পর্ব ১। পর্ব ২। পর্ব ৩। পর্ব ৪। পর্ব ৫। পর্ব ৬। পর্ব ৭।
মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী ও ইংরেজ সরকার
‘আল-ফুরক্বান’ রাবওয়া সমীপে
[যদিও আলোচ্য গ্রন্থের বিষয়বস্ত্তর সঙ্গে নিচের প্রবন্ধটির কিছুটা তফাৎ আছে, তবুও মাওলানা মুহাম্মাদ হুসাইন বাটালভীর কর্মনীতি থেকে আহলেহাদীছ জামা‘আতের প্রকৃত অবস্থান পরিষ্কারভাবে বুঝার জন্য একটি দিক এতে বিদ্যমান রয়েছে। লেখক এ প্রবন্ধটি ১৫ বছর পূর্বে জনৈক মির্যায়ী কাদিয়ানীর লেখার জবাবে লিখেছিলেন। যা ৩০শে অক্টোবর ১৯৭০ সালে ‘আল-ই‘তিছাম’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। এখন উল্লেখিত কারণে এবং অন্যান্য উপকারিতা হেতু তা এ গ্রন্থভুক্ত করা হ’ল। -ছালাহুদ্দীন ইউসুফ]
যখন থেকে করাচীর জেমস আবাদ কোর্টের সিভিল জজ শেখ মুহাম্মাদ রফীক গিরিজা আকল-নকল তথা যুক্তি ও কুরআন-হাদীছ উভয়ের আলোকে কাদিয়ানীদের মুসলিম উম্মাহ থেকে খারিজ, পৃথক একটি অমুসলিম সম্প্রদায় এবং তার প্রতিষ্ঠাতা মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী ইংরেজদের হাতের ক্রীড়নক ছিলেন বলে কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে রায় প্রদান করেন, তখন থেকেই কাদিয়ানীদের মধ্যে একটা অস্থিরতা তৈরি হয় এবং তারা নানাভাবে এই রায়ের প্রভাব-প্রতিক্রিয়া রদ করার জন্য উঠে-পড়ে লাগে। তাদের কিছু লেখক নিজেদের দলকে এই বলে আশ্বস্ত করতে থাকে যে, এটা আল্লাহ তা‘আলার একটা পরীক্ষা। আর আল্লাহওয়ালাদের এমন পরীক্ষার মুখোমুখি হতেই হয়। তাদের কেউ কেউ এ মামলায় কাদিয়ানী পক্ষের লোকটিকে কাদিয়ানী মানতেই নারাজ। তাদের এমনও প্রতিক্রিয়া নযরে এসেছে যে, যেসব উপরওয়ালাদের স্বার্থে আদালত কাদিয়ানীদেরকে মুসলমানদের একটি সম্প্রদায় বলে ঘোষণা করেছে, তারা সেসব ফায়ছালাকে পুস্তিকা আকারে সারা দেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে।
সে পুস্তিকার একটি কপি আমাদের হাতেও এসেছে। তাছাড়া নিজ সম্প্রদায়কে স্থির ও নিশ্চিন্ত রাখতে তারা মুসলমানদের সেসব দল ও ব্যক্তির মতামতও তাদের সামনে তুলে ধরছে, যারা ইংরেজ সরকারের ‘ধর্মীয় উদারতা’হেতু তাদের ধন্যবাদ জানিয়েছে এবং তাদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছে। উদাহরণস্বরূপ ‘আল-ফুরক্বান’ রাবওয়ার আগস্ট সংখ্যায় শী‘আ, সুন্নী ও আহলেহাদীছের সাথে যুক্ত এমন কিছু আলেমের কথা তুলে ধরা হয়েছে। তারপর সেপ্টেম্বর সংখ্যায় আহলেহাদীছের একজন আলেমের সেসব লেখা তুলে ধরা হয়েছে যাতে ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান হেতু সরকারকে ধন্যবাদ জানানো হয়েছে। তাছাড়া আহলেহাদীছ জামা‘আতের প্রতি ‘ওহাবী’ শব্দ ব্যবহারে আইনী