মানুষের মধ্যে যেসব লোক অদৃশ্য ও ভবিষ্যত সম্বন্ধে জ্ঞানের অধিকারী বলে দাবী করে তারা বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন- গণক, ভবিষ্যদ্বক্তা, যাদুকর, ভবিষ্যৎদ্রষ্টা, জ্যোতিষী, হস্তরেখা বিশারদ প্রভৃতি। এসব ভবিষ্যদ্বক্তা নানা পদ্ধতি ও মাধ্যম ব্যবহার করে তথ্যাবলী উপস্থাপন করার দাবী করে থাকে। পদ্ধতিগুলির মধ্যে রয়েছে- চায়ের পাতা পড়া, নানা প্রকার রেখা বা নকশা আঁকা, সংখ্যা লেখা, হাতের তালুর রেখা পড়া, রাশিচক্র খুঁটিয়ে দেখা, স্ফটিক বলের প্রতি স্থির দৃষ্টিপাত করা, হাড় দিয়ে খটর খটর বা ঝনঝন করানো, লাঠি ছোঁড়া ইত্যাদি। আলোচ্য প্রবন্ধে ভাগ্য গণনার নানাবিধ কলা-কৌশল ও এর শারঈ ভিত্তি নিয়ে আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ্।

অদৃশ্য প্রকাশে ও ভবিষ্যদ্বাণী করতে সক্ষম হওয়ার দাবীদার জ্যোতিষীদেরকে প্রধানত দু’ভাগে বিভক্ত করা যায়।

  1. প্রথমতঃ ঐসব জ্যোতিষী যাদের প্রকৃতপক্ষে কোন সত্য জ্ঞান বা গুপ্ত রহস্য জানা নেই; বরং তারা তাদের নিকট আগত লোকদেরকে তাই বলে, যা সাধারণত অধিকাংশ লোকের ক্ষেত্রে সচরাচর ঘটে থাকে। তারা প্রায় সময়ই অর্থহীন কিছু ধর্মীয় কর্মকান্ড সম্পন্ন করার মাধ্যমে পূর্বপরিকল্পিত সাধারণ অনুমান প্রকাশ করে থাকে। কখনো কখনো তাদের কিছু অনুমান অতি সাধারণতার জন্য সত্য হয়ে যায়। অতিসামান্য যে কয়েকটি ভবিষ্যদ্বাণী সত্য বলে প্রকাশ লাভ করে, অধিকাংশ মানুষের মধ্যে সেগুলো মনে রাখার প্রবণতা দেখা যায়; কিন্তু যেগুলো আদৌ সত্য বলে প্রকাশিত হয় না, তার বেশিরভাগই মানুষ খুব দ্রুত ভুলে যায়। প্রকৃত সত্য কথা হচ্ছে, কোন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যদি পুনরায় মনে না পড়ে, তাহ’লে কিছু দিন পরে সকল ভবিষ্যদ্বাণীর অর্ধেকই মানুষ অবচেতনভাবে ভুলে যায়। উদাহরণস্বরূপ, প্রতিটি নতুন বৎসরের শুরুতে আসন্ন বছরে মানুষের জীবনে সংঘটিতব্য ঘটনা সম্পর্কে বিভিন্ন খ্যাতিমান জ্যোতিষীদের নানা রকম ভবিষ্যদ্বাণী প্রকাশ করা উত্তর আমেরিকায় একটা সাধারণ প্রথার রূপ পরিগ্রহ করেছে।** ১৯৮০ সালে প্রচারিত ও প্রকাশিত বিভিন্ন প্রকার ভবিষ্যদ্বাণীর উপর পরিচালিত এক গবেষণা জরিপে দেখা যায়, সবচেয়ে নির্ভুল ভবিষ্যদ্বক্তার ভবিষ্যদ্বাণীর মাত্র ২৪% সঠিক হয়েছিল!
  2. যাদের সঙ্গে জিনের সখ্যতা ও যোগাযোগ এবং বিভিন্ন ধরনের অপজ্ঞান রয়েছে, তারা এ দ্বিতীয় শ্রেণীর দলভুক্ত।
  1. এ দলটির গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি, কারণ এরা শিরকের মত বৃহত্তর ও জঘন্যতম গুনাহের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ কাজে জড়িতদের উপস্থাপিত তথ্যাবলী সাধারণত কিছুটা নির্ভুল হয়, যা মুসলিম ও অমুসলিম উভয়ের জন্য বড় ধরনের ফিৎনার কারণ।

জিনের জগৎ

‘জিন’ সম্পর্কে কুরআনে সম্পূর্ণ একটি সূরা অবতীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও কিছু কিছু লোক জিনের অস্তিত্বকে অস্বীকার করার চেষ্টা করেছে। ক্রিয়াপদ ‘জান্না’, ‘ইয়াজুন্ন’ হ’তে উৎপন্ন হওয়া ‘জিন’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থের ভিত্তিতে তারা দাবী করে, জিন হচ্ছে ‘চতুর ভিনদেশী’ বা ‘ভিন্ন জাতের প্রাণী’। আবার অনেকে এমনও দাবী করেন যে, জিন হচ্ছে স্বভাবে অগ্নিময় এমন ধরনের মানুষ যার মস্তিষ্কে অন্তরের উপস্থিতি নেই। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এ পৃথিবীতে মানুষের সঙ্গে সহাবস্থানকারী আল্লাহর অপর এক সৃষ্টি হ’ল জিন জাতি। মানব জাতি সৃষ্টির পূর্বেই আল্লাহ্ তা‘আলা জিন জাতি সৃষ্টি করেন। মানব সৃষ্টির উপাদান হ’তে ভিন্নতর উপাদানের সমষ্টিতে আল্লাহ তা‘আলা জিন জাতি সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْأِنْسَانَ مِنْ صَلْصَالٍ مِنْ حَمَأٍ مَسْنُوْنٍ- وَالْجَانَّ خَلَقْنَاهُ مِنْ قَبْلُ مِنْ نَارِ السَّمُوْمِ-

