পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ । পর্ব ৬ । শেষ পর্ব ।

বর্তমান বসুন্ধরা অসংখ্য ধর্মের কোটি কোটি অনুসারীর পদভারে মুখরিত। কিন্তু এমন একটি ধর্মও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে কি নৈতিক কি ব্যবহারিক কোন ক্ষেত্রেই মানবীয় ভ্রাতৃত্ববোধ ইসলামের চেয়ে বেশী। বরং ইসলামই একমাত্র ধর্ম যেখানে মানব জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগে মানবীয় মর্যাদাবোধ ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের বিষয়টি নৈতিক ও ব্যবহারিক প্রতিটি ক্ষেত্রে সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত। যা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ) বর্ণনা করে গেছেন। যেমন-

وَعَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهُِ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّ اللهَ تَعَالَىْ يَقُوْلُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَا ابْنَ آدَمَ! مَرِضْتُ فَلَمْ تَعُدْنِىْ. قَالَ: يَا رَبِّ! كَيْفَ أَعُوْدُكَ وَأَنْتَ رَبُّ الْعَالَمِيْنَ؟ قَالَ: أَمَا عَلِمْتَ أَنَّ عَبْدِىْ فُلاَنًا مَّرِضَ فَلَمْ تَعُدْهُ، أَمَا عَلِمْتَ أَنَّكَ لَوْ عُدْتَّهُ لَوَجَدْتَّنِىْ عِنْدَهُ؟ يَا ابْنَ آدَمَ! اِسْتَطْعَمْتُكَ فَلَمْ تُطْعِمْنِىْ. قَالَ: يَارَبِّ! كَيْفَ أُطْعِمُكَ وَ أَنْتَ رَبُّ الْعَالَمِيْنَ؟ قَالَ: أَمَا عَلِمْتَ أَنَّهُ اسْتَطْعَمَكَ عَبْدِىْ فُلاَنٌ فَلَمْ تُطْعِمْهُ؟ أَمَا عَلِمْتَ أَنَّكَ لَوْ أَطْعَمْتَهُ لَوَجَدْتَّ ذَلِكَ عِنْدِىْ؟ يَا ابْنَ آدَمَ! اسْتَسْقَيْتُكَ فَلَمْ تُسْقِنِىْ. قَالَ: يَا رَبِّ! كَيْفَ أَسْقِيْكَ وَأَنْتَ رَبُّ الْعَالَمِيْنَ؟ قَالَ: اسْتَسْقَاكَ عَبْدِىْ فُلاَنٌ فَلَمْ تُسْقِهِ، أَمَا عَلِمْتَ أَنَّكَ لَوْ سَقَيْتَهُ وَجَدْتَّ ذَلِكَ عِنْدِىْ-

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, হে আদম সন্তান! আমি পীড়িত হয়েছিলাম, তুমি আমাকে দেখতে আসনি। সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! আমি কিভাবে তোমাকে দেখতে আসব, অথচ তুমিই সমস্ত জগতের প্রভু? আল্লাহ বলবেন, তুমি কি জানতে না যে, আমার অমুক বান্দা পীড়িত হয়েছিল? কিন্তু তুমি তাকে দেখতে যাওনি। তুমি কি জানতে না যে, তুমি যদি তাকে দেখতে যেতে নিশ্চয়ই তার নিকট আমাকে পেতে? হে আদম সন্তান! আমি তোমার নিকট খানা চেয়েছিলাম, তুমি আমাকে খানা দাওনি। সে বলবে, হে আমার প্রভু! আমি তোমাকে কিরূপে খানা দিব, অথচ তুমিই সমস্ত জগতের প্রতিপালক? তিনি বলবেন, তুমি কি জানতে না যে, আমার অমুক বান্দা তোমার নিকট খানা চেয়েছিল, আর তুমি তাকে খানা দাওনি? তুমি কি জানতে না যে, যদি তুমি তাকে খানা দিতে, নিশ্চয়ই তা আমার নিকট পেতে? হে আদম সন্তান! আমি তোমার নিকট পানি চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে পানি পান করাওনি। সে বলবে, হে আমার প্রভু! আমি তোমাকে কিরূপে পানি পান করাব, যখন তুমিই সমস্ত জগতের প্রতিপালক? তিনি বলবেন, আমার অমুক বান্দা তোমার নিকট পানি চেয়েছিল, কিন্তু তুমি তাকে পানি পান করাওনি। তুমি কি জানতে না যে, তুমি যদি তাকে পানি পান করাতে, তুমি সেখানে আমাকে পেতে?’[1]

