পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ । পর্ব ৬ । শেষ পর্ব ।
ইসলামী ভ্রাতৃত্বের উদ্দেশ্য :
ইসলামী ভ্রাতৃত্বের মূল উদ্দেশ্য হ’ল আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ অহি-র বিধান সমাজে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি অজর্ন করা। সে লক্ষ্যে নিম্নোক্ত কাজ অতীব যরূরী।
(ক) তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করা : ইসলামী শরী‘আতের মূল বিষয় হ’ল তাওহীদ প্রতিষ্ঠা। আদি পিতা হযরত আদম (আঃ) থেকে শুরু করে সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ) পর্যন্ত পৃথিবীতে যত নবী এবং রাসূলের আগমন ঘটেছে, তাঁদের সকলেরই মূল দাওয়াত ছিল لاَ إِلَهَ ِالاَّ اللهُ‘আল্লাহ ব্যতীত কোন (সত্য) মা‘বূদ নেই’। অর্থাৎ আল্লাহর একত্বের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন,
شَرَعَ لَكُمْ مِّنَ الدِّيْنِ مَا وَصَّىْ بِهِ نُوْحاً وَّالَّذِيْ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيْمَ وَمُوْسَى وَعِيْسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّيْنَ وَلَا تَتَفَرَّقُوْا فِيْهِ.
‘তিনি তোমাদের জন্য দ্বীনের ক্ষেত্রে সে পথই নির্ধারণ করেছেন, যার আদেশ দিয়েছিলেন নূহকে, যা আমি প্রত্যাদেশ করেছি আপনার প্রতি এবং যার আদেশ দিয়েছিলাম ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে এই মর্মে যে, তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত কর এবং তাতে অনৈক্য সৃষ্টি করো না’ (শূরা ৪২/১৩)।
অত্র আয়াতে ‘ইক্বামতে দ্বীন’ বলতে তাওহীদ এবং আল্লাহর আনুগত্যপূর্ণ সকল কাজকে বুঝানো হয়েছে। অনেকে ‘দ্বীন প্রতিষ্ঠা’র অর্থ ‘হুকুমত প্রতিষ্ঠা’ করে থাকেন, যেটা সর্বৈব ভ্রান্ত। উল্লেখিত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়াব্যাপী মুশরিক সমাজকে লক্ষ্য করে এরশাদ করেন যে, তোমাদের জন্য তোমাদের প্রভু নির্ধারণ করেছেন সেই দ্বীন, যা তিনি নির্ধারণ করেছিলেন দুনিয়ার প্রথম রাসূল হযরত নূহ (আঃ)-এর উপর। অতঃপর শ্রেষ্ঠ রাসূলগণের মধ্যে ইবরাহীম, মূসা, ঈসা ও সর্বশেষ রাসূল মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উপরে। আর সেটা হ’ল, এককভাবে আল্লাহর ইবাদত করা ও তাঁর সাথে কাউকে শরীক না করা।১ বিষয়টি আরো স্পষ্ট করে মহান আল্লাহ বলেন, وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَّسُوْلٍ إِلاَّ نُوْحِيْ إِلَيْهِ أَنَّهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنَا فَاعْبُدُوْنِ-‘আমি আপনার পূর্বেকার সকল রাসূলের নিকটে একই বিষয় প্রত্যাদেশ করেছি যে, আমি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। অতএব তোমরা কেবলমাত্র আমারই ইবাদত কর’ (আম্বিয়া ২১/২৫)।
সকল নবী-রাসূলের মৌলিক আদর্শের অভিন্নতা প্রসঙ্গে রাসূল (ছাঃ) বলেন, أَلْأَنْبِيَاءُ إِخْوَةٌ مِّنْ عَلاَّتٍ، وَأُمَّهَاتُهُمْ شَتَّى، وَدِيْنُهُمْ وَاحِدٌ.‘নবীগণ পরস্পরে বৈমাত্রেয় ভাই। তাঁদের মায়েরা পৃথক। কিন্তু তাঁদের সকলের দ্বীন এক’।২ উল্লেখিত আয়াত ও হাদীছ থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, প্রত্যেক নবী-রাসূলের দায়িত্ব ছিল মূলতঃ এক ও অভিন্ন। তা হ’ল তাওহীদের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা।
