পর্ব ১। পর্ব ২। পর্ব ৩। পর্ব ৪। পর্ব ৫। পর্ব ৬।

হযরত মাওলানা মাহমূদ হাসান ছাহেবের নযরবন্দিত্ব এবং তার মুক্তির জন্য প্রচেষ্টা

‘ওলামায়ে দেওবন্দের যে প্রতিনিধি দল ৬ই নভেম্বর ১৯১৭ সালে মীরাটে যুক্তপ্রদেশের লাট বাহাদুরের খেদমতে হাযির হয়ে হযরত মাওলানা মাহমূদ হাসান (মাদ্দা যিল্লুহুম ওয়া দামা ফায়যুহুম- তার ছায়া দীর্ঘায়িত হোক এবং তার দয়া অব্যাহত থাকুক) সম্পর্কে যথোপযুক্ত শিষ্টাচারসহ যে আবেদন পেশ করেছিলেন এবং জনাব লাট বাহাদুর পূর্ণ মেহেরবানী সহ যে আশ্বাসপূর্ণ জবাব দিয়েছিলেন আমরা সেই প্রতিনিধি দলের অবস্থা সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করেছিলাম। আমরা এ কথাও প্রকাশ করেছিলাম যে, প্রতিনিধি দলের সাক্ষাতের অনুমতি লাভের জন্য কয়েক মাস আগে থেকেই চেষ্টা-তদবীর চলছিল। কিন্তু লাট বাহাদুরের অতিশয় ব্যস্ততার কারণে ৬ই নভেম্বরের আগে প্রতিনিধি দলের দরবারে সাক্ষাতের অনুমতি মেলেনি। আমরা এ কথাও প্রকাশ করেছিলাম যে, প্রতিনিধি দল লাট বাহাদুর সমীপে একটি দরখাস্ত পেশ করেছিলেন। আমরা তার ফল লাভের অপেক্ষায় ছিলাম। এ কারণে প্রশংসাভাজন হযরত মাওলানার নযরবন্দিত্বের ফলে যেসব মুসলিমের অন্তর ব্যথিত ও অস্থির ছিল তাদের অবগতির জন্য এতটুকু প্রকাশই যথেষ্ট মনে করেছিলাম যে, প্রতিনিধি দল সাক্ষাৎ করে আবেদন করেছেন এবং লাট বাহাদুর আশ্বাসপূর্ণ জবাব দিয়েছেন। সমবেদনা প্রকাশকারীদের তাগাদা সত্ত্বেও আমরা সেই আবেদনের অনুলিপি প্রকাশ করিনি। কিন্তু অনেক অপেক্ষার পরেও এখন পর্যন্ত যখন কোন ফল প্রকাশ পেল না, এদিকে আবার বহু মানুষ আমাদের কাছে ঐ অনুলিপি চাচ্ছেন, আর এও সত্য যে, এত বেশী সংখ্যায় অনুলিপি প্রেরণ আমাদের পক্ষে সহজ নয়, তাই আমরা তা প্রকাশের মাধ্যমে মুদ্রিত আকারে জানিয়ে দেওয়া সমীচীন মনে করছি। এ অনুলিপি দেখে সে সব মানুষও আশ্বস্ত হবেন যাদের মাঝে কিছু ভুল বর্ণনার প্রেক্ষিতে কিংবা নিজস্ব কল্পনা থেকে এমন ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে, ওলামা প্রতিনিধিদল হযরত মাওলানাকে অপরাধী স্বীকার করে মার্সি পিটিশন দাখিল করেছেন। দরখাস্ত নিজেই তার বিষয়বস্ত্ত বলে দিচ্ছে। এছাড়াও তারা মৌখিক কিছু আবেদন করেছিলেন। মাওলানার সম্পর্কে যেসব ধারণা করা হয় সে আবেদনে তা-ই ছিল। মাওলানার মধ্যে এ রীতি (ইংরেজ বিরোধিতা) কখনই ছিল না। এ কথার সমর্থনে হযরত মাওলানার স্বহস্তে লিখিত কিছু ফৎওয়াও তারা দেখিয়ে ছিলেন। হাঁ এটা অবশ্য ঠিক যে, লিখিত ও মৌখিক সব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় শিষ্টাচার মেনে আবেদন-নিবেদন পেশ করা হয়েছে। আর আমরা তা সমর্থনও করি’।

দরখাস্তের অনুলিপি

দেওবন্দের ওলামা প্রতিনিধি দলের দরখাস্তের অনুলিপি যা ৬ই নভেম্বর ১৯১৭ সালে হিজ অনার স্যার জেমস মেস্টিন বাহাদুরকে সি.এস.আই. ও লেফটেনেন্ট গভর্ণর, যুক্তপ্রদেশ আগ্রা ও অযোধ্যা, মীরাট সমীপে যে দরখাস্ত হস্তান্তর ও পাঠ করে শুনানো হয় তার অনুলিপি।

উচ্চ খেতাবধারী হিজ অনার স্যার জেমস স্কারজি মেস্টিন ছাহেব বাহাদুর কে.সি.এস.আই লেফটেনেন্ট গভর্ণর, যুক্তপ্রদেশ আগ্রা ও অযোধ্যা সমীপে

মহোদয়,

আমরা দারুল উলূম দেওবন্দের কিছু খাদেম একটি খাঁটি ধর্মীয় জামা‘আতের কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদল হিসাবে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি হিজ অনারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি যা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে যদিও আমাদের আলোচনার আওতায় অনেকটা পড়ে না, কিন্তু ধর্মীয় দিক দিয়ে তা মোটেও উপেক্ষণীয় নয়, যেই ধর্মীয় দিকের যোগ রয়েছে দারুল উলূমের সাথে, দারুল উলূমের দলীয় কর্মীদের সাথে এবং দারুল উলূমের সাহায্যকারী সাধারণ মুসলমানের সাথে।

মহোদয়,

আমরা নিজেদের স্বভাবজাত সরলতা ও স্বচ্ছতার পথে থেকে (যে পথ লৌকিকতা মুক্ত, ধর্মীয় ছায়ায় প্রতিপালিত এবং যাকে হিজ অনারের দয়ায় গভর্ণমেন্টের নিয়ম-নীতির নিরিখে আজ পর্যন্ত কোন আইনী বাধা-বিপত্তির মুখোমুখি হ’তে হয়নি।) এ মুহূর্তে নেহায়েত আদবের সাথে কিছু নিবেদন পেশ করছি। তাতে বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে যদিও সাময়িকভাবে হিজ অনারের কিংবা গভর্ণমেন্টের উচ্চপদস্থ অফিসারদের মেযাজ খাট্টা হ’তে পারে, কিন্তু সত্য এই যে, (আর সর্বদা সত্য বলাই আমাদের কর্তব্য) বর্তমান অবস্থাই আমাদেরকে এমন এক বিষয়ে এগিয়ে আসতে বাধ্য করেছে। যা সফল হ’লে আমরা বুঝতে পারব যে, এ পদক্ষেপে হিন্দুস্থানের মুসলমানদের অনন্য ধর্মীয় কেন্দ্রের সবচেয়ে বড় সম্মান অর্জিত হয়েছে এবং তা হিন্দুস্থানের সাধারণ জনগণের জন্য শান্তি ও স্বস্তির বড় কারণ হয়েছে। তাছাড়া তাতে খোদ সরকারের জন্য বর্তমান সাময়িক ঘোলাটে পরিস্থিতি সত্ত্বেও বড় ধরনের বাস্তব নিরাপত্তা ও শান্তি অর্জনের নিশ্চয়তা হবে এবং সরকারের এহেন কৌশলগত পদক্ষেপে সাধারণ মুসলিমদের হৃদয় বশীভূত হবে। একটি বড় দলীল হয়ে থাকবে।

আমাদের জামা‘আতের দরদী হিতাকাঙ্ক্ষী হিজ অনারের নিকট এ কথা অবিদিত নেই যে, শিক্ষক হযরত মাওলানা মাহমূদ হাসানের অনাকাঙ্ক্ষিত নযরবন্দী (গভর্ণমেন্টের নিকটে তা যতই শক্তিশালী প্রমাণের ভিত্তিতে হোক না কেন) দারুল উলূমের সার্বিক অবস্থাকে নিদারুণ মর্মাহত করেছে। এক্ষণে বার বার তার মুক্তির আশা করা সত্ত্বেও দারুল উলূমের বন্ধু-বান্ধব এবং তার অসংখ্য শিক্ষার্থী তার দীর্ঘ বিচ্ছেদে অত্যন্ত ব্যাকুল ও ভগ্ন হৃদয়ে দারুল উলূমের কেন্দ্রীয় মর্যাদা ও কাফেলা প্রধান শামসুল ওলামা মাওলানা মৌলভী হাফেয মুহাম্মাদ আহমাদ ছাহেবের আল্লাহ প্রদত্ত সম্মান, পদ ও প্রভাবের সাথে আমাদের আশার তরী যুক্ত করে (অর্থাৎ তার নেতৃত্বে) হযরত মাওলানার মুক্তির জন্য প্রথমে আমরা আল্লাহর রহমতের উপর এবং পরে হিজ অনারের বিশেষ বিবেচনার উপর ভরসা করছি। আশা করি আমরা নিরাশ হব না।

