পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ । পর্ব ৬ । পর্ব ৭ । পর্ব ৮ । পর্ব ৯ । শেষ পর্ব ।
আক্বীদা ও আহকামে সুন্নাতের ইত্তেবা প্রত্যেক যুগে আবশ্যক :
প্রিয় ভ্রাতৃমন্ডলী! কিতাব ও সুন্নাতের পূর্বোল্লেখিত দলীলগুলি অকাট্যভাবে নির্দেশ করে যে, নবী করীম (ছাঃ) যা কিছু নিয়ে এসেছেন, সেগুলি নিঃশর্তভাবে মেনে চলা ওয়াজিব। যে ব্যক্তি সুন্নাতের মাধ্যমে ফায়ছালা করানোর এবং এর প্রতি অনুগত হ’তে সম্মত হয় না, সে মূলতঃ মুমিন নয়। তাই দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, যা সুন্নাত দ্বারা বুঝা যায়।
(১) কুরআন ও সুন্নাহর উপরোক্ত দলীলসমূহ ঐ সকল ব্যক্তিকে শামিল করে, ক্বিয়ামত পর্যন্ত যাদের নিকট এই দাওয়াত পৌঁছবে। এ বিষয়টি আল্লাহ তা‘আলার নিমেণাক্ত বাণীতে সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়। মহান আল্লাহ বলেন, لِأُنْذِرَكُمْ بِهِ وَمَنْ بَلَغَ ‘যাতে এর দ্বারা আমি ভয় প্রদর্শন করি তোমাদের ও যাদের কাছে এটি পৌঁছবে তাদের’ (আন‘আম ৬/১৯)। আল্লাহ আরো বলেন,وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا كَافَّةً لِلنَّاسِ بَشِيْراً وَنَذِيْراً- ‘আর আমরা তোমাকে সমগ্র মানবজাতির জন্য (জান্নাতের) সুসংবাদদাতা ও (জাহান্নামের) ভয় প্রদর্শনকারী হিসাবে প্রেরণ করেছি’ (সাবা ৩৪/২৮)।
রাসূল
(ছাঃ) উলেলখিত বিষয়টিকে হাদীছের মাধ্যমে এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, وَكَانَ
النَّبِيُّ يُبْعَثُ إِلَى قَوْمِهِ خَاصَّةً وَبُعِثْتُ إِلَى النَّاسِ
كَافَّةً- ‘অন্য নবীকে পাঠানো হ’ত সুনির্দিষ্ট জাতির নিকট আর আমি প্রেরিত
হয়েছি সকল মানুষের নিকট’।[1] তিনি আরো বলেন, وَالَّذِيْ نَفْسِيْ بِيَدِهِ
لَا يَسْمَعُ بِي رَجُلٌ مِنْ هَذِهِ الْأُمَّةِ وَلَا يَهُودِيٌّ وَلَا
نَصْرَانِيٌّ ثُمَّ لَمْ يُؤْمِنْ بِي إِلَّا كَانَ مِنْ أَهْلِ النَّارِ-
‘সেই সত্তার কসম যাঁর হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, এই উম্মতের কোন ব্যক্তি এবং
কোন ইহুদী বা খৃষ্টান যে আমার সম্পর্কে শুনল অথচ আমার প্রতি ঈমান আনল না,
সে জাহান্নামীদের অন্তর্ভুক্ত হবে’।[2]
(২) উক্ত দলীলগুলি দ্বীনের সকল বিষয়কে শামিল করে। আক্বীদা বা আমলের ক্ষেত্রে কোন পার্থক্য নেই। প্রত্যেক ছাহাবীর ওপর যেমন ওয়াজিব ছিল নবী করীম (ছাঃ)-এর পক্ষ হ’তে কোন কিছু তাঁর নিকট পৌঁছলে তার প্রতি ঈমান আনা। তেমনিভাবে তাবেঈর ওপর ওয়াজিব ছিল কোন ছাহাবীর পক্ষ হ’তে তাঁর নিকট পৌঁছলে তার প্রতি বিশ্বাস রাখা। অনুরূপভাবে কোন ছাহাবীর জন্য জায়েয হ’ত না আক্বীদার ক্ষেত্রে নবী করীম (ছাঃ)-এর কোন হাদীছ শোনার পর তা প্রত্যাখ্যান করা এই যুক্তিতে যে, তা খবরে আহাদ। তিনি তাঁর মতই একজন মাত্র ছাহাবীর নিকট হ’তে তা শুনেছেন। তদ্রূপ একই কারণ দেখিয়ে পরবর্তীদের জন্যও তা প্রত্যাখ্যান করা বৈধ নয়, যদি সংবাদ বাহক তার নিকট বিশ্বস্ত হয়। এভাবেই ক্বিয়ামত পর্যন্ত চলা উচিত। এ বিষয়টি তাবেঈ ও মুজতাহিদ ইমামগণের যুগে এভাবেই চলতো। এ বিষয়ে একটু পরেই ইমাম শাফেঈর বক্তব্য তুলে ধরা হবে।
সুন্নাতকে ফায়ছালাকারী হিসাবে গ্রহণ করার ব্যাপারে পরবর্তীদের শিথিলতা :
