দেশে উচ্চশিক্ষা বিস্তারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনস্বীকার্য। এ দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন প্রভৃতি ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পেছনে আছে এক দশকের দীর্ঘ ইতিহাস; যেখানে ক্রিয়াশীল ছিল একটি চেতনা, একটি অনুপ্রেরণা। নতুন প্রজন্মের সামনে সেই ইতিহাস তুলে ধরার জন্য আলোচ্য নিবন্ধের অবতারণা।

দিন তারিখের হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯২১ সালের ১লা জুলাই প্রতিষ্ঠিত হ’লেও মূলতঃ এর সূত্রপাত হয় ১৯০৬ সালে। স্যার সৈয়দ আহমাদ খানের (১৮১৭-১৮৯৮) মৃত্যুর পর আলীগড় আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গঠিত ‘মোহামেডান এডুকেশনাল কনফারেন্সে’র ঢাকার শাহবাগে ২৭-৩১শে ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ২০তম অধিবেশনে নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, ব্যারিস্টার আফতাব আহমাদ প্রমুখ মুসলিম নেতৃবৃন্দের প্রচেষ্টায় ১৯০৬ সালের ৩০শে ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠা লাভ করে ‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগ’। পূর্ববঙ্গের অনগ্রসর মুসলিম জনসমাজ যাতে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পায় সে লক্ষ্যে উক্ত সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এ কনফারেন্স থেকে সর্বপ্রথম ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবী উত্থাপন করেন।

ইংরেজ আমলের প্রথম দিকে অভিমানে পিছিয়ে থাকলেও ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড’ এ প্রবাদকে সামনে রেখে বাংলার মুসলমানরা পরে আন্দোলন শুরু করেছিল। তাদের অতীত ইতিহাস ছিল জ্ঞানের আলোয় সমুজ্জ্বল। বিশেষতঃ ইউরোপ যখন অজ্ঞতার অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন ছিল, তখন মুসলমানরা সুদূর স্পেনে ইসলামের পতাকা সমুন্নত করেছিল এবং জ্বালিয়ে দিয়েছিল জ্ঞানের দীপশিখা। ফলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কর্ডোভা ও গ্রানাডার মত জগদ্বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও মুসলমানরা যথেষ্ট ত্যাগ করেছেন ও অসীম ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন। ব্রিটিশদের ইচ্ছা থাকলেও বর্ণ-হিন্দুদের বিরোধিতার কারণে পূর্ব বাংলা সকল সুযোগ-সুবিধা হ’তে বঞ্চিত হ’তে থাকে। কারণ এ অঞ্চলের জনগণের বেশিরভাগ ছিল মুসলমান। কিন্তু মুসলমানদের ধর্মীয় চেতনার ফলে সকল ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত নস্যাৎ করে দিয়ে স্বীয় দাবী আদায়ে তারা সক্ষম হয়েছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে যাদের প্রচেষ্টায় এ প্রতিষ্ঠানটি ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ হিসাবে খ্যাতি লাভ করেছিল সে ইতিহাস জাতি আজ ভুলতে বসেছে। বিশেষতঃ এ সময়ে মুসলিম চেতনা কতটুকু ভূমিকা রেখেছিল তা তৎকালীন ইতিহাস থেকে তুলে ধরার চেষ্টা করব। যে কয়জন মুসলিম  মনীষী  এক্ষেত্রে অনন্য অবদান  রেখেছিলেন তাঁদের মধ্যে নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক অন্যতম।

