ভূমিকা :
মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পদই হচ্ছে মীরাছ, যা মৃতের নিকটাত্মীয়রা লাভ করে। প্রাচীনকাল থেকে মৃতের সন্তানাদি ও আত্মীয়দের মাঝে সম্পত্তি বণ্টনের নিয়ম চলে আসছে। সম্পদ বণ্টনে অনিয়ম হ’লে উত্তরাধিকারীদের মাঝে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। অনেক ক্ষেত্রে তা প্রতিহিংসার চরম সীমায় উপনীত হয়। তাই মৃত ব্যক্তির সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টনের গুরুত্ব অপরিসীম। এতে ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন কল্যাণ নিহিত রয়েছে। নিম্নে মীরাছ বণ্টনের শারঈ দৃষ্টিকোণ তুলে ধরা হ’ল।-
মীরাছ-এর আভিধানিক অর্থ :
আরবী ‘মীরাছ’ (ميراث) শব্দটি ক্রিয়ামূল, যা وَرَثَ يَرِثُ إرْثًا ومِيْرَاثًا থেকে উদগত। আভিধানিক অর্থ : অংশীদার হওয়া, হকদার হওয়া।[1] যেমন আল্লাহ বলেন,وَوَرِثَ سُلَيْمَانُ دَاوُودَ ‘সুলায়মান দাঊদের ওয়ারিছ হয়েছে’ (নামল ২৭/১৬)।
কোন
বস্ত্ত এক সম্প্রদায় থেকে অপর সম্প্রদায় বা এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির
কাছে স্থানান্তরিত হওয়া, চাই তা বিদ্যা, পদমর্যাদা বা সম্পদ হোক।[2] যেমন
রাসূল (ছাঃ) বলেন,وَإِنَّ الْعُلَمَاءَ وَرَثَةُ الأَنْبِيَاءِ وَإِنَّ
الأَنْبِيَاءَ لَمْ يُوَرِّثُوْا دِيْنَارًا وَلاَ دِرْهَمًا وَإِنَّمَا
وَرَّثُوا الْعِلْمَ فَمَنْ أَخَذَهُ أَخَذَ بِحَظٍّ وَافِرٍ ‘আলেমগণ
নবীগণের ওয়ারিছ। নিশ্চয়ই নবীগণ কোন দিরহাম বা দীনারের ওয়ারিছ করেননি। বরং
তাঁরা জ্ঞানের (ইলম) ওয়ারিছ করেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি তা অর্জন করেছে, সে
পূর্ণ অংশ গ্রহণ করেছে’।[3]
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,الَّذِينَ يَرِثُونَ الْفِرْدَوْسَ هُمْ فِيهَا خَالِدُوْنَ ‘তারাই ফেরদাউসের উত্তরাধিকারী হবে, যেখানে তারা চিরস্থায়ীভাবে অবস্থান করবে’ (মুমিনূন ২৩/১১)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,وَنَحْنُ الْوَارِثُوْنَ ‘আমরাই উত্তরাধিকারী’ (হিজর ১৫/২৩)।
পারিভাষিক অর্থ :
মীরাছ হ’ল মৃত ব্যক্তি হ’তে তার জীবিত ওয়ারিছদের নিকট মালিকানা স্থানান্তরিত হওয়া। যা স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ অথবা শারঈ যেকোন হক হোক।
মীরাছের বিষয়টি মানুষের মরণোত্তর সময়ের সাথে সম্পৃক্ত, তাই এর সংশ্লিষ্ট জ্ঞানকে ‘নিছফুল ইলম’ বা জ্ঞানের অর্ধেক বলা হয়েছে।[4]
জাহেলী ও ইসলামী যুগে মীরাছের বিধান :
জাহেলী যুগে আরবে মীরাছ হ’তে মহিলাদেরকে কোন অংশ দেয়া হ’ত না। এক্ষেত্রে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, তারা যুদ্ধ-বিগ্রহ বা অন্য কোনভাবে নিজ সম্প্রদায়কে শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারে না। তারা বলত, ‘যারা ঘোড়ায় চড়তে পারে না, তরবারী ব্যবহার করতে জানে না এবং শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে না, আমরা কিভাবে তাদেরকে সম্পদ প্রদান করতে পারি’? তাই তারা শিশুদের মত মেয়েদেরকেও উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করত।
