হিজরী প্রথম ও দ্বিতীয় শতকে হাদীছ সংকলন :
প্রথম হিজরী শতাব্দীর শেষভাগে হাদীছের আনুষ্ঠানিক লেখনী শুরু হয়েছিল। আব্দুল আযীয ইবনু মারওয়ান মিসরের গভর্নর থাকাকালীন (৬৫হি.-৮৫হি.) হাদীছ সংকলনের আনুষ্ঠানিক প্রচেষ্টা হাতে নিয়েছিলেন। তিনি হিমছের অধিবাসী কাছীর ইবনু মুর্রা আল-হাযরামীকে নির্দেশ দেন আবূ হুরায়রা (রাঃ) ব্যতীত অন্যান্য ছাহাবীদের নিকট থেকে যে সকল হাদীছ শুনেছেন তা লিপিবদ্ধ করার জন্য। কেননা আবূ হুরায়রা (রাঃ)-এর হাদীছ তৎপূর্বেই সংগৃহীত হয়েছিল। কাছীর ইবনু মুর্রা ৭০ জন বদরী ছাহাবীর সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন।[1] তবে এই প্রচেষ্টার ফলাফল কি হয়েছিল তা অজ্ঞাত রয়ে গেছে। অতঃপর তাঁর সন্তান ওমর ইবনু আব্দিল আযীয (৬১-১০১হি.) খেলাফতে আসীন হয়ে মদীনায় তাঁর নিযুক্ত গভর্নর আবূ বকর ইবনু হাযম আনছারী (১২০হি.)-এর নিকট ফরমান পাঠান, انْظُرْ مَا كَانَ مِنْ حَدِيثِ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَاكْتُبْهُ ، فَإِنِّى خِفْتُ دُرُوسَ الْعِلْمِ وَذَهَابَ الْعُلَمَاءِ ‘তুমি রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছ অনুসন্ধান কর এবং তা লিপিবদ্ধ কর। কেননা আমি দ্বীনের জ্ঞান লোপ পাওয়া এবং আলেমদের বিদায়ের ভয় করছি’।[2] তিনি তাকে আরও নির্দেশ দেন, আমরাহ বিনতু আব্দির রহমান (৯৮হি.) এবং কাসিম ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু আবী বাকর (১২০হি.)-এর কাছে সংরক্ষিত হাদীছসমূহ লিপিবদ্ধ করতে।[3] কেননা তারা ছিলেন আয়েশা (রাঃ)-এর হাদীছ সম্পর্কে সর্বাধিক অবগত। কেবল তা-ই নয়, তিনি অন্যান্য ইসলামী রাজ্যগুলোতেও একই ফরমান জারী করলেন।[4] তবে আবূবকর ইবনু হাযম তাঁর জমাকৃত হাদীছসমূহ প্রেরণের পূর্বেই ওমর ইবনু আব্দিল আযীযের মৃত্যু ঘটে।
অবশেষে ইবনু শিহাব যুহরী (১২৪হি.) সর্বপ্রথম সামগ্রিক আকারে এবং সফলভাবে হাদীছ সংকলন কর্ম শুরু করেন।[5] ওমর ইবনু আব্দিল আযীয (১০১হি.)-এর আহবানে সাড়া দিয়ে তিনি মদীনার হাদীছসমূহ একত্রিত করে খলীফার কাছে প্রেরণ করেন। খলীফা এই সংকলনটির একটি করে কপি ইসলামী সাম্রাজ্যের সকল শহরে প্রেরণ করেন। এটিই ছিল হাদীছ সংকলনের সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিক প্রয়াস।[6] এভাবেই হিজরী দ্বিতীয় শতকে শুরু থেকে হাদীছ সংকলন আন্দোলন শুরু হয় এবং বিদ্বানগণ এ বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেন। প্রধানত জাল হাদীছের উদ্ভব তাদেরকে সুন্নাহ সংরক্ষণ এবং তাতে দুষ্টমতি মানুষের অনৈতিক হস্তক্ষেপ প্রতিরোধে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
