাঁর ইলমী খিদমতের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। আদব, আখলাক, পরহেযগারিতা, ইবাদত-বন্দেগী, দাওয়াত-তাবলীগ, মু‘আমালাত, জনকল্যাণমূলক কাজ ইত্যাদি বিষয়ে সকলেই তাঁর প্রশংসা করেছেন।

শায়খ ইবনু বায (মৃ. ১৯৯৯ খৃ.) বলেন, ‘ইবনু সা‘দী (রহ.) (মৃ. ১৩৭৬ হি.) যেমন ফিক্বহী বিষয়ে গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন, তেমনি মতভেদপূর্ণ মাসআলায় গ্রহণযোগ্য মতামতকে দলীলের ভিত্তিতে তারজীহ প্রদানে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তিনি শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়্যাহ ও ইবনুুল ক্বাইয়্যিম (রহ.)-এর বই খুব বেশী অধ্যয়ন করতেন। সর্বদা দলীল দিয়েই যে কোন মতামতকে প্রাধান্য দিতেন। তিনি খুব কম কথা বলেতেন, একদম উপকারী ও কল্যাণকর কিছু ছাড়া মন্তব্য করতেন না। আমি মক্কা ও রিয়াদে তাঁর কাছে কয়েকবার বসেছি, ইলমী মাসআলা ছাড়া তার কথা খুব কমই শুনেছি। আচরণের দিক থেকে তিনি অত্যন্ত নম্র ও ভদ্র চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। যে তার বই পড়বে, সে তার মর্যাদা, জ্ঞানের গভীরতা দলীলের প্রতি যত্নশীলতা দেখতে ও বুঝতে পারবে’।[30]

শায়খ ছালিহ আল-উছায়মীন (মৃ. ১৪২১ হি.) বলেন, ‘ইবাদত, ইলম ও আখলাকে তাঁর যুগে এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কেননা তিনি ছোট-বড় সবার সাথে সুন্দর আচরণ করতেন। দরিদ্রদের খোঁজ নিতেন এবং তাদের প্রয়োজনীয় দ্রব্য পৌঁছে দিতেন। মানুষের আঘাতকে খুব সহজে হজম করতেন এবং ধৈর্যধারণ করতেন। কেউ কোন ভুল করলে বিভিন্ন অজুহাতে মাফ করে দিতেন’।[31]

এছাড়াও শায়খ আব্দুর রাযযাক আফীফী,[32] শায়খ মুহাম্মাদ হামীদ আল-ফাকী,[33] শায়খ আব্দুল্লাহ ইবনু আব্দুর রহমান আল-বাসসাম,[34] শায়খ আব্দুল্লাহ ইবনু আব্দুল আযীয আল-আকীল,[35] শায়খ ছালিহ ইবনু আব্দুল আযীয আল-উছায়মীন,[36] মুহাম্মাদ আল-কাযী,[37] শায়খ আব্দুর রহমান ইবনু আব্দুল হামীদ আল-ফাওযান,[38] শায়খ আব্দুর রহমান আল-আদওয়াবী,[39] প্রমুখ তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।

উপসংহার :

শায়খ সা‘দী (রহ.) ছিলেন ইসলামী জ্ঞানের সকল শাখায় পারদর্শী এক বিদগ্ধ পন্ডিত। তাঁর অতৃপ্ত জ্ঞানপিপাসা অসাধারণ ধী-শক্তি ও সর্বতোমুখী প্রতিভা তাকে আধুনিক যুগের অপ্রতিদ্বন্দ্বী মুফাসসির, মুহাদ্দিছ ও ফক্বীহের গৌরবময় আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। তাঁর চিন্তা ও গবেষণা ইসলামের সঠিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও প্রচারে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছে। ইসলাম ও ইসলামী জ্ঞানের বিশুদ্ধতা রক্ষায় তাঁর অবদান নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং আজও গবেষক, জ্ঞানী ও সাধারণ মানুষ তাঁর গ্রন্থের আলোকে ইসলামকে বোঝার চেষ্টা করছে। ভবিষ্যতেও তাঁর গবেষণা ও চিন্তাধারা ইসলামী জ্ঞানের অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখবে। ইলমে তাফসীরে তাঁর খেদমত ইসলামী শিক্ষার এক অমূল্য জ্ঞানভান্ডার, যা কুরআনের গভীর অর্থ ও তাৎপর্য সহজভাবে তুলে ধরে। এছাড়াও এটি মুসলিম সমাজের জ্ঞানচর্চা ও আমল-আখলাক পরিবর্তনে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে ইনশাআল্লাহ।