এ হাদীছ থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, বর্ণিত তিনটি বিষয়েই কিয়ামতের দিন প্রতিটি বনু আদম আল্লাহর নিকটে জিজ্ঞাসিত হবে। আরও স্পষ্ট যে, সৃষ্টির প্রতি দয়া প্রদর্শনের মাধ্যমে স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জন করা সম্ভব। বর্ণিত হাদীছে পীড়িত, ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত এই তিন ব্যক্তির ব্যাপারে বিশেষভাবে গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। যার বাস্তব প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায় প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর জীবনে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত একটি হাদীছে বলা হয়েছে, একদা রাসূল (ছাঃ) একজন রোগাক্রান্ত বেদুঈনকে দেখতে গেলেন। শুধু তাই নয়, অন্যান্য রোগী দেখতে যাওয়ার সাধারণ নিয়মানুসারে তিনি তাকেও বললেন, لاَبَأْسَ طَهُوْرٌ إِنْ شَاءَ اللهُ ‘ভয় নেই! আল্লাহ চাহেতো দ্রুত আরোগ্য লাভ করবে’।[2] অপর এক হাদীছে বারা ইবনে আযেব (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) আমাদেরকে সাতটি বিষয়ে নির্দেশ এবং সাতটি বিষয়ে নিষেধ করেছেন। নির্দেশ প্রদানকৃত সাতটি বিষয়ের প্রথমটিই হ’ল রোগীর পরিচর্যা করা’।[3]

শুধু রোগী দেখা বা পীড়িতকে সেবা করার ক্ষেত্রেই নয়, বিশ্বভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধির অন্যতম নিয়ামক ক্ষুধার্তকে অন্ন দানের ক্ষেত্রেও ইসলাম উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, যা নিম্নোক্ত হাদীছ থেকে সহজেই অনুমেয়।عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم يَقُوْلُ: لَيْسَ الْمُؤْمِنُ بِالَّذِيْ يَشْبَعُ وَجَارُهُ جَائِعٌ إِلَىْ جَنْبِهِ- হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, ‘ঐ ব্যক্তি ঈমানদার নয়, যে উদরপূর্তি করে খায় আর তার পার্শ্বের প্রতিবেশী অভুক্ত থাকে’।[4] অপর এক হাদীছে বলা হচ্ছে-عَنْ أَبِىْ مُوْسَى قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم أَطْعِمُوا الْجَائِعَ وَعُوْدُوا الْمَرِيْضَ وَفُكُّوا الْعَانِىَ- হযরত আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান কর, রুগ্ন ব্যক্তির দেখাশুনা কর এবং বন্দীকে মুক্ত কর’।[5] অত্র হাদীছে ক্ষুধার্তকে খাদ্য দানের সাথে রুগ্ন ব্যক্তির দেখাশুনা করারও নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। ক্ষুধার্তকে অন্ন দান করা ইসলামে উত্তম কাজ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন-عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو أَنَّ رَجُلاً سَأَلَ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَىُّ الْإِِسْلاَمِ خَيْرٌ قَالَ: تُطْعِمُ الطَّعَامَ وَتُقْرِئُ السَّلاَمَ عَلَى مَنْ عَرَفْتَ وَمَنْ لَّمْ تَعْرِفْ- হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করল, ইসলামে কোন্ কাজ উত্তম? (উত্তরে) তিনি বললেন, অভুক্তকে খানা খাওয়ানো এবং চেনা-অচেনা সকলকে সালাম করা’।[6]

