পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ । পর্ব ৬ । পর্ব ৭ । পর্ব ৮ । পর্ব ৯ । শেষ পর্ব ।
হাদীছের কতিপয় পরিভাষা
সুন্নাহ, হাদীছ, খবর ও আছার :
সুন্নাহ
শব্দটির শাব্দিক অর্থ সমাজ জীবনে প্রচলিত সাধারণ রীতি (الطريقة المسلوكة
والمعتادة فى الحياة)। নবী করীম (ছাঃ) বলেন, مَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِي
فَلَيْسَ مِنِّي ‘যে ব্যক্তি আমার সুন্নাত হ’তে বিমুখ হবে, সে আমার দলভুক্ত
নয়’।[1] তিনি আরো বলেন, فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِى وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ
الرَّاشِدِينَ ‘তোমরা আমার সুন্নাত ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে আঁকড়ে
ধর’।[2]
পরিভাষায়هي ما صدر عن النبي صلى الله عليه وسلم من قول أو فعل أو تقرير مما يراد به التشريع للأمة. ‘রাসূল (ছাঃ)-এর কথা, কাজ বা মৌন সম্মতি যার মাধ্যমে উম্মতের জন্য শরী‘আত প্রবর্তন উদ্দেশ্য করা হয় তাকে হাদীছ বলে’। এ সংজ্ঞার মাধ্যমে রাসূল (ছাঃ) কর্তৃক সংঘটিত দুনিয়াবী ও স্বভাবজাত বিষয়গুলি বাদ পড়ে যায়, যেগুলির সাথে দ্বীনের এবং অহীর কোন সম্পর্ক নেই।
মুহাদ্দিছদের মতে সাধারণ অর্থে সুন্নাহ ওয়াজিব ও মানদূবকে অন্তর্ভুক্ত করে। আর ফকীহদের পরিভাষায় যা ওয়াজিব ব্যতীত কেবল মানদূবকে বুঝায়।
হাদীছ : শব্দটির শাব্দিক অর্থ কথা, যা আলোচনা করা হয় এবং ধ্বনি ও লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়।
পরিভাষায় জমহুর বিদ্বানের মতে ‘হাদীছ’ শব্দটি সুন্নাহর সমার্থবোধক শব্দ। কেউ কেউ হাদীছ বলতে কেবল নবী করীম (ছাঃ)-এর মুখনিঃসৃত বাণীকে বুঝিয়েছেন; কাজ ও মৌন সম্মতিকে নয়। তবে সত্য কথা হ’ল শাব্দিক অর্থে সুন্নাহ দ্বারা কাজ ও মৌনসম্মতিকে বুঝায়। আর ‘হাদীছ’ দ্বারা কথাকে বুঝায়। কিন্তু যেহেতু এখানে দু’টিই নবী করীম (ছাঃ)-এর দ্বারা সংঘটিত বিষয়ের দিকে ফিরে যায়, সেহেতু অধিকাংশ মুহাদ্দিছ এ দু’টির শাব্দিক মৌলিক অর্থকে বাদ দিয়ে একই পরিভাষাগত ব্যবহারের দিকে ঝুঁকেছেন এবং দু’টিকে সমার্থবোধক শব্দ বলেছেন। যেমন হাদীছকে তারা মারফূ, যা নবী করীম (ছাঃ) পর্যন্ত যা পৌঁছেছে তার সাথে খাছ বা নির্দিষ্ট করেছেন এবং তিনি ব্যতীত অন্য কারো দ্বারা সংঘটিত বিষয়কে বিশেষ শর্ত ছাড়া নিঃশর্তভাবে হাদীছ বলা হয় না।
খবর : ‘খবর’ শব্দটিও আভিধানিক অর্থে হাদীছের সমার্থবোধক। এ দু’টি দ্বারা একই বিষয়কে বুঝায়। কিন্তু অনেক বিদ্বানের মতে, হাদীছ বলতে কেবল যা কিছু নবী করীম (ছাঃ) হ’তে সংঘটিত হয়েছে তাকেই বুঝায়। আর খবরকে এর চেয়ে ব্যাপক অর্থে মনে করেন। যা নবী করীম (ছাঃ) হ’তে এবং অন্য কারো দ্বারা সংঘটিত বিষয়কে শামিল করে। এ দু’টি শব্দের মাঝে আম ও খাছ-এর সম্পর্ক বিদ্যমান। তাই সব হাদীছই খবর কিন্তু সব খবরই হাদীছ নয়। এজন্যই সুন্নাহ বিষয়ে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তিকে বলা হয় ‘মুহাদ্দিছ’। আর ইতিহাস বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে বলা হয় ‘আখবারী’ বা ইতিহাসবেত্তা। আবার কেউ কেউ খবরকে হাদীছ ও সুন্নাহর সমার্থবোধক শব্দ বলেছেন। তবে প্রথম মতটিই সর্বোত্তম।
আছার : ‘আছার’ বলতে পূর্ববর্তীদের থেকে বর্ণিত বিষয়কে বুঝায় (هو الشىء المنقول عن السابقين)। ফলে তা খবরের মতই নবী করীম (ছাঃ) ও অন্যদের থেকে সংঘটিত বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে। কেউ কেউ আছার বলতে কেবল সালাফ তথা ছাহাবী, তাবেঈন ও তাবে তাবেঈন থেকে সংঘটিত বিষয়কে বুঝিয়েছেন। ব্যবহারের ক্ষেত্রে এটিই উত্তম ও সুন্দর। কেননা এর দ্বারা মওকূফ হাদীছকে মারফূ‘ থেকে পৃথক করা হয়।
সনদ ও মতন :
সুন্নাহর কিতাবগুলিতে বর্ণিত নবীর হাদীছ গঠিত হয় দু’টি মৌলিক ভাগে; প্রথমটি ‘সনদ’ আর দ্বিতীয়টি ‘মতন’।
সনদ বা ইসনাদ :
هو الطريق الموصلة إلى المتن، أي الرواة الذين نقلوا المتن وأدوه، ابتداء من الراوي المتأخر مصنف كتاب الحديث، وانتهاء بالرسول صلى الله عليه وسلم.
