পর্ব ১। পর্ব ২। পর্ব ৩। পর্ব ৪।

ভূমিকা :

দারুল উলূম দেওবন্দ ও তথাকার শিক্ষাপ্রাপ্ত মনীষীদের ইলমী ও দ্বীনী খিদমত পাকভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। প্রতিষ্ঠানটির জন্মলগ্ন থেকে নিজেদের ফিক্বহী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে উপরোক্ত ক্ষেত্রে তাঁরা যে কাজ করে চলেছেন মতপার্থক্য সত্ত্বেও তা অস্বীকারের কোন উপায় নেই। কিন্তু শিক্ষণ-শিখন, পঠন-পাঠন, তাবলীগী প্রচার কার্য ও বই-পুস্তক লেখালেখি এক জগৎ আর জাতীয় ও রাজনৈতিক খিদমত ভিন্ন জগৎ। এটা আবশ্যক নয় যে, শিক্ষণ-শিখন, পঠন-পাঠন, তাবলীগ বা প্রচার ও বই-পুস্তক লেখালেখির সঙ্গে জড়িত লোকেরা রাজনীতির ময়দানেরও বীরকেশরী হবেন।

একইভাবে প্রথমোক্ত দলের খিদমতের গুরুত্বও এ কথার উপর সীমাবদ্ধ নয় যে, পরে উল্লেখিত দলের খিদমতের সাথে তাদের কোন না কোন সংযোগ অবশ্যই থাকতে হবে। কিন্তু এ কথা খুবই আফসোসের যে, দেওবন্দী ঘরানার ব্যক্তিরা নিজেদের সম্মানিত ও মহান ব্যক্তিবর্গের জীবনী ও অবদান আলোচনাকালে এই ভুলটাই করেছেন। তারা ধরে নিয়েছেন যে, তারা যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁদেরকে রাজনীতির ময়দানের বীরপুরুষ (সোহরাব-রুস্তম) না প্রমাণ করতে পারছেন ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁদের জ্ঞানগত শ্রেষ্ঠত্ব ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা পাবে না। চিন্তার এই বক্রতা তাদেরকে নিজেদের বুযর্গদের রাজনৈতিক ভূমিকার একটি চিত্র দাঁড় করাতে বাধ্য করেছে, চাই তা বাস্তবের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হোক বা না হোক। এজন্য তারা প্রকৃত ইতিহাস লেখার পরিবর্তে মনগড়া ইতিহাস তৈরির পথ বেছে নিয়েছেন। সে ইতিহাস তৈরিতে তারা নিম্নের বিষয়গুলো সবার দৃষ্টিগোচর করার প্রয়াস পেয়েছেন।

১. তারা দেওবন্দী চিন্তাধারাকে ওয়ালিউল্লাহ চিন্তাধারার উত্তরসূরী হিসাবে খাড়া করেছেন। কেননা শাহ অলিউল্লাহ পরিবারের বিদ্যাচর্চা-শিক্ষাদান, সংস্কার প্রচেষ্টা, শুদ্ধি আন্দোলন এবং পরবর্তীতে জিহাদী খিদমত একটি সর্বজন স্বীকৃত বিষয়। অথচ শাহ অলিউল্লাহ ও তাঁর শিক্ষা পরিবার পাকভারতীয় উপমহাদেশে যেভাবে হাদীছের প্রসার ঘটিয়েছেন এবং ফিক্বহী জড়তা দূরীভূত করেছেন, তার সাথে দেওবন্দী চিন্তা-চেতনার কোনই সম্পর্ক নেই। তাদের চিন্তা ও কর্ম অলিউল্লাহর চিন্তা ও কর্ম থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। বরং শাহ অলিউল্লাহর চিন্তা-চেষ্টার ধারাবাহিকতা পাকভারতীয় উপমহাদেশে যদি কেউ কায়েম রেখে থাকেন তবে তারা হলেন আহলেহাদীছ। শাহ আব্দুল আযীযের মসনদে সমাসীন শাহ মুহাম্মাদ ইসহাক (রহ.)-এর হিজরতের পর অলিউল্লাহ মসনদের উত্তরাধিকারী হন হযরত শায়খুল কুল মিয়াঁ নাযীর হুসাইন মুহাদ্দিছ দেহলভী (রহ.)। যিনি অর্ধ শতাব্দীর বেশী সময় ধরে এই আসনে সমাসীন থেকে হাদীছের দারস প্রদান করেন। তাঁর ছাত্ররা সারা হিন্দুস্তানে কুরআন ও হাদীছের আওয়ায বুলন্দ করেছেন। যার ফলে ফিক্বহী জড়তা কেটে গিয়ে তাক্বলীদের বন্ধন শিথিল হ’তে থাকে এবং কুরআন ও হাদীছের দিকে ফিরে যাওয়ার প্রবণতা ব্যাপক হ’তে থাকে। যেমনটা মাওলানা সুলাইমান নাদভী ইমাম খান নওশাহরা রচিত ‘তারাজিমে ওলামায়ে হাদীছ হিন্দ’ (হিন্দুস্তানের হাদীছ চর্চাকারী আলেমদের জীবনকথা) গ্রন্থের ভূমিকায় এ কথা স্বীকার করেছেন।

