পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ । পর্ব ৬ । পর্ব ৭ । পর্ব ৮ । পর্ব ৯ । শেষ পর্ব ।

তিন : আব্দুল্লাহ্ বিন ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,

بَيْنَا النَّاسُ بِقُبَاءٍ فِي صَلاَةِ الصُّبْحِ، إِذْ جَاءَهُمْ آتٍ، فَقَالَ : إِنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَدْ أُنْزِلَ عَلَيْهِ اللَّيْلَةَ قُرْآنٌ، وَقَدْ أُمِرَ أَنْ يَسْتَقْبِلَ الكَعْبَةَ، فَاسْتَقْبِلُوهَا، وَكَانَتْ وُجُوهُهُمْ إِلَى الشَّامِ، فَاسْتَدَارُوا إِلَى الكَعْبَةِ -

‘লোকজন কুবা মসজিদে ফজরের ছালাত পড়ছিলেন। এমতাবস্থায় একজন লোক তাদের নিকটে এসে বললেন, আজ রাতে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর উপর কুরআন নাযিল করা হয়েছে। তাকে কা‘বামুখী হয়ে ছালাত আদায় করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সুতরাং তোমরা তার দিকেই মুখ ফিরাও। তখন তাদের মুখমন্ডল শামের (সিরিয়া) দিকে ছিল। ফলে তৎক্ষণাৎ তারা কা‘বার দিকে মুখ ফিরালেন’।[1]

এটা প্রমাণ করে যে, ছাহাবীগণ বায়তুল মুক্বাদ্দাসের দিকে মুখ ফিরিয়ে ছালাত আদায় করা ওয়াজিব মর্মে অকাট্যভাবে প্রমাণিত বিষয়টি রহিত হওয়ার ক্ষেত্রে ‘খবরে ওয়াহিদ’কে গ্রহণ করেছেন এবং একজন ব্যক্তির প্রদত্ত সংবাদ অনুযায়ী ক্বিবলা পরিবর্তন করে কা‘বামুখী হয়েছেন। সুতরাং যদি ‘খবরে ওয়াহিদ’ তাদের নিকট হুজ্জত বা দলীল না হ’ত, তাহ’লে তার ভিত্তিতে তারা প্রথম ক্বিবলা সম্পর্কে অকাট্যভাবে প্রমাণিত বিষয়ের বিরোধী আমল করতেন না। ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন,ولم يُنْكِرْ عَلَيْهِمْ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بَلْ شُكِرُوْا عَلَى ذَلِكَ ‘আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাদের ক্বিবলা পরিবর্তনের বিষয়টিকে অপসন্দ করেননি বরং সেজন্য তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন’।[2]

চার : সাঈদ বিন জুবায়ের (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,

قُلْتُ لِابْنِ عَبَّاسٍ: إِنَّ نَوْفًا الْبِكَالِيَّ يَزْعُمُ أَنَّ مُوْسَى صَاحِبَ الْخَضِرِ لَيْسَ بِمُوْسَى بَنِي إِسْرَائِيلَ، فَقَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ : كَذَبَ عَدُوُّ اللهِ، أَخْبَرَنِي أُبَيُّ بْنُ كَعْبٍ قَالَ : خَطَبَنَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، ثُمَّ ذَكَرَ حَدِيثَ مُوسَى وَالْخَضِرِ بِشَيْءٍ يَدُلُّ عَلَى أَنَّ مُوسَى صَاحِبُ الْخَضِرِ-

‘আমি ইবনু আববাস (রাঃ)-কে বললাম, নাওফা আল-বিকালী ধারণা করে যে, খিযিরের সাথী মূসা বণী ইসরাঈলের মূসা ছিলেন না। একথা শুনে ইবনু আববাস (রাঃ) বললেন, আল্লাহর শত্রু মিথ্যা বলেছে। উবাই বিন কা‘ব আমাকে সংবাদ দিয়েছেন যে, ‘রাসূল (ছাঃ) খুৎবা দিলেন। অতঃপর তিনি মূসা ও খিযির প্রসঙ্গে এমন কথা বললেন যা প্রমাণ করে যে, বণী ইসরাঈলের মূসাই ছিলেন খিযিরের সাথী’।[3]

ইমাম শাফেঈ ‘খবরে ওয়াহিদ’ দ্বারা আক্বীদা সাব্যস্ত করেন :

ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেন,

فابن عباس مع فقهه وورعه يثبت خبر أبي بن كعب عن رسول الله صلى الله عليه وسلم حتى يكذب به امرءا من المسلمين إذ حدثه أبي بن كعب عن رسول الله صلى الله عليه وسلم بما فيه دلالة على أن موسى نبي إسرائيل صاحب الخضر-

‘ইবনু আববাস (রাঃ) তারঁ অগাধ পান্ডিত্য ও আল্লাহ্ভীতি থাকার পরও তিনি রাসূল (ছাঃ) থেকে উবাই বিন কা‘ব (রাঃ)-এর খবর (হাদীছ) সাব্যস্ত করেছেন। এমনকি তার খবরের ভিত্তিতেই তিনি একজন মুসলিমকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেন। যেহেতু উবাই রাসূল (ছাঃ) থেকে বর্ণনা করেছিলেন। এতে বুঝা যায় যে, বণী ইসরাঈলের মূসাই ছিলেন খিযির-এর সাথী’।

আমি (আলবানী) বলেছি, ‘ইমাম শাফেঈ (রহঃ)-এর এমন কথা দ্বারা স্পষ্ট বুঝা যায় যে, আক্বীদা ও আমলের ক্ষেত্রে ‘খবরে ওয়াহিদ’ দ্বারা দলীল গ্রহণ করার ক্ষেত্রে তিনি কোন পার্থক্য করেননি। কেননা মূসা (আঃ)-এর খিযিরের সাথী হওয়ার মাসআলাটি আক্বীদাগত বিষয়, আমলগত বিধান নয়, যা স্পষ্ট। এ বক্তব্যের সমর্থনে বলা যায়, ইমাম শাফেঈ (রহঃ) তার ‘আর-রিসালাহ’ গ্রন্থে ‘আল হুজ্জাতু ফী তাছবীতি খাবারিল ওয়াহিদ’ (الحجة في تثبيت خبر الواحد) ‘খবরে ওয়াহিদ সাব্যস্ত করার দলীল’ শিরোনামে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচনা করেছেন। অতঃপর সেখানে তিনি এর স্বপক্ষে কিতাব ও সুন্নাহ হ’তে অনেকগুলি ‘আম’ ও ‘মুত্বলাক্ব’ দলীল উল্লেখ করেছেন (পৃঃ ৪০১-৪৫৩), যা দ্বারা বুঝা যায় যে, ‘খবরে ওয়াহিদ’ আক্বীদার ক্ষেত্রেও দলীল। তাছাড়া এ বিষয়ে তিনি আমভাবেও কথা বলেছেন। পরিশেষে তিনি নিমেণাক্ত কথাগুলি দিয়ে আলোচনার পরিসমাপ্তি টেনেছেন,

وفي تثبيت خبر الواحد أحاديث يكفي بعض هذا منها ولم يزل سبيل سلفنا والقرون بعدهم إلى من شاهدنا هذه السبيل. وكذلك حكي لنا عمن حكى لنا عنه من أهل العلم بالبلدان-

‘খবরে ওয়াহিদ সাব্যস্ত করা বিষয়ে অনেক হাদীছ রয়েছে, যার মধ্যে উল্লিখিত কিছুসংখ্যকই যথেষ্ট মনে করছি। আমাদের সালাফ বা পূর্বসূরীগণ ও তাদের পরবর্তী যুগের লোকদের যাদেরকে আমরা দেখেছি তাদের এটিই পথ ছিল। অনুরূপভাবে বিভিন্ন দেশের বিদ্বানগণের মধ্যে যাদের থেকে আমাদের কাছে বর্ণনা করা হয়েছে এটি তাদের রীতি ছিল’। তার এই কথাটি ‘আম। যেমনভাবে তাঁর নিম্নোক্ত বক্তব্যটিও ‘আম। তিনি বলেন,

ولو جاز لأحد من الناس أن يقول في علم الخاصة أجمع المسلمون قديما وحديثا على تثبيت خبر الواحد والانتهاء إليه بأنه لم يعلم من فقهاء المسلمين أحد إلا وقد ثبته جاز لي ولكن أقول لم أحفظ عن فقهاء المسلمين أنهم اختلفوا في تثبيت خبر الواحد-

