এছাড়াও দুনিয়াবী ক্ষণস্থায়ী জীবনে স্বার্থপরতার মূলোৎপাটন, সর্বদা ভোগের বিপরীতে ত্যাগের মনোভাব তৈরী করার মধ্য দিয়ে পরকালীন জীবনে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের পথ সুগম করাই ইসলামী ভ্রাতৃত্বের মূল উদ্দেশ্য।
উল্লিখিত উদ্দেশ্য হাছিলের লক্ষ্যে মুমিনের পারস্পরিক সম্পর্ক তথা ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধির বিষয়ে মহান আল্লাহ এবং নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) মুসলিম সমাজকে উদ্বুদ্ধ করে গেছেন। নিম্নে তার যৎসামান্য উপস্থাপন করা হ’ল।
নো‘মান বিন বাশীর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, تَرَى الْمُؤْمِنِيْنَ فِىْ تَرَاحُمِهِمْ وَتَوَادِّهِمْ وَتَعَاطُفِهِمْ كَمَثَلِ الْجَسَدِ إِذَا اشْتَكَى عُضْوًا تَدَاعَى لَهُ سَائِرُ الْجَسَدِ بَالسَّهَرِ وَالْحُمَّى.‘তুমি ঈমানদারদেরকে তাদের পারস্পরিক সহানুভূতি, বন্ধুত্ব ও দয়া-অনুগ্রহের ক্ষেত্রে একটি দেহের ন্যায় দেখবে। যখন দেহের কোন অঙ্গ অসুস্থ হয়, তখন সমস্ত শরীর তজ্জন্য বিনিদ্র ও জ্বরে আক্রান্ত হয়’।২ অন্য হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
اَلْمُؤْمِنُوْنَ كَرَجُلٍ وَّاحِدٍ إِنِ اشْتَكَى عَيْنُهُ اِشْتَكَى كُلُّهُ وَإِنِ اشْتَكَى رَأْسُهُ اِشْتَكَى كُلُّهُ.
নো‘মান বিন বাশীর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘সকল মুমিন এক ব্যক্তির মত। যদি তার চক্ষু অসুস্থ হয়, তখন তার সর্বাঙ্গ অসুস্থ হয়ে পড়ে। আর যদি তার মাথায় ব্যথা হয়, তখন তার সমস্ত দেহই ব্যথিত হয়’।৩
আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী (ছাঃ) বলেছেন, الْمُؤْمِنُ لِلْمُؤْمِنِ كَالْبُنْيَانِ يَشُدُّ بَعْضُهُ بَعْضًا ثُمَّ شَبَّكَ بَيْنَ أَصَابَعِهِ.‘একজন মুমিন আর একজন মুমিনের জন্য এক গৃহের মত, যার একাংশ অপরাংশকে সুদৃঢ় রাখে। অতঃপর তিনি এক হাতের অঙ্গুলিগুলি অপর হাতের অঙ্গুলির মধ্যে প্রবিষ্ট করালেন’।৪
উল্লিখিত তিনটি হাদীছে মুমিনের পারস্পরিক সম্পর্ক ও সুদৃঢ় অবস্থানের স্পষ্ট বর্ণনা ফুটে উঠেছে। দেহের প্রতিটি অঙ্গের স্বতন্ত্র অবস্থান ও কর্মপরিধি থাকলেও বিপদে যেমন পরস্পরের প্রতি সহমর্মী-সমব্যাথী, তেমনি বর্ণে, বংশে, কর্মক্ষেত্রে বা ভৌগলিক অবস্থানগত পার্থক্য থাকলেও সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে বিশ্বের সকল মুসলমান একটি অখন্ড শরীরের মত। মুসলমানদের পারস্পরিক সহযোগিতার কথা হাদীছে বিশেষভাবে উল্লেখিত হয়েছে।
আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, أُنْصُرْ أََخَاكَ ظَالِمًا أَوْ مَظْلُوْمًا فَقَالَ رَجُلٌ: يَا رَسُوْلَ اللهِ أَنْصُرُهُ مَظْلُوْمًا، فَكَيْفَ أَنْصُرُهُ ظَالِمًا؟ قَالَ: تَمْنَعُهُ مِنَ الظُّلْمِ، فَذَالِكَ نَصْرُكَ إِيَّاهُ.‘তুমি তোমার ভাইকে সাহায্য কর, চাই সে অত্যাচারী হোক বা অত্যাচারিত হোক। তখন এক ব্যক্তি বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! অত্যাচারিতকে তো সাহায্য করব; কিন্তু অত্যাচারীকে কিভাবে সাহায্য করব? তখন নবী করীম (ছাঃ) বললেন, তাকে অত্যাচার করা থেকে বিরত রাখবে। এটিই তাকে তোমার সাহায্য করার নামান্তর’।৫
পারস্পরিক সহযোগিতার পুরস্কার সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন,
اَلْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ، لاَيَظْلِمُهُ، وَلاَيُسْلِمُهُ، وَمَنْ كَانَ فِىْ حَاجَةِ أَخِيْهِ كَانَ اللهُ فِىْ حَاجَتِهِ، وَمَنْ فَرَّجَ عَنْ مُّسْلِمٍ كُرْبَةً فَرَّجَ اللهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرُبَاتِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ، وَمَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ اللهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ.
