‘আশরাফুল মাখলূকাত’ এই বাক্যাংশটি ইসলামী পরিভাষা তথা আরবী ভাষার শব্দ বিধায় উচ্চারণ-নিষিদ্ধ নামের মতো যারা মনে করেন, তারাও ‘মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব’ কথাটা অস্বীকার করেন না। মানুষ কেন শ্রেষ্ঠ জীব, তাদের শিং এবং চারটি পা নেই বলে? অবশ্য তা নয়। মানুষ শ্রেষ্ঠ জীব তার বুদ্ধি, বিবেক ও ধর্ম থাকার কারণেই। এগুলি না থাকলে সে পশুতুল্য শুধুই নয়, কখনও কখনও পশুরও অধম বিবেচিত হয়।

ডারউইনবাদী এবং স্বয়ম্ভুবাদীরা সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী নয়; তারা নাস্তিক। নাস্তিক যদিও না হয়, ডারউইনবাদ পড়ে অন্তত সংশয়বাদী হবেই। নাস্তিক এবং সংশয়বাদীর মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই। কেননা নাস্তিক বিশ্বাস বর্জনকারী এবং সংশয়বাদী বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মধ্যে দিশেহারা অবস্থায় হাবুডুবু খায়। আসলে উভয়েরই পরিণাম এক রকমের। প্রকৃতপক্ষে তারা কেউই স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাসী নয়।

বুদ্ধি মানুষকে কর্মকুশলতা শেখায়। বিবেক ভাল-মন্দ যাচাই-বাছাই করার ক্ষমতা যোগায়। আর ধর্ম মানুষকে পাপ ও পতন থেকে রক্ষা করে। পন্ডিতেরা বলেন, ‘ধৃ’ ধাতু থেকে ‘ধর্ম’ শব্দের উৎপত্তি। ‘ধৃ’ অর্থ ধারণ বা ধরে রাখা। বিশ্লেষণে বলা যেতে পারে যে, কতকগুলি সৎবিধি অনুসরণ করে চলা মানুষের কর্তব্য। আর তা-ই মানুষের ধর্ম। পশুদের জন্য সেরূপ কোন বিধি-বিধান নেই। কেননা তাদের বুদ্ধি-বিবেকও মানুষের মতো নেই বলেই তারা ধর্মাচরণের অযোগ্য। এ কারণেও মানুষ শ্রেষ্ঠ জীব।

সত্যিকারের ধার্মিক লোকেরা বিশ্বাস করে যে, মানুষকে ধর্ম বিধিও দিয়েছেন স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা। এটা কোন মানবরচিত বিধান নয়। Evolution Theory (ইভোলিউশন থিওরী) বা বিবর্তনবাদ চার্লস ডারউইন নামের একজন বিজ্ঞানীর ব্যক্তিগত চিন্তার ফসল, ‘গ্রন্থ সাহেব’ পাঞ্জাবের গুরু নানকের বাণী, ত্রিপিটক নেপালের (কপিলাবস্ত্ত) বুদ্ধদেবের (সিদ্ধার্থ) উপদেশমালা- এ সকলই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টজীব মানুষেরই উর্বর মস্তিষ্কের চিন্তার ফসল। এ ধরনের বহু কিছু মানুষের মস্তিষ্কে আসতে পারে। তাই বলে মানুষকে কখনও স্বয়ম্ভু বলা যাবে না। মানুষ স্রষ্টার সৃষ্টজীব। সকল মানুষকে সৃষ্টিকর্তার দেওয়া বিধান অনুসরণ করেই চলতে হবে। আর তাকেই বলে ধর্ম পালন। আর তা সঠিকভাবে পালন করলেই পাপ ও পতন থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