নিষেধাজ্ঞা জারির জন্য আহলেহাদীছদের কেউ কেউ ইংরেজ সরকারের প্রতি যে ধন্যবাদ ও সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে পত্রিকায় সে কথাও তুলে ধরা হয়েছে। আল-ফুরক্বানের সম্পাদক বলছেন, ‘ইংরেজের আনুগত্য সত্ত্বেও যদি এ সকল লোক ইংরেজের হাতের ক্রীড়নক গণ্য না হন তাহ’লে মির্যা ছাহেবকে কেন একই ধরনের খেয়াল যাহির করার জন্য ইংরেজের হাতের ক্রীড়নক গণ্য করা হবে?’ তারপর ‘আল-ফুরক্বানে’ এ ব্যাপারে আহলেহাদীছ আলেমদেরকে ‘বিনয়-নম্রভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের’ জন্য বিশেষভাবে আহবান জানানো হয়েছে।
এজন্যই আমরা ইংরেজদের বিষয়ে মির্যা ছাহেব ও কতিপয় আলেমের কর্মপন্থার মধ্যে যে সকল বৈশিষ্ট্য ও পার্থক্য বিদ্যমান রয়েছে তা স্পষ্ট করা যরূরী মনে করছি।
এ প্রসঙ্গে সর্বপ্রথম মির্যা ছাহেব ও অন্যান্য আলেমদের আনুগত্যের গতি-প্রকৃতির মধ্যেকার পার্থক্য অনুধাবন করা যরূরী মনে করি। মুসলমান আলেমদের মধ্যে যারা ইংরেজ সরকারের আনুগত্য প্রকাশ করেছেন তাদের কথামতই তার কারণ এই ছিল যে, এ সরকারের ছায়াতলে ধর্মীয় স্বাধীনতা পুরোপুরি বিদ্যমান রয়েছে। তাছাড়া মুসলমানদের হাতে এমন কোন শক্তি, ক্ষমতা ও উপকরণ মওজুদ নেই যে তার সাহায্যে যুদ্ধ করে তারা ইংরেজদের দেশছাড়া করতে পারবে। এমতাবস্থায় তারা ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করে তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলাকেই সমীচীন মনে করেছেন। তা সত্ত্বেও এ কথা ধ্রুব সত্য যে, কোন আলেমই জিহাদকে আগাগোড়া মানসূখ (রহিত) ও হারাম গণ্য করেননি এবং শেষ যামানায় আগমনকারী ইমাম মাহদীকে ‘খুনী মাহদী’ বলেননি। পক্ষান্তরে মির্যা ছাহেব ইংরেজের সহযোগিতার শিঙ্গায় কেবল তার স্বরে ফুঁক দেননি যাতে তিনি ইংরেজের ইশারায় নবুঅত দাবী করেছেন বলে সন্দেহ দানা বাধে, বরং তিনি স্বপ্রণোদিত হয়ে নিজেকে মাহদিয়াতের পদে আসীন করার জন্য ‘প্রতিশ্রুত মাহদীর আবির্ভাব’ সংক্রান্ত মুসলমানদের আক্বীদা-বিশ্বাসকে খতম করার ব্যর্থ চেষ্টা করতে গিয়ে ইমাম মাহদীকে ‘খুনী মাহদী’ বলে অভিহিত করেছেন।
‘আল-ফুরক্বানে’র সম্পাদক ছাহেব কান লাগিয়ে শুনুন (সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরছি)।-
প্রথমতঃ মির্যা ছাহেব নিজেকে ‘ইংরেজের কর্ষিত ভূমির চারা’ বলে ঘোষণা করেছেন।[1] ইংরেজ সরকারের মঙ্গল কামনা ও সহযোগিতায় নিজেকে ইংরেজ সরকারের আশ্রয়স্থল (কিল্লা) বলে উল্লেখ করেছেন[2] এবং স্বয়ং বৃটিশ সাম্রাজ্যকে নিজের ও
নিজের জামা‘আতের জন্য আশ্রয়স্থল বলেছেন।[3]
