(১)
১৭৯৯ সালে ফরাসী বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। এ বিপ্লবের পেছনে দু’টি সামাজিক উপাদান বড় প্রভাব ফেলেছিল। এর মধ্যে সামাজিক মূল্যবোধ ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ফরাসী সমাজ ও রাষ্ট্র এ সময় নীতিহীনতায় জর্জরিত হয়ে পড়েছিল। সামাজিক বৈষম্যের কারণে দেশে দারিদ্র্য বেড়ে গিয়েছিল। ফলে সমাজে অস্থিরতা মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল। সমাজ থেকে মূল্যবোধ হারিয়ে গিয়েছিল। সময়ের ব্যবধানে সমাজের মুক্তিকামী জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন। তারা নীতিহীনতার বিরুদ্ধে আপোষহীন ভূমিকা প্রদর্শন করেছিলেন। মূল্যবোধ উপাদানটি ঐ সময় ফরাসী সমাজে আপোষহীনতায় রূপান্তরিত হয়েছিল। ফলে ১৭৮৯ সালে সূচিত হওয়া বিপ্লব ১৭৯৯ সালে চূড়ান্তরূপ লাভ করেছিল।
একই সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশে এ মূল্যবোধের যথেষ্ট চর্চা ছিল। প্রাচীন ভারতে বহু ধর্মের লোক এক সমাজে পাশাপাশি বসবাস করতো। তাদের মাঝে একে অপরের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাবোধ ছিল। পাশাপাশি বসবাস করলেও কারো প্রতি কোন হিংসা-বিদ্বেষ ছিল না। এর মূল কারণ ছিল উন্নত মূল্যবোধ। প্রাচীন ভারতের ধর্মীয় জীবন ছিল খুবই উন্নত। ধার্মিকরা ছিলেন চরম পরমতসহিষ্ণু ও পরধর্মসহিষ্ণু। ফলে তাদের সামাজিক মূল্যবোধ হয়ে উঠেছিল অনেক উন্নত। এ সময় বাংলায় মূল্যবোধের অনুশীলন ছিল চোখে পড়ার মতো। সুনীতি, সুশিক্ষা আর সুবিচার ছিল বাংলার শাসন ব্যবস্থার অনন্য শ্রেষ্ঠ উপাদান। সহনশীলতা, উদারতা, মায়া-মমতা আর মানবতা ছিল প্রাচীন বাংলার সমাজ জীবনের প্রতিচ্ছবি। ফলে পুরো উপমহাদেশ হয়ে উঠেছিল মূল্যবোধের পাঠশালা। কিন্তু বর্তমানের অবস্থাটা খুবই হতাশাজনক। বর্তমানে মূল্যবোধের চর্চা এখানে অনেকটাই উপেক্ষিত। বলা হয়ে থাকে, ‘যায় দিন ভাল, আসে দিন খারাপ’।
বাংলার বর্তমান অবস্থাটা এ প্রবাদের প্রতিচ্ছবিতে রূপান্তরিত হয়েছে। ভালটা যেন সমাজ থেকে দিন দিন উঠে যেতে বসেছে। আগের সমাজের মানুষ ধনের চেয়ে নিজেদের সম্মানটাকে বড় করে দেখতো। মান-সম্মানকে মানুষ বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করতো। কিন্তু বর্তমান সমাজটা একবারেই পাল্টে গেছে। সমাজের মানুষ বিরামহীন ছুটে চলছে বিত্তের পেছনে। বিরামহীন ছুটতে গিয়ে তারা জলাঞ্জলি দিচ্ছে তাদের সততা ও নৈতিকতা। জড়িয়ে পড়ছে তারা নানা অনৈতিক কর্মকান্ডে। আর এটা এখন শুধু দেশের একটি সেক্টরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এ অনৈতিক কর্মকান্ড এখন দেশের প্রতিটি সেক্টরে ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের প্রভাবশালীদের অনেকে দুর্নীতির অভিযোগে কারাগারে রয়েছেন। ‘ভবিষ্যতে অনেককেই কারাগারে যেতে হবে’ ভয়ে বাঁচবার জন্য তারা এখন থেকেই অনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। দেশের বর্তমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই অস্বস্তিকর। রাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রই নীতিহীনতায় নিমজ্জিত। এ নীতিহীনতাই সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয় হিসাবে পরিচিত। দেশে নীতির চর্চা এখন অনেকটা বোকাদের কাজে রূপান্তর লাভ করেছে।
নীতিবান লোককে এখন সমাজে তেমন আর সম্মান করা হয় না। সম্মান এখন টাকা ও অর্থ দ্বারা বিবেচনা করা হয়। অথচ এ দেশেই এককালে নীতিবান হতদরিদ্র ব্যক্তিকেও সম্মানের চোখে দেখা হ’ত। প্রাচীন বাংলায় এসব নীতিবান ব্যক্তিই গুণীজন হিসাবে পরিচিত ছিলেন। এ সমস্ত গুণীজনকে সমাজের সকলেই সম্মানের চোখে দেখতো। কিন্তু বর্তমানে বাংলায় সেদিন আর অবশিষ্ট নেই। নীতি আর মূল্যবোধ চর্চাকে এখন বিদ্রূপের চোখে দেখা হয়। সমাজ এখন ‘টাকা যার, সম্মান তার’ নীতিতে পরিচালিত হচ্ছে। নীতিবান গুণীজনেরা সমাজে অনেকটা অপাংক্তেয় ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। বাংলার সমাজ এখন আর গুণীজনদের কদর করে না। তারা কদর করে সূদখোর টাকাওয়ালা মহাজনদের। এসব টাকাওয়ালা ব্যক্তিবর্গ এখন সমাজের পরিচালক ও নীতি নির্ধারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। ফলে তারা এখন প্রচন্ড প্রভাবশালী ও ক্ষমতাশালী। সমাজ এখন এসব প্রভাবশালীকেই সম্মান ও তাযীম করে। নীতিহীন এসব ব্যক্তিকেই জনগণ সংবর্ধনা আর সম্মাননা প্রদান করে থাকে। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এ নীতিহীন মানুষগুলোর মুখ থেকেই আবার নীতিবাক্য উচ্চারিত হয়!