‘পচা কর্দমের বিশুষ্ক ঠনঠনে মাটি থেকে আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি। এর পূর্বে আমি জিনকে আগুনের লেলিহান শিখা থেকে সৃষ্টি করেছি’ (হিজর ১৫/২৬-২৭)

লোকচক্ষুর আড়ালে থাকার কারণে তাদেরকে জিন নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আল্লাহ্ তা‘আলা আদমকে সিজদা করার হুকুম দানকালে ফিরিশতাদের মাঝে অবস্থান করা সত্ত্বেও ইবলীস (জিন জাতির অন্তর্ভুক্ত) সিজদা করতে অস্বীকার করলে তাকে এ অবাধ্যতার কারণ জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। এ ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, قَالَ أَنَا خَيْرٌ مِنْهُ خَلَقْتَنِيْ مِنْ نَارٍ وَخَلَقْتَهُ مِنْ طِيْنٍ ‘সে বলল, আমি তার চেয়ে উত্তম, আপনি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন আর তাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে’ (ছোয়াদ ৩৮/৭৬)

আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘ফিরিশতাদেরকে নূর (আলো) হ’তে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং জিনদেরকে করা হয়েছে আগুন হ’তে’।[1]

আল্লাহ্ তা‘আলা আরও বলেন,

وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلائِكَةِ اسْجُدُوْا لِاٰدَمَ فَسَجَدُوْا إِلَّا إِبْلِيْسَ كَانَ مِنَ الْجِنِّ... -

‘স্মরণ কর, যখন আমি ফিরিশতাদেরকে বলেছিলাম, আদমকে সিজদা কর। তখন ইবলীস ছাড়া তারা সবাই সিজদা করল। সে ছিল জিনদের অন্তর্ভুক্ত...’ (কাহফ ১৮/৫০)। তাই ইবলীসকে পদস্খলিত ফিরিশতা মনে করা ভুল।

জিনদের অস্তিত্বের ধরন অনুযায়ী এদেরকে সাধারণত তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তিন শ্রেণীর জিন রয়েছে। এক প্রকার জিন সারাক্ষণ আকাশে উড়ে বেড়ায়, দ্বিতীয় প্রকার জ্বিনেরা সাপ ও কুকুর হিসাবে বিদ্যমান, তৃতীয় প্রকার জিন পৃথিবী অভিমুখে অগ্রসরমান তথা পৃথিবীতে অবস্থান করে এবং এরা এক জায়গায় বসবাস করা সত্ত্বেও এখানে সেখানে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাফেরা করে।[2]

জিনজাতির বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে তাদেরকে দু’শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে। মুসলিম (আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাসী) এবং কাফির (আল্লাহর অস্তিত্বে অবিশ্বাসী)। আল্লাহ্ তা‘আলা মুসলিম জিনদের সম্পর্কে বলেন,

قُلْ أُوحِيَ إِلَيَّ أَنَّهُ اسْتَمَعَ نَفَرٌ مِنَ الْجِنِّ فَقَالُوْا إِنَّا سَمِعْنَا قُرْاٰناً عَجَباً- يَهْدِيْ إِلَى الرُّشْدِ فَاٰمَنَّا بِهِ وَلَنْ نُشْرِكَ بِرَبِّنَا أَحَداً- وَأَنَّهُ تَعَالَى جَدُّ رَبِّنَا مَا اتَّخَذَ صَاحِبَةً وَلاَ وَلَداً- وَأَنَّهُ كَانَ يَقُوْلُ سَفِيْهُنَا عَلَى اللهِ شَطَطاً-

‘বল, আমার কাছে অহী করা হয়েছে যে, জিনদের একটি দল মনোযোগ দিয়ে (কুরআন) শুনেছে অতঃপর তারা বলেছে, আমরা এক অতি আশ্চর্যজনক কুরআন শুনেছি যা সত্য-সঠিক পথ প্রদর্শন করে, যার কারণে আমরা তাতে ঈমান এনেছি, আমরা কখনও কাউকে আমাদের প্রতিপালকের অংশীদার গণ্য করব না। আর আমাদের প্রতিপালকের মর্যাদা অতি উচ্চ। তিনি গ্রহণ করেননি কোন স্ত্রী ও কোন সন্তান। আর আমাদের মধ্যেকার নির্বোধেরা তাঁর সম্পর্কে সীমাতিরিক্ত কথাবার্তা বলত’ (জিন ৭২/১-৪)