দ্বিতীয়তঃ মির্যা ছাহেব আল্লাহর সৃষ্টির সংশোধনের বদলে ইংরেজের সাহায্য ও সহযোগিতাকেই তার প্রেরিত হওয়ার মূল কারণ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘তিনি (আল্লাহ) আমাকে পূর্ব প্রতিশ্রুতি মোতাবেক আসমান থেকে পাঠিয়েছেন যেন আমি মহারাণীর (ভিক্টোরিয়া) পুণ্য ও বরকতময় উদ্দেশ্যসমূহ পূরণের কাজে নিয়োজিত থাকি। তিনি (আল্লাহ) আমাকে অসীম বরকতে পরিপূর্ণ করেছেন এবং আমাকে তার মসীহ বানিয়েছেন, যাতে তিনি মহারাণীর (ভিক্টোরিয়া) পবিত্র উদ্দেশ্যগুলো বাস্তবায়নে স্বয়ং আসমান থেকে সাহায্য করতে পারেন’।[4]
‘হে হিন্দুস্থানের ক্বায়ছারাহ মহারাণী (ভিক্টোরিয়া), আল্লাহ তা‘আলা তোমার আয়ুষ্কালকে সৌভাগ্য ও আনন্দসহ বরকতময় করুক। তোমার শাসনকাল কতই না কল্যাণময়! স্বয়ং আসমান থেকে আল্লাহ তোমার উদ্দেশ্যসমূহ বাস্তবায়নে সহযোগিতার হাত প্রসারিত রেখেছেন। তোমার প্রজাবৎসল নেক নিয়তের রাস্তাগুলোকে ফেরেশতারা পরিষ্কার করছে। তোমারই নিয়তের হরকতে আল্লাহ আমাকে প্রেরণ করেছেন’।[5]
তৃতীয়তঃ তিনি ইংরেজ গভর্নমেন্টকে আল্লাহর সুমহান রহমত ও আসমানী বরকত বলেছেন এবং ইংরেজ গভর্নমেন্টের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশকে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং তাকে বর্জন আল্লাহকে বর্জন হিসাবে গণ্য করেছেন।[6]
চতুর্থতঃ তিনি আকাশে আল্লাহর এবং যমীনে বৃটিশ সরকারের হুকুম মান্য করা এবং বৃটিশ সরকারের অবাধ্যতাকে আল্লাহ ও রাসূলের অবাধ্যতা হিসাবে নিজের ধর্মস্থির করেছেন।[7]
পঞ্চমতঃ তিনি ইংরেজ গভর্নমেন্টের সহযোগিতা ও আনুগত্য স্বরূপ পঞ্চাশ হাযারের কাছাকাছি বই, পুস্তিকা ও প্রচারপত্র লিখে ছাপিয়েছেন। ইংরেজ সংক্রান্ত মির্যা ছাহেবের এসব লেখা যদি একত্রিত করা হয় তবে পঞ্চাশটি আলমারীতে হয়তো তার সংকুলান হবে না।[8]
ষষ্ঠতঃ সবচেয়ে বড় কথা, তিনি ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-জিহাদকে কেবল জোরালো ভাষায় হারাম ও মানসূখ বলেননি বরং ইংরেজের বিরুদ্ধে অন্তরে বিদ্রোহ ও শত্রুতা পোষণকারীকেও আহম্মক, গন্ডমূর্খ, নির্বোধ জাহেল, কাটমোল্লা, আল্লাহর দুশমন, নবী অস্বীকারকারী, দুষ্টু, বজ্জাত, হারামী, বদকার, নালায়েক, যালেম, চোর, ডাকাত এবং এ জাতীয় অনেক অশ্লীল শব্দে সম্বোধন করেছেন।
সপ্তমতঃ ঐ সময়ে যেখানেই ইংরেজ ও মুসলমানদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে সেখানেই মির্যার অনুসারীরা নিজেদের নবীর শিক্ষা অনুসারে মুসলমানদের সাহায্য-সহযোগিতার পরিবর্তে ইংরেজদের সহযোগিতা করেছে এবং তাদের বিজয় ও সাহায্যের জন্য দো‘আ করেছে। ইংরেজদের বিজয় এবং মুসলমানদের পরাজয়ে তারা উৎসবের আয়োজন করেছে।
উদাহরণস্বরূপ ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যখন তুর্কীরা পরাজিত হয় এবং ইংরেজরা কিছু আরব ভূমি তুরস্কের ইসলামী খিলাফত থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়, তখন সেই খুশীতে মির্যার উম্মত কাদিয়ানীদের মনোভাব লক্ষণীয় :