ইসলামী শরী‘আত মীরাছে তাদের হক প্রতিষ্ঠা করেছে। সম্মান ও ইযযতের সাথে তা গ্রহণ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছে। এটা কারো দয়া বা অনুগ্রহ-অনুকম্পা নয়; বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের জন্য নির্ধারিত অংশ।
মীরাছের আয়াত সমূহ নাযিল হ’লে আরবদের কাছে তা অত্যন্ত কঠিন বলে মনে হয়। তাই তারা এ হুকুমের বিলুপ্তি কামনা করতে থাকে। কেননা এ নির্দেশ ছিল তাদের অভ্যাসের পরিপন্থী।
ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে ইবনু জারীর ত্বাবারী বর্ণনা করেন, যখন ফারায়েয সম্পর্কিত আয়াত অবতীর্ণ হ’ল, যাতে আল্লাহ তা‘আলা পুত্র ও কন্যা সন্তান এবং পিতা-মাতার অংশ নির্দিষ্ট করেছেন, তখন অনেকেই তা অপসন্দ করল। তারা বলল, স্ত্রীকে এক-চতুর্থাংশ বা এক-অষ্টমাংশ এবং মেয়েকে অর্ধেক ও ছোট শিশুকেও সম্পদ প্রদান করা হয়েছে। অথচ তারা কেউই গোত্রের প্রতিরক্ষার জন্য যুদ্ধ করে না এবং যুদ্ধলব্ধ সম্পদ লাভ করতে পারে না। তাই এ হাদীছ সম্পর্কে নীরব থাক। সম্ভবতঃ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এটা ভুলে যাবেন অথবা আমরা তাঁকে এ হুকুম পরিবর্তনের জন্য বলব। কেউ কেউ বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি শিশুকেও মীরাছ দিব, অথচ তারা কোন কাজে আসে না? মেয়েকে কি তার পিতার পরিত্যক্ত সম্পদের অর্ধেক দেব, অথচ সে ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করতে জানে না এবং গোত্রের জন্য যুদ্ধ করে না।
ভারতীয়
উপমহাদেশে হিন্দু সমাজে পিতার পক্ষ থেকে নারীরা কোন মীরাছ পায় না। বরং
বিয়ের সময় যতটুকু দিয়ে কন্যা বিদায় করা হয়, তা-ই নারীর শেষ প্রাপ্য হিসাবে
গণ্য হয়। অথচ ইসলামের বিধান ভিন্ন। ইসলামে নারীকে মীরাছ প্রদান করে তার
প্রতি যুলুম ও বাড়াবাড়ির পথ রুদ্ধ করা হয়েছে। তাকে সম্পদের উত্তরাধিকারী
করা হয়েছে। পুরুষের অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাদের জন্য অংশ নির্দিষ্ট করা হয়েছে।[5]
মীরাছের আয়াত অবতীর্ণের কারণ :
একদা
সা‘দ বিন রাবী‘ (রাঃ)-এর স্ত্রী সা‘দের ঔরষজাত দু’টি মেয়েকে সাথে নিয়ে
রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! এরা দুইজন সা‘দ
ইবনে রাবীর কন্যা। তাদের পিতা সা‘দ ওহোদ যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। এখন তাদের
চাচা তাদের সমস্ত সম্পদ আত্মসাৎ করেছে, তাদের জন্য কিছুই রাখেনি। অর্থ ছাড়া
তাদেরকে বিয়েও দেয়া যাবে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, এ ব্যাপারে আল্লাহ
ফায়ছালা দিবেন। এর পরেই উত্তরাধিকার সংক্রান্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়। আল্লাহ
তা‘আলা বলেন,يُوصِيكُمُ اللهُ فِي أَوْلَادِكُمْ لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ
الْأُنْثَيَيْنِ فَإِنْ كُنَّ نِسَاءً فَوْقَ اثْنَتَيْنِ فَلَهُنَّ
ثُلُثَا مَا تَرَكَ وَإِنْ كَانَتْ ‘আল্লাহ তোমাদের সন্তানদের (মধ্যে মীরাছ
বণ্টনের) ব্যাপারে তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, এক পুত্রের অংশ দুই
কন্যার অংশের সমান’ (নিসা ৪/১১)। এরপর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাদের
চাচাকে এ নির্দেশ পাঠালেন যে, সা‘দের মেয়েদেরকে দুই-তৃতীয়াংশ ও তাদের মাকে
এক অষ্টমাংশ দাও এবং অবশিষ্টাংশ তোমার জন্য রাখো।[6]
মীরাছ বণ্টনে শারঈ দৃষ্টিকোণ :
মহান আল্লাহ কুরআনে মীরাছ বণ্টনের বিধান উল্লেখ করেছেন এবং রাসূল (ছাঃ) কথা ও কাজের মাধ্যমে তার নমুনা রেখে গেছেন। নিম্নে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ হতে মীরাছ বণ্টনের বিধান তুলে ধরা হ’ল।-
পবিত্র কুরআনে মীরাছের বিধান :
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,لِلرِّجَالِ نَصِيبٌ مِمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْأَقْرَبُونَ وَلِلنِّسَاءِ نَصِيبٌ مِمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْأَقْرَبُونَ مِمَّا قَلَّ مِنْهُ أَوْ كَثُرَ نَصِيبًا مَفْرُوضًا ‘পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুরুষদের অংশ রয়েছে এবং পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের সম্পত্তিতে নারীদের অংশ রয়েছে, কম হৌক বা বেশী হৌক। এ অংশ সুনির্ধারিত’ (নিসা ৪/৭)।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,يُوصِيكُمُ اللهُ فِي أَوْلَادِكُمْ لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنْثَيَيْنِ فَإِنْ كُنَّ نِسَاءً فَوْقَ اثْنَتَيْنِ فَلَهُنَّ ثُلُثَا مَا تَرَكَ وَإِنْ كَانَتْ وَاحِدَةً فَلَهَا النِّصْفُ وَلِأَبَوَيْهِ لِكُلِّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا السُّدُسُ مِمَّا تَرَكَ إِنْ كَانَ لَهُ وَلَدٌ فَإِنْ لَمْ يَكُنْ لَهُ وَلَدٌ وَوَرِثَهُ أَبَوَاهُ فَلِأُمِّهِ الثُّلُثُ فَإِنْ كَانَ لَهُ إِخْوَةٌ فَلِأُمِّهِ السُّدُسُ مِنْ بَعْدِ وَصِيَّةٍ يُوصِي بِهَا أَوْ دَيْنٍ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ لَا تَدْرُونَ أَيُّهُمْ أَقْرَبُ لَكُمْ نَفْعًا فَرِيضَةً مِنَ اللهِ إِنَّ اللهَ كَانَ عَلِيمًا حَكِيمًا- ‘আল্লাহ তোমাদের সন্তানদের (মধ্যে মীরাছ বণ্টনের) ব্যাপারে তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, এক পুত্রের অংশ দুই কন্যার অংশের সমান। যদি তারা দুইয়ের অধিক কন্যা হয়, তাহ’লে তারা পরিত্যক্ত সম্পত্তির দুই-তৃতীয়াংশ পাবে। আর যদি কেবল একজনই কন্যা হয়, তবে তার জন্য অর্ধেক। মৃতের পিতা-মাতার প্রত্যেকে পরিত্যক্ত সম্পত্তির ছয় ভাগের এক ভাগ করে পাবে, যদি মৃতের কোন পুত্র সন্তান থাকে। আর যদি না থাকে এবং কেবল পিতা-মাতাই ওয়ারিছ হয়, তাহ’লে মা পাবে তিন ভাগের এক ভাগ। কিন্তু যদি মৃতের ভাইয়েরা থাকে, তাহ’লে মা পাবে ছয় ভাগের এক ভাগ মৃতের অছিয়ত পূরণ করার পর এবং তার ঋণ পরিশোধের পর। তোমাদের পিতা ও পুত্রদের মধ্যে কে তোমাদের জন্য অধিক উপকারী, তা তোমরা জানো না। এটা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত অংশ। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়’ (নিসা ৪/১১)।
