ভূমিকা : মানবতার হেদায়াতের জন্য মহান আল্লাহ যুগে যুগে নবী-রাসূলগণকে পাঠিয়েছেন। যাতে মানুষ পথভ্রষ্ট হয়ে পরকালে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত না হয়। সেই সাথে দিশারী হিসাবে বিভিন্ন সময় ইলাহী গ্রন্থ এসেছে মানুষকে সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য। মানুষ আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসূল প্রদর্শিত সেই হেদায়াতের পথে চললে পরকালীন জীবনে নাজাত লাভ করবে। পক্ষান্তরে হেদায়াতের রাস্তা থেকে বিচ্যুত হ’লে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। তাই হেদায়াত লাভের পথ-পন্থা জানা মানুষের জন্য যরূরী। এ নিবন্ধে হেদায়াত লাভের উপায় আলোচনা করা হ’ল।-
হেদায়াত অর্থ : হেদায়াত (هِدَايَة) আরবী শব্দ। অর্থ পথ প্রদর্শন, পথের সন্ধান, নির্দেশনা, পরিচালনা ইত্যাদি। এর ইংরেজী প্রতিশব্দ হচ্ছে, Way of salvation, straight way, conversion ইত্যাদি। হেদায়াত শব্দটি ভাল ও মন্দ দু’টি অর্থেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন আল্লাহ বলেন, وَهَدَيْنَاهُ النَّجْدَيْنِ، ‘আর আমরা কি তাকে (ভাল ও মন্দ) দু’টি পথই দেখাইনি? (বালাদ ৯০/১০)। অন্যত্র তিনি বলেন,إِنَّا هَدَيْنَاهُ السَّبِيلَ إِمَّا شَاكِرًا وَّإِمَّا كَفُورًا، ‘আমরা তাকে সুপথ প্রদর্শন করেছি। এক্ষণে সে কৃতজ্ঞ হৌক কিংবা অকৃতজ্ঞ হৌক’ (দাহর ৭৬/৩)। এখানে ‘হেদায়াত’ অর্থ সুপথ প্রদর্শন ও তার তাওফীক লাভ করা। যেমন আল্লাহ তদীয় রাসূলকে বলেন, وَإِنَّكَ لَتَهْدِيْ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيْمٍ، ‘নিশ্চয়ই তুমি সরল পথ প্রদর্শন করে থাক’ (শূরা ৪২/৫২)। অনুরূপভাবে জান্নাতবাসীরা আল্লাহকে বলবে,الْحَمْدُ للهِ الَّذِيْ هَدَانَا لِهَذَا وَمَا كُنَّا لِنَهْتَدِيَ لَوْلاَ أَنْ هَدَانَا اللهُ، ‘যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি আমাদেরকে এর পথ প্রদর্শন করেছেন। আর আল্লাহ আমাদের হেদায়াত না করলে আমরা হেদায়াতপ্রাপ্ত হ’তাম না’... (আ‘রাফ ৭/৪৩)।
পারিভাষিক অর্থ : হেদায়াতের পারিভাষিক অর্থ প্রসঙ্গে আল-জুরজানী বলেন,الدلالة على ما يوصل الى المطلوب وقد يقال هى سلوك طريق يوصل الى المطلوب. ‘এমন পথনির্দেশ যা উদ্দিষ্ট স্থলে পৌঁছে দেয়। আর এটাও বলা হয় যে, তা হ’ল এমন রাস্তা অবলম্বন করা যা গন্তব্যে পৌঁছে দেয়’।[1]
হেদায়াতের প্রকারভেদ : হেদায়াত দু’প্রকার। যথা- ১. ইলমের হেদায়াত। যেমন আল্লাহ কুরআনকে هُدًى لِلْمُتَّقِينَ ‘মুত্তাক্বীদের জন্য হেদায়াত’ (বাক্বারাহ ২/২) এবং هُدًى لِلنَّاسِ ‘মানবজাতির জন্য হেদায়াত’ (বাক্বারাহ ২/১৮৫) বলেছেন। এ
বিষয়ে জ্ঞানার্জনের জন্য আল্লাহর হেদায়াত প্রয়োজন।
২. ইলম অনুযায়ী আমল করার তাওফীক লাভের হেদায়াত। কারণ ইসলামই যে সরল পথ, এ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা এবং তদনুযায়ী আমল করা, উভয়টির জন্যই আল্লাহর হেদায়াত প্রয়োজন। যেমন আল্লাহ বলেন,وَأَمَّا ثَمُوْدُ فَهَدَيْنَاهُمْ فَاسْتَحَبُّوا الْعَمَى عَلَى الْهُدَى فَأَخَذَتْهُمْ صَاعِقَةُ الْعَذَابِ الْهُونِ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُوْنَ، ‘অতঃপর ছামূদ জাতি। তাদেরকে আমরা পথপ্রদর্শন করেছিলাম। কিন্তু তারা সৎপথের বিপরীতে ভ্রান্তপথ অবলম্বন করল। ফলে তাদের কৃতকর্মের ফলস্বরূপ লাঞ্ছনাকর শাস্তি তাদের গ্রেফতার করে’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/১৭)। এমনিভাবে যুগে যুগে কাফের ও মুনাফিক লোকেরা ভ্রান্তপথ অবলম্বন করেছে এবং এখনও করে চলেছে। আমরা যেন তাদের মত না করি, সেজন্য আল্লাহর নিকটে হেদায়াত প্রার্থনা করতে বলা হয়েছে।
