পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ । পর্ব ৬ । পর্ব ৭ । পর্ব ৮ । পর্ব ৯ । শেষ পর্ব ।
দলীল বুঝতে অপারগ ব্যক্তির জন্য তাক্বলীদ জায়েয প্রসঙ্গে :
কেউ বলতে পারে, সবাই তো এই অর্থে আলেম হ’তে পারবে না। আমরা বলব, হ্যাঁ, বিষয়টি এমনই। কিন্তু নিমেণাক্ত আয়াত ও হাদীছ বিষয়ে কে বিতর্ক করবে? আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ ‘যদি তোমরা না জানো, তাহ’লে জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস কর’ (আম্বিয়া ২১/৭)। তিনি আরোও বলেন, فَاسْأَلْ بِهِ خَبِيْرًا ‘অতএব এ বিষয়ে যিনি সর্বাধিক অবগত, তাকে জিজ্ঞেস কর’ (ফুরক্বান ২৫/৫৯)।
যারা
অজ্ঞতা সত্ত্বেও ফৎওয়া দেয় তাদের সম্পর্কে নবী করীম (ছাঃ) বলেন, أَلَا
سَأَلُوْا حِيْنَ جَهِلُوْا فَإِنَّمَا شِفَاءُ الْعَيِّ السُّؤَالُ ‘না
জানার সময় যদি তারা জিজ্ঞেস করতো। কেননা না জানার চিকিৎসা হ’ল জিজ্ঞেস
করা’।[1]
যদিও আলোচনার বিষয় এটা নয় যে, কার পক্ষে তা সম্ভব আর কার পক্ষে তা সম্ভব না। বরং আলোচনার বিষয়বস্ত্ত দ্বারা বুঝা যায় যে, তা বিশেষ শ্রেণীর লোকের জন্য প্রযোজ্য, যাদেরকে ‘আহলে ইলম’ বলে ধরা হয় এবং মনে করা হয় যে, তাদের পক্ষে মাসআলা সমূহ জানা সম্ভব অথবা কিছু মাসআলা দলীল সহ জানা সম্ভব। বাস্তব কথা হ’ল ওরা মাযহাবের অভিমত বিষয়ে পন্ডিত আর কিতাব ও সুন্নাতের ব্যাপারে অজ্ঞ। সুতরাং এমন প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক। বিশেষত এ অধ্যায়ের শুরুতেই উছূল বিষয়ক মৌলিক নীতিমালা উল্লেখ করেছি, যা আমাদেরকে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ফায়েদা দিয়ে থাকে। (এক) তাক্বলীদ কোন উপকারী ইলম নয়। এ বিষয়ে স্পষ্ট বর্ণনা করেছি যা যথেষ্ট হবে ইনশাআল্লাহ। (দুই) তাক্বলীদ সাধারণ ও অজ্ঞ লোকের কাজ। ফলে দলীলাদি জানতে সক্ষম আলেম এ হুকুমের বাইরে। তার কাজ তাক্বলীদ নয়; ইজতিহাদ করা। একথাটি দ্বিতীয় বিষয়টিকে স্পষ্ট করে দেয়। তাই আমি বলি, ইবনু আব্দিল বার্র তাঁর কথার শেষে বলেছেন যার সারাংশ পূর্বেও উল্লেখিত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এসবই সাধারণ লোকদের জন্য। কেননা সাধারণ লোকজনের উচিত তাদের আলেমগণের তাক্বলীদ করা। কেননা দলীলের ক্ষেত্র তার নিকট স্পষ্ট নয় এবং না বুঝার কারণে এ বিষয়ে কোন ইলমও তারা অর্জন করতে পারে না। কেননা ইলমের অনেক স্তর রয়েছে। যার নিমণটি ব্যতীত শীর্ষস্তরে যাওয়া সম্ভব নয়। এখানেই সাধারণ মানুষের মাঝে ও দলীল অন্বেষণের মাঝে অন্তরায়। আল্লাহ অধিক অবগত। সাধারণ লোকজন তাদের আলেম-ওলামার তাক্বলীদ করবে মর্মে আলেমগণ কোন দ্বিমত পোষণ করেননি এবং নিমেণাক্ত আয়াতে তারাই