এ কথা প্রকাশের আমরা তেমন কোন প্রয়োজন বোধ করি না যে, আমাদের জামা‘আত একটি রক্ষণশীল জামা‘আত। যাদের অধিকার প্রার্থনা কিংবা দাবী-দাওয়া আদায়ে আজকালকার প্রচলিত নতুন নতুন পথ ও পদ্ধতির সাথে আদৌ কোন সম্পর্ক নেই।

আবার আমাদের সমমনা এমন কোন সম্মানিত ব্যক্তিও নেই যিনি কাউন্সিল সমূহে আমাদের কোন চাওয়া-পাওয়া সম্পর্কে বিরামহীন চেষ্টা-চরিত্র চালিয়ে যাবেন। আবার ইংরেজী শিক্ষাও আমাদের মস্তিষ্ককে এতটা আলোকিত করেনি যে, আমাদের আবেদনগুলি মনযূর করিয়ে নিতে আমরা আয়ারল্যান্ডের কিংবা কমপক্ষে ন্যাশনাল কংগ্রেসের অনুকরণে আইনী কিংবা বেআইনী আন্দোলন (ধমরঃধঃরড়হ) খাড়া করব। এহেন আন্দোলনকে আমরা আমাদের দুর্বলতা হেতু রাষ্ট্রীয় শিষ্টাচার রক্ষার ক্ষেত্রে অদূরদর্শিতা মনে করি।

আমাদেরকে নিঃসন্দেহে এরূপ সুপরামর্শও দেওয়া হয়েছে যে, আইনী সীমারেখার মধ্যে থেকে মিছিল-মিটিং ও শোরগোল তুললে তোমাদের নযরবন্দ ব্যক্তিকেও মিঃ এনি বেসান্টের মতো ছেড়ে দেওয়া হবে। কিন্তু আমাদের কেউ চাটুকার বলুক, কিংবা ভীরু অথবা দূরদর্শী কিংবা বুদ্ধিমান বলুক আমরা শুধু বললাম, প্রথমত সাধারণ নযরবন্দ ব্যক্তিদের ব্যাপারে মিঃ এনি বেসান্টের দৃষ্টান্ত আমাদের জন্য পুরোপুরি দিকনির্দেশনা দেয় না। দ্বিতীয়তঃ যদি আমরা কিছু জোরালো রেজুলেশন পাশ করি এবং দু’চারটা টেলিগ্রাম বা তারবার্তা ভাইসরয় বাহাদুর ও স্টেট সেক্রেটারী (রাজ্য সচিব) বরাবর পাঠিয়ে দিয়ে জনতার মিছিল ও হট্টগোলে শরীক হই, তবে আমাদের নিজেদের নীরব মতাদর্শের উপরে অবস্থান করে যে ফায়েদাটুকু আমরা পেতাম, সেটাও হাতছাড়া হয়ে যাওয়া ছাড়া তার আর কি ফলাফল হ’তে পারে?

মহোদয়,

এ সূক্ষ্ম বিষয় বিশেষভাবে হিজ অনারের মতো হুঁশিয়ার শাসকের মনোযোগ আকর্ষণযোগ্য যে, মিঃ এনি বেসান্টের ঘটনায় ইউরোপীয় এসোসিয়েশনের তীক্ষ্ণধীসম্পন্ন সদস্যদের মনে গভর্ণমেন্টের দরবারে ভদ্র শান্তিপ্রিয়দের তুলনায় বেআদব, হট্টগোলকারী ও আন্দোলনপ্রিয়রা বেশী সফলতা পাচ্ছে বলে সন্দেহ সৃষ্টি হচ্ছে। যদি এ সন্দেহ কোন পর্যায়েও মূল্য পায়, তাহ’লে তার ক্ষতিপূরণের উপায় হিসাবে সম্পূর্ণ নীরব ও রাজনীতির সাথে পুরোপুরি সম্পর্কহীন একটি জামা‘আতের প্রার্থনা মতো গভর্ণমেন্ট দয়া করে হযরত মাওলানা মাহমূদ হাসান ছাহেবকে সত্বর মুক্তি প্রদান করলে এ মুহূর্তে তার থেকে ভালো কিছু আর হবে না। তাতে সরকারের পক্ষে শুধু আমাদের পুরো জামা‘আতেরই নয়; বরং সকল ইসলামী গণমানুষের মন জয় ও কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করা সম্ভব হবে এবং সরকারের পক্ষ হ’তে সর্বতোভাবে প্রমাণ হবে যে, নীরব শান্তিপ্রিয়রা আন্দোলনপ্রিয়দের থেকে সফলতা লাভে বেশী সক্ষম হ’তে পারে।

মহোদয়,

ত্রিশ-চল্লিশ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের এ কথা বলতে একটুও দ্বিধা নেই যে, হযরত মাওলানা মাহমূদ হাসান সারা জীবন তামাম দেওবন্দী জামা‘আতের মতোই রাজনৈতিক ডামাডোল থেকে দূরে থেকেছেন। না তিনি স্বাদেশিকতাবাদী, আর না তিনি জাতীয়তাবাদী; বরং তিনি একজন সাচ্চা আল্লাহ প্রেমিক মানুষ। আর মানুষ যতক্ষণ মানুষ, ততক্ষণ তার থেকে বিস্মৃতি, ভুল-ভ্রান্তি ও ভুল বুঝাবুঝি হতেই পারে। কিন্তু একজন দ্বীনদার ধার্মিক মানুষ কখনো বদ স্বভাবের হ’তে পারে না। আমাদের পূর্ববর্তী ৪০ বছরের অভিজ্ঞতা এবং হযরত মাওলানার স্বহস্তে লেখা কিছু রচনার ভিত্তিতে আমরা তাকে দ্বীনদার নেক স্বভাবের বলেই জানি। এজন্য যুক্তপ্রদেশ সরকারের নিম্নের ঘোষণা যে, ‘লিখিত ও অন্যান্য সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে প্রমাণিত হয় যে, মাওলানা মাহমূদ হাসান ছাহেব হিজ মেজেস্টি মহামতি সম্রাটের দুশমনদের সেনা সন্নিবেশ পরিকল্পনায় সাহায্য করেছেন’... থেকে আমরা খুবই পেরেশানী ও দুঃখবোধ করছি। কিন্তু সেই লিখিত ও অন্যান্য সাক্ষ্য-প্রমাণ জানা ও পরীক্ষা করার কোন সুযোগ যখন আমাদের নেই, তখন পথ সংক্ষেপ করার জন্য আমরা স্রেফ এই আবেদন করতে চাই যে, যদি প্রশংসাভাজন মাওলানার আওয়ায কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তির আওয়াযের সাথে মিশে গভর্ণমেন্টের কানে পৌঁছে থাকেও, তবুও করুণা ও প্রজাবাৎসল্যের কথা মনে করে গভর্ণমেন্ট যেন এমন এক ব্যক্তিত্বকে মুক্তিদানে একটুও দ্বিধা না করেন যার মুক্তিতে একটি গৌরবময় ইসলামী জামা‘আতের আবেগ-অনুভূতি গভর্ণমেন্টের প্রতি কৃতজ্ঞতাপাশে বন্দী হয়ে থাকবে এবং দারুল উলূমের দরজা-প্রাচীর দিয়ে গভীর কৃতজ্ঞতার উপচে পড়া এমন আবেগের ঢেউ নযরে আসবে যা সম্ভবত ইতিপূর্বে কখনও দেখা যায়নি।

হিজ অনারের প্রশস্ত হৃদয় ও করুণা-মেহেরবানী যা আজ অবধি আমাদের জামা‘আতের উপর ক্রিয়াশীল, তাতে আমাদের পূর্ণ বিশ্বাস যে, আমাদের এ দরখাস্ত বৃথা যাবে না এবং হিজ অনার যথাসাধ্য মেহেরবানী করতে কোন কসুর করবেন না।

পরিশেষে আমরা অতি কথনের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং সফলতা ও কল্যাণের আশা রেখে এ অকিঞ্চিৎকর লেখা এখানেই শেষ করছি। আমরা আপনার অকৃত্রিম শুভানুধ্যায়ী ও বিশ্বস্ত-