তিনি আরো বলেন,وَلَكُمْ نِصْفُ مَا تَرَكَ أَزْوَاجُكُمْ إِنْ لَمْ يَكُنْ لَهُنَّ وَلَدٌ فَإِنْ كَانَ لَهُنَّ وَلَدٌ فَلَكُمُ الرُّبُعُ مِمَّا تَرَكْنَ مِنْ بَعْدِ وَصِيَّةٍ يُوصِينَ بِهَا أَوْ دَيْنٍ وَلَهُنَّ الرُّبُعُ مِمَّا تَرَكْتُمْ إِنْ لَمْ يَكُنْ لَكُمْ وَلَدٌ فَإِنْ كَانَ لَكُمْ وَلَدٌ فَلَهُنَّ الثُّمُنُ مِمَّا تَرَكْتُمْ مِنْ بَعْدِ وَصِيَّةٍ تُوصُونَ بِهَا أَوْ دَيْنٍ وَإِنْ كَانَ رَجُلٌ يُورَثُ كَلَالَةً أَوِ امْرَأَةٌ وَلَهُ أَخٌ أَوْ أُخْتٌ فَلِكُلِّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا السُّدُسُ فَإِنْ كَانُوا أَكْثَرَ مِنْ ذَلِكَ فَهُمْ شُرَكَاءُ فِي الثُّلُثِ مِنْ بَعْدِ وَصِيَّةٍ يُوصَى بِهَا أَوْ دَيْنٍ غَيْرَ مُضَارٍّ وَصِيَّةً مِنَ اللهِ وَاللهُ عَلِيمٌ حَلِيمٌ ‘আর তোমাদের স্ত্রীদের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে তোমরা অর্ধেক পাবে, যদি তাদের কোন সন্তান না থাকে। যদি থাকে, তবে তোমরা সিকি পাবে, তাদের অছিয়ত পূরণ ও ঋণ পরিশোধের পর। আর তোমাদের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে স্ত্রীরা সিকি পাবে, যদি তোমাদের কোন সন্তান না থাকে। যদি থাকে, তবে তারা অষ্টমাংশ পাবে, তোমাদের অছিয়ত পূরণ ও ঋণ পরিশোধের পর। আর যদি পিতা ও সন্তানহীন কোন পুরুষ বা স্ত্রী মারা যায় এবং তার একজন ভাই অথবা বোন থাকে, তবে তারা প্রত্যেকে এক ষষ্ঠাংশ করে পাবে। আর যদি তারা একাধিক হয়, তাহ’লে তারা সকলে এক তৃতীয়াংশে শরীক হবে, অছিয়ত পূরণ অথবা ঋণ পরিশোধের পর, কাউকে কোনরূপ ক্ষতি না করে। এটি আল্লাহ প্রদত্ত বিধান। আল্লাহ মহাজ্ঞানী ও সহনশীল’ (নিসা ৪/১২)।
তিনি আরো বলেন,يَسْتَفْتُونَكَ قُلِ اللهُ يُفْتِيكُمْ فِي الْكَلَالَةِ إِنِ امْرُؤٌ هَلَكَ لَيْسَ لَهُ وَلَدٌ وَلَهُ أُخْتٌ فَلَهَا نِصْفُ مَا تَرَكَ وَهُوَ يَرِثُهَا إِنْ لَمْ يَكُنْ لَهَا وَلَدٌ فَإِنْ كَانَتَا اثْنَتَيْنِ فَلَهُمَا الثُّلُثَانِ مِمَّا تَرَكَ وَإِنْ كَانُوا إِخْوَةً رِجَالًا وَنِسَاءً فَلِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنْثَيَيْنِ يُبَيِّنُ اللهُ لَكُمْ أَنْ تَضِلُّوا وَاللهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ ‘লোকেরা তোমার নিকট ফৎওয়া জানতে চাচ্ছে। তুমি বলে দাও, আল্লাহ তোমাদেরকে কালালাহ-র সম্পত্তি বণ্টন সম্পর্কে ফৎওয়া দিচ্ছেন; যদি কোন ব্যক্তি একক অবস্থায় মারা যায় যে, তার কোন সন্তান নেই কিন্তু একটি বোন আছে, তাহ’লে সে অর্ধেক পাবে। পক্ষান্তরে কালালাহ যদি নিঃসন্তান নারী হয় তাহ’লে তার ভাই তার পরিত্যক্ত সমুদয় সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে। আর যদি কালালাহ ব্যক্তির দু’টি বোন থাকে, তবে তারা দুই-তৃতীয়াংশ পাবে। আর যদি তারা অনেক ভাই ও বোন থাকে, তাহ’লে ‘এক ভাই সমান দুই বোন’ নীতিতে সম্পত্তি বণ্টিত হবে। আল্লাহ তোমাদেরকে এগুলি বর্ণনা করছেন যাতে তোমরা বিভ্রান্ত না হও। বস্ত্ততঃ আল্লাহ সকল বিষয়ে সুবিজ্ঞ’ (নিসা ৪/১৭৬)।