‘হযরত মসীহ মাওঊদ বলেছেন, গভর্নমেন্ট আমার তরবারি। অতএব আমরা আহমদীরা এই বিজয়ে (বাগদাদ বিজয়ে) কেন খুশী হব না? ইরাক-আরবে হোক আর শাম-সিরিয়ায় হোক সর্বত্রই আমরা আমাদের তরবারির ঝলকানি দেখতে চাই। এ বিজয়ের পালে প্রকৃতপক্ষে হাওয়া যুগিয়েছেন দু’জন ফেরেশতা। গভর্নমেন্টকে সাহায্য করার জন্য আল্লাহ তাদেরকে পাঠিয়েছিলেন’।[9]
এর কিছুকাল আগে ইসলামী তুরস্কের উপর হামলা করে রাশিয়া তাদের কিছু এলাকা দখল করে নিলে তার উপর মির্যায়ীরা যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল তা লক্ষ্য করুন!
‘সদ্যপ্রাপ্ত সংবাদে জানা যাচ্ছে যে, রাশিয়া বরাবরের মতো তুর্কী ভূমিতে ঢুকে পড়ছে।... আল্লাহ তা‘আলা যালেম নন। তার ফায়ছালা সঠিক ও যথার্থ। আমরা তার এ ফায়ছালায় সন্তুষ্ট’।[10]
২৭শে নভেম্বর ১৯১৮ সালে তুরস্কের চূড়ান্ত পরাজয় ঘটলে এ উপলক্ষ্যে কাদিয়ানে এক জমকালো আলোকসজ্জা ও উৎসবের আয়োজন করা হয়। এ প্রসঙ্গে ‘আল-ফযল’ লিখেছে, ‘বড়ই চিত্তাকর্ষক ও আনন্দ উদ্রেককারী এ উৎসবের প্রভাব সুদূরপ্রসারী এবং দেখার মতো। এতে বৃটিশ সরকারের প্রতি আহমদিয়া জনগণের আন্তরিক বিশ্বস্ততার ব্যাপক প্রতিফলন ঘটেছে’।[11]
অষ্টমতঃ মির্যা ছাহেব ইংরেজদের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তিও করেছিলেন। তিনি তার দলীয় লোকদের সাহায্যে এমন কিছু ‘অবুঝ’ মুসলমানের নাম-ঠিকানাসহ একটি তালিকা প্রস্ত্তত করে বৃটিশ সরকারের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, যারা হিন্দুস্থানকে দারুল হারব বা যুদ্ধক্ষেত্র হিসাবে মনে করত।[12]
উপরোক্ত আটটি কারণে মির্যা ছাহেবের বৃটিশ সরকারের সাহায্য-সহযোগিতা এবং অন্য পক্ষে মুসলমানদের কতিপয় আলেমের ইংরেজের প্রতি আনুগত্য ও ইংরেজ তোষণের মাঝে যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য রয়েছে, তা ভালোভাবেই উপলব্ধি করা যায়। উভয় পক্ষের কর্মকান্ডকে এক জাতীয় প্রমাণ করে মির্যা ছাহেবের ইংরেজপূজা আড়াল করা যাবে। বরং উভয় পক্ষের শব্দ চয়ন থেকে শুরু করে চিন্তা-চেতনা ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের মাঝে এত ব্যাপক ও বিশাল পার্থক্য রয়েছে যে, তাদের উল্লেখিত দশ-বিশটা উদ্ধৃতি দিয়ে নয়, বরং শত শত উদ্ধৃতি দিয়েও তা ঘুচানো সম্ভব হবে না।
আহলেহাদীছ জামা‘আতের উপর ইংরেজ সরকারের বশ্যতা স্বীকার সম্পর্কিত অভিযোগের সত্যতা বিচার :