ওলামায়ে দেওবন্দ ১৮ই মুহাররম ১৩৩৬ হিজরী মোতাবেক ৬ই নভেম্বর ১৯১৭ খৃষ্টাব্দে।[1]

দরখাস্তের আলোকে

দেওবন্দের আলেমদের উক্ত সম্মিলিত দরখাস্ত থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।-

১. মাওলানা মাহমূদ হাসান (শায়খুল হিন্দ) রেশমী রুমাল আন্দোলনের মাধ্যমে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন বলে প্রমাণ করানোর চেষ্টা করা হয়, তা মোটেও বাস্তবসম্মত নয়। তিনি ইংরেজের বিরুদ্ধে কোন আন্দোলনে অংশ নেননি।

২. মাওলানা মাহমূদ হাসান মরহূমের গ্রেফতারী স্রেফ সন্দেহের বশে হয়েছিল।

৩. মাওলানা মাহমূদ হাসান সহ সমগ্র দেওবন্দী জামা‘আত রাজনৈতিক ডামাডোল থেকে পৃথক ছিলেন এবং যে স্বাদেশিকতা ও জাতীয়তাবাদী চেতনা থেকে মানুষ সাধারণত রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশ নিয়ে থাকে, তা থেকে পবিত্র ছিলেন।

৪. দেওবন্দী জামা‘আত ‘একটি সম্পূর্ণ নিশ্চুপ এবং রাজনীতির সাথে সম্পর্কহীন জামা‘আত’।

৫. এ দরখাস্ত ১৯১৭ সালের। যার পরিষ্কার অর্থ, ১৯১৭ সালের আগে দেওবন্দী আলেমদের সম্মিলিত স্বীকৃতি অনুসারে দেওবন্দী আলেমদের জিহাদ আন্দোলন অথবা স্বাধীনতা আন্দোলন কিংবা অন্য কোন রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের কোন প্রমাণ নেই। যদি কোন ব্যক্তি এমন দাবী করেন এবং তাদের রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের কথা বলেন তবে তার দাবী ভুল।

এই সম্মিলিত দরখাস্ত থেকে আমাদের এই অবস্থানের সমর্থন মেলে যে, দেওবন্দী আলেমদের ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের নায়ক সাব্যস্ত করা অথবা তাদেরকে জিহাদ আন্দোলনের সেনাপতি প্রমাণ করা সরাসরি ইতিহাস বিকৃতি।

শায়খুল হিন্দের প্রথম দিকের জীবনী লেখকদের বর্ণনা থেকে সমর্থন

পূর্বের বর্ণনা থেকে যদিও দেওবন্দী মুরববীদের রাজনৈতিক কর্মকান্ডের দৈর্ঘ-প্রস্থ তথা সীমারেখা পরিষ্কার হয়ে গেছে, তথাপি এ প্রসঙ্গে আরো সূত্র ও সাক্ষ্যের উল্লেখ কম চিত্তাকর্ষক হবে না। এজন্য সেটাও দেখা ভালো। এ প্রসঙ্গে আমরা শায়খুল হিন্দের প্রথম দিকের দু’জন নির্ভরযোগ্য জীবনী লেখকের বর্ণনা উল্লেখ করব।-

রেশমী রুমাল আন্দোলনের দু’টি দিকের কথা বলা হয়।

‘একটি দিক, হিন্দুস্থানের বাইরে ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রচার-প্রোপাগান্ডা চালানো এবং বিভিন্ন দেশে নিজেদের দূত পাঠিয়ে বহিঃশক্তির সাহায্য গ্রহণ। দ্বিতীয় দিকটি ছিল, হিন্দুস্থানের মুসলমানদের মধ্যে জাগরণ সৃষ্টি করা এবং বাইরে থেকে সৃষ্ট আন্দোলনকে সহযোগিতা দানের জন্য তাদের প্রস্ত্তত করা’।[2]

শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমূদ হাসানের হেজায সফর এবং সেখানে গালিব পাশা, আনওয়ার পাশা ও অন্যান্য তুর্কী কর্মকর্তার সাথে সাক্ষাৎ- বর্ণিত প্রথম উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যে বলে বলা হয়ে থাকে। কিন্তু ‘আসীরে মাল্টা’ যা ঐ সফর ও সফরে সংঘটিত ঘটনাবলীর সবচেয়ে প্রামাণ্য ও গ্রহণযোগ্য বই এবং যার লেখক মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী মরহূম, যিনি শায়খুল হিন্দের সফরসঙ্গী হিসাবে প্রকাশ্যে নির্জনে সর্বদা তার সঙ্গী ছিলেন, তাতে হেজায সফরের উদ্দেশ্য সম্পর্কে এ কথা বলা হয়েছে যে, বলকান ও ত্রিপলী যুদ্ধে মাওলানা মাহমূদ হাসান মরহূম তুর্কী খেলাফতের প্রতি সহানুভূতিশীল ও তার হিতাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। এজন্য ইংরেজদের ইঙ্গিতে তুর্কী খেলাফতের বিরুদ্ধে যেসব ফৎওয়া ও বিবৃতি প্রদান করা হ’ত তিনি তার ঘোর বিরোধী ছিলেন। এ বিষয়টিই মরহূম মাওলানা সম্পর্কে ইংরেজ সরকারকে বিদ্বিষ্ট করে তোলে এবং তাকে গ্রেফতার করা হ’তে পারে বলে সন্দেহ সৃষ্টি হয়। তাই গ্রেফতারী থেকে বাঁচার জন্য তিনি হেজায গমনের সংকল্প করেন। এ বিষয়ে মাওলানা মাদানী মরহূম লিখেছেন, ‘যেহেতু মাওলানার ধর্মীয় সম্মানবোধ অত্যন্ত তীব্র ছিল, সেহেতু এসব অবস্থা দেখে তিনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন না। তাই ধর্মীয় জোশে কোন কোন সময় প্রথা ও রাষ্ট্রবিরোধী কথাও মুখ ফসকে বেরিয়ে যেত। যার ফলে গভর্ণমেন্টের খয়ের খাঁ, ইসলামের দুশমন ও প্রবৃত্তিপূজারীদের দল তার বিরুদ্ধে সরকারের নিকট কান ভাঙানির সুযোগ পেয়ে যায়। মরহূম মাওলানার দুশমনদের অনেক দিন থেকেই তাকে অপমান-অপদস্থ করার বাসনা ছিল। তাদের সে বাসনা পূর্ণ হ’ল... এদিকে তুর্কীরা খেলাফত লাভের হকদার নয় মর্মে দু’বার ফৎওয়া প্রকাশিত হয় এবং (তার সম্মতি ও স্বাক্ষরের জন্য) দু’বার তার সামনে তা উত্থাপন করা হয়। দু’বারই তিনি তা নাকচ করে দেন এবং যারা যারা এর পক্ষে লিখেছিলেন তিনি তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষা ব্যবহার করেন, সর্বসমক্ষে তাদের একেবারে ছুঁড়ে মারেন। যেহেতু এ ফৎওয়া সরকারের ইঙ্গিতে কিংবা আদেশে প্রদান করা হয়েছিল, সেহেতু উক্ত কারণে সরকার তার প্রতি আরো সন্দেহপ্রবণ হয়ে ওঠে.... মৌলভী আব্দুল হক হক্কানী প্রমুখ ছিলেন এ ফৎওয়ার উদগাতা ও লেখক।[3] এ দিনগুলিতে আফগানিস্তান সীমান্তেও নানা ঘটনার সূত্রপাত হয় এবং তাতে সরকারের প্রাণহানি, অর্থহানি দু’টিই ঘটে। যেহেতু সীমান্তের উপজাতিগুলির মাঝে এ ধরনের আন্দোলন সচরাচর তথাকার মৌলভীদের দ্বারা ঘটে এবং ইয়াগিস্তান কিংবা আফগানিস্তানের অধিকাংশ মৌলভী ছিলেন মাওলানা মরহূমের ছাত্র কিংবা শুভানুধ্যায়ী, সেহেতু দুশমনদের গভর্ণমেন্টের নিকট তার বিরুদ্ধে কান ভারি করার সুযোগ এসে যায়। সরকারকে বুঝানো হয় যে, ইয়াগিস্তানের উপজাতিগুলির মাঝে যে নানামুখী জিহাদী তৎপরতা চলছে তা মাওলানা ছাহেবের ইঙ্গিতে হচ্ছে। এ সুযোগে শত্রুরা বলকান ও ত্রিপলীর যুদ্ধকালে মাওলানার আবেগমথিত আলোচনা তুলে ধরে গভর্ণমেন্টকে তার প্রতি আরো সন্দিগ্ধ করার চেষ্টা চালাতে থাকে। মোদ্দাকথা, একদিকে যুদ্ধের ঘটনাবলী মাওলানা মরহূমের উপর প্রভাব ফেলছিল, অন্যদিকে তার প্রতি সরকারের সন্দেহ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল, আর শত্রুদেরও তার বিরুদ্ধে বরাবর নানা সুযোগ হাতে আসছিল। শেষ পর্যন্ত অবস্থা এতদূর গড়ায় যে, মাওলানার প্রতি সরকারের সন্দেহের তীর অত্যন্ত প্রবল হয়ে দাঁড়ায়। চারিদিকের খবর সম্পর্কে অবগত কিছু বন্ধু-বান্ধব মাওলানাকে জানান যে, এ সময়ে গভর্ণমেন্ট ‘ইন্ডিয়া সেফটি এ্যাক্ট’-এর অধীনে লোকদের গ্রেফতার করছে। ইতিমধ্যে ‘যমীনদার’ পত্রিকার সম্পাদক মৌলভী যাফর আলী খান, ‘কমরেড’ পত্রিকার সম্পাদক মাওলানা মুহাম্মাদ আলী ও তার ভাই মাওলানা শওকত আলী প্রমুখ নযরবন্দ হয়েছেন, আপনার সম্পর্কেও সরকারের এমনই চিন্তা-ভাবনা চলছে। তাই এই ফিৎনার যুগে যখন কোন ইনভেস্টিগেশন যথাযথ হয় না, তখন নিজের হেফাযতের ব্যবস্থা আপনি নিজেই করুন! কিছুদিন আগে থেকেই মাওলানা মরহূমের হেজায সফরের ইচ্ছা ছিল। তাই এ সময়ে হেজায সফরই সমীচীন বোধ হয়। সেখানে অন্তত মহাযুদ্ধের দিনগুলি নিরাপদে ও নিশ্চিন্তে মা‘বূদের স্মরণে কাটানো যাবে। জীবনের শেষাংশ এমন সৌভাগ্যের ও বরকতময় স্থানে ব্যয় করতে পারা খুবই উত্তম ও উপযোগী হবে’।[4]