হাদীছে মীরাছের বিধান :
রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) সা‘দ বিন আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ)-কে লক্ষ্য করে বলেন,فَالثُّلُثُ،
وَالثُّلُثُ كَثِيرٌ، إِنَّكَ أَنْ تَدَعَ وَرَثَتَكَ أَغْنِيَاءَ خَيْرٌ
مِنْ أَنْ تَدَعَهُمْ عَالَةً يَتَكَفَّفُونَ النَّاسَ فِى أَيْدِيهِمْ،
‘এক-তৃতীয়াংশ। আর এক-তৃতীয়াংশই অধিক। ওয়ারিছকে সম্পদশালী অবস্থায় রেখে
যাওয়া, তাদেরকে মানুষের নিকট মুখাপেক্ষী অবস্থায় রেখে যাওয়া অপেক্ষা
উত্তম’।[7]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,لاَ
يَرِثُ الْمُسْلِمُ الْكَافِرَ، وَلاَ الْكَافِرُ الْمُسْلِمَ ‘মুসলমান
কাফেরের এবং কাফের মুসলমানের ওয়ারিছ হবে না’।[8]
উপরোক্ত হাদীছদ্বয়ের প্রথমটিতে একজন ব্যক্তির অছিয়ত হ’তে কতটুকু অংশ কার্যকর হবে তা বর্ণিত হয়েছে। আর দ্বিতীয় হাদীছ দ্বারা মুসলিম অমুসলিমের এবং অমুসলিম মুসলিমের ওয়ারিছ হবে না, তা ফুটে উঠেছে।
পরিত্যক্ত সম্পদের সাথে সম্পর্কিত বিষয়াবলী :
মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পদের সাথে বেশ কিছু কর্তব্য রয়েছে। প্রথমতঃ মৃত্যুর সময় থেকে মৃতের পরিত্যক্ত সম্পদ দ্বারা তার গোসল, কাফন, দাফন পর্যন্ত সমস্ত ব্যয়ভার বহন করতে হবে। সেক্ষেত্রে তার সম্পদের উপর ভিত্তি করে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করে মৃতের দাফন সংশ্লিষ্ট কার্যাবলী সমাপ্ত করতে হবে।
দ্বিতীয়তঃ
তার ঋণ পরিশোধ করা। মৃতের নিকটে কোন মানুষের ঋণ থাকলে তার পরিত্যক্ত সম্পদ
থেকে ঋণ পরিশোধের পর বাকী সম্পদ ওয়ারিছদের মাঝে বণ্টিত হবে। রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) বলেন,نَفْسُ الْمُؤْمِنِ مُعَلَّقَةٌ بِدَيْنِهِ حَتَّى يُقْضَى
عَنْهُ ‘মুমিনের আত্মা ঋণ পরিশোধের পূর্ব পর্যন্ত ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে’।[9]
তৃতীয়তঃ মৃতের অছিয়ত পূরণ করা। মৃতের অছিয়ত বাস্তবায়ন করতে হবে দাফন, কাফন ও ঋণ পরিশোধের পর।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন,إِنَّ اللهَ تَصَدَّقَ عَلَيْكُمْ عِنْدَ وَفَاتِكُمْ بِثُلُثِ أَمْوَالِكُمْ زِيَادَةً لَكُمْ فِىْ أَعْمَالِكُمْ ‘আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের মৃত্যুবরণের সময় এক-তৃতীয়াংশ সম্পদ (অর্থাৎ অছিয়ত) দান করেছেন তোমাদের আমল বৃদ্ধি করার জন্য’।[10] সুতরাং কেউ চাইলে এক-তৃতীয়াংশ দান করতে পারে, তার বেশী নয়।
চতুর্থতঃ পরিত্যক্ত সম্পদ ওয়ারিছদের মাঝে বণ্টন করতে হবে।[11]
পুরুষের অংশ মহিলার দ্বিগুণ কেন?