একথা ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে, নিতান্ত প্রশাসনিক সুবিধার্থে তৎকালীন দখলদার ইংরেজ সরকার বিশাল বঙ্গদেশ দুইভাগে বিভক্ত করে। তবে এ বিভাগের পিছনে তাদের একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ক্রিয়াশীল ছিল। আর তা হ’ল ‘ভাগ কর ও শাসন কর’ (Divide and rule policy)। তৎকালীন বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা নিয়ে গঠিত ‘বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি’ বা বঙ্গপ্রদেশ ছিল এ উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ প্রদেশ। এ প্রদেশের লোকসংখ্যা ছিল সমগ্র উপমহাদেশের এক-তৃতীয়াংশ। একজন মাত্র শাসকের (ছোটলাট) পক্ষে এতবড় প্রদেশ শাসন করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই প্রায় দেড়শ’ বছর পর প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে ‘বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা’ প্রদেশকে দু’ভাগে বিভক্ত করে বাংলার পূর্বাঞ্চল (আজকের বাংলাদেশ)-কে আসামের সাথে যুক্ত হয়ে ঢাকাকে রাজধানী করে ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ নামে একটি স্বতন্ত্র প্রদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ (বর্ধমান ও প্রেসিডেন্সি বিভাগ)-কে বিহার ও উড়িষ্যার সাথে যুক্ত হয়ে কলকাতাকে রাজধানী করে অপর একটি প্রদেশ- ‘বাংলা প্রদেশ’ গঠন করা হয়। ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ প্রদেশের আয়তন ১,০৬,৫০৪ বর্গমাইল, জনসংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ১০ লক্ষ। এর মধ্যে ১ কোটি ৮০ লক্ষ মুসলমান, ১ কোটি ২০ লক্ষ হিন্দু এবং বাকি বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী।[1] অপরদিকে ‘বাংলা প্রদেশ’-এর আয়তন ১,৪১,৫৮০ বর্গমাইল এবং জনসংখ্যা ৫ কোটি ৪০ লক্ষ। এদের মধ্যে ৪ কোটি ২০ লক্ষ হিন্দু, ৯০ লক্ষ মুসলমান এবং বাকি অন্যান্য ধর্মাবলম্বী।[2] 

একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী’ উপমহাদেশে শাসন প্রতিষ্ঠিত করলেও মুসলমানদের ইসলামী চেতনা বিনষ্ট করতে পারেনি। এক সময় ভারত বর্ষের রাজনৈতিক ঐক্য রক্ষার জন্য মিঃ গান্ধী বলেছিলেন, We are first Indian, then we are Hindu or Muslim. ‘আমরা প্রথমে ভারতীয় অতঃপর হিন্দু অথবা মুসলিম’। এর উত্তরে কায়েদে আযম মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ (১৮৭৬-১৯৪৮) দ্বার্থহীনভাবে বলেছিলেন, We are first Muslim, then we are Indian. ‘আমরা প্রথমে মুসলিম অতঃপর ভারতীয়’।

মুসলমানদের মৌলিক চেতনা হ’ল তাদের আক্বীদার বিপ্লব। নির্ভেজাল আক্বীদা সম্পন্ন মুসলিমকে তার ঈমানী চেতনা থেকে দূরে রাখা বা চেতনা নির্মূল করা আদৌ সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে বিরুদ্ধবাদীরা অনেক ভূমিকা পালন করেছে।

বঙ্গভঙ্গের ফলাফল ছিল সুদূর প্রসারী। পূর্ব বাংলার জনগণের কাছে বঙ্গভঙ্গ ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। পূর্ব বাংলার জনগণ বিশেষ করে মুসলিম জনগোষ্ঠী এটাকে সমর্থনের কারণ ছিল ঢাকা কেন্দ্রিক নতুন প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণের জন্য শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিকাশের ক্ষেত্রে নতুন নতুন সুযোগ  সৃষ্টি হবে। সাথে সাথে বাণিজ্য তথা অর্থনীতি, যোগাযোগসহ সকল ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধিত হবে। সবচেয়ে বেশী প্রাধান্য পেয়েছিল শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রভূত সুযোগ সৃষ্টির সম্ভাবনা।

অবিভক্ত বঙ্গদেশে ১৯০৫ সালে যে ৪৫টি কলেজ ছিল তার ৩০টি ছিল পশ্চিমবঙ্গে। বাকী ১৫টি ছিল পূর্ববঙ্গ ও আসামে। যদিও জনসংখ্যা এখানেই বেশি ছিল। অপরদিকে শুধু কলকাতায় ছিল ১৩টি কলেজ এবং ৭টি মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। এসব বঞ্চিত পরিবেশ থেকে উত্তরণের আকাঙ্ক্ষায় পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা বঙ্গভঙ্গকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করে।

বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ব বাংলায় অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির যে সূচনা হয়, কলকাতা কেন্দ্রিক ভদ্র হিন্দু সমাজ তা মেনে নিতে পারেনি। বিশেষ করে শিক্ষা ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল। এক্ষেত্রে এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯০৬ সাল থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত পূর্ব বাংলা ও আসামের কলেজ পর্যায়ে মুসলিম ছাত্র সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৬,৯৯,০৫১ জন থেকে ৯,৩৬,৬৫৩ জন হয় এবং শিক্ষা খাতে বাজেট বৃদ্ধি পেয়ে ৪৭,৮১,৮৩৩ টাকা থেকে ৭৩,০৫,২৬০ টাকায় উন্নীত হয়’।[3]

কিন্তু বঙ্গ দেশের অখন্ডতা রক্ষার দাবীতে রবীন্দ্রনাথসহ হিন্দু নেতা, লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রবল গণ-আন্দোলন গড়ে তোলেন। যা অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে বৃটিশ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে।[4] ১৯০৫ সালের ১০ই জুলাই বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনা প্রকাশিত হওয়ার দু’দিন পরেই কৃষ্ণকুমার মিত্র সম্পাদিত ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকা ১৯০৫ সালের ১৩ই জুলাই সম্পাদকীয় নিবন্ধে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে সামগ্রিক ‘বয়কট’ যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ‘হিতবাদী’ পত্রিকায় বলা হয়, বিগত ১৫০ বছরের মধ্যে বাঙ্গালী জাতির সম্মুখে এরূপ বিপর্যয় কখনও আসেনি। ‘সন্ধ্যা’ পত্রিকায় বলা হয়, বাঙ্গালী জাতিকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যেই বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।[5] শুধু নেতৃবৃন্দ ও বুদ্ধিজীবীরাই নয়, ব্যবসায়িক স্বার্থ বিপন্ন হবার আশঙ্কায় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা পর্যন্ত এর চরম বিরোধিতা করেন। তারা বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলন অব্যাহত রাখার জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রদান করেন।

সেকারণ শেরে বাংলা একেফজলুল হক (১৮৭৩-১৯৬২) এক সময় বলেছিলেন, Politics of Bengal is in reality economics of Bengal. ‘বাংলার অর্থনীতিই হ’ল বাংলার আসল রাজনীতি’।[6]

১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর ‘বঙ্গভঙ্গ’ কার্যকর করার দিন থেকেই কলকাতার হিন্দু নেতৃবৃন্দ এবং কংগ্রেস সদস্যরা ‘স্বদেশী আন্দোলন’-এর নামে ‘বঙ্গভঙ্গ রদ’ আন্দোলন শুরু করেন এবং দুর্বার গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন।[7]

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রজনী কান্ত সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতি রচিত স্বদেশী গান বাংলার আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তুলেছিল। এই উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি রচনা করেন, যা বর্তমানে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত।[8]

মোটকথা বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন যে প্রবল রূপ ধারণ করেছিল এবং যে চরিত্র পরিগ্রহ করেছিল, সে পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করা বৃটিশ সরকারের পক্ষে সম্ভব ছিল না। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের ‘অনুশীলন সমিতি’ বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে পুরোপুরি সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে রূপ নেয়।[9] পরিস্থিতির ভয়াবহতা লক্ষ্য করে ইংরেজ সরকার অবশেষে ১৯১১ সালের ১২ই ডিসেম্বর বঙ্গভঙ্গ রদ করার সিদ্ধান্ত নেয়।[10] যা ১৯১২ সালের জানুয়ারী মাস হ’তে কার্যকর হয়।[11] এর ফলে বঙ্গদেশের অখন্ডতায় বিশ্বাসী জনগণ যেমন আনন্দ-উল্লাসে ফেটে পড়ে, তেমনি বঙ্গভঙ্গের সমর্থনপুষ্ট মুসলিম জনগোষ্ঠী ক্ষোভে ফেটে পড়ে। এমত পরিস্থিতিতে বাঙ্গালী মুসলিমরা যে আশার আলো দেখেছিল তা দপ করে নির্বাপিত হয়ে যায়।

