ভূমিকা :
সকল প্রশংসা সৃষ্টিকুলের প্রতিপালক আল্লাহর। আমরা তার প্রশংসা করি, তার কাছে সাহায্য চাই, তার কাছে ক্ষমা চাই এবং তার কাছে ফিরে যাই। আমাদের মনের অনিষ্টতা বা কুচিন্তা থেকে এবং আমাদের কার্যাবলির কদর্যতা থেকে আমরা আল্লাহর নিকটে সাহায্য চাই। আল্লাহ যাকে সুপথ দেন তাকে বিপদগামী করার কেউ নেই। আর যাকে বিপদগামী করেন তাকে সুপথে আনারও কেউ নেই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তিনি একক, তার কোন শরীক নেই। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (ছাঃ) তাঁর বান্দা এবং রাসূল। আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে সুপথের দিশা ও সত্য দ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন। তিনি আল্লাহর রিসালাত (বার্তা) মানুষের কাছে পৌঁছিয়েছেন, আমানত প্রত্যার্পণ করেছেন, উম্মতের কল্যাণ করেছেন এবং আল্লাহর পথে যথার্থভাবে সংগ্রাম করেছেন। অনন্তর রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক তাঁর উপর, তাঁর পরিবারবর্গের উপর, তাঁর ছাহাবীগণের উপর এবং তাদের উপর, যারা ক্বিয়ামত দিবস পর্যন্ত সুচারুরূপে তাঁদের অনুসরণ করবেন। অতঃপর প্রিয় ভ্রাতৃবর্গ, এই প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় ‘দাঈদের পারস্পরিক সহযোগিতা এবং সমাজে তার প্রভাব’, যা সকলের কিংবা অধিকাংশ মানুষের জানা। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, শরী‘আতে আল্লাহর পথে দাওয়াতের বিরাট মর্যাদা রয়েছে। কারণ আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কিতাবে নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে তাঁর উম্মতের নিকট দাওয়াত দানের একটি বিশেষ আদেশ পৌঁছে দিতে বলেছেন। সেই আদেশটি হচ্ছে,قُلْ هَذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللهِ عَلَى بَصِيرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِي وَسُبْحَانَ اللهِ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ ‘(হে রাসূল,) তুমি বল এটাই আমার পথ। আমি ও আমার অনুসারীগণ ডাকি আল্লাহর দিকে জাগ্রত জ্ঞান সহকারে। আল্লাহ পবিত্র। আর আমি অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত নই’ (ইউসুফ ১২/১০৮)।
মুহাম্মাদী দাওয়াতের স্বরূপ :
নবী করীম (ছাঃ) আল্লাহর পক্ষ থেকে সমগ্র কুরআনের কথা বলতে আদিষ্ট হয়েছেন। তিনি আল্লাহর বাণী আল্লাহর বান্দাদের নিকটে পৌঁছে দিতেও আদিষ্ট হয়েছেন। কিন্তু দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ যেহেতু খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তাই মহান আল্লাহ তাঁর রাসূলকে স্বীয় উম্মতের মাঝে দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে বিশেষভাবে মনোযোগ দিতে আদেশ করেছেন। যেমন আল্লাহ বলেছেন, قُلْ لِلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ...، وَقُلْ لِلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ، ‘তুমি মুমিন পুরুষদের বলে দাও, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে অবনত রাখে।... আর তুমি মুমিন নারীদের বলে দাও, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে অবনত রাখে’ (নূর ২৪/৩০-৩১)। অনুরূপভাবে তিনি বলেছেন, قُلْ لَا أَقُولُ لَكُمْ عِنْدِي خَزَائِنُ اللهِ وَلَا أَعْلَمُ الْغَيْبَ ‘তুমি বলে দাও, আমি তোমাদের একথা বলি না যে, আমার কাছে আল্লাহর ধন-ভান্ডার আছে। আর আমি অদৃশ্যের খবর রাখি না’ (আন‘আম ৬/৫০)। এখানে গুরুত্বপূর্ণ কথা হ’ল যে, আল্লাহ তা‘আলা যখন মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে তার পক্ষ থেকে কোন কথা বলে দেওয়ার জন্য আদেশ জারী করেন তখন বিষয়টি যে সতর্ক যত্নের দাবীদার তা আমাদের খুব খেয়াল করতে হবে।
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে বলছেন, ‘এটাই আমার পথ’ এখানে ‘হা-যিহী’ বা ‘এটাই’ ইঙ্গিতকারী শব্দ। আর ইঙ্গিতকৃত বিষয় হচ্ছে আল্লাহর বাণী ‘আমি আল্লাহর দিকে ডাকি জেনে-বুঝে। আমি ডাকি এবং যারা আমার অনুসরণ করে তারা ডাকে’। অর্থাৎ নবী করীম (ছাঃ) এবং তাঁর অনুসারীগণের দায়িত্বই হচ্ছে যে, তারা জেনে-বুঝে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকবেন।
নবী করীম (ছাঃ) অন্য সকল নবী-রাসূলের মতই আল্লাহর দিকে দাওয়াত দানের এই সুমহান ও সুউচ্চ মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানের অধিকারী ছিলেন। তবে এ দাওয়াত হবে জেনে-বুঝে। না জেনে না বুঝে নয়। যে বিষয়ের প্রতি দাওয়াত দেওয়া হচ্ছে (যেমন ইসলাম নির্দেশিত আক্বীদা ও আমল) সে সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে-বুঝতে হবে; যাদের দাওয়াত দেওয়া হচ্ছে তাদের হাল-অবস্থা (যেমন ধর্ম, মন-মানসিকতা, সামাজিকতা ইত্যাদি) ভালোভাবে জানতে-বুঝতে হবে এবং দাওয়াত দানের পদ্ধতি, কৌশল ও রীতি সম্পর্কে জানতে-বুঝতে হবে। এই তিনটি জানা-বুঝা দাওয়াতী ক্ষেত্রে একান্তই যরূরী। তারা যে বিষয়ের দাওয়াত দিবে তা জানবে ও বুঝবে, যাদের দাওয়াত দিবে তাদের অবস্থা জানবে ও বুঝবে এবং দাওয়াতদানের পদ্ধতি জানবে ও বুঝবে। যখন এই তিনটি কাজ পূর্ণতা পাবে তখন সে দাওয়াত হবে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর দাওয়াত। যদি এর একটাতেও ঘাটতি থাকে তাহ’লে এ তিনটি বিষয় পূর্ণতা পেতে ততটুকুই ঘাটতি তৈরি হবে।