মুখের উচ্চারণ আর কাগজের মাঝেই দেশের মূল্যবোধ এখন আটকে রয়েছে। প্রভাবশালীদের অনৈতিক শক্তিতে শিকলবন্দি হয়ে পড়েছে দেশের মূল্যবোধ। বাংলাদেশে মূল্যবোধের অবস্থা বর্তমানে শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী প্রজন্ম মনুষ্যত্বকে পুরোপুরি হারিয়ে ফেলবে। একসময় তারা মানুষরূপী দানবে পরিণত হবে। নিকট ভবিষ্যতে নতুন প্রজন্ম মূল্যবোধকে রূপকথার কল্পকাহিনী হিসাবে খুঁজে ফিরবে। আধুনিক যুগে বাংলাদেশের সামগ্রিক বৈশিষ্ট্য অত্যন্ত দুর্বল এবং প্রশ্নবিদ্ধ। অথচ ১৯৭১ সালে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধ ছিল মূল্যবোধকে পুঁজি করে। একই বছরের ১০ই এপ্রিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারী করা হয়েছিল। এ ঘোষণাপত্রটি ছিল মূল্যবোধে উজ্জীবিত এক অসামান্য মূলনীতি। মূল্যবোধের দিক থেকে এ ঘোষণাপত্রটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে অনন্য এক দলীল। এটি ছিল বাংলাদেশের প্রথম অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান। ছিল রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়ার আইনী দলীল। এ ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থে, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্ররূপে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করিলাম।’ মৌলিক মানবীয় মূল্যবোধে রচিত এ সংবিধান আজ বলতে গেলে দেশের সর্বক্ষেত্রে উপেক্ষিত। স্বাধীন দেশের মানুষের জন্য এটা একদিকে যেমন দুঃখজনক তেমনি লজ্জাজনকও বটে। কারণ জারীকৃত উক্ত নীতির ভিত্তিতে আজকের বাংলাদেশ পরিচালিত হচ্ছে না।[1]
মূলতঃ জারীকৃত উক্ত মূল্যবোধের অনুপস্থিতিটাই হ’ল আমাদের সামাজিক অবক্ষয়। সমাজে যখন নৈতিক স্খলন ঘটে, যখন চ্যুতি-বিচ্যুতি ঘটে তখনই তাকে সামাজিক অবক্ষয় বলা হয়ে থাকে। বাংলাদেশ আজ নানামূখী অবক্ষয়ে জর্জরিত। বাংলাদেশের সমাজে মাদক এবং ইয়াবার ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। গাঁজা ফেনসিডিলের ব্যবসাও রমরমা। মাদকতার স্রোতে দেশের যুবসমাজ আজ ভেসে যেতে বসেছে। দেশের কোন কোন জনপ্রতিনিধি এ ব্যবসার সাথে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি দেশের জনপ্রিয় কয়েকজন নায়ক-নায়িকা মদের ব্যবসার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন। এছাড়া দেশের নামি দামী অনেকেই এ ব্যবসায় জড়িত বলে মিডিয়ার মাধ্যমে জানা গেছে। লোকাল এডুকেশন এন্ড ইকোনোমিক ডেভেলপমেন্টের মতে, বাংলাদেশে প্রায় ২৫ লাখ শিশু আছে, যাদেরকে পথশিশু বলা হয়। এদের মধ্যে ১৯ শতাংশ শিশু হিরোইন আসক্ত। ৪০ শতাংশ ধূমপায়ী। ২৮ শতাংশ শিশু ট্যাবলেটে আসক্ত। আর ৮ শতাংশ শিশু আছে যারা ইনজেকশনে আসক্ত। এটা জাতি-রাষ্ট্রের জন্য ভয়ানক এক অশুভ ইঙ্গিত। এটা মানবিক মূল্যবোধের চরমতম অবক্ষয়।
দেশে বন্যার পানির মতো পর্নোগ্রাফির আসক্তি বেড়ে গেছে। তরুণ-তরুণী ও কিশোর-কিশোরীরা বর্তমানে পর্নোগ্রাফির ভয়াল নেশায় মত্ত। আর শুধু শিক্ষার্থীদের মাঝেই এ নেশা সীমিত নয়। মধ্যবয়সী নারী-পুরুষও এ মরণ নেশার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনে’র এক তথ্য মতে, রাজধানী ঢাকার স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের শতকরা ৮০ ভাগ পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত। ফলে পর্নোগ্রাফি আসক্তি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। ফলশ্রুতিতে অপরিণত ও অসংগতিপূর্ণ যৌনাচার সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। আর এসব অবক্ষয়ের সাথে জড়িত অধিকাংশই শিক্ষিত জনশক্তির অন্তর্ভুক্ত। উল্লেখিত অবক্ষয়সৃষ্ট অস্থিরতার কারণে সমাজে সৃষ্টি হয়েছে নানা জটিলতা। এ অবক্ষয়ের ব্যাপ্তি সর্বগ্রাসী রূপ লাভ করেছে। ফলে নাগরিকদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের ক্ষেত্রে সততা ও স্বচ্ছতার অভাব দেখা দিয়েছে। তারা ধৈর্য্য, উদারতা ও শিষ্টাচার হারিয়ে ফেলেছে। কর্মে তাদের নান্দনিকতা, নিয়মানুবর্তিতা ও সৃজনশীলতা লোপ পেয়েছে। তারা তাদের অধ্যাবসায়, দেশপ্রেম, কল্যাণবোধ ও দায়িত্ববোধ প্রভৃতি নৈতিক গুণাবলী নষ্ট করে ফেলেছে। সামগ্রিক জটিলতার কারণে মানবিক মূল্যবোধের জায়গায় স্থান পেয়েছে সামাজিক অবক্ষয়। দেশের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় অবক্ষয় এখন জয়-জয়কার অবস্থা।