ছাহাবী ও তাবেঈগণ তাদের পরে এমন প্রজন্ম রেখে গেলেন, যারা নবীর সুন্নাতকে বিনষ্ট ও তার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করল এমন কিছু মূলনীতির কারণে, যা কিছু ধর্মতাত্ত্বিক তৈরী করেছে এবং এমন কিছু কায়েদার কারণে, যা কিছু উছূলবিদ ও মুক্বাল্লিদ ফক্বীহ দাবী করেছেন। এর ফলাফল হ’ল সুন্নাতের প্রতি এমন অবহেলা যা অনেক ক্ষেত্রেই তার প্রতি সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। আবার আরেক দল তাদের তৈরীকৃত উছূল ও কায়েদা বিরোধী হওয়ায় হাদীছের অনেকাংশকে প্রত্যাখ্যান করেছে। ফলে তাদের নিকট আয়াতের অর্থ পরিবর্তন হয়ে গেছে। তাদের মূলনীতি ও কায়েদাগুলিকে সুন্নাতের আলোকে যাচাই না করে এবং তাকে শারঈ বিষয়ে মীমাংসার মানদন্ড হিসাবে মেনে না নিয়ে উল্টোটা করেছে। তারা সুন্নাতকে যাচাই করেছে তাদের স্বরচিত কায়েদা ও মূলনীতির মানদন্ডে। এক্ষেত্রে সুন্নাতের যা কিছু তাদের মূলনীতির অনুকূলে মনে হয়েছে তা তারা গ্রহণ করেছে। অন্যথা তা প্রত্যাখান করেছে। এভাবে নবী করীম (ছাঃ) এবং মুসলিমের মাঝের সম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বিশেষ করে তাদের পরবর্তীদের নিকট। ফলে তারা নবী করীম (ছাঃ), তাঁর আক্বীদা, সীরাত, ইবাদত, ছিয়াম-কিয়াম, হজ্জ, আহ্কাম ও ফৎওয়া সম্পর্কে অজ্ঞতায় ডুবে গেছে। তাদেরকে যদি উল্লেখিত বিষয়গুলির কোন একটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়, তাহ’লে তারা আপনাকে জবাব দিবে যঈফ হাদীছ দ্বারা অথবা ভিত্তিহীন হাদীছ দ্বারা অথবা অমুকের মাযহাব দ্বারা। যদি এ বিষয়ে ঐক্যমত পাওয়া যায় যে, তা ছহীহ হাদীছ বিরোধী এবং তাদেরকে বিষয়টি অবহিত করা হ’লেও তারা সেদিকে দৃকপাত করে না এবং তার দিকে ফিরে যেতেও সম্মত হয় না। এক্ষেত্রে তারা এমন কিছু সংশয়ের সৃষ্টি করে যা এখানে উল্লেখ করার অবকাশ নেই। এ সবকিছুর পেছনে রয়েছে তাদের সেই সমস্ত উছূল ও কায়েদা, যার সম্পর্কে পূর্বেই ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। তন্মধ্যে কিছুটা অচিরেই উল্লেখ করা হবে ইনশাআল্লাহ।
এই মহামারী ব্যাপক আকার ধারণ করেছে এবং পুরো মুসলিম বিশ্ব, গবেষণা পত্রিকা সমূহ এবং ধর্মীয় বই-পুস্তকগুলিকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। কেবল সল্পসংখ্যক লোক তা থেকে মুক্ত রয়েছে। তাই আপনি কিছুসংখ্যক লোক ব্যতীত কিতাব ও সুন্নাহর আলোকে ফৎওয়া দেন এমন ব্যক্তিকে পাবেন না। বরং তাদের অধিকাংশই চার মাযহাবের কোন একটির ওপর নির্ভরশীল। কখনো বা এর বাইরেও যায় যদি তাদের ধারণা অনুযায়ী তাতে ভাল কিছু আছে বলে মনে হয়। পক্ষান্তরে হাদীছকে তারা বেমা‘লূম ভুলে গেছে। তবে তারা কল্যাণকর মনে করলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা গ্রহণ করেন। যেমন তাদের কেউ কেউ এক সাথে তিন তালাকের ব্যাপারে ইবনু আববাস (রাঃ)-এর হাদীছের ক্ষেত্রে করেছেন। রাসূল (ছাঃ)-এর যামানায় তা এক তালাক হিসাবে গণ্য করা হ’ত। তারা এটাকে অগ্রাধিকারযোগ্য মাযহাব হিসাবে ধরে নিয়েছেন। কিন্তু উক্ত মূলনীতি তৈরী করার পূর্বে তারা এর সমালোচনা করেছেন।
পরবর্তীদের নিকট সুন্নাত যেন এক অপরিচিত বস্ত্ত :
এ
যুগে সুন্নাতের অপরিচিত হওয়ার এবং আলেম-ওলামা ও মুফতীদের অজ্ঞতার একটি
দলীল হ’ল সেই উত্তর, যা একটি প্রসিদ্ধ ইসলামী পত্রিকা দিয়েছে। ‘প্রাণীদেরও
কি পুনরুত্থান হবে’? এ প্রশ্নের জবাবে বলা হয়েছে, ‘ইমাম আলূসী (রহঃ) তাঁর
তাফসীরে বলেছেন, ‘এ ব্যাপারে অর্থাৎ প্রাণীদের পুনরুত্থান বিষয়ে কিতাব ও
সুনণাতে এমন কোন নির্ভরযোগ্য দলীল নেই যা দ্বারা মানুষ ও জ্বিন ব্যতীত
অন্যান্য পশু-পাখিকে হাশরের মাঠে উপস্থিত করার প্রমাণ পাওয়া যায়’।
উত্তরদাতা আলূসীর বক্তব্যকে ভিত্তি করেই জবাব দিয়েছেন, যা খুবই বিস্ময়কর।
এটা দ্বারা খুব সহজেই আপনারা বুঝতে পারেন যে, সুন্নাতের জ্ঞানের প্রতি
আলেম-ওলামার অবহেলা কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে! অন্যদের কথা বাদই দিলাম। অথচ
একাধিক হাদীছ দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, প্রাণীকুলকেও হাশরের মাঠে