উদ্দেশ্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَاسْأَلوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لا تَعْلَمُونَ ‘যদি তোমরা না জানো, তাহ’লে জ্ঞানীদের নিকটে জিজ্ঞেস কর’ (আম্বিয়া ২১/৭)। তারা এ বিষয়ে একমত যে, অন্ধ ব্যক্তির ওপর আবশ্যক কিবলা চিনতে সমস্যা হ’লে বিশ্বস্ত ও তা সম্পর্কে জ্ঞাত ব্যক্তির তাক্বলীদ করা। অনুরূপভাবে দ্বীন গ্রহণের ব্যাপারে যার কোন ইলম এবং দূরদৃষ্টি নেই, সেও অবশ্যই আলেমের তাক্বলীদ করবে। অনুরূপ আলেমগণ একমত যে, সাধারণ লোকের জন্য ফৎওয়া দেওয়া জায়েয নেই। এটা এ কারণে যে, কিভাবে হালাল করা হয় আর কিভাবে হারাম করা হয় সে সম্পর্কে তার কোন ইলম নেই’।
তবে আমি মনে করি, সাধারণ লোক অবশ্যই তাক্বলীদ করবে কথাটি দু’টি অবস্থা থেকে মুক্ত নয়। কেননা আপনি ভাল করেই জানেন যে, তাক্বলীদ হ’ল অন্যের কথা দলীলবিহীন মেনে নিয়ে আমল করা। অনেক সময় এমন কিছু বিচক্ষণ সাধারণ লোক থাকে যারা তাদের নিকটে পৌঁছানো দলীল স্পষ্ট হওয়ার কারণে দলীল হিসাবে তা তারা জানতে পারে। কে দাবী করবে যে, রাসূলের বাণীاَلَّتيَمُّمُ ضَرْبَةٌ وَاحِدَةٌ لِلْوَجْهِ وَالْكَفَّيْنِ ‘তায়াম্মুম হ’ল মুখমন্ডল ও দু’কব্জির জন্য একবার (দু’হাত মাটিতে) মারা’।[2] এটার দলীল তাদের নিকট স্পষ্ট নয়? বরং তাদের চেয়ে কম মেধার অধিকারী হ’লেও? সুতরাং সত্য কথা হ’ল, যে ব্যক্তি দলীল জানতে অপারগ তার জন্য আবশ্যক তাক্বলীদ করা। আর আল্লাহ তা‘আলা কারো ওপর সাধ্যাতীত কোন কিছু আরোপ করেন না। এ প্রসঙ্গে আলোচনার শেষে ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ)-এর বক্তব্য তুলে ধরা হবে, যা এটিকে আরোও শক্তিশালী করবে। আলেমও কখনো কখনো কিছু মাসআলায় তাক্বলীদের শরণাপন্ন হন। যখন সে বিষয়ে শক্তিশালী কোন দলীল আল্লাহর কিতাবে ও তাঁর রাসূলের হাদীছে তিনি নিজে খুঁজে না পান, তখন সে বিষয়ে তার চেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তির অভিমত পেলে যরূরী কারণে তারই তাক্বলীদ করেন। যেমন কিছু মাসআলায় ইমাম শাফেঈ (রহঃ) করেছেন। এজন্যই ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন,
وَهَذَا فِعْلُ أَهْلِ الْعِلْمِ، وَهُوَ الْوَاجِبُ؛ فَإِنَّ التَّقْلِيدَ إنَّمَا يُبَاحُ لِلْمُضْطَرِّ، وَأَمَّا مَنْ عَدَلَ عَنِ الْكِتَابِ وَالسُّنَّةِ وَأَقْوَالِ الصَّحَابَةِ وَعَنْ مَعْرِفَةِ الْحَقِّ بِالدَّلِيلِ مَعَ تَمَكُّنِهِ مِنْهُ إلَى التَّقْلِيدِ فَهُوَ كَمَنْ عَدَلَ إلَى الْمَيْتَةِ مَعَ قُدْرَتِهِ عَلَى الْمُذَكَّى؛ فَإِنَّ الْأَصْلَ أَنْ لَا يَقْبَلَ قَوْلُ الْغَيْرِ إلَّا بِدَلِيلٍ إلَّا عِنْدَ الضَّرُورَةِ، فَجَعَلْتُمْ أَنْتُمْ حَالَ الضَّرُورَةِ رَأْسَ أَمْوَالِكُمْ-
‘এটা আহলে ইলমের কাজ যা ওয়াজিব। কেননা