‘সেটি এমন পথ, যা মতন পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেয়। অর্থাৎ যে সকল রাবী মতন (Text) বর্ণনা করে ও পৌঁছে দেয় যা সর্বশেষ রাবী তথা হাদীছের কিতাবের সংকলক থেকে শুরু হয় এবং রাসূল (ছাঃ) পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়।
আর ‘মতন’ হ’ল, هو ألفاظ الحديث التي تقوم بها المعاني. ‘হাদীছের অর্থ নির্দেশক শব্দসমষ্টি’। সনদবিহীন যেকোন হাদীছকে গ্রহণ করতে বিদ্বানগণ অসম্মতি জ্ঞাপন করেছেন। এর কারণ হ’ল নবীর নামে মিথ্যার ছড়াছড়ি। বিশিষ্ট তাবেঈ মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন (রহঃ) বলেন,
لم يكونوا يسألون عن الإسناد، فلما وقعت الفتنة قالوا سموا لنا رجالكم، فينظر إلى أهل السنة فيؤخذ حديثهم، وينظر إلى أهل البدع فلا يؤخذ حديثهم.
‘লোকেরা ইতিপূর্বে কখনও হাদীছের সনদ
সূত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করত না। কিন্তু যখন ফিৎনার যুগ এল, তখন লোকেরা
বলতে লাগল আগে তোমরা বর্ণনাকারীদের পরিচয় বল। অতঃপর যদি দেখা যেত যে,
বর্ণনাকারী ‘আহলে সুন্নাত’ দলভুক্ত, তাহ’লে তাঁর বর্ণিত হাদীছ গ্রহণ করা
হ’ত। কিন্তু ‘আহলে বিদ‘আত’ দলভুক্ত হ’লে তার বর্ণিত হাদীছ গ্রহণ করা হ’ত
না’।[3]
এরপর থেকেই আলেমগণ তাদের নিকট পেশকৃত প্রত্যেকটি ‘সনদ’ ভাল করে যাচাই করতেন। যদি তাতে ছহীহ হওয়ার শর্তসমূহ যেমন রাবীদের পূর্ণ ‘যবত্ব’ বা সংরক্ষণ ক্ষমতা, ‘আদালাত’ (তাকবওয়ার গুণে গুণান্বিত হওয়া এবং ব্যক্তিত্ব ক্ষুণ্ণকারী দোষ-ত্রুটি থেকে বেঁচে থাকা, সনদের ধারাবাহিকতা ঠিক থাকা এবং ‘শায’ (ছিক্বাহ রাবীর তার চেয়ে অধিক ছিক্বাহ বা নির্ভরযোগ্য রাবীর বিপরীত বর্ণনা না করা) বা ‘ইল্লাতে’র (গোপন ত্রুটি) দোষে দূষিত না হওয়া, তাহ’লে তা গ্রহণ করতেন। অন্যথা তারা তা প্রত্যাখ্যান করতেন। এভাবেই ‘ইসনাদ’ দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়। যদি সনদ না থাকত তাহ’লে যে কেউ যাচ্ছেতাই বলতো’ (الإسناد من الدين، ولولاه لقال من شاء ما شاء)। এমনটিই বলেছেন আব্দুল্লাহ্ বিন মুবারক (রহঃ)।
হাদীছ বিশারদগণ সকল ‘সনদ’ ও ‘মতনে’র জন্য বিভিন্ন নিয়ম ও মূলনীতি প্রণয়ন করেছেন, যার ভিত্তিতে সে দু’টি গৃহীত হয়ে থাকে। এই মূলনীতি ও উছূল বিষয়ক বিশেষ ইলমকে বলা হয় ‘ইলমু মুছত্বলাহিল হাদীছ’ বা ‘হাদীছের পরিভাষা বিজ্ঞান’। যে ব্যক্তি এ বিষয়ে অধিক জানতে আগ্রহী তাকে কিছু সংকলিত গ্রন্থের শরণাপন্ন হ’তে হবে। এ বিষয়ে সবচেয়ে ভাল বই হাফেয ইবনু কাছীর রচিত ‘ইখতিছারু উলূমিল হাদীছ’। এর সবচেয়ে সুন্দর ছাপা মিছরীয়, যা শায়খ আহমাদ মুহাম্মাদ শাকির কর্তৃক তাহক্বীক্ব ও তা‘লীককৃত। এর শিরোনাম হ’ল ‘আল-বা‘ইছুল হাছীছ শারহু ইখতিছারি উলূমিল হাদীছ’(الباعث الحثيث شرح اختصار علوم الحديث)
আমাদের নিকট পৌঁছার দিক থেকে সুন্নাহর প্রকারসমূহ- মুতাওয়াতির ও আহাদ:
আমাদের নিকট সুন্নাহ পৌঁছার পদ্ধতি বিচারে তা দুই প্রকার : ‘মুতাওয়াতির’ ও ‘আহাদ’। হানাফীরা তৃতীয় আর একটি প্রকার বৃদ্ধি করেছেন। আর তা হ’ল ‘মুসতাফীয’ অথবা ‘মাশহূর’।