যেখানে গালিব পাশা ও অন্যদের সঙ্গে যোগ দিয়ে ইংরেজের বিরুদ্ধে সাহায্য লাভের কথা উঠছে সেখানে মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী মরহূম আগুনে পানি ঢালার মতো করে ‘মাওলানার বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ ও তার অযৌক্তিকতা’ শিরোনামে লিখছেন, ‘এ স্থানে ঐ খবরের জট খুলে দেওয়াও সমীচীন মনে করছি, যে খবর শত্রুরা গভর্ণমেন্টের কানে পৌঁছিয়েছিল এবং যার সম্পর্কে আমাদেরকে বার বার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। গভর্ণমেন্টের কানে এ খবর পৌঁছানো হয়েছিল যে, মাওলানা মরহূম মক্কা মু‘আযযমায় অবস্থানকালে হেজাযের গভর্ণর গালিব পাশার সাথে দেখা করে হিন্দুস্থান- বাসীদের উদ্বুদ্ধকরণ ও তুর্কীদের পক্ষ থেকে সকল প্রকার সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানের প্রতিশ্রুতিযুক্ত একটি লিখিত পত্র লাভ করেছেন। সে পত্র মৌলভী মুহাম্মাদ মিয়াঁ ছাহেব মদীনা মুনাওয়ারা থেকে নিজে সাথে করে নিয়ে আসেন এবং হিন্দুস্থানের লোকেরা সে পত্র দেখেছে। আমি বুঝি না, এ ধরনের অবাস্তব কথা ও গুজবে গভর্ণমেন্ট কেন কান দেয় এবং প্রত্যেক ভদ্র-অভদ্রের অযৌক্তিক কথায় বিশ্বাস করে।

গালিব পাশার সাথে মাওলানার সাক্ষাৎ হয় হজ্জের আগে সম্ভব হবে, নয় পরে। কিন্তু যেহেতু সারা পৃথিবী জানে যে, গালিব পাশা তায়েফে বাস করতেন, বিশেষ করে গরমকালে। এজন্য হজ্জের আগে তার সাথে সাক্ষাৎ সম্ভব ছিল না। গালিব পাশা সে বছরও তায়েফ থেকে রওয়ানা দিয়ে সোজা আরাফাতে এসে হজ্জে শরীক হন। মাওলানা মরহূমও হজ্জের আগে মক্কা মু‘আযযমার বাইরে কোথাও যাননি। হজ্জ শেষে অবশ্য গালিব পাশা মক্কায় এসেছিলেন, কিন্তু যেহেতু সিরীয় কাফেলা হজ্জে এসেছিল এবং তার পরিচালক ছিলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আনোয়ার পাশার সম্মানিত পিতা, সেহেতু গভর্ণর ছাহেবের নিজের সরকারী দায়-দায়িত্বের বাইরে কারো সাথে একটা কথা বলারও অবকাশ ছিল না। পুরো কাফেলার ব্যবস্থা করা, কোষাগারের চিন্তা, আনোয়ার পাশার সম্মানিত পিতার যত্ন-আপ্যায়ন, হজ্জের ব্যবস্থাপনা, শহরের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, দূর-দূরান্ত থেকে আগত তুর্কী কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাৎ ইত্যাদি নানা কারণে তার এত সময় কোথায় ছিল যে, তিনি মাওলানার সাথে প্রারম্ভিক সাক্ষাৎ ও পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপন করবেন? আবার সে সম্পর্কও এতটা গভীর ও উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছবে যে, তা শাহী অঙ্গীকারনামা এবং প্রতিশ্রুতি পত্র তৈরি ও হস্তান্তরের উপলক্ষ হয়ে দাঁড়াবে? এমন কাজে তো মাসের পর মাস লেগে যায়!

এদিকে মাওলানারও মদীনা মুনাওয়ারা যাত্রার চিন্তা, সেজন্য প্রস্ত্ততি নেওয়া, মাওলানার নিকট আগত বিভিন্ন শ্রেণীর হিন্দুস্থানী হাজীদের সব সময় লেগে থাকা ভিড় সামাল দেওয়া এবং হারাম শরীফে ইবাদতের আগ্রহ, যা বহুকাল পর নছীব হয়েছিল, এতসব কিছু তাকেই বা কি করে এ জাতীয় কথার সুযোগ করে দেবে? তদুপরি ঘটনা এমন দাঁড়ায় যে, গালিব পাশা সিরীয় কাফেলা রওয়ানা হওয়ার পরপরই তায়েফ ফিরে যান। আবার তুর্কী ভাষা ছাড়া না তিনি উর্দূ-ফারসী জানতেন, (দু’চারটে প্রয়োজনীয় শব্দ ছাড়া কথাবার্তা চালানোর মতো আরবীও তার জানা ছিল না) আর না মাওলানাও তুর্কী ভাষা জানতেন। মাওলানার সেখানে এমন কোন মধ্যস্থতাকারীও ছিল না যে তার মাধ্যমে এমন একজন উচ্চপদস্থ শাসকের নিকট তিনি পৌঁছতে পারবেন। আর জীবনভর মাওলানারও না শাসকশ্রেণী ও দুনিয়াদারদের প্রতি কোন আন্তরিক আকর্ষণ ছিল। এতসব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও জানি না গভর্ণমেন্ট কোত্থেকে গালিব পাশার প্রতিশ্রুতি পত্রের পেরেশানী উদ্রেককারী স্বপ্ন দেখল এবং তার উপর দৃঢ় বিশ্বাস করে বসল। এভাবেই গভর্ণমেন্টের লোকেরা যারা দৃশ্যত গভর্ণমেন্টের বন্ধু কিন্তু বাস্তবে শত্রু, গভর্ণমেন্টকে ভুলভাল অনেক ধোঁকা দিয়েছে। ঘটনাবলীর সত্যতা তাদের সেসব ভুল দিবালোকের মতো স্পষ্ট করে দিয়েছে।

এতে কোন সন্দেহ নেই যে, মাওলানার মধ্যে ইসলামের প্রতি সহানুভূতি ও দ্বীনী মহববত অনেক বেশী ছিল। এ কারণে স্বদেশ ও স্বজাতির আযাদী লাভের চিন্তাও তার মধ্যে বেশী মাত্রায় ছিল। এ নিয়ে তিনি সর্বদাই পেরেশান থাকতেন। নানারকম ব্যবস্থা ও কার্যক্রমও হাতে নিতেন। কিন্তু কথা এখানে যে, এসব উদ্দেশ্য সাধনের জন্য মাওলানা কোন বাইরের রাষ্ট্রের সাহায্য গ্রহণ এবং তদ্বারা গভর্ণমেন্টের ক্ষতি করার মানসে কোন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন কি? শত্রুরা তো এমনই এক জুজুবুড়ির ভয় দেখিয়ে গভর্ণমেন্টকে মাওলানার প্রতি সন্দেহাকুল করে তোলে। গভর্ণমেন্ট দেশের অভ্যন্তরে স্বাধীনতা লাভের চেষ্টা এবং আইনী সীমারেখার মধ্যে থেকে ইসলামের যেসব কাজ নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ সেগুলির প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শনে বাধা দিত না এবং খারাপ বিবেচনা করত না ।