অন্যত্র আল্লাহ বলেন,

وَأَنَّا مِنَّا الْمُسْلِمُوْنَ وَمِنَّا الْقَاسِطُوْنَ فَمَنْ أَسْلَمَ فَأُولَئِكَ تَحَرَّوْا رَشَداً- وَأَمَّا الْقَاسِطُوْنَ فَكَانُوْا لِجَهَنَّمَ حَطَباً-

‘আমাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক (আল্লাহর প্রতি) আত্মসমর্পণকারী আর কিছু সংখ্যক অন্যায়কারী। যারা আত্মসমর্পণ করে তারা সঠিক পথ বেছে নিয়েছে। আর যারা অন্যায়কারী তারা জাহান্নামের ইন্ধন’ (জিন ৭২/১৪-১৫)

কাফির (অবিশ্বাসী) জিনদেরকে বিভিন্ন নামে আরবীতে ও বাংলাতে উল্লেখ করা হয়: ইফরীত, শয়তান, ক্বারীন, দৈত্য, পিশাচ, অপদেবতা, ভূত, পেত্নী, প্রেতাত্মা ইত্যাদি। এরা নানাভাবে মানুষকে ভ্রান্তপথে পরিচালিত করার আপ্রাণ চেষ্টা-সাধনা করে থাকে। যে কেউ তাদের প্রতি কর্ণপাত করে, সে-ই তাদের কর্মী হিসাবে মানবীয় শয়তান রূপে পরিগণিত হয়।

এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন।

وَكَذَالِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوّاً شَيَاطِيْنَ الْأِنْسِ وَالْجِنِّ...

‘এভাবে আমি প্রত্যেক নবীর জন্য মানুষ আর জিন শয়তানদের মধ্য হ’তে শত্রু বানিয়ে দিয়েছি...’ (জিন ৬/১১২)

প্রতিটি মানুষের সঙ্গে ক্বারীন (সঙ্গী) নামক একজন জিন রয়েছে। এটা এ জীবনে মানুষের পরীক্ষার অন্যতম এক গুরুত্বপূর্ণ দিক ব্যতীত কিছুই নয়। এ জিনটি তাকে নিচু প্রকৃতির কামনা-বাসনার প্রতি অবিরত উৎসাহিত করে এবং সরল-সত্য পথ থেকে বিচ্যুত করার প্রচেষ্টায় রত থাকে। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন যে, ‘জিনদের মধ্য হ’তে একজন করে সাথী তোমাদের প্রত্যেকের সঙ্গে যুক্ত করে দেয়া হয়েছে। ছাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, এমনকি আপনার সাথেও, হে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)! তিনি উত্তরে বলেন, হ্যাঁ, আমার সাথেও। কিন্তু ব্যতিক্রম হচ্ছে যে, আল্লাহ তা‘আলা আমাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করেছেন এবং সে আনুগত্য স্বীকার করেছে। তাই সে আমাকে শুধু সৎকাজ করতে বলে’।[3]

সুলায়মান (আঃ)-কে নবুঅতের নিদর্শন স্বরূপ জিনদের নিয়ন্ত্রণ করার মত অলৌকিক ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছিল। আল্লাহ বলেন,

وَحُشِرَ لِسُلَيْمَانَ جُنُوْدُهُ مِنَ الْجِنِّ وَالْأِنْسِ وَالطَّيْرِ فَهُمْ يُوْزَعُوْنَ-

‘সুলায়মানের সামনে তাঁর সেনাবাহিনীকে সমবেত করা হ’ল, জিন, মানুষ ও পক্ষীকুলকে; অতঃপর তাদেরকে বিভিন্ন ব্যুহে বিন্যস্ত করা হ’ল’ (নামল ২৭/১৭)

কিন্তু অন্য কাউকে এ ক্ষমতা দেয়া হয়নি। জিনদেরকে নিয়ন্ত্রণ করার অনুমতি কাউকে প্রদান করা হয়নি। তাছাড়া কেউ তা পারেও না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আমার ছালাত ভাঙ্গার জন্য গতরাতে জিনদের মধ্য হ’তে এক ইফরীত[4] থু থু নিক্ষেপ করেছিল। তবে তার উপরে বিজয়ী হ’তে আল্লাহ আমাকে সাহায্য করেছেন। সকালে তোমাদের সবাইকে দেখানোর জন্য আমি তাকে মসজিদের একটি খুঁটির সাথে বাঁধতে চেয়েছিলাম। তারপর আমার ভাই সুলায়মানের দো‘আ মনে পড়ল,

رَبِّ اغْفِرْ لِي وَهَبْ لِيْ مُلْكاً لا يَنْبَغِيْ لِأَحَدٍ مِنْ بَعْدِيْ إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ-

‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে ক্ষমা কর, আর আমাকে এমন রাজ্য দান কর, যা আমার পরে আর কারো জন্য শোভনীয় হবে না। তুমি হ’লে পরম দাতা...’ (ছোয়াদ ৩৮/৩৫)[5]