জনমনে প্রশ্নের উদ্রেক হ’তে পারে, মহিলা দুর্বল ও সম্পদের অধিক মুখাপেক্ষী হওয়া সত্ত্বেও তাকে পুরুষের অর্ধেক সম্পদ দেয়ার কারণ কি? এর জবাবে বলা যায়, এ বিধান মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর পক্ষ থেকে। যিনি সৃষ্টিকুলের কল্যাণ সর্বাধিক পরিজ্ঞাত।
ইসলামী শরী‘আত বেশ কিছু যুক্তিসঙ্গত কারণে মীরাছে নারী-পুরুষের মধ্যে পার্থক্য করেছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু কারণ হ’ল।-
১. মহিলার প্রয়োজনীয় ভরণ-পোষণের ব্যয়ভার ছেলে, পিতা, ভাই বা অন্যান্য আত্মীয়ের উপর ন্যস্ত।
২. মহিলা নিজে কারো ব্যয়ভার বহনে বাধ্য নয়। অথচ পুরুষ পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও দাবীদারদের ভারণ-পোষণে আদিষ্ট।
৩. পুরুষের ব্যয় পরিমাণহীন ও তার সম্পদের আবশ্যকতা অধিক। সেহেতু তার অর্থের প্রয়োজন মহিলার চেয়ে বেশী।
৪. পুরুষ তার স্ত্রীর মোহর প্রদান করে এবং সন্তানদের ও স্ত্রীর অন্ন-বস্ত্রের ব্যয়ভার ও বাসস্থান নির্মাণের দায়িত্ব পালন করে।
৫. সন্তানদের লেখা-পড়া, চিকিৎসা, স্ত্রীর সকল ব্যয়ভার পুরুষের উপরই ন্যস্ত, মহিলার উপরে নয়।
একটি পরিবার ও তৎসংশ্লিষ্টদের সব ধরনের ভরণ-পোষণ ও খরচের বিষয়াদি পুরুষের উপরে ন্যস্ত। যা ইসলামী শরী‘আত স্বীকৃত ও নির্দেশিত।[12] এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহর বাণী হ’ল- لِيُنْفِقْ ذُو سَعَةٍ مِنْ سَعَتِهِ وَمَنْ قُدِرَ عَلَيْهِ رِزْقُهُ فَلْيُنْفِقْ مِمَّا آتَاهُ اللهُ ‘সম্পদশালীদের উচিৎ যে, সে যেন স্বীয় সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যয় করে এবং যার আয়-উপার্জন কম তার উচিৎ যে, আল্লাহ তাকে যতটুকু দান করেছেন, তা হ’তে সে ব্যয় করবে’ (তালাক ৬৫/৭)। মহান আল্লাহ আরো বলেন,وَعَلَى الْمَوْلُودِ لَهُ رِزْقُهُنَّ وَكِسْوَتُهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ ‘আর সন্তানের খাদ্য ও বস্ত্র নিয়ম মাফিক জন্মদাতার উপর ন্যস্ত’ (বাক্বারাহ ২/২৩৩)।
মীরাছের বিধান লংঘনের পরিণতি :
মহান আল্লাহ কুরআন মাজীদে সূরা নিসার ১১-১২ ও ১৭৬ নং আয়াতে মীরাছ বণ্টনের নিয়ম-নীতি বর্ণনা করেছেন। যে এই নীতি বাস্তবায়ন করবে তার জন্য রয়েছে জান্নাত এবং যে তালবাহানা ও কৌশল অবলম্বন করে এ বণ্টনে কম-বেশী করবে তার জন্য রয়েছে জাহান্নামের শাস্তি। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, تِلْكَ حُدُودُ اللهِ وَمَنْ يُطِعِ اللهَ وَرَسُوْلَهُ يُدْخِلْهُ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِيْنَ فِيهَا وَذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيْمُ، وَمَنْ يَعْصِ اللهَ وَرَسُولَهُ وَيَتَعَدَّ حُدُوْدَهُ يُدْخِلْهُ نَارًا خَالِدًا فِيْهَا وَلَهُ عَذَابٌ مُهِيْنٌ- ‘এগুলি হ’ল আল্লাহর নির্ধারিত সীমা। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে, তিনি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার তলদেশ দিয়ে নদী সমূহ প্রবাহিত হয়। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। আর এটাই হ’ল মহা সফলতা। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যতা করবে এবং তাঁর সীমাসমূহ লংঘন করবে, তিনি তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন। সেখানে সে চিরদিন থাকবে। আর তার জন্য রয়েছে অপমানজনক শাস্তি’ (নিসা ৪/১৩-১৪)।
ইসলাম প্রদত্ত মীরাছের বিধান দ্বারা ব্যক্তির অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। মহান আল্লাহ মানব জাতির ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তির জন্যই এ বিধান অবতীর্ণ করেছেন।
ব্যক্তির হক নষ্টের জন্য ব্যক্তির নিকট থেকেই ক্ষমা নিতে হবে। যদি কেউ ব্যক্তির হক নষ্ট করে মৃত্যুবরণ করে তাহ’লে ক্বিয়ামতের দিন নিজের পুণ্য দিয়ে বা তার পাপ গ্রহণ করে তা পরিশোধ করতে হবে।
মহান আল্লাহ বলেন,وَلَا تَأْكُلُوْا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ وَتُدْلُوْا بِهَا إِلَى الْحُكَّامِ لِتَأْكُلُوْا فَرِيْقًا مِنْ أَمْوَالِ النَّاسِ بِالْإِثْمِ وَأَنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ ‘আর তোমরা অন্যায়ভাবে পরস্পরের সম্পদ ভক্ষণ করো না এবং অন্যের সম্পদ গর্হিত পন্থায় গ্রাস করার উদ্দেশ্যে তোমরা জেনেশুনে তা বিচারকদের নিকট পেশ করো না’ (বাক্বারাহ ২/১৮৮)।
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,
أَتَدْرُونَ مَا الْمُفْلِسُ. قَالُوا الْمُفْلِسُ فِينَا مَنْ لاَ دِرْهَمَ لَهُ وَلاَ مَتَاعَ. فَقَالَ إِنَّ الْمُفْلِسَ مِنْ أُمَّتِى يَأْتِى يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِصَلاَةٍ وَصِيَامٍ وَزَكَاةٍ وَيَأْتِى قَدْ شَتَمَ هَذَا وَقَذَفَ هَذَا وَأَكَلَ مَالَ هَذَا وَسَفَكَ دَمَ هَذَا وَضَرَبَ هَذَا فَيُعْطَى هَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ وَهَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ فَإِنْ فَنِيَتْ حَسَنَاتُهُ قَبْلَ أَنْ يُقْضَى مَا عَلَيْهِ أُخِذَ مِنْ خَطَايَاهُمْ فَطُرِحَتْ عَلَيْهِ ثُمَّ طُرِحَ فِى النَّارِ.