উপস্থিত করা হবে এবং সেগুলির পরস্পরের ক্বিছাছ তথা বদলা দিয়ে দেওয়া হবে।
যেমন ছহীহ মুসলিমে বর্ণিত আছে,لَتُؤَدُّنَّ الْحُقُوقَ إِلَى أَهْلِهَا
يَوْمَ الْقِيَامَةِ، حَتَّى يُقَادَ لِلشَّاةِ الْجَلْحَاءِ، مِنَ
الشَّاةِ الْقَرْنَاءِ- ‘ক্বিয়ামতের দিন যাবতীয় হক তার প্রাপককে দিয়ে দেওয়া
হবে। এমনকি শিংবিহীন ছাগলের বদলা শিং বিশিষ্ট ছাগলের কাছ থেকে দিয়ে দেওয়া
হবে’।[3]
অনুরূপভাবে ইবনু ওমর (রাঃ) প্রমুখ হ’তে বর্ণিত হয়েছে যে, কাফের যখন এমন ক্বিছাছ দেখবে তখন বলবে, يَا لَيْتَنِي كُنْتُ تُرَاباً ‘হায়! আমি যদি মাটি হতাম’! (নাবা ৭৮/৪০)।
পরবর্তীদের তৈরীকৃত যে সকল মূলনীতির কারণে হাদীছকে পরিত্যাগ করা হয়েছে :
কি সেই উছূল ও কায়েদা, যা পরবর্তীরা তৈরী করেছে? এমনকি তা তাদেরকে সুন্নাতের অধ্যয়ন ও অনুসরণ হ’তে বিরত রেখেছে? এ প্রশ্নের জবাবে আমি বলব, এ সকল মূলনীতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হ’ল-
১. কিছু ধর্মতাত্ত্বিকের বক্তব্য যে, আহাদ হাদীছ দ্বারা আক্বীদা সাব্যস্ত হ’তে পারে না। বর্তমান কিছু মুসলিম দাঈ স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, আহাদ হাদীছ দ্বারা আক্বীদা গ্রহণ করা বৈধ নয়, বরং হারাম।
২. অনুসরণীয় মাযহাবগুলির কিছু কায়েদা ও উছূল। তন্মধ্যে বর্তমানে যেসব মনে পড়ছে তা হল, যেমন (ক) খবরে ওয়াহেদের ওপর ক্বিয়াসকে প্রাধান্য দেওয়া।[4] (খ) উছূল বিরোধী হ’লে খবরে ওয়াহেদকে প্রত্যাখান করা।[5] (গ) কুরআনের আয়াতের চেয়ে বেশী হুকুম বহন করে এমন হাদীছ প্রত্যাখান করা এ দাবীতে যে, তা কুরআন দ্বারা মানসূখ হিসাবে গণ্য হবে। পক্ষান্তরে হাদীছ কুরআনকে মানসূখ করতে পারে না।[6] (ঘ) ‘আম’ ও ‘খাছ’-এর মাঝে বৈপরীত্য দেখা দিলে ‘আম’ বিধানকে প্রাধান্য দেওয়া অথবা খবরে ওয়াহেদ দ্বারা কুরআনের ‘আম’ বিধানকে ‘খাছ’ করাকে নাজায়েয মনে করা।[7] (ঙ) মদীনাবাসীর আমলকে ছহীহ হাদীছের ওপর প্রাধান্য দেওয়া।
৩. তাক্বলীদকে মাযহাব ও দ্বীন হিসাবে গ্রহণ করা।
হাদীছের ওপর ক্বিয়াস ও অন্য জিনিসকে প্রাধান্য দেওয়ার অসারতা :
ক্বিয়াস
অথবা পূর্বোল্লেখিত কায়েদার ভিত্তিতে ছহীহ হাদীছকে প্রত্যাখ্যান করা এবং
মদীনাবাসীর আমলের বিরোধী হওয়ায় তা পরিত্যাগ করা পূর্ববর্তী ঐ সকল আয়াত ও
হাদীছের স্পষ্ট বিরোধী, যা দ্বারা ইখতেলাফ ও মতানৈক্যের সময় কুরআন ও
সুন্নাহর দিকে ফিরে যাওয়া ওয়াজিব সাব্যস্ত হয়। একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে,
ঐ সমস্ত কায়েদার কারণে হাদীছকে প্রত্যাখ্যান করা যায় মর্মে সকল আলেম একমত
নন; বরং অধিকাংশ আলেম ঐ সকল নিয়ম-নীতির বিরোধিতা করেছেন। তারা কিতাব ও
সুন্নাহর অনুসরণার্থে ছহীহ হাদীছকে সেগুলির ওপর প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। আর
কেনইবা দিবেন না! কেননা হাদীছ অনুযায়ী আমল করা ওয়াজিব, যদিও তার বিপরীতে
ঐক্যমত আছে বলে ধারণা করা হয়ে থাকে অথবা তা অনুযায়ী কেউ আমল করেছেন মর্মে
জানাও যায় না, তবুও তদনুযায়ী আমল করা ওয়াজিব। ইমাম শাফেঈ (রহঃ)
বলেন,وَيَجِبُ أَنْ يُقْبَلَ الْخَبَرُ فِي الْوَقْتِ الَّذِيْ ثَبَتَ
فِيْهِ وِإِنْ لَمْ يَمْضِ عَمَلٌ مِنَ الْأَئِمَّةِ بِمِثْلِ الْخَبَرِ-
‘হাদীছ সাব্যস্ত হওয়ার সাথে সাথে তা গ্রহণ করা ওয়াজিব, যদিও সে অনুযায়ী কোন
ইমামের আমল না থাকে’।[8]
ইবনুল ক্বাইয়িম
(রহঃ) বলেন, ‘ইমাম আহমাদ (রহঃ) ছহীহ হাদীছের ওপর কোন আমল, রায়, ক্বিয়াস এবং
কারো কোন অভিমতকে প্রাধান্য দিতেন না। তিনি বিরোধী সম্পর্কে না জানাকেও
প্রাধান্য দিতেন না যাকে অনেকেই ‘ইজমা’ আখ্যায়িত করেছেন এবং ছহীহ হাদীছের
ওপর তাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। ইমাম আহমাদ এমন ‘ইজমা’র দাবীদারকে মিথ্যুক