‘এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। সে তার উপর যুলুম করবে না এবং তাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিবে না। যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের অভাব মোচনে সাহায্য করবে, আল্লাহ তা‘আলা তার অভাব মোচনে সাহায্য করবেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের দুঃখ-কষ্ট দূর করবে, আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামতের দিন তার বিপদসমূহের কোন একটি বড় বিপদ দূর করে দিবেন। আর যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের দোষ-ত্রুটি ঢেকে রাখবে, আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামতের দিন তার দোষ-ত্রুটি ঢেকে রাখবেন’।৬
অন্য হাদীছে রাসূল (ছাঃ) বলেন,
اَلْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ، لاَيَظْلِمُهُ، وَلاَيَخْذُلُهُ، وَلاَيَحْقِرُهُ، اَلتَّقْوَى هَهُنَا وَيُشِيْرُ إِلىَ صَدْرِهِ ثَلاَثَ مِرَارٍ بِحَسْبِ امْرِءٍ مِّنَ الشَّرِّ أَنْ يُّحْقِرَ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ، كُلُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ حَرَامٌ : دَمُهُ وَمَالُهُ وَعِرْضُهُ.
‘এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। কাজেই সে তার উপর যুলুম করবে না, তাকে লজ্জিত করবে না এবং তাকে হীন মনে করবে না। ‘তাক্বওয়া’ (আল্লাহভীতি) এখানে একথা বলে তিনি তিনবার নিজের বক্ষের দিকে ইংগিত করলেন। তিনি আরো বলেন, কোন ব্যক্তির মন্দ কাজ করার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে নিজের কোন মুসলমান ভাইকে হেয় জ্ঞান করে। বস্ত্ততঃ একজন মুসলমানের সব কিছুই অপর মুসলমানের জন্য হারাম। তার জান, মাল ও ইয্যত’।৭
(চ) পারস্পরিক কল্যাণ কামনা : ইসলামী ভ্রাতৃত্বের আর একটি উদ্দেশ্য হ’ল পারস্পরিক কল্যাণ কামনা করা। পারস্পরিক কল্যাণ কামনার বিষয়ে নবী করীম (ছাঃ) বলেন, اَلدِّيْنُ اَلنَّصِيْحَةُ‘দ্বীন হচ্ছে কল্যাণ কামনা’।৮ বিষয়টির প্রতি গুরুত্বারোপ করে তিনি কথাটি তিন বার উল্লেখ করেন।
জারীর ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, بَايَعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّم عَلَى إِقَامِ الصَّلَوةِ وَإِيْتَاءِ الزَّكَوةِ وَالنُّصْحِ لِكُلِّ مُسْلِمٍ.‘আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হাতে ছালাত আদায়, যাকাত প্রদান এবং প্রত্যেক মুসলমানের কল্যাণ কামনা করার অঙ্গীকার করে বায়‘আত করলাম’।৯
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, حَقُّ الْمُؤْمِنِ عَلَى الْمُؤْمِنِ سِتٌّ‘একজন মুমিনের উপরে আরেক মুমিনের ছয়টি কর্তব্য রয়েছে’। তন্মধ্যে একটি হ’ল وَإِذَا اسْتَنْصَحَكَ فَانْصَحْ لَهُ‘যখন সে তোমার কাছে পরামর্শ চাইবে, তখন তুমি তাকে (কল্যাণকর) উপদেশ দিবে’।১০
অন্য একটি প্রসিদ্ধ হাদীছে বলা হয়েছে, এক মুসলমানের উপর অপর মুসলমানের ছয়টি হক রয়েছে। তন্মধ্যে অন্যতম হ’ল, وَيُنْصَحُ لَهُ إِذَا غَابَ أَوْ شَهِدَ ‘এবং উপস্থিত বা অনুপস্থিত উভয় অবস্থায় তার কল্যাণ কামনা করবে’।১১
