২৬. মুমিনদের ক্ষয়ক্ষতিতে উল্লসিত হওয়া :
মুমিনদের যে কোন ক্ষয়ক্ষতিতে উল্লসিত হওয়া মুনাফিকদের খুবই নীচ স্বভাব। তারা মুমিনদের শত্রু ভাবে বলেই এমনটা হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُواْ لاَ تَتَّخِذُواْ بِطَانَةً مِّنْ دُوْنِكُمْ لاَ يَأْلُونَكُمْ خَبَالاً وَدُّواْ مَا عَنِتُّمْ قَدْ بَدَتِ الْبَغْضَاءُ مِنْ أَفْوَاهِهِمْ وَمَا تُخْفِيْ صُدُوْرُهُمْ أَكْبَرُ قَدْ بَيَّنَّا لَكُمُ الآيَاتِ إِنْ كُنْتُمْ تَعْقِلُوْنَ- هَاأَنْتُمْ أُوْلاء تُحِبُّونَهُمْ وَلاَ يُحِبُّوْنَكُمْ وَتُؤْمِنُوْنَ بِالْكِتَابِ كُلِّهِ وَإِذَا لَقُوْكُمْ قَالُواْ آمَنَّا وَإِذَا خَلَوْاْ عَضُّواْ عَلَيْكُمُ الأَنَامِلَ مِنَ الْغَيْظِ قُلْ مُوْتُوْا بِغَيْظِكُمْ إِنَّ اللهَ عَلِيمٌ بِذَاتِ الصُّدُوْرِ- إِن تَمْسَسْكُمْ حَسَنَةٌ تَسُؤْهُمْ وَإِنْ تُصِبْكُمْ سَيِّئَةٌ يَفْرَحُوْا بِهَا وَإِنْ تَصْبِرُواْ وَتَتَّقُواْ لاَ يَضُرُّكُمْ كَيْدُهُمْ شَيْئاً إِنَّ اللهَ بِمَا يَعْمَلُوْنَ مُحِيْطٌ-
‘হে মুসলিমগণ! তোমরা মুমিন ব্যতীত অন্য কাউকে অন্তরঙ্গরূপে গ্রহণ কর না; তারা তোমাদের অমঙ্গল সাধনে কোন ত্রুটি করে না- তোমরা কষ্টে থাক, তাতেই তাদের আনন্দ। শত্রুতাপ্রসূত বিদ্বেষ তাদের মুখেই ফুটে বেরোয়। আর যা কিছু তাদের মনে লুকিয়ে রয়েছে, তা আরো অনেকগুণ বেশী জঘন্য। তোমাদের জন্য নিদর্শন বিশদভাবে বর্ণনা করে দেয়া হল, যদি তোমরা তা অনুধাবন করতে সমর্থ হও। দেখ! তোমরাই তাদের ভালবাস, কিন্তু তারা তোমাদের প্রতি মোটেও সদভাব পোষণ করে না। আর তোমরা সমস্ত কিতাবেই বিশ্বাস কর। অথচ তারা যখন তোমাদের সাথে এসে মিশে, বলে ‘আমরা ঈমান এনেছি’। পক্ষান্তরে তারা যখন পৃথক হয়ে যায়, তখন তোমাদের উপর রোষবশতঃ আঙ্গুল কামড়াতে থাকে। বলুন, তোমরা আক্রোশে মরতে থাক। আল্লাহ মনের কথা ভালই জানেন। তোমাদের যদি কোন মঙ্গল হয় তাহ’লে তাদের খারাপ লাগে। আর তোমাদের যদি অমঙ্গল হয়, তাহ’লে তাতে তারা আনন্দিত হয়। আর যদি তোমরা ধৈর্যধারণ কর এবং তাকওয়া অবলম্বন কর, তবে তাদের প্রতারণায় তোমাদের কোনই ক্ষতি হবে না। নিশ্চয়ই তারা যা কিছু করে সে সমস্তই আল্লাহর আয়াত্তে রয়েছে’ (আলে ইমরান ৩/১১৮-১২০)।
এসব আয়াতে
আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের অন্তরঙ্গ বন্ধু বানাতে তাঁর মুমিন বান্দাদের
নিষেধ করেছেন। মুমিনরা যেন তাদের গোপন বিষয় মুনাফিকদের কখনই অবহিত না করে।
তাদের শত্রুদের নিকট যেন কোন তথ্য গোপনে না বলে। মুনাফিকরা তাদের
শক্তি-সামর্থ্য মুমিনদের ক্ষতিতে ব্যয় করতে সামান্য অবহেলাও করবে না। তারা
যথাসাধ্য মুমিনদের বিরোধিতা করবে এবং তাদের ক্ষতি সাধন করবে। তাদের
বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের জাল বুনতে তারা যথাশক্তি উজাড় করে দিবে।
মুমিনরা যাতে চরম সংকটে পড়ে, তাদের উপর মুছীবতের পাহাড় চেপে বসে মুনাফিকরা
সেটাই কামনা করে।[1]
২৭. গচ্ছিত জিনিস আত্মসাৎ করা, কথোপকথনকালে মিথ্যা বলা, প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভঙ্গ করা এবং বাকবিতন্ডাকালে বাজে কথা বলা :
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَمِنْهُم مَّنْ عَاهَدَ اللهَ لَئِنْ آتَانَا مِنْ فَضْلِهِ لَنَصَّدَّقَنَّ وَلَنَكُوْنَنَّ مِنَ الصَّالِحِيْنَ- فَلَمَّا آتَاهُم مِّنْ فَضْلِهِ بَخِلُوْا بِهِ وَتَوَلَّواْ وَّهُم مُّعْرِضُوْنَ- قُلُوْبِهِمْ إِلَى يَوْمِ يَلْقَوْنَهُ بِمَا أَخْلَفُواْ اللهَ مَا وَعَدُوْهُ وَبِمَا كَانُواْ يَكْذِبُوْنَ-
‘ওদের মাঝে এমন কিছু লোকও আছে যারা আল্লাহর সাথে ওয়াদা করেছিল, যদি তিনি নিজ অনুগ্রহে আমাদের সম্পদ দান করেন, তাহ’লে আমরা অবশ্যই তার (একাংশ আল্লাহর পথে) দান করব এবং অবশ্যই আমরা সৎ লোকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব। অতঃপর যখন তিনি নিজ অনুগ্রহে তাদের ধন-সম্পদ দান করলেন, তখন তারা (দানের বদলে) কৃপণতা করতে শুরু করল এবং উপেক্ষার সাথে মুখ ফিরিয়ে নিল। ফলে তিনি তাদের অন্তরে মুনাফিকী বদ্ধমূল করে দিলেন সেদিন পর্যন্ত, যেদিন তারা তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করবে। এটা এ কারণে যে, তারা আল্লাহর সঙ্গে যে ওয়াদা করেছিল তা ভঙ্গ করেছে এবং তারা মিথ্যা বলেছিল’ (তওবা ৯/৭৫-৭৭)।
কিছু মুনাফিক আল্লাহ তা‘আলাকে এই মর্মে প্রতিশ্রুতি
দিয়েছিল যে, আল্লাহ যদি অনুগ্রহ করে তাদের ধনী করে দেন তাহ’লে তারা তাদের
ধন-সম্পদ থেকে দান করবে এবং তারা সৎ লোকদের শ্রেণীভুক্ত হয়ে যাবে। কিন্তু
ধনী হওয়ার পর তারা সে কথা রাখেনি এবং তাদের দাবীর সত্যতাও প্রতিপাদন করেনি।
ফলশ্রুতিতে আল্লাহ তাদের অন্তরে ক্বিয়ামত পর্যন্ত মুনাফিকী স্থায়ী করে
দিয়েছেন। আল্লাহ এহেন অবস্থা থেকে আমাদের তাঁর নিকট আশ্রয় দিন।[2]
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَّقُوْلُ آمَنَّا بِاللهِ وَبِالْيَوْمِ الْآخِرِ وَمَا هُمْ بِمُؤْمِنِيْنَ ‘মানুষের মাঝে এমন লোকও আছে যারা মুখে বলে আমরা আল্লাহ ও পরকালের উপর ঈমান এনেছি। কিন্তু তারা ঈমানদার নয়’ (বাক্বারাহ ২/৮)।
ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেছেন, প্রতারণা ও চক্রান্ত তাদের পুঁজি, মিথ্যা কথন ও চাটুকারিতা তাদের পণ্য বা বেসাতী, আর মুসলিম অমুসলিম উভয় পক্ষ যাতে তাদের প্রতি প্রসন্ন থাকে সেটাই তাদের জীবন-জীবিকা। সকলের মাঝে বাস করে তারা থাকবে অক্ষত নিরাপদ।[3] এভাবে তারা আল্লাহ ও মুমিনদেরকে ধোঁকা দেয়, মূলতঃ তারা নিজেরাই নিজেদেরকে ধোঁকায় ফেলে। কিন্তু তারা বুঝতে পারে না।
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو أَنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ أَرْبَعٌ مَنْ كُنَّ فِيْهِ كَانَ مُنَافِقًا خَالِصًا، وَمَنْ كَانَتْ فِيْهِ خَصْلَةٌ مِنْهُنَّ كَانَتْ فِيْهِ خَصْلَةٌ مِنَ النِّفَاقِ حَتَّى يَدَعَهَا إِذَا حَدَّثَ كَذَبَ وَإِذَا عَاهَدَ غَدَرَ، وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ وَإِذَا خَاصَمَ فَجَرَ.
আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) হ’তে
বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, ‘যার মধ্যে চারটি আচরণ থাকবে সে নির্ভেজাল
মুনাফিক বলে গণ্য হবে। আর যার মধ্যে সেগুলোর একটি আচরণ পাওয়া যাবে তার
মধ্যে মুনাফিকীর একটি চিহ্ন বিদ্যমান থাকবে যে পর্যন্ত না সে তা পরিহার
করে। যখন সে কথা বলে, তখন মিথ্যা বলে; যখন কোন চুক্তিবদ্ধ হয় তখন তা ভঙ্গ
করে; যখন কোন প্রতিশ্রুতি দেয় তখন তা অমান্য করে এবং যখন বাক-বিতন্ডা করে
তখন বেহুদা বা বাজে কথা বলে’।[4]
ইমাম নববী (রহঃ) বলেছেন, একদল আলেম এই হাদীছকে মুশকিল বা দুর্জ্ঞেয় অর্থবোধক হাদীছ হিসাবে গণ্য করেছেন। কেননা এই আচরণগুলো অনেক খাঁটি মুসলিমের মধ্যেও পাওয়া যায়। যার ঈমানের মধ্যে কোন সন্দেহ নেই। ইউসুফ (আঃ)-এর ভাইদের মধ্যে উল্লিখিত আচরণের সবক’টি ছিল। অনুরূপ পূর্বসূরী অনেক মহাজন ও বিদ্বানের মাঝে এগুলো আংশিক কিংবা সার্বিকভাবে বিদ্যমান ছিল। তাই প্রশ্ন দেখা দেয়, একই ব্যক্তি একই সাথে কি করে মুমিন ও মুনাফিক হ’তে পারে। এজন্যই হাদীছটিকে তারা মুশকিল বা দুর্বোধ্য বলেছেন।
কিন্তু ইমাম নববী বলেন, আল্লাহরই সকল প্রশংসা, হাদীছটিতে আসলে কোন দুর্বোধ্যতা নেই। অবশ্য আলেমরা এর অর্থ নিয়ে নানা কথা বলেছেন। অনুসন্ধানী আলেমগণ ও অধিকাংশ ব্যক্তির মত যা সঠিক ও শ্রেয় তা এই যে, এই আচরণগুলো মুনাফিকীর আচরণ। যে এসব আচরণের অধিকারী সে মুনাফিকতুল্য এবং তাদের চারিত্রিকগুণে বিভূষিত। কেননা মুনাফিকী মূলতঃ প্রকাশ্যে এক রকম এবং গোপনে অন্য রকম। এই অর্থ উক্ত আচরণগুলোর অধিকারীর মধ্যেও বিরাজমান। তার এ মুনাফিকী ঐ ব্যক্তির সাথে যার সাথে সে কথা বলেছে, প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, আমানত গচ্ছিত রেখেছে, বাক-বিতন্ডা করেছে এবং চুক্তি করেছে। সে ইসলামের মধ্যে মুনাফিক নয়- যে কিনা বাইরে মুসলিম কিন্তু ভেতরে কাফের। নবী করীম (ছাঃ)ও এতদ্বারা তাকে জাহান্নামের নিম্নদেশে চিরকাল অবস্থানকারী মুনাফিক গণ্য করেননি।
রাসূল (ছাঃ)-এর উক্তি ‘সে
নির্ভেজাল মুনাফিক’-এর অর্থ এ আচরণগুলোর কারণে সে মুনাফিকদের সাথে কঠিন
সাদৃশ্যপূর্ণ। জনৈক আলেম বলেছেন, কঠিনভাবে মুনাফিকের সাথে তুলনীয় সেই
ব্যক্তি যার মধ্যে এসব আচরণ অতি মাত্রায় বিরাজিত। যার মধ্যে অল্প মাত্রায়
রয়েছে সে মুনাফিক শ্রেণীভুক্ত নয়। এটিই হাদীছের গ্রহণীয় ও শ্রেয় অর্থ।[5]
২৮. ছালাতকে যথাসময় থেকে বিলম্বিত করা :
আলা ইবনু আব্দুর রহমান হ’তে বর্ণিত তিনি একবার যোহর ছালাত শেষ করে বছরা শহরে ছাহাবী আনাস ইবনু মালিক (রাঃ)-এর বাড়ীতে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যান। তাঁর বাড়ীটা ছিল মসজিদের পাশেই। তিনি বলেন, আমরা যখন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম তখন তিনি বললেন, তোমরা কি আছর ছালাত আদায় করেছ? আমরা তাঁকে বললাম, আমরা তো এই মাত্র যোহর ছালাত আদায় করে আসলাম। তিনি বললেন, তোমরা আছর ছালাত আদায় কর। আমরা তখন আছর ছালাত আদায় করলাম। আমাদের ফিরে আসার সময় তিনি বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি,
تِلْكَ صَلاَةُ الْمُنَافِقِ يَجْلِسُ يَرْقُبُ الشَّمْسَ حَتَّى إِذَا كَانَتْ بَيْنَ قَرْنَىِ الشَّيْطَانِ قَامَ فَنَقَرَ أَرْبَعًا لاَ يَذْكُرُ اللهَ فِيْهَا إِلاَّ قَلِيْلاً
‘যে বসে বসে সূর্য ডোবার প্রতীক্ষা করে, তারপর সূর্য যখন
শয়তানের দুই শিঙের মাঝ বরাবর হয় অর্থাৎ একেবারে ডুবে যাবার উপক্রম করে তখন
চারটা ঠোকর মারে (অতি দ্রুত চার রাক‘আত আছর পড়ে) তাতে সে আল্লাহ তা‘আলাকে
নামমাত্র স্মরণ করে। তার ঐ ছালাত মূলতঃ মুনাফিকের ছালাত’।[6]
আল্লামা
ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেছেন, তারা ছালাতকে তার প্রথম ওয়াক্ত থেকে
বিলম্বিত করে মরণাপন্ন ব্যক্তির দম বন্ধ হওয়ার উপক্রমের মুহূর্তে (একেবারে
শেষ মুহূর্তে) আদায় করে। ফজর আদায় করে সূর্যোদয়ের মুহূর্তে এবং আছর আদায়
করে সূর্যাস্তের সময়ে। কাক যেমন ঠোকর মারে তারাও তেমনি (সিজদার নামে) ঠোকর
মারে। তা দৈহিকভাবে ছালাত হ’লেও আন্তরিকতাপূর্ণ ছালাত নয়। এ ছালাত আদায়কালে
তারা শিয়ালের মত এদিক ওদিক তাকাতে থাকে। কেননা তাদের বিশ্বাস হয়, এভাবে
ছালাত আদায়ের জন্য তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হ’তে পারে এবং কৈফিয়তের জন্য তলব করা
হ’তে পারে।[7]
২৯. ছালাতের জামা‘আতে শরীক না হওয়া :
আব্দুল্লাহ
ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, ক্বিয়ামতের ময়দানে যে ব্যক্তি