এমনিভাবে বিভিন্ন হাদীছে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ) কোন জাতি, ধর্ম বা বর্ণের উল্লেখ না করে আমভাবে সামর্থ্যবান লোকদেরকে সামর্থহীন-অসহায়-দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা দিয়েছেন। যা বিশ্বভ্রাতৃত্ব সৃষ্টির এক প্রোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

অভাবগ্রস্তকে খাদ্য দানের বিষয়ে মহান আল্লাহও সূরা মাঊনের শুরুতে বলেন, ‘আপনি কি দেখেননি যে দ্বীনকে অস্বীকার করে? সে ঐ ব্যক্তি, যে ইয়াতীমকে রূঢ়ভাবে তাড়িয়ে দেয় এবং সে অভাবগ্রস্তকে খাদ্যদানে উৎসাহ দেয় না’ (মাঊন ১০৭/১-৩)। অর্থাৎ দ্বীনকে শুধু মুখে অস্বীকারকারীই ক্ষতিগ্রস্ত নয়, যারা দ্বীনের বিধান অমান্য করে অর্থাৎ ইয়াতীম ও অভাবগ্রস্তকে সহায়তা করে না তারা মুখে যতই দ্বীনের স্বীকৃতি দিক, প্রকৃতপক্ষে তারা দ্বীনকে অস্বীকারকারী। একারণেই অন্তত প্রত্যেক মুসলমানের উচিত, যেকোন ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী অন্ন দান করা, সাথে সাথে যাদের সামর্থ্য আছে তাদেরকেও অন্ন দানে উৎসাহ প্রদান করা। আর এটাই আল্লাহর হুকুম। মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন, ‘আর ধনীদের সম্পদে ফকীর ও বঞ্চিতদের অধিকার আছে’ (যারিয়াত ৫১/১৯)। আর এ হুকুম-আহকাম যথাযথভাবে প্রতিপালনের মধ্য দিয়ে ধনী ও গরীবের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কে গড়ে উঠবে।

ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার অন্যতম নিয়ামক হ’ল যাকাত। যে বিষয়ে মহান আল্লাহ সূরা তওবায় উল্লেখ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই যাকাত কেবল ফকীর, মিসকীন, যাকাত আদায়কারী, যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন, দাস-মুক্তি, ঋণগ্রস্ত, আল্লাহর রাস্তায় এবং মুসাফিরদের জন্য। এই হ’ল আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়’ (তওবা ৯/৬০)

অত্র আয়াতে যাকাত প্রদানের আটটি খাতের মধ্যে ‘যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন’ বলে যে খাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তা শুধুমাত্র অমুসলিমদের জন্যই প্রযোজ্য। এর মাধ্যমে একটি বিষয় সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, উদ্দেশ্য যাই থাক না কেন, ইসলাম ধর্মে ধন বণ্টনের ক্ষেত্রে মোট সম্পদের আট ভাগের একভাগ অমুসলিমদের জন্য নির্ধারিত। বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় মহানবী যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন, সেকথার উল্লেখ করে বাংলার বহু কবি কবিতা রচনা করেছেন। যেমন- কবি আবুল হাসান শামসুদ্দিন (জন্ম: ১৯৩৫) তাঁর ‘বিশ্বনবী’ কবিতার শেষ স্তবকে বলেন,

‘একতার বাণী, সাম্যের বাণী প্রথম হাঁকিলে তুমি,

তুমি শিখালে: মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নাই;

মিলনের গানে মুখরিয়া দিক জাগিয়া বিশ্বভূমি,

জানিল মানুষ : মানুষেরা ভাই ভাই।’