মুতাওয়াতির : শাব্দিক অর্থে মুতাওয়াতির বলতে বুঝায় বিরতি সহ কোন কিছু একের পর এক আসা। এটি আরবী ‘বিতর’ বা বিজোড় শব্দ থেকে গৃহীত। পারিভাষিক অর্থে মুতাওয়াতির বলা হয় এমন বিপুল সংখ্যক রাবীর বর্ণিত হাদীছকে যাদের সংখ্যাধিক্য অথবা নির্ভরযোগ্যতার দরুণ কোন ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য বিষয়ে স্বভাবগত ও বিবেকগত উভয় দিক থেকে মিথ্যার ব্যাপারে তাদের সবার একমত হওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে অথবা বিপুল সংখ্যক রাবীর তাদের মতই বিপুলসংখ্যক রাবী থেকে বর্ণিত হাদীছকে যার পরিসমাপ্তি ঘটে যা পরস্পর সরাসরি সাক্ষাত অথবা শ্রবণের মতো ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য বিষয়ে গিয়ে হয়। ফলে এক্ষেত্রে খবরটি রাসূল (ছাঃ) থেকে শ্রবণ করা এবং তাঁর কর্ম স্বচক্ষে দেখা বা তাঁর সম্মতি পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়।
উপরোক্ত সংজ্ঞা দ্বারা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে মুতাওয়াতির হাদীছের মধ্যে অবশ্যই চারটি শর্ত বিদ্যমান থাকা আবশ্যক। ১. হাদীছ বর্ণনাকারী রাবীগণ যে বিষয়ে বলেছেন সে বিষয়ে অকাট্যভাবে জানা থাকতে হবে। তাদের মাঝে যথেচ্ছাচারিতা অথবা ধারণার বশবর্তী হয়ে বলার মত কোন বৈশিষ্ট্য থাকা যাবে না। ২. তাদের ইলম কোন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল হ’তে হবে। যেমন পরস্পরে সাক্ষাৎ অথবা শ্রবণ। ৩. তাদের সংখ্যা এমন পর্যায়ে উপনীত হ’তে হবে যে, সাধারণত মিথ্যার ব্যাপারে তাদের সবার একমত হওয়া অসম্ভব। সঠিক মত অনুযায়ী তাদের সংখ্যার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোন সীমা নেই। বরং রাবীদের বিশ্বস্ততা, যবত্ব, মুখস্থশক্তির ভিন্নতা ভেদে সংখ্যাও ভিন্ন ভিন্ন হ’তে পারে। ৪. প্রত্যেকটি স্তরেই গ্রহণযোগ্য সংখ্যক রাবী থাকতে হবে। অর্থাৎ শুরুতে, মাঝখানে ও শেষে।[4] মুতাওয়াতির শব্দগত ও অর্থগত দু’ভাবেই হ’তে পারে। খবরের সত্যতা ও বিশুদ্ধতার দৃষ্টিকোণ থেকে দু’প্রকার মুতাওয়াতিরই অকাট্য ও ইয়াকীনের ফায়েদা দিয়ে থাকে। এ ব্যাপার বিদ্বানগণের মাঝে কোন মতভেদ নেই।
আহাদ হাদীছ : এটি এমন হাদীছ যার মাঝে পূর্বোল্লোখিত মুতাওয়াতিরের শর্তসমূহ পাওয়া যায় না। কখনো তা একজন রাবী বর্ণনা করে। তখন একে ‘গরীব’ হাদীছ বলা হয়। কখনোবা দুই বা ততোধিক রাবী বর্ণনা করে। তখন সেটিকে ‘আযীয’ বলা হয়। আবার কখনোবা একদল বা একটি জামা‘আত বর্ণনা করে। তখন তাকে ‘মাশহূর’ অথবা ‘মুসতাফীয’ বলা হয়। এর ভিত্তিতে বলা যায়, এ বৈশিষ্ট্য দ্বারা এটা বুঝায় না যে, আহাদ হাদীছ সর্বদা একজন রাবী থেকে বর্ণিত হয়।
মাশহূর ও মুসতাফীয
: বিশুদ্ধ মতে এটি খবরে ওয়াহিদেরই একটি প্রকার। তবে হানাফীরা এ মতের
বিরোধী। তারা এটিকে ভিন্ন এক প্রকার হিসাবে গণ্য করেছেন এবং এর জন্য বিশেষ
বিধিবিধানও সাব্যস্ত করেছেন। তারা বলেছেন, এটি এমন প্রশান্তির ফায়েদা দেয়
যা ‘আহাদ’ বা একজনের বর্ণিত হাদীছ দেয় না। এর আলোকেই তারা মূলনীতি নির্ধারণ
করেছেন যে, তা মুতাওয়াতিরের মতই কিতাবের ‘মুতলাক’ (নিঃশর্ত) হুকুমকে
‘মুকাইয়াদ’ (শর্তযুক্ত) করতে পারে।[5]