হেদায়াত-এর স্তরসমূহ : هداية শব্দটি নবী-রাসূল, অলী ও সাধারণ উম্মত এমনকি সকল সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কেননা প্রত্যেকের জন্য স্তর বিশেষে হেদায়াতের প্রয়োজন রয়েছে। যেমন-
১. হেদায়াতের প্রথম স্তরে রয়েছে সমস্ত সৃষ্টি তথা জড়পদার্থ, উদ্ভিদ, প্রাণীজগত ইত্যাদি। এদের মধ্যে প্রয়োজনীয় বুদ্ধি ও অনুভূতির অস্তিত্ব রয়েছে। এরা সকলেই আল্লাহর হেদায়াত অনুযায়ী স্ব স্ব নিয়মে আল্লাহর গুণগান করে থাকে। যেমন আল্লাহ বলেন,أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللهَ يُسَبِّحُ لَهُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَالطَّيْرُ صَافَّاتٍ كُلٌّ قَدْ عَلِمَ صَلَاتَهُ وَتَسْبِيحَهُ وَاللهُ عَلِيمٌ بِمَا يَفْعَلُونَ، ‘তুমি কি জানো না যে, আসমান ও যমীনে যা কিছু রয়েছে, সবকিছুই আল্লাহর গুণগান করে থাকে? বিশেষ করে পক্ষীকুল যারা সারিবদ্ধভাবে উড়ে বেড়ায়। প্রত্যেকেই স্ব স্ব দো‘আ ও তাসবীহ সম্পর্কে জ্ঞাত। আল্লাহ তাদের কর্ম সম্পর্কে সম্যক অবগত’ (নূর ২৪/৪১)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, الَّذِيْ أَعْطَى كُلَّ شَيْءٍ خَلْقَهُ ثُمَّ هَدَى، ‘যিনি প্রত্যেক বস্ত্তর বিশেষ আকৃতি দান করেছেন। অতঃপর তার উপযোগী হেদায়াত প্রদান করেছেন’ (ত্বোয়াহা ২০/৫০)। এজন্যেই পশু-পক্ষী প্রত্যেকে আল্লাহ প্রদত্ত বোধশক্তি অনুযায়ী চলাফেরা করে। কখনও অবাধ্যতা করে না।
২. হেদায়াতের দ্বিতীয় স্তরে রয়েছে জিন ও মানব জাতি, যারা অন্যান্য সৃষ্টি অপেক্ষা তীক্ষ্ণ মেধা ও উচ্চ জ্ঞানসম্পন্ন। আল্লাহর পক্ষ হ’তে নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে তাদের নিকটে হেদায়াত পাঠানো হয়েছে। কেউ তা গ্রহণ করে ধন্য হয়েছে। আবার কেউ প্রত্যাখ্যান করে হতভাগা হয়েছে।
৩. হেদায়াতের তৃতীয় স্তর হ’ল মুমিন-মুত্তাক্বীদের জন্য, যাতে তারা অধিকতর নেক বান্দা হওয়ার তাওফীক লাভ করেন। আল্লাহর দেওয়া তাওফীক অনুযায়ী এই স্তর বিন্যাস হয়ে থাকে। যেমন আল্লাহপাক বলেন,تِلْكَ الرُّسُلُ فَضَّلْنَا بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ مِنْهُمْ مَنْ كَلَّمَ اللهُ وَرَفَعَ بَعْضَهُمْ دَرَجَاتٍ، ‘এই রাসূলগণ! আমরা তাদের একে অপরের উপর মর্যাদা দিয়েছি। তাদের মধ্যে কারো সাথে আল্লাহ কথা বলেছেন এবং কারো মর্যাদা উচ্চতর করেছেন’ (বাক্বারাহ ২/২৫৩)। এই তৃতীয় স্তরই মানুষের প্রকৃত উন্নতির ক্ষেত্র। এই স্তরের মানুষেরা অধিকতর হেদায়াত লাভের জন্য সর্বদা আল্লাহর রহমত ও তাওফীক লাভে সচেষ্ট থাকেন। প্রতিনিয়ত এই প্রচেষ্টাই মানুষকে সর্বোচ্চ মর্যাদায় অভিষিক্ত করে। এমনকি এক সময় সে ফেরেশতাদের চাইতে উন্নত মর্যাদায় আসীন হয়। নবী-রাসূলগণ এই স্তরে আছেন। যেকারণে মি‘রাজ রজনীতে জিব্রীলকে ছেড়ে রাসূল (ছাঃ) শেষ মুহূর্তে একাকী আল্লাহর দীদার লাভে সক্ষম হন। অতএব মানুষ যেখানে যে অবস্থায় থাকুক না কেন, সর্বদা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে প্রদত্ত আল্লাহর হেদায়াত সমূহ অনুসরণে ছিরাতে মুস্তাক্বীম ধরে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে যাবে তার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর পানে জান্নাত লাভের বাসনা নিয়ে।
উল্লেখ্য যে, উঁচু-নীচু সকল পর্যায়ের মানুষেরই সর্বদা সর্বাবস্থায় আল্লাহর হেদায়াত প্রয়োজন। সকল স্তরের ও সকল পর্যায়ের মানুষের জন্য ছিরাতে মুস্তাক্বীম-এর হেদায়াত সর্বদা যরূরী। সেই হেদায়াত প্রার্থনার জন্য আল্লাহ স্বীয় বান্দাকে শিক্ষা দিয়েছেন।
হেদায়াত লাভের উপায়
হেদায়াত লাভের নানা উপায় মহান আল্লাহ স্বীয় কিতাব কুরআনে এবং তদীয় রাসূল (ছাঃ) স্বীয় হাদীছে উল্লেখ করেছেন। তন্মধ্যে কতিপয় উপায় নিম্নে উল্লেখ করা হ’ল।-