‘ইশা‘আতুস সুন্নাহ’ পত্রিকার কতিপয় উদ্ধৃতির ভিত্তিতে আহলেহাদীছ জামা‘আতের উপর ইংরেজ সরকারের বশ্যতা স্বীকারের অভিযোগ বড়ই আজব ব্যাপার। এটা ঠিক যে, (উক্ত পত্রিকার সম্পাদক) মাওলানা মুহাম্মাদ হুসাইন বাটালভী মরহূম এমন বশ্যতার খেয়াল প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু ভাববার বিষয় এই যে, আহলেহাদীছ কি শুধু মাওলানা বাটালভী একাই? এককভাবে তার খেয়ালই কি সমগ্র আহলেহাদীছ জামা‘আতের উপর চাপিয়ে দিতে হবে? তিনি জামা‘আতের একজন সদস্য ছিলেন মাত্র। যিনি অন্যান্য কতিপয় আলেমের মতো কিছু কারণ বশত ইংরেজ সরকারের আনুগত্য প্রকাশ করতেন। কিন্তু তিনি ছাড়া অন্যান্য আহলেহাদীছ আলেমদের অধিকাংশই যে ইংরেজের বিরুদ্ধে জিহাদে লিপ্ত ছিলেন সে ঐতিহাসিক সত্য কি অস্বীকারযোগ্য?
যে ছাদেকপুরী আলেমগণ সাইয়েদ আহমাদ শহীদ (রহঃ) ও শাহ ইসমাঈল শহীদ (রহঃ)-এর শাহাদাতের পর অতুলনীয় দৃঢ়তা ও উদ্দীপনা সহকারে জিহাদ আন্দোলনকে সামনে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তারা কি আহলেহাদীছ ছিলেন না? একথা কি সত্য নয় যে, ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের ব্যর্থতার পর যে দলের লোকদের উপর ইংরেজ সরকার সবচেয়ে বেশী যুলুম ও বর্বরতা চালিয়েছিল, তারা ছিলেন আহলেহাদীছ? শুধু ১৮৬৩ সাল থেকে নিয়ে ১৮৭০ সাল পর্যন্ত সাত বছরের স্বল্প সময়ের মধ্যে এই জামা‘আতের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পাঁচ পাঁচটি বড় মামলা দেওয়া হয়েছিল। আম্বালায় একটি (১৮৬৪ খৃ.), পাটনায় দু’টি (১৮৬৫ ও ১৮৭০ খৃ.), মালদায় একটি (১৮৭০ খৃ.) ও রাজমহলে একটি (১৮৭০ খৃ.) মামলা করা হয়েছিল। এসব মামলায় জামা‘আতের নেতৃবৃন্দ ও আলেমদেরকে ফাঁসির পাটাতনের উপর হেঁচড়ানো হয়েছিল। এছাড়াও তাদের সম্পত্তি বাযেয়াফ্ত করা হয়েছিল এবং কালাপানিতে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল। জেলের অন্ধকার নির্জন কুঠরীগুলোকে ঐ পাগলপারারাই আবাদ করেছিলেন। ঐ মুজাহিদদের ক্রিয়াকলাপই ইংরেজদের অতিষ্ঠ করে ছেড়েছিল, যাদের ‘ওহাবী’ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। এই ওহাবী কারা ছিলেন? হান্টার ছাহেবের বই পড়লে জানতে পারা যাবে, তারা ছিলেন আহলেহাদীছ জামা‘আতের লোক।
মোটকথা, অল্প কিছু ব্যক্তি ছাড়া আহলেহাদীছের অধিকাংশ লোক শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদে সোচ্চার ছিলেন। ইংরেজদের যে ধরনের চাটুকারিতা ও মোসাহেবী পরলোকগত মির্যা ছাহেবের রীতি-নীতি ও অভ্যাস ছিল, সে ধরনের চাটুকারিতা ও মোসাহেবী না আমরা আহলেহাদীছরা কখনো করেছি, না অন্য কোন মনীষীরা করেছেন।