মনে করতেন এবং প্রমাণিত হাদীছের ওপর সেটিকে প্রাধান্য দেওয়াকেও বৈধ মনে
করতেন না’। অনুরূপভাবে ইমাম শাফেঈ (রহঃ) তাঁর ‘রিসালা জাদীদা’তে বলেছেন,
‘কোন কিছু সম্পর্কে বিপরীত দলীল জানা না গেলেই তাকে ‘ইজমা’ বলা হয় না’।
ইমাম আহমাদ (রহঃ) সহ সকল ইমামের নিকট রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছই বেশী
মর্যাদাপূর্ণ সন্দেহপূর্ণ ইজমার চেয়ে। যার পুঁজি হ’ল বিরোধী সম্পর্কে না
জানা। এমন ইজমা যদি জায়েয হ’ত তাহ’লে কুরআন-সুন্নাহর দলীল অকেজো হয়ে যেত।
প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য যেকোন মাসআলায় তার বিরোধী সম্পর্কে জানে না তার
জন্য এটা জায়েয হয়ে যেত যে, সে তার ঐ অজ্ঞতাকেই (কুরআন-সুন্নাহর) দলীলের
ওপর প্রাধান্য দিবে’।[9]
ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) আরো বলেন, ‘সালাফে ছালেহীন কোন রায়, ক্বিয়াস, ইসতিহসান অথবা কোন ব্যক্তির মতামতের ভিত্তিতে- সে যেই হোক না কেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছের বিরোধিতাকারীদেরকে চরম অপসন্দ ও ঘৃণা করতেন। এমন কার্য সম্পাদনকারীদেরকে তারা পরিত্যাগ করতেন এবং যারা তাদেরকে দৃষ্টান্ত হিসাবে উল্লেখ করতেন তাদেরকেও অত্যন্ত ঘৃণা করতেন। রাসূল (ছাঃ) ব্যতীত কারো নিঃশর্ত অনুসরণ করা, তার সব কথা শোনা ও মানা এবং তার আনুগত্য মেনে নেওয়াকে তারা বৈধ মনে করতেন না। তারা রাসূলের কথা অন্তর থেকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে কোন দ্বিধায় ভুগতেন না এবং কোন আমল অথবা ক্বিয়াস অথবা কারো সমর্থন পাওয়ার আশায় বসে থাকতেন না। বরং তারা আল্লাহ তা‘আলার নিম্নোক্ত বাণীর প্রতি আমল করতেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللهُ وَرَسُولُهُ أَمْراً أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ- ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে ফায়ছালা দিলে কোন মুমিন পুরুষ বা নারীর সে বিষয়ে নিজস্ব কোন ফায়ছালা দেওয়ার এখতিয়ার নেই’ (আহ্যাব ৩৩/৩৬)।
এ জাতীয় আরো অনেক উদাহরণ পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।
আমরা এমন যামানায় পৌঁছেছি যে, যদি কাউকে বলা হয়, রাসূল (ছাঃ) থেকে প্রমাণিত তিনি এরূপ এরূপ বলেছেন, তখন সে বলে, এটা কার উক্তি? কথার শুরুতেই সে বাধা দিতে চায় এবং সেটা কেউ না জানাকে তার হাদীছ বিরোধিতা ও হাদীছের প্রতি আমল পরিত্যাগ করার জন্য যুক্তি হিসাবে দাঁড় করায়।
যদি সে নিজেকে উপদেশ
দিত তাহ’লে অবশ্যই জানতে পারতো যে, তার এমন বক্তব্য একেবারেই অনর্থক ও
বাতিল। এমন অজ্ঞতাহেতু রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতকে পরিত্যাগ করা তার জন্য বৈধ
নয়। এর চেয়ে বড় নিকৃষ্ট হ’ল তার অজ্ঞতার ওযর পেশ করা। যেহেতু সে বিশ্বাস
করে যে, ঐ সুন্নাতের বিপরীতে ইজমা সংঘটিত হয়েছে। এটা তো মুসলিমদের জামা‘আত
সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করার নামান্তর। কেননা সে এর মাধ্যমে আল্লাহর
রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতের বিপরীতে মুসলিমদের ইজমা হওয়ার অপবাদ দিয়েছে। তার
চেয়ে জঘন্য হ’ল এই ইজমার দাবীর ক্ষেত্রে তার ওযর পেশ করা আর তা হ’ল যার
বক্তব্য হাদীছের অনুকূলে তার সম্পর্কে অজ্ঞতা। এর শেষ ফল হ’ল সুন্নাতের ওপর
তার অজ্ঞতাকেই প্রাধান্য দেওয়া! আল্লাহ সহায় হৌন![10]
আমি বলেছি, এটা তো ঐ ব্যক্তির কথা যে এ ধারণার বশবর্তী হয়ে সুন্নাতের বিরোধিতা করে যে সকল আলেম এর বিপরীতে একমত পোষণ করেছেন। তাহ’লে যে ব্যক্তি এটা জানার পরেও সুন্নাতের বিরোধিতা করে, যে অনেক আলেম এমনটি বলেছেন তার অবস্থা কি হবে? আর যে এর বিরোধিতা করে তার কোন দলীল নেই পূর্বোল্লেখিত কায়েদাগুলি অথবা তাক্বলীদ ব্যতীত। এ বিষয়ে চতুর্থ অধ্যায়ে আলোচিত হবে।