ব্যক্তিগত ইবাদত-বন্দেগীর সাথে দাওয়াত-তাবলীগের আবশ্যকতা :
উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা জেনে-বুঝে দাওয়াত দানের কথা বলেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি নবী করীম (ছাঃ)-এর অনুসরণ করবে তার শুধু বিশেষ কিছু ইবাদত যেমন ছালাত, যাকাত, ছিয়াম, হজ্জ, মাতা-পিতার খেদমত, আত্মীয়তার হক আদায় ইত্যাদি পালন করলেই হবে না; বরং তাকে জেনে-বুঝে আল্লাহর দিকে দাওয়াতদাতা হ’তে হবে। দাওয়াতের অবস্থা, দাওয়াতের কথা তাকে জানতে হবে। যাদের দাওয়াত দিবে তাদের অবস্থা জানতে-বুঝতে হবে এবং দাওয়াতী কাজ করতে হবে।
দাওয়াতদানের কৌশল :
মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ)-কে ইয়ামানে প্রেরণকালে নবী করীম (ছাঃ) বলেছিলেন, ‘তুমি শীঘ্রই আহলে কিতাবদের একটি কওমের মাঝে যাবে’।[1] তারপর তিনি আহলে কিতাবদের কীরূপ অবস্থা তা তাঁর সামনে তুলে ধরেন, যাতে তিনি সে মোতাবেক তাদের সাথে সাক্ষাতের প্রস্ত্ততি নিতে পারেন এবং প্রত্যেকটা লোককে তার মর্যাদা অনুসারে স্থান দিতে পারেন। সন্দেহ নেই যে, প্রতিটি মানুষই বিবেক সম্পন্ন। সে জানে, অজ্ঞ জাহেল মানুষকে দাওয়াত প্রদান আর একগুঁয়ে অহঙ্কারীকে দাওয়াত প্রদানের মাঝে তফাৎ কী। এ কারণেই আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَلَا تُجَادِلُوا أَهْلَ الْكِتَابِ إِلَّا بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِلَّا الَّذِينَ ظَلَمُوا مِنْهُمْ وَقُولُوا آمَنَّا بِالَّذِي أُنْزِلَ إِلَيْنَا وَأُنْزِلَ إِلَيْكُمْ وَإِلَهُنَا وَإِلَهُكُمْ وَاحِدٌ وَنَحْنُ لَهُ مُسْلِمُونَ، ‘তোমরা উত্তম পদ্ধতি অবলম্বন ব্যতীত গ্রন্থধারী আহলে কিতাবদের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়ো না। তবে তাদের মধ্যে যারা যালিম-সীমালঙ্ঘনকারী তাদের বিষয় আলাদা’ (আন‘কাবূত ২৯/৪৬)। সুতরাং যারা যালিম তাদের সাথে আমরা উত্তম পদ্ধতিতে বিতর্ক করতে যাব না, বরং তাদের অবস্থান ও যুলূম অনুসারে আমরা তাদের সাথে বিতর্ক করব।
দাঈকে অবশ্যই বিজ্ঞ হ’তে হবে দাওয়াতের পদ্ধতি সম্পর্কে এবং কিভাবে লোকদের দাওয়াত দিতে হবে সে সম্পর্কে। আসলে দাঈরা কিভাবে লোকদের দাওয়াত দিবে তা জানা তাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। লোকেরা বর্তমানে যে ধর্ম ও মতের উপর আছে তা বদলাতে তারা কি তাদের উপর বল ও চাপ প্রয়োগ এবং রূঢ় আচরণ করবে, নাকি বিনয়-নম্র বচনে সুন্দর আচরণের মাধ্যমে কাম্য বিষয়ে তাদের দাওয়াত দিবে? তাদের জীবন বিধান ও জীবন যাপন পদ্ধতি নিয়ে যাচ্ছেতাই গালাগালি করবে, নাকি তার কোন বদনাম না করে দাওয়াতী কাজ আঞ্জাম দিবে? আমরা মনোযোগ দিয়ে শুনি, মহান আল্লাহ তাঁর নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কেই শুধু নয়, বরং তার সকল বানদাকে, সকল মুমিনকে কী বলছেন,وَلَا تَسُبُّوا الَّذِيْنَ يَدْعُوْنَ مِنْ دُونِ اللهِ فَيَسُبُّوا اللهَ عَدْوًا بِغَيْرِ عِلْمٍ، ‘(হে বিশ্বাসীগণ!) তোমরা তাদের গালি দিয়োনা যারা আল্লাহকে ছেড়ে অন্যকে আহবান করে। তাহ’লে ওরা অজ্ঞতাবশে বাড়াবাড়ি করে আল্লাহকে গালি দিবে’ (আন‘আম ৬/১০৮)।
আমরা সবাই জানি, মুশরিক-মূর্তিপূজারীদের পূজ্য দেব-দেবীকে গালি দেওয়া একটি প্রত্যাশিত বিষয়। কেননা এসব দেব-দেবী বাতিল উপাস্য। যেমনটা আল্লাহ বলেছেন,ذَلِكَ بِأَنَّ اللهَ هُوَ الْحَقُّ وَأَنَّ مَا يَدْعُونَ مِنْ دُونِهِ هُوَ الْبَاطِلُ ‘এটা এ কারণেও যে, কেবলমাত্র আল্লাহই সত্য এবং তিনি ব্যতীত যাকে তারা ডাকে সবই মিথ্যা’ (হজ্জ ২২/৬২)।
বাতিলকে গালি দেওয়া এবং মানুষের সামনে বাতিলের অবস্থান তুলে ধরা একটি কাম্য বিষয়, যা একান্তই স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু তা করতে গেলে যখন বড় রকমের ক্ষতি দেখা দিবে, অথচ এই ক্ষতি এড়িয়েও বাতিল দূর করা সম্ভব তখন সেদিক লক্ষ্য করে আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, ‘ওরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদের ইবাদত-উপাসনা করে তোমরা তাদের গালি দিও না। নচেৎ ওরা শত্রুতা বশত কোন জ্ঞান-গরিমা ছাড়াই আল্লাহকে গালি দিবে’। এ কথা বিদিত যে, ওরা যখন আল্লাহকে গালি দিবে তখন সে গালি একান্তই শত্রুতা বশত নাহকভাবে দিবে। অথচ আমরা জানি, মহান আল্লাহ যাবতীয় দোষ-ত্রুটি থেকে পবিত্র। অপরদিকে আমরা যদি তাদের উপাস্য দেব-দেবীকে গালি দিতাম তবে তা হ’ত একান্তই হক ও ন্যায়সঙ্গত। তা সত্ত্বেও মহান আল্লাহ তা‘আলা এই বিদ্বেষপূর্ণ অন্যায় গালি তাদের মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ার আশঙ্কায় ঐ হক কাজ করতেই নিষেধ করলেন। কেননা যে কোন পক্ষ থেকেই হোক, আল্লাহ তা‘আলাকে গালি দেওয়া একটি জঘন্য অন্যায় কাজ।