চিন্তার আরেকটি দিক : উপরোক্ত আলোচনার সাথে এদিকটাও ভেবে দেখার বিষয় যে, মির্যা ছিলেন নবুঅতের দাবীদার। যদিও মুসলিম আলেমকুল শেষ নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর পরে অন্য কারো জন্য নবুঅতের দাবীকে কুফরী গণ্য করেন। কতিপয় আলেমের ইংরেজ সরকারের আনুগত্য ও তোষণ নীতি আর মির্যার বৃটিশ সরকারের সহযোগিতাকে ঈমানের অংশ বানানোর মধ্যে যে আকাশ-পাতাল তফাৎ রয়েছে (ইতিপূর্বে সে আলোচনা আমরা করেছি) তা যদি কিছুক্ষণের জন্য মুলতবী রাখা হয়, তবুও চিন্তার বিষয় যে, যারা নবী নন, ক্ষেত্র বিশেষে হয়তো তাদের পা হোঁচট খেতে পারে, দ্বীনের মোকাবিলায় হয়তো তাদের মধ্যে দুনিয়াবী স্বার্থ প্রাধান্য পেতে পারে। হ’তে পারে জায়গা বিশেষে তারা সেরকম দৃঢ়তা ও ধৈর্য দেখাতে পারেন না যা কুফরের মোকাবিলায় প্রয়োজন। নবী নন এমন ব্যক্তিদের জন্য কিছু কিছু জায়গায় অবকাশের উপর আমল করার অনুমতিও রয়েছে; কিন্তু আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামদের জন্য দ্বীনের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে দুনিয়াবী স্বার্থ ও সুযোগ-সুবিধা লাভ করা কোনভাবেই জায়েয ও বৈধ নয়। তাঁদের এমন অবকাশ কখনও দেওয়া হয়নি। নবীগণ ছিলেন কুফরীর বিরুদ্ধে উলঙ্গ তরবারি এবং নবুঅতের রাস্তায় আগত বিপদাপদ মোকাবিলায় ধৈর্যের এক অবিচল পাহাড়। তাঁরা কখনই তাঁদের উম্মতকে দাসত্বের সবক শিখাতেন না।
কিন্তু জানি না, মির্যা ছাহেব কোন কিসিমের ‘নবুঅতে’ ভূষিত হয়েছিলেন যে, তিনি কুফরীর মোকাবিলার পরিবর্তে কাফেরের আনুগত্যকে ফরয এবং ঈমানের অংশ স্থির করলেন! জাতিকে ইংরেজের গোলামী থেকে মুক্তির বদলে জাতির মধ্যে গোলামীর যিঞ্জীর পাকাপোক্ত করার বন্দোবস্ত করলেন! নিজ আল্লাহর কাছে ইংরেজ কাফেরদের থেকে নাজাতের দো‘আর বদলে তাদের বিজয় ও সাহায্য এবং তাদের স্থায়িত্ব ও দৃঢ়তার দো‘আ করে গেলেন! কি বিস্ময়কর ব্যাপার! মানব জাতির ইতিহাসে কি এমন ভূমিকা পালনকারী কোন নবী কিংবা সংস্কারকের সাক্ষাৎ মিলবে? এ কথাতেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে, মির্যা ছাহেব সেই আল্লাহর প্রেরিত নবী নন, যিনি কুফরীর মোকাবিলা করার হুকুম দিয়েছেন। তিনি ছিলেন বরং ইংরেজের কূটনীতিজাত নবী, যার উদ্দেশ্য ছিল কেবলই মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য ও বিভেদ সৃষ্টি করা।
এ কারণে কাদিয়ানীরা নিজেদের নবীকে বাঁচাতে এক্ষেত্রে ইংরেজদের আনুগত্যসূচক অন্যদের যেসব উদ্ধৃতি ও বরাত তুলে ধরেন তা বিলকুল বেমানান ও বেখাপ্পা। আর ইংরেজের আনুগত্য ও বিরোধিতাই কেবল হক ও বাতিল নির্ণয়ের মানদন্ড নয়, না এ দৃষ্টিকোণ থেকে হক-বাতিলের মীমাংসা কখনো করা হয়েছে। শী‘আরা তো সামগ্রিকভাবে ইংরেজের বশংবদ ছিল। যার স্বীকারোক্তি খোদ হান্টার তার বইয়ে করেছেন। কিন্তু তাদের এই কর্মকে ভিত্তি ধরে তো কখনো তাদের সম্পর্কে বলা হয়নি যে, ইংরেজ তোষণ হেতু শী‘আরা একটি ভ্রান্ত সম্প্রদায়।