... মোটকথা, যেসব অকপট চাওয়া-পাওয়া আম-খাছ সবার মধ্যে থাকা সমীচীন, তা লাভের চেষ্টা করা বরং গভর্ণমেন্টের উদ্দেশ্য পূরণে সহযোগিতা করা। এজন্য গভর্ণমেন্টের নিকট প্রজাদের এমন কাজ খুবই প্রিয় ও পসন্দনীয়। কিন্তু সেক্ষেত্রে বাইরের রাষ্ট্র সমূহের সাথে যোগাযোগকে ভালো চোখে দেখা হয় না। অথচ শত্রুরা সেই মিথ্যা রটনাটাই বহু ভাবে করেছিল। কিন্তু আল-হামদুলিল্লাহ, তাদের কোন কথাই প্রমাণিত হয়নি এবং তাতে বাস্তবতার ছিটেফোঁটাও ছিল না।

লোকেরা গভর্ণমেন্টের কানে একথাও পৌঁছিয়েছিল যে, মাওলানা ছাহেব আনোয়ার পাশা ও জামাল পাশার নিকট থেকে লিখিত প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকারনামা হাছিল করে মৌলভী হাদী হাসান ছাহেবের মাধ্যমে অমুক কাপড়ে মুড়িয়ে অমুক সিন্দুকে করে পাঠিয়েছেন। এ খবর পাওয়ার সাথে সাথেই নিরাপত্তারক্ষীরা মৌলভী হাদী হাসান ছাহেবের অনুপস্থিতিতে তার বাড়িতে গিয়ে হাযির হয় এবং বাড়ি তল্লাশির নামে তন্ন তন্ন করে সিন্দুকের মধ্যে খোঁজ করে। প্রতিটা শেলফ বা তাক ভেঙে ফেলে। কিন্তু কিছুই বের হ’ল না। আর বের হবেই বা কি করে? যে জিনিস হয়ই নি তা বের হবে কোত্থেকে? কিন্তু শত্রুরা গভর্ণমেন্টকে ধোঁকায় ফেলতে বিন্দুমাত্র ত্রুটি করেনি।

এসব কাজে লাভের লাভ এতটুকু অবশ্যই হয়েছে যে, গভর্ণমেন্ট বুঝে ফেলেছে, মাওলানা সম্পর্কে আনীত অধিকাংশ কথাই বাস্তবতা বিরোধী এবং ব্যক্তিগত স্বার্থ ও হিংসা চরিতার্থ করার জন্য এগুলি আনা হয়েছে’।[5]

সামনে গিয়ে পুনরায় তিনি মাওলানা মরহূমের জামাল পাশা ও আনোয়ার পাশার সাথে দেখা করা এবং তাদের থেকে অঙ্গীকারনামা অর্জনকে অসত্য, মিথ্যা অপবাদ ও স্রেফ গুজব বলে আখ্যায়িত করেছেন।[6]

এখন প্রশ্ন দাঁড়ায় যে, মাওলানা মাহমূদ হাসান মরহূম যদি গালিব পাশা ও অন্যান্যদের নিকট সাহায্যের আবেদন না-ই করবেন তাহ’লে তাকে গ্রেফতার করা হ’ল কেন? তার কারণ সম্পর্কে মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী মরহূম বলেছেন যে, তুর্কীদের বিরুদ্ধে কুফরীর ফৎওয়া তৈরি করা হয়েছিল। তার উপর শায়খুল হিন্দ ও তার সঙ্গীদেরও স্বাক্ষর করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তারা স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করায় হেজাযের শাসক শরীফ হুসাইন তাদের প্রতি ক্রুদ্ধ হন এবং তাদের গ্রেফতার করে ইংরেজদের হাতে সোপর্দ করেন। [সারকথা, আসীরে মাল্টা]

২- শায়খুল হিন্দের অন্য একজন জীবনী লেখক মাওলানা সাইয়েদ আছগার হুসাইন ‘কুধারণা সৃষ্টির আরেক কাহিনী’ শিরোনামে ঐ গ্রেফতারীর আরেকটি কারণ উল্লেখ করেছেন। সে কারণের সাথেও বর্ণিত রেশমী রুমাল আন্দোলনের কোন সম্পর্ক নেই।[7]

স্মরণ রাখুন, এ গ্রন্থও বড়ই বিশ্বাসযোগ্য ও প্রামাণ্য। গ্রন্থের ভূমিকায় গ্রন্থটিতে বর্ণিত ঘটনাবলী ও বিবরণাদির প্রামাণ্যতা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘এ গ্রন্থে যা কিছু লেখা হয়েছে তার অধিকাংশই চোখে দেখা অথবা হযরত আকদাসের বরকতময় মুখ থেকে শোনা, অথবা কিছু খুবই নির্ভরযোগ্য মনীষীর বর্ণনা (পৃ. ১০)। তাছাড়াও রূহানীভাবে গ্রন্থটি যে শায়খুল হিন্দের পসন্দসই হয়েছিল তার প্রকাশ নিম্নোক্ত শব্দে তুলে ধরা হয়েছে। ‘গ্রন্থটি বিন্যাস ও রচনাকালে বিভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে সাতবার স্বপ্নে হযরতের যিয়ারত নছীব হওয়ায় এতটুকু আশা করা যায় যে, তিনি নারায নন’ (পৃ. ১১)

এ গ্রন্থেও হযরত শায়খুল হিন্দ ও তার সাথীদের গ্রেফতারের সেসব কারণ উল্লেখ করা হয়েছে যা ‘আসীরে মাল্টা’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানেও কোত্থাও ‘রেশমী রুমাল আন্দোলনের’ উল্লেখ নেই। বরং এক জায়গায় লেখা আছে, ‘নেককারদের এই জামা‘আত, যাদের নির্জনতা, ইবাদতে ব্যস্ততা, দুনিয়াবিমুখতা ও সত্য প্রকাশ ছাড়া নিজেদের কোন অপরাধ আছে বলে জানা ছিল না তারা (গ্রেফতারের) এ হুকুম শুনে হতভম্ব হয়ে যান’ (পৃ. ৭২)

যাহোক শায়খুল হিন্দের এই দুইজন প্রথম দিকের বিশ্বস্ত জীবনীকার এ বিষয়ে একমত যে, তার গ্রেফতারী ইংরেজের বিরুদ্ধে কোন আন্দোলনের ফলে ছিল না, বরং তা ছিল অহেতুক গুজব, মিথ্যা অপবাদ, হেজাযে উদ্ভূত কাফের সাব্যস্ত করার ফৎওয়া স্বাক্ষরে অস্বীকৃতি এবং অন্যান্য সন্দেহজনক বিষয়ের ফলশ্রুতিতে সৃষ্ট ফিৎনা।

এছাড়াও ঐ দুই জীবনী গ্রন্থে একথাও বলা হয়েছে যে, হযরত শায়খুল হিন্দ হেজায সফরকালে স্বাভাবিক বয়সের শেষ দিকে উপনীত হয়েছিলেন। তখন তার বয়স ছিল সত্তুরের ঊর্ধ্বে। এ বয়সে তার কোন রাজনৈতিক আন্দোলনের সূত্রপাত করা কিংবা তাতে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো সক্ষমতা ছিল না।

গ্রেফতারকাল অবধি শায়খুল হিন্দ ও তার হাযার হাযার ছাত্র রাজনৈতিক বিষয়াদি ও কার্যাবলী থেকে সম্পূর্ণরূপে সম্পর্কহীন ছিলেন। ‘রাজনীতি ও বর্তমান পরিস্থিতির সাথে সম্পৃক্ততা’ শিরোনামে মাওলানা সাইয়েদ আছগার হুসাইন (রহঃ) যা কিছু লিখেছেন তার শব্দে শব্দে উক্ত কথার সমর্থন মেলে। এতদ্বিষয়ক বিস্তারিত বর্ণনা নীচে উদ্ধৃত হ’ল।-

