পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ । পর্ব ৬ । শেষ পর্ব ।

(ঙ) পরস্পর দেখা-সাক্ষাৎ করা : ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধির অন্যতম উপায় হ’ল পারস্পরিক দেখা-সাক্ষাৎ। একজন মুসলমান প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে অপর দ্বীনী ভাইয়ের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করবে, এটাই স্বাভাবিক। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন পারস্পরিক হৃদ্যতা বৃদ্ধি পায়, তেমনি আল্লাহও সন্তুষ্ট হন। যার মাধ্যমে উভয়েরই পরকালে জান্নাত লাভের পথ সুগম হয়।

আবু হুরায়রা (রাঃ) নবী করীম (ছাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি অন্য এক গ্রামে তার মুসলমান ভাইয়ের সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে বের হ’ল। আল্লাহ তা‘আলা তার গমন পথে একজন অপেক্ষমান ফেরেশতা বসিয়ে রাখলেন। লোকটি যখন সেখানে পৌঁছল, তখন ফেরেশতা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোথায় যাচ্ছ? সে বলল, ঐ গ্রামে একজন ভাই আছে, তার সাথে সাক্ষাতে যাচ্ছি। ফেরেশতা জিজ্ঞেস করলেন, তার কাছে তোমার কোন অনুগ্রহ আছে কি, যার বিনিময় লাভের জন্য তুমি যাচ্ছ? সে বলল, না, আমি তাকে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ভালবাসি। তখন ফেরেশতা বললেন, আমি আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে তোমার কাছে এই সংবাদ দেওয়ার জন্য প্রেরিত হয়েছি যে, আল্লাহ তোমাকে অনুরূপ ভালবাসেন, যেরূপ তুমি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তাকে ভালবাস’।[1]

আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে পরস্পরে দেখা-সাক্ষাৎ করার গুরুত্ব বর্ণিত হয়েছে নিম্নের হাদীছেও। আবু ইদরীস খাওলানী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদীছের শেষাংশে বলা হয়েছে- ‘মহান আল্লাহ বলেন, যারা আমার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে পরস্পর মুহাববত করে, আমার সন্তোষের উদ্দেশ্যে পরস্পর উঠা-বসা করে, আমার সন্তোষের আশায় পরস্পর দেখা-সাক্ষাৎ করে এবং আমার উদ্দেশ্যেই পরস্পর নিজেদের সম্পদ খরচ করে, তাদের মুহাববত করা আমার জন্য ওয়াজিব হয়ে যায়’।[2]

(চ) বিপদে-আপদে সাহায্য করা : কোন মানুষের পক্ষে পৃথিবীতে একাকী বাস করা সম্ভব নয়। বিভিন্ন প্রয়োজনে একে অপরের সাহায্য ছাড়া মানুষ চলতে পারে না। এছাড়াও নানা বিপদসঙ্কুল পরিস্থিতিতে অন্যের সাহায্যের প্রয়োজন পড়ে। কেননা কোন মানুষ যখন কোন বিপদের সম্মুখীন হয়, সে তখন সবচেয়ে বেশি অসহায়ত্ব অনুভব করে। ঐ সময় সে আন্তরিকভাবে অন্যের সাহায্য প্রত্যাশা করে।

ইসলামী শরী‘আতে মুমিনের পারস্পরিক সম্পর্ক হ’ল একটি দেহের ন্যায়। দেহের একটি অঙ্গ যেকোন ধরনের বিপদে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্য অঙ্গ তাকে সাহায্যের জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠে। উদাহরণ স্বরূপ- কারো চোখে কোন কিছু পড়ার সাথে সাথে দেহের অন্যান্য সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আপন কাজ বন্ধ হয়ে যায় এবং তারা সকলে কিভাবে চোখকে তার বিপদ থেকে রক্ষা করবে সেদিকে নিমগ্ন হয়ে পড়ে। প্রয়োজনে অন্যেরও শরণাপন্ন হয়। অনুরূপ কোন মুসলমান ভাই যখন কোন প্রকার বিপদে পড়ে, তখন অপর মুসলমান ভাইয়ের কর্তব্য তাকে সাহায্য করা। কেননা যে মানুষকে সাহায্য করে আল্লাহ তাকে সাহায্য করেন।

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোন মুমিনের পার্থিব দুঃখ-কষ্ট দূর করবে, আল্লাহ ক্বিয়ামতে তার দুঃখ-কষ্ট দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোন সংকটাপন্ন ব্যক্তির সংকট নিরসন করবে, আল্লাহ তার দুনিয়া ও আখিরাতের যাবতীয় সংকট নিরসন করে দিবেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখে, আল্লাহ দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন। আর আল্লাহ ততক্ষণ পর্যন্ত বান্দার সাহায্য করে থাকেন, যতক্ষণ পর্যন্ত বান্দা নিজ ভাইয়ের সাহায্যে রত থাকে।[3]