হাদীছের ওপর ক্বিয়াস ও উছূলকে প্রাধান্য দেওয়ার মত ভুলের কারণ :
আমার দৃষ্টিতে তাদের উল্লেখিত কায়েদাগুলিকে সুন্নাতের ওপর প্রাধান্য দেওয়ার মত বড় ভুলের মূল কারণ হ’ল সুন্নাতের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি হ’ল, তা কুরআনের মর্যাদা হ’তে ভিন্নতর মর্যাদায়। অপরদিকে সুন্নাত প্রমাণিত কি-না এ ব্যাপারে তাদের মনে সন্দেহ-সংশয় রয়েছে। তা যদি না হয় তাহ’লে তার ওপর ক্বিয়াসকে প্রাধান্য দেওয়া তাদের জন্য কি করে জায়েয হয়? অথচ এটা স্বতঃসিদ্ধ যে, ক্বিয়াস রায় ও ইজতিহাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। যা ভুলও হ’তে পারে, এটা সকলেরই জানা। সেজন্য এ দু’টির আশ্রয় নেওয়া হয় কেবল বিশেষ প্রয়োজনে। যেমন ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেন,لاَ يَحِلُّ الْقِيَاسُ وَالْخَبَرُ مَوْجُوْدٌ- ‘হাদীছ মওজূদ থাকতে ক্বিয়াস বৈধ নয়’।
আর কিভাবেই বা কতিপয় নগরীর অধিবাসীদের
আমলকে রাসূলের সুন্নাতের ওপর প্রাধান্য দেওয়া তাদের জন্য জায়েয হয়ে যায়?
অথচ তারাও জানে যে, মতভেদের সময় তার দিকে ফিরে গিয়ে সমাধান খুঁজতে তারাও
আদিষ্ট, যা ইতিপূর্বে আলোচিত হয়েছে। ইমাম সুবকী (রহঃ) এমন মাযহাবী সম্পর্কে
কতই-না সুন্দর কথা বলেছেন, যে হাদীছ পাওয়ার পরও সেটিকে তার মাযহাব হিসাবে
গ্রহণ করে না এবং তার অনুসরণীয় মাযহাব ব্যতীত অন্য কোন প্রবক্তা সম্পর্কে
জানেও না। তিনি বলেছেন,وَالْأوْلَى عِنْدِيْ اِتِّباَعُ الْحَدِيْثِ وليفرض
الإِنْسَانُ نَفْسهُ بَيْنَ يَدَيِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ
وَسَلَّمَ وَقَدْ سَمِعَ ذَلِكَ مِنْهُ أَيَسَعَهُ التَّأَخُّرُ عَنِ
الْعَمَلِ بِهِ؟ لَا وَاللهِ وَكُلُّ أَحَدٍ مُكَلَّفٌ بِحَسْبِ فَهْمِهِ-
‘আমার মতে উত্তম হ’ল হাদীছের অনুসরণ করা। কোন মানুষ নিজেকে নবীর সামনে মনে
করুক। এখন তাঁর নিকট থেকে (হাদীছ) শোনার পর সে অনুযায়ী আমল করা থেকে বিলম্ব
করার কোন সুযোগ তার আছে কি? আল্লাহর কসম করে বলছি, সে সুযোগ নেই।
প্রত্যেকের ওপর তার জ্ঞান ও বুঝ অনুযায়ী শরী‘আত প্রযোজ্য হবে’।[11]
আমি বলেছি, এ কথা আমরা পূর্বে যা বলেছি সেটিকে আরোও শক্তিশালী করে তা হ’ল সুন্নাত সাব্যস্ত হওয়ার ব্যাপারে তাদের মনে সন্দেহ-সংশয়ই তাদেরকে ঐরকম ভুলের মধ্যে নিক্ষেপ করেছে। তারা যদি সে সম্পর্কে জানতো এবং মানত যে রাসূল (ছাঃ) তা বলেছেন, তাহ’লে মুখে ঐ সমস্ত কায়েদা আওড়াত না এবং সেগুলিকে প্রয়োগও করত না। আর সেগুলির কারণে নবী করীম (ছাঃ) থেকে প্রমাণিত শত শত হাদীছের বিরোধিতাও করত না।
তাদের এমন কর্মের ভিত্তি রায়, ক্বিয়াস ও বিশেষ গোষ্ঠীর আমল ব্যতীত কিছুই নয়, যেমনটা আমি পূর্বে উল্লেখ করেছি। বিশুদ্ধ আমল তো সেটিই যা সুন্নাত মোতাবেক হয়ে থাকে। এর ওপর বেশী করা মানে দ্বীনে কোন কিছু সংযোজন করা এবং এর চেয়ে কম করা মানে দ্বীনের মধ্যে সংকোচন করা। ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) উল্লেখিত কম-বেশী করার ব্যাখ্যায় বলেন,فَالْأَوَّلُ اَلْقِيَاسُ وَالثَّانِيْ اَلتَّخْصِيْصُ الْبَاطِلُ وَكِلَاهُمَا لَيْسِ مِنَ الدِّيْنِ... ‘প্রথমটি ক্বিয়াস আর দ্বিতীয়টি বাতিল ‘খাছ’করণ। এ দু’টির কোনটিই দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত নয়। যে ব্যক্তি দলীল সম্পর্কে জানে না, সে কখনো দলীলে নেই এমন কিছুকে তার মধ্যে বৃদ্ধি করে বলবে, এটি ক্বিয়াস। আবার কখনো তার মধ্যে থেকে কিছু কম করবে এবং তাকে তার হুকুম থেকে বের করে দিয়ে বলবে, এটিকে ‘খাছ’ করা হয়েছে। আবার কখনো দলীলকে সম্পূর্ণরূপে বর্জন করে বলবে, এর ওপর কোন আমল পাওয়া যায় না। অথবা বলবে, এটি ক্বিয়াসের বিরোধী অথবা উছূলের বিরোধী’।