এ সূত্র ধরেই একজন দাঈ তার দৃষ্টিতে যখন কাউকে কোন বাতিল ধর্মের কিংবা মতের উপর পাবে কিন্তু ঐ লোক তা হক বলে ধারণা করে সেক্ষেত্রে ঐ দাঈ তার ধর্ম ও মতের নিন্দা-মন্দ গেয়ে তাকে হক দ্বীন তথা ইসলামের পথে আনার চেষ্টা করবেন না। এটা আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক তার রাসূল মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে শেখানো দাওয়াতের পদ্ধতি নয়। এতে ঐ লোকটি দাঈর প্রতি বিতৃষ্ণাপরায়ণ ও অসহিষ্ণু হয়ে উঠবে। এমনকি ঐ লোকটি দাঈ যে হক দ্বীনের উপর আছে তা নিয়ে কটূক্তি ও গালাগালিও করতে পারে। কেননা দাঈ তো তার ধর্মকে গালমন্দ করেছে, যাকে সে হক জানে।
দাঈর কর্তব্য ও বোঝাপড়া :
এখানে দাঈ হিসাবে আমার পদ্ধতি হবে যে, আমি তার সামনে হক দ্বীন ও তার সত্যতা তুলে ধরব। হক দ্বীন কিভাবে হ’ল তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করব। কারণ অনেক মানুষের সামনেই সত্য ধর্মের আলো অনুদঘাটিত থেকে যায়। বিশেষ করে যারা কোন দল ও মতের অন্ধ অনুসারী। খেয়াল-খুশির তাড়না ও অন্ধ পরানুকরণ হেতু তারা হক ও সত্য ধর্মের দেখা পায় না। এজন্যই আমি বলছি, তার সামনে সত্য ধর্মের বর্ণনা করতে হবে, সত্য ধর্মকে স্পষ্ট করতে হবে। নির্মল নিষ্কলুষ স্বভাব সত্য ধর্ম গ্রহণে অবশ্যই আগুয়ান হবে। কারণ সত্য ধর্ম আল্লাহর দ্বীন এবং তার শরী‘আত। সুতরাং এ সত্য অবশ্যই প্রভাব ফেলবে। প্রভাব ফেলবে দাওয়াতপ্রাপ্ত ব্যক্তির উপর। আমি বলছি না যে, এ প্রভাব হবে তাৎক্ষণিক। কেননা এটা সময় বিশেষে জটিল রূপ নেয়। কিন্তু সময়ক্ষেপণ হ’লেও প্রভাব পড়বেই। কখনো কখনো দাওয়াতপ্রাপ্ত ব্যক্তি তাকে যে বিষয়ে দাওয়াত দেওয়া হচ্ছে তা নিয়ে বার বার চিন্তা-ভাবনা করতে থাকে। এভাবে তার সামনে হক স্পষ্ট রূপে ধরা দেয়। সুতরাং দাঈ যে বিষয়ে দাওয়াত দিচ্ছেন সে বিষয়ে ভালোভাবে জানাশোনা থাকা এবং যে পদ্ধতি মেনে দাওয়াতী কাজ করবেন সে সম্পর্কেও উত্তমরূপে জানাবোঝা থাকা তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
দাওয়াতপ্রাপ্ত ব্যক্তি দাওয়াত গ্রহণ করবে কি করবে না সে ক্ষেত্রে দাওয়াতদাতার আচরণের বিশেষ ভূমিকা আছে। নবী করীম (ছাঃ)-কে দেখুন, তিনি আল্লাহর পথে সর্বোত্তম উপায়ে কিভাবে দাওয়াত দিয়েছেন। আমরা মরুচারী সেই বেদুইনের কথা খুব ভালো করে জানি, যে মসজিদের এক কোণে গিয়ে পেশাব করছিল। ছাহাবীগণ তা দেখে তার প্রতি চিল্লিয়ে ওঠেন এবং পেশাব করতে নিষেধ করতে থাকেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তোমরা তাকে পেশাব করতে দাও, বাধা দিও না’।[2]
লোকটার পেশাব ফেরা শেষ হ’লে রাসূল (ছাঃ) নাপাকী দূর করার জন্য ঐ পেশাবের স্থানে এক বালতি পানি ঢেলে দিতে আদেশ দিলেন। তারপর তিনি তাকে কাছে ডেকে বললেন, দেখ, মসজিদে পেশাব করা, নোংরা করা সমীচীন নয়। মসজিদ কেবলই আল্লাহর যিকির, ছালাত আদায় এবং কুরআন অধ্যয়নের জন্য’।[3]
পাঠক! ন্যায়ের পথে দাওয়াতের এ রীতি ও পদ্ধতি একটু চিন্তা করুন। এভাবে কোমল ও শান্ত মেজাযে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মসজিদের মর্যাদা বজায় রাখতে বেদুইন লোকটাকে যে আহবান জানালেন তাতে আপনি এ কথা না ভেবে পারবেন না যে, ঐ বেদুইন অবশ্যই তাঁর কথা মান্য করবে, তৃপ্তি বোধ করবে, আরাম পাবে এবং ছাহাবায়ে কেরামের উত্তেজিত হয়ে ওঠা এবং আল্লাহর রাসূলের শান্তভাবে শিক্ষাদানের মধ্যে তফাৎটা ধরতে পারবে, যে শিক্ষায় মন উদার হয়, হৃদয় তৃপ্তিতে ভরে ওঠে।
দাঈর আমল-আখলাক :
দাঈ অবশ্যই প্রথমে নিজের দেহে ও আখলাকে সেই হকের প্রতিফলন ঘটাবেন, যার প্রতি তিনি লোকদের দাওয়াত দিবেন। কেননা যে হকের দাওয়াত তিনি দিচ্ছেন, তিনি নিজেই যদি তার বিরোধিতা করেন তবে তার থেকে চূড়ান্ত আহম্মকি আর কিছু হ’তে পারে না। আর যদি তিনি কোন ভ্রান্ত ও মন্দ বিষয়ের দিকে দাওয়াত দেন তবে মানুষকে ভ্রান্ত ও মন্দ বিষয়ের দিকে দাওয়াত দেওয়া তো আরও জঘন্য ঘৃণ্য। অতএব দাঈর চাল-চলন যখন তার দাওয়াতের বিপরীত হবে তখন সে দাওয়াত যে লোকের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না তাতে কোন সন্দেহ নেই। মানুষ অন্য সকলকে যে দৃষ্টিতে দেখে দাঈদের তার থেকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখে। যখন তারা দেখে, দাঈ যে বিষয়ের দাওয়াত দিচ্ছেন, তিনি নিজেই তা পালন করছেন না তখন তাদের মনে দাওয়াতী বিষয়ে সন্দেহ জাগবে, তা হক, না বাতিল? দাওয়াতপ্রাপ্ত লোকেরা বলবে, দাওয়াতী বিষয় হক হ’লে তিনি কেন করছেন না। এভাবে জনগণের মাঝে তার গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পাবে। একই সাথে লোকেদের দাওয়াত দিয়ে দাওয়াতী বিষয় থেকে নিজেকে দূরে রাখার দরুন সে পাপীও হবে। বনী ইসরাঈলের ইহুদীরা এমন আচরণ করেছিল বিধায় আল্লাহ তা‘আলা তাদের এ কাজকে নিন্দা জানিয়ে বলেছেন,أَتَأْمُرُوْنَ النَّاسَ بِالْبِرِّ وَتَنْسَوْنَ أَنْفُسَكُمْ وَأَنْتُمْ تَتْلُوْنَ الْكِتَابَ أَفَلَا تَعْقِلُوْنَ، ‘তোমরা কি লোকদের সৎকাজের আদেশ দাও এবং নিজেদের বেলায় তা ভুলে যাও? অথচ তোমরা আল্লাহর কিতাব (তাওরাত) পাঠ করে থাকো। তোমরা কি বুঝ না?’ (বাক্বারাহ ২/৪৪)।