এটা ঠিক যে, এর বর্ণনাকারীদের ক্ষেত্রে সংখ্যাধিক্য এবং মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধি ও ব্যাপকতা লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু সত্য হ’ল যেমন জমহুর বিদ্বান মনে করেন যে, এগুলি সেটিকে আহাদ হাদীছের বৈশিষ্ট্য থেকে খারিজ করে দেয় না এবং তাকে মুতাওয়াতিরের পর্যায়েও উন্নীত করে না। শুরুতে ও শেষে তা আহাদ হাদীছই; যতই ভিন্ন ভিন্ন নাম ও লকব থাকুক না কেন। এজন্যই তা ছহীহ, হাসান ও যঈফ শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে থাকে।
ছহীহ আহাদ হাদীছের ইলম ও
ইয়াকীনের ফায়েদা দেওয়ার ব্যাপারে বিদ্বানগণের মাঝে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়।
তাদের কেউ কেউ যেমন ইমাম নববী (রহঃ) ‘আত-তাক্বরীব’ গ্রন্থে মত প্রকাশ
করেছেন যে, এটি অগ্রাধিকারযোগ্য ধারণার ফায়েদা দেয়। আর অন্যরা মনে করেন,
ইমাম বুখারী ও মুসলিম তাঁদের স্ব স্ব ছহীহ গ্রন্থে যে সকল সনদযুক্ত হাদীছ
বর্ণনা করেছেন তা ইলম ও অকাট্যের (العلم والقطع) ফায়েদা দেয়। ইমাম ইবনু
হাযম (রহঃ)-এর মতে, ‘খবরে ওয়াহেদ যদি আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) পর্যন্ত অনুরূপ
ন্যায়পরায়ণ রাবী কর্তৃক বর্ণিত হয় তাহ’লে তা ইলম ও আমল উভয়ই ওয়াজিব করে’।[6]
হক কথা হ’ল যা আমরা মনে করি ও বিশ্বাস করি যে, প্রতিটি ছহীহ আহাদ হাদীছ যাকে কোনরূপ অস্বীকৃতি ও দোষারোপ ছাড়াই উম্মত সানন্দচিত্তে গ্রহণ করেছেন নিশ্চয়ই তা ইল্ম ও ইয়াক্বীনের ফায়েদা দেয়; চাই তা ছহীহায়েন তথা বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হোক অথবা অন্য কোন গ্রন্থে।[7] পক্ষান্তরে যার ব্যাপারে উম্মত মতভেদ করেছে এবং কিছু বিদ্বান যেটিকে ছহীহ বলেছেন এবং অন্যরা সেটিকে যঈফ বলেছেন তা কেবল তাদের মতে ‘শক্তিশালী ধারণা’র (الظن الغالب) ফায়েদা দেবে যারা সেটিকে ছহীহ বলেছেন। আল্লাহ তা‘আলাই অধিক অবগত।
সুন্নাহ যিকিরের অন্তর্ভুক্ত, যা ক্বিয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকবে :
এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা। এর গুরুত্ব ও অনেক মানুষ সে সম্পর্কে গাফেল হওয়ার কথা মাথায় রেখে আমি সে বিষয়ে সতর্ক করতে চাই। তা হ’ল সুন্নাহ যিকিরের অন্তর্ভুক্ত। এটি নষ্ট ও ধ্বংস হওয়া থেকে পুরোপুরি সুরক্ষিত এবং তা বহিঃর্মিশ্রণ থেকে এমনভাবে নিরাপদ যে, ইখতিলাত্ব বা সংমিশ্রণ ঘটলেও তা থেকে মিশ্রিত বস্ত্তকে পৃথক করা সম্ভব। যদিও কিছু বিপথগামী ও পথভ্রষ্ট ফিরকার লোকেরা এর বিপরীত ধারণা পোষণ করে। যেমন কাদিয়ানী ও আহলে কুরআন। এরা বলে থাকে, ‘ছহীহ ও প্রমাণিত হাদীছের সাথে মিথ্যা ও জাল হাদীছ মিশ্রিত হয়ে গেছে। আর এ দু’য়ের মাঝে পার্থক্য করার সাধ্য মানুষের নেই। নবী করীম (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পর মুসলিমরা তাদের নবীর হাদীছের ব্যাপারে সংশয়ে পড়েছে এবং তা নষ্ট ও হারিয়ে গেছে। সুতরাং তারা তা থেকে উপকৃত হওয়া ও তার দিকে ফিরে যেতেও সক্ষম হননি। কেননা এর কোন অংশই আর কখনো বিশ্বাস করা সম্ভব নয়’!!