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা দেখি
যখনই কোন ব্যক্তি যত বেশী ক্বিয়াসের মধ্যে মগ্ন হয়েছে ততবেশী সুন্নাতের
বিরোধিতা করেছে। রায় ও ক্বিয়াসের অনুসারীরা ব্যতীত সুন্নাত ও আছারের বিরোধী
আমরা আর কাউকে দেখি না। এসবের কারণে কত স্পষ্ট ও ছহীহ হাদীছকে ত্যাগ করা
হয়েছে! আর কত আছার রয়েছে যার হুকুম এর কারণে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। রায় ও
ক্বিয়াসপন্থীদের নিকট হাদীছ ও আছার সমূহ মুখ থুবড়ে পড়েছে এবং তার
বিধি-বিধান পরিত্যক্ত হয়েছে। সেটি যেন শাসন ও রাজত্ব হ’তে বিচ্ছিন্ন শাসকের
ন্যায়। কেবল এর নাম রয়েছে কিন্তু হুকুম চলে অন্যের। তার কেবল সীলমোহর ও
বক্তব্য চলে আর আদেশ-নিষেধ চলে অন্যের। তা না হ’লে কোন যুক্তিতে হাদীছকে
পরিত্যাগ করা হয়েছে’?[12]
ঐ সমস্ত কায়েদার কারণে যে সকল ছহীহ হাদীছের বিরোধিতা করা হয়েছে তার কিছু দৃষ্টান্ত :
১. বিবাহের শুরুতেই স্ত্রীর সাথে স্বামীর রাত্রিযাপন বণ্টন সংক্রান্ত হাদীছ। তা এই যে, স্ত্রী কুমারী হ’লে সাত রাত আর বিধবা হ’লে তিন রাত সময় দিতে হবে। অতঃপর সমানভাবে পালা বণ্টিত হবে।
২. ব্যভিচারী অবিবাহিত হ’লে দেশান্তর করার হাদীছ।
৩. হজ্জের শর্ত সংক্রান্ত ও শর্তসাপেক্ষে হালাল হওয়ার বৈধতা সম্পর্কিত হাদীছ।
৪. ‘জাওরাব’ বা সুতার তৈরী মোযার ওপর মাসাহ সংক্রান্ত হাদীছ।
৫. বিস্মৃত ও অজ্ঞ ব্যক্তির কথায় ছালাত বাতিল না হওয়া সংক্রান্ত আবূ হুরায়রা ও মু‘আবিয়া ইবনুল হাকাম আস-সালামী (রাঃ)-এর হাদীছ।
৬. ফজরের ছালাত এক রাক‘আত হওয়ার পর সূর্যোদয় হয়ে গেলে ছালাত পূর্ণ করার হাদীছ।
৭. ভুলে খেয়ে ফেলা ব্যক্তির ছিয়াম পূর্ণ করার হাদীছ।
৮. মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে ক্বাযা ছিয়াম পূর্ণ করার হাদীছ।
৯. সুস্থতা লাভের সম্ভাবনা নেই এমন রুগ্ন ব্যক্তির পক্ষ থেকে হজ্জ সম্পাদন সম্পর্কিত হাদীছ।
১০. কসম সহ সাক্ষীর মাধ্যমে বিচার করা সম্পর্কিত হাদীছ।
১১. এক-চতুর্থাংশ দীনার চুরির কারণে চোরের হাত কাটা সম্পর্কিত হাদীছ।
১২. যে ব্যক্তি তার পিতার স্ত্রীকে বিবাহ করবে তার গর্দান কাটা যাবে এবং তার সম্পদ কেড়ে নেওয়া সংক্রান্ত হাদীছ।
১৩. কাফেরের কারণে কোন মুমিনকে হত্যা করা যাবে না সংক্রান্ত হাদীছ।
১৪. হালালকারী ও যার জন্য হালাল করা হয় উভয়ের ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত সম্পর্কিত হাদীছ।
১৫. অলী বা অভিভাবক ব্যতীত বিবাহ শুদ্ধ নয় সম্পর্কিত হাদীছ।
১৬. তিন তালাক প্রাপ্তা নারীর কোন বাসস্থান ও খরচ পাওয়ার অধিকার নেই সংক্রান্ত হাদীছ।
১৭. ‘তুমি তাকে লোহার একটি আংটি দিয়ে হ’লেও মোহরানা দাও’ শীর্ষক হাদীছ।
১৮. ঘোড়ার গোশত হালাল সম্পর্কিত হাদীছ।
১৯. সকল প্রকার নেশা সৃষ্টিকারী দ্রব্য হারাম সম্পর্কিত হাদীছ।
২০. পাঁচ ওয়াসাক্বের কম হ’লে তাতে যাকাত নেই মর্মে বর্ণিত হাদীছ।
২১. বরগা ও ইজারা চাষ সম্পর্কিত হাদীছ।
২২. পশুকে যবেহ করা তার গর্ভে থাকা বাচ্চার জন্য যথেষ্ট মর্মের হাদীছ।
২৩. বন্ধক রাখা পশুতে আরোহণ করা এবং দুধ দোহন করা যাবে মর্মের হাদীছ।
২৪. মদের সিরকা তৈরী করা নিষেধ সম্পর্কিত হাদীছ।
২৫. দুদ্ধপোষ্য শিশুর এক চোষণ ও দুই চোষণের কারণে হারাম না হওয়া সম্পর্কিত হাদীছ।
২৬. ‘তুমি ও তোমার মাল সবই তোমার পিতার’ হাদীছ।
২৭. উটের গোশত খেয়ে অযূ করা সংক্রান্ত হাদীছ।
২৮. পাগড়ির ওপর মাসাহ করা সংক্রান্ত হাদীছ।