একজন মানুষ অন্যদের সৎকাজের আদেশ দিবে আর নিজে সে সৎকাজ করবে না, তা কখনো বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক হ’তে পারে না। দাওয়াতী কাজ যদি সত্যিই ভাল হয় তাহ’লে তো প্রথমেই দাওয়াতদাতা তা কার্যকর করবেন এবং তিনি তা আমলে নিবেন। এতে করে তিনি কথায় ও কাজে মানুষের দাওয়াতদাতা হবেন।
দাঈকে যা জানতে হবে :
দাওয়াতদাতার জন্য স্বীয় দাওয়াতী বিষয় সম্পর্কে ভালোভাবে জানা-বুঝা ও ওয়াকিফহাল থাকা যরূরী। তিনি যেটাকে হক বলে জানেন, কিংবা তার জোর ধারণা আছে যে, এটি হক ও সত্য তিনি কেবল সে বিষয়েই দাওয়াত দিবেন। জোর ধারণাও কেবল সেক্ষেত্রে সিদ্ধ যেখানে ধারণা করার অবকাশ আছে। যে বিষয় তিনি জানেন না সে সম্পর্কে দাওয়াত দিলে তাতে গড়ার থেকে ভাঙাই বরং বেশী হবে। একই সাথে তিনি বড় গুনাহেরও ভাগী হবেন। মহান আল্লাহ বলেন,وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولَئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُولًا، ‘যে বিষয়ে তোমার নিশ্চিত জ্ঞান নেই, তার পিছনে ছুটো না। নিশ্চয়ই তোমার কর্ণ, চক্ষু ও হৃদয় প্রতিটিই জিজ্ঞাসিত হবে’ (বনী ইসরাঈল ১৭/৩৬)। তুমি এমন কিছুর পিছু নিয়ো না যার সম্বন্ধে তোমার জ্ঞান নেই। কারণ তুমি জিজ্ঞাসিত হবে। আল্লাহ আরও বলেন,قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَالْإِثْمَ وَالْبَغْيَ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَأَنْ تُشْرِكُوْا بِاللهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ سُلْطَانًا وَأَنْ تَقُولُوْا عَلَى اللهِ مَا لَا تَعْلَمُوْنَ، ‘তুমি বল, নিশ্চয়ই আমার প্রতিপালক প্রকাশ্য ও গোপন সকল প্রকার অশ্লীলতা হারাম করেছেন এবং হারাম করেছেন সকল প্রকার পাপ ও অন্যায় বাড়াবাড়িকে। আর তোমরা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করো না যে বিষয়ে তিনি কোন প্রমাণ নাযিল করেননি এবং আল্লাহ সম্বন্ধে এমন কথা বল না, যে বিষয়ে তোমরা কিছু জান না’ (আ‘রাফ ৭/৩৩)।
না জেনে-বুঝে দাওয়াতদানের পরিণাম :
আমরা কিছু দাঈকে দেখি, যারা তাদের দাওয়াতী বিষয়ে সঠিক অবস্থান থেকে অনেক দূরে। তারা যে জেনে-শুনে এবং স্বেচ্ছায় এ দাওয়াত দিচ্ছেন না, বরং অজ্ঞতাবশে দিচ্ছেন তা আমাদের জানা অথবা এ বিষয়ে আমরা জোর ধারণা পোষণ করি। এতে দু’টি বড় রকমের ক্ষতি দেখা দিচ্ছে।
প্রথম ক্ষতি : দলীল-প্রমাণ ছাড়াই দাঈর বাতিল দাওয়াত গ্রহণ করে নেওয়া।
দ্বিতীয় ক্ষতি : দলীল-প্রমাণের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হক রদ হয়ে যাওয়া।
যেমন- আমরা কিছু লোককে দেখি ও শুনি ‘তারা এমন অনেক জিনিস হারাম বলে থাকে, যার সপক্ষে তাদের কাছে কোন প্রমাণ নেই। অনুরূপভাবে তারা এমন অনেক জিনিস ফরয বলে থাকে যার সপক্ষে তাদের কাছে কোন প্রমাণ নেই। লোকেরা এ ধরনের দাঈদের প্রতি সুধারণা রাখে। ফলে তারা অন্যদের বর্ণিত হক কথা প্রত্যাখ্যান করে এদের বাতিল কথা মেনে নেয়। উদাহরণ স্বরূপ আমরা কোন কোন দাঈকে বলতে শুনেছি, ‘রেকর্ডিং যন্ত্রের ব্যবহার জায়েয নেই’। যদি বলা হয় কেন? উত্তরে তারা বলে, ‘এ যন্ত্র নবী করীম (ছাঃ)-এর যুগে ছিল না’। এটা কি কোন দলীল হ’ল? এ কথা দ্বারা দলীল দেওয়ার কোন ছূরত আছে কি?
প্রত্যুত্তরে বলব, এ কথা দ্বারা দলীল দেওয়ার কোনই ছূরাত নেই। কেননা রেকর্ডিং যন্ত্র ইবাদতগত কোন বিষয় নয়। ইবাদতের বিষয় হ’লে আমরা হয়তো বলতাম, এটার পক্ষে শারঈ কোন প্রমাণ নেই, সুতরাং এটি প্রত্যাখ্যাত। বরং রেকর্ডিং যন্ত্র তো মূল সূত্র অনুসারে মুবাহ মাধ্যমের আওতাভুক্ত। মূলনীতি অনুসারে ইবাদত-বন্দেগী ছাড়া সকল বস্ত্তই মুবাহ বলে বিবেচিত, যতক্ষণ না তার বিপক্ষে কোন নিষেধাজ্ঞা পাওয়া যাবে।
ইবাদত ব্যতীত সকল কিছুই মূলতঃ হালাল। তবে এসব বস্ত্ত ব্যবহার গুণে হালাল-হারাম হ’তে পারে। যদি তা বিধিসম্মত কাজের সহায়ক হয়, তবে তা হবে হালাল। আর যদি কোন অবৈধ কাজের সহায়ক হয় তবে তা হবে হারাম। তাই যে রেকর্ডিং যন্ত্রের কথা বলা হয়েছে তাতে যদি ভালো কথা রেকর্ড করা হয়, তবে নিঃসন্দেহে তা হবে উত্তম। আর যদি মন্দ কথা রেকর্ড করা হয়, তবে তা হবে নিকৃষ্ট কিছু। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যুগে ছাহাবায়ে কেরাম কুরআন লিখিতভাবে রেকর্ড রাখতেন। এই লেখালেখি একটি মাধ্যম। বর্তমান যুগে আমরা লেখার মাধ্যমে সংরক্ষণ করি, আবার শব্দ রেকর্ড করার মাধ্যমেও সংরক্ষণ করি। এই শব্দ রেকর্ডিং আমাদের উপর আল্লাহর এক বড় অনুগ্রহ বলেই আমি বিবেচনা করি। কত বিদ্যা যে এর মাধ্যমে সংরক্ষণ করা হচ্ছে! আর কত শ্রোতা যে তার দ্বারা উপকৃত হচ্ছে! একজন দাঈ সেক্ষেত্রে কিভাবে বলতে পারেন যে, রেকর্ডিং যন্ত্র একটি অবৈধ ও বিদ‘আত জিনিস? কিভাবেই তিনি বলতে পারেন, এটাতো রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যুগে ছিল না? যদি আমরা তার পথ ও মতে চলি তবে আমরা এমন অনেক কিছুই বাতিলের খাতায় জমা করব যাতে স্পষ্টতই মুসলিমদের কল্যাণ রয়েছে। এ রকম উদাহরণ প্রচুর। আমি বিষয়টা আর দীর্ঘায়িত করতে চাই না। তবে আমি এ কথায় জোর দিতে চাচ্ছি যে, দাঈকে অবশ্যই আল্লাহর দ্বীন সম্পর্কে ভালো জ্ঞানী হ’তে হবে। যাতে তিনি নিজের অজান্তে নিষিদ্ধ বিষয়ের দাওয়াত না দিয়ে বসেন, কিংবা অজ্ঞতাবশত বৈধ বিষয় পালন করতে নিষেধ না করেন।