মানুষ জিনদের নিয়ন্ত্রণ করতে অক্ষম। কেননা এ বিশেষ অলৌকিক ক্ষমতা কেবল সুলায়মান (আঃ)-কে প্রদান করা হয়েছিল। এমতাবস্থায় আছর বা আকস্মিক ঘটনা ব্যতীত অধিকাংশ সময় জিনদের সঙ্গে যোগাযোগ সাধারণত ধর্মদ্রোহী ও নিষিদ্ধ কর্মকান্ড সম্পাদনের মাধ্যমে করা হয়।[6] এভাবে উপস্থিত করা বা ডাকায় জ্বিনেরা তাদের সাথীদেরকে পাপকাজে লিপ্ত হ’তে ও স্রষ্টায় অবিশ্বাস করতে সাহায্য করতে পারে। আল্লাহর সাথে শরীক করার মত জঘন্য পাপকর্মে লিপ্ত করতে যত বেশি সম্ভব মানুষকে আকৃষ্ট করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য।

জিনদের সাথে গণকদের একবার যোগাযোগ ও চুক্তি সম্পন্ন হ’লে ভবিষ্যতে ঘটবে এমন কিছু ঘটনা সম্পর্কে জিন তার অনুসারী গণকদেরকে জানাতে পারে। ভবিষ্যতে ঘটবে এমন সব ঘটনার সংবাদ জিনেরা কিভাবে সংগ্রহ করে সে সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, জিনেরা প্রথম আসমানের নিম্নাংশ পর্যন্ত পৌঁছতে এবং ভবিষ্যতে ঘটবে এমন সব ঘটনাবলী সম্পর্কে ফিরিশতারা পরষ্পর যে আলোচনা করে তা শুনতে সক্ষম। তারপর তারা পৃথিবীতে ফিরে এসে শ্রবণকৃত সংবাদগুলো তাদের সেই চুক্তিকৃত বন্ধুদের নিকটে পরিবেশন করে।[7] মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর নবুঅত প্রাপ্তির পূর্বে এ ধরনের অনেক ঘটনা সংঘটিত হ’ত এবং গণকরাও তথ্য প্রকাশে অনেকাংশে নির্ভুল ছিল। তারা রাজকীয় আদালতে আসীন হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করার পাশাপাশি প্রচুর জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। এমনকি পৃথিবীর কিছু কিছু দেশে তাদের পূজা-অর্চনাও করা হ’ত।

রাসূল (ছাঃ)-এর উপরে কুরআন নাযিল হওয়ার সময় হ’তেই এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। আসমানের নীচের অংশে পাহারা দেবার জন্য ফিরিশতাদেরকে নিযুক্ত করা হয় এবং বেশিরভাগ জিনকে উল্কা ও ধাবমান নক্ষত্র দিয়ে তাড়ানো হয়। এক জিন কর্তৃক বর্ণিত বিস্ময়কর ঘটনাটি আল্লাহ্ তা‘আলা কুরআনের ভাষায় উল্লেখ করেছেন,

وَأَنَّا لَمَسْنَا السَّمَاءَ فَوَجَدْنَاهَا مُلِئَتْ حَرْساً شَدِيْداً وَشُهُبًا- وَأَنَّا كُنَّا نَقْعُدُ مِنْهَا مَقَاعِدَ لِلسَّمْعِ فَمَنْ يَسْتَمِعِ الْآنَ يَجِدْ لَهُ شِهَاباً رَصَدًا-

‘আর আমরা আকাশের খবর নিতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমরা সেটাকে পেলাম কঠোর প্রহরী বেষ্টিত ও জ্বলন্ত উল্কাপিন্ডে পরিপূর্ণ। আমরা (আগে) সংবাদ শুনার জন্য আকাশের বিভিন্ন ঘাঁটিতে বসতাম, কিন্তু এখন কেউ সংবাদ শুনতে চাইলে তার উপর নিক্ষেপের জন্য সে জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডকে লুকিয়ে থাকতে দেখে’ (জিন ৭২/৮-৯)

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

وَحَفِظْنَاهَا مِنْ كُلِّ شَيْطَانٍ رَجِيْمٍ - إِلَّا مَنِ اسْتَرَقَ السَّمْعَ فَأَتْبَعَهُ شِهَابٌ مُبِيْنٌ-

‘আর প্রত্যেক অভিশপ্ত শয়তান থেকে সেগুলোকে সুরক্ষিত করে দিয়েছি। কিন্তু কেউ চুরি করে (খবর) শুনতে চাইলে উজ্জ্বল অগ্নিশিখা তার পশ্চাদ্ধাবণ করে’ (হিজ্র ১৫/১৭-১৮)।

ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) এবং তাঁর একদল ছাহাবী উকায বাজারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করলে আসমান থেকে ইলাহী সংবাদ শ্রবণে শয়তানরা বাধাগ্রস্ত হ’ল।[8] তাদের প্রতি উল্কাপিন্ড নিক্ষিপ্ত হ’ল। তাই তারা ফিরে এল তাদের লোকজনের নিকটে। তাদের লোকেরা ফিরে আসার কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা সংঘটিত ঘটনা বলল। কেউ কেউ বলল, নিশ্চয়ই কিছু একটা ঘটেছে; ফলে তারা কারণ উদঘাটনে পৃথিবীর চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল। তাদের মধ্যে কয়েকজন রাসূল (ছাঃ) এবং তাঁর ছাহাবীদেরকে ছালাতরত অবস্থায় দেখতে পেয়ে কুরআন তেলাওয়াত শ্রবণ করল। এমতাবস্থায় তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করল যে, নিশ্চয়ই এটাই তাদেরকে আসমানী সংবাদ শ্রবণ থেকে বাধা দান করেছে। তখন তারা তাদের লোকজনের নিকটে ফিরে গিয়ে বলল,