দেশের ব্যাংক ব্যবসায় দুর্নীতি প্রকট আকার ধারণ করেছে। বেসিক ব্যাংক, জনতা ব্যাংক এবং রাষ্ট্রীয় ব্যাংক থেকে রিজার্ভ চুরি দেশের মূল্যবোধের বড় অবক্ষয়ের নির্দেশক। শেয়ারমার্কেট, ডেসটিনি, যুবক আর হলমার্ক কেলেংকারীর ঘটনা নৈতিক মূল্যবোধ বিচ্যুতির ইঙ্গিত প্রদান করে। দেশে নারী নির্যাতন, শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ ও চুরির ঘটনা নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডাকাতি, ছিনতাই, গুম ও খুন এখন স্বাভাবিক নিয়মের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছে। সন্ত্রাস, রাহাজানি ও নৈরাজ্য সামাজিক অবক্ষয় বিস্তৃতির এক মারাত্মক বহিঃপ্রকাশ।
এসব অবক্ষয়ের মূলে রয়েছে পারস্পরিক অসহিষ্ণুতা, সর্বগ্রাসী অশ্লীলতা এবং মাদকতা। পাশাপাশি রয়েছে ধর্মবিমুখতা, ধর্মের অপব্যবহার, ধর্মব্যবসা, ধর্মীয় সংকীর্ণতা ও ধর্মান্ধতা। অথচ যুগযুগ ধরে ধর্মই মানুষকে ভদ্র করে গড়ে তুলেছে। ধর্মের সঠিক অনুশীলন ও শিক্ষা মানুষকে রুচিশীল ও সাংস্কৃতিবান করেছে। ধর্ম ধার্মিকদেরকে করেছে ভদ্র ও মার্জিত। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আগমনের সময়কালে আরবের প্রায় সকল মানুষ ছিল ইতর, বর্বর আর নিকৃষ্ট। তারা ছিল অভদ্র, নির্দয়, নিষ্ঠুর আর অত্যাচারী-পাপী। অথচ ধর্মের সঠিক শিক্ষা ও অনুশীলনের মাধ্যমে সেই তারাই বিশ্বসেরা সোনার মানুষে পরিণত হয়েছিলেন। ধর্মের যথাযথ অনুশীলন তাদেরকে তৎকালীন বিশ্বসেরা গুণীজন হিসাবে ভূষিত করেছিল। গুণীজন হিসাবে তারা শুধু পৃথিবীতেই সেরা মানুষ ছিলেন না। বরং পরকালের জন্য নির্বাচিত সেরা মানুষের স্বীকৃতিটাও এ পৃথিবীতে পেয়ে গিয়েছিলেন।
আল্লাহ বলেন, ‘তাদের জন্য প্রতিদান রয়েছে তাদের প্রতিপালকের নিকটে চিরস্থায়ী বসবাসের বাগিচাসমূহ; যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত হয় নদী সমূহ। যেখানে তারা অনন্তকাল থাকবে। আল্লাহ তাদের উপর সন্তুষ্ট এবং তারাও তাঁর উপরে সন্তুষ্ট। এটা তার জন্য, যে তার পালনকর্তাকে ভয় করে’ (বাইয়্যেনাহ ৯৮/৮)।
হাদীছে এসেছে, ‘আবুবকর, ওমর, আলী, ওছমান, তালহা ইবনু ওবায়দুল্লাহ, যুবায়ের ইবনুল আওয়াম, আব্দুর রহমান ইবনু আওফ, সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস, সাঈদ ইবনু যায়েদ ও আবু ওবায়দা ইবনুল জাররাহ (রাঃ)-এ দশজন ছাহাবী দুনিয়া থেকে জান্নাতের সুসংবাদ পেয়ে গেছেন’।[2] এরকম মূল্যবোধেসিক্ত মানুষ আর পৃথিবীতে আসবে না। বিশ্বের সকল ইতিহাস এটাই জানান দেয় যে, পৃথিবীর সকল সভ্যতা গড়ে উঠেছিল কোন না কোন ধর্মকে কেন্দ্র করে। তাই মূল্যবোধে সিক্ত একটি সমাজ গড়তে প্রয়োজন ধর্মের ব্যাপক শিক্ষা ও তার যথার্থ অনুশীলন। প্রয়োজন ধর্ম লালন ও তার সম্প্রসারণ। ইসলামী চিন্তাবিদ সাইয়েদ কুতুব (রহঃ) তাই বলেছেন, ‘যে সমাজে মানবীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতার প্রাধান্য থাকে তাকে সভ্য সমাজ বলে’।
(২)
আধুনিক যুগ একটি পরিবর্তনের যুগ। দ্রুত পরিবর্তন হয়ে গেছে সৌরজগতের এ ছোট পৃথিবীটি। আর যেটুকু আছে সেটুকুও ভবিষ্যতে আরো ব্যাপক পরিবর্তন অপেক্ষা করছে। যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষগুলো পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। তারা হয়ে যাচ্ছে বড্ড অচেনা। ইতিমধ্যে দেশীয় বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। অবকাঠামোগত নানা দিকেরও পরিবর্তন সাধিত হ’তে চলেছে। আর মানব-জীবনের সবচেয়ে বড় দিক হ’ল মানুষের নৈতিকতার পরিবর্তন। ন্যায় ও অন্যায় বিভাজনে মানুষ এখন বড়ই দ্বিধান্বিত। সত্যকে সত্য আর মিথ্যাকে মিথ্যা বলাটা এখনবড়ই দুষ্কর। দেশে কোনটা আলো আর কোনটা অন্ধকার সেটার পার্থক্য করাও বড় কষ্টকর। সততার আলো যেন মানুষের চক্ষুকে এখন ঝলসে দিচ্ছে। মানুষ যেন বুনো বাদুরে পরিণত হয়ে