হে দাঈ! আপনি আজ যে বিষয়ে না জেনে না বুঝে দাওয়াত দিচ্ছেন তা যদি মুলতবী রেখে আগামীকাল দলীল-প্রমাণ জেনে-বুঝে সে দাওয়াত দেন তবে তা অনেক ভালো হবে। দাঈর জন্য তার দাওয়াতী বিষয়াদির জ্ঞান অর্জন, যাদের দাওয়াত দেওয়া হচ্ছে তাদের হাল-হাকীকত জানা এবং দাওয়াত দানের কৌশলাদি রপ্ত করা নিতান্তই সাধারণ কথা। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সকল প্রশংসা মহান আল্লাহর।
দাওয়াতের পথে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা :
দাঈর জন্য দাওয়াতের পথে ধৈর্যশীল ও সহিষ্ণু থাকা ফরয। এ পথে তিনি কথায় ও কাজে পীড়নের শিকার হ’তে পারেন, তাকে দৈহিক ও মানসিকভাবে অত্যাচার ও কষ্ট দেওয়া হ’তে পারে, তিনি আর্থিক ও বৈষয়িক ক্ষতিতে পড়তে পারেন। এসব ক্ষেত্রে তিনি অবশ্যই অটল-অবিচল থাকবেন। সাধারণত দেখা যায়, কল্যাণের পথে দাওয়াতদাতার প্রতিপক্ষ দাঁড়িয়ে যায়। তার দাওয়াতী কাজকে তারা ঘৃণা ও অপসন্দ করে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,وَكَذَلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوًّا مِنَ الْمُجْرِمِيْنَ وَكَفَى بِرَبِّكَ هَادِيًا وَنَصِيْرًا، ‘এভাবেই আমরা প্রত্যেক নবীর জন্য অপরাধীদের মধ্য থেকে শত্রু নির্ধারণ করেছি। আর তোমার জন্য পথপ্রদর্শক ও সাহায্যকারী হিসাবে তোমার পালনকর্তাই যথেষ্ট’ (ফুরক্বান ২৫/৩১)।
প্রত্যেক নবীর জন্যই কোন না কোন পাপাচারী শত্রু ছিল। এ শত্রুতা তাঁদের ব্যক্তিগত কারণে নয়, বরং নবুঅতের কারণে। এজন্যেই দেখা যায়, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যেখানে নবুঅত ও রিসালাত লাভের আগে কুরাইশদের মাঝে ছাদিক (সত্যবাদী) ও আল-আমীন (বিশ্বস্ত) নামে পরিচিত ছিলেন, সেখানে নবুঅত লাভের পর তিনি তাদের কাছে হয়ে উঠলেন মহামিথ্যুক, যাদুকর, কবি, গণক, পাগল ইত্যাদি নানা কুৎসিত অভিধায় আখ্যায়িত একজন নিন্দিত মানুষ। আল্লাহ বলেন, ‘এভাবেই আমরা প্রত্যেক নবীর জন্য অপরাধীদের মধ্য থেকে শত্রু নির্ধারণ করেছি’ (ফুরক্বান ২৫/৩১)।
কেন এ শত্রুতা? এ কি তাঁর ব্যক্তিসত্তার কারণে, নাকি নবুঅতের কারণে? বরং নবুঅতেরই কারণে। সুতরাং যে-ই নবীর পথ ও কার্যক্রম ধরে চলবে পাপাচারীদের মধ্য থেকে তার শত্রু হ’তেই হবে। আর যখন কেউ তার শত্রু হবে তখন সে কথায়-কাজে সাধ্যমতো তাকে কষ্ট দিতে কোন ত্রুটি করবে না। দাঈকে এক্ষেত্রে ছবর করতে হবে, ছওয়াবের আশা রাখতে হবে, আল্লাহর সাহায্যের প্রত্যাশা করতে হবে এবং ভবিষ্যতে প্রশংসনীয় পরিণাম কামনা করতে হবে।
ব্যক্তিস্বার্থে নয় বরং আল্লাহর জন্য দাওয়াত : ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা লাভের জন্য দাওয়াত দেওয়া দাঈর জন্য সমীচীন হবে না, তাকে অবশ্যই আল্লাহর খাতিরে আল্লাহর পথে আসার জন্য দাওয়াত দিতে হবে। তিনি দাওয়াতের কাজে বিজয় লাভ করছেন কি-না, তার প্রদত্ত দাওয়াত তার জীবদ্দশায় জনসমাজে গৃহীত হচ্ছে কি-না এসব নিয়ে তিনি মোটেও চিন্তান্বিত হবেন না। বরং তিনি যে হকের প্রতি দাওয়াত দিচ্ছেন তা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। চাই তা তার জীবদ্দশায় হোক, কিংবা তার মৃত্যুর পরে হোক। এটা ঠিক যে, মানুষ তার প্রচারিত সত্যকে নিজের জীবদ্দশায় বিজয়ী হ’তে দেখলে খুশি হয় এবং তৃপ্তিবোধ করে। কিন্তু আল্লাহর পরিকল্পনা ভিন্ন রকম হ’তে পারে। এ পথে তার কতটুকু ধৈর্য আছে কিংবা নাই তা তিনি পরীক্ষা করতে পারেন। তাৎক্ষণিক ও জীবদ্দশায় তার প্রচারিত সত্য জনমনে গৃহীত না হওয়ার মাধ্যমেও আল্লাহ তাকে পরীক্ষা করতে পারেন। তাকে ধৈর্য ধরতে হবে এবং যে সত্যকে তিনি হক বলে জানেন তার উপর অটল থাকতে বদ্ধপরিকর থাকতে হবে এবং শেষ পরিণাম যে তার পক্ষে যাবে সেই ইয়াকীন পোষণ করতে হবে।
দ্বীনের সত্যতা নিয়ে দাঈ সন্দেহে পতিত হবেন না : কিছু দাঈকে দেখা যায়, তারা যখন এমন কোন কথা শুনতে পান, যা তাদের কষ্ট দেয় অথবা তাদেরকে জড়িয়ে এমন কোন কাজ সংঘটিত হ’তে দেখেন, যা তাদের পীড়া দেয় তখন তারা ঘাবড়িয়ে যান, দ্বিধাদ্বন্দ্বে পতিত হন কিংবা তাদের লালিত আদর্শ হক কি-না তা নিয়ে সন্দেহে পতিত হয়ে পড়েন। এমন দাঈরা মূলতঃ ব্যর্থ।
আল্লাহ তা‘আলা তো তার নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে এমন সন্দেহ হ’তে কড়াভাবে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন,فَإِنْ كُنْتَ فِي شَكٍّ مِمَّا أَنْزَلْنَا إِلَيْكَ فَاسْأَلِ الَّذِينَ يَقْرَءُوْنَ الْكِتَابَ مِنْ قَبْلِكَ لَقَدْ جَاءَكَ الْحَقُّ مِنْ رَبِّكَ فَلَا تَكُوْنَنَّ مِنَ الْمُمْتَرِيْنَ، ‘অতঃপর যদি তুমি সন্দেহে পতিত হও যা আমরা তোমার প্রতি নাযিল করেছি, তাহ’লে তুমি তাদেরকে জিজ্ঞেস কর যারা তোমার পূর্বেকার কিতাব পাঠ করে। নিঃসন্দেহে তোমার নিকট তোমার প্রভুর পক্ষ হ’তে এসে গেছে সত্য কিতাব। অতএব তুমি কখনোই সংশয়বাদীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না’ (ইউনুস ১০/৯৪)।