আমরা শেষ নবীর উম্মত হওয়ায় তাঁর তিরোধানের পর তাওহীদের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার সেই গুরু দায়িত্ব এখন প্রত্যেক মুসলমানের বিশেষত আলেমদের উপর অর্পিত হয়েছে। কেননা রাসূল (ছাঃ) বলেন, وَإِنَّ الْعُلَمَاءَ وَرَثَةُ الْأَنْبِيَاءِ، وَإِنَّ الْأَنْبِيَاءَ لَمْ يُوَرِّثُوْا دِيْنَارًا وَلاَ دِرْهَمًا، وَإِنَّمَا وَرَّثُوا الْعِلْمَ، فَمَنْ أَخَذَهُ أَخَذَ بِحَظًّ وَافِرٍ-‘আলেমগণ হ’লেন নবী-রাসূলগণের উত্তরাধিকারী। নবীগণ টাকা-পয়সার উত্তরাধিকারী করেন না; বরং তাঁরা জ্ঞানের উত্তরাধিকারী করেন। কাজেই যে ব্যক্তি সেই জ্ঞান অর্জন করল, সে পরিপূর্ণ অংশ গ্রহণ করল।৩
বর্তমান বিশ্বে আল্লাহর একত্বের বিপরীতে বহুঈশ্বরবাদ এমনভাবে সুসংগঠিত ও ব্যাপকভাবে সমাজমূলে শিকড় গেড়ে বসে গেছে, যা আইয়ামে জাহেলিয়াতকেও হার মানিয়ে দিয়েছে। অপরদিকে মুসলিম সমাজেও সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর একত্ব নিয়ে নানা রকম ভ্রান্ত আক্বীদার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। রব হিসাবে অথবা নাম ও গুণাবলীর ক্ষেত্রে আল্লাহ্কে এক হিসাবে বিশ্বাস করলেও মানব জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাঁর দাসত্ব করতে হবে এক্ষেত্রে বহুলাংশে অনীহা পরিলক্ষিত হয়। এমনিতর বহুমুখী সুসংঘবদ্ধ জাহেলিয়াতের মুকাবেলায় সমাজে নির্ভেজাল তাওহীদের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের বিকল্প নেই।
(খ) বৃহত্তর মুসলিম ঐক্য গড়ে তোলা : ইসলাম ভাষা, বর্ণ, ভৌগলিক সীমারেখা, ধনী-গরীবের বৈষম্য ইত্যাদির ঊর্ধ্বে উঠে বিশ্বমুসলিম ঐক্যে বিশ্বাসী। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে উম্মতে মুহাম্মাদী তথা সমগ্র মুসলিম জাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবে তাঁর প্রেরিত বিধানকে আকড়ে ধরার উদাত্ত আহবান জানিয়েছেন। সাথে সাথে মুসলমানরা যাতে আপোষে দল-বিভক্তির কবলে পড়ে নিজেদের শক্তিকে বিনষ্ট না করে সেজন্যও কঠোর ভাষায় হুঁশিয়ারি উচ্চারিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন,
وَاعْتَصِمُواْ بِحَبْلِ اللهِ جَمِيْعاً وَّلاَ تَفَرَّقُواْ.‘তোমরা ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জুকে আকড়ে ধর। সাবধান! দলে দলে বিভক্ত হয়ো না’ (আলে ইমরান ৩/১০৩)। তিনি আরো বলেন,
إِنَّ الَّذِيْنَ فَرَّقُواْ دِيْنَهُمْ وَكَانُواْ شِيَعاً لَّسْتَ مِنْهُمْ فِيْ شَيْءٍ إِنَّمَا أَمْرُهُمْ إِلَى اللهِ.‘নিশ্চয়ই যারা স্বীয় ধর্মকে খন্ড-বিখন্ড করেছে এবং বহু দলে বিভক্ত হয়েছে, তাদের সাথে আপনার কোনই সম্পর্ক নেই। তাদের ব্যাপার আল্লাহর নিকট সমর্পিত’ (আন‘আম ৬/১৫৯)।
একই সাথে রাসূল (ছাঃ)ও একমাত্র তাঁর আদর্শ অনুসরণের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহ্র ঐক্য সুদৃঢ় রাখা এবং এর মাধ্যমে কেবল জান্নাত পাওয়ার সুসংবাদ দিয়ে গেছেন। যেমন তিনি বলেন,وَإِنَّ بَنِيْ إِسْرَائِيْلَ تَفَرَّقَتْ ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِيْنَ مِلَّةً، وَتَفْتَرِقُ أُمَّتِىْ عَلَى ثَلاَثٍ وَّسَبْعِيْنَ مِلَّةً، كُلُّهُمْ فِى النَّارِ إِلاَّ مِلَّةً وَّاحِدَةً. قَالُوْا: مَنْ هِىَ يَا رَسُوْلَ اللهِ؟ قَالَ: مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِىْ.‘নিশ্চয়ই বনী ইসরাঈলগণ ৭২ দলে বিভক্ত হয়েছিল, আর আমার উম্মত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে। এদের সব দলই জাহান্নামে যাবে, একটি দল ব্যতীত। ছাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, সে দল কোন্টি? রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘আমি ও আমার ছাহাবীগণ যে আদর্শের উপরে আছি, তার উপরে যে দল থাকবে’।৪