তাক্বলীদ বৈধ কেবল নিরুপায় ব্যক্তির জন্য। কিন্তু যে ব্যক্তি কিতাব,
সুন্নাত, ছাহাবীগণের মতামত ও দলীল সহ হক জানতে সক্ষম হওয়ার পরও এসব থেকে
মুখ ফিরিয়ে তাক্বলীদ করবে, সে যেন যবাইকৃত পশু ভোগ করার সামর্থ্য থাকা
সত্ত্বেও তা বাদ দিয়ে মৃত পশুর দিকে মুখ ফিরালো। কেননা মূল কথা হ’ল দলীল
ছাড়া অন্য কারো কথা গ্রহণ না করা। কিন্তু মুক্বাল্লিদরা যরূরী অবস্থাকে আসল
মূলধন মনে করে নিয়েছে’।[3]
ইজতিহাদের বিরুদ্ধে মাযহাবীদের যুদ্ধ এবং প্রত্যেক ব্যক্তির ওপর তাক্বলীদ আবশ্যক করা :
এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর এখন আমাদের পূর্বেকৃত ওয়াদা যা বাকী রয়েছে তা হ’ল, ইমামগণের অনুসরণের দাবীদারদের অবস্থা পর্যালোচনা করা এবং তাদের মতামতগুলি অনুসরণের যৌক্তিকতা তুলে ধরা। এ প্রসঙ্গে আমি বলব, যুগ যুগ ধরে তাক্বলীদপন্থী মাশায়েখের অধিকাংশের অবস্থান খুবই বিস্ময়কর। কেননা তারা যখন দাবী করে যে, বিধি-বিধান বুঝার ক্ষেত্রে কিতাব ও সুন্নাতের দিকে ফিরে যাওয়ার যোগ্যতা তাদের নেই এবং ইমামগণের তাক্বলীদ করা তাদের আবশ্যক! তখন আপনি দেখবেন যে তারা কিন্তু জাহেল বা অজ্ঞ সাব্যস্ত হ’তে রাযী নয়। অথচ তাদের আলেমগণের মতামতের দাবী এটাই। বরং আমরা দেখতে পাই তারা তাদের অনেক মূলনীতির তাক্বলীদ থেকেও বেরিয়ে গেছেন এবং নিজেরাই কিছু মূলনীতি তৈরী করেছেন! অথচ তাক্বলীদের দাবীদার হওয়ার পর তাদের এমন দাবী করাটা যৌক্তিক ছিল না। বিশেষ করে তখন যখন তাদের তৈরী করা মূলনীতিগুলি কিতাব ও সুন্নাতের দলীল বিরোধী। আসলে তারা এসব মূলনীতি এজন্য তৈরী করেছেন যাতে শাখা-প্রশাখাগত বিষয়গুলিতে ইমামগণের তাক্বলীদ করাকে নিজেদের ওপর আবশ্যক করতে পারেন। যদিও সেগুলি তাদের অনুসরণীয় ইমামগণের পূর্ববর্তী নির্দেশ বিরোধী। তারা দাবী করে যে, أَنَّ الْمُجْتَهِدَ الْمُطْلَقَ قَدْ فُقِدَ ‘মুজতাহিদ মুতলাক্ব পাওয়া যায় না’।[4] তাদের প্রসিদ্ধ কথা হ’ল ‘৪র্থ শতাব্দী হিজরীর পর ইজতিহাদের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে!’ ইবনু আবেদীন তার হাশিয়াতে এমনটিই উল্লেখ করেছেন (১/৫৫১)।
এজন্য তারা মুসলমানদেরকে কিতাব ও সুন্নাতের জ্ঞান অর্জন করতে নিষেধ করেছেন এবং চার ইমামের কোন একজনের তাক্বলীদ করা তাদের ওপর ওয়াজিব করেছেন। যেমন ‘আল-জাওহারাহ’ গ্রন্থকার বলেছেন,
وَوَاجِبٌ تَقْلِيْدُ حَبْرٍ مِنْهُمُ ... كَذَا حَكَى الْقَوْمُ بِلَفْظٍ يُفْهَمُ-
‘তাদের মধ্যে একজন বড় আলেমের তাক্বলীদ ওয়াজিব। এমনটিই লোকেরা সুস্পষ্ট শব্দে বর্ণনা করেছেন’।
তারা দাবী করেছেন যে, ইলমে হাদীছ ও ফিক্বহ পূর্ণতা পেয়েছে এবং শুকিয়ে গেছে।[5] তারা দৃঢ়তার সাথে এটা বলেছেন এবং এর স্বপক্ষে মানদন্ড হিসাবে আবুল হাসান কারখীর নিমেণাক্ত কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন,