‘কোন লোকের জন্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ইলম সম্পর্কে যদি একথা বলা জায়েয হয় যে, পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল মুসলিম ‘খবরে ওয়াহিদ’ সাব্যস্ত করার এবং সাধারণভাবে তার দ্বারা দলীল সাব্যস্তকরণের ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন। কেননা কোন একজন মুসলিম ফক্বীহ তা সাব্যস্ত করেননি, এমনটি জানা যায় না। তাহ’লে আমার জন্যও সেটা বলা জায়েয হ’ত। কিন্তু আমি বলি, খবরে ওয়াহিদ সাব্যস্ত করার ব্যাপারে মুসলিম ফক্বীহগণ সামান্যতম মতভেদ করেছেন তা আমার জানা নেই’।[4]

‘আহাদ হাদীছ’ দ্বারা আক্বীদার ক্ষেত্রে দলীল গ্রহণ না করা নবোদ্ভাবিত বিদ‘আত :

কিতাব ও সুন্নাতের দলীল-আদিল্লা, ছাহাবীগণের আমল ও ওলামায়ে কেরামের অভিমত দ্বারা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, শরী‘আতের সকল ক্ষেত্রে আহাদ হাদীছ গ্রহণ করা ওয়াজিব। চাই তা আক্বীদাগত অথবা আমলগত বিষয়ে হোক। আর এতদুভয়ের মাঝে পার্থক্য করা বিদ‘আত, যা সালাফগণ জানতেন না। এজন্যই ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন,

وهذا التفريق باطل بإجماع الأمة، فإنها لم تزل تحتج بهذه الأحاديث في الخبريات العلميات (يعني العقيدة)، كما تحتج بها في الطلبيات العمليات...

‘এই পার্থক্যকরণ উম্মতের ইজমা দ্বারা বাতিল। কেননা তারা সবাই এই হাদীছগুলিকে আক্বীদাগত বিষয়ে দলীল হিসাবে গ্রহণ করেন, যেমন আমলগত বিষয়গুলিতে গ্রহণ করেন...। বিশেষত আমলগত আহকাম আল্লাহর পক্ষ থেকে খবরকে অন্তর্ভুক্ত করে যে, তিনি এরূপ বিধান দিয়েছেন, এটি ওয়াজিব করেছেন এবং দ্বীন হিসাবে মনোনীত করেছেন...ইত্যাদি। সুতরাং তাঁর দেওয়া শরী‘আত ও দ্বীন তাঁর নাম ও ছিফাতসমূহের দিকেই ফিরে যায়। আর ছাহাবীগণ, তাবেঈগণ, তাবে তাবেঈগণ, আহলেহাদীছ ও আহলে সুন্নাতের সকলেই নাম ও গুণাবলী, তাক্বদীর ও ফায়ছালা এবং আহকামের ক্ষেত্রে এই খবরগুলি দ্বারা দলীল গ্রহণ করে থাকেন। তাদের একজন থেকেও জানা যায় না যে, তিনি ‘খবরে ওয়াহিদ’ দ্বারা আহকামের ক্ষেত্রে দলীল গ্রহণ করেছেন, অথচ আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নামসমূহ ও গুণাবলী সম্পর্কে দলীল গ্রহণ করা জায়েয মনে করেননি। সুতরাং এই দুই বিষয়ের মাঝে পার্থক্যকারী সালাফ বা পূর্বসূরী কোথায়? তবে হ্যাঁ; তাদের সালাফ হ’ল এমন কিছু পরবর্তী ধর্মতাত্ত্বিক যারা আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর ছাহাবীগণের পক্ষ থেকে যা এসেছে তার প্রতি তাদের কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। বরং কিতাব-সুন্নাত ও ছাহাবীগণের বাণীর মাধ্যমে এ বিষয়ে সঠিক পথ পাওয়া থেকেও তাদের অন্তরসমূহকে তারা বিরত রাখে। তারা ধর্মতাত্ত্বিকদের মতামত এবং ভানকারীদের রেফারেন্স দেয়। ওরাই মূলতঃ এ দু’টি বিষয়ের মাঝে পার্থক্য সৃষ্টিকারী বলে জানা যায়।