বিশ্বভ্রাতৃত্বের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হ’ল জাতি, ধর্ম বা বর্ণের বেড়াজাল ছিন্ন করে মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে ধনী-গরীবের বৈষম্য দূরীভূত করে সকলে এক আদমের সন্তান হিসাবে ভ্রাতৃত্বের সুদৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সুখে-শান্তিতে বসবাস করা। একই সাথে যেহেতু পৃথিবীর সকল মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি, সেহেতু সকলেই তাঁর প্রেরিত অহির বিধান মেনে চলবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবতা তার বিপরীত। বর্তমান বিশ্ব পরিসংখ্যানে মুসলমানের তুলনায় অমুসলমানের সংখ্যাই বেশী। ২০০৭ সালের হিসাব অনুযায়ী বিশ্বে খৃষ্টান জনসংখ্যা ২১৯,৯৮,১৭,৪০০, মুসলমান জনসংখ্যা ১৩৮,৭৪,৫৪,৫০০, হিন্দু ৮৭,৫৭,২৬,০০০, বৌদ্ধ ৩৮,৫৬,০৯,০০০, শিখ ২২৯, ২৭,৫০০ ও ইহুদী জনসংখ্যা ১৪৯,৫৬,০০০।[7] এসকল আল্লাহ বিমুখ মানুষের নিকটে অহির বিধান পৌঁছে দিতে তাদের সংস্পর্শে যাওয়া বা তাদেরকে নিজের সংস্পর্শে আনা একান্ত প্রয়োজন। যা পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে তোলার মাধ্যমে সহজ ও সম্ভব হবে। রাসূলে আকরাম (ছাঃ)-এর সাথে মক্কার কাফেরদের কৃত হুদায়বিয়ার সন্ধিই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। চুক্তির বেশিরভাগ শর্ত বাহ্যত মুসলমানদের বিপক্ষে ছিল। সে কারণে প্রসিদ্ধ ছাহাবীগণ এ চুক্তি সম্পাদনে একমত ছিলেন না। কিন্তু দূরদর্শী নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) দেখলেন, চুক্তির শর্ত যতই মুসলমানদের বিপক্ষে থাক না কেন, এর মাধ্যমে যদি আমি তাদের সংস্পর্শে যাওয়ার সুযোগ পাই তাহলেই আমরা সফল। কার্যত সেটাই হয়েছিল। অবশেষে দেখা গেল হুদায়বিয়ার সন্ধির পথ ধরেই মুসলমানরা মক্কা বিজয় করতে সক্ষম হ’ল। যেটিকে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ‘ফাত্হুম্ মুবীন’ তথা মহা বিজয় (ফাতহ ৪৮/১) বলে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ ইসলামী শরী‘আতে বিশ্বভ্রাতৃত্বের এসকল হুকুম বিধর্মীদের নিকটে আল্লাহর একত্ব প্রচারের লক্ষ্যে তাদেরকে কাছে পাওয়ার ক্ষেত্রে একটা স্থায়ী হিকমত বলা যেতে পারে। তবে একটা বিষয় কোন অবস্থাতেই ভুলে গেলে চলবে না যে, একজন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের সাথে কোন অবস্থাতেই একজন মুসলমানের সত্যিকারের বন্ধুত্ব হ’তে পারে না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘মুমিনগণ! তোমরা আমার ও তোমাদের শত্রুদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তোমরা তো তাদের প্রতি বন্ধুত্বের বার্তা পাঠাও, অথচ তারা যে সত্য তোমাদের কাছে আগমন করেছে, তা অস্বীকার করছে...’ (মুমতাহিনা ৬০/১১)। ‘হে মুমিনগণ! তোমরা ইহুদী ও খৃষ্টানদেরকে বন্ধু’ হিসাবে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত’ (মায়েদাহ ৫/৫১)। অর্থাৎ মানবীয় ভ্রাতৃত্ববোধ এবং আন্তরিক বন্ধুত্ব কোন অবস্থাতেই এক বিষয় নয়।