তিনি লিখেছেন, ‘হযরত মাওলানা প্রকৃত অর্থেই দুনিয়াত্যাগী, পরকালে আগ্রহী, নির্জনতাপ্রিয় আলেম ছিলেন। বাইরে পড়া-পড়ানো ও হাদীছ শিক্ষাদান এবং ভিতরে হিম্মত, তাওয়াজ্জুহ ও যিকির-ফিকিরের তা‘লীম প্রদানের মাধ্যমে সারা জীবন মানুষের সংশোধন ও সংস্কারে লিপ্ত ছিলেন। খ্যাতির পথ ও পন্থা না তিনি গ্রহণ করেছেন, না পসন্দ করতেন। রাজনৈতিক বিষয়ে না কখনও নাক গলিয়েছেন, না প্রয়োজন ছাড়া এ জাতীয় কাজকে নিজের উচ্চ মর্যাদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ মনে করেছেন। তার এই নির্জনতার ফল দাঁড়িয়েছিল এই যে, তার হাযার হাযার সমমনা ব্যক্তিবর্গ, মুরীদ, শুভাকাঙ্ক্ষী এবং শিক্ষার্থীও রাজনীতি জাতীয় কার্যাবলী থেকে বিরত থেকেছেন। যে কারো সাথে তার যতটুকু সম্পর্ক ছিল- কম হোক কিংবা বেশী এবং যার সাথেই সংযোগ ছিল, চাই তা ভালবাসাপূর্ণ হোক কিংবা বিদ্বেষপূর্ণ, তার সবই ছিল ইসলাম ও শরী‘আতের নিরিখে এবং ঈমানী চাহিদা অনুসারে।

অমুসলিম রাষ্ট্র ও অনৈসলামী সরকার, চাই তা যতই ইনছাফপূর্ণ হোক এবং তা যতই প্রসার লাভ করুক, মুসলমানদের তাদের অধীনে থাকা বড়ই বেদনাদায়ক ও দ্বীনের জন্য বড় মুছীবত... কিন্তু তা সত্ত্বেও মাওলানা رضينا بقضاء الله ‘আমরা আল্লাহর ফায়ছালায় সন্তুষ্ট’ বলে একদম নীরবতা ও ধৈর্য অবলম্বন করে হিন্দুস্থানে বসবাস করতেন। অন্তরে যতই বেদনা ও কষ্ট থাকুক কিন্তু সময় সাক্ষী, মাওলানা লিখিত কিংবা বক্তৃতা-বিবৃতিতে এমন কোন কথা প্রকাশ ও ঘোষণা করেননি রাষ্ট্র যা সন্দেহের চোখে দেখতে পারে...। হযরত মাওলানা রশীদ আহমাদ (গাঙ্গুহী) কুদ্দিসা সির্রুহু-এর নামে এক সময়ে ‘শারঈ প্রয়োজনে চুক্তিবদ্ধ পক্ষের সাথে চুক্তি লঙ্ঘন না করা এবং চুক্তিবদ্ধ পক্ষকে হত্যা করা হারাম’ হওয়ার বিষয়ে যে ফৎওয়া প্রকাশিত হয়েছিল তাতে হযরত মাওলানার সত্যায়ন ও স্বাক্ষর দ্বারা আলোকিত ছিল...।

গভর্ণমেন্ট কোন ভুল করুক, অথবা কর্তব্যে অবহেলা করুক, কিংবা ইচ্ছা করে কোন অন্যায় করুক অথবা আচমকা কিছু ঘটে যাক, তাতে যদি মুসলমানদের বিন্দুমাত্র মানহানি ও দুঃখ-কষ্ট স্পর্শ করে তাতে ঈমানী প্রভাবের কারণে হযরত মাওলানার মনে খুবই কষ্ট লাগত এবং শাসক-কর্মচারীদের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্ম নিত। কিন্তু এ ধরনের সকল কাজে মনের মধ্যে কষ্ট ও জ্বালা সৃষ্টি হ’লেও বাইরে তিনি কোন পদক্ষেপ নিতেন না। তিনি فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ ‘না পারলে অন্তরে ঘৃণা করো’ হাদীছের এই অবকাশমূলক দিকের উপর সর্বদা আমল করতেন।

প্রসঙ্গত কানপুর মসজিদের বেদনাদায়ক ও দুঃখজনক ঘটনা যখন ঘটল, তখন তাতে হযরত মাওলানার মনে খুব কঠিন দাগ কেটেছিল। সে সময়ে কয়েক দিন ধরে মুখ দিয়ে শুধু আফসোসপূর্ণ কথা বের হত এবং চেহারার উপর বিষাদ ছেয়ে থাকত। যদিও সমকালীন নামী-দামী অনেকে উপকার ভেবে উক্ত বিষয়ে সাধ্যমতো বক্তৃতা ও বিবৃতিতে সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু হযরত মাওলানা সেই ফরযে কেফায়ায় ঐ সকল ব্যক্তির হিম্মতকে যথেষ্ট মনে করেছিলেন অথবা ক্ষমতার অভাবে কোন সক্রিয় চেষ্টাগ্রহণ অর্থহীন মনে করে নীরব ছিলেন।

১৩৩২ হিজরীতে (১৯১৪ সালে) ইউরোপে যে ধ্বংসাত্মক মহাযুদ্ধ শুরু হয় এবং জার্মানী ও বৃটেনের মধ্যে টানাপোড়েন বাড়তে বাড়তে ঘটনা এতদূর গড়ায় যে, হিন্দুস্থানের আট কোটি মুসলমানের আবেগ-অনুভূতির বিরুদ্ধে গিয়ে বৃটেন জার্মানীর পক্ষ অবলম্বনকারী তুর্কী খেলাফতকে ভেঙে টুকরা টুকরা করে দেয়। এক সময়ে তুর্কী খেলাফত বৃটেনের শুধু সমান্তরাল ক্ষমতাধরই নয়; বরং তার ভয়ংকর শত্রু ছিল। সেই করুণার যোগ্য তুর্কী সালতানাতকে রক্ষা ও তার প্রতি আন্তরিক টান থেকে ভারতীয় মুসলিমরা যে তার সাহায্য-সহযোগিতা করবে সে সুযোগও ইন্ডিয়ান সরকারের পক্ষ থেকে রুদ্ধ করে দেওয়া হয়। মুসলমানরা হৃদয়ের ক্ষত হৃদয়েই পুষে রাখতে বাধ্য হয়। এই সংকটময় অবস্থা ও ধৈর্যের পরীক্ষাকালে ‘পবিত্র স্থানসমূহ হেফাযত ও খেলাফতের ক্ষমতাধারীদের সাহায্য করা হবে’ মর্মে গভর্ণমেন্টের মন খুশী করা কিছু প্রতিশ্রুতির উপর নির্ভর করে হিন্দুস্থানী আলেম-ওলামা, নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ও জননেতাগণ যে ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও নীরবতা দেখিয়েছেন এবং সাধারণ মানুষ যেভাবে শান্ত থেকেছে তা অক্ষমতা নামক সহজ অজুহাত সূত্রে তৎকালে বৈধ ভাবলেও ভবিষ্যতে কিন্তু এহেন আচরণকে বিস্ময়কর মানতেই হবে। এক্ষণে আমরা তা মাকরূহ বা অপসন্দনীয় মনে করি আর না করি।

হযরত মাওলানা ঐ সময়ে হিন্দুস্থানে ছিলেন। কিন্তু একেবারে চুপচাপ ছিলেন। তার মধ্যে মর্মবেদনা ও আত্মিক কষ্ট যেমন বাড়ছিল, তেমনি শূন্যতা ও ক্ষোভও বাড়ছিল। কিন্তু সবকিছু সহ্য করে যাচ্ছিলেন, কথায়-কাজে কোনভাবেই রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশ নিচ্ছিলেন না। যেন অন্যদেরকে রাজনীতির যোগ্য ভেবে নিজেকে তার থেকে গুটিয়ে রাখছিলেন। কেননা আগে যেমনটা বলা হয়েছে, তার সমস্ত ভালো লাগা মন্দ লাগা শরী‘আতের অনুগামী ছিল। নীরব থাকার সুযোগও শারঈভাবে আছে বলে তিনি মনে করতেন। এখানকার দুঃখ-কষ্ট তার মনে হারামাইনের মাটি চুম্বনের আগ্রহ দ্বিগুণ বাড়িয়ে তোলে। ফলে তিনি সফরের কথা ঘোষণা দেন। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, এ দিনগুলিতে তার মনের ক্ষোভ ও অসন্তোষ অনেক বেড়ে গিয়েছিল। সম্ভবত এ কারণেই তার হেজায যাত্রার ছয় মাস আগে যুক্তপ্রদেশের লেফটেনেন্ট গভর্ণর স্যার জেমস যখন দারুল উলূমে শুভাগমন করেন, তখন সে উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি অংশগ্রহণ করেননি, নিজ বাড়িতেই রয়ে গিয়েছিলেন।[8]