মুসলিম হিসাবে আল্লাহ তা‘আলার সাথে সাক্ষাৎ লাভে ধন্য হ’তে চায়, সে যেন এই
ছালাতগুলো যেখানে আযান দেওয়া হয় সেখানে (মসজিদে) গিয়ে যথারীতি আদায় করে।
নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবীর জন্য হেদায়াত বা পথনির্দেশমূলক অনেক বিধান
দিয়েছেন। এই ছালাতগুলো ঐ হেদায়াতমূলক বিধানের অন্তর্ভুক্ত। তোমাদের
ছালাতগুলো যদি তোমরা ঘরে আদায় কর যেমন করে এই পশ্চাৎপদ ব্যক্তি তার বাড়ীতে
ছালাত আদায় করে, তাহ’লে তোমরা তোমাদের নবী করীম (ছাঃ)-এর সুন্নাত (আদর্শ)
ছেড়ে দিবে। আর যদি তোমরা তোমাদের নবীর সুন্নাত ছেড়ে দাও, তাহ’লে তোমরা
বিপথগামী হয়ে যাবে। কোন ব্যক্তি যখন খুব ভালমত পাক-পবিত্র হয়, তারপর এই
মসজিদগুলোর কোন একটি মসজিদে গমনের সঙ্কল্প করে, তার প্রতি পদক্ষেপের জন্য
একটি নেকী লেখা হয়, একটি মর্যাদা বাড়িয়ে দেওয়া হয় এবং একটি পাপ মুছে দেওয়া
হয়। নিশ্চয়ই আমি আমাদের মধ্যে দেখেছি যার মুনাফিকী সুবিদিত এমন লোক ছাড়া
ছালাতের জামা‘আত থেকে কেউ পশ্চাৎপদ থাকত না। এমনকি হাঁটতে পারে না এমন
লোককেও দু’জনের কাঁধে ভর দিয়ে (মসজিদে এনে) লাইনের মাঝে দাঁড় করিয়ে দেওয়া
হ’ত।[8]
আল্লামা শুমুন্নী (اَلشُّمُنِّىْ)
বলেছেন, এখানে মুনাফিক বলতে যে মুখে ইসলাম যাহির করে কিন্তু মনে তা গোপন
রাখে সে নয়। নচেৎ জামা‘আতে ছালাত আদায় ফরয হয়ে দাঁড়ায়। কেননা যে অন্তরে
কুফর লুকিয়ে রাখে সে তো কাফেরই। এতে ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর কথার শেষাংশ
প্রথমাংশের বিপরীত হয়ে দাঁড়াবে। কেননা জামা‘আতে ছালাত আদায়কে তিনি সুন্নাত
বলেছেন।[9]
৩০. কুরুচিপূর্ণ বচন ও বাচালতা :
আবূ উমামা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, اَلْحَيَاءُ وَالْعِىُّ شُعْبَتَانِ مِنَ الإِيْمَانِ وَالْبَذَاءُ وَالْبَيَانُ شُعْبَتَانِ مِنَ النِّفَاقِ ‘লজ্জা ও স্বল্প ভাষণ ঈমানের দু’টি শাখা এবং
কুরুচিপূর্ণ কথা ও বাচালতা মুনাফিকীর দু’টি শাখা’।[10]
ইমাম তিরমিযী (রহঃ) হাদীছটির শব্দের ব্যাখ্যায় বলেছেন, اَلْعِىُّ ‘শব্দের অর্থ কম কথা বলা, স্বল্পভাষিতা বা মিতবাক হওয়া। اَلْبَذَاءُ অর্থ কুরুচিপূর্ণ বা অশ্লীল কথা বলা। আর اَلْبَيَانُ অর্থ বাচালতা। যেমন বক্তারা বক্তৃতাকালে বাগ্মিতা যাহির করার জন্য ব্যাপক কথা বলে, লোক বিশেষের তারা এমন উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে যা আল্লাহ পসন্দ করেন না।
ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেছেন,
সংক্ষিপ্তভাবে বলতে গেলে মুসলিম সমাজে মুনাফিকদের অবস্থান অর্থ-কড়ির মাঝে
জাল মুদ্রার মত। বহু মানুষ জাল মুদ্রা সম্পর্কে সচেতন নয় বিধায় তা তাদের
মাঝে অনায়াসে চলতে থাকে। কিন্তু অভিজ্ঞ মুদ্রা পরখকারী তার মেকিত্ব ঠিকই
ধরে ফেলতে পারে। কিন্তু এমন লোকের সংখ্যা সমাজে কম। দ্বীনের জন্য মুনাফিক
শ্রেণীর লোক অপেক্ষা অধিক ক্ষতিকর আর কেউ নেই। দ্বীনকে তারা ভেতর থেকে
ধ্বংস করে দেয়। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদে তাদের ভূমিকা পরিষ্কার
করে তুলে ধরেছেন; তাদের স্বভাব-চরিত্র ও অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন এবং তাদের
আলোচনা বার বার করেছেন। কেননা মুনাফিকদের কারণে উম্মাতের উপর কঠিন চাপ
সৃষ্টি হয়; উম্মাতের মাঝে তাদের অস্তিত্ব মানেই ঘরের শত্রু হিসাবে বড় বিপদ
ডেকে আনা। তাদের চেনার প্রয়োজনীয়তাও অনস্বীকার্য, যাতে তাদের মত আচরণ
মুমিনদের থেকে না হয় এবং তাদের প্রতি কান লাগিয়ে রাখা হয়। তারা যে আল্লাহর
পথের কত পথিককে সরল রাস্তা থেকে বিভ্রান্ত করেছে তার ইয়ত্তা নেই। তারা
তাদেরকে শয়তানের নিকৃষ্ট পথে নিয়ে গেছে। তারা তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে
এবং তাদের উপর অনুগ্রহ করেছে। কিন্তু তাদের সে প্রতিশ্রুতি আসলে ধোঁকাবাজি
এবং তাদের অনুগ্রহ শুধুই দুর্ভোগ ও ধ্বংস।[11]
৩১. গান শোনা :
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেছেন, اَلْغِنَاءُ يُنْبِتُ النِّفَاقَ فِي الْقَلْبِ ‘গান অন্তরে মুনাফিকী উৎপন্ন করে’।[12] ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেছেন, তার কারণ, মুনাফিকীর মূল কথাঃ মানুষের বাইরের দিক হবে ভেতর দিক থেকে আলাদা আর গায়ক দু’টি হুকুমের মাঝে অবস্থানকারী। হয় সে গান গাওয়ায় নির্লজ্জ হবে, সে ক্ষেত্রে সে হবে ফাসিক বা পাপাচারী; নয় সে গানের মাধ্যমে ইবাদত-বন্দেগী যাহির করবে, সে ক্ষেত্রে সে হবে মুনাফিক। কারণ গানের মধ্যে সে উপর উপর আল্লাহর প্রতি ভালবাসা ও আখিরাতের প্রতি টান ফুটিয়ে তুললেও তার মনটা কামনার আগুনে টগবগ করে ফোটে; যে গানের কথা ও সুর এবং বাদ্য-বাজনা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট অপ্রিয়, তাই তার নিকট প্রিয় লাগে এবং গানের বিষয়বস্ত্তর প্রতি সে ঝুঁকে পড়ে। তার অন্তর এগুলোতে ভরপুর হয়ে যায়; তাতে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর প্রিয় জিনিসগুলোর প্রতি ভালবাসা এবং অপ্রিয় জিনিসগুলোর প্রতি ঘৃণার জন্য একটু জায়গাও খালি থাকে না। আর এটাই তো নিরেট মুনাফিকী।