كُلُّ آيَةٍ تُخَالِفُ مَا عَلَيْهِ أَصْحَابُنَا فَهِيَ مُؤَوَّلَةٌ أَوْ مَنْسُوْخَةٌ وَكُلُّ حَدِيْثٍ كَذَلِكَ فَهُوَ مُؤَوَّلٌ أَوْ مَنْسُوْخٌ-
‘আমাদের অনুসারীরা যে সকল মূলনীতির ওপর রয়েছেন তার বিরোধী যে সকল আয়াত রয়েছে বুঝতে হবে সেগুলি তাবীলযোগ্য অথবা মানসূখ বা রহিত হয়ে গেছে! অনুরূপভাবে আমাদের মাযহাব বিরোধী প্রত্যেকটি হাদীছ ব্যাখ্যাযোগ্য অথবা তা মানসূখ হয়ে গেছে’।[6] সেজন্য যে কোন আয়াত কিংবা হাদীছ আপনি তাদের সামনে পেশ করুন না কেন তারা নিজেদের জন্য সেটাকে দ্রুত প্রত্যাখান করাকে জায়েয করে নিয়েছে!! তারা এর নির্দেশনা নিয়ে কোন চিন্তা ও গবেষণা করবে না এবং এ দু’টি বাস্তবিকভাবে তাদের মাযহাব বিরোধী কি-না তা নিয়েও ভাববে না। আর আপনি এ প্রশ্ন করলে আপনাকে এই বলে জবাব দেবে যে, আপনি বেশি জানেন, না মাযহাব?!!
গোঁড়ামি ও ইমামগণের তাক্বলীদ করাকে ফরয করার ক্ষেত্রে মাযহাবীদের তাদের ইমামদের বিরোধিতা করা :
তারা
যে সকল মূলনীতি তৈরী করেছে তা তাদের ইমামগণ যা অছিয়ত করেছেন তার বিরোধী।
তারা নিজেদের অন্তরে এবং শিক্ষার্থীদের মানসপটে তাক্বলীদকেই সুদৃঢ় করে
দিয়েছে। এর মাধ্যমে তারা কিতাব ও সুন্নাতের জ্ঞান অর্জন করার রাস্তা তাদের
জন্য বন্ধ করে দিয়েছে। তাদের দৃষ্টিতে ফিক্বহ বলতে বুঝায় তাদের (মাযহাবী)
কিতাবসমূহে বর্ণিত আলেমগণের মতামতগুলি জানা ও বুঝা। তারা কেবল এতেই
সন্তুষ্ট থাকেনি বরং মাযহাবী গোঁড়ামির দিকেও আহবান করেছে। যেমন তাদের কিছু
লোক বলেছে, ‘যদি আমাদেরকে আমাদের মাযহাব ও বিরোধী মাযহাব সম্পর্কে জিজ্ঞেস
করা হয় তাহ’লে অবশ্যই বলব, আমাদের মাযহাব সম্পূর্ণ সঠিক, কিছু ভুল হওয়ার
সম্ভাবনাও রয়েছে। আর আমাদের বিরোধী মাযহাব ভুল, সঠিক হওয়ার সম্ভাবনাও
রয়েছে। আর যদি আমাদের আক্বীদা ও আমাদের বিরোধীদের আক্বীদা সম্পর্কে আমরা
জিজ্ঞাসিত হই তাহ’লে অবশ্যই বলব, আমরা যে আক্বীদার ওপর রয়েছি তা হক আর
আমাদের বিরোধীরা যার ওপর আছে তা বাতিল’।[7]
অথচ এ ধরনের কথা এবং যেগুলি আমরা উল্লেখ করিনি, সেগুলি অনুসরণীয় ইমামগণের কেউই বলেননি। বরং তারা ছিলেন জ্ঞানী ও আল্লাহভীরু। উল্লেখিত কথাটি দু’টি কারণে সুস্পষ্টরূপে বাতিল। এক- এমন কথা কিতাব ও সুন্নাতের অনেক দলীল বিরোধী, যা ইলম ছাড়া কথা বলতে মানুষকে নিষেধ করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَلا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ ‘যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই তার পিছে পড়ো না’ (বানী ইসরাঈল ১৭/৩৬)।
আপনি ভাল করেই জেনেছেন যে, প্রকৃত ইলম তো সেটাই যা কুরআন ও সুন্নাহতে এসেছে। সুতরাং তারা যা বলেছে এর স্বপক্ষে এদু’টির কোথাও কিছু এসেছে কি?!