ড. গোলাম কিবরিয়া

লিসান্স, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মদীনা, প্রভাষক (আরবী),
বশিরাবাদ দাওয়াতুল ইসলাম আলিম মাদ্রাসা, পবা, রাজশাহী।


[1]. মুহাম্মাদ ইবনু ওছমান ইবনে ছালিহ ইবনে ওছমান আল-কাযী, রাওযাতুন নাযিরীন, ‘আন মায়াসিরি ওলামাই নাজদ ওয়া হাওয়াদিসিস সিনীন. ১/২১৯ (রিয়াদ : মাতবা‘আতুল হালাবী, ১ম সংস্করণ, ১৯৮০ খৃ.); আব্দুর রাযযাক ইবনু আব্দুল মুহসিন আল-‘আববাদ, শায়খ আব্দুর রহমান ইবনু সা‘দী ওয়া জুহুদুহু ফী তাওযীহ আল-আক্বীদাহ (রিযাদ : মাকতাবাতুর রুশদ, ২য় সংস্করণ, ১৯৯৩), পৃ. ১৭।

[2]. রাওযাতুন নাযিরীন, ১ম খন্ড, পৃ. ২১৯; উলামাউ নাজদ, ৩য় খন্ড, পৃ. ২১৮; জুহুদুহু ফী তাওযীহ আল-আক্বীদাহ, পৃ. ১৭।

[3]. জুহুদুহু ফী তাওযীহ আল-আক্বীদাহ, পৃ. ১৮; মাসায়িলিল ফিক্বহিইয়াহ আল-মুসতাজাদ্দাহ, পৃ. ২২।

[4]. তদেব।

[5]. তদেব।

[6]. জুহুদুহু ফী তাওযীহ আল-আক্বীদাহ, পৃ. ৩১; কাযায়া ফিক্বহিইয়াহ মু‘য়াছারাহ, পৃ. ২৭।

[7]. জুহুদুহু ফী তাওযীহ আল-আক্বীদাহ, পৃ. ১৯; মাসায়িলিল ফিক্বহিইয়াহ আল-মুসতাজাদ্দাহ, পৃ. ২২।

[8]. ইখতিয়ারাতুশ শায়খ সা‘দী ফী ক্বাযায়া ফিক্বহিইয়াহ মু‘আছিরা, পৃ. ২৭; মাসায়িলিল ফিক্বহিইয়াহ আল-মুসতাজাদ্দাহ, পৃ. ২৫।

[০9]. রাওযাতুন নাযিরীন, ১ম খন্ড, পৃ. ৪১; উলামাউ নাজদ, ১ম খন্ড, পৃ. ২৭৭।

[10]. জুহুদুহু ফী তাওযীহ আল-আক্বীদাহ, পৃ. ৩২-৩৫; মাসায়িলিল ফিক্বহিইয়াহ আল-মুসতাজাদ্দাহ, পৃ. ২৬।

[11]. উলামাউ নাজদ খিলাল ছামানিয়াতা কুরূন, ৩য় খন্ড, পৃ. ২২০; জুহুদুহু ফী তাওযীহ আল-আক্বীদাহ, পৃ. ৩১।

[12]. মাসায়িলিল ফিক্বহিইয়াহ আল-মুসতাজাদ্দাহ, পৃ. ২৫; ইখতিয়ারাতুশ শায়খ সা‘দী ফী ক্বাযায়া ফিক্বহিইয়াহ মু‘আছিরাহ পৃ. ২২৭-২২৮।

[13]. রাওযাতুন নাযিরীন, ১ম খন্ড, পৃ. ২২০; উলামাউ নাজদ, ৩য় খন্ড, পৃ. ২২২-২২৩।

[14]. উলামাউ নাজদ, পৃ. ২৩৬-২৪৪; জুহুদুহু ফী তাওযীহ আল-আক্বীদাহ, পৃ. ৪১-৪৩।

[15]. উলামাউ নাজদ, ৩য় খন্ড, পৃ. ২৪; ইসতিনবাতাতুশ সা‘দী মিনাল কুরআনিল কারীম, পৃ. ২৪।

[16]. শায়খ আব্দুর রহমান ইবনু নাছির আস-সা‘দী, কাওলুস সাদীদ শারহু কিতাবিত তাওহীদ (রিয়াদ : দারুস সুবাত, ১ম সংস্করণ ১৪২৫ হি./২০০৪ খৃ.) ভূমিকা দ্র. পৃ. ৩১।