মুনাফিকীর
অন্যান্য চিহ্নের মধ্যে রয়েছে আল্লাহর যিকির বা স্মরণ কম করা, ছালাতের
প্রতি আলসেমি এবং দায়সারা গোছের ছালাত আদায় করা। ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ
গানে আসক্ত ব্যক্তিকে আপনি দেখবেন এসব রোগে আক্রান্ত। তাছাড়াও মুনাফিকী
মিথ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত। আর গান চূড়ান্ত মিথ্যা কথা। কেননা গান খারাপ ও
কদর্য জিনিসকে সুন্দর ও সুশোভিত করে দেখায় এবং তা করতে আদেশ দেয়। অন্যদিকে
সুন্দরকে কুৎসিত আকারে তুলে ধরে এবং তা থেকে বিরত থাকতে বলে। এটাও সরাসরি
মুনাফিকী। তাছাড়াও মুনাফিকী হ’ল ধোঁকাবাজি, চক্রান্ত ও প্রতারণার নাম। আর
গানের ভিত্তিও এগুলো।[13]
মুনাফিকী থেকে বাঁচার পথ
একজন মুসলিম নিজকে মুনাফিকী থেকে পূতপবিত্র রাখতে চাইলে তাকে অবশ্যই সদগুণাবলী ও সৎকর্মে বিভূষিত হ’তে হবে। নিম্নে এ বিষয়ে আলোচনা তুলে ধরা হ’ল :
১. ছালাতের জামা‘আতে আগেভাগে হাযির হওয়া এবং তাকবীরে তাহরীমা পাওয়া : আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
مَنْ صَلَّى لِلَّهِ أَرْبَعِيْنَ يَوْمًا فِى جَمَاعَةٍ يُدْرِكُ التَّكْبِيْرَةَ الأُوْلَى كُتِبَتْ لَهُ بَرَاءَتَانِ بَرَاءَةٌ مِنَ النَّارِ وَبَرَاءَةٌ مِنَ النِّفَاقِ.
‘যে ব্যক্তি প্রথম তাকবীর
প্রাপ্তিসহ একাধারে চল্লিশ দিন (পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত) জামা‘আতে আদায় করবে তার
জন্য দু’টি মুক্তিপত্র লিখে দেওয়া হবে। একটি জাহান্নাম থেকে মুক্তি,
দ্বিতীয়টি মুনাফিকী থেকে মুক্তি’।[14]
জাহান্নাম
থেকে মুক্তি (براءة من النار) অর্থ জাহান্নাম থেকে নিষ্কৃতি লাভ করবে।
যেমন বলা হয়, بَرَأَ مِنَ الدِّيْنِ وَالْعَيْبِ : خَلَصَ ‘অমুক ঋণ ও দোষ
থেকে মুক্তি পেয়েছে; অর্থাৎ খালাস পেয়েছে। দোষ থেকে তার মুক্তি মিলেছে
অর্থাৎ নির্দোষ সাব্যস্ত হয়েছে। নিফাক থেকে মুক্তি মেলা (براءة من النفاق)
প্রসঙ্গে আল্লামা তিবী বলেছেন, ঐ লোকটি তার ছালাতের বদৌলতে দুনিয়াতে
মুনাফিকের মত আমল করা থেকে নিরাপদ থাকবে এবং একনিষ্ঠ মুখলিছের মত আমল করার
তাওফীক লাভ করবে। আর আখিরাতে সে মুনাফিকের জন্য বরাদ্দ শাস্তি থেকে নিরাপদে
থাকবে। সে যে মুনাফিক ছিল না তৎসম্পর্কে সাক্ষ্য দেওয়া হবে। অর্থাৎ বলা
হবে মুনাফিকরা যখন ছালাতে দাঁড়াত তখন আলসেমি করত। কিন্তু এই লোকটা ছিল
তাদের বিপরীত। মিরকাত গ্রন্থে এমনটাই বলা হয়েছে।[15]
২. সদাচার ও দ্বীন সম্পর্কে জ্ঞান লাভ :
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم خَصْلَتَانِ لاَ تَجْتَمِعَانِ فِىْ مُنَافِقٍ حُسْنُ سَمْتٍ وَلاَ فِقْهٌ فِى الدِّيْنِ-
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)
বলেছেন, ‘দু’টি আচার কোন মুনাফিকের মধ্যে মেলে না- সদাচার ও দ্বীন
সম্পর্কিত জ্ঞান’।[16]
হাদীছটিতে উদ্ধৃত
حُسْنُ سَمْتٍ অর্থ কল্যাণের পথের অনুসন্ধান এবং নেককার লোকদের গুণে
গুণান্বিত হওয়া, সেই সঙ্গে প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য সবরকম দোষ থেকে দূরে থাকা।
وَلاَ فِقْهٌ فِى الدِّيْنِ বাক্যটি لاَ অব্যয় যোগে পূর্বের বাক্যের সাথে
সংযুক্ত হয়েছে। কেননা حُسْنُ سَمْتٍ বাক্যাংশটি নেতিবাচক অর্থের অঙ্গীভূত।
এজন্যই وَلاَ فِقْهٌ فِى الدِّيْنِ বাক্যাংশেও لاَ বা নাবাচক অব্যয়টি আগের
নাবাচকতাকে জোরদার করেছে মাত্র।[17]
৩. দানশীলতা :
عَنْ أَبِىْ مَالِكٍ الأَشْعَرِىِّ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم الطُّهُوْرُ شَطْرُ الإِيْمَانِ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ تَمْلأُ الْمِيْزَانَ، وَسُبْحَانَ اللهِ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ تَمْلآنِ أَوْ تَمْلأُ مَا بَيْنَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَالصَّلاَةُ نُوْرٌ وَالصَّدَقَةُ بُرْهَانٌ وَالصَّبْرُ ضِيَاءٌ وَالْقُرْآنُ حُجَّةٌ لَكَ أَوْ عَلَيْكَ، كُلُّ النَّاسِ يَغْدُو فَبَائِعٌ نَفْسَهُ فَمُعْتِقُهَا أَوْ مُوْبِقُهَا.