এরপর জীবনীকার লিখেছেন, হারামাইন শরীফাইনে হেজাযের তুর্কী শাসক শরীফের বিদ্রোহ, বৃটিশ গভর্ণমেণ্টের শরীফকে সহযোগিতা দান, নিজের অন্যায় নযরবন্দী এবং বন্দিত্বের সময়কালে তুর্কী খেলাফত ও তার লোকজনদের বিরুদ্ধে ইংরেজদের কর্মকান্ড দেখে হযরত মাওলানার মনোকষ্ট আরো বেড়ে যায়। ফলে তিনি আর অনুগত ভীরু শহুরে প্রজাদের সারিতে থাকতে পারেননি, যারা কি-না সরকারের সন্দেহপূর্ণ ও অমনোপূত কাজকর্ম নিয়ে কথা বলাকে চিরস্থায়ী হারামতুল্য মনে করে। তাই মুক্তিলাভের পর তার ধৈর্যের পাল্লা সহনাতীত হয়ে পড়ে। চুপ থাকার মতো অবস্থা আর থাকেনি। শারঈ বিধানের প্রতি আনুগত্যের চেতনায় মাওলানার ইসলামী জোশ ও ধর্মীয় আবেগ উথলে ওঠে। ফলে তিনি আর বসে থাকতে পারেননি।[9]

সেই একই কথা, যা আমরা লিখে আসছি, মাওলানা মাহমূদ হাসান ও অন্যান্য দেওবন্দী আলেমগণ মাল্টার বন্দীদশার পরে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আন্দোলনে শরীক হয়েছেন। ‘হায়াতে শায়খুল হিন্দ’ গ্রন্থের লেখকও এ কথা লিখেছেন। তারপর মাওলানা মাহমূদ হাসান মাল্টা থেকে হিন্দুস্তানে ফিরে আসার পর যেসব ভূমিকা পালন করেছেন তার একটি নাতিদীর্ঘ বর্ণনা প্রদান করেছেন। যেহেতু আমরাও সে কথা অস্বীকার করছি না সেহেতু সে বর্ণনা এখানে তুলে ধরার আবশ্যকতা নেই।

যাহোক শায়খুল হিন্দের দু’জন জীবনী লেখকের বর্ণনা থেকেও এ কথার সমর্থন মেলে যে, ‘রেশমী রুমাল আন্দোলন’ নামে যে আন্দোলনের প্রচার-প্রোপাগান্ডা করা হয়, তার কোন সত্যতা নেই। না মাওলানার হেজায সফরের উদ্দেশ্য তা ছিল, যা দাবী করা হয় এবং না তার গ্রেফতারী ইংরেজদের বিরুদ্ধে কোন আন্দোলনের ফলশ্রুতি ছিল। বরং শায়খুল হিন্দ এবং তার হাযার হাযার ছাত্র ও অনুরাগী ভক্তকুল তার গ্রেফতার হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত রাজনৈতিক আন্দোলন ও কার্যকলাপ থেকে দূরে ছিলেন। প্রবাদ আছে, متفق گرديد رائے بو علي بارائے من আবু আলীর মত আর আমার মত এক মোহনায় মিলে গেছে।

এ আলোচনার পর সকল মানুষই অনুমান করতে পারছেন যে, ‘নক্বশে হায়াত’ গ্রন্থে ‘রেশমী রুমাল আন্দোলন’ ও দেওবন্দী আলেমদের রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের যে বিবরণী প্রদান করা হয়েছে তা কি ইতিহাস, নাকি ইতিহাসের নামে জালিয়াতি? সত্য ঘটনা, নাকি গালগল্প? বাস্তব কাহিনী নাকি কল্পনার কারুকার্য? প্রত্যেক ন্যায়ানুরাগী এই আয়নায় দেখে বিষয়টির সঠিক ফায়ছালা করতে পারবেন। কেননা আমরা বললে তা অভিযোগ ও দুর্নাম বলে বিবেচিত হবে।

দেওবন্দী হানাফীদের ইতিহাস বিকৃতির আরেকটি জ্বলন্ত উদাহরণ ও সাক্ষ্য :

দেওবন্দী আলেমগণ ও লেখকবৃন্দ যে প্রোপাগান্ডার যোরে ইতিহাস জালিয়াতি করেছেন তার স্বীকৃতি এমন কিছু দেওবন্দী আলেম ও লেখকরাও প্রদান করেছেন যারা পরিস্থিতি সম্পর্কে জ্ঞাত, গুপ্ত রহস্য ও অন্দর মহলের গোপন কথা অবগত হিসাবে বিবেচনার মর্যাদা রাখেন। এমনই একজন ব্যক্তি হলেন দেওবন্দ থেকে প্রকাশিত ‘তাজাল্লী’ পত্রিকার সম্পাদক মাওলানা আমের ওছমানী। আমের ওছমানী ছিলেন মাওলানা শাববীর আহমাদ ওছমানীর নিকটতম প্রিয় ব্যক্তিদের একজন। দেওবন্দ মাদ্রাসার উন্নতি এবং তার অধ্যাপনা-কারিকুলাম ও পরিচালনা বিষয়ে এই ওছমানী পরিবার ও তার মুরববীদের যে অবদান রয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু দারুল উলূম দেওবন্দের উপর চেপে বসা কাসেমী পরিবার ওছমানী পরিবারের মুরববীদের সকল খেদমত পায়ে ঠেলে দারুল উলূম দেওবন্দের উন্নতির সকল কৃতিত্ব কাসেমী পরিবারকে অর্পণ করেছে। ফলে ওছমানী পরিবারের একজন জানাশোনা ব্যক্তি মাওলানা আমের ওছমানী মরহূম এই ইতিহাস বিকৃতির উপর নিম্নোক্ত ভাষায় আক্ষেপ করেছেন :

‘দারুল উলূম দেওবন্দের বিষয়ে এ অক্ষমের পূর্বপুরুষ বুযর্গদের আলোচনা আপনি (মাওলানা মানাযির আহসান গীলানী) যেভাবে করেছেন তার উপর কিছু মন্তব্য অযাচিতভাবেই এসে যায়। আপনার জানা দরকার যে, দারুল উলূম দেওবন্দের ইতিহাস তা নয়, যা আপনি বুঝে বসে আছেন। বরং দারুল উলূম দেওবন্দের যে ইতিহাস আপনার রচিত ‘সাওয়ানিহে ক্বাসেমী’ গ্রন্থে প্রমাণের চেষ্টা করা হয়েছে তাতে বলতে হয়, বর্তমানে ইতিহাস রচনার যুগ বাসি হয়ে গেছে। এখন চলছে ইতিহাস বিকৃতির যুগ। মাওলানা মানাযির আহসান গীলানীর উপর আল্লাহর রহম হোক। কিছু কারিশমা তো তার মানসিক কল্পনা দেখিয়েছে, আর কিছু কৌশল সেসকল বুযর্গ দেখিয়েছেন যাদের নিকটে একটি বিশেষ পরিবারকে দারুল উলূমের প্রতিষ্ঠা ও উন্নতির সকল কৃতিত্ব প্রদান দ্বীন ও মিল্লাতের সবচেয়ে বড় খেদমত বলে গণ্য। ১৯৬০ সালের জুলাই মাসে এ অধম করাচীতে ছিল। সেখানে সাইয়েদ মহিউদ্দীন ছাহেবের সাথে অধমের সাক্ষাৎ হয়। সাইয়েদ মহিউদ্দীন ছাহেব এক সময় দারুল উলূমের পরামর্শ পরিষদের (মজলিশে শূরা) সদস্য ছিলেন। তার সৎ ব্যক্তিত্ব, ধার্মিকতা ও তাক্বওয়া সম্পর্কে যারাই তাকে চিনেন-জানেন তাদের কারো কোন দ্বিমত নেই। আবার মাওলানা মানাযির আহসান গীলানীর সাথেও তার গভীর সখ্যতা ছিল। সাইয়েদ মহিউদ্দীন ছাহেব এক সুযোগে অধমকে একটি ঘটনা শুনান যে, ‘সাওয়ানিহে ক্বাসেমী’ যখন ছাপার প্রস্ত্ততি চলছিল তখন তা পড়ার জন্য আমার মনে অপরিসীম আগ্রহ জন্মে। ছেপে হাতে এসে গেলে খুব শখ ও আগ্রহ নিয়ে পড়তে শুরু করলাম। কিন্তু এটা দেখে বড়ই হতবাক হলাম যে, যেসব ঐতিহাসিক ঘটনা আমাদের জানা তার কোন দূরতম সন্ধানও সেখানে নেই। কিন্তু নতুন এক ইতিহাস তাতে অবশ্যই জায়গা পেয়েছে। মনের অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না। সফর করে গীলানী ছাহেবের কাছে গেলাম এবং তাকে বললাম, হযরত, আপনি এ কি লিখেছেন? গীলানী ছাহেবের চেহারায় বিষণ্ণতা ফুটে উঠল। তিনি আফসোসের সাথে বলতে লাগলেন, ভাই কি বলব! সর্বনাশ হয়ে গেছে! আমি যা কিছু লিখেছিলাম তা ছিল ভিন্নতর। আমি বললাম, তাহ’লে মতলবটা কি? তিনি বললেন, আমার লেখা প্রায় পাঁচশ’ পৃষ্ঠা বদলে ফেলা হয়েছে।[10] দারুল উলূমের পক্ষ থেকে প্রকাশিত দারুল উলূম দেওবন্দের প্রামাণ্য ও নির্ভরযোগ্য ইতিহাস গ্রন্থ ‘সাওয়ানিহে ক্বাসেমী’-এর আসল পান্ডুলিপিকে যে কিভাবে কোন দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছাড়াই পরিবর্তন করে ছাপানো হয়েছে, সে সত্য আরো বেশ কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তি জানেন, যারা এখনও (১৯৬০ সালে) বেঁচে আছেন। আর এ পরিবর্তন খুব সামান্যও নয়, বরং অনেক ব্যাপক ও মৌলিক’।[11]