দেওবন্দীদের এখানে ইতিহাস বানানোর ধরন এই যে, তারা শাহ মুহাম্মাদ ইসহাক দেহলভী (রহ.) কর্তৃক কাউকে নিজের স্থলাভিষিক্ত করার বিষয়টা সম্পূর্ণ এড়িয়ে যান এবং হযরত মিয়াঁ ছাহেব (কাদ্দাসাল্লাহু রুহাহু) যে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন সে কথা হয় একেবারেই উল্লেখ করেন না অথবা উল্লেখ করলেও এমন ধারায় করেন যে, তাতে কথার মোড় খুব সহজেই দেওবন্দী ধারার দিকে ফিরে যায়। তারপর তারা দেওবন্দী বুযুর্গদেরকে এই মসনদের সঙ্গে যুক্ত করে তাদেরকে অলিউল্লাহ চিন্তাধারার ওয়ারিছ সাব্যস্ত করেন, যা বাস্তবতার একেবারেই বিপরীত। এই আলোচ্য বিষয় যেহেতু কিছুটা ভিন্নধর্মী তাই এখানে তার বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ নেই। তাদের মনগড়া ইতিহাস তৈরির আলোচনা করতে গিয়ে প্রসঙ্গক্রমে কথাগুলো কলমের ডগায় এসে গেল।