দাঈ তার দাওয়াতকে জনগণ কর্তৃক তাৎক্ষণিকভাবে গ্রহণ করতে দেখতে না পেলে অনেক সময় হতাশ হয়ে দাওয়াতের কাজ থেকে সরে দাঁড়ান। তার মনে প্রশ্ন দোলা দিতে থাকে, তিনি কি সত্যের উপর আছেন, না কি নাই? কিন্তু সত্য তো এই যে, আল্লাহ তা‘আলা যা হক, তার বিবরণ তুলে ধরেছেন, হকের একটি সুবিদিত বাতিঘর করে দিয়েছেন।
সুতরাং হে দাঈ, আপনি যখন জানবেন যে, আপনি হকের উপর আছেন তখন তাতে দৃঢ় ও অবিচল থাকুন। আপনার কানে কটূ ও অপসন্দনীয় যত কথাই এসে বাজুক, আর চোখের সামনে অসহনীয় যত দৃশ্যই দেখা দিক, আপনি ধৈর্য ধরে থাকুন। শেষ হাসি মুত্তাক্বীদের জন্যই।
দাওয়াতী কাজে দাঈদের পারস্পরিক সহযোগিতা : দাওয়াতী কাজে দাঈদের পারস্পরিক সহযোগিতা করা দাওয়াতের একটি আবশ্যিক আদব। কোন দাঈ যেন ‘একলা চলো’ নীতি অবলম্বন না করেন। শুধু তার কথাই লোকেরা মানবে, তার কথাই সবার আগে থাকবে, এমন চিন্তা যেন তাকে পেয়ে না বসে। বরং দাওয়াত কবুল হওয়াই হবে দাঈদের একমাত্র ফিকির। চাই সে দাওয়াত তিনি দিন অথবা অন্যে দিক। হে দাঈ ভাই। আল্লাহর বাণী বুলন্দ করার চিন্তা যতক্ষণ আপনার চেতনা জুড়ে থাকবে ততক্ষণ সে বাণী আপনার পক্ষ থেকে বুলন্দ হ’ল না অন্যের পক্ষ থেকে বুলন্দ হ’ল তা নিয়ে আপনার বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। এটা ঠিক যে, মানুষ তার হাত দিয়ে কল্যাণ সাধনকে ভালোবাসে। কিন্তু অন্যের হাত দিয়ে কল্যাণ হওয়াকে অপসন্দ করা তার জন্যে উচিত নয়। বরং তার জন্য আল্লাহর দ্বীন সমুন্নত হওয়াই বড় কথা। কার হাত দিয়ে তা সমুন্নত হ’ল তা বড় কথা নয়। দাঈ তার দাওয়াতী কাজ যখন আমাদের এ কথার ভিত্তিতে করবেন তখন তিনি আল্লাহর পথে দাওয়াত দানে অন্য দাঈদের সাহায্যে অচিরেই এগিয়ে আসবেন। তাতে লোকেরা তার দাওয়াত গ্রহণের আগে অন্যদের দাওয়াত কবুল করলেও তিনি নাখোশ হবেন না।
দাঈগণ সবাই মিলে এক জোট হবেন। তারা একে অপরকে সাহায্য করবেন, সহযোগিতা করবেন, পরস্পরে সলা-পরামর্শ করবেন। সবাই এক পথের পথিক হবেন। আল্লাহর পথে দু’জন দু’জন, তিন জন তিন জন এবং চার জন চার জন করে দাঁড়িয়ে যাবেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,قُلْ إِنَّمَا أَعِظُكُمْ بِوَاحِدَةٍ أَنْ تَقُومُوا لِلَّهِ مَثْنَى وَفُرَادَى، ‘তুমি বল, আমি তোমাদেরকে একটি বিষয়ে উপদেশ দিচ্ছি, তা এই যে, তোমরা আল্লাহর জন্য দু’দু’জন বা এক একজন করে দাঁড়িয়ে যাও’ (সাবা ৩৪/৪৬)।
আমরা তো দেখি অকল্যাণ ও খারাপ পথের দাওয়াতদাতারা সবাই একাট্টা, একজোট ও একমত। সেখানে আল্লাহর পথের দাঈরা কেন ঐক্যের এ আমলে আগুয়ান হবেন না? দাওয়াতের পথে কে কোথায় বিদ্যা-বুদ্ধিতে ভুল করছেন, দাওয়াতের পদ্ধতিতে ত্রুটি করছেন, কেন তারা ভালোবেসে একে অপরকে বলবেন না? আমরা যখন কুরআন ও সুন্নাহর বাণীর দিকে তাকাই তখন আমরা তো দেখি আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের এমন সব গুণ তুলে ধরেছেন যাতে প্রতীয়মান হয়, তারা একতাবদ্ধ এবং একে অপরকে সাহায্যকারী। তিনি বলেন,وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوْفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُقِيْمُوْنَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَيُطِيعُونَ اللهَ وَرَسُوْلَهُ أُولَئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللهُ إِنَّ اللهَ عَزِيزٌ حَكِيْمٌ، ‘আর মুমিন পুরুষ ও নারীগণ পরস্পরের বন্ধু। তারা সৎকাজের আদেশ দেয় ও অসৎ কাজে নিষেধ করে। তারা ছালাত কায়েম করে ও যাকাত আদায় করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে। এসব লোকের প্রতি আল্লাহ অবশ্যই অনুগ্রহ বর্ষণ করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাবান’ (তওবা ৯/৭১)।
তিনি আরও বলেন,وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ، وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ تَفَرَّقُوا وَاخْتَلَفُوا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَأُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ، ‘আর তোমাদের মধ্যে একটা দল থাকা আবশ্যক, যারা মানুষকে কল্যাণের দিকে আহবান করবে ও অন্যায় থেকে নিষেধ করবে। বস্ত্ততঃ তারাই হ’ল সফলকাম। তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা পরস্পরে বিচ্ছিন্ন হয়েছে এবং স্পষ্ট প্রমাণাদি এসে যাওয়ার পরেও তাতে মতভেদ করেছে। এদের জন্য রয়েছে ভয়ংকর শাস্তি’ (আলে ইমরান ৩/১০৪-১০৫)।
সহযোগিতা না করে উল্টো দাঈদের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষের কুফল : শয়তান চায়- একজন দাঈ তার মত আরেকজন দাঈকে দাওয়াতের ময়দানে সফল হ’তে দেখে হিংসাকাতর হোক। হিংসাপরায়ণ দাঈ তার মত দাওয়াতে সফল হ’তে আগ্রহী নন, বরং ঐ দাঈ যে তার থেকে এগিয়ে গেল এবং লোকেরা তার দাওয়াতে সাড়া দিল এটাই তার হিংসার কারণ। এ কারণে শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) হিংসার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘আল্লাহর অনুগ্রহ তোমার উপর না হয়ে অন্যের উপর হওয়ায় তুমি যে অসন্তুষ্ট হ’লে তারই নাম হিংসা। যদিও জ্ঞানীদের মাঝে প্রসিদ্ধি আছে যে, অন্যের প্রাপ্ত অনুগ্রহ তার থেকে অপসৃত হোক, মনে-প্রাণে এমন কামনা-বাসনা পোষণের নাম হিংসা। তাই আমরা বলি, ‘তোমাকে বাদ দিয়ে অন্যের উপর আল্লাহর অনুগ্রহ করাতেই তুমি নাখোশ হচ্ছ, তোমার এহেন মানসিকতার নামই হিংসা; চাই তুমি সে অনুগ্রহের ক্ষয়-লয় কামনা কর কিংবা না কর’।