দুই- তারা তাক্বলীদের দাবী করে। আর মুক্বাল্লিদের দলীল তার ইমামের কথা, যেমন তাদের কিতাব থেকেই জানা যায়। তাই যদি হয় তাহ’লে এ বিষয়ে তাদের ইমামের কথা কোথায় উল্লেখ আছে? এ থেকে তো তারা অনেক দূরে রয়েছেন।
মুক্বাল্লিদদের মাঝে মতানৈক্য বেশি এবং আহলেহাদীছদের মধ্যে কম :
যিনি এটা জেনেছেন তিনি দীর্ঘ শতাব্দী যাবৎ মুক্বাল্লিদদের নিন্দনীয় বিভক্তির কারণও জানতে পেরেছেন। এমনকি তাদের অনেকেই এমন ফৎওয়া দিয়েছেন যে, অন্য মাযহাবের লোকের পিছনে ছালাত আদায় করলে তা বাতিল অথবা মাকরূহ। বরং তাদের কিছু লোক হানাফীকে শাফেঈ মাযহাবের মেয়েকে বিবাহ করতে নিষেধ করেছেন। আবার কেউ কেউ এটাকে বৈধ করেছেন। কিন্তু বিপরীতটাকে (হানাফী মেয়ে ও শাফেঈ ছেলে) জায়েয বলেননি! এর কারণ হিসাবে তারা বলে থাকেন ‘তাকে (শাফেঈ মাযহাবের মেয়েকে) আহলে কিতাব হিসাবে ধরতে হবে’! বিষয়টি এমন যেন আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নিমেণাক্ত বাণীতে তাদেরকে উদ্দেশ্য করেননি,وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ تَفَرَّقُوا وَاخْتَلَفُوا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَأُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ- ‘তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা পরস্পরে বিচ্ছিন্ন হয়েছে এবং স্পষ্ট প্রমাণাদি এসে যাওয়ার পরেও তাতে মতভেদ করেছে। এদের জন্য রয়েছে ভয়ংকর শাস্তি’ (আলে ইমরান ৩/১০৫)। তিনি আরোও বলেন,فَتَقَطَّعُوا أَمْرَهُمْ بَيْنَهُمْ زُبُرًا كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ- ‘কিন্তু তারা তাদের দ্বীনকে বহু ভাগে বিভক্ত করে ফেলে। আর প্রত্যেক দলই তাদের কাছে যা আছে, তাই নিয়ে সন্তুষ্ট’ (মুমিনূন ২৩/৫৩)।
ইবনুল
ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, اَلزُّبُر দ্বারা কিতাবসমূহ উদ্দেশ্য। অর্থাৎ
প্রত্যেকটি দল নিজেদের জন্য কিতাবসমূহ রচনা করেছে, তা গ্রহণ করেছে, সেগুলি
অনুযায়ী আমল করেছে এবং সেদিকেই মানুষকে দাওয়াত দিয়েছে। আর অন্য কিতাবগুলিকে
পরিহার করেছে এবং বাস্তবতায় এমনটিই দেখতে পাওয়া যায়’।[8]
আমার বক্তব্য হ’ল, সম্ভবত এইগুলি সেই কিতাব যার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ), যা আমর বিন কায়স সাকূনী তার থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন,
خَرَجْتُ مَعَ أَبِي فِي الْوَفْدِ إِلَى مُعَاوِيَةَ فَسَمِعْتُ رَجُلًا يُحَدِّثُ النَّاسَ يَقُولُ : إِنَّ مِنْ أَشْرَاطِ السَّاعَةِ أَنْ تُرْفَعَ الْأَشْرَارُ وَتُوضَعَ الْأَخْيَارُ، وَأَنْ يُخْزَنَ الْفِعْلُ وَالْعَمَلُ وَيَظْهَرَ الْقَوْلُ، وَأَنْ يُقْرَأَ بِالْمُثَنَّاةِ فِي الْقَوْمِ لَيْسَ فِيهِمْ مَنْ يُغَيِّرُهَا أَوْ يُنْكِرُهَا فَقِيلَ : وَمَا الْمُثَنَّاةُ؟ قَالَ : مَا اكْتُتِبَتْ سِوَى كِتَابِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ-
‘আমি আমার পিতার সাথে একটি দলে
মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর নিকট গেলাম। আমি শুনতে পেলাম একজন লোক মানুষদের নিকট
আলোচনা করছেন। তিনি বলছেন, ক্বিয়ামতের আলামতগুলির মধ্যে রয়েছে খারাপ
লোকদেরকে মর্যাদায় আসীন করা এবং ভাল মানুষদের মর্যাদাকে তুচ্ছ করা (অর্থাৎ
মানুষেরা খারাপ লোকদেরকে উচ্চ মর্যাদায় আসীন করবে এবং শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের
মর্যাদা হ্রাস করা হবে, যা আজকাল দেখা যায়।) মানুষ কাজ কর্ম জমা করে রাখবে,
কথা বেশি প্রকাশ পাবে (অর্থাৎ কথা বেশী, কাজ কম হবে), লোকদের মাঝে কিতাব
(কুরআন) ছাড়া অন্যকিছুর পঠন চালু হবে। তাদের মাঝে এমন কাউকে পাওয়া যাবে না
যে তা পরিবর্তন করবে অথবা অপসন্দ করবে। বলা হ’ল, মুছান্নাত কি? তিনি বললেন,
কিতাবুল্লাহ্ ছাড়া অন্য যা কিছু লিখা হয়’।[9]
সম্ভবত এজন্যই ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) কিতাব ও সুন্নাতের একনিষ্ঠ অনুসারী হওয়ার কারণে শাখা-প্রশাখাগত ও রায়ভিত্তিক বইগুলিকে অপসন্দ করতেন।[10] এই ভয়ে যে, মানুষ কিতাব ও সুন্নাহকে বাদ দিয়ে সেগুলিকেই প্রাধান্য দিতে পারে। যেমনটি মুক্বাল্লিদরা পুরোপুরি করেছে। কেননা তারা মতভেদের সময় তাদের মাযহাবকেই কিতাব ও সুন্নাতের ওপর প্রাধান্য দিয়ে থাকে এবং মাযহাবকেই এ দু’টির মানদন্ড (مِعْيارا) মনে করে, যা পূর্বে কারখীর কথা দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণিত হয়েছে। অথচ কিতাব ও সুন্নাতের ইত্তেবা ওয়াজিব ছিল, যেটি পূর্বে উল্লেখিত কুরআন ও সুন্নাহর দাবী। তাদের ইমামগণের অভিমতগুলিও তাদের ওপর এটাই ওয়াজিব করে এবং তাদের উচিত অন্যান্য মাযহাবগুলির মধ্যে যার নিকট কিতাব ও সুন্নাত রয়েছে তার সাথে একাত্মতা পোষণ করা। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় তারা পরস্পর বিরোধী ও মতানৈক্যকারী রূপেই থেকেছে! এজন্যই ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) রাসূলের (ছাঃ) এই হাদীছটি,
وَإِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِي فَسَيَرَى اخْتِلَافًا كَثِيرًا، فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي...-
‘নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে আমার পরে যে ব্যক্তি বেঁচে থাকবে সে অচিরেই অনেক মতভেদ দেখতে পাবে। সে সময় তোমরা আমার সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরবে...’[11] উল্লেখ করে বলেন, ‘এটা মতভেদকারীদের জন্য নিন্দা এবং তাদের পথে চলার ব্যাপারে সতর্কবার্তা। নিশ্চয়ই মতভেদ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তা জটিল আকার ধারণ করেছে তাক্বলীদ ও এর অনুসারীদের কারণেই। যারা দ্বীনকে খন্ড-বিখন্ড করেছে এবং দ্বীনের অনুসারীদেরকে বিভিন্ন দলে ভাগ করে ফেলেছে। প্রত্যেকটি ফের্কা স্বীয় অনুসৃত ব্যক্তির প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত হয়, সেদিকেই দাওয়াত দেয়, তার বিরোধীদেরকে তিরস্কার করে এবং তাদের কথা অনুযায়ী