একজন নবীর হক কিংবা বাতিল হওয়ার ফায়ছালা প্রদানকারী মানদন্ড বরং এটাই যে, তিনি সারাটা জীবন কুফরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পতাকা উড্ডীন রেখেছেন, না-কি তার জীবন কুফরের সাহায্য-সহযোগিতায় পার করেছেন। তিনি তার উম্মতকে কাফেরের গোলামী থেকে মুক্ত করার অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে গেছেন, নাকি তাদেরকে কাফেরের গোলামীর শিকলে চিরকাল আবদ্ধ থাকার উপর খুশী থেকেছেন। যিনি কুফরের সাহায্য-সহযোগিতায় জীবন পার করেন এবং নিজ উম্মতকে কাফেরের গোলামীর শিকলে চিরকাল আবদ্ধ থাকার উপর খুশী থাকেন তিনি কস্মিনকালেও নবী হ’তে পারেন না।
এদিক থেকে মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী নবুঅতের পদ দূরে থাক তাজদীদ ও সংস্কারকের পদাধিকারী হওয়ার যোগ্যতাও রাখেন না। কেননা কোন যুগ-সংস্কারক এবং জাতির বড় কোন নেতা কখনো নিজ জাতিকে গোলামীর শিক্ষা দেননি। মির্যা যদি কোন সাধারণ লোক হতেন, তবে তার কর্মকান্ডের ধারা উপেক্ষা করা যেত। কিন্তু তিনি তো নিজেকে নবুঅত ও তাজদীদের উচ্চমার্গের ব্যক্তি হিসাবে দাবী করেছেন এবং তার অনুসারীরা যেভাবে তার এ নবুঅত ও তাজদীদের দাবীর পক্ষে একপায়ে খাড়া, তাতে তার জীবনভর ইংরেজ তোষণের দিকটা মোটেই উপেক্ষা করা চলে না। তার এ কর্মকান্ডই তার মিথ্যুক হওয়ার সুস্পষ্ট প্রমাণ।
মানুষের বড় বড় ভুল অনেক হ’তে পারে। যেসব আলেমের লেখা ‘আল-ফুরক্বান’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, সেসব আলেমের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষাকারী দলগুলো সেগুলিকে নিজেদের লোকদের ভুল বলে এড়িয়ে যেতে পারেন। তাদের এ স্বীকৃতিতে তাদের মতের উপর কোন প্রভাবও পড়বে না। কিন্তু কাদিয়ানীরা কি তাদের নবীর এহেন কর্মকান্ডকে ভুল আখ্যায়িত করার সাহস করে? আর এরূপ করলে তার নবুঅতের প্রাসাদ ভেঙে খান খান হয়ে ধূলোয় মিলে যাবে না?[13]
মাওলানা মুহাম্মাদ হুসাইন বাটালভী (মৃ. ১৯২০ খৃ.) এবং জিহাদ আন্দোলন :
মাওলানা মুহাম্মাদ হুসাইন বাটালভী মরহূম সম্পর্কে আগের পৃষ্ঠাগুলোতে যা কিছু বলা হয়েছে তা ঐ যুগের সাথে সম্পর্কিত, যখন মাওলানা মরহূম হানাফীদের সাথে ফিক্বহ বিষয়ক মাসআলা-মাসায়েল নিয়ে কলমযুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। সম্ভবত হানাফীদের সঙ্গে ঐ লড়াইয়ের ফলে তিনি নিজেকে জিহাদ আন্দোলন থেকে গুটিয়ে নেন এবং অন্য দিকে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। নচেৎ প্রথম দিকে তিনিও অন্যান্য আহলেহাদীছ আলেমদের মতো জিহাদ আন্দোলনে শরীক ছিলেন এবং মুজাহিদদের তৎপরতায় শামিল ছিলেন। এ প্রসঙ্গে ‘হিন্দুস্তান মেঁ ওহাবী তাহরীক’-এর লেখক পাটনার এক গোপন বৈঠকের বিষয়ে লিখেছেন,