সরকারী এই নির্দেশের ফলে তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন শহরে যে সকল ওলামায়ে কেরাম নিজস্ব শিক্ষাগার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে হাদীছের শিক্ষাদান করতেন, তাঁরাই হাদীছ সংকলনে তথা লিখিতভাবে সংরক্ষণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। চতুর্থ হিজরী শতকের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনু নাদীম তাঁর বিখ্যাত ‘আল-ফিহরিস্ত’ গ্রন্থে হিজরী ২য় শতকে রচিত প্রায় অর্ধশতাধিক হাদীছগ্রন্থের নাম তালিকাভুক্ত করেছেন।[7] তাদের মধ্যে সুপ্রসিদ্ধ কয়েকজন মুহাদ্দিছের নাম নিম্নরূপ।[8]
এ যুগে হাদীছ গ্রন্থাবদ্ধকরণের পদ্ধতি ছিল-
(ক) তাঁরা হাদীছের বিষয়ভিত্তিক অধ্যায় সাজাতেন এবং হাদীছের সাথে ছাহাবীদের বক্তব্য এবং তাবেঈদের ফৎওয়াসমূহ সংযুক্ত করতেন।
(খ) প্রথম যুগে অনানুষ্ঠানিকভাবে লিখিত ছাহাবী ও তাবেঈদের ‘ছহীফা’, ছোট ছোট সংকলনসমূহ বা ‘জুয’ ছিল এবং মৌখিক বর্ণনা ছিল এ সকল গ্রন্থের প্রধান উৎস। এছাড়া ছাহাবীদের মন্তব্য এবং তাবেঈদের ফৎওয়াও ছিল অন্যতম উৎস।[9]
(গ) এ সকল সংকলনকে তাঁরা ‘মুছান্নাফ’, ‘সুনান’, ‘মুওয়াত্ত্বা’, ‘জামি‘’ প্রভৃতি নামে নামকরণ করা শুরু করেন। এছাড়া একক বিষয়ভিত্তিক যেমন- ‘জিহাদ’, ‘যুহদ’, ‘মাগাযী ওয়াস সিয়ার’ প্রভৃতি বিষয়েও পৃথক হাদীছগ্রন্থ সংকলন করা হয়েছে।
হিজরী তৃতীয় শতকে হাদীছ সংকলন :
হিজরী দ্বিতীয় শতকের শেষভাগ থেকে শুরু করে হিজরী তৃতীয় শতকের শেষভাগ পর্যন্ত ছিল হাদীছ সংকলনের স্বর্ণযুগ। এই শতাব্দীতে হাদীছের সংকলনসমূহে ছাহাবী এবং তাবেঈদের উদ্ধৃতিসমূহ সচরাচর স্থান পায় নি। সংকলকগণ সাধারণভাবে প্রত্যেক ছাহাবীর হাদীছসমূহ আলাদাভাবে জমা করতে শুরু করেন, যদিও বিষয়বস্ত্ত হ’ত ভিন্ন। এইরূপ সংকলনকে বলা হ’ত মুসনাদ। নিম্নে মুসনাদ সংকলকদের নাম উল্লেখ করা হ’ল[10] :
এ সকল মুসনাদ সংকলনের মধ্যে কিছু প্রকাশিত হয়েছে। কিছু অপ্রকাশিত অবস্থায় পান্ডুলিপি আকারে রয়ে গেছে। কিছু অদ্যাবধি পাওয়া যায়নি। এখনও ইস্তাম্বুল, মরক্কো, সিরিয়া এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের প্রাচীন লাইব্রেরীতে শত-সহস্র আরবী পান্ডুলিপি পড়ে আছে। হয়তবা অনুসন্ধান করলে এখনও মিলতে পারে।[11]