আমল করাকে বৈধ মনে করে না। এমনকি বিষয়টি এমন যেন ওরা ভিন্ন ধর্মের লোক! তারা তাদের বিরুদ্ধে জবাব দেওয়ার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম ও মেহনত করে। তারা বলে, ‘তাদের বইগুলি’ ও ‘আমাদের বইগুলি’, ‘তাদের ইমামগণ’ ও ‘আমাদের ইমামগণ’ ‘তাদের মাযহাব’ ও আমাদের মাযহাব’! অথচ নবী একজন, কুরআন একটিই, রব এক। সুতরাং সকলের ওপর ওয়াজিব হ’ল একটি বাক্যের প্রতি অনুগত হওয়া যা সবার কাছেই সমান, রাসূল (ছাঃ) ব্যতীত আর কারো নিঃশর্ত আনুগত্য না করা, অন্য কাউকে তার সমকক্ষ মনে করে তার মতামতগুলিকে তাঁর বাণীর মত মনে না করা, আল্লাহ ব্যতীত পরস্পরকে প্রভু হিসাবে গ্রহণ না করা। এসব বিষয়ে যদি তাদের সবার কথা এক হয়, তাদের প্রত্যেকেই যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে আহবানকারীর প্রতি অনুগত হয়, তারা সবাই যদি সুন্নাত ও ছাহাবীগণের আছারের মাধ্যমে শারঈ বিষয়ে ফায়ছালা গ্রহণ করে, তাহ’লে অবশ্যই মতভেদ কমে যেত। যদিও তা একেবারে পৃথিবী থেকে নিঃশেষ হ’ত না। সেজন্য আপনি দেখতে পাবেন আহলে সুন্নাত ও আহলেহাদীছরা মানুষের মধ্যে সবচেয়ে কম মতভেদকারী। সুতরাং ভূ-পৃষ্ঠে ঐক্যের দিক দিয়ে তাদের চেয়ে বেশি এবং মতভেদের ক্ষেত্রে তাদের চেয়ে কম আর কোন দলকে আপনি দেখতে পাবেন না। কেননা তারা এই মূলের ওপর প্রতিষ্ঠিত। যখনই কোন ফির্কা হাদীছ থেকে বেশী দূরে থাকবে তখনই তাদের নিজেদের মাঝে মতভেদ ততবেশি কঠিন ও জটিল আকার ধারণ করবে। কেননা যে হককে প্রত্যাখ্যান করে, তখন হক তার নিকট বিশৃঙ্খল ও অগোছালো মনে হয়। সঠিক বিষয়টাও তার নিকট সংশয়পূর্ণ মনে হয়। ফলে সে তার গন্তব্যস্থল সম্পর্কে জানে না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,بَلْ كَذَّبُوْا بِالْحَقِّ لَمَّا جَاءَهُمْ فَهُمْ فِي أَمْرٍ مَرِيْجٍ- ‘বরং তারা সত্য আসার পর তাতে মিথ্যারোপ করেছে। ফলে তারা সংশয়ে পড়ে গেছে’ (ক্বাফ ৫০/৫)।
তিনি আরো বলেন, (২/৩৪৭) ‘আমরা এমন দাবী করি না যে, আল্লাহ তা‘আলা সকল সৃষ্টির ওপর এটি ফরয করে দিয়েছেন যে, দ্বীনের ছোট-বড় সকল মাসআলায় সত্য বিষয়কে দলীল সহ জানবে। আমরা কেবল সেগুলিকেই অপসন্দ করি যেগুলিকে ইমামগণ ও তাদের পূর্বে ছাহাবীগণ ও তাবেঈগণ অপসন্দ করেছেন। আমরা অপসন্দ করি রাসূল (ছাঃ)-এর ভাষায় শ্রেষ্ঠ যুগের পর নিন্দিত চতুর্থ শতাব্দী হিজরীর পর ইসলামের নামে যা কিছু নতুন সৃষ্টি হয়েছে সেগুলিকে। যেমন একজন ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট করে নিয়ে তাঁর ফৎওয়া সমূহকে শরী‘আত প্রণেতার দলীলের মর্যাদা দেয়া, বরং তাঁর ওপর তাকে প্রাধান্য দেওয়া, তার কথাকে রাসূল (ছাঃ)-এর পরে তাঁর উম্মতের সকল আলেমের মতামতের ওপর প্রাধান্য দেওয়া, আহকামকে আল্লাহর কিতাব, তাঁর রাসূলের সুন্নাত ও ছাহাবীগণের বক্তব্য থেকে হাছিল করার পরিবর্তে তাঁর তাক্বলীদকেই যথেষ্ট মনে করা, এগুলির সাথে আরো কিছু যোগ করা যেমন ‘মুক্বাল্লাদ’ (অনুসৃত ব্যক্তি) সম্পর্কে এমন বিশ্বাস করা যে, তিনি