قُلْ أُوحِيَ إِلَيَّ أَنَّهُ اسْتَمَعَ نَفَرٌ مِنَ الْجِنِّ فَقَالُوا إِنَّا سَمِعْنَا قُرْآناً عَجَباً- يَهْدِيْ إِلَى الرُّشْدِ فَآمَنَّا بِهِ وَلَنْ نُشْرِكَ بِرَبِّنَا أَحَدًا-

‘আমরা এক অতি আশ্চর্যজনক কুরআন শুনেছি যা সত্য-সঠিক পথ প্রদর্শন করে, যার কারণে আমরা তাতে ঈমান এনেছি। আমরা কখনো কাউকে আমাদের প্রতিপালকের অংশীদার গণ্য করব না’ (জিন ৭২/১-২)[9]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কর্তৃক ইসলাম প্রচারের পূর্বে জিনেরা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বিভিন্ন সংবাদ সংগ্রহ করতে সক্ষম হ’লেও পরবর্তীতে তা আর পারেনি। এ কারণে তারা তাদের সংবাদের সংগে অনেক মিথ্যা মিশ্রিত করে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘জিনেরা সংবাদ পাঠাতেই থাকবে যতক্ষণ না এটা যাদুকর বা গণক পর্যন্ত পৌঁছে। মাঝে মাঝে সংবাদ পাঠানোর পূর্বেই একটি উল্কাপিন্ড আঘাত করবে। আর উল্কাপিন্ড দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার পূর্বেই যদি সংবাদটি পাঠাতে সক্ষম হয়, তাহ’লে এর সঙ্গে একশ’টা মিথ্যা যোগ করে পাঠাবে’।[10]

আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে গণকদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘এরা কিছুই না’। তারপর গণকদের কথা মাঝে মাঝে সত্য হওয়ার ব্যাপারে আয়েশা (রাঃ) উল্লেখ করলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘এটা সত্য সংবাদের একটি অংশবিশেষ যা জিনেরা চুরি করে এবং এ তথ্যের সঙ্গে একশ’টি মিথ্যা যুক্ত করে তার বন্ধুর কাছে প্রকাশ করে’।[11]

ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) একদিন বসেছিলেন, এমন সময় এক সুদর্শন লোক[12] তাঁর পাশ দিয়ে চলে গেল। ওমর (রাঃ) বললেন, ‘আমার যদি ভুল না হয়, লোকটি এখনও প্রাক-ইসলামী বিশ্বাসের অনুসরণকারী অথবা সম্ভবত সে তাদের মধ্যে যেসব গণক রয়েছে তার অন্তর্ভুক্ত। ওমর (রাঃ) লোকটিকে তাঁর নিকটে আনার জন্য আদেশ করলেন এবং তিনি তাঁর অনুমানের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন। লোকটা উত্তর দিল, একজন মুসলিমকে আজ এমন এক অভিযোগের সম্মুখীন হ’তে হচ্ছে, যা আমি আর কখনও দেখিনি। ওমর (রাঃ) বললেন, নিশ্চয়ই আমাকে এ ব্যাপারে জানানো তোমার দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। তারপর লোকটি বলল, জাহেলী যুগে আমি তাদের ভবিষ্যৎ-গণনাকারী ছিলাম। এ কথা শুনে ওমর (রাঃ) বললেন, সবচেয়ে বিস্ময়কর যে বিষয়টি তোমার পরী (নারী জিন) তোমাকে বলেছে তা আমাকে বল। লোকটি তখন বলল, আমি একদিন বাজারে থাকাবস্থায় সে উদ্বিগ্ন হয়ে আমার নিকটে আগমন করে বলল, ‘অপমান হওয়ার পর হতাশাগ্রস্ত অবস্থায় তুমি কি জিনদের দেখতে পাওনি? আর তাদেরকে (জিনদেরকে) এমন অবস্থায় দেখতে পাওনি যে, তারা মাদী উট ও এদের পিঠে আরোহণকারীদের অনুসরণ করছে? ওমর (রাঃ) মন্তব্য করে বললেন, ‘হ্যাঁ, এটা সত্য’।[13]