২৯. কাতারের পিছনে একাকী ছালাত আদায়কারীকে পুনরায় ছালাত আদায়ের নির্দেশ সম্পর্কিত হাদীছ।
৩০. জুম‘আর দিন ইমামের খুৎবা চলাকালীন কেউ মসজিদে প্রবশ করলে সে তাহিয়্যাতুল মসজিদ পড়ে বসবে মর্মে বর্ণিত হাদীছ।
৩১. গায়েবানা জানাযা সম্পর্কিত হাদীছ।
৩২. ছালাতে সশব্দে আমীন বলার হাদীছ।
৩৩. পিতা কর্তৃক সন্তানকে কোন কিছু হেবা করে তা আবার ফেরত নেওয়া জায়েয এবং অন্য কারো জন্য ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ নেই মর্মের হাদীছ।
৩৪. সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়ার পর ঈদ সম্পর্কে জানতে পারলে পরের দিন সকালে ঈদের ছালাতের জন্য বের হওয়া সম্পর্কিত হাদীছ।
৩৫. যে দুগ্ধপোষ্য ছেলেশিশু বাইরের খাবার খায়নি তার পেশাবে ভাল করে পানি ছিটিয়ে দিলেই যথেষ্ট হবে মর্মের হাদীছ।
৩৬. কবরের পাশে ছালাত আদায় করার হাদীছ।
৩৭. আরোহণের শর্তে জাবির (রাঃ)-এর উট বিক্রি সংক্রান্ত হাদীছ। (অর্থাৎ মদীনায় ফিরে আসার সময় তাতে আরোহণ করা। এটা ছিল খায়বার যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার সময়ের ঘটনা।)
৩৮. হিংস্র পশুর চামড়া ব্যবহার নিষিদ্ধ সম্পর্কিত হাদীছ।
৩৯. ‘তোমাদের কেউ যেন তার প্রতিবেশীকে প্রয়োজনে তার দেয়ালে কাটা পুঁততে বাধা না দেয়’ মর্মে বর্ণিত হাদীছ।
৪০. যদি কেউ ইসলাম গ্রহণ করে আর এমতাবস্থায় তার নিকট স্ত্রী হিসাবে দুই সহোদর বোন থাকে তাহ’লে তাদের দু’জনের মধ্যে যাকে ইচ্ছা নির্বাচন করবে (এবং অন্যজনকে তালাক দিবে) মর্মের হাদীছ।
৪১. সওয়ারীর ওপর বিতর ছালাত আদায় সংক্রান্ত হাদীছ।
৪২. সকল নখওয়ালা হিংস্র পশু-প্রাণী হারাম সম্পর্কিত হাদীছ।
৪৩. ছালাতে ডান হাত বাম হাতের ওপর রাখা সুন্নাত সম্পর্কিত হাদীছ।
৪৪. রুকূ ও সিজদাতে যে ব্যক্তি তার পিঠ সোজা করে না তার ছালাত শুদ্ধ নয় মর্মের হাদীছ।
৪৫. ছালাতে রুকূতে যাওয়া ও ওঠার সময় রাফ‘ঊল ইয়াদায়েন করা সম্পর্কিত হাদীছ সমূহ।
৪৬. ছালাতে ‘ইসতেফতাহ’-এর দো‘আ সংক্রান্ত হাদীছ সমূহ।
৪৭. ‘তাকবীর’ তথা আল্লাহু আকবার বলার মাধ্যমে ছালাতে অন্যান্য বিষয় নিষিদ্ধ হয় এবং ‘তাসলীম’ বা সালাম ফিরানোর মাধ্যমে হালাল হয়’ সম্পর্কিত হাদীছ।
৪৮. ছালাতরত অবস্থায় শিশুকে বহন করা সম্পর্কিত হাদীছ।
৪৯. আক্বীকা সম্পর্কিত হাদীছ সমূহ।
৫০. ‘যদি কোন লোক অনুমতি ব্যতীত তোমার নিকট প্রবেশ করে’ মর্মে বর্ণিত হাদীছ।
৫১. নিশ্চয়ই বিলাল রাতে আযান দেয় মর্মের হাদীছ।
৫২. জুম‘আর দিন খাছ করে ছিয়াম রাখা নিষেধ সম্পর্কিত হাদীছ।
৫৩. সূর্যগ্রহণ এবং ‘ইসতেসক্বা’ বা বৃষ্টি প্রার্থনার ছালাত সম্পর্কিত হাদীছ।
৫৪. ষাঁড়ের বীর্যের বিনিময় গ্রহণ করা সম্পর্কিত হাদীছ।
৫৫. মুহরিম (হজ্জ ও ওমরার ইহরাম অবস্থায় থাকা) ব্যক্তি যদি মারা যায় তাহ’লে তার মাথা ঢাকা ও সুগন্ধি মাখানো যাবে না সম্পর্কিত হাদীছ।
আমি (আলবানী) বলছি যে, এই হাদীছগুলির সবগুলিই অথবা এর চেয়েও অনেক বেশি সংখ্যক হাদীছকে ক্বিয়াস অথবা উল্লেখিত কায়েদাগুলির কারণে পরিত্যাগ করা হয়েছে। ইবনু হাযম (রহঃ) এর মধ্যে কিছু হাদীছকে মদীনাবাসীর আমলের কারণে সুন্নাতকে ত্যাগকারীদের দিকে সম্পর্কিত করেছেন। তাদের সুন্নাতের বিরোধিতা বিষয়ে আরোও কিছু উদাহরণ পেশ করতে চাই। যেমন-
১. মাগরিবের ছালাতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সূরা তূর এবং শেষ জীবনে ‘মুরসালাত’ পাঠ করার হাদীছ।
২. সূরা ফাতিহার পর তাঁর ‘আমীন’ বলা।
৩. إِذَا السَّمَاءُ انْشَقَّتْ-এ তাঁর সিজদা দেওয়ার হাদীছ।
৪. লোকদেরকে নিয়ে বসে ছালাত আদায় করা এবং তারাও তাঁর পিছনে বসে আদায় করার হাদীছ। ওরা বলে, এভাবে ছালাত আদায়কারীর ছালাত বাতিল!