সুতরাং হে মানুষ! তোমার দাঈ ভাইকে তার দাওয়াতী কাজে সাহায্য-সহযোগিতা করা তোমার উপর অবশ্য কর্তব্য। এমনকি সেই দাওয়াতদাতা ভাই দাওয়াতী লাইনে তোমার থেকে এগিয়ে থাকলেও এবং তাতে অপেক্ষাকৃত বেশী সফল হ’লেও তুমি তার সহযোগিতা করতে পিছপা হবে না, যতক্ষণ আল্লাহর এ যমীনে আল্লাহর বাণী সব কিছুর ঊর্ধ্বে স্থান লাভ তোমার চাওয়া-পাওয়া হবে।
আমার ভাইয়েরা, যারা মন্দ ও খারাপ কাজের দাওয়াত দেয় ওরা তো ভালো ও কল্যাণমুখী কাজের দাঈদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিভেদই চায়। ওরা জানে, মঙ্গল পথের দাঈদের মধ্যে ঐক্য ও সহযোগিতা তাদের জন্য সফলতা বয়ে আনবে। পক্ষান্তরে অনৈক্য ও অসহযোগিতা তাদের ব্যর্থতা ও অসফলতা নিশ্চিত করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَأَطِيعُوا اللهَ وَرَسُولَهُ وَلَا تَنَازَعُوا فَتَفْشَلُوا وَتَذْهَبَ رِيحُكُمْ وَاصْبِرُوا إِنَّ اللهَ مَعَ الصَّابِرِينَ، ‘তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর। আপোষে ঝগড়া করো না। তাহ’লে তোমরা শক্তিহীন হবে ও তোমাদের প্রতিপত্তি উবে যাবে। তোমরা ধৈর্যধারণ কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে থাকেন’ (আনফাল ৮/৪৬)।
সন্দেহ নেই যে, আমাদের প্রত্যেকেই ভুল-ভ্রান্তির আওতাভুক্ত। সুতরাং আমরা যখন আমাদের কারও থেকে ভুল কোন কিছু হ’তে দেখব তখন আমাদের কর্তব্য হবে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে ভুল শুধরিয়ে দেওয়া, কোথায় কিভাবে ভুল হচ্ছে তা বুঝিয়ে দেওয়া। অনেক সময় এমনও হ’তে পারে যে, আমাদের ধারণায় কাজটা ভুল, কিন্তু বাস্তবে তা ভুল নয়। তখন সেই ভাইটাই আমাদের ধারণায় যে ভুল হয়েছে তা বুঝিয়ে দিবেন। কারও ভুলের দরুন তাকে নিন্দা-মন্দ করা, তার প্রতি ঘৃণা ছড়ান যেখানে কোন মুমিনের জন্যই শোভনীয় হ’তে পারে না সেখানে আল্লাহর পথের একজন দাঈর জন্য তো তা মোটেও সমীচীন হ’তে পারে না।
কিছু দাঈর ভুল মানসিকতা : এদিকে নিকট অতীতে বেশ কিছু বছর ধরে অনেক যুবক আল্লাহর পথে দাওয়াতী কাজে সঠিক ভূমিকা পালন করে চলেছেন, ফালিল্লাহিল হাম্দ। কিন্তু দুঃখজনক হ’লেও সত্য যে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে গলতিও হচ্ছে। কোন কোন যুবককে দেখা যাচ্ছে, তিনি এককভাবে চলছেন। তিনি অন্যদের মতামতের কোন তোয়াক্কা করছেন না। নিজের জ্ঞান-গরিমা ও চিন্তা-ভাবনার উপর তিনি খুবই আত্মতুষ্ট। যদিও জ্ঞানের ক্ষেত্রে তার অজ্ঞতা এবং চিন্তার মধ্যে ভুলের পরিমাণ নেহায়েত কম নয়। তথাপি তিনি অন্যদের তুচ্ছ ভাবতে কম করেন না। তাদের কাছে যে হক আছে সেদিকে একটু ফিরেও দেখেন না। এমনকি তার সামনে যদি মুসলিম সমাজের এমন কোন গণ্যমান্য ইমামের নাম উচ্চারণ করা হয় যাঁর জ্ঞান-গরিমা, ধার্মিকতা ও আমানতদারী সর্বজন স্বীকৃত তখন তিনি বলেন, ইনি আবার কে? ইনিও পুরুষ আমিও পুরুষ। অথচ তার পৌরুষ যে স্বল্প জানাবুঝা ও স্বল্প বিদ্যাভিত্তিক তাও সত্য। উদাহরণ স্বরূপ তিনি কোন একটা বিষয়ের নানাদিকের দলীল-প্রমাণ একত্র করে ঘাঁটাঘাঁটি না করে বরং তার পসন্দমতো একটা দলীল নেন এবং তার ভিত্তিতে নিজের মত প্রকাশ করতে থাকেন। বিশেষ করে যদি সে দলীল দ্বারা বিরল কোন বিধান সাব্যস্ত হয় তাহ’লে তিনি তা স্বাচ্ছন্দ্যে লুফে নেন এবং অন্য সব দলীল পাশ কাটিয়ে যান। সঠিক দলীলের দিকে ফিরে আসার কোনই গরজবোধ করেন না। দৃষ্টান্ত স্বরূপ যখন তাকে বলা হয়, ভাই, আপনার গৃহীত মত পুনর্বিবেচনা করুন; এতদসংক্রান্ত সকল দলীল-প্রমাণ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করুন এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেমদের মতামত যে আপনার মতের বিরুদ্ধে তাও খেয়াল করুন, তখন তিনি এ কথায় একটুও কর্ণপাত করেন না। অধিকন্তু দাওয়াতের ময়দানে কর্মরত অন্যান্য কর্মী ভাইয়েরা যখন তার মতের বিপরীত মত প্রকাশ করেন তখন তিনি তাদের মতকে বাতিল এবং নিজের মতকে হক দাবী করতে থাকেন, যেন তার কাছে এ সম্পর্কে অহী এসেছে।
সন্দেহ নেই যে, দাওয়াতের এ মানহাজ বা পদ্ধতি সঠিক নয়। ইজতিহাদী বা গবেষণাযোগ্য বিষয়ে ‘আমিই সঠিক এবং অন্যেরা ভুলের উপর আছে’ এমন বিশ্বাস পোষণ করা কারো জন্যই বৈধ নয়। এমন আক্বীদা পোষণ করলে দাঈ নিজেকে যেন নবুঅত ও রিসালাতের পদাধিকারী গণ্য করছেন, যিনি নিষ্পাপ। অথচ তা কখনই হ’তে পারে না। সুতরাং হে যুবক! ভুল যেমন আপনার বাদে অন্যের হ’তে পারে তেমনি আপনারও হ’তে পারে। আর যে নির্ভুলতার দাবী আপনি নিজের জন্য করছেন, অন্যেও তা দাবী করতে পারে। এমনও হ’তে পারে যে, আপনার বিপক্ষে যিনি আছেন তিনিই সঠিক এবং আপনি আছেন ভুলের উপর।