২. তারা ইংরেজদের বিরুদ্ধে শামেলীর ঘটনা ও রেশমী রুমাল আন্দোলনের কথা খুব জোরেশোরে প্রচার করেন এবং জিহাদ আন্দোলনের সাথে তার একটা যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা করেন। অথচ সাইয়েদ আহমাদ শহীদ (রহ.) ও শাহ ইসমাঈল শহীদ (রহ.)-এর জিহাদ আন্দোলন দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার বেশ কিছুকাল আগের কথা। ১৮৩১ খৃষ্টাব্দে বালাকোটের মর্মান্তিক জিহাদ সংঘটিত হয়েছিল। তাঁতে দুই মহান নেতাই শাহাদাতের পিয়ালা পান করেছিলেন। এটি ছিল জিহাদ আন্দোলনের প্রথম যুগ। তাঁদের শাহাদাতের পর ছাদেকপুরের আলেমগণ পূর্ণ সততা, দৃঢ়তা ও স্থৈর্যের সাথে জিহাদ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন এবং প্রায় একশ’ বছর এ পথে নযীরবিহীন কুরবানী বা অতুলনীয় ত্যাগ স্বীকার করেন। এটা শুধু পাক ভারত উপমহাদেশের জিহাদ আন্দোলনের ইতিহাসের নয়; বরং ইসলামের ইতিহাসেরও একটি অত্যন্ত উজ্জ্বল অধ্যায়। এই জিহাদ আন্দোলনে যেহেতু দেওবন্দের বুযুর্গদের কোথাও নাম আসে না, তাই দেওবন্দী ঘরানার লেখকেরা ১৮৫৭ সালের শামেলীর একটি ঘটনাকে বাড়িয়ে-চড়িয়ে উপস্থাপন করে থাকেন এবং তাকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে একটা বিশাল যুদ্ধ হিসাবে প্রতীয়মান করতে চান। তার অর্ধ শতাব্দী পরে আরেকটি আন্দোলন যা ‘রেশমী রুমাল আন্দোলন’ নামে পরিচিত, তারা তারও খুব প্রচার-প্রপাগান্ডা করে থাকেন। তাদের এসব কিছু করার মূল উদ্দেশ্য, দেওবন্দের বুযুর্গদের স্বাধীনতা যুদ্ধের বীরপুরুষ বানানো। অথচ শামেলীর ঘটনা ও ‘রেশমী রুমাল আন্দোলনে’র উদ্দেশ্য ও বিস্তারিত বর্ণনা যা দেওবন্দী লেখকেরা যাহির করে থাকেন বাস্তব ঘটনা ও সত্যতা তাদের সাপোর্ট করে না। প্রিয় পাঠক, এ গ্রন্থে তার আবশ্যকীয় বর্ণনা আপনি পড়তে পাবেন।

৩. একই ধারায় দেওবন্দী ঘরানার লেখকরা এটাও প্রমাণ করার চেষ্টা করে থাকেন যে, ছাদেকপুরের আলেমরা ছিলেন হানাফী। এভাবে জিহাদ আন্দোলনের অনেক কৃতিত্ব আপনা থেকেই হানাফীদের ভাগে এসে পড়ে। অথচ এ দাবী একেবারেই বাস্তবতা বিরোধী। তার বিবরণও সামনে আসছে।

৪. আহলেহাদীছদের ইংরেজ ভক্ত প্রমাণ করা ছিল তাদের আরেকটা কদর্য চেষ্টা। এমনটা হ’লে ইংরেজদের বিরুদ্ধে চেষ্টা-সংগ্রামে দেওবন্দের বুযুর্গদের ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলা যাবে। অথচ এ কথাও বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যশীল নয়। এ কথা ঠিক যে, আহলেহাদীছ আলেমদের মধ্যে মাওলানা মুহাম্মাদ হুসাইন বাটালভী (রহ.) নানা কারণে ইংরেজের আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন এবং একইভাবে নওয়াব ছিদ্দীক হাসান খানও নিজের রাজ্য রক্ষা ও পদ-পদবীর বাধ্যবাধকতায় এ ধরনের আনুগত্যমূলক কথা বলেছেন, কিন্তু তার সাথে এটাও সত্য যে, আহলেহাদীছ আলেমদের একটি বিরাট অংশ এবং অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ ও ব্যবসায়ীরা জিহাদ আন্দোলনে খুবই তৎপরতার সাথে অংশ নিয়েছিলেন। আর ছাদেকপুরী পরিবার যারা ছিলেন হাদীছের উপর আমলকারী তারা ছিলেন এ আন্দোলনের প্রাণপুরুষ। যেই আহলেহাদীছরা কিনা শত বছরের বেশী সময় ধরে জিহাদের পতাকা উড্ডীন রেখেছিলেন সেই আহলেহাদীছদের গোটা জামা‘আতকে মাওলানা বাটালভী ও নওয়াব ছিদ্দীক হাসান খানের কার্যক্রমের ভিত্তিতে ইংরেজভক্ত প্রমাণের চেষ্টা নেহায়েত অসমীচীন ও বেআইনি। কিন্তু দেওবন্দী ঘরানার লেখকরা এই কাজটাই করে চলেছেন।