৫. আবুবকর ছিদ্দীক্ব (রাঃ) লোকদেরকে নিয়ে ছালাত শুরু করার পর রাসূল (ছাঃ) এসে তার পাশে বসে লোকদের নিয়ে বাকী ছালাত সম্পন্ন করেন মর্মে বর্ণিত হাদীছ। ওরা বলে, এই হাদীছের ওপর কোন আমল নেই। যদি কেউ এভাবে ছালাত আদায় করে তাহ’লে তার ছালাত বাতিল হয়ে যাবে।
৬. যোহর ও আছরের ছালাত জমা করে পড়া।[13]
৭. একজন পুত্র শিশুকে নিয়ে আসা হ’ল। সে রাসূল (ছাঃ)-এর কাপড়ে পেশাব করে দিলে তিনি পানি নিয়ে আসতে বললেন। এরপর সেখানে কেবল ভাল করে পানি ছিটিয়ে দিলেন। আর তা ধৌত করলেন না।
৮. তিনি ঈদের ছালাতে ‘ক্বাফ’ ও ‘ক্বিয়ামাহ’ সূরাদ্বয় পড়তেন মর্মে বর্ণিত হাদীছ।
৯. তিনি সুহাইল বিন বায়যার জানাযার ছালাত মসজিদে আদায় করেছিলেন মর্মে বর্ণিত হাদীছ।
১০. তিনি দু’জন ব্যভিচারী ইহুদীকে রজম করেছিলেন। ওরা বলে, ওদেরকে রজম করা জায়েয নেই।
১১. তিনি মুহরিম অবস্থায় শিঙ্গা লাগিয়েছেন মর্মে বর্ণিত হাদীছ।
১২. তিনি বায়তুল্লাহতে তওয়াফ করার আগে পরিহিত চাদরে সুগন্ধি লাগিয়েছিলেন মর্মে বর্ণিত হাদীছ।[14]
১৩. ছালাতে দুই সালাম সম্পর্কিত হাদীছসমূহ।
ইত্যাদি আরোও অনেক হাদীছ রয়েছে যেখানে তারা রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশনাগুলির বিরোধিতা করেছে। যদি সেগুলি কেউ খুঁজে বের করে, তাহ’লে কয়েক হাযারে পৌঁছবে। এমনটিই বলেছেন ইবনু হাযম (রহঃ)।
পূর্বে আমরা হাদীছের ওপর ক্বিয়াসকে প্রাধান্য দেওয়ার মাসআলাটি পর্যালোচনা করেছি। এখন কুরআন ও হাদীছ এবং উল্লেখিত দলীলগুলির আলোকে আরোও দু’টি বিষয় দু’টি অধ্যায়ে পর্যালোচনা করব, যাতে এ দু’টির বাস্তবতা আমাদের সামনে স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। [চলবে]
[1]. বুখারী হা/৪৩৮; মুসলিম হা/৫২১।
[2]. মুসলিম হা/১৫৩; ইবনু মানদাহ, আত-তাওহীদ হা/১৪৯; ছহীহাহ হা/১৫৭।
[3]. মুসলিম হা/২৫৮২; মিশকাত হা/৫১২৮।
[4]. ই‘লাম ১/৩২৭, ৩০০; শারহুল মানার, পৃঃ ৬২৩।
[5]. ই‘লাম ১/৩২৯; শারহুল মানার. পৃঃ ৬৪৬।
[6]. শারহুল মানার, পৃঃ ৬৪৭; আল-ইহকাম ২/৬৬।
[7]. শারহুল মানার. পৃঃ ২৮৯-২৯৪; ইরশাদুল ফুহূল, পৃঃ ১৩৮-১৩৯, ১৪৩-১৪৪।
[8]. আর-রিসালাহ, পৃঃ ৪৬৩-৪৬৪।
[9].ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন ১/৩২-৩৩।
[10]. ঐ, ৩/৪৬৪-৪৬৫।
[11]. রিসালা : ‘ইমাম মুত্তালিবীর কথার অর্থ হ’ল ‘যখন কোন হাদীছ ছহীহ পাবে সেটিই আমার মাযহাব’ ৩/১-২; মাজমু‘আতুর রাসায়িল আল-মুনীরিয়াহ।
[12]. ই‘লাম ১/২৯৯
[13]. অর্থাৎ মদীনাতে, কোন ভয় কিংবা সফরের কারণে নয়। এটি কোন সমস্যা থাকলে যেমন ইবনু আববাস (রাঃ)-এর জবাবে স্পষ্ট হয়ে যায়। তাকে প্রশ্ন করা হ’ল: এর উদ্দেশ্য কি? তিনি বললেন, যাতে তার উম্মতের জন্য কষ্টকর না হয়।
[14] .ইবনু হাযম, আল-ইহকাম ফী উছূলিল আহকাম ২/১০০-১০৫।