১. ঈমান আনয়ন করা : প্রকৃত ঈমানদার লোকেরা হেদায়াত লাভে ধন্য হবে। আল্লাহ বলেন,إِنَّ الَّذِيْنَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ يَهْدِيْهِمْ رَبُّهُمْ بِإِيْمَانِهِمْ، ‘নিশ্চয়ই যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তাদের পালনকর্তা তাদের পথ প্রদর্শন করেন তাদের ঈমানের মাধ্যমে’ (ইউনুস ১০/৯)। অন্যত্র তিনি বলেন, وَمَنْ يُؤْمِنْ بِاللهِ يَهْدِ قَلْبَهُ وَاللهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ، ‘বস্ত্ততঃ যে ব্যক্তি আল্লাহকে বিশ্বাস করে, তিনি তার হৃদয়কে সুপথে পরিচালিত করেন। আর আল্লাহ সকল বিষয়ে বিজ্ঞ’ (তাগাবুন ৬৪/১১)।
আর ঈমানের সাথে শিরক মিশ্রিত না করার নাম হচ্ছে প্রকৃত মুমিন। বস্ত্তত তারাই হেদায়াতপ্রাপ্ত হয়। আল্লাহ বলেন, الَّذِينَ آمَنُوا وَلَمْ يَلْبِسُوا إِيمَانَهُمْ بِظُلْمٍ أُولَئِكَ لَهُمُ الْأَمْنُ وَهُمْ مُهْتَدُونَ، ‘যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানের সাথে শিরককে মিশ্রিত করেনি, তাদের জন্যই রয়েছে (জাহান্নাম থেকে) নিরাপত্তা এবং তারাই হেদায়াতপ্রাপ্ত’ (আন‘আম ৬/৮২)। পক্ষান্তরে কেউ ঈমানহীন হ’লে সে হেদায়াতের আলোকিত পথ থেকে ভ্রষ্টতার অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হবে।
২. অন্তরের প্রশস্ততা : ইসলাম গ্রহণ ও তার শিক্ষা লাভের জন্য হৃদয়ের প্রশস্ততা আবশ্যক। অন্তর প্রশস্ত হওয়ার অন্যতম উপায় হ’ল শিরক বিমুক্ত তাওহীদে বিশ্বাস। সুতরাং তাওহীদপন্থী ব্যক্তির অন্তর আল্লাহ প্রশস্ত করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,فَمَنْ يُرِدِ اللهُ أَنْ يَهْدِيَهُ يَشْرَحْ صَدْرَهُ لِلْإِسْلَامِ وَمَنْ يُرِدْ أَنْ يُضِلَّهُ يَجْعَلْ صَدْرَهُ ضَيِّقًا حَرَجًا، ‘অতএব আল্লাহ যাকে সুপথ প্রদর্শন করতে চান, তিনি তার বক্ষকে ইসলামের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। আর যাকে তিনি পথভ্রষ্ট করতে চান, তার বক্ষকে সংকীর্ণ ও সংকুচিত করে দেন’ (আন‘আম ৬/১২৫)। বস্ত্ততঃ তাওহীদ হচ্ছে হেদায়াতের চাবি। আর নেক আমল ও আল্লাহর নৈকট্য হাছিলের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা হচ্ছে ঐ চাবির দাঁত। সুতরাং যে ব্যক্তি সকল প্রকার ইবাদত সম্পাদন করে এবং আল্লাহর আনুগত্যের সকল দিক অনুসরণ করেন তার অন্তর প্রশস্ত হয়। অপরদিকে যে ব্যক্তি প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং হারামে আকণ্ঠ নিমজ্জিত থাকে, চোখ থাকতেও দুনিয়াতে সে অন্ধ এবং তার হৃদয় হয় সংকুচিত। যেরূপ মহান আল্লাহ উপরোক্ত আয়াতে বলেছেন।
২. সর্বদা আল্লাহর যিকর করা : সর্বদা আল্লাহর যিকর করলে বান্দার অন্তর আল্লাহর সাথে সংযুক্ত থাকে। বান্দার সাথে আললাহর সুসম্পর্ক তৈরী হয়। ফলে তার অন্তর প্রশান্ত হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,الَّذِينَ آمَنُوا وَتَطْمَئِنُّ قُلُوبُهُمْ بِذِكْرِ اللهِ أَلَا بِذِكْرِ اللهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ، ‘যারা আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং আল্লাহকে স্মরণ করলে যাদের অন্তরে প্রশান্তি আসে। মনে রেখ, আল্লাহর স্মরণেই কেবল হৃদয় প্রশান্ত হয়’ (রা‘দ ১৩/২৮)। তিনি আরো বলেন,فَاذْكُرُونِي أَذْكُرْكُمْ وَاشْكُرُوا لِي وَلَا تَكْفُرُونِ، ‘অতএব তোমরা আমাকে স্মরণ কর আমি তোমাদের স্মরণ করব। আর তোমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর, অকৃতজ্ঞ হয়ো না’ (বাক্বারাহ ২/১৫২)। আর যিকরের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য হাছিল হয়। যাতে হেদায়াতের আলোকোজ্জ্বল রাজপথে অবিচল থাকা যায়।
আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,يَقُولُ اللهُ تَعَالَى أَنَا عِنْدَ ظَنِّ عَبْدِى بِى، وَأَنَا مَعَهُ إِذَا ذَكَرَنِى، فَإِنْ ذَكَرَنِى فِى نَفْسِهِ ذَكَرْتُهُ فِى نَفْسِى، وَإِنْ ذَكَرَنِى فِى مَلأٍ ذَكَرْتُهُ فِى مَلأٍ خَيْرٍ مِنْهُمْ، وَإِنْ تَقَرَّبَ إِلَىَّ بِشِبْرٍ تَقَرَّبْتُ إِلَيْهِ ذِرَاعًا، وَإِنْ تَقَرَّبَ إِلَىَّ ذِرَاعًا تَقَرَّبْتُ إِلَيْهِ بَاعًا، وَإِنْ أَتَانِى يَمْشِى أَتَيْتُهُ هَرْوَلَةً. ‘আল্লাহ ঘোষণা করেন, আমি আমার বান্দার প্রতি ঐরূপ, যেরূপ বান্দা আমার প্রতি ধারণা রাখে। আমি বান্দার সঙ্গে থাকি যখন সে আমাকে স্মরণ করে। যদি সে মনে মনে আমাকে স্মরণ করে, আমিও তাকে নিজে স্মরণ করি। আর যদি সে জন-সমাবেশে আমাকে স্মরণ করে, তবে আমিও তাদের চেয়ে উত্তম সমাবেশে তাকে স্মরণ করি। যদি সে আমার দিকে এক বিঘত এগিয়ে আসে, তবে আমি তার দিকে এক হাত এগিয়ে যাই, যদি সে আমার দিকে এক হাত অগ্রসর হয়; আমি তার দিকে দু’হাত এগিয়ে যাই। আর সে যদি আমার দিকে হেঁটে আসে, আমি তার দিকে দৌড়ে যাই’।[2] অন্যদিকে যে ব্যক্তি আল্লাহর যিকর থেকে গাফেল থাকে কিংবা আল্লাহর যিকরে অলসতা করে আল্লাহ শয়তানকে তার সাথী করে দেন। তিনি বলেন,وَمَنْ يَعْشُ عَنْ ذِكْرِ الرَّحْمَنِ نُقَيِّضْ لَهُ شَيْطَانًا فَهُوَ لَهُ قَرِينٌ، ‘যে ব্যক্তি দয়াময়ের স্মরণ থেকে বিমুখ হয়, আমরা তার জন্য এক শয়তানকে নিযুক্ত করি। যে তার সাথী হয়’ (যুখরুফ ৪৩/৩৬)।
৩. কুরআন তেলাওয়াত করা : অর্থ বুঝে বিনয়-নম্রতা ও একাগ্রতার সাথে কুরআন তেলাওয়াত করার গুরুত্ব ও ফযীলত অপরিসীম। কেননা কুরআন মানবতার জন্য হেদায়াতের আলোকবর্তিকা। যার মাধ্যমে সঠিক পথের দিশা পাওয়া যায়। আল্লাহ বলেন,إِنَّ هَذَا الْقُرْآنَ يَهْدِي لِلَّتِي هِيَ أَقْوَم،ُ ‘নিশ্চয়ই এই কুরআন এমন পথের নির্দেশনা দেয়, যা সবচাইতে সরল’ (বনী ইসরাঈল ১৭/৯)। তিনি আরো বলেন,وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْآنِ مَا هُوَ شِفَاءٌ وَرَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِينَ وَلَا يَزِيدُ الظَّالِمِينَ إِلَّا خَسَارًا، ‘আর আমরা কুরআন নাযিল করি, যা বিশ্বাসীদের জন্য আরোগ্য ও রহমত স্বরূপ। কিন্তু পাপীদের জন্য তা কেবল ক্ষতিই বৃদ্ধি করে’ (বনী ইসরাঈল ১৭/৮২)।
মহান আল্লাহ কুরআনকে হেদায়াত বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, هَذَا بَيَانٌ لِلنَّاسِ وَهُدًى وَمَوْعِظَةٌ لِلْمُتَّقِينَ ‘এই কিতাব (কুরআন) মানবজাতির জন্য স্পষ্ট বর্ণনা এবং আল্লাহভীরুদের জন্য পথপ্রদর্শক ও উপদেশবাণী’ (আলে ইমরান ৩/১৩৮)। এ কুরআনেই হেদায়াতের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা রয়েছে। আল্লাহ বলেন,شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ، ‘রামাযান হ’ল সেই মাস, যাতে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। যা মানুষের জন্য সুপথ প্রদর্শক ও সুপথের স্পষ্ট ব্যাখ্যা এবং সত্য ও মিথ্যার পার্থক্যকারী’ (বাক্বারাহ ২/১৮৫)। সুতরাং হেদায়াত কুরআনেই তালাশ করতে হবে, অন্যত্র নয়। হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন,مَنْ أَرَادَ الْهِدَايَةَ فَعَلَيْهِ بِهَذَا الْقُرْآنِ، فَإِنَّهُ منجاةٌ لَهُ وَهِدَايَةٌ، وَلَا هِدَايَةَ فِيمَا سِوَاهُ، ‘যে ব্যক্তি সুপথ পেতে চায়, তার জন্য অপরিহার্য হ’ল এই কুরআন। কেননা এটিই হ’ল তার জন্য নাজাত ও হেদায়াতের পথ। এর বাইরে কোন সুপথ নেই’।[3]