একটি আন্তরিক আবেদন

পরিশেষে এ গ্রন্থকার দেওবন্দী লেখক ও ইতিহাস রচয়িতাদের উদ্দেশ্যে একটি আন্তরিক আবেদন রাখছেন যে, দেওবন্দের মরহূম আলেমদের ধর্মীয় ও শিক্ষা বিস্তারজনিত অবস্থান একটি স্বীকৃত বিষয় এবং তাদের শ্রেষ্ঠত্বের জন্য এই একটা বিষয়ই যথেষ্ট। যোর-যবরদস্তী করে তাদেরকে রাজনীতির ময়দানের বীরপুরুষ এবং যুদ্ধ-জিহাদের শাহেনশাহ বানানোর কোন প্রয়োজন নেই। তা নিয়ে এতটা বাড়াবাড়ি করারও প্রয়োজন নেই যে, জামা‘আতে মুজাহিদীন (আহলেহাদীছ)-কে ইংরেজদের অনুগত প্রমাণ করতে হবে এবং যখন ইংরেজদের শক্তিমত্তা উচ্চতার শীর্ষে অবস্থান করছিল, আর তাদের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে কেবল সেই মুজাহিদরাই ময়দানে ছিলেন যাদের অধিকাংশ ছিলেন হাদীছ

অনুযায়ী আমলকারী, তখন দেওবন্দী আলেমদেরকে ইংরেজ শক্তির একমাত্র প্রতিপক্ষ বানানোর চেষ্টাও নিষ্প্রয়োজন, যারা ছিলেন জিহাদ আন্দোলন থেকে সর্বদা দূরে এবং অন্তত পক্ষে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক ডামাডোল থেকে মুক্ত।

আল্লাহ সাক্ষী, আমাদের জন্য এ আলোচনা মোটেও প্রীতিকর নয়। আমাদের নিশ্চিত অনুমান যে, আমাদের এই প্রত্যুত্তর ও প্রতিরক্ষামূলক জওয়াবে দেওবন্দী ঘরানার কপালে ভাঁজ পড়বে। কিন্তু শুধু ‘রাজনীতি’ই যে মান-মর্যাদার মাপকাঠি নয়, তা বুঝতে ও বুঝাতে আমাদের এ অপ্রিয় আলোচনায় অংশ নিতে হয়েছে। যদি আমাদের দেওবন্দী ভাইগণ দয়া করে এ বিষয়কে তাদের গৌরব অনুশীলন ক্ষেত্র না বানাতেন এবং আহলেহাদীছ জামা‘আতের উপর মিথ্যা অপবাদ না চাপাতেন, তাহ’লে আমরা দেওবন্দী আলেমদের রাজনৈতিক ও জিহাদী খেদমত নিয়ে কখনও কলম ধরতাম না।

কেননা আমাদের দৃষ্টিতে শুধু রাজনীতিই প্রত্যেক মানুষের খেদমতের পরিধির পরিমাপক নয়। ধর্মীয় ও জাতীয়ভাবে সেবা ও খেদমতের বিভিন্ন সেক্টর রয়েছে। আর যে সেক্টরেই হোক, তাতে কেউ ধর্মীয় ও জাতীয় খেদমত আঞ্জাম দিলে তিনিই হবেন মুসলিম জাতির কল্যাণকারী। সে ক্ষেত্রেই তার সম্মান ও মহত্ত্বের স্বীকৃতিদান যরূরী। কিন্তু কারো সাধ্যমতো খিদমতের পরেও কোন বিভাগ যদি তার কার্যক্রমের আওতার বাইরে থেকে যায় তবে এটা যরূরী নয় যে, তাকে ঠেলে-গুঁজে ঐ বিভাগেরও বীরপুরুষ বানাতে হবে। অন্যদের খেদমত অস্বীকার করে তাদের মুকুটও নিজেদের প্রশংসাভাজনদের মাথায় পরানোর ব্যর্থ চেষ্টা বরং যুলুম। আমাদের এ লেখা প্রকৃতপক্ষে এই জোরাজুরি ও যুলুমের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী আওয়ায মাত্র। আর আমরা যা বলছি তার সাক্ষী স্বয়ং মহান আল্লাহ।

[ক্রমশঃ]

মূল (উর্দূ): হাফেয ছালাহুদ্দীন ইউসুফ

পাকিস্তানের প্রখ্যাত আহলেহাদীছ আলেম, লেখক ও গবেষক; সাবেক সম্পাদক, আল-ই‘তিছাম, লাহোর, পাকিস্তান।

অনুবাদ : মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

ঝিনাইদহ।

[1]. মাসিক আর-রশীদ, দেওবন্দ, রজব ১৩৩৬ হিজরী থেকে সংকলিত

[2]. মাওলানা সাঈদ আহমাদ আকবরাবাদী, প্রবন্ধ : ওলামায়ে হিন্দ কা সিয়াসী মাওকেফ, মাসিক বুরহান, দিল্লী, নভেম্বর ১৯৪৮, পৃ. ৬৫

[3]. ইংরেজদের ইঙ্গিতে ও তাদের সমর্থনে লেখা ফৎওয়াসমূহের লেখকরাও ছিলেন মূলত হানাফী আলেমকুল- লেখক

[4]. সফরনামা আসীরে মাল্টাপৃ. ১৪-১৬, লাহোর ছাপা

[5]. আসীরে মাল্টা, পৃ. ২৩-২৭

[6]. ঐ, পৃ. ৪২-৪৩

[7]. দেখুন : হায়াতে শায়খুল হিন্দ, পৃ অ, ইদারায়ে ইসলামিয়াত, লাহোর

[8]. হায়াতে শায়খুল হিন্দ, পৃ. ২১৯-২২৩

[9]. প্রাগুক্ত, পৃ ২২৪

[10]. স্মর্তব্য যে, সাওয়ানিহে ক্বাসেমী১৩২০ পৃষ্ঠার এক বিশাল গ্রন্থযা তিন খন্ডে প্রকাশিত-লেখক

[11]. মাসিক তাজাল্লী, দেওবন্দ, পৃ. ৫৭, ফেব্রুয়ারী-মার্চ ১৯৬১






শারঈ জ্ঞানার্জনের বাধ্যবাধকতা ও বর্তমান সমাজ বাস্তবতা - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
বায়তুল মাক্বদিস মুসলমানদের নিকটে কেন এত গুরুত্ববহ? - ড. মুখতারুল ইসলাম
নেতৃত্বের মোহ (৩য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
আল-কুরআনের আলোকে জাহান্নামের বিবরণ (শেষ কিস্তি) - বযলুর রশীদ
মানব জীবনে সূদের ক্ষতিকর প্রভাব - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
ইয়াতীম প্রতিপালন - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
মানবসম্পদ উন্নয়নে ইমামদের ভূমিকা - জামীলুর রহমান - কোরপাই, বুড়িচং, কুমিল্লা
জামা‘আতে ছালাত আদায়ের গুরুত্ব, ফযীলত ও হিকমত (৩য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
বিশ্ব ভালবাসা দিবস - আত-তাহরীক ডেস্ক
হজ্জের ন্যায় ফযীলতপূর্ণ আমল - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
মুসলমানদের রোম ও কন্সটান্টিনোপল বিজয় - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ ভেঙ্গে দিচ্ছে ভারত - আহমদ সালাহউদ্দীন
আরও
আরও
.