গেছে। পরিণত হয়ে পড়েছে তারা পেঁচায়। দিনের আলো যেন মানুষের এখন ভালো লাগে না। রাতের অন্ধকার তাদের বড়ই প্রিয় হয়ে উঠেছে। কারণ তারা দিনের চেয়ে রাতকেই বেশী ভালবাসে। অসৎ মানুষেরা রাতটাকে এখন বাদুড়ের মতো আরামদায়ক করে নিয়েছে। আবহমান- কাল থেকে বাংলার সরকারী-বেসরকারী অফিসগুলোতে ‘ঘুষ’ নামে একটি অনৈতিক প্রথার প্রচলন ছিল। অনেকদিন ধরে এটাকে বাঙ্গালীরা ঘুষ বলেই জানতো। কিন্তু যুগ পরিবর্তনের সাথে সাথে এ শব্দটির নামও পরিবর্তন হয়ে এটার নাম এখন ‘তদবির খরচ’ ‘বখশিশ’ ইত্যাদি ধারণ করেছে। তথাকথিত শিক্ষিতজন কর্তৃক এটি একটি আনঅফিসিয়াল পরিভাষায় রূপান্তর লাভ করেছে। এটা অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের মহা এক ফাঁদে পরিণত হয়েছে। এটা মূল্যবোধের এক চরম অবক্ষয় হিসাবে সকল মহলে পরিচিত।
ছোট বেলায় এ দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ছিল নৈতিকতা অর্জনের কারখানা। আগেকার দিনে প্রাথমিকে শিশুদেরকে নানা নীতিবাক্য শেখানো হ’ত। ‘সদা সত্য বলিবে, মিথ্যা বলিবে না। না বলিয়া পরের দ্রব্যে হাত দিবে না। না বলিয়া পরের দ্রব্যে হাত দেয়াকে চুরি করা বলে। চুরি করা বড়ো দোষ’ ইত্যাদি নীতিবাক্য শিশুরা রপ্ত করতো। কিন্তু বর্তমানে সেই শিক্ষাতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এসব নীতিবাক্যের জায়গায় ‘আগডুম বাগডুমে’র আগমন ঘটেছে। ঘোড়াডুমের মতো অর্থহীন শিখন ও পঠন ব্যবস্থার প্রচলন হয়েছে। কোমলমতি শিশুদেরকে নীতিহীন করেই আমরা বড় করে তুলছি। এটা আমাদের শিক্ষা কারিকুলামের এক জাতীয় সংকট ছাড়া অন্য কিছু নয়। মূল্যবোধ জলাঞ্জলির বড় উদাহরণ এর চেয়ে আর কী-ই বা হ’তে পারে!
দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ হ’ল বিশ্ববিদ্যালয়। এটা এক সময় উন্নত জ্ঞান-গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে বিবেচিত হ’ত। কিন্তু বর্তমান সময়ে সেখানেও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। গ্রামের সাধারণ মানুষ ও অভিভাবকগণ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম শুনলেই আঁৎকে উঠেন। এটা মানবিক মূল্যবোধের ভয়ানক অবক্ষয়ই বলতে হবে। কবি আল-মাহমুদ বিশ্ববিদ্যালয়কে তাই ‘ডাকাতের গ্রাম’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন মেধার চর্চা হয় না বললেই চলে। এখানে এখন চর্চা হয় নীতিভ্রষ্ঠ রাজনীতির। এখানে ব্যাপকভাবে এখন নিয়োগ বাণিজ্যের চর্চা হয়। মেধার পরিবর্তে টাকার বিনিময়ে নিয়োগ সম্পাদিত হয়ে থাকে। সেখানে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে তেলবাজি ও দলবাজিকে প্রাধান্য দেয়া হয়। এক্ষেত্রে দলবাজির কাছে মূল্যবোধ পরাজিত হয়। স্কুল ও কলেজগুলোর অবস্থাও তথৈবচ। স্কুল-কলেজের কমিটিগুলোর বিরুদ্ধে অর্থবাণিজ্যের অভিযোগ এখন ওপেন সিক্রেট। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগে মেধাকে খুব কমই প্রাধান্য দেয়া হয়ে থাকে। নির্লজ্জ দলবাজি আর অর্থই শিক্ষক হওয়ার একমাত্র যোগ্যতা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। আর এ অবস্থা সারা দেশের স্কুল-কলেজে কম-বেশী চলমান রয়েছে।
এতে করে বাচ্চাদের হাতেখড়ি হচ্ছে অনৈতিক শিক্ষকের কাছে। এর মাধ্যমে শিশুদের পড়ানোর জন্য আমরা অনৈতিক কর্মকান্ডে লিপ্ত হচ্ছি। শিক্ষক যখন দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগ পান, এমতাবস্থায় তাদের কাছ থেকে নৈতিকতা আশা করা অর্থহীন। কারণ তাদের সামগ্রিক নিয়োগ প্রক্রিয়াটাই নৈতিকতা পরিপন্থী। সুতরাং তারা নিজেরাই মূল্যবোধ বিবর্জিত মানুষ। তাদের কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করা বাতুলতার নামান্তর। এটি তেঁতুল গাছ থেকে আনারস পাবার আশা করার মতো অর্থহীন ব্যাপার। অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়া ঐ শিক্ষকের দ্বারা যেকোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যাওয়া মোটেই অসম্ভব ব্যাপার নয়। তাইতো শিক্ষাঙ্গনে বার বার ঘটছে যৌন নিপীড়নের মতো ঘৃণ্য ঘটনা। কিন্তু ভুক্তভোগীরা এ ঘটনার কাঙ্ক্ষিত প্রতিকার