‘বঙ্গভঙ্গ রদ’ হ’লে মুসলিম নেতৃবৃন্দ চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ভারতের বর্ণ-হিন্দুদের আন্দোলনে এটি আরও মারাত্মক আকার ধারণ করে। তখন ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ এবং ময়মনসিংহের সৈয়দ নবাব আলী চৌধুরী আগা খানের ‘দাবীপত্রে’ ‘বঙ্গভঙ্গ স্থায়ী’ করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার জোর প্রচেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু আগা খান বিষয়টি গুরুত্ব দেননি, বরং তিনি এর বিরোধিতা করেছিলেন। ‘বঙ্গভঙ্গ রদ’ করার কারণে বাংলার মুসলমান তথা সর্বশ্রেণীর জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়টি ক্ষুণ্ণ হয়। বিশেষ করে তারা সামাজিক, রাজনৈতিক ও আর্থিকভাবে দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ বিষয়টি গভর্ণর জেনারেল লর্ড কার্জন বুঝলেও আগা খান বুঝতে চাইলেন না। অবশ্য এর পিছনে বর্ণ-হিন্দুদের বিরোধিতাও ছিল মূল কারণ। তাঁরা আগা খাঁর বিরোধিতাকেই বেশী প্রাধান্য দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে প্রণব কুমার চট্টোপাধ্যায় বলেন, এ সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য যে, বাঙ্গালী মুসলমান নেতৃবৃন্দ, বিশেষত ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ ও সৈয়দ নবাব আলী চৌধুরী এই দাবীপত্রে বঙ্গভঙ্গের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আগা খাঁর বিরোধিতায় তা সম্ভব হয়নি।[12] একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যখন মুসলমান জনগণ তাদের নিজেদের বিষয়ে দাবী উত্থাপন করেছে, তখনই অমুসলিমরা চরম বিরোধিতা করেছে।

বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পর পূর্ব বাংলার বিক্ষুব্ধ ও বিমর্ষ মুসলমানদের মধ্যে সৃষ্ট অসন্তোষ প্রশমনের জন্য তৎকালীন বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ পূর্ববঙ্গ সফরের কর্মসূচী গ্রহণ করেন। তদনুযায়ী তিনি ১৯১২ সালের ৩১শে জানুয়ারী ঢাকা সফরে আসেন। ঐ দিনই নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী ও এ কে ফজলুল হক প্রমুখ মুসলিম নেতাদের একটি প্রতিনিধি দল তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার অনুরোধ জানান। এই অনুরোধের প্রেক্ষিতে তিনি ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন।[13] উক্ত ঘোষণার পর একই বছর মে মাসে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বিস্তারিত সুপারিশ পেশ করার জন্য ‘নাথান কমিশন’ (১৯১২) নামে একটি কমিশন গঠন করা হয়।[14]

ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হ’লে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব হ্রাস পাবে, চাষা ও যবনরা শিক্ষিত হবে এই আশঙ্কায় পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বুদ্ধিজীবীরা এর চরম বিরোধিতা শুরু করে। রবীন্দ্রনাথসহ সকল বাঙ্গালী হিন্দু নেতা ও বুদ্ধিজীবি ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চরম বিরোধী ছিলেন। এমনকি পূর্ববঙ্গের হিন্দুরাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে ছিল। এ লক্ষ্যে জনমত সৃষ্টির জন্য ১৯১২ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারী ফরিদপুর ও ময়মনসিংহে, ২৩শে মার্চ দিনাজপুরে, ২৪শে মার্চ রংপুরে, ২৬শে মার্চ রাজশাহীতে, ২৮শে মার্চ কুমিল্লা ও মেদিনীপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিরোধী সভা অনুষ্ঠিত হয়। এসব জনসভায় সভাপতি ও আলোচক ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ।[15] সবচেয়ে মজার ব্যাপার হ’ল ১৯১২ সালের ২৮শে মার্চ কলকাতার গড়ের মাঠে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে হিন্দুরা যে প্রতিবাদ সভা ডাকে, সে সভায় সভাপতিত্ব করেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।[16]