মানুষ তার দ্বীনী ভাইয়ের কল্যাণ কামনায় সর্বদা উদগ্রীব থাকবে। তারই মঙ্গল সাধনে সর্বোতভাবে চেষ্টা অব্যাহত রাখবে। তার কোন ক্ষতি হোক এমন কোন বিষয় তার দ্বারা সংঘটিত হবে না। অথচ সমাজে দেখা যায়, এক শ্রেণীর মানুষ তার দ্বীনী ভাইয়ের কল্যাণ কামনার পরিবর্তে তার ক্ষতি করার জন্য সর্বদা সময়, শ্রম, মেধা ও বুদ্ধি অপচয় করে থাকে। প্রতিনিয়ত নানা কূটকৌশল ও চক্রান্তের জাল বিস্তার করে। একটি কৌশল ব্যর্থতায় পর্যবসিত হ’লে নতুন ফন্দী আটে। বাহ্যিকভাবে তারা মানুষের কাছে ভাল হ’লেও প্রকৃতপক্ষে তারা নিকৃষ্ট প্রকৃতির লোক। এ জাতীয় লোককে আল্লাহ পসন্দ করেন না; বরং তিনি প্রকৃতি ‘মুহসিন’ বান্দাকে পসন্দ করেন’ (বাক্বারাহ ১৯৫)।
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উপরোক্ত বিষয় ছাড়াও আরো অনেক বিষয় আছে যার মাধ্যমে পারস্পরিক সৌহার্দ্য বৃদ্ধি পাবে, সম্পর্ক অটুট থাকবে, সাথে সাথে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।
ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধির উপায় :
ইসলামী শরী‘আতে মুমিনের পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধির বিভিন্ন নিয়ামকের বর্ণনা প্রদান করা হয়েছে। দৈনন্দিন জীবনে সেসব কর্ম ও আচরণ গ্রহণ ও অনুসরণ করলে পারস্পরিক সম্পর্ক সুদৃঢ় ও স্থায়ী হয়, বন্ধুত্ব ও হৃদ্যতা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় এবং এর ফলে দু’টি হৃদয় শিশাঢালা প্রাচীরের ন্যায় ঘনিষ্ঠতর ও মযবুত হয়। এক্ষেত্রে শরী‘আতের কিছু আহকাম আছে আবশ্যকীয় এবং কিছু আছে ইচ্ছাধীন। তবে পারস্পরিক ভালবাসা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক বিকশিত ও ফুলে-ফলে সুশোভিত করার জন্য উভয়েরই গুরুত্ব অনস্বীকার্য। নিম্নে ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধির কতিপয় নিয়ামক সম্পর্কে আলোকপাত করা হ’ল।-
(ক) সালাম প্রদান : মুমিন জীবনে সালামের গুরুত্ব অপরিসীম। আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করে তাঁর উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রথম যে নির্দেশ প্রদান করা হয়, তা হ’ল ফেরেশতাদের উদ্দেশ্যে সালাম প্রদান।১২ সালামের বহুমুখী দিক রয়েছে। যেমন সালামের ফযীলত, সালাম প্রদানকারী অহঙ্কার হ’তে মুক্ত, সালাম প্রদান করা হক্ব, সালাম না দেওয়া কৃপণতা ইত্যাদি। এছাড়াও এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হ’ল, সালাম প্রদানের মাধ্যমে পারস্পরিক ভালবাসা বৃদ্ধি পায়। কারণ সালামের অর্থই হ’ল দ্বীনী ভাইয়ের প্রতি শান্তি, রহমত ও বরকত প্রার্থনা করা। সালামের মাধ্যমে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধি প্রসঙ্গে নিম্নের হাদীছটি প্রণিধানযোগ্য।