কেবল তাই বলেছেন যা কিতাব ও সুন্নাতে রয়েছে, (এর বাইরে তিনি কিছু বলতেই পারেন না)! এটা এমন সাক্ষ্য যে, সাক্ষীদাতা নিজেই তা জানে না এবং এটি আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে না জেনে কথা বলার নামান্তর। সে তার বিরোধী ব্যক্তি সম্পর্কে বলে থাকে যে, তিনি কিতাব ও সুন্নাতের সঠিক অনুসারী নন! যদিও বাস্তবিকপক্ষে তিনিই তার চেয়ে বেশি জ্ঞানী! সে আরো বলে যে, আমি যার অনুসরণ করি তিনিই সঠিক অথবা বলে, তারা দু’জনই কিতাব ও সুন্নাহর যথার্থ অনুসারী। অথচ দেখা যায় যে, তাদের উভয়ের অভিমত পরস্পর বিরোধী। ফলে সেই ব্যক্তি কিতাব ও সুন্নাহর দলীলগুলি পরস্পর সাংঘর্ষিক মনে করে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ) একই সময়ে কোন একটি বিধান দেন আবার তার বিরোধী বিধানও দেন। তাঁর দ্বীন কি লোকদের রায়ের অনুগামী? একই বিষয়ে তাঁর কি নির্দিষ্ট কোন বিধান নেই? ঐ ব্যক্তি হয় এই মাসলাক অনুসরণ করে চলবে অথবা তার অনুসৃত ব্যক্তির বিরোধী ব্যক্তিকে ভুল বলবে। এ দু’টি বিষয়ের যেকোন একটি করা তার জন্য যরূরী। আর এটাই তার তাক্বলীদের বরকত!
যখন এই কথাগুলি জানা গেল তখন আমরা বলছি এবং পূর্বেও বলেছি যে, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদের ওপর সাধ্যমত তাঁকে ভয় করা আবশ্যক করেছেন। যা থেকে বেঁচে থাকবে তা জানাই তাক্বওয়ার মূল বিষয়। তারপর সে অনুযায়ী আমল করা। তাই প্রত্যেক বান্দার ওপর ওয়াজিব যে বিষয়ে তাক্বওয়া অবলম্বন করবে সে বিষয়ে জানার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা যেমন আল্লাহর আদেশ, নিষেধ ইত্যাদি। অতঃপর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যকে আঁকড়ে ধরবে। জানার চেষ্টা করার পর যা কিছু তার অজানা থেকে যাবে সে বিষয়ে তিনি রাসূল (ছাঃ) ব্যতীত অন্য লোকদের মতই। কেননা তিনি ব্যতীত তাঁর আনীত বিষয়ের কিছু না কিছু প্রত্যেকের নিকট অজানা থাকেই। কিন্তু এই অজানা তাকে আহলে ইলমের তালিকা থেকে বের করে দেয় না। হক জানা ও মানার ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদের ওপর সাধ্যাতীত কিছু চাপিয়ে দেন না।
[চলবে]
[1]. আবূদাঊদ হা/৩৩৬, হাসান।
[2]. আবূদাঊদ হা/৩২৭, ছহীহ।
[3]. ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন ২/৩৪৪।
[4]. আদ-দুর্রুল মুখতার ১/৪৫, হাশিয়া দ্রঃ।
[5]. ঐ, হাশিয়া দ্রঃ।
[6]. ঐ, হাশিয়া দ্রঃ।
[7]. আল্লামা খুযারী, তারীখুত তাশরীঈল ইসলামী, পৃঃ ৩৩২।
[8]. ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন ১/৩১৪
[9]. হাকেম হা/৮৬৬১। তিনি বলেছেন, এর সনদ ছহীহ। যাহাবী তাকে সমর্থন করেছেন। যদিও তা মাওকূফ কিন্তু তার হুকুম মারফূ‘। কেননা তা এমন গায়েবী বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত যা কেবল রায় দ্বারা বলা যায় না। তাছাড়া কিছু রাবী এটিকে মারফূ‘ সূত্রে বর্ণনা করে ছহীহও বলেছেন।
[10]. ইবনুল জাওযী, মানাক্বিবু আহমাদ, পৃঃ ১৯২।
[11]. আবূদাঊদ হা/৪৬০৭, ছহীহ।