পাচ্ছেন না। স্বাধীন দেশে আমাদের কাছে এটা অত্যন্ত লজ্জার ও ঘৃণার বিষয়। জাতি হিসাবে আমরা এসব ঘটনা থেকে শিক্ষা নিচ্ছি না। অধিকন্তু এ সমস্ত শিক্ষকের সাথে সচেতন নাগরিকরাই একাট্টা হয়ে মিশে যাচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থীরা দুর্নীতির সাথে আপোষকামী হিসাবে তৈরি হয়ে উঠছে। তারা দুর্নীতিকে আর দুর্নীতি মনে করছে না। অন্যায়কেও অন্যায় হিসাবে আর বিবেচনায় নিচ্ছে না। ফলে তাদের বিবেকবোধ অসুস্থ জরাজীর্ণে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। তাদের সুকুমার প্রবৃত্তি নিস্তেজ হয়ে গেছে। ফলে তারা রাষ্ট্রের যেখানেই গিয়েছে সেখানেই সৃষ্টি করেছে হ-য-ব-র-ল অবস্থা।
প্রাচীন বাংলায় কোন না কোন একজন শিক্ষক ছিলেন শিক্ষার্থীদের অনুকরণীয় আদর্শ। কিন্তু বিগত কয়েক যুগে সে জায়গাটিরও বিলোপ সাধিত হয়েছে। বলতে গেলে শিক্ষার্থীদের কাছে কোন শিক্ষকই এখন আর অনুকরণীয় মডেল নেই। নায়ক-নায়িকা, গায়ক-গায়িকা কিংবা কোন খেলোয়াড় হয়ে গেছে তাদের অনুসরণীয় মডেল। যুবসমাজ থেকে মূল্যবোধ, মনুষ্যত্ব, সভ্যতা সবই প্রায় হারিয়ে গেছে। এ সমস্ত শিক্ষার্থীদের হাতে গির্জা, মসজিদ এবং মন্দিরও এখন নিরাপদ নয়। তাদের মাধ্যমেই জন্ম হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ। আর তাদের মাধ্যমে রাজনীতি হয়ে পড়েছে কলুষিত। রাজনীতি রাজ্য শাসনের সর্বোচ্চ নীতি হ’লেও সেটা এখন ক্ষমতা দখলের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। নবীন রাজনীতিকরা প্রবীণ রাজনীতিকদের অনৈতিক চতুরতা রপ্ত করে ফেলেছে। ফলে নবীনরা হয়ে উঠেছেন সীমাহীন অনৈতিক ক্ষমতাবান। প্রবীণদের টিক্কা মেরে তারা সামনে এগিয়ে যেতেও দ্বিধা করে না। কিছু রাজনীতিকদের নোংরা শব্দচয়ন দেশবাসীকে হতবাক করেছে। এসব রাজনীতিবিদ তাদের নীতিবোধকে মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। জাতির সামনে তাদের মনুষ্যত্ব কলুষিত রূপ ধারণ করেছে। বলতে গেলে দেশের ক্ষয়িষ্ণু রাজনীতি ক্রমান্বয়ে লুটপাটের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। এটা এখন অবৈধ অর্থ সংগ্রহের মাধ্যম হিসাবে পরিণত হয়েছে।
দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় এখন নৈতিকতার বড়ই সংকট। আমজনতা এটাকে টাকা উপার্জনের পথ বলেই মনে করে থাকেন। অথচ দেশে গণতন্ত্রের যাত্রার সময় নির্বাচনটা ছিল আনন্দের অনুষঙ্গ। মানুষ উৎসব মুখর পরিবেশে ভোট প্রদান করতো। পসন্দের প্রার্থীর জয়-পরাজয়ের খবর জানতে মানুষ রেডিও-টিভির সামনে সারা রাত বসে থাকতো। এখন আর সেদিন নেই। রাজনীতিবিদগণ এ ব্যবস্থা পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছেন। এখন একদলের মধ্যেই নির্বাচনী প্রচারণা চলতে দেখা যায়। তাদের মধ্যেই চলে ভোট যুদ্ধ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হ’তে দেখা যায়। নিজ দলের মধ্যে মারামারী, হাঙ্গামা ও হত্যার ঘটনা এখন নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২১ সালের (ইউপি) নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘটিত সংঘাত ও মৃত্যুই এর বাস্তব প্রমাণ। প্রথম দফা নির্বাচনী সংঘাতে দেশে মৃত্যু হয়েছিল ৫ জনের। আর দ্বিতীয় দফা নির্বাচনী সংঘাতে মৃত্যু হয়েছে ২৮ জনের। এসব ঘটনায় ইলেকশন কমিশনকে শুধু বিব্রতবোধ করতেই দেখা যায়। কমিশন কার্যকরী কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেন না। ফলে যাদের মধ্যে ন্যূনতম ভদ্রতা, মনুষ্যত্ব আর মূল্যবোধ আছে তারা রাজনীতিকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলেন। বর্তমানে ভোট তাদের কাছে একটি হাস্যকর নাটক ছাড়া আর কিছুই নয়। এটা একটি দেশের জন্য মোটেই কোন ভালো খবর নয়।
দেশের মূলধারার রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। দলীয় মনোনয়ন পেতে স্থানীয় নেতারা কেন্দ্রীয় নেতাদেরকে কোটি কোটি টাকা ঘুষ প্রদান করে থাকেন। ইউনিয়ন, থানা ও যেলা কমিটির মনোনয়ন পেতেও কেন্দ্রীয় নেতাদেরকে দিতে হয় লাখ-লাখ, কোটি-কোটি টাকা। মিডিয়ার মাধ্যমে এসব খবর এখন অজপাড়াগায়ের প্রতিটি মানুষের মুখে মুখে।