মোটকথা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা গ্রহণের প্রথম কাজ হ’ল তাকে সংস্পর্শে পাওয়া। আর কাছে পাওয়ার অন্যতম পদ্ধতি হ’ল ভাল আচরণ, আর্থিক সহযোগিতা, সুপরামর্শ, প্রয়োজনে মানবিক সহায়তা প্রদান ইত্যাকার কাজের মাধ্যমে তাদের সাথে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া। এভাবে তাদের মাঝে সহজে সৃষ্টিকর্তার বিধান প্রচার করা সহজ হবে। আর এটিই হ’ল বিশ্বভ্রাতৃত্বের মূল উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য।

ইসলামী ভ্রাতৃত্ব :

সমাজে বসবাসকারী মানব সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পর ভ্রাতৃসুলভ আচরণ করা এবং একে অন্যের সুখ-দুঃখে সাথী হয়ে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, হৃদ্যতাপূর্ণ ও বন্ধুত্বসুলভ অনুপম সম্পর্ক বজায় রাখার নাম ভ্রাতৃত্ব। আর মুসলিম সমাজে এরূপ সম্পর্ক বজায় থাকার নাম ইসলামী ভ্রাতৃত্ব। ইসলামী ভ্রাতৃত্ব মূলত আদর্শিক ভ্রাতৃত্ব। যারা তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাতে বিশ্বাসী হয়ে আল্লাহর পসন্দনীয় ধর্ম ইসলামের বিধি-বিধান ও অনুশাসন মেনে চলে, তারা বিশ্বের যেকোন অঞ্চলের অধিবাসী হোক, যেকোন ভাষাভাষী হোক, যেকোন বংশ বা গোত্রে জন্মগ্রহণ করুক, তাদের আকার-আকৃতি, বর্ণ বা আর্থিক অবস্থা যাই থাক না কোন, তারা মুসলমান এবং পরস্পর ভাই ভাই। মহান আল্লাহর ঘোষণা, ‘নিশ্চয়ই মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই। সুতরাং তোমার দুই ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করে দিবে এবং আল্লাহকে ভয় করবে, সম্ভবত তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হবে’ (হুজুরাত ৪৯/১০)। তিনি আরো বলেন, ‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল এবং তাঁর সহচরগণ কাফেরদের প্রতি কঠোর, নিজেদের মধ্যে পরস্পর সহানুভূতিশীল। আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় আপনি তাদেরকে রুকূ ও সেজদারত দেখবেন’ (ফাতহ ৪৮/২৯)। মহানবী (ছাঃ)ও বলেছেন, اَلْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ ‘এক মুসলমান আরেক মুসলমানের ভাই’।[8]

ইসলামী ভ্রাতৃত্বের বাস্তব রূপকার হ’লেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ)। মহানবী (ছাঃ)-এর আবির্ভাবের পূর্বে বিশেষ করে আরবের সামাজিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত নাযুক। সামান্য বিষয়কে কেন্দ্র করে ভাইয়ে-ভাইয়ে, গোত্রে-গোত্রে মারামারি, রক্তপাত, যুদ্ধ-বিগ্রহ, হিংসা-হানাহানি লেগেই থাকত। একে অন্যের নিকটে মানবীয় সম্মানবোধের কোন বালাই ছিল না। বিশেষ করে নারী এবং কৃতদাসরা বাজারে পশুর মত বিক্রি হ’ত। এহেন নাযুক পরিস্থিতিতে মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে মহানবী (ছাঃ)-এর প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে সেই অসভ্য বর্বর সমাজ অল্প সময়ের ব্যবধানে সোনার সমাজে পরিণত হয়ে গেল। দু’দিন আগেও যারা একে অপরের মুখ দেখতে চাইত না, আজ তারা সেই পড়শির বিপদে নিজের জীবন দিয়ে হ’লেও তাকে বিপদমুক্ত করতে প্রস্ত্তত। এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক খোদাবক্স তাঁর Mohammad the Prophet গ্রন্থে বলেন, The immediate result of the prophet’s teaching was the dissolution of tribal system and the foundation of the brotherhood of Islam. ‘মহানবী (ছাঃ)-এর শিক্ষার প্রত্যক্ষ ফল হ’ল গোত্রভিত্তিক সমাজের বিলুপ্তি ও ইসলামী ভ্রাতৃত্ব স্থাপন’। ইসলামী ভ্রাতৃত্ব পৃথিবীতে বিরাজমান সর্বপ্রকার শত্রুতা, বিভেদ ও বৈষম্য বিদূরিত করে দুনিয়ার সকল মানুষকে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের অন্তর্ভুক্ত করে শান্তির মৃদমন্দ সমীরণ প্রবাহিত করেছে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে, ইসলাম গ্রহণের পর আল্লাহ তোমাদের হৃদয়ে সম্প্রীতি স্থাপন করে দিয়েছেন। তারপর আল্লাহর অনুগ্রহে তোমরা ভাই ভাই হয়ে গেছ’ (আলে ইমরান ৩/১০৩)