আবু মালিক আল-আশ‘আরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি
বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘পবিত্রতা ঈমানের অর্ধেক। একবার
আল-হামদুলিল্লাহ উচ্চারণে দাঁড়িপাল্লা (ছওয়াবে) ভরে যায়; আর সুবহানাল্লাহ
এবং আল-হামদুলিল্লাহ বলায় আসমান ও যমীনের মধ্যবর্তী সমুদয় স্থান (ছওয়াবে)
ভরে যায়। (মানুষের জন্য) ছালাত হ’ল আলো, দান হ’ল প্রমাণ এবং ধৈর্য হ’ল
জ্যোতি। আর কুরআন মাজীদ (ক্বিয়ামতে) হয় তোমার পক্ষে প্রমাণ হয়ে দাঁড়াবে
অথবা তোমার বিরুদ্ধে। ভোর বেলায় (ঘুম থেকে জাগরণের মাধ্যমে) প্রত্যেকটা
মানুষ নিজেকে (আমলের নিকট) বেঁচে দেয়। তারপর ভাল আমলের মাধ্যমে হয় সে নিজকে
মুক্ত করে অথবা খারাপ আমলের মাধ্যমে নিজকে ধ্বংস করে’।[18]
ইমাম
নববী (রহঃ) বলেছেন, দান-ছাদাক্বা দাতার ঈমানের প্রমাণ। কেননা মুনাফিক
দান-ছাদাক্বা থেকে হাত গুটিয়ে রাখে, সে দান-ছাদাক্বায় বিশবাসী নয়। সুতরাং
যে দান করে সে তার দানের মাধ্যমে তার ঈমানের সত্যতা জ্ঞাপন করে।[19]
৪. রাত জেগে ছালাত আদায় :
কাতাদা (রহঃ) বলেন, মুনাফিক খুব কমই রাত জাগে(قلما ساهر الليل منافق)।[20] তার কারণ মুনাফিকরা লোকদের দেখিয়ে দেখিয়ে সৎকাজ করতে আনন্দ পায়। নিরিবিলি থাকাকালে তাই সে সৎ কাজ করার উদ্দীপনা অনুভব করে না। সুতরাং কোন ব্যক্তি যখন রাত জেগে ছালাত আদায় করে, তখন তা তার মুনাফিক না হওয়ার এবং সত্য মুমিন হওয়ার প্রমাণ বহন করে।
৫. আল্লাহর পথে জিহাদ :
আবু
হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ
مَاتَ وَلَمْ يَغْزُ وَلَمْ يُحَدِّثْ بِهِ نَفْسَهُ مَاتَ عَلَى شُعْبَةٍ
مِنْ نِّفَاقٍ ‘যে ব্যক্তি যুদ্ধ-জিহাদ না করে অথবা নিজের মনে
যুদ্ধ-জিহাদের সংকল্প না করে মারা যাবে, সে মুনাফিকীর একটি শাখার উপর মারা
যাবে’।[21]
ইমাম নববী বলেছেন, মুনাফিকরা
যুদ্ধে যোগদান না করে বাড়ি বসে থাকে। তাই যে উক্ত হাদীছ মত কাজ করবে সে
মুনাফিকদের সদৃশ হয়ে যাবে। কেননা জিহাদ তরক করা মুনাফিকীর একটি শাখা বা
পর্যায়। এ হাদীছ থেকে একথাও প্রমাণিত হয় যে, যে ব্যক্তি কোন কাজের নিয়ত বা
ইচ্ছা করল কিন্তু তা করার আগেই সে মারা গেল, তার ক্ষেত্রে ঐ নিন্দা-সাজা
প্রযোজ্য হবে না যা সেই কাজের নিয়ত না করেই মৃত্যুবরণকারীর ক্ষেত্রে
প্রযোজ্য।[22]
৬. বেশী বেশী আল্লাহর যিকির করা :
আল্লামা ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলার কথা বেশী বেশী স্মরণ করলে মুনাফিকী থেকে মুক্তি মেলে। কেননা মুনাফিকরা আল্লাহকে কম স্মরণ করে। আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের এহেন আচরণ সম্পর্কে বলেছেন, وَلاَ يَذْكُرُوْنَ اللهَ إِلاَّ قَلِيْلاً ‘তারা আল্লাহকে অল্পই স্মরণ করে’ (নিসা ৪/১৪২)।
কা‘ব (রাঃ) বলেছেন, যে আল্লাহকে বেশী বেশী স্মরণ করে সে মুনাফিকী থেকে মুক্ত হয়ে যায়। এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা সূরা আল-মুনাফিকূন-এর উপসংহার টানতে গিয়ে বলেছেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوا لاَ تُلْهِكُمْ أَمْوَالُكُمْ وَلاَ أَوْلاَدُكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللهِ وَمَنْ يَّفْعَلْ ذَلِكَ فَأُوْلَئِكَ هُمُ الْخَاسِرُوْنَ-
‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর যিকির/স্মরণ থেকে অমনোযোগী করে না দেয়। আর যারাই এমনটা করবে তারাই হবে ক্ষতিগ্রস্ত’ (মুনাফিকূন ৬৩/৯)। মুনাফিকরা আল্লাহর স্মরণ সম্পর্কে উদাসীন বনে যাওয়ার কারণে মুনাফিকীর খপ্পরে পড়েছিল। তাই এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ঈমানদারদের যিকির থেকে উদাসীন বা বেখেয়াল হওয়া সম্পর্কে সতর্ক করেছেন।
জনৈক ছাহাবীকে
খারেজীরা মুনাফিক কি-না জিজ্ঞেস করা হ’লে, তিনি বললেন, ‘না, তারা মুনাফিক
নয়; কেননা মুনাফিকরা আল্লাহকে খুব অল্পই স্মরণ করে’। সুতরাং অল্প-স্বল্প
যিকর মুনাফিকীর চিহ্ন ও প্রতীক এবং বেশী বেশী যিকরে মুনাফিকীর খপ্পরে পড়া
থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। যিকররত অন্তরকে আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকীর পরীক্ষার
মুখোমুখি করেন না, এ পরীক্ষা কেবল তাদের জন্য যারা আল্লাহ তা‘আলার যিকরে
উদাসীন।[23]
৭. দো‘আ :
জুবায়ের
ইবনু নুফায়ের (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি সিরিয়ার হিমছ শহরে আবুদ
দারদা (রাঃ)-এর বাড়িতে তাঁর সাথে দেখা করতে গেলাম। আমি যখন সেখানে পৌঁছলাম
তখন দেখলাম, তিনি তাঁর ছালাতের জায়গায় দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করছেন। যখন তিনি
বসে আত্তাহিয়্যাতু পড়া শেষ করলেন তখন মুনাফিকী থেকে আল্লাহর আশ্রয়
প্রার্থনা করতে লাগলেন। তাঁর ছালাত শেষ হ’লে আমি বললাম, হে আবুদ দারদা
আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন! মুনাফিকী নিয়ে আপনার ভাবনা কেন? তিনি অবাক সুরে
বললেন, আল্লাহ মাফ কর! আল্লাহ মাফ কর! আল্লাহ মাফ কর! বালা-মুছীবতের হাত
থেকে কে নিশ্চিন্ত থাকতে পারে? বালা-মুছীবতের হাত থেকে কে নিশ্চিন্ত থাকতে
পারে? আল্লাহর কসম! একজন মানুষ মুহূর্তের মধ্যে বিপদে পড়তে পারে এবং
সেজন্যে তার দ্বীন-ধর্মও ত্যাগ করতে পারে।[24]
৮. আনছারদের ভালবাসা :
আনাস
(রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, آيَةُ الإِيْمَانِ حُبُّ
الأَنْصَارِ، وَآيَةُ النِّفَاقِ بُغْضُ الأَنْصَارِ ‘ঈমানের নিদর্শন
আনছারদের প্রতি ভালবাসা এবং মুনাফিকীর নিদর্শন আনছারদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ
করা’।[25]
৯. আলী ইবনু আবু তালিব (রাঃ)-কে ভালবাসা :
যির (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আলী ইবনু আবু তালিব (রাঃ) বলেছেন,
وَالَّذِى فَلَقَ الْحَبَّةَ وَبَرَأَ النَّسَمَةَ إِنَّهُ لَعَهْدُ النَّبِىِّ الأُمِّىِّ صلى الله عليه وسلم إِلَىَّ أَنَّهُ لاَ يُحِبُّنِى إِلاَّ مُؤْمِنٌ وَلاَ يُبْغِضُنِى إِلاَّ مُنَافِقٌ
‘যে মহান সত্তা ফসল
উদগত করেন এবং জীবকে অস্তিতবহীন অবস্থা থেকে অস্তিত্ব দান করেন তাঁর কসম!