এমন পার্থক্যের ব্যাপারে ওরা আবার ‘ইজমা’রও দাবী করে! অথচ এমন ‘ইজমা’ কোন একজন ইমাম থেকেও বর্ণিত নেই। কোন ছাহাবী কিংবা তাবেঈ থেকেও নেই। সুতরাং আমরা তাদের নিকট আবেদন করি যে, ‘খবরে ওয়াহিদ’ দ্বারা দ্বীনের কোন অংশ সাব্যস্ত করা জায়েয আর কোন অংশ জায়েয নয় এতদুভয়ের মাঝে সঠিক পার্থক্য নিরূপণ করুন! তাহ’লে তারা পার্থক্য করার সমর্থনে তাদের বাতিল দাবী ব্যতীত কোন পথই খুঁজে পাবে না। যেমন তাদের কিছু লোক বলে, উছূল সংক্রান্ত বিষয় বলতে ইলমী বিষয়সমূহ আর শাখা-প্রশাখাগত বিষয় বলতে আমলগত মাসআলাসমূহকে বুঝায় (তাদের এমন পার্থক্যকরণও বাতিল)।

কারণ আমলগত বিষয়সমূহ দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল ইলম ও আমল। ইলমী বিষয়সমূহ দ্বারাও উদ্দেশ্য ইলম ও আমল। তা হ’ল অন্তরের ভালোবাসা ও ঘৃণা। হকের প্রতি অন্তরের ভালোবাসা, যা ইলম দ্বারা বুঝা যায়। আবার বাতিলের প্রতি তার ঘৃণা, যা তার বিরোধিতা করার মাধ্যমে বুঝা যায়। সুতরাং আমল কেবল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমলের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং অন্তরের আমলসমূহ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমলসমূহের মূল পরিচালক। আর অঙ্গের আমলসমূহ তার অনুগামী। সুতরাং প্রতিটি ইলমী মাসআলার সাথেই অন্তরের বিশ্বাস, সত্যায়ন ও ভালোবাসা জড়িত রয়েছে। আর সেটিই আমল। বরং আমলের মূল। ঈমানের মাসআলা সমূহের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি সম্পর্কে অনেক ধর্মতাত্ত্বিক উদাসীন। তারা মনে করেন ঈমান শুধু অন্তরের সত্যায়ন মাত্র; আমলের প্রয়োজন নেই। আর এটাই সবচেয়ে জঘন্য ও মারাত্মক ভুল। কেননা অনেক কাফের নিশ্চিতভাবে নবী সত্য তা জানতো এবং এতে তাদের মনে কোন সন্দেহ-সংশয় ছিল না। কিন্তু তারা এমন সত্যায়নের সাথে আমল করেনি। তা হ’ল নবী যা নিয়ে এসেছেন তাকে ভালোবাসা, তার প্রতি ও তার ইচ্ছার প্রতি সন্তুষ্ট থাকা, তার প্রতি ভালবাসা প্রদর্শন এবং তার শত্রুর সাথে শত্রুতা পোষণ করা...ইত্যাদি। তাই এ বিষয়টিকে অবহেলা করা যাবে না। কেননা এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমেই আপনি সত্যিকারের ঈমান বুঝতে পারবেন।

সুতরাং ইলমী মাসআলা সমূহ আমলগত। আবার আমলগত মাসআলা সমূহ ইলমী বা আক্বীদাগত। কেননা শরী‘আত প্রণেতা বান্দার নিকট থেকে আমলগত বিষয়ে ইলম ছাড়া আমলকে যথেষ্ট মনে করেননি। অনুরূপ ইলমী বিষয়গুলিতে আমল ব্যতীত কেবল ইলমকেই যথেষ্ট মনে করেননি’।[5]

সুতরাং ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ)-এর বক্তব্য থেকে প্রমাণিত হ’ল যে, উল্লিখিত পার্থক্য ইজমা দ্বারা বাতিল। কেননা তা সালাফের আমল বিরোধী এবং উল্লিখিত দলীল সমূহেরও বিরোধী। এটি অন্যদিক থেকেও বাতিল। আর তা হ’ল পার্থক্যকারীরা ইলমকে আমলের সাথে এবং আমলকে ইলমের সাথে সম্পৃক্ত করাকে আবশ্যক মনে করে না। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট, যা বিষয়টি ভালভাবে বুঝতে এবং উল্লিখিত পার্থক্যকে নিশ্চিত ভাবে বাতিল বলে বিশ্বাস রাখতে মুমিনদেরকে সহযোগিতা করবে।