যাই হোক মুসনাদ সংকলনসমূহে ছহীহ হাদীছের সাথে সাথে বহু যঈফ এবং জাল হাদীছও মিশ্রিত ছিল। কেননা মুসনাদ সংকলকগণ প্রাথমিকভাবে হাদীছের ভান্ডার এবং সনদসমূহ সংরক্ষণ করতে চেয়েছিলেন। যাতে একত্রিত করার পর পরবর্তী কালে সূক্ষ্মভাবে যাচাই-বাছাই করা সম্ভব হয়। ফলে হাদীছ শাস্ত্রে সুদক্ষ আলিমগণ ব্যতীত এসব গ্রন্থ থেকে উপকৃত হওয়া কঠিন ছিল। তাছাড়া কোন বিষয়ে ইসলামী শরী‘আতের বিধান জানতে চাইলে এসব গ্রন্থে নির্দিষ্ট হাদীছসমূহ একক স্থানে পাওয়া যেত না। ফলে এই সমস্যা নিরসনের জন্য ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল আল-বুখারী (২৫৬হি.) তাঁর শিক্ষকের পরামর্শে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সুদীর্ঘ পরিশ্রমের পর তিনি কেবল ছহীহ হাদীছগুলোকে একত্রিত করেন এবং শারঈ বিধি-বিধানগুলো সহজে জানার জন্য হাদীছগুলো বিষয়ভিত্তিক অধ্যায় এবং পরিচ্ছদে বিন্যস্ত করেন। তিনি এর নামকরণ করেন ‘আল জামে‘উছ-ছহীহ’। অতঃপর তাঁর পদাংক অনুসরণ করেন ইমাম মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ (২৬১হি.)। এভাবে হাদীছশাস্ত্রের সবচেয়ে বিশুদ্ধ সংকলনদ্বয় জনসম্মুখে আসে। এর ফলে সাধারণ আলিম এবং ফক্বীহদের জন্য শরী‘আতের বিধি-বিধান জানা সহজসাধ্য হয়ে যায়।
|
হাদীছের সংকলনসমূহের মধ্যে ইমাম বুখারী এবং মুসলিম-এর সংকলিত এই ‘ছহীহ’দ্বয় সর্বাধিক প্রসিদ্ধ এবং বিশুদ্ধ। এই সংকলনকর্মে তাঁরা মূলত নির্ভর করেছিলেন পূর্ববর্তী মুসনাদ গ্রন্থসমূহের উপর। অতঃপর হাদীছের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছহীফা সমূহের উপর, যেগুলো সনদসহ সংকলন করেছিলেন হাদীছ সংগ্রাহকগণ তাঁদের পূর্ববর্তী সংগ্রাহক ইমামগণের নিকট থেকে; কখনও শ্রবণসূত্রে, কখনও বা লেখনীর সূত্রে। সেই সাথে আরও সংগ্রহ করেছেন তৎকালীন যুগে প্রচলিত ধারাবাহিক মৌখিক বর্ণনাসূত্র থেকেও। এভাবে হারিয়ে যাওয়া মুসনাদ গ্রন্থসমূহের অনেক হাদীছও তাঁরা সংরক্ষণ করতে সক্ষম হন।
ইমাম বুখারী এবং মুসলিমের অনুসরণে তাঁদের সমসাময়িক এবং পরবর্তী বিদ্বানগণও ফিক্বহী ধারাবাহিকতায় তথা বিষয়ভিত্তিকভাবে হাদীছ সংকলনে প্রবৃত্ত হন। যেমন :
পরবর্তী অনুচ্ছেদে ‘কুতুবে সিত্তাহ’ খ্যাত উপরোক্ত ছয়টি গ্রন্থের বিস্তারিত বিবরণ আসবে। মূলত এই ছয়টি সংকলনকে কেন্দ্র করেই মুসলিম বিদ্বানগণ হিজরী তৃতীয় শতককে সুন্নাহ সংকলনের স্বর্ণযুগ হিসাবে অভিহিত করেন। এ যুগে হাদীছ সংকলনের বৈশিষ্ট্য ছিল নিম্নরূপ :