৪. আল্লাহর সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করা : আল্লাহর সৃষ্টি সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করা, ভূ-মন্ডল ও নভোমন্ডলের প্রতি লক্ষ্য করা এবং সমগ্র বিশ্ব ও সৌরজগৎ সম্পর্কে গবেষণা করলে সে অবশ্যই আল্লাহর প্রতি বিনীত ও অনুগত হয়ে হেদায়াতের পথে ফিরে আসবে। আল্লাহ বলেন,إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لَآيَاتٍ لِأُولِي الْأَلْبَابِ، الَّذِينَ يَذْكُرُونَ اللهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَى جُنُوبِهِمْ وَيَتَفَكَّرُونَ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هَذَا بَاطِلًا سُبْحَانَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ، ‘নিশ্চয়ই আসমান ও যমীনের সৃষ্টিতে এবং রাত্রি ও দিবসের আগমন-নির্গমনে জ্ঞানীদের জন্য (আল্লাহর) নিদর্শন সমূহ নিহিত রয়েছে। যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে সর্বাবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আসমান ও যমীনের সৃষ্টি বিষয়ে চিন্তা-গবেষণা করে এবং বলে, হে আমাদের পালনকর্তা! তুমি এগুলিকে অনর্থক সৃষ্টি করোনি। মহা পবিত্র তুমি। অতএব তুমি আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে বাঁচাও! (আলে ইমরান ৩/১৯০-৯১)। আয়েশা (রাঃ) বলেন, অত্র আয়াত নাযিল হ’লে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছালাতে দাঁড়িয়ে যান। এমন সময় বেলাল আসেন আযান দিতে। তিনি দেখেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কাঁদছেন। বেলাল জিজ্ঞেস করলেন আপনি কাঁদছেন কেন? অথচ আল্লাহ আপনার পূর্বাপর সব গোনাহ মাফ করে দিয়েছেন! তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, হে বেলাল!أَفَلَا أَكُونُ عَبْدًا شَكُورًا، ‘আমি কি কৃতজ্ঞ বান্দা হবো না? অথচ আজ রাতে আমার প্রতি অত্র আয়াতটি তিনি নাযিল করেছেন। আয়াতটি পাঠ করে তিনি বললেন, وَيْلٌ لِمَنْ قَرَأَهَا وَلَمْ يَتَفَكَّرْ فِيهَا، ‘দুর্ভোগ ঐ ব্যক্তির জন্য যে এটি পাঠ করে অথচ এতে চিন্তা-গবেষণা করে না’।[4] অতএব আল্লাহর সৃষ্টিতো বটেই, কেউ যদি কেবল নিজের দৈহিক গঠন ও আকার-আকৃতি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে তাহ’লে সে আল্লাহর এই সুনিপুন সৃষ্টিকৌশল দেখে বিমোহিত হবে, তার ঈমান বেড়ে যাবে। ফলে হেদায়াত লাভ করার জন্য সে তৎপর হবে। যেমন আল্লাহ বলেন,وَفِي الْأَرْضِ آيَاتٌ لِلْمُوقِنِينَ، وَفِي أَنْفُسِكُمْ أَفَلَا تُبْصِرُونَ، ‘আর দৃঢ় বিশ্বাসীদের জন্য পৃথিবীতে রয়েছে নিদর্শনসমূহ। এবং তোমাদের নিজেদের মধ্যেও। অথচ তোমরা কি তা অনুধাবন করবে না’? (যারিয়াত ৫১/২১)
৫. সৎকর্মশীল ও উত্তম ব্যক্তিদের সাথী হওয়া : বহু মানুষ স্বীয় সাথী ও বন্ধুর কারণে হেদায়াত লাভ করে। তাই মুত্তাক্বী-পরহেযগার সৎকর্মশীল ব্যক্তিকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করা কর্তব্য। আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেন,الرَّجُلُ عَلَى دِينِ خَلِيلِهِ، فَلْيَنْظُرْ أَحَدُكُمْ مَنْ يُخَالِلُ، ‘মানুষ তার বন্ধুর রীতিনীতির (দ্বীন-ধর্মের) অনুসারী হয়। কাজেই তোমাদের প্রত্যেকেই যেন লক্ষ্য করে, সে কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে’।[5] মানবজীবনে সৎ ও অসৎ বন্ধুর প্রভাব অতি ব্যাপক। এজন্য রাসূল (ছাঃ) সৎ বন্ধুকে আতরওয়ালা ও অসৎ বন্ধুকে হাফরওয়ালার সাথে তুলনা করেছেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَثَلُ الْجَلِيسِ الصَّالِحِ وَالسَّوْءِ كَحَامِلِ الْمِسْكِ وَنَافِخِ الْكِيرِ، فَحَامِلُ الْمِسْكِ إِمَّا أَنْ يُحْذِيَكَ، وَإِمَّا أَنْ تَبْتَاعَ مِنْهُ، وَإِمَّا أَنْ تَجِدَ مِنْهُ رِيحًا طَيِّبَةً، وَنَافِخُ الْكِيرِ إِمَّا أَنْ يُحْرِقَ ثِيَابَكَ، وَإِمَّا أَنْ تَجِدَ رِيحًا خَبِيثَةً. ‘সৎসঙ্গী ও অসৎ সঙ্গীর দৃষ্টান্ত হ’ল, কস্ত্তরীওয়ালা ও কামারের হাপরের ন্যায়। কস্ত্তরীওয়ালা হয়তো তোমাকে কিছু দান করবে কিংবা তার নিকট হ’তে তুমি কিছু ক্রয় করবে কিংবা তার নিকট হ’তে তুমি সুগন্ধি পাবে। আর কামারের হাপর হয়তো তোমার কাপড় পুড়িয়ে দেবে কিংবা তুমি তার নিকট হ’তে দুর্গন্ধ পাবে’।[6] পার্থিব জীবনের অসৎ বন্ধুরা ক্বিয়ামত দিবসে শত্রুতে পরিণত হবে। আল্লাহ বলেন,الْأَخِلَّاءُ يَوْمَئِذٍ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ إِلَّا الْمُتَّقِينَ، ‘বন্ধুরা সেদিন পরস্পরে শত্রু হবে মুত্তাক্বীরা ব্যতীত’ (যুখরুফ ৪৩/৬৭)। অতএব পার্থিব জীবনের সকল বন্ধু-সহচর, সঙ্গী-সাথী যেন মুত্তাক্বী হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