আমার সপক্ষে নিরক্ষর নবী (ছাঃ)-এর অছিয়ত রয়েছে যে, মুমিন ছাড়া আমাকে কেউ
ভালবাসবে না এবং মুনাফিক ছাড়া কেউ আমার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করবে না’।[26]
মুনাফিকদের মুকাবেলায় মুসলমানদের ভূমিকা :
মুনাফিকদের ক্ষেত্রে কোন ঢিলেমি না করা ফরয। তাদের পক্ষ থেকে আগত বিপদকে খাট করে দেখাও বৈধ নয়। বর্তমানে মুনাফিকরা তো নবী করীম (ছাঃ)-এর যুগ থেকে বেশী বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, মুনাফিকরা আজ নবী করীম (ছাঃ)-এর যুগের থেকেও ভয়ানক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেদিন তারা লুকিয়ে ছাপিয়ে মুনাফিকী করত। কিন্তু আজ প্রকাশ্যে বুক ফুলিয়ে তা করছে’।[27] তাদের বিষয়ে মুসলমানদের ভূমিকা হবে নিম্নরূপ :
১. তাদের আনুগত্য না করা :
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ اتَّقِ اللهَ وَلَا تُطِعِ الْكَافِرِيْنَ وَالْمُنَافِقِيْنَ إِنَّ اللهَ كَانَ عَلِيْماً حَكِيْماً.
‘হে
নবী, আল্লাহকে ভয় কর এবং কাফির ও মুনাফিকদের আনুগত্য কর না। অবশ্যই আল্লাহ
সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়’ (আহযাব ৩৩/১)। ইমাম তাবারী (রহঃ) বলেন, আল্লাহ তা‘আলা
তাঁর নবীকে সম্বোধন করে বলেছেন, হে নবী, তুমি আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য এবং
তাঁর প্রতি তোমার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের মাধ্যমে তাঁকে ভয় কর। আর তাঁকে
ভয় কর, তাঁর নির্দেশিত হারাম থেকে দূরে থাকা ও তার সীমালংঘন না করার
মাধ্যমে। আর তুমি ঐ সকল কাফিরের আনুগত্য করবে না যারা তোমাকে বলে, তোমার
যেসব ছোট লোক ঈমানদার অনুসারী আছে তোমার নিকট থেকে তাদের হটিয়ে দাও, যাতে
আমরা তোমার কাছে বসতে পারি’। তুমি ঐ সকল মুনাফিকেরও আনুগত্য করবে না যারা
দৃশ্যত তোমার উপর ঈমান রাখে এবং তোমার কল্যাণ কামনা করে, কিন্তু ভিতরে
ভিতরে তোমার, তোমার দ্বীন এবং তোমার ছাহাবীদের ক্ষতি করতে মোটেও কোন সুযোগ
হাতছাড়া করবে না। তুমি তাদের কোন মতামত গ্রহণ করবে না এবং শুভাকাঙ্খী মনে
করে তাদের কাছে কোন পরামর্শও চাইতে যাবে না। কারণ তারা তোমার শত্রু। ঐ
সমস্ত মুনাফিকের অন্তরে কী লুক্কায়িত আছে আর কী উদ্দেশ্যেই বা তারা বাহ্যত
তোমার কল্যাণ কামনা যাহির করছে তা তাঁর ভাল জানা আছে। তিনি তোমার, তোমার
দ্বীনের এবং তোমার ছাহাবীদের সহ সমগ্র সৃষ্টির ব্যবস্থাপনায় মহাপ্রজ্ঞার
অধিকারী।[28]
২. মুনাফিকদের উপেক্ষা করা, ভীতি প্রদর্শন ও উপদেশ দান
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, بَشِّرِ الْمُنَافِقِيْنَ بِأَنَّ لَهُمْ عَذَاباً أَلِيْماً ‘তুমি মুনাফিকদের এই সংবাদ জানিয়ে দাও যে, তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি’ (নিসা ৪/১৩৮)।
তিনি আরো বলেন,
أُولَـئِكَ الَّذِيْنَ يَعْلَمُ اللهُ مَا فِيْ قُلُوْبِهِمْ فَأَعْرِضْ عَنْهُمْ وَعِظْهُمْ وَقُل لَّهُمْ فِي أَنفُسِهِمْ قَوْلاً بَلِيْغاً .
‘ঐ মুনাফিকরাই তো তারা, যাদের অন্তরে কী আছে আল্লাহ তা জানেন। সুতরাং তুমি ওদের এড়িয়ে চল বা উপেক্ষা কর, ওদের উপদেশ দাও এবং ওদের এমন কথা যা মর্মে গিয়ে পৌঁছে’ (নিসা ৪/৬৩)।
আল্লাহ তা‘আলা আয়াতে ‘ওরা’ (اولئك) বলতে মুনাফিকদের বুঝিয়েছেন, ইতিপূর্বে যাদের বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে। তিনি বলেন, হে রাসূল! তাগূতের কাছে তাদের বিচার প্রার্থনা করা, তোমার কাছে বিচার প্রার্থনা না করা এবং তোমার কাছে আসতে বাধা দানে তাদের মনে কী অভিপ্রায় লুকিয়ে ছিল তা আল্লাহ খুব ভাল জানেন। তাদের মনে তো মুনাফিকী ও বক্রতা লুকিয়ে রয়েছে যদিও তারা শপথ করে বলে, আমরা কেবলই কল্যাণ ও সম্প্রীতি কামনা করি।
আল্লাহ
তা‘আলা তাঁর রাসূলকে বলছেন, ‘তুমি ওদের ছাড় দাও, কায়িক-দৈহিক কোন শাস্তি
তুমি ওদের দেবে না। তবে তুমি তাদের উপর আল্লাহর শাস্তি চেপে বসার এবং
তাদের বসতিতে আল্লাহর মার অবতীর্ণ হওয়া সম্পর্কে তাদেরকে ভয় দেখিয়ে উপদেশ
দাও। তারা আল্লাহ ও তার রাসূল সম্পর্কে যে সন্দেহের দোলাচলে ঘুরপাক খাচ্ছে।
সেজন্য যে অপ্রীতিকর অবস্থার মুখোমুখি তারা হবে সে সম্পর্কে তাদের সতর্ক
কর। আর তাদের হুকুম কর আল্লাহকে ভয় করতে এবং আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল,
আল্লাহর প্রতিশ্রুতি ও শাস্তিকে সত্য বলে মেনে নিতে’।[29]
৩. মুনাফিকদের সঙ্গে বিতর্কে না জড়ানো :
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَلاَ تُجَادِلْ عَنِ الَّذِيْنَ يَخْتَانُوْنَ أَنْفُسَهُمْ إِنَّ اللهَ لاَ يُحِبُّ مَن كَانَ خَوَّاناً أَثِيْماً.