প্রশ্ন হচ্ছে- ৯০% মুসলমানের দেশকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র করতে হবে কেন? ধর্ম কি ক্ষতি করেছে এ দেশটার? ধর্মের কারণে এ দেশের মানুষের কোন্ অকল্যাণ ঘটেছে যে, দেশটাকে ধর্মনিরপেক্ষ না করলে আর চলে না? এটা কি সেই মেষশাবক আর নেকড়ের গল্পের মতো ঘটনা? মেষশাবকের শেষ প্রশ্ন : আমাকে খাবে কেন? কি দোষ করেছি আমি? নেকড়ের উত্তর : দোষের কোন কথা নয়। তোকে খাবই। বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার আমদানী কি সে রকমের ব্যাপার? প্রসঙ্গতঃ বলতে হয়, বাংলাদেশে ’৭০-এর নির্বাচনের পর একদল দ্বীনদার মুসলমান আশংকা করেছিলেন যে, আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করতে পারলে দেশে ইসলাম থাকবে না। বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের সংবিধান থেকে ইসলামী ভাবধারার বিষয়াবলী বর্জনের ঘোষণা, কুরআন বিরোধী নারী উন্নয়ণ নীতি প্রচলনের সিদ্ধান্ত, মাদরাসা শিক্ষায় ইসলামী বিষয়ের সংকোচন ইত্যাদি কিসের আলামত?

বাংলাদেশের লোকসংখ্যা যদি ষোল কোটি হয়, তবে তার মধ্যে প্রায় পনের কোটিই মুসলমান, যাদের ধর্ম ইসলাম এবং বাকী দেড় কোটির মধ্যে রয়েছে তিন ধর্মের মানুষ, যথা- হিন্দু, বৌদ্ধ ও খৃষ্টান। দেশের সংবিধানের শীর্ষে ‘বিসমিল্লা-হির রহমানির রহীম’ যে বাক্যটি প্রায় ১৫ কোটি লোকের ধর্ম বিধিমতে শোভা পাচ্ছে, তা তাদের সকল কাজের শুরুতে থাকা অপরিহার্য। কুরআন মাজীদের প্রতিটি সূরার প্রারম্ভে লেখা রয়েছে ‘বিসমিল্লা-হির রহমা-নির রহীম’। মুসলমান তাই প্রতি কাজের শুরুতে এটি বলে থাকেন। এ নিয়ম মুসলমানের কাছে অলংঘনীয়। হালাল পশুও ‘বিসমিল্লাহ’ বলে যবেহ না করলে সেই গোশত মুসলমানের জন্য হালাল নয়।

বাংলাদেশে ৭২ সালে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসাবে ধর্মনিরপেক্ষতা কেন গ্রহণ করা হয়েছিল? মনে হয়, দেশে ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ কোন কালেই সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল না। তা যদি প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের অনুসরণে হয়, তাহ’লে বলতে হবে যে, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ নীতি তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসীর হিন্দু ধর্মকে পাশ কাটিয়ে হয়নি, যেমন বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতা সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম ইসলামকে পাশ কাটিয়ে হচ্ছে। ভারতে হিন্দু ধর্মের কোন সংকোচন হয়েছে বলে শোনা  যায় না। সেখানে ধর্মভিত্তিক  দল গঠন নিষিদ্ধ করা হয়নি। কিংবা ধর্মশিক্ষাকে সংকুচিত করার চেষ্টাও নেই। যদি তা থাকত তাহ’লে নিশ্চয়ই তা নিয়ে আন্দোলন হতো। কিন্তু সে রকম খবর পাওয়া যায় না।

বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরও ‘বাঙালী’ বলে পরিচয় দিতে অসুবিধার কারণ নেই। তবে বাঙালী সংস্কৃতিকে তারা মেনে নেবেন না কিছুতেই, যেহেতু বাঙালী সংস্কৃতি হিসাবে যা চলছে তা ইসলাম ধর্মবিরোধী। দেখা যাচ্ছে, আমাদের দেশে এক দল লোক বর্ষবরণ, বসন্তবরণ এবং এরূপ আরো কিছু কিছু অনুষ্ঠান পালন করে, বাঙালী সংস্কৃতির নামে। যেগুলি হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত, হয়তো তাদের ধর্মীয় অনুশাসনও সমর্থন করে। কিন্তু ইসলামে সে সকল বিষয় নিষিদ্ধ। এইসব ইসলাম বিরোধী সংস্কৃতির চর্চা অবাধে চলতে পারে যদি রাষ্ট্রের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং বাঙালী জাতীয়তাবাদ বহাল থাকে। এজন্যই কি ৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাবার প্রতি কিছু লোকের এত আগ্রহ? ইতিহাস বলে, দূর অতীতে এদেশ ছিল হিন্দুদের দেশ। গোটা ভারতবর্ষই ছিল হিন্দুর দেশ। কালক্রমে এদেশে মুসলমানের আগমন ঘটে। আর মুসলমানেরা তাদের ধর্ম ইসলাম অনুসরণ করেই জীবন যাপন করেছে। আজও মুসলমানকে তাদের ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করেই চলতে হবে। বর্তমান বাংলাদেশে ৯০% মুসলমানের বসবাস। সেকারণ এদেশকে মুসলমানের দেশ বলা যেতে পারে। তাই বলে এদেশে অন্যান্য ধর্মের লোকের বসবাসে কোন অসুবিধার কারণও নেই। তাহ’লে ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে কি ধর্ম থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য? যদি তা হয়, তবে তা হবে ধর্মদ্রোহিতা।

সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ কুরআন পাকে ঘোষণা করেন, ‘তোমাদেরকে যা (কিতাব) দিয়েছি তা শক্ত করে ধর এবং তাতে যা আছে মনে রাখ, যাতে তোমরা মুত্তাক্বী হ’তে পার’ (বাক্বারাহ ৬৩)। কুরআন মাজীদে আরও বলা হয়েছে, ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ কর এবং শয়তানের অনুসরণ কর না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু’ (বাক্বারাহ ২০৮)। অতএব দ্বীনদার মুসলমান কখনও ধর্মনিরপেক্ষ হ’তে পারে না। ধর্ম তাদের রক্ষাকবচ। তাই ধর্মের মধ্যেই তাদের কল্যাণ নিহিত। তারা বাঙালী সংস্কৃতির নামে বিজাতীয় আচার-অনুষ্ঠান সমর্থন বা পালন করতে পারে না। তা থেকে তাদের দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে। কুরআন মাজীদে আল্লাহ যে সকল বিধান দিয়েছেন, তা তাদের কাছে অলংঘনীয়। তাই ধর্মনিরপেক্ষতা, নারী অধিকার, নারীর পর্দাহীনতা, বেগানা নারী-পুরুষের সহাবস্থান, অবাধ মেলামেশা যা কুরআনে নিষিদ্ধ রয়েছে, তা অমান্য করলে আল্লাহ এবং তাঁর কিতাবকে অস্বীকার করা হয়। আর এতে আল্লাহ এবং তাঁর কিতাবের প্রতি বিশ্বাস থাকে না। ইসলাম যে পাঁচটি মূল ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত তার প্রথম ভিত্তি হ’ল ঈমান (বিশ্বাস)। এটি হারালে অন্যগুলি মেনে চলার মানে হয় না। বিসমিল্লাহ-এ গলদ ঘটলে, সবই গলদপূর্ণ হয়ে যায়। মুসলমান বলে পরিচয় দিতে হ’লে আল্লাহ এবং তাঁর কিতাবের ও কিতাব বর্ণিত যাবতীয় বিষয়ের প্রতি মজবুত ঈমান থাকা প্রয়োজন। ধর্মপ্রাণ মুসলমান অবশ্যই আল্লাহর সংবিধান মেনে চলবে। এ সংবিধানের সংগে সাংঘর্ষিক কোন কার্যকলাপে দ্বীনদার মুসলমান থাকতে পারে না। আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই সত্য উপলব্ধির তাওফীক্ব দিন- আমীন!!

  মুহাম্মাদ হাবীবুর রহমান 

সম্পাদক, কালান্তর, রাজাবাড়ী, পিরোজপুর।







বিষয়সমূহ: বিধি-বিধান
অনুমতি গ্রহণের আদব সমূহ - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
যে সকল কর্ম লা‘নত ডেকে আনে (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
আলেমগণের মধ্যে মতভেদের কারণ (২য় কিস্তি) - আব্দুল আলীম বিন কাওছার
ছিয়ামের ফাযায়েল ও মাসায়েল - আত-তাহরীক ডেস্ক
আল-কুরআনে বিজ্ঞানের নিদর্শন (৩য় কিস্তি) - ইঞ্জিনিয়ার আসীফুল ইসলাম চৌধুরী
মাদ্রাসার পাঠ্যবই সমূহের অন্তরালে - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ছিয়ামের ফাযায়েল ও মাসায়েল
ছাহাবী ও তাবেঈগণের যুগে মহামারী ও তা থেকে শিক্ষা - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
ধর্মদ্রোহিতা - মুহাম্মাদ হাবীবুর রহমান
ইসলামী বাড়ীর বৈশিষ্ট্য - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত পরিচিতি (৩য় কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
মুহাসাবা (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
আরও
আরও
.