৫. আহলেহাদীছের বিপরীতে কিছু হানাফী ব্যক্তিগতভাবে যদিও জিহাদ আন্দোলনে শরীক ছিলেন, কিন্তু হানাফীদের বিশেষ করে দেওবন্দের আলেমগণের গোষ্ঠী ধরে জিহাদ আন্দোলনে শরীক হওয়া ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত নয়। কিন্তু দেওবন্দী লেখকরা দেওবন্দের মনীষীদের জিহাদ আন্দোলন ও স্বাধীনতা যুদ্ধের হিরো বানানোর চেষ্টায় কোন কসুর করেন না। অথচ সত্য ঘটনা এই যে, জিহাদ আন্দোলনে তাদের মোটেও কোন ভূমিকা ছিল না। তবে দেশ মুক্তির আন্দোলনসমূহে তাঁরা শরীক ছিলেন। কিন্তু সেসব আন্দোলনে তাদের অংশগ্রহণ মাওলানা মাহমূদুল হাসানের মাল্টা থেকে মুক্তি লাভের পর ঘটেছিল। আর এটা এমন সময় ঘটেছিল যখন সকল আন্দোলনই ব্যাপকতা লাভ করেছিল এবং ধর্ম, মত নির্বিশেষে দেশের সকল স্তরের মানুষ তাতে শরীক হচ্ছিল। তখনও কিন্তু আহলেহাদীছ ও ছাদেকপুরবাসীরা ইংরেজদের বিরোধিতায় সম্মুখসারিতে ছিলেন। শুরেশ কাশ্মীরী বলেন :

هم نے اُس دقت سياست مىں قدم ركهاتها

جب سياست كاصله آهنى زبخير يں تهيں

سرفروشوں كےيے دارورسن قائم تهے!

خان زادوں كےيے مفت كى جاگير يں تهيں

بےگناهو ں كالهوعام تها بازاروں ميں

خورن احراريں ڈوبى هوئى شمشيريں تهيں

ازأفق تا به أفق خوف كا سناٹا تها

رات كى قيد ميں خورشيد كى تنويريں تهيں

আমরা সে সময় রাজনীতির মাঠে পা রেখেছিলাম যে সময় রাজনীতির প্রতিদানে মিলত লৌহ শিকল। যারা ছিলেন জীবন উৎসর্গকারী তাদের জন্য তৈরি থাকত ফাঁসির রশি কিন্তু শাহজাদাদের মিলত ফ্রি জায়গীর। নিরপরাধদের রক্ত বাজারে ছিল সস্তা তলোয়ার ডুবে ছিল স্বাধীনচেতাদের রক্তে। দিগন্তের এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্ত পর্যন্ত ত্রাস ছেয়েছিল, রাতের কয়েদখানায় বন্দী ছিল সূর্যরশ্মি।

৬. ইংরেজ গবেষক ও নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকগণ স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন যে, ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে হিন্দুস্তানের যে দলটি সবচেয়ে বেশী তৎপর ছিল তারা হ’ল ‘ওহাবী’। এমনকি ‘ওহাবী’কে বিদ্রোহীর সমার্থক ভাবা হ’ত। দেওবন্দী লেখকরা এ কথা প্রমাণ করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন যে, এখানে ‘ওহাবী’ দ্বারা আহলে হাদীছদের বুঝানো হয়নি, বরং তাদের বুঝানো হয়েছে, যারা জিহাদ আন্দোলনে শরীক এবং ইংরেজ সরকারের বিরোধিতায় অগ্রণী ছিলেন। এ কথা ঠিক যে, কিছু ঐতিহাসিকের বর্ণনায় ‘ওহাবী’ বলতে উল্লেখিতদেরই নির্দেশ করা হয়েছে, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যে, তাদের ওহাবী বলার হেতু কী? তার কারণ এটাই যে, ঐ মুজাহিদরা আক্বীদা ও আমলের দিক দিয়ে ওহাবী অর্থাৎ আহলেহাদীছই ছিলেন। আন্দোলনের নেতৃত্বও বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে তাদের হাতে ছিল এবং এতে অংশগ্রহণকারী সাধারণ জনগণও এই হক দলের সাথে সম্পর্কিত ছিলেন। অবশ্য স্বল্প সংখ্যক হানাফীও এই দলে শরীক ছিলেন। কিন্তু যেহেতু তাদের প্রভাবশালী ও উল্লেখযোগ্য বড় একটা সংখ্যা ছিলেন আহলেহাদীছদের আলেম ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ সেহেতু এই জিহাদে অংশগ্রহণকারীদের নাম দেওয়া হয় ‘ওহাবী’। এ জন্যে ওহাবী বলতে আহলেহাদীছদেরই বুঝানো হয়েছে; না হানাফীদেরকে, না হানাফী-আহলেহাদীছ উভয়কে।