অনেক খবরে ওয়াহিদ ইল্ম ও ইয়াক্বীনের ফায়েদা দেওয়া :

পূর্বের আলোচনা ও বিশ্লেষণ থেকে স্পষ্টভাবে জানা যায় যে, উল্লিখিত বাতিল পার্থক্যের ভিত্তি হ’ল তাদের দাবী ‘খবরে ওয়াহিদ কেবল প্রবল ধারণার ফায়েদা দেয়, তা ইয়াকীন ও অকাট্য ইলমের ফায়েদা দেয় না’। অথচ জানা উচিত যে, তাদের একথা নিঃশর্তভাবে মেনে নেওয়ার মত নয়। এ বিষয়ে যথাস্থানে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। এখানে আমাদের জন্য যে বিষয়টি উল্লেখ করা গুরুত্বপূর্ণ সেটি হ’ল, অনেক সময় ‘খবরে ওয়াহিদ’ ইলম ও ইয়াকীনের ফায়েদা দেয়। এ বিষয়ে এমন অনেক হাদীছ রয়েছে, যা উম্মত গ্রহণ করেছে। তন্মধ্যে ইমাম বুখারী ও মুসলিম তাদের স্ব স্ব ছহীহ গ্রন্থে যেসব হাদীছ উল্লেখ করেছেন এবং যেগুলির কোন সমালোচনা করা হয়নি, তা অকাট্যভাবে ছহীহ প্রমাণিত। সেগুলি দ্বারা ইলমুল ইয়াক্বীন বা নিশ্চিত বিশ্বাস অর্জিত হয়। যেমনটি ইমাম ইবনুছ ছালাহ এ বিষয়ে তার ‘উলূমুল হাদীছ’ (পৃঃ ২৮-২৯) গ্রন্থে জোরালোভাবে আলোচনা করেছেন। হাফেয ইবনু কাছীর তার ‘মুখতাছার’-এ তাকে সমর্থন করেছেন। তাঁর পূর্বে শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ এবং আল্লামা ইবনুল ক্বাইয়িম আল-জাওযিয়াহ (রহঃ) তাঁর ‘মুখতাছারুস ছাওয়াইক’ (২/৩৮৩) গ্রন্থে একে সমর্থন করেছেন। অতঃপর এ বিষয়ে উদাহরণ স্বরূপ অনেক হাদীছ উল্লেখ করেছেন। তন্মধ্যে ওমর (রাঃ)-এর হাদীছ অন্যতম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالَّنيَّاتِ  ‘নিশ্চয়ই যাবতীয় আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল’[6] এবং  إِذَا جَلَسَ بَيْنِ شُعَبِهَا الْأَرْبَعِ ثُمَّ جَهَدَهَا فَقَدْ وَجَبَ الْغُسْلُ-  ‘যদি স্বামী স্ত্রীর চার শাখার মাঝে বসে (মিলনের) প্রচেষ্টা করে, তাহ’লে তার ওপর গোসল ওয়াজিব হয়ে যায়’ অন্যতম।[7]

অনুরূপ ইবনু ওমর (রাঃ)-এর হাদীছ,

فَرَضَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ صَدَقَةَ الْفِطْرِ فِيْ رَمَضَانَ عَلَى الصَّغِيْرِ وَالْكَبِيْرِ وَالذَّكَرِ وَالْأُنْثَى-

‘আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ছোট-বড়, নারী-পুরুষ সকলের ওপর রামাযানে ছাদাক্বাতুল ফিতর ফরয করেছেন’।[8] ইত্যাদি আরোও অনেক হাদীছ রয়েছে।

ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, ‘শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, ‘উম্মতে মুহাম্মাদীর পূর্বাপর অধিকাংশের নিকট এটি ইলমুল ইয়াক্বীন বা নিশ্চিত বিশ্বাসের ফায়েদা দেয়। সালাফদের মাঝে এ বিষয়ে কোন মতভেদই ছিল না। আর পরবর্তীদের মধ্যে এটি চার ইমামের অনুসারী বড় বড় ফক্বীহদের মাযহাব। এই মাসআলাটি হানাফী, মালেকী, শাফেঈ ও হাম্বলীদের কিতাবগুলিতে উল্লিখিত হয়েছে। যেমন হানাফীদের মধ্যে সারাখসী ও আবুবকর রাযী, শাফেঈদের মধ্যে শায়খ আবু হামেদ, আবুত তাইয়েব ও শায়খ আবু ইসহাক্ব, মালেকীদের মধ্যে ইবনু খুওয়াইয মিনদাদ প্রমুখ, হাম্বলীদের মধ্যে রয়েছেন ক্বাযী আবু ই‘য়ালা, ইবনু আবী মূসা, আবুল খাত্ত্বাব প্রমুখ, ধর্মতত্ত্ববিদের মধ্যে আবু ইসহাক্ব ইসফারাঈনী, ইবনু ফাওরাক ও আবু ইসহাক্ব নাযযাম প্রমুখ। ইবনুছ ছালাহ এটিকে উল্লেখ করে ছহীহ বলেছেন ও পসন্দ করেছেন। তবে তিনি এর প্রবক্তার আধিক্য সম্পর্কে জানতেন না। যাতে তাদের মাধ্যমে তার কথা শক্তিশালী হ’ত। তিনি কেবল দলীল ছহীহ হওয়ার কারণে বলেছেন। যে সমস্ত বিদ্বান ও দ্বীনদার মাশায়েখ তার বিপক্ষে গেছেন এবং এ বিষয়ে পূর্ণ জ্ঞান না থাকার কারণে তারা মনে করেছেন যে, আবু আমর ইবনুছ ছালাহ যা বলেছেন এর মাধ্যমে তিনি জমহূর হ’তে আলাদা হয়ে গেছেন! এ ব্যাপারে তাদের ওযর হ’ল, এই মাসআলাগুলিতে তারা ইবনুল হাজিবের বক্তব্যের দিকে ফিরে যান। যদি আর একটু উঁচু পর্যায়ে যান তাহ’লে তারা সাইফ আমেদী ও ইবনুল খতীব পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেন। আর যদি তাদের সনদ আরোও উঁচু স্তরের হয় তাহ’লে তারা গাযালী, জুওয়াইনী ও বাকিল্লানীর পর্যায়ে পৌঁছান। তিনি বলেন, সকল আহলেহাদীছ শায়খ আবু আমর যা উল্লেখ করেছেন তার উপরেই রয়েছেন। আর জমহূরের কথার বিপরীতে দলীল হ’ল, খবরকে সত্যায়ন ও আমলগতভাবে গ্রহণ করা উম্মতের ইজমা। আর উম্মত কখনো ভ্রান্তির ওপর ইজমা করতে পারে না। যেমন উম্মত যদি কোন ‘আম’ (সাধারণ) অথবা ‘মুত্বলাক’ (নিঃশর্ত) অথবা ইলমে হাকীকত অথবা ক্বিয়াসের ওপর একমত হয়, তাহ’লে তারা কোন ভুলের ওপর একমত হননি। যদিও তাদের মধ্যে কোন একজনের প্রতি যদি এককভাবে দেখা যায় তাহ’লে দেখা যাবে যে, তিনি ভুল হ’তে নিরাপদ নন। কেননা নির্ভুলতা কেবল সামগ্রিকভাবে সাব্যস্ত হ’তে পারে। যেমন মুতাওয়াতির খবরের ক্ষেত্রেও সংবাদ বাহকদের মধ্যে এককভাবে কারো ওপর ভুল অথবা মিথ্যার ত্রুটি আসা সম্ভব। কিন্তু সামগ্রিকভাবে সবার ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। আর সমষ্টিগতভাবে বর্ণনায় ও সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে উম্মত ভুল হ’তে নিরাপদ। তিনি আরো বলেন, এ ক্ষেত্রে আহাদ বিভিন্ন শর্তে ধারণার ফায়েদা দিতে পারে। যদি আরোও শক্তিশালী হয় তাহ’লে ইলমের রূপ পরিগ্রহ করে। আর যদি দুর্বল হয় তাহ’লে সংশয় ও বাতিল কল্পনায় পরিণত হয়।