[17]. রাওযাতুন নাযিরীন, ১ম খন্ড, পৃ. ২২২; জুহুদুহু ফী তাওযীহ আল-আক্বীদাহ, পৃ. ৪৮।

[18]. মাসায়িলিল ফিক্বহিইয়াহ আল-মুসতাজাদ্দাহ, পৃ. ২৩-২৪; কাযায়া ফিক্বহিইয়াহ মু‘য়াসিরাহ, পৃ. ২৩।

[19]. রাওযাতুন নাযিরীন, ১ম খন্ড, পৃ. ২২৬; জুহুদুহু ফী তাওযীহ আল-আক্বীদাহ, পৃ. ২৪; কাযায়া ফিক্বহিইয়াহ মু‘য়াসিরাহ, পৃ. ২৪।

[20]. জুহুদুহু ফী তাওযীহ আল-আক্বীদাহ, পৃ. ২৩-২৪; কাযায়া ফিক্বহিইয়াহ মু‘য়াসিরাহ, পৃ. ২৫।

[21]. উলামাউ নাজদ খিলালি সামানিয়াতা কুরুন, ৩/২৫০।

[22]. জুহুদুহু ফী তাওযীহ আল-আক্বীদাহ, পৃ. ২১; কাযায়া ফিক্বহিইয়াহ মু‘য়াসিরাহ, পৃ. ২৪।

[23]. রাওযাতুন নাযিরীন, ১ম খন্ড, পৃ.২২৩; জুহুদুহু ফী তাওযীহ আল-আক্বীদাহ, পৃ. ২২; কাযায়া ফিক্বহিইয়াহ মু‘য়াসিরাহ, পৃ. ২৪।

[24]. উলামাউ নাজদ, ৩/২৫৮।

[25]. তদেব।

[26]. তদেব।

[27]. জুহুদুহু ফী তাওযীহ আল-আক্বীদাহ, পৃ. ২২; কাযায়া ফিক্বহিইয়াহ মু‘য়াসিরাহ, পৃ. ২৪।

[28]. জুহুদুহু ফী তাওযীহ আল-আক্বীদাহ, পৃ. ২৩।

[29]. তদেব।

[30]. রাওযাতুন নাযিরীন, ১ম খন্ড, পৃ. ২২০; উলামাউ নাজদ, ৩য় খন্ড, পৃ. ২২২-২২৩; জুহুদুহু ফী তাওযীহ আল-আক্বীদাহ, পৃ. ৩২-৩৫।

[31]. তদেব।

[32]. রাওযাতুন নাযিরীন ‘আন মায়াসিরি উলামাঈ নাজদ ওয়া হাওয়াদিসিস সিনীন. প্রথম খন্ড, পৃ. ২২০; উলামাউ নাজদ খিলাল সামানিয়াতা কুরূন, তৃতীয় খন্ড, পৃ. ২২২-২২৩।

[33]. তদেব।

[34]. http://saaid.org/fawaed/91.htm.

[35]. জুহুদুহু ফী তাওযীহ আল-আক্বীদাহ, পৃ. ৬৬।

[36]. তদেব।

[37]. https://draltayyar.com/books/8036

[38]. তদেব, পৃ. ৬৭।

[39]. https://draltayyar.com/books/8036






মাওলানা মুহাম্মাদ আবুল কাসেম সায়েফ বেনারসী (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - ড. নূরুল ইসলাম
ইবনু মাজাহ (রহঃ) - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর (শেষ কিস্তি) - ড. নূরুল ইসলাম
মাওলানা মুহাম্মাদ আবুল কাসেম সায়েফ বেনারসী - ড. নূরুল ইসলাম
ইমাম নাসাঈ (রহঃ) - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর (৩য় কিস্তি) - ড. নূরুল ইসলাম
ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (রহঃ) (২য় কিস্তি) - ড. নূরুল ইসলাম
ড. মুক্তাদা হাসান আযহারী - ড. নূরুল ইসলাম
যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) (৫ম কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী (রহঃ) (২য় কিস্তি) - ড. নূরুল ইসলাম
ইমাম নাসাঈ (রহঃ) (শেষ কিস্তি) - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ)-এর ব্যাপারে কিছু আপত্তি পর্যালোচনা (৩য় কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
আরও
আরও
.