‘তোমরা
কি জানো নিঃস্ব কে? ছাহাবীগণ বললেন, আমাদের মাঝে নিঃস্ব ঐ ব্যক্তি, যার
কোন অর্থ ও সামগ্রী নেই। রাসূল (ছাঃ) বললেন, আমার উম্মতের নিঃস্ব ঐ
ব্যক্তি, যে ছালাত, ছিয়াম ও যাকাতের নেকী নিয়ে ক্বিয়ামতের মাঠে উপস্থিত
হবে। অথচ সে কাউকে গালি দিয়েছে, কারো প্রতি মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে, কারো
সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করেছে, কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে এবং কাউকে
প্রহার করেছে। তখন তার নেকী হ’তে তাদেরকে পরিশোধ করা হবে। প্রাপ্য পরিশোধের
পূর্বে তার নেকী শেষ হয়ে গেলে তাদের পাপ নিয়ে তার উপর চাপানো হবে এবং তাকে
জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে’।[13]
বর্তমানে অধিকাংশ মানুষই মীরাছ বণ্টনের শারঈ বিধান লংঘন করে চলেছে। মীরাছ বণ্টনে শরী‘আতের সীমাকে উপেক্ষা করে নিজ স্বার্থ হাছিলের চেষ্টা করছে। যেমন পিতা কর্তৃক পুত্র সন্তানদেরকে মীরাছ প্রদান করা এবং কন্যাদেরকে বঞ্চিত করা। চাচা কর্তৃক নাবালিকা ভাতিজাদের মীরাছ থেকে বঞ্চিত করা। বিধবা পিতা-মাতাকে বশীভূত করে প্রভাবশালী সন্তান কর্তৃক সম্পদ আত্মসাৎ করা। বড় ভাই কর্তৃক পিতার সম্পদ সুষ্ঠু বণ্টন না করে অন্যান্য ভাই-বোনদের সাধ্যমত বঞ্চিত করা। অপরিচিতা কোন মহিলাকে ফুফু বানিয়ে নিজ ফুফুর জমি জাল দলীল করে আত্মসাৎ করা। কাউকে পিতা বানিয়ে নিজ পিতার জমি জাল দলীল করে প্রভাবশালী পুত্রের আত্মসাৎ করা। অনুরূপ বহু ঘটনা বর্তমান সমাজে অহরহ ঘটছে। ফলে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজে অশান্তির দাবানল দাউদাউ করে জ্বলছে।
উপসংহার :
পরিশেষে বলা যায়, ইসলামের মীরাছ বিধান ন্যায়-নীতিপূর্ণ। এ বিধান পালনে আমাদের জন্য কল্যাণ নিহিত রয়েছে। আর লংঘনে রয়েছে কঠিন শাস্তি। সুতরাং আমরা প্রত্যেককে তার ন্যায্য মীরাছ প্রদান করে জাহান্নামের শাস্তি থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করি। আল্লাহ আমাদের তাওফীক্ব দিন-আমীন!
[1]. মুহাম্মাদ আলী আছ-ছাবূনী, আল-মাওয়ারীছু ফিশ শারী‘আতিল ইসলামিয়্যাহ (দামেশক : দারুল কলম, ৩য় সংস্করণ, ১৯৯৭ খ্রি.), পৃঃ ৩৩-৩৪।
[2]. ঐ, পৃঃ ৩৪।
[3]. আবুদাঊদ হা/৩৬৪১; তিরমিযী হা/২৮৯৮; ইবনু মাজাহ হা/২২৩; মিশকাত হা/২১২, সনদ ছহীহ।
[4]. আল-মাওয়ারীছ, পৃঃ ৩৪।
[5]. আল-মাওয়ারীছ, পৃঃ ২০-২২; ছালেহ বিন ফাওযান, আত-তাহকীকাতুল মারযিয়্যাহ (রিয়ায : মাকতাবাতুল মা‘আরিফ, ৩য় সংস্করণ ১৯৮৬ খ্রি.), পৃঃ ১৭-১৯।
[6]. তিরমিযী হা/২০৯২; আবুদাঊদ হা/২৮৯১; আত-তাহকীকাতুল মারযিয়্যাহ, পৃঃ ২২।
[7]. ইবনু মাজাহ হা/২৭০৮; ছহীহ ইবনে খুযায়মা হা/২৩৫৫।
[8]. বুখারী হা/৬৭৬৪; মুসলিম হা/৪২২৫; মিশকাত হা/৩০৪৩।
[9]. তিরমিযী হা/১০৭৮; ইবনু মাজাহ হা/২৫০৬; মিশকাত হা/২৯১৫।
[10]. ইবনু মাজাহ হা/২৭০৯; মুসনাদে আহমাদ হা/২৬২১০, সনদ হাসান।
[11]. আল-মাওয়ারীছ, পৃঃ ৩৫-৩৬।
[12]. ঐ, পৃঃ ১৮-১৯।
[13]. মুসলিম হা/৪৬৭৮; মিশকাত হা/৫১২৮।