তিনি আরো বলেন, জেনে রাখ! বুখারী ও মুসলিমের অধিকাংশ হাদীছ এ জাতীয়। যেমন শায়খ আবু আমর এবং তার পূর্ববর্তী আলেম হাফেয আবু তাহির সিলাফী প্রমুখ উল্লেখ করেছেন। কারণ যে হাদীছকে মুহাদ্দিছগণ সত্যায়ন ও গ্রহণ করেছেন তা নিশ্চিত বিশ্বাসের ফায়েদা দেয়। সুতরাং তারা ব্যতীত এ বিষয়ে অন্যান্য ধর্মতাত্ত্বিক ও উছূলবিদদের কথা ধর্তব্য নয়। কেননা ধর্মীয় সকল বিষয়ে ইজমার ক্ষেত্রে আহলে ইলম বা বিশেষজ্ঞ আলেমদের কথা ধর্তব্য, অন্যদের নয়। যেমন শারঈ আহকামের ক্ষেত্রে ইজমার বিষয়ে আলেমগণ ব্যতীত ধর্মতাত্ত্বিক, বৈয়াকরণ ও চিকিৎসকদের কথা ধর্তব্য নয়। অনুরূপভাবে হাদীছ সত্য ও অসত্যের বিষয়ে ইজমার ক্ষেত্রে হাদীছ, এর বিভিন্ন বর্ণনা পদ্ধতি ও সূক্ষ্ম ত্রুটি বিষয়ে পন্ডিত আলেমগণ ব্যতীত অন্যদের কথা ধর্তব্য নয়। তারা হ’লেন হাদীছবিশারদ যারা তাদের নবীর সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে অবগত, তাঁর সকল কথা ও কর্মের পূর্ণ সংরক্ষণকারী। মুক্বাল্লিদরা যেমন তাদের অনুসরণীয় ব্যক্তিদের মতামতের ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়, হাদীছবিশারদগণ তার চেয়ে অনেক বেশী যত্নবান হন রাসূল (ছাঃ)-এর কথা ও কর্মের প্রতি। মুতাওয়াতির ইলম যেমন ‘আম’ ও ‘খাছ’ দু’ভাগে বিভক্ত হয়। তা বিশেষ একদলের নিকট মুতাওয়াতির হয়, যা অন্যরা জানতেই পারে না। মুতাওয়াতির হওয়া তো দূরের কথা। তদ্রূপ আহলেহাদীছগণ তাদের নবীর সুন্নাতের প্রতি এত অধিক যত্নবান হন যে, তাঁর কথা, কর্ম ও অবস্থা যথাযথ আয়ত্ব করার কারণে তারা এমন জ্ঞানলাভ করেন যাতে তারা সামান্যতম সন্দেহে পতিত হন না, অথচ সেসব বিষয়ে অন্যদের আদৌ কোন অনুভূতিই থাকে না’ (ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন, ২/৩৭৩)                                              [চলবে]


[1]. বুখারী হা/৪০৩; মুসলিম হা/৫২৬।

[2]. মুখতাছার ছাওয়াইকুল মুরসালাহ ১/৫৭৭।

[3]. বুখারী হা/১২২; মুসলিম হা/২৩৮০; মুসনাদে শাফেঈ হা/১৭৯৩।

[4]. আর-রিসালাহ, পৃঃ ৪৫৭।

[5]. ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন, ২/৪১২।

[6]. বুখারী হা/১।

[7]. বুখারী হা/২৯১; মুসলিম হা/৩৪৮; আবূদাঊদ হা/২১৬।

[8]. বুখারী হা/১৫০৩; নাসাঈ হা/২৫০০।  





মহামনীষীদের পিছনে মায়েদের ভূমিকা (৭ম কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
পুলছিরাত : আখেরাতের এক ভীতিকর মনযিল (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
মিথ্যা সাক্ষ্য দানের ভয়াবহতা - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
হজ্জ পরবর্তী করণীয় - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
বিদ‘আত ও তার পরিণতি (৩য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
ধন-সম্পদ : মানব জীবনে প্রয়োজন, সীমালংঘনে দহন (১ম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
জান্নাতের পথ (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - ড. নূরুল ইসলাম
খলীফা বা আমীর নিযুক্ত করা কি যরূরী? - ড. নূরুল ইসলাম
ইসলামের দৃষ্টিতে তাবীয ও ঝাড়-ফুঁক - ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
রামুর ঘটনা সাম্প্রদায়িক নয় রাজনৈতিক - আত-তাহরীক ডেস্ক
অপরিবর্তনীয় জ্ঞান বনাম পরিবর্তনীয় জ্ঞান - প্রফেসর ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া
কুরবানী : ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
আরও
আরও
.