ক. হাদীছের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ছয়টি সংকলন ‘ছহীহাইন’ এবং ‘সুনান আরবা‘আহ’ এই যুগে সংকলিত হয়।
খ. রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছের সাথে ছাহাবী এবং তাবেঈদের মন্তব্যসমূহ উদ্ধৃতকরণ পরিত্যাগ করা হয়।
গ. হাদীছের শুদ্ধাশুদ্ধি উল্লেখ করার প্রবণতা সৃষ্টি হয়।
ঘ. হাদীছ সংগ্রাহক ওলামায়ে কেরাম হাদীছ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে মুসলিম সাম্রাজ্যের সর্বত্র ভ্রমণ শুরু করেন।
ঙ. তাঁরা একই সাথে হাদীছ মুখস্থকরণ এবং সংকলনের উপর সমানভাবে নির্ভর করতেন।
চ. জ্ঞানের চর্চা তুঙ্গে ওঠে। বিভিন্ন শহরে শক্তিশালী ইলমী কেন্দ্র গড়ে উঠতে থাকে। ফলে হাদীছ শাস্ত্রের উদ্ভব হয় এবং হাদীছ সমালোচক বিদ্বানগণের জন্ম হয়।
ছ. হাদীছের বিশুদ্ধতা নিরূপণের ব্যবস্থা আরও শাণিত করার উদ্দেশ্যে রিজাল শাস্ত্র তথা বর্ণনাকারীদের নির্ভরযোগ্যতা নির্ণয় শাস্ত্র প্রবর্তন করা হয়।[12]
(ক্রমশঃ)
[1]. ইবনু সা‘দ, আত-তাবাক্বাতুল কুবরা, ৭ম/৩১১; জামালুদ্দীন মিযযী, তাহযীবুল কামাল (বৈরূত : মুআস্সাসাতুর রিসালাহ, ১৯৮০খৃ.), ২৪/১৬০।
[2]. বুখারী, ১/৩১; দারেমী, হা/৫০৪-৫০৫।
[3]. ইবনু সা‘দ, আত-তাবাক্বাতুল কুবরা, ২/২৯৫; ইবনু আবী হাতিম, আল-জারহু ওয়াত তা‘দীল , ১/২১।
[4]. আবূ নাঈম আছফাহানী, তারীখু আছফাহান (বৈরূত : দারুল কুতুবিল-ইলমিয়াহ, ১৯৯০খৃ.), ১/৩৬৬।
[5]. ইমাম মালিক ইবনু আনাস (১৭৯হি.) বলেন, أول من دون العلم ابن شهاب ‘প্রথম হাদীছ সংকলন করেন ইবনু শিহাব’। দ্র. আবূ নাঈম আছফাহানী, হিলয়াতুল আওলিয়া, ৩/৩৬৩।
[6]. ইবনু আব্দিল বার্র, জামিঊ বায়ানিল ইলম, ১/৩২০, ৩৩১।
[7]. ইবনু নাদীম, আল-ফিহরিস্ত , পৃ. ২৭৭-২৮৪।
[8]. জালালুদ্দীন সুয়ূত্বী, তাদরীবুর রাবী, ১/৯৩; আল-কাত্তবানী, আর-রিসালাতুল মুসতাত্বরিফাহ, পৃ. ৮-৯; এ সকল পান্ডুলিপির প্রাপ্তিস্থান এবং বর্তমান অবস্থা উল্লেখ করেছেন ড. ফুয়াদ সেযগীন। দ্র. ড. ফুয়াদ সেযগীন, তারীখুত তুরাছ আল-আরাবী, ১/১৬৬-১৮০; ড. আকরাম যিয়া আল-ঊমরী, বুহূছুন ফী তারীখিস সুন্নাহ আল-মুশাররাফাহ, পৃ. ২৩২-২৩৪।
[9]. আবূ যাহূ, আল-হাদীছ ওয়াল মুহাদ্দিছূন, পৃ. ২৪৪।
[10]. বুহূছুন ফী তারীখিস সুন্নাহ আল-মুশাররাফাহ, পৃ. ২৩৪-২৩৮।
[11]. তাওফীক ওমর আস-সাইয়েদী তাঁর ‘লাক্বতুল আনাক্বীদ ফী বায়ানিল মাসানীদ’ গ্রন্থে এ পর্যন্ত প্রাপ্ত প্রকাশিত এবং অপ্রকাশিত মোট ৩৯৮টি মুসনাদের নাম উল্লেখ করেছেন।
[12]. দ্র. মুহাম্মাদ আবূ যাহূ, আল-হাদীছ ওয়াল মুহাদ্দিছূন, পৃ. ৩৬৪-৩৬৭।