কিন্তু দাওয়াতের এহেন ভুল পদ্ধতিতে কাজ করতে দেখা যায় অনেক যুবককে। তারা একটা গ্রুপের সাথে ভিড়ে যায় কিংবা নির্দিষ্ট কোন আলেমের অনুসারী সাজে। তাকেই সাহায্য-সহযোগিতা করে এবং তার কথাই শিরোধার্য করে নেয়, চাই তা ভুল হোক কিংবা ঠিক হোক। বাস্তবে এমন ধারার কাজকর্ম ও আচরণ উম্মতের মধ্যে বিভেদ ডেকে আনছে এবং উম্মতের শক্তি-সাহস দুর্বল করে দিচ্ছে। আল্লাহর পথে আগমনকারী এসব যুবক পরিণামে মন্দ ও খারাপ পথের পথিকদের ঠাট্টা-তামাশার পাত্রে পরিণত হচ্ছে।
আমাদের করণীয় : এক্ষেত্রে আমাদের করণীয় হবে আল্লাহ যেরূপ আদেশ করেছেন তেমনটা হওয়া। আমরা বরং ঠিক তেমন গুণাবলীর অধিকারী হব যেমনটা আল্লাহ তা‘আলা আমাদের জন্য উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন,إِنَّ هَذِهِ أُمَّتُكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً ‘এরা সবাই তোমাদের একই উম্মতভুক্ত’ (আম্বিয়া ২১/৯২)। আমাদের কথা হবে এক। আমি বলছি না যে, আমাদের কথা এক হওয়া মানে যেখানে মতভেদের অবকাশ আছে সেখানেও আমাদের মতান্তর হবে না। এমনটা হওয়া আদৌ সম্ভব নয়। কিন্তু আমি বলতে চাচ্ছি, যেখানে মতভেদের অবকাশ আছে সেখানকার মতান্তর যেন আমাদের মনান্তরে রূপ না নেয়। বরং আমাদের অন্তরগুলো একতাবদ্ধ থাকবে, আমাদের মাঝে বন্ধুত্ব বজায় থাকবে এবং পরস্পরে মিল মহববত অটুট থাকবে, ইজতিহাদী বিষয়ে আমরা যতই মতানৈক্য করি না কেন।
এখানে উদাহরণ হিসাবে একটা মাসআলা তুলে ধরা যাক। মাসআলাটি ইসলামের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের তুলনায় অনেকটাই লঘু। আপনারা অনেকেই জানেন, ছালাতের প্রথম ও তৃতীয় রাক‘আতে উঠে দাঁড়ানোর মুহূর্তে বসার একটি বিষয় রয়েছে। কিছু আলেম মনে করেন এ বসা সুন্নাত এবং কিছু আলেম মনে করেন এ বসা সুন্নাত নয়। আবার কিছু আলেম বিষয়টি এড়িয়ে চলেন। এ মত খুবই মশহূর। কিন্তু দাওয়াতের ময়দানে আমার কোন সাথী ও শরীক যদি মনে করেন, এ বসা সুন্নাত এবং আমি মনে করি এ বসা সুন্নাত নয়, আর সে বসে কিন্তু আমি বসি না, তবে কি এই বসা- না বসার মতভেদকে কেন্দ্র করে আমাদের একজনে অন্যজনকে অপসন্দ ও ঘৃণা করা বৈধ হবে? আমরা কি কেউ কাউকে বদনাম ও অপদস্থ করতে পারব? আল্লাহর কসম, এমনটা কখনই জায়েয হবে না।
ছাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) নিজেদের মধ্যে এর থেকেও অনেক বড় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে মতানৈক্য করেছেন তারপরও তারা কেউ কাউকে ঘৃণা ও অপসন্দ করেননি। তাহ’লে আমরা কেন দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি ছেড়ে এসব সামান্য মাসআলা নিয়ে ঘৃণা-বিদ্বেষের ছড়াছড়ি করব? আমাদের অনেকেরই এ ঘটনা জানা আছে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আহযাব যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে জিবরীল (আঃ) তাঁর সাথে দেখা করেন এবং তাঁকে বনু কুরায়যা পল্লীতে যাওয়ার আদেশ করেন। তারা মুসলমানদের সাথে কৃত ওয়াদা ভঙ্গ করেছিল। ফলে তিনি তাঁর ছাহাবীদের বনু কুরায়যা পল্লীতে যাওয়ার জন্য ঘোষণা দিলেন এবং বললেন, কেউ যেন বনু কুরায়যায় না পৌঁছা অবধি আছর ছালাত আদায় না করে। তারা মদীনা থেকে বেরিয়ে পড়লেন। পথিমধ্যে আছর ছালাতের ওয়াক্ত হয়ে গেলে কিছু ছাহাবী বললেন, বনু কুরায়যায় না পৌঁছে আমরা ছালাত আদায় করব না। তারা ছালাত এতটা বিলম্বিত করলেন যে ওয়াক্ত পেরিয়ে গেল। অন্য কিছু ছাহাবী বললেন, আমরা সময়মতই আছর ছালাত পড়ে নেব, বনু কুরায়যায় গিয়ে না হয় ছালাত নাইবা পড়ব।
এ খবর নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট পৌঁছলে তিনি দু’দলের কাউকেই ভৎর্সনা বা তিরস্কার করেননি। ছাহাবীরাও এ নিয়ে কেউ কারও প্রতি মনের মধ্যে ঘৃণা ও শত্রুতা পোষণ করেননি। যদিও প্রথম ও তৃতীয় রাক‘আতে সিজদা থেকে ওঠার সময় বসা থেকে সময় মতো ছালাত আদায় নিয়ে মতানৈক্য অনেক বেশী কঠিন। সময় পেরিয়ে গেলে ছালাত পড়বে না সময়ের মধ্যে ছালাত পড়বে এ মতানৈক্য বসার মতানৈক্য থেকে বড় জটিল।
সুতরাং দাওয়াতদাতা ভাইদের কাছে আমার প্রত্যাশা, তারা যেন ইজতিহাদের সুযোগ আছে এমন সব বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা, দলাদলী এবং পরস্পরকে গুমরাহ আখ্যা না দেন। কেননা এতে করে তাদের শত্রুদের সামনে তাদের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়বে। আপনারা জানেন আমাদের এমন অনেক শত্রু আছে যারা ইসলামের কল্যাণময় পথের দাওয়াতদাতাদের ধ্বংসের প্রতীক্ষায় ওঁৎ পেতে আছে। তবে যার সঙ্গে আল্লাহ আছেন শুভ পরিণাম তার জন্যই। তিনিই দুনিয়া ও আখেরাতে সাহায্যপ্রাপ্ত। যেমন আল্লাহ বলেছেন,إِنَّا لَنَنْصُرُ رُسُلَنَا وَالَّذِينَ آمَنُوا فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَيَوْمَ يَقُومُ الْأَشْهَادُ، ‘নিশ্চয়ই আমরা সাহায্য করব আমাদের রাসূলদের ও মুমিনদের, যেদিন দন্ডায়মান হবে সাক্ষীগণ’ (মুমিন ৪০/৫১)।
শেষ প্রার্থনা : আমি আল্লাহ তা‘আলার নিকট প্রার্থনা জানাই, তিনি যেন আমাকে এবং আপনাদেরকে তাঁর দ্বীনের সাহায্যকারী এবং তাঁর দ্বীনের প্রতি জেনেবুঝে দাওয়াতদাতা বানান এবং আমাদেরকে তার পক্ষ থেকে রহমত দান করেন। নিশ্চয়ই তিনি মহান দাতা।
[1]. মুসলিম, কিতাবুল ঈমান, হা/১৯।
[2]. বুখারী হা/৬২০৫, কিতাবুল আদব।
[3]. মুসলিম হা/২৮৫, তাহারাত অধ্যয়।