জিনদের সাথে যোগাযোগকারী মানুষকে অর্থাৎ জিনদের সাহায্যে যেসব ভবিষ্যদ্বক্তারা ভবিষ্যদ্বাণী করেন, তাদেরকে জিনেরা অতি নিকট-ভবিষ্যত সম্পর্কে জানাতে সক্ষম। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ভবিষ্যদ্বক্তার নিকটে কেউ গমন করলে, উপস্থিত ব্যক্তিটি গণকের নিকটে আসার পূর্বে কী কী পরিকল্পনা তৈরি করেছিল তা গণকের জিন আগত ব্যক্তির সাথী জিনের (ক্বারীন)[14] নিকট থেকে অবগত হয়। ফলে আগত ব্যক্তিটি কী কী করবে বা কোথায় কোথায় যাবে তা জানাতে গণক সক্ষম হয়। আর এভাবেই একজন গণক বা ভবিষ্যদ্বক্তা আগন্তুক ব্যক্তির অতীত সম্পূর্ণভাবে জানতে পারে। সেই গণক সবিস্তারে বলতে সক্ষম হয়, আগন্তুকের পিতা-মাতার নাম, জন্মস্থান এবং ছোটবেলার কর্মকান্ড সম্পর্কে। জিনের সাথে যোগাযোগ রয়েছে এমন একজন ভবিষ্যদ্বক্তার আলামত হচ্ছে যে, সে বিস্তারিতভাবে অতীতের বর্ণনা দিতে পারবে। কারণ মুহূর্তের মধ্যেই বিশাল ব্যবধানের দূরত্ব অতিক্রম করা, গোপনীয় বিষয় বা ঘটনা, হারানো দ্রব্য, অদৃষ্ট ঘটনাবলী সম্পর্কে অনেক তথ্য সংগ্রহ ও সরবরাহ করা জিনের সাধারণ একটি বৈশিষ্ট্য। এ ক্ষমতার সত্যতা আমরা নবী সুলায়মান (আঃ) এবং সাবার রাণী বিলকীস সম্পর্কে কুরআনের বিবরণে দেখতে পাই। সুলায়মান (আঃ)-কে রাণী বিলকীস দেখতে আসলে, রাণীর দেশ থেকে তার সিংহাসন নিয়ে আসতে তিনি (সুলায়মান) উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে নির্দেশ প্রদান করলেন এবং তৎক্ষণাৎ সেখানে উপস্থিত মানুষ, জিনসহ অন্যদের মধ্যে, একজন বলল,

قَالَ عِفْرِيْتٌ مِنَ الْجِنِّ أَنَا آتِيْكَ بِهِ قَبْلَ أَنْ تَقُوْمَ مِنْ مَقَامِكَ وَإِنِّي عَلَيْهِ لَقَوِيٌّ أَمِيْنٌ-

‘এক শক্তিধর জিন বলল, আপনি আপনার জায়গা থেকে উঠবার আগেই আমি তা আপনার কাছে এনে দেব, এ কাজে আমি অবশ্যই ক্ষমতার অধিকারী ও আস্থাভাজন’ (নামল ২৭/ ৩৯)

ভাগ্য গণনা সম্পর্কে ইসলামের বিধান

তাওহীদ বিরুদ্ধ শিরকী ও কুফরী বিশ্বাস জড়িত থাকার কারণে ইসলাম ভাগ্য গণনার প্রতি কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে। ভাগ্য গণনায় লিপ্তদেরকে এ নিষিদ্ধ চর্চা ত্যাগ করতে উপদেশ দান ছাড়াও ইসলাম তাদের সঙ্গে যে কোন ধরনের সম্পৃক্ততার বিরোধিতা করে।

গণকের নিকটে গমন করা

গণকের যে কোন ধরনের দর্শনের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সুস্পষ্টভাবে নীতি নির্ধারণ করেছেন। হাফছা (রাঃ) থেকে ছাফিয়া বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যদি কেউ কোন গণক, গায়বী বিষয়ের সংবাদদাতা বা ভবিষ্যদ্বক্তার নিকট গমন করে তাকে কিছু জিজ্ঞেস করে তবে ৪০ দিবস পর্যন্ত তার ছালাত কবুল করা হবে না’।[15]

এ হাদীছে বর্ণিত শাস্তি শুধু গণকের নিকটে গমন করে কৌতুহল বশতঃ তাকে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার জন্য। এ নিষিদ্ধতা আরও সমর্থিত হয়েছে মু‘আবিয়া ইবনে আল-হাকাম আস-সুলামী বর্ণিত হাদীছ দ্বারা। এ হাদীছে মু‘আবিয়া (রাঃ) বলেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! নিশ্চয়ই আমাদের মধ্যে এমন কিছু লোক রয়েছে, যারা গণকের নিকটে যায়। রাসূল (ছাঃ) উত্তর দিলেন, ‘তাদের কাছে যাবে না’।[16]

এ ধরনের কঠিন শাস্তির বিধান নির্দিষ্ট করা হয়েছে কেবল গণকের নিকট গমনের জন্য। কারণ ভবিষ্যদ্বাণী বিশ্বাস করার ক্ষেত্রে এটাই প্রথম পর্যায়। যদি কেউ ভবিষ্যদ্বাণীর বাস্তবতায় দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে গণকের নিকট গমন করে, আর গণকের কোন ভবিষ্যদ্বাণী সত্যরূপে পরিগণিত হয়, তাহ’লে নিশ্চিতভাবেই সে গণকের গোঁড়া সমর্থক ও ভবিষ্যদ্বাণীর প্রতি উৎসাহী ও বিশ্বাসী হবে।

গণকের নিকটে গমন করা সত্ত্বেও কোন ব্যক্তি উক্ত চল্লিশ দিনের বাধ্যতামূলক ছালাত আদায় করতে বাধ্য, যদিও ঐ ছালাতের জন্য সে কোন প্রকার পুরস্কার পাবে না। আর সে যদি সকল ছালাত পরিত্যাগ করে, তাহ’লে তো সে আরও একটি গুরুতর গুনাহ করল। চুরিকৃত সম্পদের উপরে বা ভিতরে ছালাত আদায় করা সম্পর্কে ইসলামের বিধান অধিকাংশ ইসলামী ফিকহবিদের মতে একই। তারা সবাই এ মত পোষণ করেন যে, ফরয ছালাত আদায় করলে সাধারণত তা দু’ধরনের ফলাফল বহন করে: ১. উক্ত ব্যক্তির উপর ঐ ছালাত আদায়ের ব্যাপারে বাধ্যবাধকতা থাকে না। ২. তার জন্য পুরস্কার অর্জিত হয়।