বাঙালি সমাজের প্রতিটি পরিবার এক সময় ছিল একটি বিদ্যালয় সমতুল্য। এই পরিবারই ছিল নৈতিকতা অর্জনের সূতিকাগার। এখন সেটা আর সে অবস্থায় নেই। এখন সেটারও পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। সেটা এখন প্রতিযোগিতার নিকেতনে পরিণত হয়েছে। আমাদের সন্তানদের শুধু দৌড়াতে শিখাচ্ছি। তাদেরকে আমরা বানাতে চাচ্ছি ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার। বড় করতে চাচ্ছি টাকা উপার্জনকারী এক ধনাঢ্য ব্যক্তি হিসাবে। কিন্তু তাদেরকে আমরা ভালো মানুষ বানাতে চাচ্ছি না। বাচ্চারা এখন পড়াশুনা করছে শুধু A+ পাবার জন্যে। তারা আনন্দের জন্য পড়ছে না; ভালো মানুষ হওয়ার জন্য পড়ছে না। তারা তোতাপাখির মতো কিছু বুলি মুখস্থ করছে। তারা পড়ছে শুধু টাকা অর্জনের জন্য। এটা নৈতিক অবক্ষয়ের মারাত্মক এক দিক।
প্রাচীন বাংলায় পাত্রীকে পাত্রস্থ করতে মেয়ে এবং মেয়ের বাবা সৎ পাত্রের খোঁজ করতো। পাত্র চরিত্রবান কি-না সেটাকে অগ্রাধিকার দিত। কিন্তু বর্তমান সমাজের পাত্রী এবং পাত্রীর পিতারা পাত্রের টাকাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। অর্থাৎ একজন পাত্র সরকারী চাকরী করলেই হ’ল। সততা সেখানে গুরুত্বহীন। বাড়ি আছে কি-না, পাত্রের জমাজমি আছে কি-না ইত্যাদি বিষয় এখন প্রাধান্য পায়। অর্থাৎ একজন ব্যক্তি সৎ, না অসৎ; সামাজিক জীবনে তার কোন প্রভাব প্রতিফলিত হচ্ছে না। তরুণ প্রজন্মও হাঁটছে সেদিকে। জোর কদমে এগিয়ে চলছে তারা অজানা গন্তব্যের দিকে। তারা চলছে ভোগবাদিতার দিকে। এটা জাতির জন্য এক মহা অশনিসংকেত। তরুণ প্রজন্ম পরিণত হয়েছে মানসিক দাসে। আর মানসিক লালসা তাদেরকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। এটা একটি দেশ ও জাতির জন্য মারাত্মক বিপদ সংকেত।
(৩)
সমাজের কতক লোক আবার সততার ছদ্মাবরণে আচ্ছাদিত। বাহ্যিকভাবে তারা ভালো মানুষের রূপ ধারণ করতে বেশ অভ্যস্ত। এক্ষেত্রে তাদের সবচেয়ে বড় অবলম্বন ধর্মীয় লেবাস। এসব লেবাসধারীদের অন্তরটা শত জটিল, কুটিল আর নানা অসততায় পরিপূর্ণ। কোন কারণে যে কোন বিষয়ে তাদের সাথে মতের অমিল হ’লেই তাদের খোলস বেরিয়ে পড়ে। তাদের লেবাসের অন্তরালে জমানো ঘৃণ্য চরিত্র উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। তাদের অন্তরে লালিত আসল চেহারা মুখের ভাষায় প্রকাশ পেতে থাকে। লেবাসের আড়ালে মূলতঃ তাদের অনৈতিকতা, অসাধুতা আর চরম নির্লজ্জতাই যাহির হয়ে পড়ে। সরকারী অফিসের অনেক ঘুষখোর আছেন যাদের মুখ দাঁড়িতে ভরা। পরণে থাকে তাদের ধর্মীয় পোশাক। আর মাথা থাকে টুপিতে ঢাকা। এই ঘুষের টাকা দিয়ে তিনি প্রতি বছর হজ্জে যান। এসব মন্দ লোকের বাইরের আবরণটা বেশ চুপচাপ ও ভদ্রতায় ভরা। কিন্তু তাদের ভিতরটা ভয়ঙ্কর নেকড়ে মানসিকতায় ভরা। সুযোগ পেলেই তারা হিংস্র হয়ে উঠে। এটাই হ’ল বর্তমান বাংলার বাস্তব সমাজচিত্র।
এ চিত্র প্রতিদিনই মানুষের আত্মাকে একটু একটু করে কলুষিত করে চলেছে। অর্থ আর স্বার্থ ভালবাসার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। দেশের সামগ্রিক পরিবেশ মূল্যায়ন করে এভাবে বলা যায় যে, নৈতিকতার যদি কোন কাঠামো ও অবয়ব থাকত, তাহ’লে এতদিনে তাকে গুম করা হ’ত কিংবা গভীর জঙ্গলে নির্বাসন দেয়া হ’ত অথবা নদীতে ডুবিয়ে চিরতরের জন্য সলিল সমাধির ব্যবস্থা করা হ’ত। সুতরাং আমরা ঘোরময় মূল্যবোধশূন্য এক অন্ধকার অমানিশাতে বসবাস করছি। দেশে টাকাওয়ালা লোকের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। ধনীরা ক্রমশঃ ধনী হচ্ছে। তারা সম্পদের পাহাড় তৈরীতে ব্যস্ত। এক্ষেত্রে তাদের কাছে নৈতিকতার কোন প্রয়োজন নেই। যে কোন উপায়ে অর্থ উপার্জনই তাদের একমাত্র লক্ষ্য। ধনীরা প্রচুর অর্থের মালিক হয়েও তারা মনে কোন শান্তি পাচ্ছে না। তারা একটু সুখ ও শান্তির জন্য বিভিন্ন ডাক্তারের শরণাপন্ন হচ্ছে। কিন্তু কোন ডাক্তারই তাদেরকে সুখী করতে পারছে না। তাদের মনের মধ্যে সুখপাখিটা যেন অধরাই রয়ে গেছে। আনন্দ, হাসি আর স্বস্তি কোনটাই তাদের মাঝে উপস্থিত নেই।