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি স্যার আশুতোষ মুখার্জী, যিনি ছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইঝি জামাই। তাঁর নেতৃত্বে তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জকে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন না করার জন্য ১৮ বার স্মারকলিপি দিয়ে প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করা হয়।[17] সে সময়ে অনেক হিন্দু কটাক্ষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বলত ‘মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়’। স্যার আশুতোষ মুখার্জীর স্মারকলিপির জবাবে লর্ড হার্ডিঞ্জ দ্বর্থহীন কণ্ঠে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হবেই। কি মূল্যের বিনিময়ে আপনি প্রতিবাদলিপি প্রত্যাহার করতে রাযী আছেন বলুন। তখন স্যার আশুতোষ মুখার্জী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অতিরিক্ত ৪টি প্রফেসরের পদ সৃষ্টির বদৌলতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা বন্ধ করেন।[18] কিন্তু অন্যান্য মহল তাদের বিরোধিতা অব্যাহত রাখে।

এসব বাধা-বিপত্তির মাঝেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া থেমে থাকেনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং তৎপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাপী সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দার অজুহাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজ বিলম্বিত হয়। অতঃপর ১৯১৭ সালের ২০শে মার্চ সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ভারতীয় আইনসভায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবী পুনরায় উত্থাপন করেন এবং অবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা বিল পাসের দাবী জানান। আইনসভার পক্ষ থেকে জানানো হয় যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিল-এর খসড়া প্রস্ত্তত রয়েছে, তবে যুদ্ধ সঙ্কটের মধ্যে সরকার এ বিলে হাত দিতে চান না। যুদ্ধ শেষে যথাসময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে। অতঃপর একই বছর ‘কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন’ পূর্বের ‘নাথান কমিশন’ রিপোর্ট অনুমোদন করে। এ রিপোর্টের ভিত্তিতে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ’ পাস হয়। অবশেষে সকল প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে দীর্ঘ নয় বছর পর ১৯২১ সালে বহুল প্রত্যাশিত ও অনেক সংগ্রামের ফসল ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্নে এর পরিধি কেমন ছিল এবং বর্তমান পরিধি কি রূপ সেটা নিম্নে উল্লেখ করা হ’ল।-

১৯২১ সালের ১লা জুলাই ৬০০ একর জমির উপরে আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময় ৩টি অনুষদ ও ১২টি বিভাগ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। অনুষদ ৩টি হ’ল কলা, বিজ্ঞান ও আইন। এ অনুষদের অন্তর্গত বিভাগগুলো হ’ল : (১) ইংরেজী (২) সংস্কৃত ও বাংলা (৩) আরবী ও ইসলামিক স্টাডিজ (৪) ফার্সী ও উর্দূ (৫) ইতিহাস (৬) অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান (৭) দর্শন (৮) গণিত (৯) পদার্থ বিদ্যা (১০) রসায়ন (১১) আইন এবং (১২) শিক্ষা। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংখ্যা ছিল সর্বমোট ৬০ জন। এর মধ্যে ২৮ জন ছিলেন কলা অনুষদের, ১৭ জন বিজ্ঞানের এবং ১৫ জন আইনের।[19] ছাত্র-ছাত্রী ছিল ৮৭৭ জন ও আবাসিক হল ছিল ৩টি।

বর্তমানে এর অনুষদ ১৩টি এবং বিভাগ ৭০টি। ইন্সটিটিউট ১১টি, গবেষণা কেন্দ্র ৩৯টি। ক্যাম্পাস ২৩টি। ছাত্র-ছাত্রী ৩৩,৫০০ জন। ছাত্র-ছাত্রীদের থাকার জন্য হল ও হোস্টেল ২১টি। এর মধ্যে ছাত্রদের ১৬টি ও ছাত্রীদের ৫টি। শিক্ষক ১৮০৫ জন। একাডেমিক স্টাফ ১৮১৭ জন এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারী ৩৪০৮ জন। এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে বিশ্বের বিখ্যাত ১০০ নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে তুলনীয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনেক ত্যাগ, সংগ্রাম ও আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ খ্যাত এ বিশ্ববিদ্যালয় আজ বাংলার মুসলমানদের উচ্চশিক্ষার এক অনন্য প্রতিষ্ঠান। এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ, নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক প্রমুখ ব্যক্তিত্বের অবদান সবিশেষ গুরুত্বের দাবীদার। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রচেষ্টা না থাকলে হয়তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হ’তে পারত না। জাতি তাঁদের কৃতিত্বের কথা আজীবন স্মরণ রাখবে। এসব ব্যক্তিত্ব মূল যে প্রেরণা নিয়ে কাজ করেছিলেন তা ছিল তাঁদের মুসলিম চেতনা।