এর বিস্তারিত আলোচনা আপনি এ গ্রন্থে দেখতে পাবেন ইনশাআল্লাহ।

৭. দেওবন্দীগণ আরেকটি যুলুম করে চলছেন যে, স্বাধীনতা হাছিলে যেসব আন্দোলনে আহলেহাদীছ ও দেওবন্দের মান্যবরগণ শরীক থেকেছেন সে সকল আন্দোলনের আলোচনাকালে তারা কেবল দেওবন্দী আলেমদের কার্যাবলী স্পষ্ট করে আলোচনা করেন, আহলেহাদীছ আলেমদের খিদমত ও কার্যাবলী সাধারণত পুরোপুরি এড়িয়ে যান। অথচ ইতিহাস লেখায় এ ধরনের দলীয় সংকীর্ণতা ও পক্ষপাতিত্ব কোন দিক দিয়েই ভালো নয়। যেহেতু আমাদের আলোচ্য বিষয় থেকে এ কথার বিবরণ কিছুটা ভিন্নধর্মী তাই এ সময়ে এ আলোচনা সমীচীন হবে না।

মোটকথা, এই লাইন বা রেখা ধরে দেওবন্দীগণ নিজেদের ইতিহাস তৈরির ভিত্তি মযবুত করেছেন। এখন এই লাইনের আলোকে ইতিহাসের নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে ছহীহ-শুদ্ধ ও প্রকৃত ঘটনা সামনে নিয়ে আসা প্রয়োজন, যাতে দেওবন্দীদের ইমিটেশনকৃত ইতিহাসের পর্দা বিদীর্ণ হয়ে যায় এবং যে সকল কাজের উপর পর্দা আরোপের চেষ্টা করা হয়েছে, অথবা বিস্মৃতির অতলান্তে তলিয়ে দেওয়া হয়েছে সেগুলোকে আবার আলোর সামনে তুলে ধরা যায় এবং ইতিহাসের কমনীয় ধারা এমন আলোকিত ও উজ্জ্বল করে তোলা যায় যাতে ইতিহাসের প্রতিটি কাজ নিজ নিজ হক অনুযায়ী সম্মান ও গুরুত্ব লাভ করে। না কাউকে তার প্রাপ্য মর্যাদা থেকে নীচে নামিয়ে দেওয়া হবে, না কাউকে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে তার প্রাপ্য মর্যাদা থেকে উপরে তুলে ধরা হবে। সীমা ছাড়া মর্যাদা দান কিংবা প্রাপ্য মর্যাদা দানে কার্পণ্যতার সিলসিলা যেন বন্ধ হয়ে যায় যা দেওবন্দের ছোট বড় সকল শ্রেণীর লেখক করে চলেছেন।