বিশ্বের সকল মুসলমানের প্রভু এক, রাসূল এক, বিধান এক, কেবলা এক। সুতরাং তারা জাতিতেও এক। অথচ বাস্তবতায় তা পরিলক্ষিত হয় না। এক দেশের মুসলমানের সাথে অন্য দেশের মুসলমানের কোন মিল নেই। পারস্পরিক সহযোগিতা তো দূরের কথা, অনেক ক্ষেত্রে একে অন্যের ক্ষতি করার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। এহেন পরিস্থিতিতে বিশ্বের সকল মুসলমানের সমস্ত প্রকার বিভেদ দূর করে ঐক্যবদ্ধ মুসলিম মিল্লাত গড়ে তুলতে প্রয়োজন পারস্পরিক সহমর্মিতা, হৃদ্যতা ও বন্ধুত্ব। এককথায় বিশ্বব্যাপী বৃহত্তর মুসলিম ঐক্য গড়ে তুলতে প্রয়োজন মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করা।
(গ) মুসলিম মিল্লাতের সমৃদ্ধি অর্জন : ইসলামী ভ্রাতৃত্বের আর একটি উদ্দেশ্য হ’ল সার্বিক অর্থে মুসলিম মিল্লাতের সমৃদ্ধি আনয়ন করা। সমাজের পুঞ্জীভূত সমস্যা সমাধানে আর্থিক উন্নতি ও সামাজিক প্রভাব-প্রতিপত্তির কোন বিকল্প নেই। এ লক্ষ্যে বিশ্বের সকল মুসলমান সম্মিলিতভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য, সাহায্য-সহযোগিতা ও পারস্পরিক শলা-পরামর্শ প্রদানের মাধ্যমে মুসলিম সমাজের বৃহত্তর সমৃদ্ধি অর্জন করা একান্ত যরূরী। ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রুদের মুকাবেলায় শক্তি ও সমৃদ্ধি অর্জনের বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন,وَأَعِدُّواْ لَهُمْ مَّا اسْتَطَعْتُمْ مِّنْ قُوَّةٍ وَّمِنْ رِّبَاطِ الْخَيْلِ تُرْهِبُوْنَ بِهِ عَدُوَّ اللّهِ وَعَدُوَّكُمْ وَآخَرِيْنَ مِنْ دُوْنِهِمْ لاَ تَعْلَمُوْنَهُمُ اللّهُ يَعْلَمُهُمْ.‘তোমরা তাদের মুকাবেলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ব-বাহিনী প্রস্ত্তত রাখবে, এদ্বারা তোমরা আল্লাহর শত্রুদের ও তোমাদের শত্রুদের সন্ত্রস্ত করবে এবং এতদ্ব্যতীত অন্যদেরকে, যাদের তোমরা জান না; কিন্তু আল্লাহ জানেন’ (আনফাল ৮/৬০)।
বর্তমান বিশ্বে ইসলাম বিরোধী শক্তিগুলো আল্লাহদ্রোহিতার ক্ষেত্রে আপোষে সকল প্রকার মতভেদ ভুলে সঙ্ঘবদ্ধভাবে ইসলাম ও মুসলমানদের ধ্বংসের লক্ষ্যে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে চলেছে। এই ঐক্যবদ্ধ তাগূতী শক্তির মুকাবেলায় মুসলিম সমাজে চাই নিষ্কাম ভ্রাতৃত্ববোধের উন্মেষ। অপরদিকে যদি মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধের ঘাটতি থাকে, তাহ’লে শত্রুপক্ষ যেকোন মুহূর্তে তাদের ঘায়েল করতে কুণ্ঠাবোধ করবে না।
(ঘ) নিঃস্বার্থ সম্প্রীতি স্থাপন করা : প্রত্যেক মুসলমানের মূল এবং একমাত্র উদ্দেশ্য হ’ল পারলৌকিক মুক্তি অর্জন করা। এটি অর্জনের অন্যতম পথ হ’ল নিঃস্বার্থভাবে মানবতার সেবায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করা। আর কোন মানুষের প্রতি সেবা বা সহযোগিতার মানসিকতা তখনি সৃষ্টি হয়, যখন তার প্রতি হৃদয়ের গভীর থেকে এক ধরনের আন্তরিক ভালবাসা জাগ্রত হয়। এ প্রসঙ্গে নিম্নোক্ত হাদীছ প্রণিধানযোগ্য।
عَنْ مُّعَاذِ بْنِ جَبَلٍ قَالَ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم يَقُوْلُ : قَالَ اللهُ تَعَالَى: وَجَبَتْ مَحَبَّتِىْ لِلْمُتَحَابِّيْنَ فِىَّ، وَالْمُتَجَالِسِيْنَ فِىَّ وَالْمُتَزَاوِرِيْنَ فِىَّ، وَالْمُتَبَاذِلِيْنَ فِىَّ.