[1]. কে. এম. রাইছ উদ্দিন খান, বাংলাদেশ ইতিহাস পরিক্রমা, (ঢাকা : খান ব্রাদাস, ২০০১), পৃঃ ৫৯২।

[2]. ঐ,  পৃঃ ৫৯৩।

[3]. ড. এমাজ উদ্দীন আহমদ, শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : ইতিহাসের বিস্মৃত এক অধ্যায়, (ঢাকা : শিকড় প্রকাশনী, ২০০২), পৃঃ ২৬১।

[4]বশির আলহেলাল, ইবরাহীম খাঁ, (ঢাকা : বাংলা একাডেমী, ১৯৮৮), পৃঃ ১৯।

[5]. বাংলাদেশ ইতিহাস পরিক্রমা, পৃঃ ৫৯৩।

[6]. ঐ, পৃঃ ৫৯৫।

[7]. এম. এ. মতিন, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিক ইতিহাস ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা, (ঢাকা : জ্ঞান বিতরণী, ২০০১), পৃঃ ২২।

[8]. বাংলাদেশ ইতিহাস পরিক্রমা, পৃঃ ৬০১।

[9]. আবদুল গফুর, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম, (ঢাকা : ইফাবা, ১৯৮৭), পৃঃ ১২১।

[10]. বাংলাদেশ ইতিহাস পরিক্রমা, পৃঃ ৬০৭।

[11]. ঐ, পৃঃ ৬০৭।

[12]. আধুনিক ভারত, ১ম খন্ড, (কোলকাতা ১৯৮৩), পৃঃ ১৩৮।

[13]. আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিক ইতিহাস ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা, পৃঃ ২৪।

[14].  ঐ।

[15]ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : ইতিহাসের বিস্মৃত এক অধ্যায়, পৃঃ ২৬৫।

[16]. নীরোদ চন্দ্র চৌধুরী, দি অটোবায়োগ্রাফী অফ অ্যান আননোন ইন্ডিয়ান।

[17]. জীবনের স্মৃতিদ্বীপে: ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার।

[18]ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : ইতিহাসের বিস্মৃত এক অধ্যায়, পৃঃ ২৬৫।

[19]. ডঃ আ.ফ.ম আবুবকর সিদ্দীক, বাংলার মুসলিম চেতনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পৃঃ ৪৭।





আক্বীদা ও আহকামে হাদীছের প্রামাণ্যতা - মীযানুর রহমান মাদানী
চুল ও দাড়িতে কালো খেযাব ব্যবহারের বিধান - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
পবিত্রতা অর্জন সম্পর্কিত বিবিধ মাসায়েল (৪র্থ কিস্তি) - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
পবিত্রতা অর্জন সম্পর্কিত বিবিধ মাসায়েল (৩য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার : ইসলামী দৃষ্টিকোণ - মুহাম্মাদ শাহাদত হোসাইন, বসুন্ধরা গ্রুপ, ঢাকা
চিন্তার ইবাদত (শেষ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
মাদ্রাসার পাঠ্যবই সমূহের অন্তরালে (৪র্থ কিস্তি) - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আশূরায়ে মুহাররম - আত-তাহরীক ডেস্ক
মাসায়েলে কুরবানী - আত-তাহরীক ডেস্ক
মুহাররম ও আশূরা : করণীয় ও বর্জনীয় - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
ছাহাবায়ে কেরামের প্রতি আমাদের কর্তব্য - আব্দুল আলীম বিন কাওছার
হজ্জ ও ওমরাহ সংশ্লিষ্ট ভুল-ত্রুটি সমূহ - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
আরও
আরও
.