চুরিকৃত সম্পদের উপরে বা ভিতরে ছালাত আদায় করলে ছালাত আদায়ের বাধ্যবাধকতা অবশিষ্ট না থাকা সত্ত্বেও যে কোন ব্যক্তি এজন্য কোন পুরস্কার পেতে পারে না।[17]

গণকের প্রতি বিশ্বাস

অদৃশ্য ও ভবিষ্যতে কী ঘটবে সে সম্বন্ধে গণক ওয়াকিফহাল এ বিশ্বাসে গণকের নিকটে গমন করা কুফরী কাজ।

আবূ হুরায়রা এবং আল-হাসান উভয়ে বর্ণনা করেন যে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যদি কেউ কোন গণক বা ভবিষ্যদ্বক্তার নিকট গমন করে তার কথা বিশ্বাস করে, তবে সে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উপর অবতীর্ণ দ্বীনের প্রতি কুফরী করল’।[18]

এ ধরনের বিশ্বাস দ্বারা অদৃশ্য ও ভবিষ্যৎ বিষয়াদি সম্পর্কে আল্লাহর জ্ঞান রাখার মত গুণাবলীকে তাঁর সৃষ্টির প্রতি আরোপিত হয়। ফলস্বরূপ তাওহীদুল আসমা ওয়াছ-ছিফাত ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং এক্ষেত্রে শিরকের সূচনা হয়। অর্থাৎ কেউ কোন জ্যোতিষী, গণক, রাশিবিদ, পীর, ফকীর, সাধু- দরবেশ ইত্যাদি গোপন জ্ঞানের দাবীদারকে গায়বী বা গোপন জ্ঞানের অধিকারী বলে বিশ্বাস করলে শিরক আকবার (বড় শিরক) সংঘটিত হবে। 

গণকদের লেখা বই, পত্র-পত্রিকা বা গবেষণা-পত্র পড়া এবং তাদের অনুষ্ঠান রেডিওতে শ্রবণ করা বা টিভিতে দেখা ইত্যাদির মধ্যে সাদৃশ্য বিদ্যমান থাকায় এসব কর্মকান্ড কুফরীর অন্তর্ভুক্ত। কারণ ভবিষ্যদ্বক্তারা তাদের ভবিষ্যদ্বাণী প্রচার ও প্রসারে বিংশ শতাব্দীতে এ মাধ্যমগুলোকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করছে। আল্লাহ তা‘আলা পরিষ্কারভাবে কুরআনে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি ব্যতীত অন্য কেউই অদৃশ্য সম্পর্কে জ্ঞান রাখে না, এমনকি রাসূলও না।

وَعِنْدَهُ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لا يَعْلَمُهَا إِلَّا هُوَ-...

‘সমস্ত গায়বের চাবিকাঠি তাঁর কাছে, তিনি ছাড়া আর কেউ তা জানে না...’ (আন‘আম ৬/৫৯)

তারপর তিনি রাসূল (ছাঃ)-কে বলেন,

قُلْ لاَ أَمْلِكُ لِنَفْسِيْ نَفْعاً وَلا ضَرّاً إِلَّا مَا شَاءَ اللَّهُ وَلَوْ كُنْتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لَاسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوءُ... -

‘বল, আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তাছাড়া আমার নিজের ভাল বা মন্দ করার কোন ক্ষমতা নেই। আমি যদি অদৃশ্যের খবর জানতাম তাহ’লে নিজের জন্য অনেক বেশি ফায়দা হাছিল করতাম, এবং কোন প্রকার অকল্যাণই আমাকে স্পর্শ করত না...’ (আ‘রাফ ৭/১৮৮)

আল্লাহ্ তা‘আলা আরও বলেন,

قُلْ لاَ يَعْلَمُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ الْغَيْبَ إِلَّا اللَّهُ... -

‘আকাশ ও পৃথিবীতে যারা আছে তারা কেউই অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান রাখে না আল্লাহ্ ছাড়া...’ (নামল ২৭/৬৫)

অতএব ভবিষ্যদ্বক্তা, গণক এবং অনুরূপ ব্যক্তি কর্তৃক ব্যবহৃত নানা রকম পন্থা বা পদ্ধতি সমূহ মুসলিমদের জন্য নিষিদ্ধ। হস্তরেখা গণনা, ভাগ্য গণনার মাধ্যম আই চিং, সাফল্যের বিস্কুট বা কেক ও চায়ের পাতার পাশাপাশি রাশিচক্র ও 'Bio-rhythm' নামক কম্পিউটার প্রোগ্রাম- এগুলোতে বিশ্বাস স্থাপনকারী লোকজনের দাবী অনুযায়ী, এসব উপায়সমূহ তাদের ভবিষ্যৎ সংক্রান্ত তথ্যাদি জানাতে পারে। অথচ আল্লাহ তা‘আলা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন যে, একমাত্র তিনিই অদৃশ্য ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন। তিনি বলেন,