মু‘আয ইবনে জাবাল (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ) কে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘যারা আমার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে পরস্পরকে ভালবাসে, আমার উদ্দেশ্যে সমাবেশে মিলিত হয়, আমার উদ্দেশ্যে পরস্পরে সাক্ষাৎ করে এবং আমার উদ্দেশ্যেই নিজেদের মাল-সম্পদ ব্যয় করে, আমার ভালবাসা তাদের জন্য অবধারিত’।৫ অর্থাৎ পারস্পরিক ভালবাসা, কোথাও সমবেত হওয়া বা সাক্ষাৎ করা অথবা কারো জন্য কিছু অর্থ-সম্পদ ব্যয় করার ক্ষেত্রে অবশ্যই খালেছ নিয়ত থাকতে হবে। এসকল কাজ একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যেই হ’তে হবে। দুনিয়াবী কোন স্বার্থে নয়। তিনি আরো বলেন,
وَعَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ : قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّم: إِنَّ اللهَ يَقُوْلُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ : أَيْنَ الْمُتَحَابُّوْنَ بِجَلاَلِىْ؟ اَلْيَوْمَ أُظِلُّهُمْ فِىْ ظِلِّىْ يَوْمَ لاَ ظِلَّ إِلاَّ ظِلِّىْ.
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, আমার সুমহান ইয্যতের খাতিরে যারা পরস্পরে ভালবাসা স্থাপন করেছে, তারা কোথায়? আজ আমি তাদেরকে আমার বিশেষ ছায়ায় স্থান দিব। আজ আমার ছায়া ব্যতীত আর কোন ছায়া নেই’।৬ এখানেও ক্বিয়ামতের ভয়াবহতম পরিস্থিতিতে তারাই কেবল আল্লাহ কর্তৃক ছায়াতলে আশ্রয়প্রাপ্ত হবেন, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য মানুষের সাথে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হন।
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি স্থাপনের বিষয়ে অন্য একটি হাদীছে আরো স্পষ্ট বর্ণনা এসেছে।
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم : أَنَّ رَجُلاً زَارَ أَخًا لَّهُ فِىْ قَرْيَةٍ أُخْرَى، فَأََرْصَدَ اللهُ لَهُ عَلَى مَدْرَجَتِهِ مَلَكًا فَلَمَّا أَتَي عَلَيْهِ قَالَ : أَيْنَ تُرِيْدُ ؟ قَالَ : أُرِيْدُ أَخًا لِّىْ فِىْ هَذِهِ الْقَرْيَةِ، قَالَ: هَلْ لَّكَ عَلَيْهِ مِنْ نِّعْمَةٍ تَرُبُّهَا ؟ قَالَ: لاَ غَيْرَ أَنِّىْ أَحْبَبْتُهُ فِى اللهِ قَالَ فَإِنِّىْ رَسُوْلُ اللهِ إِلَيْكَ بِأَنَّ اللهَ قَدْ أَحَبَّكَ كَمَا أَحْبَبْتَهُ فِيْهِ-
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) নবী (ছাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি অন্য এক গ্রামে তার মুসলমান ভাইয়ের সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে বের হ’ল। আল্লাহ তা‘আলা তার গমন পথে একজন অপেক্ষমান ফেরেশতা বসিয়ে রাখলেন। লোকটি যখন সেখানে পৌঁছল, তখন ফেরেশতা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোথায় যাচ্ছ? সে বলল, ঐ গ্রামে একজন ভাই আছে, তার সাথে সাক্ষাতে যাচ্ছি। ফেরেশতা জিজ্ঞেস করলেন, তার কাছে তোমার কোন অনুগ্রহ আছে কি? যার বিনিময় লাভের জন্য তুমি যাচ্ছ? সে বলল, না, আমি তাকে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ভালবাসি। তখন ফেরেশতা বললেন, আমি আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে তোমার কাছে এই সংবাদ দেওয়ার জন্য প্রেরিত হয়েছি যে, আল্লাহ তোমাকে অনুরূপ ভালবাসেন, যেরূপ তুমি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তাকে ভালবাস’।৭