৬. দো‘আ করা : দো‘আ মুমিনের এক শক্তিশালী হাতিয়ার। মুমিন সর্বাবস্থায় আল্লাহর কাছে দো‘আ করবে। আল্লাহ বলেন,وَقَالَ رَبُّكُمُ ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ إِنَّ الَّذِينَ يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِي سَيَدْخُلُونَ جَهَنَّمَ دَاخِرِينَ، ‘আর তোমাদের প্রতিপালক বলেন, তোমরা আমাকে ডাক। আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব। নিশ্চয়ই যারা আমার ইবাদত থেকে অহংকার করে। তারা সত্বর জাহান্নামে প্রবেশ করবে লাঞ্ছিত অবস্থায়’ (গাফির/মুমিন ৪০/৬০)। হাদীছে কুদসীতে আল্লাহ বলেন,يَا عِبَادِي كُلُّكُمْ ضَالٌّ إِلَّا مَنْ هَدَيْتُهُ، فَاسْتَهْدُونِي أَهْدِكُمْ، ‘হে আমার বান্দাগণ! তোমাদের প্রত্যেকেই পথভ্রষ্ট। কিন্তু আমি যাকে পথ দেখাই (সে-ই পথের সন্ধান পায়)। সুতরাং তোমরা আমার নিকট পথের সন্ধান কামনা কর, তাহ’লে আমি তোমাদেরকে পথের সন্ধান দেব’।[7] সুতরাং আল্লাহর কাছে হেদায়াতের জন্য দো‘আ করতে হবে। যেমন আমরা ছালাতে সূরা ফাতিহায় পড়ি, اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ ‘আপনি আমাদেরকে সরল পথ প্রদর্শন করুন’! (ফাতিহা ১/৬)। অন্যত্র আল্লাহ আমাদের শিখিয়েছেন,رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ ‘(তারা প্রার্থনা করে বলে) হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি আমাদেরকে সুপথ প্রদর্শনের পর আমাদের অন্তর সমূহকে বক্র করো না। আর তুমি আমাদেরকে তোমার পক্ষ হতে বিশেষ অনুগ্রহ প্রদান কর। নিশ্চয়ই তুমি সর্বাধিক দানকারী’ (আলে ইমরান ৩/৮)।
আয়েশা (রাঃ) বলেন,كَانَ إِذَا قَامَ مِنَ اللَّيْلِ افْتَتَحَ صَلَاتَهُ: اللهُمَّ رَبَّ جَبْرَائِيلَ، وَمِيكَائِيلَ، وَإِسْرَافِيلَ، فَاطِرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ، عَالِمَ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ، أَنْتَ تَحْكُمُ بَيْنَ عِبَادِكَ فِيمَا كَانُوا فِيهِ يَخْتَلِفُونَ، اهْدِنِي لِمَا اخْتُلِفَ فِيهِ مِنَ الْحَقِّ بِإِذْنِكَ، إِنَّكَ تَهْدِي مَنْ تَشَاءُ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ ‘আল্লাহর নবী (ছাঃ) রাতে যখন উঠতেন, তখন তিনি তাঁর ছালাত আরম্ভ করতেন, হে আল্লাহ! জিবরীল, মীকাঈল ও ইসরাফীলের প্রতিপালক আসমানসমূহ ও যমীনের স্রষ্টা, অদৃশ্য ও দৃশ্যের জ্ঞাতা আপনিই মীমাংসা করবেন আপনার বান্দাদের মাঝে সে বিষয়ে যাতে তারা মতবিরোধ করছিল। আপনি আমাকে হেদায়াত ও সঠিক পথ প্রদর্শন করুন, সত্য ন্যায়ের বিপরীত বিষয়ে আপনার হুকুমে, আপনিই হেদায়াত করেন যাকে ইচ্ছা সরল পথের দিকে’।[8]
অনুরূপভাবে আমরা বিতর ছালাতের দো‘আ কুনূতে হেদায়াতের জন্য দো‘আ করে থাকি। হাসান ইবনু আলী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে কয়েকটি বাক্য শিখিয়ে দিয়েছেন। এগুলো আমি বিতরের ছালাতে পাঠ করে থাকি,اللَّهُمَّ اهْدِنِي فِيمَنْ هَدَيْتَ، وَعَافِنِي فِيمَنْ عَافَيْتَ، وَتَوَلَّنِي فِيمَنْ تَوَلَّيْتَ، وَبَارِكْ لِي فِيمَا أَعْطَيْتَ، وَقِنِي شَرَّ مَا قَضَيْتَ، فَإِنَّكَ تَقْضِي وَلَا يُقْضَى عَلَيْكَ، وَإِنَّهُ لَا يَذِلُّ مَنْ وَالَيْتَ، تَبَارَكْتَ رَبَّنَا وَتَعَالَيْتَ، ‘আল্ল-হুম্মাহদিনী ফীমান হাদাইতা ওয়া ‘আ-ফিনী ফীমান ‘আ-ফাইতা, ওয়াতা ওয়াল্লানী ফীমান তাওয়াললাইতা, ওয়াবা-রিক লী ফীমা- আ‘ত্বইতা, ওয়াক্বিনী শাররা মা- ক্বযাইতা, ফাইন্নাকা তাক্বযী