ইসলামী ভ্রাতৃত্ব যেহেতু আদর্শিক ভ্রাতৃত্ব, সেহেতু পৃথিবীর যেকোন প্রান্তে যেকোন বর্ণের মানুষ ইসলামের মহামন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ করলে সে বিশ্বজনীন ইসলামী ভ্রাতৃসংঘের সদস্য হয়ে যায়। এ ভ্রাতৃত্বের ভীত এত মজবুত যে, এর আকর্ষণে দেশ, বংশ বা রক্তের সম্পর্কও ঠুনকো হয়ে যায়। ইসলামী ভ্রাতৃত্ব যেমন মজবুত ও সুদৃঢ়, তেমনি মহান ও পবিত্র।

[চলবে]


[1]. মুসলিম, মিশকাত, হা/১৫২৮ ‘জানাযা’ অধ্যায়, ‘রোগীর পরিচর্যা ও রোগের ছওয়াব’ অনুচ্ছেদ।

[2]. বুখারী, মিশকাত, হা/১৫২৯।

[3]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত, হা/১৫২৬।

[4]. বায়হাকী, মিশকাত, হা/৪৯৯১; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/১১২, হাদীছ হাসান।

[5]. বুখারী, মিশকাত, হা/১৫২৩।

[6]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত, হা/৪৬২৯।

[7]. দৈনিক ইনকিলাব, ১২ জুলাই ’১০, পৃঃ ১ ও ২

[8]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ; মিশকাত হা/৪৯৫৮ ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়, ‘সৃষ্টির প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ’ অনুচ্ছেদ।






বিষয়সমূহ: নীতি-নৈতিকতা
আহলেহাদীছ আন্দোলন-এর পাঁচ দফা মূলনীতি : একটি বিশ্লেষণ (২য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
শায়খ আলবানীর তাৎপর্যপূর্ণ কিছু মন্তব্য (১ম কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
ঈমানের গুরুত্ব ও ফযীলত - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
আশূরায়ে মুহাররম - আত-তাহরীক ডেস্ক
অনুভূতির ছাদাক্বাহ - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
মাদ্রাসার পাঠ্যবই সমূহের অন্তরালে (৪র্থ কিস্তি) - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ছাদাক্বাতুল ফিতরের বিধান - লিলবর আল-বারাদী - যশপুর, তানোর, রাজশাহী
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ)-এর উপর নির্যাতন - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
পেরেনিয়ালিজম এবং ইসলাম (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - প্রফেসর ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া
তাহরীকে জিহাদ : আহলেহাদীছ ও আহনাফ (৮ম কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
তাক্বলীদের বিরুদ্ধে ৮১টি দলীল (৪র্থ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
ধন-সম্পদ : মানব জীবনে প্রয়োজন, সীমালংঘনে দহন (৩য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
আরও
আরও
.