‘যারা নিজেদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে, তুমি তাদের পক্ষে বিতর্কে লিপ্ত হবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কখনো বিশ্বাসঘাতক পাপিষ্ঠকে পসন্দ করেন না’ (নিসা ৪/১০৭)।
আল্লাহ বলেছেন, হে রাসূল! যারা নিজেদের সাথে খিয়ানত তথা বিশ্বাসঘাতকতা করে তাদের পক্ষ নিয়ে তুমি বিতর্ক করবে না। বনু উবাইরিক গোত্রের কিছু লোক এই বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। যাফর গোত্রের তাম‘আহ বা বশীর ইবনু উবাইরিক এক আনছারীর বর্ম চুরি করে। বর্মের মালিক নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে অভিযোগ করে এবং তাম‘আহর প্রতি তার সন্দেহের কথা বলে। অনুসন্ধান শুরু হ’লে সে বর্মটি এক ইহুদীর কাছে গচ্ছিত রাখে। পরে তাম‘আহ, তার ভাই-বেরাদার ও বনু যাফরের আরো কিছু লোক জোট পাকিয়ে সেই ইহুদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে। ইহুদীকে জিজ্ঞেস করা হ’লে সে নিজেকে নির্দোষ দাবী করে। কিন্তু তাম‘আহর লোকেরা জোরেশোরে বলতে থাকে, এতো শয়তান ইহুদী, সেতো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অস্বীকার করে। তার কথা কেমন করে বিশ্বাসযোগ্য হ’তে পারে? বরং আমাদের কথা মেনে নেওয়া উচিত। কেননা আমরা মুসলমান। এ মোকদ্দমার বাহ্যিক ধারাবিবরণীতে প্রভাবিত হয়ে নবী করীম (ছাঃ) ঐ ইহুদীর বিরুদ্ধে রায় দিতে এবং অভিযোগকারীকে বনু উবাইরিকের বিরুদ্ধে দোষারোপ করার জন্য সতর্ক করে দিতে প্রায় উদ্যত হয়েছিলেন। এমন সময় উক্ত আয়াত নাযিল হয় এবং সমস্ত ব্যাপারটির প্রকৃত সত্য উদঘাটিত হয়।
আসলে যে ব্যক্তি অন্যের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে সে সবার আগে নিজের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। কারণ মন ও মস্তিষ্কের শক্তিগুলো তার কাছে আমানত হিসাবে গচ্ছিত রাখা হয়েছে। সে সেগুলোকে অযথা ব্যবহার করে তাদেরকে বিশ্বাসঘাতকতা করতে বাধ্য করে। বিবেক-বুদ্ধিকে দ্বীনের অনুগত না করে বরং আপন খেয়ালখুশির অনুগত করে সে এভাবে নিজের সাথে খিয়ানত ও বিশ্বাসঘাতকতা করে।
তাই এমন
বিশ্বাসঘাতকদের পক্ষ নিতে নবী করীম (ছাঃ)-কে নিষেধ করা হয়েছে। বস্ত্তত
মানুষের সম্পদ আত্মসাৎ করা যাদের স্বভাব এবং এরূপ আত্মসাৎ ও অন্যান্য
হারামের মাঝে বিচরণের মাধ্যমে যারা পাপ-পঙ্কিলতার মাঝে ডুবে থাকে, আল্লাহ
তা‘আলা তাদেরকে মোটেও ভালবাসেন না এবং পসন্দও করেন না।[30]
৪. মুনাফিকদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে না তোলা :
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا لاَ تَتَّخِذُوْا بِطَانَةً مِّنْ دُوْنِكُمْ لاَ يَأْلُوْنَكُمْ خَبَالاً وَدُّوْا مَا عَنِتُّمْ قَدْ بَدَتِ الْبَغْضَاءُ مِنْ أَفْوَاهِهِمْ وَمَا تُخْفِي صُدُوْرُهُمْ أَكْبَرُ قَدْ بَيَّنَّا لَكُمُ الآيَاتِ إِنْ كُنتُمْ تَعْقِلُوْنَ.
‘হে মুসলিগণ! তোমরা মুমিন ব্যতীত অন্য কাউকে অন্তরঙ্গরূপে গ্রহণ করো না; তারা তোমাদের অমঙ্গল সাধনে কোন ত্রুটি করে না- তোমরা কষ্টে থাক, তাতেই তাদের আনন্দ। শত্রুতাপ্রসূত বিদ্বেষ তাদের মুখেই ফুটে বেরোয়। আর যা কিছু তাদের মনে লুকিয়ে রয়েছে, তা আরো অনেকগুণ বেশী জঘন্য। তোমাদের জন্যে নিদর্শন বিশদভাবে বর্ণনা করে দেয়া হলো, যদি তোমরা তা অনুধাবন করতে সমর্থ হও’ (আলে ইমরান ৩/১১৮)।
উক্ত আয়াত কিছু মুসলিম সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। তারা
তাদের ইহুদী মুনাফিক বন্ধুদের সঙ্গে গভীর মিতালি রাখত এবং প্রাক ইসলামী
যুগে জাহেলিয়াতের যামানায় যেসব কারণে তাদের মাঝে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল ইসলাম
পরবর্তীকালেও তারা তা নির্ভেজালভাবে অটুট রেখেছিল। আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াতে
তাদেরকে এমন বন্ধুত্ব রক্ষা করতে নিষেধ করেন এবং একই সাথে তাদের কোন কাজে
ওদের থেকে পরামর্শ নিতেও নিষেধ করে দেন’।[31]
৫. মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ চালনা এবং কঠোরতা আরোপ :
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ جَاهِدِ الْكُفَّارَ وَالْمُنَافِقِيْنَ وَاغْلُظْ عَلَيْهِمْ وَمَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ وَبِئْسَ الْمَصِيْرُ. ‘হে নবী! তুমি কাফির ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ চালিয়ে যাও এবং তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ কর। তাদের বাসস্থান হবে জাহান্নাম। আর তা কতই না নিকৃষ্ট আবাস’! (তওবা ৯/৭৩)।
মুনাফিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও ভয় দেখানোর মাধ্যমে এই কঠোর অবস্থান নিশ্চিত করা যায়।
৬. মুনাফিকদের প্রতি অবজ্ঞা দেখান এবং তাদের নেতা না বানানো :
عَنْ بُرَيْدَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم لاَ تَقُولُوْا لِلْمُنَافِقِ سَيِّدٌ فَإِنَّهُ إِنْ يَكُ سَيِّدًا فَقَدْ أَسْخَطْتُمْ رَبَّكُمْ عَزَّ وَجَلَّ.
বুরাইদা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা কোন মুনাফিককে সাইয়্যিদ বা নেতা নামে
আখ্যায়িত করো না। কেননা সে যদি সত্যিই (তোমাদের) নেতা হয়, তাহ’লে তোমরা
তোমাদের প্রভুকে ক্ষুব্ধ করবে’।[32]
৭. মুনাফিকদের জানাযার ছালাতে অংশগ্রহণ না করা :
আল্লাহ তা‘আরা বলেন,
وَلاَ تُصَلِّ عَلَى أَحَدٍ مِّنْهُم مَّاتَ أَبَداً وَلاَ تَقُمْ عَلَىَ قَبْرِهِ إِنَّهُمْ كَفَرُواْ بِاللهِ وَرَسُوْلِهِ وَمَاتُوْا وَهُمْ فَاسِقُوْنَ.