ওয়ালা- ইউক্বযা- ‘আলাইকা, ওয়া ইন্নাহূ লা- ইয়াযিল্লু মাওঁ ওয়ালাইতা, তাবা-রাকতা রববানা- ওয়া তা‘আ-লাইতা’। অর্থ : ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে হেদায়াত দান করো সেসব মানুষের সঙ্গে যাদের তুমি হেদায়াত দান করেছ (নবী-রাসূলগণ)। তুমি আমাকে দুনিয়ার বিপদাপদ থেকে হেফাযত করো ঐসব লোকের সঙ্গে যাদেরকে তুমি হেফাযত করেছ। যাদের তুমি অভিভাবক হয়েছ, তাদের মাঝে আমারও অভিভাবক হও। তুমি আমাকে যা দান করেছ (জীবন, জ্ঞান সম্পদ, ধন ও নেক আমল), এতে বরকত দান কর। আর আমাকে তুমি রক্ষা কর ঐসব অনিষ্ট হ’তে যা আমার তাক্বদীরে লিখা হয়ে গেছে। নিশ্চয়ই তুমি যা চাও তাই আদেশ কর। তোমাকে কেউ আদেশ করতে পারে না। তুমি যাকে ভালোবাস তাকে কেউ অপমানিত করতে পারে না। হে আমার রব! তুমি বরকতে পরিপূর্ণ। তুমি অতি উচ্চমর্যাদা সম্পন্ন’।[9] এভাবে হেদায়াতের জন্য প্রতিনিয়ত দো‘আ করা কর্তব্য। যেভাবে রাসূল (ছাঃ) দো‘আ করতেন। তিনি বলতেন, اللهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ الْهُدَى وَالتُّقَى وَالْعَفَافَ وَالْغِنَى، ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট হেদায়াত, তাক্বওয়া, চরিত্রের নির্মলতা ও আত্মনির্ভরশীলতা প্রার্থনা করছি’।[10]
৭. হেদায়াত লাভের প্রচেষ্টা চালানো : যে কোন বস্ত্ত, পদমর্যাদা, জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে উন্নতি-অগ্রগতি লাভ করতে হ’লে চেষ্টা-সাধনার কোন বিকল্প নেই। কেননা চেষ্টা ব্যতীত কোন কিছু লাভ করা যায় না। আল্লাহ বলেন, وَأَنْ لَيْسَ لِلْإِنْسَانِ إِلَّا مَا سَعَى ‘আর মানুষ কিছুই পায় না তার চেষ্টা ব্যতীত’ (নাজম ৫৩/৩৯)। তদ্রূপ হেদায়াত লাভের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসূল (ছাঃ) প্রদর্শিত পথে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। আল্লাহ বলেন,وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا وَإِنَّ اللهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِينَ ‘আর যারা আমাদের পথে প্রচেষ্টা চালায়, তাদেরকে আমরা আমাদের পথ সমূহের দিকে পরিচালিত করি। আর আল্লাহ অবশ্যই সৎকর্মশীলদের সাথে থাকেন’ (আনকাবূত ২৯/৬৯)।
৮. আল্লাহকে অাঁকড়ে ধরা : আল্লাহকে তথা তাঁর বিধানকে আঁকড়ে ধরার মাধ্যমে হেদায়াতের আলোকোদ্ভাসিত পথে থাকার দৃঢ়তা অর্জন করা যায়। আল্লাহ বলেন,وَمَنْ يَعْتَصِمْ بِاللهِ فَقَدْ هُدِيَ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ، ‘বস্ত্ততঃ যে ব্যক্তি আল্লাহকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করবে, সে ব্যক্তি অবশ্যই সরল পথে পরিচালিত হবে’ (আলে ইমরান ৩/১০১)। এ আয়াতে আল্লাহকে অাঁকড়ে ধরার অর্থ হ’ল আল্লাহর বিধানকে অাঁকড়ে ধরা। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ইবনু আববাস (রাঃ)-কে বলেন,يَا غُلَامُ إِنِّي أُعَلِّمُكَ كَلِمَاتٍ، احْفَظِ اللهَ يَحْفَظْكَ، احْفَظِ اللهَ تَجِدْهُ تُجَاهَكَ، ‘হে বৎস! আমি তোমাকে কয়েকটি কথা শিখিয়ে দিচ্ছি- তুমি আল্লাহর বিধানসমূহ যথাযথভাবে মেনে চল আল্লাহ তোমাকে হেফাযতে রাখবেন। আল্লাহর বিধান পালন কর, তবে তুমি আল্লাহকে তোমার সম্মুখে পাবে’।[11]
৯. আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ)-এর আনুগত্য করা : আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর আনুগত্য ব্যতিরেকে ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ ও সফলতা লাভ করা সম্ভব নয়। অনুরূপভাবে হেদায়াত লাভের অন্যতম উপায় হ’ল আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর অনুসরণ করা। আল্লাহ বলেন,قُلْ أَطِيعُوا اللهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا عَلَيْهِ مَا حُمِّلَ وَعَلَيْكُمْ مَا حُمِّلْتُمْ وَإِنْ تُطِيعُوهُ تَهْتَدُوا وَمَا عَلَى الرَّسُولِ إِلَّا الْبَلَاغُ الْمُبِينُ، ‘বল, তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর ও রাসূলের আনুগত্য কর। অতঃপর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তাহ’লে তার দায়িত্বের জন্য তিনি দায়ী এবং তোমাদের দায়িত্বের জন্য তোমরা দায়ী। আর যদি তোমরা তার আনুগত্য কর তাহ’লে তোমরা সুপথ প্রাপ্ত হবে। বস্ত্ততঃ রাসূলের উপর দায়িত্ব হ’ল কেবল সুস্পষ্টভাবে (আল্লাহর বাণী) পৌঁছে দেওয়া’ (নূর ২৪/৫৪)।