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, لاَتَدْخُلُوْنَ الْجَنَّةَ حَتَّى تُؤْمِنُوْا، وَلاَتُؤْمِنُوْا حَتَّى تَحَابُّوْا، أَوَلاَ أَدُلُّكُمْ عَلَى شَىْءٍ إِذَا فَعَلْتُمُوْهُ تَحَابَبْتُمْ أَفْشُوا السَّلاَمَ بَيْنَكُمْ.‘তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমরা ঈমান গ্রহণ করবে। আর তোমরা ঈমানদার হিসাবে গণ্য হবে না, যতক্ষণ না তোমরা পরস্পরকে ভালবাসবে। আমি কি তোমাদেরকে এমন কথা বলে দিব না যা তোমাদের পারস্পরিক ভালবাসা বৃদ্ধি করবে? (আর তা হচ্ছে) তোমরা পরস্পরের মধ্যে সালামের প্রচলন করবে’।১৩
নবী করীম (ছাঃ) যখন রাস্তায় চলতেন, তখন নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে যার সঙ্গেই তাঁর দেখা হ’ত, তাকে তিনি সালাম দিতেন। আমাদেরকেও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অনুসরণে মুসলিম নারী-পুরুষ শিশু-বৃদ্ধ সকলকে সালাম প্রদান করতে হবে। এতে সকলের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে উঠবে, পারস্পরিক হৃদ্যতা বৃদ্ধি পাবে। তবে সালামের আদান-প্রদান যখন সঠিক অনুভূতি নিয়ে করা হবে অর্থাৎ এক ভাই অপর ভাইকে শান্তির জন্য দো‘আ করবে এবং এর মাধ্যমে তার হৃদয়ে ভালবাসা ও শুভ কামনার সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ ঘটবে, কেবল তখনই সালামের মাধ্যমে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধি পাবে। অন্যথা প্রচলিত অভ্যাসের বশবর্তী হয়ে শুধু মুখে তোতা পাখির মত দু’টি আরবী শব্দ নিঃসৃত হ’লে সালামের হক্ব আদায় হ’তে পারে, কিন্তু তাতে পারস্পরিক ভালবাসা বৃদ্ধির সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
(খ) মুছাফাহা করা : সালামের সাথে সম্পর্কযুক্ত বিষয় হ’ল মুছাফাহা। যার অর্থ পরস্পর হাত মিলানো বা করমর্দন করা। কদমবুচি বা পদচুম্বন ইসলামী শরী‘আতে বৈধ না হ’লেও মুছাফাহা এবং মু‘আনাকা তথা কোলাকুলি বৈধ। যেমন হাদীছে এসেছে,
عَنْ قَتَادَةَ، قَالَ : قُلْتُ لِأَنَسٍ : أَكَانَتِ الْمُصَافَحَةُ فِىْ أَصْحَابِ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمُ؟ قَالَ نَعَمْ.
কাতাদা (রাঃ) বলেন, আমি আনাস (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণের মধ্যে মুছাফাহার প্রচলন ছিল কি? তিনি বললেন, হ্যাঁ, ছিল’।১৪ মুসলমানদের পরস্পরের সাথে সাক্ষাৎ হ’লে সালাম বিনিময়ের পর হৃদয়ের গভীরে আন্তরিকতার যে প্রগাঢ় আবেগ নিহিত থাকে, সেই প্রেরণা থেকেই আপোসে করমর্দন করে থাকে। এর মাধ্যমে যেমন বন্ধুত্ব সুসংহত হয়, তেমনি উভয়ের গোনাহ মাফ হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَا مِنْ مُّسْلِمَيْنِ يَلْتَقِيَانِ فَيَتَصَافَحَانِ إِلاَّ غُفِرَلَهُمَا قَبْلَ أَنْ يَّتَفَرَّقَا.‘যখন দু’জন মুসলমানের পরস্পর সাক্ষাৎ হয় এবং তারা মুছাফাহা করে, পৃথক হওয়ার পূর্বেই তাদের উভয়ের গোনাহ মাফ করে দেওয়া যায়’।১৫ তাই পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃত গোনাহ হ’তে পরিত্রাণ লাভের সহজ ও সুন্দর মাধ্যম হিসাবে মুমিন জীবনে বেশী বেশী সালাম ও মুছাফাহার প্রচলন করা উচিত।