উপরের আলোচনায় তাদের এহেন কারসাজির উপরই আলোকপাত করা হয়েছে। আলোচ্য গ্রন্থ অবশ্য পুরোপুরি উল্লেখিত দৃষ্টিকোণের আলোকে লেখা হয়নি। কেননা এজন্য যতটা অবকাশ ও শ্রমদান প্রয়োজন নানান ব্যস্ততায় তা হয়ে ওঠেনি। তা সত্ত্বেও আগেকার কিছু বাক্যে এর একটা স্কেচ আঁকা হয়েছে এই আশায় যে, সম্ভবত কোন জানাশোনা লোক তাতে রং-তুলি চড়াবে এবং ইতিহাসের এই শূন্যতাকে পূরণ করবে। লেখকের এ গ্রন্থ তো আসলে ছিল একটা প্রবন্ধ, যা আজ থেকে ১২-১৩ বছর আগে এক দেওবন্দী প্রফেসরের জবাবে লেখা হয়েছিল; যিনি কি-না একটি দুর্ঘটনায় ইন্তিকাল করেছেন। (রাহিমাহুল্লাহু ওয়া গাফারা লাহু)। উক্ত প্রফেসর ছাহেব মনগড়া ইতিহাস রচনার মাধ্যমে আহলেহাদীছ আলেম-ওলামা ও ছাদেকপুরী পরিবারের কার্যাবলী বিকৃত করার প্রয়াস পেয়েছিলেন। তার কয়েক কিস্তি ‘আল-ই‘তিছাম’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। তখন লেখকের এক গুণী বন্ধু মাওলানা আবদুল খালেক কুদ্দূসীও (মাকতাবায়ে কুদ্দূসিয়া, উর্দূ বাজার, লাহোর-এর মালিক) উল্লেখিত প্রফেসরের জবাবে একটি সমালোচনামূলক প্রবন্ধ লেখা শুরু করেন। ফলে লেখক তার লেখা বন্ধ রাখেন।

তখন থেকে এভাবে প্রবন্ধটি অপূর্ণ পড়ে থাকে। আশা ছিল যে, এই অনভিপ্রেত আলোচনা সাধারণের গোচরে হয়তো পুনর্বার আনার প্রয়োজন পড়বে না। এজন্য এ লেখক তার প্রবন্ধের কথা মাথা থেকে বিলকুল ঝেড়ে ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত উক্ত প্রফেসর ক্ষুদ্রাকারে যে আলোচনার সূত্রপাত করে গিয়েছিলেন দেওবন্দী লেখকরা তা ব্যাপকভাবে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে লিখতে শুরু করেন এবং অনবরত এ বিষয়ে উত্তেজনাকর কথাবার্তা বলে চলেন। বিগত কয়েক বছরে দেওবন্দী দোস্তদের পক্ষ থেকে পূর্বে বর্ণিত নিশানার ভিত্তিতে এমন উত্তেজনাকর লেখা সামনে এসেছে যা পড়ে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেছে।

দেওবন্দী লেখকরা যে আহলেহাদীছ জামা‘আতকে ইংরেজ প্রভুর সেবাদাস প্রমাণের কোশেশ করছিলেন এবং তাদের হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে চলছিলেন তার স্বরূপ উন্মোচন ও তা প্রতিহত করার জন্য আমার কিছু দোস্ত-বন্ধুও আমাকে কলম ধরতে খুব পীড়াপীড়ি করেন।

যেমনটা ইতিপূর্বে বলা হয়েছে যে, সময়-সুযোগের অভাবে এ লেখকের পক্ষে আলোচ্য বিষয়ে বিস্তারিত লেখা সম্ভব হয়নি। তবুও مَا لاَيُدْرَكُ كُلُّهُ لاَيُتْرَكُ كُلُّهُ ‘যার পুরোটা আয়ত্বে আসছে না, তার পুরোটাই ছেড়ে দেওয়া উচিত হবে না’ প্রবাদ সূত্রে চিন্তা করলাম যে, ফিলহাল বিস্তারিত না হ’লেও সংক্ষিপ্ত আকারে তাদের দাবীর অসত্যতা প্রকাশ করি। ভবিষ্যতে কোন সময় এই সংক্ষিপ্ত বিবরণ বিস্তারিত লেখার সুযোগ সৃষ্টি হ’তে পারে। لَعَلَّ اللهَ يُحْدِثُ بَعْدَ ذَلِكَ أَمْرًا ‘হয়তো ভবিষ্যতে আললাহ কোন উপায় বের করে দিবেন’ (ত্বালাক ৬৫/১)