তিনি আরো বলেন,
وَعَنْ عُمَرَ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم: إِنَّ مِنْ عِبَادِ اللهِ لَأُنَاسًا مَّا هُمْ بِأَنْبِيَاءَ وَلاَشُهَدَاءَ، يَغْبِطُهُمُ الْأَنْبِيَاءُ وَالشُّهَدَاءُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِمَكَانِهِمْ مِّنَ اللهِ. قَالُوْا: يَارَسُوْلَ اللهِ تُخْبِرُنَا مَنْ هُمْ؟ قَالَ: هُمْ قَوْمٌ تَحَابُّوْا بِرَوْحِ اللهِ عَلَى غَيْرِ أَرْحَامٍ بَيْنَهُمْ، وَلاَ أَمْوَالٍ يَّتَعَاطَوْنَهَا، فَوَاللهِ إِنَّ وُجُوْهَهُمْ لَنُوْرٌ وَّإِنَّهُمْ لَعَلَى نُوْرٍ، لاَيَخَافُوْنَ إِذَا خَافَ النَّاسُ، وَلاَيَحْزَنُوْنَ إِذَا حَزِنَ النَّاسُ، وَقَرَأَ هَذِهِ الْآيَةَ: أَلاَ إِنَّ أَوْلِيْاءَ اللهِ لاَ خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلاَهُمْ يَحْزَنُوْنَ-
হযরত আমর (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে এমন কতিপয় লোক আছে, যারা নবীও নন এবং শহীদও নন। কিন্তু ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলার কাছে তাদের মর্যাদা দেখে নবী-শহীদগণও ঈর্ষা করবেন। ছাহাবীগণ আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদেরকে বলুন তারা কারা? তিনি বললেন, তারা এমন এক সম্প্রদায় যারা শুধু আল্লাহর রূহ (কুরআনের সম্পর্ক) দ্বারা পরস্পরকে ভালবাসে। অথচ তাদের মধ্যে কোন প্রকার আত্মীয়তা নেই এবং তাদের পরস্পরে মাল-সম্পদের লেনদেনও নেই। আল্লাহর কসম! তাদের চেহারা হবে জ্যোতির্ময় এবং তারা উপবিষ্ট হবেন নূরের উপর। তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হবে না, যখন সমস্ত মানুষ ভীত থাকবে। তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবে না, যখন সকল মানুষ দুশ্চিন্তায় নিমগ্ন থাকবে। অতঃপর তিনি কুরআনের এই আয়াত পড়েন, ‘জেনে রাখ! নিশ্চয়ই আল্লাহর বন্ধুদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্তও হবে না’।৮ মূলত একেই বলে নিঃস্বার্থ ভ্রাতৃত্ব।
১. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, ইক্বামতে দ্বীন : পথ ও পদ্ধতি, পৃঃ ৪।
২. বুখারী, মুসলিম হা/২৩৬৫, ‘ঈসা (আঃ)-এর ফাযায়েল’ অধ্যায়, মিশকাত-আলবানী, হা/৫৭২২ ‘ক্বিয়ামতের অবস্থা ও সৃষ্টির সূচনা’ অধ্যায়,
৩. তিরমিযী হা/২৬৮২; আবূদাঊদ হা/৩৬৪১; ইবনু মাজাহ হা/২২৩; মিশকাত হা/২১২ ‘ইলম’ অধ্যায়, হাদীছ ছহীহ।
৪. ছহীহ তিরমিযী, হা/২১২৯; মিশকাত হা/১৭১।
৫. মুওয়াত্তা মালেক, মিশকাত, হা/৫০১১, সনদ ছহীহ।
৬. মুসলিম হা/২৫৬৬, মিশকাত, হা/৫০০৬।
৭. মুসলিম, হা/২৫৬৭; মিশকাত, হা/৫০০৭।
৮. তাহক্বীক্ব আবুদাঊদ হা/৩৫২৭, মিশকাত, হা/৫০১২, ছহীহ লি-গায়রিহি।