(গ) হাদিয়া প্রদান : হাদিয়া প্রদান ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধির একটি অন্যতম নিয়ামক। প্রকৃতপক্ষে ভাল কথা বলা, উৎকৃষ্ট আচরণ করা, সৎ পরামর্শ প্রদান ইত্যাদিও এক ধরনের হাদিয়া। এর মাধ্যমে একজন মানুষ অতি সহজেই অন্যের হৃদয়কে আকৃষ্ট করে তার সাথে যোগসূত্র রচনা করতে পারে। তেমনি বস্ত্তগত হাদিয়ার মাধ্যমে মানুষের পারস্পরিক প্রেম-প্রীতি ও বন্ধুত্ব বৃদ্ধি পায়। হাদিয়া প্রদানে উৎসাহিত করে রাসূল (ছাঃ) যেমন উপদেশ দিয়েছেন, তেমনি হাদিয়া প্রদানের উপকারিতাও বর্ণনা করেছেন। যেমন তিনি বলেন,
تَهَادُوْا تَحَابُّوْا‘তোমরা একে অপরকে হাদিয়া পাঠাও, এর দ্বারা পারস্পরিক ভালবাসা বৃদ্ধি পাবে’।১৬ আনাস (রাঃ) বলতেন, يَا بَنِىَّ! تَبَاذَلُوْا بَيْنَكُمْ، فَإِنَّهُ أَوَدُّ لِمَا بَيْنَكُمْ‘হে বৎসগণ! তোমরা একে অপরের জন্য অর্থ-সম্পদ ব্যয় করবে, এতে তোমাদের মধ্যে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর হবে’।১৭ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজে যেমন তাঁর সঙ্গী-সাথীদের হাদিয়া দিতেন, তেমনি ছাহাবীগণও তাঁকে ও অন্য ছাহাবীদেরকে হাদিয়া প্রদান করতেন।
(ঘ) হাসিমুখে কথা বলা : হাসিমুখে কথা বলার মাধ্যমে অতি সহজেই অন্যের মন জয় করা সম্ভব। তাছাড়া কর্কষভাষী বা কঠিন হৃদয়ের মানুষকে কেউ পসন্দ করে না। মহান আল্লাহ বলেন, فَبِمَا رَحْمَةٍ مِّنَ اللّهِ لِنْتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيْظَ الْقَلْبِ لاَنْفَضُّواْ مِنْ حَوْلِكَ.‘আল্লাহর অনুগ্রহে তুমি তাদের প্রতি কোমল-হৃদয় হয়েছিলে। যদি তুমি রূঢ় ও কঠিন হৃদয়ের লোক হ’তে, তবে তোমার নিকট থেকে তারা দূরে সরে যেত’ (আলে ইমরান ১৫৯)। অনুরূপভাবে মিষ্টি হেসে কথা বলাকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছাদাক্বা হিসাবে উল্লেখ করেছেন।১৮ তাছাড়া ভাল ও সুন্দর কথা পরকালে জাহান্নামের শাস্তি থেকে আত্মরক্ষায় সহায়ক হিসাবে ভূমিকা পালন করবে। রাসূল (ছাঃ) এরশাদ করেন,
إِتَّقُوا النَّارَ وَلَوْ بِشِقِّ تَمْرَةٍ فَمَنْ لَّمْ يَجِدْ فَبِكَلِمَةٍ طَيِّبَةٍ.
‘জাহান্নামের আগুন থেকে আত্মরক্ষা কর। যদিও তা অর্ধেক খেজুরের বিনিময়েও হয়। যে তাও দান করতে অক্ষম, সে লোকজনকে ভাল ও সুন্দর কথা দ্বারা জাহান্নামের আগুন থেকে আত্মরক্ষা করবে’।১৯ অন্যত্র তিনি আরো বলেন,
وَالْكَلِمَةُ الطَّيِّبَةُ صَدَقَةٌ.‘ভাল কথাও ছাদাক্বা হিসাবে গণ্য হবে’।২০ অপর হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِىْ ذَرٍّ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ، قَالَ : قَالَ لِىْ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : لاَتَحْقِرَنَّ مِنَ الْمَعْرُوْفِ شَيْئًا وَلَوْ أَنْ تَلْقَى أَخَاكَ بِوَجْهٍ طَلِيْقٍ.
আবু যর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে বলেছেন, ‘ভাল কাজের কোনটাকেই তুচ্ছ মনে করবে না। যদিও তা তোমার ভাইয়ের সাথে হাসিমুখে সাক্ষাৎও হয়’।২১
উল্লিখিত আয়াত ও হাদীছের আলোকে একথা নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয় যে, পরকালে পাপ মুক্তির অসীলা হিসাবে হাসিমুখে কথা বলার গুরুত্ব অপরিসীম। সাথে সাথে দুনিয়াবী জীবনে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধিতেও হাসিমুখ ও কোমল আচরণের বিকল্প নেই।
[চলবে]