তাই এ লেখক বিভিন্ন সময়ে তার উল্লেখিত প্রবন্ধের কিছুটা পূর্ণতা দিয়েছে। যদিও আলোচনার আরও অনেক দিক এখনও বাকী আছে তবুও আশা করি যে, এই অপূর্ণ রচনাও আল্লাহ চাহেন তো দেওবন্দীদের দাবীগুলোর জট খুলতে মুখ্য চাবির ভূমিকা পালন করবে।

এ রচনা দ্বারা নিশ্চিতই গবেষণার নতুন একটি রাস্তা খুলবে, অনেক সত্য উন্মোচিত হবে। মিথ্যা প্রোপাগান্ডার ফলে জমে ওঠা মোটা দাগের আবর্জনা পরিষ্কার হয়ে যাবে এবং আহলেহাদীছদের উপর যুলুমের কিছুটা প্রতিকার হবে। লেখক এই অপূর্ণ রচনা দ্বারা এখনকার মতোانْصُرْ أَخَاكَ ظَالِمًا أَوْ مَظْلُومًا ‘তোমার ভাইকে সাহায্য করো, চাই সে যালেম হোক কিংবা মাযলূম’ (বুখারী হা/২৪৪৩; মিশকাত হা/৪৯৫৭)-এর উপর আমল করে নিপীড়িত আহলেহাদীছদের হেফাযত ও প্রতিরক্ষার ভূমিকা পালন করেছে। সেই সঙ্গে যালেমকেও তার যুলুম সম্পর্কে অবহিত করে আগামীতে তাকে যুলুম ও অবৈধ আক্রমণ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছে। আল্লাহ করুন, যালেম গোষ্ঠী যেন তাদের যুলুম থেকে সরে আসে-যাতে ভবিষ্যতে এ বিষয়ে কলম ধরার আর কোন প্রয়োজন দেখা না দেয়। وَمَا ذَلِكَ عَلَى اللهِ بِعَزِيزٍ ‘আর সেটা আল্লাহর জন্য মোটেই কঠিন নয়’ (ইবরাহীম ১৪/২০)

[ক্রমশঃ]

মূল (উর্দূ): হাফেয ছালাহুদ্দীন ইউসুফ

পাকিস্তানের প্রখ্যাত আহলেহাদীছ আলেম, লেখক ও গবেষক; সাবেক সম্পাদক, আল-ই‘তিছাম, লাহোর, পাকিস্তান।

অনুবাদ : মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

ঝিনাইদহ।






সংগঠনের প্রচার ও প্রসারে তাবলীগী ইজতেমার ভূমিকা - ড. এ এস এম আযীযুল্লাহ
তাহরীকে জিহাদ : আহলেহাদীছ ও আহনাফ (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
খলীফা বা আমীর নিযুক্ত করা কি যরূরী? - ড. নূরুল ইসলাম
কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে ঈমান - হাফেয আব্দুল মতীন - পিএইচ.ডি গবেষক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া
মানব জাতির প্রকাশ্য শত্রু শয়তান - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
মানব জাতির প্রতি ফেরেশতাদের দো‘আ ও অভিশাপ (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - মুহাম্মাদ আবু তাহের, পরিচালক, কিউসেট ইনস্টিটিউট, সিলেট।
আল-কুরআনে বিজ্ঞানের নিদর্শন (৩য় কিস্তি) - ইঞ্জিনিয়ার আসিফুল ইসলাম চৌধুরী
বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন : সাম্রাজ্যবাদের নতুন মন্ত্র !
নেতৃত্বের মোহ - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ ভেঙ্গে দিচ্ছে ভারত - আহমদ সালাহউদ্দীন
মানবাধিকার ও ইসলাম (৭ম কিস্তি) - শামসুল আলম
ইসলামের দৃষ্টিতে তাবীয ও ঝাড়-ফুঁক - ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
আরও
আরও
.