এর বিপরীতে রয়েছে নিঃস্ব, গরীব ও অসহায় শ্রেণীর মানুষ। এই গরীবেরা ক্রমশঃ গরীব হয়েই চলেছে। তাদের অবস্থাটাও ধনীদেরই মতো। তাদের কাছেও স্বাদের সুখপাখিটা অধরাই রয়ে গেছে। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেও যেন এতটুকু শান্তি-স্বস্তি খুঁজে পাচ্ছে না। সবাই আরো ‘কী’ যেন পাবার নেশায় ছুটছে। সবাই দৌড়াচ্ছে সুখপাখিটা ধরতে। কিন্তু উভয় শ্রেণীই এক্ষেত্রে ব্যর্থ হচ্ছে। সবার মাঝেই ব্যাপক অস্থিরতা কাজ করছে। মূলতঃ এটা হ’ল অনৈতিক ভোগবাদিতার অন্ধ আসক্তি। তারা এ আসক্তিতে মারাত্মকভাবে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। একথাটি কুরআনে নিমেণাক্তভাবে প্রকাশ করা হয়েছে,أُولَئِكَ الَّذِينَ اشْتَرَوُا الضَّلَالَةَ بِالْهُدَى فَمَا رَبِحَتْ تِجَارَتُهُمْ وَمَا كَانُوا مُهْتَدِيْنَ، ‘ওরা হ’ল তারাই যারা হেদায়াতের বদলে গোমরাহীকে খরীদ করেছে। কিন্তু তাদের এ ব্যবসা লাভবান হয়নি এবং তারা সুপথপ্রাপ্ত হয়নি’ (বাক্বারাহ ২/১৬)। ফলে তারা মূল্যবোধহীন এক বন্য পশুতে পরিণত হয়েছে। সেখান থেকে তারা আর মনুষ্যত্বে ফিরে আসতে পারছে না।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
لَهُمْ قُلُوبٌ لَا يَفْقَهُونَ بِهَا وَلَهُمْ أَعْيُنٌ لَا يُبْصِرُونَ بِهَا وَلَهُمْ آذَانٌ لَا يَسْمَعُونَ بِهَا أُولَئِكَ كَالْأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ أُولَئِكَ هُمُ الْغَافِلُونَ-
‘যাদের হৃদয় আছে কিন্তু বুঝে না, চোখ আছে কিন্তু দেখে না, কান আছে কিন্তু শোনে না, ওরা হ’ল চতুষ্পদ জন্তুর ন্যায়, বরং তার চাইতেও পথভ্রষ্ট। ওরা হ’ল উদাসীন’ (আ‘রাফ ৭/১৭৯)।
মূল্যবোধে উজ্জীবিত হ’তে শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। কুরআন শিক্ষিত হওয়াকে ফরয আমল (আবশ্যিক দায়িত্ব) হিসাবে গণ্য করেছে। আল্লাহ বলেন, اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ ‘পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন’ (আলাক ৯৬/১)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ ‘প্রত্যেক মুসলিমের উপর জ্ঞান অর্জন করা ফরয’।[3]
উল্লেখিত শিক্ষার মাধ্যমে একজন শিক্ষিত মানুষ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান আয়ত্ব করেন। যার কারণে অন্যান্য প্রাণী থেকে তিনি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য অর্জন করেন। তিনি অন্যান্য প্রাণী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যান। ফলে তিনি শ্রেষ্ঠ মর্যাদায় আসীন হয়ে যান। আর এ উপাদানগুলোর সামষ্টিক নাম হ’ল মৌলিক মানবীয় মূল্যবোধ। এ মূল্যবোধ অবলম্বনের কারণেই মানুষ পৃথিবীতে সৃষ্টির সেরা জীবের স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু এ উপাদানগুলো মানুষের চেতনায় ও প্রতিভায় ঘুমন্ত থাকে। জীবনের বিভিন্ন প্রয়োজনে তাই এটাকে আবিষ্কার করতে হয়। মানুষকে তার জীবন চলার প্রতিটি বাকে এটাকে চর্চা করতে হয়। জীবনের সকল সুখে, দুঃখে ও প্রেরণায় এটাকে প্রয়োগ করতে হয়। সামাজিক বিভিন্ন উদ্যোগ আর উদ্যমে এগুলোর ব্যবহার জানতে হয়। রাষ্ট্রের বিভিন্ন সেক্টরে এ মূল্যবোধের প্রয়োগ ঘটাতে হয়। ব্যক্তি জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে ও পদক্ষেপে এটির প্রয়োগ করতে হয়।
প্রতিটি কার্যক্রমে এ উপাদানগুলোর অনুশীলন ও প্রয়োগ ঘটাতে হয়। পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তা আত্মস্থ করতে হয়। আর এ উপাদানগুলোকে নির্দিষ্ট সংখ্যা দ্বারা সীমাবদ্ধ করা যায় না। মূল্যবোধের সীমা-পরিসীমা বলে কিছু নেই। মায়া-মমতা, স্নেহ-প্রীতি, প্রেম-ভালবাসা, সহযোগিতা, সহানুভূতি, সহমর্মিতা ইত্যাদিকে মূল্যবোধ বলা হয়ে থাকে। আবার ত্যাগ-তিতিক্ষা, সৌজন্য, দয়া, সাধুতা, ক্ষমা, অনুগ্রহ, উদারতা, কল্যাণচিন্তা ইত্যাদিও মূল্যবোধের অন্তর্ভুক্ত। এসব উপাদান যেসব মানুষ আয়ত্ত করতে পেরেছেন তাদেরকেই গুণীজন বলা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে পিএইচ.