এভাবেই এরা দ্বীন ইসলামের দ্বিতীয় মৌলিক উৎসকে দেয়ালে ছুঁড়ে ফেলেছে এবং এর ধ্বংস সাধন করেছে। অথচ ইসলামের প্রথম উৎস স্বয়ং কুরআন বুঝা ও তা থেকে ফায়েদা হাছিল করা হাদীছের উপর নির্ভরশীল। কাফের ও ইসলামের শত্রুদের হাদীছে সংশয় সৃষ্টি একটি বড় লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও মনোবাঞ্ছা। এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সম্ভাব্য সবকিছু তারা করছে।
তাদের কেউ কেউ বলেন, ছহীহ হাদীছের সাথে যঈফ হাদীছ মিশ্রিত হওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত বাস্তবতা। কিন্তু এর একটি থেকে অপরটি পৃথক করার পদ্ধতিও রয়েছে। আর তা হ’ল রাসূল (ছাঃ)-এর বাণী :
سيفشوا الكذب علي، فما سمعتم عني فأعرضوه على القرآن، فما وافقه فأنا قلته، وما لم يوافقه فأنا بريء منه.
‘অচিরেই আমার ওপর মিথ্যারোপ ব্যাপকতা লাভ করবে। সুতরাং তোমরা আমার নামে যা কিছু শুনবে তা কুরআনের নিকট পেশ করবে; যা কিছু তার সাথে মিলবে তা আমি বলেছি বলে ধরে নিবে। আর যা কিছু কুরআনের সাথে মিলবে না তা থেকে আমি দায়মুক্ত’।
এই
হাদীছটি সকল হাদীছ বিশারদের নিকট জাল বা বানোয়াট হিসাবে পরিচিত। একজন
বিচক্ষণ আলেম বলেছেন, ‘রাসূল (ছাঃ) এই হাদীছের মাধ্যমে আমাদের কাছে যা
চেয়েছেন আমরা অবশ্যই তা পালন করেছি। তাই এটিকে কুরআনের ওপর পেশ করে তাকে
কুরআনের নিমেণাক্ত ও অন্যান্য আয়াত বিরোধী পেয়েছি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوْا-
‘আর রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা হ’তে বিরত
থাক’ (হাশর ৫৯/৭)। তাই আমরা এটিকে জাল বলে আখ্যায়িত করেছি এবং নবী করীম (ছাঃ)-কে এর থেকে দায়মুক্ত ঘোষণা করেছি।[8]
হাদীছ সংরক্ষণ সম্পর্কিত দলীলগুলির মধ্যে অন্যতম হ’ল আল্লাহর বাণী, إِنَّا نَحْنُ نزلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ ‘আমরাই কুরআন নাযিল করেছি এবং আমরাই এর সংরক্ষণকারী’ (হিজর ১৫/৯)। এই আয়াতে কারীমায় যিকিরের সংরক্ষণ সম্পর্কে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে দৃঢ় অঙ্গীকার করা হয়েছে। সেই যিকির কি? নিঃসন্দেহে তা সর্বপ্রথম কুরআন কারীমকে বুঝায়। কিন্তু সূক্ষ্মভাবে চিন্তা-গবেষণা করলে দেখা যাবে যে, তা সুন্নাতে নববীকেও অন্তর্ভুক্ত করে। এ মর্মেই বেশ কিছু মুহাক্কিক আলেম মত দিয়েছেন। তন্মধ্যে রয়েছেন ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু হাযম (রহঃ)। তিনি তাঁর মূল্যবান গ্রন্থ ‘আল-ইহকাম ফী উছূলিল আহ্কাম’-এর ১০৯-১২২ পৃষ্ঠায় এ বিষয়ে একটি উপকারী ও দীর্ঘ অধ্যায় রচনা করেছেন। সেখানে তিনি শক্তিশালী দলীল ও লাজওয়াবকারী প্রমাণাদি উল্লেখ করেছেন এ মর্মে যে, সুন্নাত যিকিরের অন্তর্ভুক্ত। আর তা কুরআনের ন্যায় সংরক্ষিত এবং খবরে আহাদ ইলমের ফায়েদা দেয়। তাঁর উলেলখিত দলীলগুলির মধ্যে রয়েছে, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবী (ছাঃ) সম্পর্কে বলেন, وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى إِنْ هُوَ إِلا وَحْيٌ يُوحَى ‘তিনি নিজ খেয়াল-খুশীমত কোন কথা বলেন না। এটি কেবল তাই যা তার নিকট অহি করা হয়’ (নাজম ৫৩/৩-৪)। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবীকে বলতে আদেশ করে বলেন, إنْ أَتَّبِعُ إلاَّ مَا يُوحَى إليَّ ‘আমি তো কেবল তারই অনুসরণ করি যা আমার প্রতি অহি করা হয়’ (আহক্বাফ ৪৬/৯)।