‘তাদের (মুনাফিকদের) কেউ মারা গেলে তুমি কখনও তার জানাযার ছালাত আদায় করবে না এবং তার কবরের পাশে দাঁড়াবে না। নিশ্চয়ই তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে কুফরী করেছে এবং পাপাচারী অবস্থাতেই তাদের মৃত্যু হয়েছে’ (তওবা ৯/৮৪)।
এই আয়াতের শানে নুযূল সম্পর্কে
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত আছে যে, যখন মুনাফিকদের দলপতি
আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই মারা যায় তখন তার পুত্র আব্দুল্লাহ নবী করীম (ছাঃ)-এর
নিকট এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আপনার জামাটা আমাকে দিন, ওটা
দিয়ে আমি ওকে কাফন দেব। আর আপনি ওর জানাযার ছালাত আদায় করবেন এবং ওর জন্য
ক্ষমা চাইবেন। তিনি তাকে জামাটা দিয়ে বললেন, কাফন জড়ান শেষ হ’লে আমাকে
জানাবে। তিনি কাফন সম্পন্ন করে তাঁকে জানালেন। তিনি তখন জানাযার ছালাতে
ইমামতির জন্য এগিয়ে গেলেন। কিন্তু সে সময় ওমর (রাঃ) তাঁকে টেনে ধরলেন এবং
বললেন, আল্লাহ কি আপনাকে মুনাফিকদের জানাযার ছালাত আদায় করতে নিষেধ করেননি?
তিনি কি বলেননি, তুমি তাদের জন্য মাফ চাও কিংবা না চাও সবই সমান। তুমি যদি
তাদের জন্য সত্তর বারও ক্ষমা চাও তবুও আল্লাহ তাদের মোটেও ক্ষমা করবেন না?
তখন অবতীর্ণ হয়- ‘হে রাসূল! তুমি তাদের কেউ মারা গেলে কোন দিন তার জানাযার
ছালাত আদায় করবে না এবং তার কবরের পাশে দাঁড়াবে না’। তারপর থেকে তিনি
মুনাফিকদের জানাযার ছালাতে অংশ নেওয়া বন্ধ করে দেন।[33]
শেষ কথা :
পূর্বের বর্ণনা থেকে মুনাফিকীর বিপদ সম্পর্কে ধারণা সুস্পষ্ট হয়েছে। আসলে মুনাফিকী একটি প্রাণঘাতী মানসিক রোগ এবং নিন্দনীয় স্বভাব। নবী করীম (ছাঃ) এহেন স্বভাবের অধিকারীকে বিশ্বাসঘাতক, আত্মসাৎকারী, মিথ্যুক ও পাপাচারী হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। কেননা মুনাফিক মনে যা লুকিয়ে রাখে, বাইরে তার উল্টোটা প্রকাশ করে। সে সত্য বলছে বলে দাবী করে অথচ সে জানে যে সে মিথ্যুক। সে দাবী করে আমানত রক্ষা করার, অথচ সে ভালই জানে যে সে তা আত্মসাৎকারী। সে আরও দাবী করে যে, সে অঙ্গীকার পালনে অত্যন্ত দৃঢ় অথচ সে অঙ্গীকার ভঙ্গকারী। সে তার প্রতিপক্ষের নামে বানোয়াট সব দোষ বলে বেড়ায় অথচ সে ভাল করেই জানে তার এসব দোষারোপের মাধ্যমে সে পাপাচারী হচ্ছে। সে মারাত্মক অপরাধ করছে। সুতরাং তার স্বভাব চরিত্রের পুরোটাই ধোঁকা ও প্রতারণার উপর দন্ডায়মান। এমন যার অবস্থা তার বেলায় বড় মুনাফিক হয়ে যাওয়ার ভয় উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কেননা নিফাকে আমালী বা আমলভিত্তিক মুনাফিকী যদিও ঐসব পাপের অন্তর্ভুক্ত যদ্দরুন বান্দা ঈমান থেকে খারিজ হয়ে যায় না, তবুও যখন তা বান্দার ওপর জেঁকে বসে এবং তার আচরণকে প্রতারণার জালে আটকে ফেলে এবং তা অনেক্ষণ চলতে থাকে তখন আল্লাহ তাকে বড় ও আসল মুনাফিকের খাতায় নাম তুলে দিতে পারেন। তার আমলের শাস্তি হিসাবেই তার অন্তর থেকে ঈমান খারিজ করে সেখানে মুনাফিকীর জায়গা তিনি করে দেন।
আমরা আল্লাহর নিকট দো‘আ করি- তিনি যেন আমাদের অন্তরের দোষ-ত্রুটিকে সংশোধন করে দেন এবং প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল ফিৎনা-ফাসাদ থেকে আমাদের দূরে রাখেন। আর আল্লাহ তা‘আলা রহমত ও শান্তি বর্ষণ করুন, আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উপর।
মূল : শায়খ মুহাম্মাদ ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ
অনুবাদ : মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
* কামিল, এমএ, বিএড; সহকারী শিক্ষক, হরিণাকুন্ডু সরকারী বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ঝিনাইদহ।
[1]. তাফসীরুল কুরআনিল আযীম ২/১০৬।
[2]. ঐ, ৪/৮৩।
[3]. মাদারিজুস সালিকীন ১/৩৪৯।
[4]. বুখারী হা/৩৪; মুসলিম হা/৫৮।
[5]. শরহুনববী মুসলিম ২/৪৬-৪৭।
[6]. মুসলিম হা/৬২২।
[7]. মাদারিজুস সালিকীন ১/৩৫৪।
[8]. মুসলিম হা/৬৫৪।
[9]. আওনুল মা‘বূদ ২/১৭৯।
[10]. তিরমিযী হা/২০২৭, হাকেম এটিকে ছহীহ বলেছেন।
[11]. তরীকুল হিজরাতাইন, পৃঃ ৬০৩।
[12]. শু‘আবুল ঈমান ১০/২২৩।
[13]. ইগাছাতুল লাহফান ১/২৫০।
[14]. তিরমিযী হা/২৪১, আলবানী এটিকে হাসান বলেছেন।
[15]. তুহফাতুল আহওয়াযী ২/৪০।
[16]. তিরমিযী হা/২৬৮৪, আলবানী এটিকে ছহীহ বলেছেন।
[17]. তুহফাতুল আহওয়াযী ৭/৩৭৮।
[18]. মুসলিম হা/২২৩।
[19]. শরহে নববী মুসলিম ৩/১০১।
[20]. হিলয়াতুল আওলিয়া ২/৩৩৮।
[21]. মুসলিম হা/১৯১০।
[22]. শরহে নববী, মুসলিম ১৩/৫৬।
[23]. আল-ওয়াবিল আছছাইয়িবু, পৃঃ ১১০।
[24]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৬/৩৮২, যাহাবী সনদ ছহীহ বলেছেন।
[25]. বুখারী হা/১৭; মুসলিম হা/৭৪।
[26]. মুসলিম হা/৭৮ ‘ঈমান’ অধ্যায়।
[27]. বুখারী হা/৭১১৩।
[28]. জামিউল বায়ান ২০/২০২।
[29]. ঐ, ৮/৫১৫।
[30]. ঐ, ৯/১৯০।
[31]. ঐ, ৭/১৪০।
[32]. আবুদাঊদ হা/৪৯৭৭, আলবানী এটিকে ছহীহ বলেছেন।
[33]. বুখারী হা/৫৭৯৬।