ডিধারী হওয়া যেমন শর্ত নয়, তেমনি রাষ্ট্রের কোন বড় অফিসার হওয়াও শর্ত নয়। সমাজের যে কোন মানুষের মাঝে এ গুণাবলী পাওয়া যেতে পারে। যার মাঝে এসব গুণ পাওয়া যাবে তাকে ভালো মানুষ বা গুণী মানুষ বলা যেতে পারে। মূলতঃ উল্লেখিত গুণাবলী যাদের মধ্যে থাকে তারা ইতিবাচক মনোভাবসম্পন্ন হয়ে থাকেন। তারা সামাজিক যে কোন কাজে ইতিবাচক মানসিকতা পোষণ করে থাকেন। তারাই সমাজের প্রকৃত বন্ধু হিসাবে পরিচিতি পান। এসব মানুষের মধ্যে অহংকার থাকে না বললেই চলে। তাদের মধ্যে বসগিরি খুঁজে পাওয়া যায় না। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়েও তারা ক্ষমতার বড়াই করেন না। এসব মানুষের মধ্যে থাকে প্রকৃত দেশপ্রেম ও মানবপ্রেম। তাদের কাজে ও কর্মে সেবার মানসিকতা প্রকাশ পায়। স্ব স্ব কর্মস্থল কর্মচঞ্চল, স্থির ও কর্মময় হয়ে ওঠে। পরস্পরের মধ্যে সৌহাদ্র্য ও সম্প্রীতি সৃষ্টি হয়। ফলে অধীনস্তদের মাঝে কর্মস্পৃহা তৈরি হয়। পারস্পরিক সহযোগী সম্পর্ক তৈরি করতে সবাই উদ্বুদ্ধ হয়। আর একে অপরকে ভালবাসতে অনুপ্রাণিত করে।
মানুষের ঘরে জন্ম নিলেই মানুষ হওয়া যায় না। মানুষ শব্দটি লিখতে গেলে দু’টি শব্দের প্রয়োজন হয়। আর তা হ’ল ‘মান’+ ‘হুশ’=মানুষ। এখানে ‘মান’ বলতে নিজের সম্মানবোধকে বোঝানো হয়েছে। আর হুঁশ বলতে সামগ্রিক চেতনাকে বুঝানো হয়েছে। এই দু’টি গুণ যার মধ্যে আছে তাকেই সাধারণত মানুষ বলা হয়ে থাকে। কারণ পৃথিবীতে অসংখ্য মানুষের বসবাস। আর তাদের মধ্যে ভালো ও মন্দ-দুই শ্রেণীর মানুষই বসবাস করছে। এদের মধ্যে যাদের মানবিক গুণাবলী রয়েছে তাদেরকে শুধুমাত্র মানুষ বলা সমীচিন।
মানুষের মাঝে অন্তর্নিহিত এসব গুণের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে মানুষের ব্যক্তিত্ব। মানুষের ক্রমান্বয়ে বয়স বাড়তে থাকে। আর ব্যক্তিত্ব নিরিখেই নির্ধারিত হয় তার পারিবারিক ও সামাজিক মর্যাদা। পৃথিবীতে মানুষ বড়ই অনুকরণপ্রিয়। প্রত্যেক মানুষের একটি ছোটকাল থাকে। এই ছোটকাল থেকেই সে কারো না কারো অনুকরণ করতে থাকে। মনের অজান্তেই তাকে অনুসরণ করতে থাকে। এই ছোট মানুষটি বড় হয়ে তার মতো হ’তে চায়। তার কথা তার হৃদয়ে গভীর রেখাপাত করে। অনুকরণীয় ব্যক্তিটি হ’তে পারে তার পিতা। হ’তে পারে তার কোন শিক্ষক। হ’তে পারে ইতিহাসের কোন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব বা অন্য যেকোন একজন। আমাদের সমাজে এ জাতীয় মানুষের যথেষ্ট অভাব পরিলক্ষিত হয়। অথচ বর্তমান সময়ের দাবী অনুযায়ী এসব মানুষের খুবই প্রয়োজন। অবশ্য যথেষ্ট আন্তরিকতা দিয়ে খুঁজলে কিছু সংখ্যক গুণী মানুষ পাওয়া অসম্ভব নয়। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, সমাজ থেকে গুণের কদর লোপ পেয়েছে। এ একই কারণে গুণীজনের কদরও শূন্যের কোঠায় পৌঁছেছে।
সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে গুণীজনেরা নিজেদেরকে নিভৃতচারী করে রাখার নীতি অবলম্বন করেছেন। নীতিভ্রষ্ট রাজনীতি প্রকৃত গুণীজনদের কোনঠাসা করে রেখেছে। সমাজটা অরাজকতায় জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। বর্তমানে সুষ্ঠু সমাজ গড়ার প্রত্যাশা করাটা দূরাশায় পরিণত হয়ে গেছে। অথচ একজন অসৎ লোকের জন্যও সুষ্ঠু ও শান্তিময় সমাজ
দরকার। আর শান্তিময় সমাজ পুনঃনির্মাণে উল্লেখিত মূল্যবোধের বিকল্প নেই। সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ সমাজ পুনঃগঠনে প্রয়োজন মূল্যবোধের জাগরণ। আর এ জাগরণের নেপথ্যে মূল ভূমিকা রাখতে পারেন গুণীজনেরা। আর তাদের মাঠকর্মী হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে তরুণ ছাত্র ও যুবসমাজ। এ দুয়ের সম্মিলিত শক্তিই কেবল সমাজ ও রাষ্ট্রকে সুন্দর করতে পারে। তাদের সমন্বিত শক্তি আর উদ্যোগই কেবল পারে সামাজিক অবক্ষয় রুখে দিতে। তারাই ফিরিয়ে আনতে পারেন বাংলা থেকে হারিয়ে যাওয়া সততা, মননশীলতা, মানবতা আর বদান্যতা। ফিরে আসতে পারে হারানো সকল মানবীয় গুণ। তাদের মাধ্যমে বাংলা আবার পরিণত হ’তে পারে মূল্যবোধে সিক্ত এক অনুপম জনসমাজে।
ড. মুহাম্মাদ কামরুজ্জামান
অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
[1]. বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১০ই এপ্রিল, ২০১৬।
[2]. মুসনাদে আহমাদ হা/১৫৬৫।
[3]. ইবনু মাজাহ হা/২২০।