তিনি আরো বলেন, إِنَّا نَحْنُ نزلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُوْنَ- ‘আমরাই কুরআন নাযিল করেছি এবং আমরাই এর সংরক্ষণকারী’ (হিজর ১৫/৯)। তিনি আরোও বলেন,وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُوْنَ- ‘আর তোমার নিকটে প্রেরণ করেছি কুরআন, যাতে তুমি মানুষকে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে দাও যা তাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে’ (নাহল ১৬/৪৪)।
সুতরাং বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত হ’ল যে, দ্বীনী বিষয়ে আল্লাহর রাসূলের সকল কথাই আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতারিত অহী। এতে কোনই সন্দেহ নেই। আর ভাষাবিদ ও শারঈ পন্ডিতগণের মাঝেও এ বিষয়ে কোন দ্বিমত নেই যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ প্রত্যেকটি অহী নাযিলকৃত যিকির। সুতরাং সকল অহীই নিশ্চিতভাবে আল্লাহর হেফাযতে সংরক্ষিত। আর স্বয়ং মহান আল্লাহ যার হেফাযতের দায়িত্ব নিয়েছেন তা ধ্বংস বা নষ্ট হবে না এবং তার কোন অংশেরই কখনো এমন কোন পরিবর্তন হবে না, যা বাতিল বলে সাব্যস্ত হবে না। যদি এর বিপরীত কিছু সংঘটিত হওয়া জায়েয হ’ত তাহ’লে তো আল্লাহর কালাম মিথ্যায় পরিণত হ’ত এবং তার হেফাযতের নিশ্চয়তাও বাতিল ও অসম্পূর্ণ হয়ে যেত। আর এমন কথা সামান্যতম বিবেকের অধিকারীর মনেও কখনো উদিত হবে না। সুতরাং এটা মেনে নেয়া ওয়াজিব হয়ে যায় যে, মুহাম্মাদ (ছাঃ) যে দ্বীন আমাদের নিকট নিয়ে এসেছেন তা স্বয়ং মহান আল্লাহর তত্ত্বাবধানে সংরক্ষিত এবং কিয়ামত পর্যন্ত আগত প্রত্যেক আকাঙ্খিত ব্যক্তির নিকট তা যথাযথভাবে পৌঁছে দেওয়া হবে। মহান আল্লাহ বলেন, لأنْذِرَكُمْ بِهِ وَمَنْ بَلَغَ ‘যাতে এর দ্বারা আমি ভয় প্রদর্শন করি তোমাদের ও যাদের কাছে এটি পৌঁছবে তাদের’ (আন‘আম ৬/১৯)।
যদি ব্যাপারটি তাই হয় তাহ’লে যরূরী ভিত্তিতে আমাদের জানা দরকার যে, দ্বীনী বিষয়ে রাসূল (ছাঃ) যা কিছু বলেছেন তা অবশ্যই ধ্বংস ও নষ্ট হবার নয়। এর সাথে কখনোই এমন কোন মিথ্যা বা বাতিল মিশ্রিত হওয়ার কোন পথ নেই যা মানুষের মধ্যে কেউ চিহ্নিত করতে পারবে না। যদি তাই হ’ত তাহ’লে যিকির অরক্ষিত হ’ত! আর আল্লাহ তা‘আলার নিমেণাক্ত বাণী :إِنَّا نَحْنُ نزلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ ‘আমরাই কুরআন নাযিল করেছি এবং আমরাই এর সংরক্ষণকারী’ (হিজর ১৫/৯) মিথ্যা হ’ত এবং তাঁর কৃত ওয়াদাও ভঙ্গ হ’ত! এমন কথা কোন মুসলিম কখনো বলতে পারে না।
যদি
কেউ বলে যে, এর দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা কেবল কুরআন মাজীদকে উদ্দেশ্য করেছেন।
আল্লাহ কেবল কুরআন হেফাযতের গ্যারান্টি দিয়েছেন; কুরআন ব্যতীত অন্য সকল
অহীর নয়! এর জবাবে আমরা তাকে বলব, (আল্লাহর কাছেই তাওফীক্ব কামনা করছি) এমন
দাবী মিথ্যা ও দলীলবিহীন এবং দলীল ছাড়াই যিকিরকে ‘খাছ’ করার নামান্তর। আর
এমন দাবী বাতিল। কারণ আল্লাহ তা‘আলা বলেন, قُلْ هَاتُوْا بُرْهَانَكُمْ
إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِيْنَ ‘তুমি বল, তোমরা তোমাদের প্রমাণ উপস্থিত কর যদি
তোমরা সত্যবাদী হও’ (নামল ২৭/৬৪)। সুতরাং প্রমাণিত হ’ল যে, যার
দাবীর স্বপক্ষে কোন দলীল নেই, তার দাবীতে সে মিথ্যুক। আর যিকির বলা হয়
আল্লাহ তা‘আলা যা কিছু তাঁর নবীর ওপর নাযিল করেছেন; কুরআন হোক অথবা সুন্নাহ
হোক যা দ্বারা কুরআনের ব্যাখ্যা করা হয়। অনুরূপভাবে আল্লাহ তা‘আলা
বলেন,وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ
إِلَيْهِمْ، ‘আর তোমার নিকটে প্রেরণ করেছি কুরআন, যাতে তুমি মানুষকে
বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে দাও, যা তাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে’ (নাহল ১৬/৪৪)।
সুতরাং প্রমাণিত হ’ল যে, রাসূল (ছাঃ) লোকদের নিকট কুরআনের ব্যাখ্যা করতে
আদিষ্ট হয়েছেন। কুরআনে অনেক ‘মুজমাল’ বা সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখিত বিষয়
রয়েছে। যেমন ছালাত, যাকাত, হজ্জ ইত্যাদি যা আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের শব্দে
আমাদের ওপর ওয়াজিব করেছেন তা আমরা বিস্তারিত জানতে পারি না। কিন্তু রাসূল
(ছাঃ)-এর বিস্তারিত বর্ণনার মাধ্যমে আমরা তা জানতে পারি। তাই ঐ সমস্ত
সংক্ষিপ্ত বিষয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর বর্ণনা যদি অরক্ষিত থাকে এবং অন্য বাতিল
কিছুর সাথে মিশে যাওয়া থেকে নিরাপদ থাকার নিশ্চয়তা না থাকে, তাহ’লে তো
কুরআনের বাণী দ্বারা উপকার লাভ বাতিল হয়ে যাবে। ফলে তাতে আমাদের ওপর ফরযকৃত
অধিকাংশ শরী‘আতের বিধান বাতিল হয়ে যাবে! তাই যদি হয়, তাহ’লে আল্লাহ
তা‘আলার সঠিক উদ্দেশ্য কী আমরা তা জানতে পারব না। যদি ভুলকারী ভুল করে সে
বিষয়ে অথবা কোন মিথ্যুক ইচ্ছা করে সে বিষয়ে যদি মিথ্যা কিছু বলে সেটিও ধরতে
পারব না! এসব থেকে আল্লাহ তা‘আলার নিকট আশ্রয় চাই’।[9]
আমি বলেছি, ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) তাঁর ‘মুখতাছার আছ-ছাওয়াইক আল-মুরসালাহ’ নামক কিতাবে (পৃঃ ৪৮৭-৪৯০) ইবনু হাযম সহ অন্যান্য বিদ্বানের বক্তব্য উদ্ধৃত করে তিনি সেটিকে সমর্থন করেছেন এবং সুন্দর বলেছেন। আলোচনা শেষে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘আবু মুহাম্মাদ অর্থাৎ ইবনু হাযম যা বলেছেন তা ঐ খবর সম্পর্কে সত্য, যা উম্মত আক্বীদাগত ও আমলগতভাবে গ্রহণ করেছে। তবে ‘গরীব হাদীছ’ ব্যতীত, যাকে উম্মত গ্রহণ করেছেন মর্মে জানা যায়নি’।
ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (রহঃ)ও উক্ত মতকেই সমর্থন করেছেন। তঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, এই জাল হাদীছগুলির কি হবে? জবাবে তিনি বলেন,تَعِيْشُ لَهُ الْجَهَابِذَةُ ‘এর জন্য হাদীছ বিশারদ পন্ডিতগণ রয়েছেন’। আল্লাহ বলেন, إِنَّا نَحْنُ نزلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُوْنَ- ‘আমরাই কুরআন নাযিল করেছি এবং আমরাই এ কুরআন সংরক্ষণকারী’ (হিজর ১৫/৯)।[10] ইমাম আব্দুর রহমান বিন মাহদী থেকেও অনুরূপ কথা বর্ণিত আছে।
তাঁদের
মধ্যে রয়েছেন আল্লামা মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম আল-ওযীর। তিনি পূর্বোক্ত
আয়াতটি উল্লেখ করার পর বলেন, وهذا يقتضي أن شريعة رسول الله صلى الله عليه
وسلم لا تزال محفوظة، وسنته لا تبرح محروسة... ‘এটি দাবী রাখে যে, রাসূল
(ছাঃ) আনীত শরী‘আত সংরক্ষিত এবং তাঁর সুন্নাতও সর্বদা সুরক্ষিত রয়েছে’...।[11]
এ বিষয়ে আরোও প্রমাণাদি হ’ল আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে শেষ নবী ও রাসূল বানিয়েছেন এবং তাঁর শরী‘আতকে সর্বশেষ শরী‘আত হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। কিয়ামত পর্যন্ত তাঁর প্রতি ঈমান আনা ও তাঁর শরী‘আতের অনুসরণ করা মানুষের ওপর আবশ্যক করেছেন এবং এর বিরোধী সব শরী‘আতকে বাতিল করে দিয়েছেন। এসবই দাবী রাখে যে, বান্দার ওপর আল্লাহর হুজ্জত কায়েম থাকবে এভাবে যে, রাসূল (ছাঃ)-এর দ্বীন টিকে থাকবে এবং তাঁর শরী‘আত সুরক্ষিত থাকবে। কারণ এটা অসম্ভব যে, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদের ওপর এমন শরী‘আত অনুসরণ করার দায়িত্ব ন্যস্ত করবেন যা বিলুপ্তি ও ধ্বংসের সম্মুখীন হবে। জ্ঞাতব্য যে, ইসলামী শরী‘আতের মৌলিক দু’টি উৎস হ’ল কুরআন ও সুন্নাহ। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللهِ وَالرَّسُوْلِ- ‘যদি কোন বিষয়ে তোমরা বিতন্ডা কর, তাহ’লে বিষয়টি আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও’ (নিসা ৪/৫৯)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ألا إني أوتيت القرآن ومثله معه. ‘নিশ্চয় আমাকে কুরআন এবং তার মত আরোও একটি বস্ত্ত দেওয়া হয়েছে’।[12] কুরআন সংরক্ষিত হয়েছে আমাদের নিকট মুতাওয়াতির সূত্রে পৌঁছানোর মাধ্যমে, যা খবরসমূহ সাব্যস্ত হওয়ার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ স্তরের। তাছাড়া সুন্নাত যেহেতু কুরআনের সংক্ষিপ্ত বিষয়কে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করে ও ব্যাখ্যা করে, ‘আম’ হুকুমসমূহকে ‘খাছ’ এবং ‘মুতলাক’ বিধানসমূহকে ‘মুকাইয়াদ’ করে, সেহেতু সুন্নাহ ব্যতীত কুরআন বুঝা ও আমল করা সম্ভব নয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُوْنَ- ‘আর তোমার নিকটে প্রেরণ করেছি কুরআন, যাতে তুমি মানুষকে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে দাও যা তাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে, যেন তারা চিন্তা-গবেষণা করে’ (নাহল ১৬/৪৪)।
সুতরাং নবী করীম (ছাঃ) তাঁর সুন্নাতের মাধ্যমে মানুষের জন্য নাযিলকৃত আল্লাহর বাণীকে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এটা দ্বারা আবশ্যিকভাবে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তা‘আলা সুন্নাতকে হেফাযত করবেন এবং তা টিকে থাকার নিশ্চয়তা দিবেন। এর আলোকেই উছূলের নিমেণাক্ত সঠিক মূলনীতিটি প্রযোজ্য হবে, ما لا يتم الواجب إلا به فهو واجب ‘যা ব্যতীত ওয়াজিব পূর্ণ হয় না, সেটিও ওয়াজিব’। বান্দাদের ওপর আল্লাহর হুজ্জত প্রতিষ্ঠা হ’তে পারে কেবল তাঁর রিসালত ও শরী‘আতকে হেফাযতের মাধ্যমে। এই হেফাযত সুসম্পন্ন হবে না সুন্নাতের হেফাযত ব্যতীত। সুতরাং এর মাধ্যমে সুন্নাতের হেফাযত আবশ্যক হয়ে যায় এবং সেটি কাম্যও বটে।
প্রিয় পাঠক ভাই! এই বিষয়গুলিই আমি ভূমিকাতে পেশ করতে চেয়েছি। এখন আমি আলোচনার লাগাম ছেড়ে দিচ্ছি আমাদের শ্রদ্ধেয় উস্তাদ আল্লামা মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানীর হাতে। যাতে তিনি তাঁর সুমিষ্ট বর্ণনা ও জ্ঞানগর্ভ স্টাইলের মাধ্যমে আমাদের জন্য পেশ করেন। সুতরাং আমরা পূর্ণ মনোযোগ সহকারে তাঁর কথাগুলি শ্রবণ করি এবং অন্তর ও বুদ্ধিমত্তা সহকারে তাঁর আলোচনা পরখ করি। ওয়াস-সালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।
[চলবে]
[1]. বুখারী, মুসলিম; মিশকাত হা/১৪৫।
[2]. আহমাদ, আবুদাঊদ, তিরমিযী; মিশকাত হা/১৬৫।
[3]. মুক্বাদ্দামা মুসলিম: (বৈরূতঃ দারুল ফিক্র ১৪০৩/১৯৮৩) পৃঃ ১৫।
[4]. শাওকানী, ইরশাদুল ফুহূল, পৃঃ ৪১-৪২ (ঈষৎ পরিবর্তিত)।
[5]. আল-খুযারী, উছূলুল ফিক্বহ, পৃঃ ২১২।
[6]. আল-ইহকাম ১/১১৯-১৩৭।
[7]. অতঃপর আমি দেখেছি যে, খতীব বাগদাদী তাঁর ‘আল-ফাকীহ ওয়াল মুতাফাক্কিহ’ (পৃঃ ৯৬) গ্রন্থে একথা দৃঢ়তার সাথে বলেছেন।
[8]. শাওকানী, ইরশাদুল ফুহূল, পৃঃ ২৯।
[9]. আল-ইহকাম ১/১০৯-১১০।
[10]. সুয়ূত্বী, তাদরীবুর রাবী, পৃঃ ১০২; আহমাদ শাকির, আল-বা‘ইছুল হাছীছ, পৃঃ ৯৫।
[11]. আর-রাওযুল বাসিম ফিয যাবিব আন সুন্নাতে আবিল ক্বাসিম, পৃঃ ৩৩।
[12]. আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১৬৩।