إِنَّ اللهَ عِنْدَهُ عِلْمُ السَّاعَةِ وَيُنَزِّلُ الْغَيْثَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْأَرْحَامِ وَمَا تَدْرِيْ نَفْسٌ مَاذَا تَكْسِبُ غَداً وَمَا تَدْرِيْ نَفْسٌ بِأَيِّ أَرْضٍ تَمُوْتُ إِنَّ اللهَ عَلِيْمٌ خَبِيْرٌ-

‘ক্বিয়ামাতের জ্ঞান কেবল আল্লাহর নিকটই আছে, তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন, (মায়ের) রেহেমে কী আছে তা তিনিই জানেন। কেউ জানে না আগামীকাল সে কী অর্জন করবে, কেউ জানে না কোন্ জায়গায় তার মৃত্যু ঘটবে। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্বাধিক অবহিত’ (লুক্বমান ৩১/৩৪)। 

ফলে মুসলিমদের অবশ্যই বই-পুস্তক, পত্রিকা, সংবাদপত্র ইত্যাদির পাশাপাশি বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে সেসব লোকদের ব্যাপারে, যারা বিভিন্ন উপায়ে দাবী করে যে তারা ভবিষ্যৎ ও অদৃশ্য বিষয়ে জ্ঞান রাখেন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে হকের উপর অটল থাকার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!

মূল: আবূ আমীনাহ বেলাল ফিলিপস্

বাড্ডা, গুলশান, ঢাকা।

ভাষান্তর: ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মাদ হাসান

** কেবল উত্তর আমেরিকাতেই নয় বরং বাংলাদেশ সহ সারাবিশ্বের প্রায় সকল দেশের জ্যোতিষীরা নতুন বছরের আগমনকে কেন্দ্র করে এ ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী প্রকাশ করে থাকে। -অনুবাদক

[1]. ছহীহ মুসলিম হা/৭১৩৪।

[2]. আত-ত্বাবারী ও আল-হাকিম।

[3]. ছহীহ মুসলিম হা/৬৭৫৭।

[4]. খুব শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান শয়ত্বান জিন (E.W. Lane, Arabic-English Lexicon, (Cambridge, England: Islamic Texts Society, 1984), Vol. 2, p. 2089.

[5]. বুখারী ৭৫; মুসলিম, হা/১১০৪।

[6]. আবূ আমীনাহ বিলাল ফিলিপ্স, জিন সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়ার রচনা, (ঢাকা: তাওহীদ পাবলিকেশন, ১৯৮৯), পৃ. ২১।

[7]. বুখারী; মুসলিম হা/৫৫৩৮।

[8]. মূলত: এ দিন বা এ সময় থেকে শয়তানদেরকে ইলাহী খবরাখবর শোনায় বাধা প্রদান এবং তাদের উপর উল্কাপিন্ড নিক্ষেপ করা শুরু হয়নি। বরং তা এর আগে থেকেই শুরু করা হচ্ছিল। হয়তো শয়তানরা এর কারণ এ ঘটনার মাধ্যমে এ সময়ে জানতে পেরেছে মাত্র। কারণ এ সম্পর্কিত যেসব শব্দ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, তা অতীত নির্দেশক। দ্র: ছহীহ বুখারী, ২য় খন্ড, পৃঃ ৭৩২।

[9]. বুখারী হা/৪৪৩; মুসলিম হা/৯০৮; তিরমিযী, আহমাদ।

[10]. বুখারী হা/২৩২; তিরমিযী।

[11]. বুখারী হা/৬৫৭; মুসলিম হা/৫৫৩৫।

[12]. তার নাম হল, সাওয়াদ ইবনে ক্বারিব।

[13]. বুখারী হা/২০৬।

[14]. যে জিন প্রতিটি মানুষের সাথে সর্বদা অবস্থান করে।

[15]. মুসলিম হা/৫৫৪০।

[16]. মুসলিম হা/৫৫৩২।

[17]. নববী তাইসীর আল-আযীয আল-হামীদ, পৃ. ৪০৭।

[18]. সুনান আবি দাঊদ হা/৩৮৯৫; আহমাদ, আল-মুসনাদ, ২/৪২৯ পৃঃ; বায়হাক্বী; আলবানী, ছহীহুত তারগীব, ৩/৯৭-৯৮।






জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপনের আবশ্যকতা (৫ম কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
গীবত থেকে বাঁচার উপায় - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
ইসলামের আলোকে জ্ঞান চর্চা (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - ড. মুহাম্মাদ আজিবার রহমান
অভ্যাসগত বিশ্বাস থেকে চিন্তাশীল বিশ্বাসের পথে যাত্রা - মুহাম্মাদ আনওয়ারুল কারীম
আল্লাহর প্রতি ঈমানের স্বরূপ (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
সীমালংঘন ও দুনিয়াপূজা : জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হওয়ার দুই প্রধান কারণ (২য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
বাজারের আদব সমূহ - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
মুনাফিকী (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
নেতৃত্বের মোহ (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময় - রফীক আহমাদ - বিরামপুর, দিনাজপুর
আক্বীদা ও আহকামে হাদীছের প্রামাণ্যতা (৩য় কিস্তি) - মীযানুর রহমান মাদানী
ফৎওয়া : গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা ও বিকাশ (৩য় কিস্তি) - ড. শিহাবুদ্দীন আহমাদ, শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, রাজশাহী
আরও
আরও
.