‘এক পুলিশী রিপোর্টে পাটনার কমিশনারকে জানানো হয় যে, বিশিষ্ট ওহাবীদের আরেকটি বৈঠক সিরাজগঞ্জে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে নাযীর হুসাইন তার ভাগ্নীর বিবাহ অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার বাহানায় উপস্থিত হয়েছিলেন। এই অনুষ্ঠান ওহাবীদের একস্থানে সমবেত হওয়ার একটা সহজ কৌশল হয়ে দাঁড়ায়। উপস্থিত নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন নাযীর হুসাইন, মুহাম্মাদ হুসাইন লাহোরী (বাটালভী) ও ইব্রাহীম আরাভী। বৈঠকের উদ্যোক্তা ও আয়োজক ছিলেন ইব্রাহীম। বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিল তাদের সাহায্য লাভ করা এবং দেশকে ‘দারুল হারব’ বা ‘যুদ্ধ এলাকা’ ঘোষণা দেওয়া। এ সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছিল যে, যেহেতু সীমান্তের ওহাবী রাজ্যের হিন্দুস্থানের সাথে যোগাযোগ ও সহযোগিতা তুলনামূলকভাবে খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে, তাই হিন্দুস্থান থেকে আরো স্বেচ্ছাসেবক ও আর্থিক সহযোগিতা প্রেরণের চেষ্টা চালাতে হবে’।[14]
এ উদ্ধৃতি অনুসারে মাওলানা বাটালভীর একসময় জিহাদ আন্দোলনের সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত থাকার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। তা সত্ত্বেও পরবর্তীতে তাঁর অবস্থানে পরিবর্তন এসেছিল। যার বিবরণ ও ধরণ স্পষ্ট করতে স্বতন্ত্র একটি প্রবন্ধের দরকার। আল্লাহ কখনো তাওফীক দিলে ইনশাআল্লাহ তা নিয়ে কলম ধরা যাবে। তারপরও এ সত্য নিয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, আহলেহাদীছ জামা‘আত মাওলানা বাটালভীর অবস্থানের বিপরীতে জিহাদ আন্দোলনে সর্বদাই শরীক থেকেছেন। পূর্বের পৃষ্ঠাগুলোতে সে কথা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
মূল (উর্দূ): হাফেয ছালাহুদ্দীন ইউসুফ
পাকিস্তানের প্রখ্যাত আহলেহাদীছ আলেম, লেখক ও গবেষক; সাবেক সম্পাদক, আল-ই‘তিছাম, লাহোর, পাকিস্তান।
অনুবাদ : মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
ঝিনাইদহ।
[1]. তাবলীগে রিসালাত, ৩/১৯।
[2]. নূরুল হক, ১/৩৩-৩৪।
[3]. তিরয়াকুল কুলূব ২৬ পৃ.।
[4]. সিতারায়ে ক্বায়ছারাহ ১০ পৃ.।
[5]. ঐ, ১৫ পৃ.।
[6]. শাহাদাতুল কুরআন, ৮৬ পৃ.।
[7]. ঐ, ১২, ৮৬ পৃ.।
[8]. তিরয়াকুল কুলূব, ২৫ পৃ.।
[9]. আল-ফযল, ৭ই সেপ্টেম্বর ১৯১৮।
[10]. ঐ, ১৭ই নভেম্বর ১৯১৪।
[11]. ঐ, ৩রা ডিসেম্বর ১৯১৮।
[12]. তাবলীগে রিসালাত ৫/১১।
[13]. সাপ্তাহিক আল-ই‘তিছাম, লাহোর, ৩০শে অক্টোবর ১৯৭০।
[14]. ড. ক্বেয়ামুদ্দীন আহমাদ, হিন্দুস্তান মেঁ ওহাবী তাহরীক, পৃ. ৩৩৪, ৩৩৫, নাফীস একাডেমী, করাচী।