মানুষকে মহান আল্লাহ তাঁর ও তদীয় রাসূলের আনুগত্য করার নির্দেশ দিয়েছেন। যারা এই আদেশ-উপদেশ মেনে চলবে মূলতঃ তারা হেদায়াত লাভ করবে। আল্লাহ বলেন, وَلَوْ أَنَّهُمْ فَعَلُوا مَا يُوعَظُونَ بِهِ لَكَانَ خَيْرًا لَهُمْ وَأَشَدَّ تَثْبِيتًا، وَإِذًا لَآتَيْنَاهُمْ مِنْ لَدُنَّا أَجْرًا عَظِيمًا، وَلَهَدَيْنَاهُمْ صِرَاطًا مُسْتَقِيمًا، ‘তবে তাদেরকে যেসব বিষয়ে উপদেশ দেওয়া হয়েছে, সেগুলি যদি তারা করত, তাহ’লে সেটাই তাদের জন্য উত্তম ও অধিক দৃঢ়তর বিষয় হ’ত। আর তখন আমরা আমাদের পক্ষ থেকে অবশ্যই তাদেরকে বড় পুরস্কারে ভূষিত করতাম। এবং তাদেরকে আমরা অবশ্যই সরল পথ প্রদর্শন করতাম’ (নিসা ৪/৬৬-৬৮)।
১০. নবী-রাসূল ও ছাহাবী-তাবেঈগণের জীবনচরিত অধ্যয়ন করা : নবী-রাসূল, ছাহাবী-তাবেঈ ও অন্যান্য সৎকর্মশীল বান্দাদের জীবনচরিত অধ্যয়ন করলে হেদায়াত লাভ করা সহজ হয়। আল্লাহ বলেন,وَكُلًّا نَقُصُّ عَلَيْكَ مِنْ أَنْبَاءِ الرُّسُلِ مَا نُثَبِّتُ بِهِ فُؤَادَكَ، ‘বিগত রাসূলগণের বৃত্তান্ত সমূহ থেকে আমরা তোমার কাছে বিবৃত করলাম। যার দ্বারা আমরা তোমার চিত্তকে দৃঢ় করতে চাই’ (হূদ ১১/১২০)। অন্যত্র তিনি বলেন, لَقَدْ كَانَ فِي قَصَصِهِمْ عِبْرَةٌ لِأُولِي الْأَلْبَابِ، ‘নিশ্চয়ই নবীদের কাহিনীতে জ্ঞানীদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ রয়েছে’ (ইউসুফ ১২/১১১)।
এতদ্ব্যতীত হেদায়াত প্রাপ্তির জন্য কুরআন-হাদীছ ও ইসলামী বই-পুস্তক অধ্যয়ন করা, দ্বীনী ইলমের বৈঠকে অংশগ্রহণ করা, হেদায়াতপ্রাপ্তদের সাহচর্য লাভ করা, অধিক হারে নেক আমল করা, মৃত্যু ও আখেরাত সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করা এবং জান্নাত লাভের উপায় ও জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণের জন্য চেষ্টা করা আবশ্যক।
পরিশেষে বলব, পার্থিব জীবনে উন্নতি-অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি লাভের জন্য যেমন চেষ্টা করতে হয়, তেমনি পরকালীন জীবনে সফলতা ও হেদায়াত লাভের জন্যও সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। আর এক্ষেত্রে সকল চেষ্টা-প্রচেষ্টা অবশ্যই কুরআন-হাদীছে বর্ণিত নির্দেশনা মোতাবেক হ’তে হবে। অন্যথা সফলতা লাভ করা সম্ভব নয়। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেদায়াত লাভ করার এবং পরকালীন জীবনে জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও জান্নাতে প্রবেশের তাওফীক দান করুন-আমীন!
[1]. জুরজানী, আত-তা‘রীফাত, পৃঃ ১১২।
[2]. বুখারী হা/৭৫০৫, ৭৫৩৭; মুসলিম হা/১৬৭৫।
[3]. তাফসীর ইবনে কাছীর, ৮/৩৪০, সূরা তাকভীর ২৮নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্র.।
[4]. ইবনু হিববান হা/৬২০; ছহীহাহ হা/৬৮; ছহীহুত তারগীব হা/১৪৬৮।
[5]. আবু দাঊদ হা/৪৮৩৩; তিরমিযী হা/২৩৭৮; ছহীহাহ হা/৯২৭।
[6]. বুখারী হা/৫৫৩৪, ২১০১; মুসলিম হা/২৬২৮।
[7]. মুসলিম হা/২৫৭৭; মিশকাত হা/২৩২৬।
[8]. মুসলিম হা/৭৭০।
[9]. তিরমিযী হা/৪৬৪; আবূ দাঊদ হা/১৪২৫; নাসাঈ হা/১৭৪৫, ইবনু মাজাহ হা/১১৭৮; ইরওয়া হা/৪২৯।
[10]. মুসলিম হা/২৭২১; তিরমিযী হা/৩৪৮৯; ইবনু মাজাহ হা/৩৮৩২; মিশকাত হা/২৪৮৪।
[11]. তিরমিযী হা/২৫১৬; মিশকাত হা/৫৩০২; ছহীহাহ হা/২৩৮২।