অপর এক হাদীছে রাসূল (ছাঃ) বলেন, প্রত্যেক মুসলমানের উপর ছাদাক্বা করা ওয়াজিব। একজন প্রশ্ন করলেন, যদি কারো সে সামর্থ্য না থাকে, তবে কি হবে? ... ছাহাবাদের পর্যায়ক্রমিক প্রশ্নের উত্তরে এক পর্যায় তিনি বলেন, فَيُعِيْنُ ذَا الْحَاجَةِ الْمَلْهُوْفَ ‘তাহ’লে কোন দুঃখে বা বিপদে পতিত ব্যক্তিকে সাহায্য করবে’।[4] 

কোন মানুষের কঠিন বিপদের মুহূর্তে যখন কেউ তাকে সাহায্য করে, তখন তার সে সাহায্যের কথা সে কখনো ভোলে না। যারা বিপদগ্রস্ত মানুষের সাহায্যকারী হয়, তারাই প্রকৃত বন্ধু। এজন্য ইংরেজীতে প্রবাদ আছে, A friend in need is a friend indeed. ‘বিপদের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু’। তাই ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধিতে এটি একটা বড় উপাদান।

(ছ) রুগ্ন ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া : মানব জীবনে বিপদ-আপদের যতগুলো ক্ষেত্র আছে, তার মধ্যে অসুস্থতা অন্যতম। দুনিয়াবী জীবনে মানুষ যে কত বড় অসহায়, তার বাস্তব উপলব্ধি ঘটে অসুস্থ অবস্থায়। এমত পরিস্থিতিতে কোন শত্রুও যদি দেখা করতে আসে বা তার সাহায্যে এগিয়ে আসে, তবে সে তাকে আর শত্রু মনে করে না। সে তখন তার নিকটে পরম বন্ধুতে পরিণত হয় এবং তার অন্তরে ঐ শত্রুর জন্য আলাদা একটা স্থানও তৈরী হয়ে যায়। তাই রুগ্ন ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া বা সাধ্যমত তার দেখ-ভাল করা ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধির একটা বড় উপায়।

রুগ্ন ব্যক্তির দেখা-শোনার বিষয়টি ইসলামী শরী‘আতও অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, عُوْدُو الْمَرِيْضَ، وَاتَّبِعُوا الْجَنَائِزَ، تُذَكِّرُكُمُ الْآخِرَةَ ‘রুগ্ন ব্যক্তিকে দেখতে যাবে এবং জানাযার অনুসরণ করবে (কাফন-দাফনে অংশগ্রহণ করবে) তাহ’লে তা তোমাকে আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দিবে’।[5] একজন মুসলমানের প্রতি অপর মুসলমানের হক্ব বা কর্তব্য সম্পর্কে যে কয়েকটি হাদীছ বর্ণিত হয়েছে, সেগুলোর প্রত্যেকটিতে عِيَادَةُ الْمَرِيْضِ তথা ‘রোগীর পরিচর্যা’র বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত আছে। এছাড়াও ক্বিয়ামতের ময়দানে রুগ্ন ব্যক্তির পক্ষে মহান আল্লাহ নিজেই ফরিয়াদী হয়ে আদম সন্তানকে জিজ্ঞেস করবেন, ‘হে আদম সন্তান! আমি রুগ্ন ছিলাম তুমি পরিচর্যা করনি’।[6] রুগ্ন ব্যক্তির সেবার মাধ্যমেই প্রভুর নৈকট্য লাভ করা সহজ।

রোগী পরিচর্যার ফযীলত সম্পর্কে অনেক হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ عَادَ مَرِيْضًا خَاضَ فِى الرَّحْمَةِ، حَتَّى إِذَا قَعَدَ اسْتَقَرَّ فِيْهَا. ‘যদি কোন ব্যক্তি কোন রুগীর পরিচর্যা করে, সে রহমতের মধ্যে ডুব দেয়, এমনকি সে যখন সেখানে বসে পড়ে, তখন তো রীতিমতো রহমতের মধ্যেই অবস্থান করে’।[7] আবূ আসমা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত একটি হাদীছে বলা হয়েছে,مَنْ عَادَ أَخَاهُ كَانَ فِىْ خُرْفَةِ الْجَنَّةِ. ‘যে ব্যক্তি তার কোন রুগ্ন ভাইকে দেখতে যায়, সে জান্নাতের ফলমূলের মধ্যে অবস্থান করবে’।[8]

অনুরূপ একটি হাদীছ ছহীহ মুসলিমেও বর্ণিত হয়েছে। যেমন-

عَنْ ثَوْبَانَ عَنِ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ إِنَّ الْمُسْلِمَ إِذَا عَادَ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ لَمْ يَزَلْ فِىْ خُرْفَةِ الْجَنَّةِ حَتَّى يَرْجِعَ، قِيْلَ يَا رَسُوْلَ اللهِ وَمَا خُرْفَةُ الْجَنَّةِ؟ قَالَ جَنَاهَا.

ছাওবান (রাঃ) নবী করীম (ছাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ‘মুসলমান যখন তার রুগ্ন মুসলমান ভাইকে দেখতে যায়, সে ফিরে না আসা পর্যন্ত জান্নাতের ‘খুরফার’ মধ্যে অবস্থান করতে থাকে। জিজ্ঞেস করা হ’ল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! জান্নাতের খুরফা কি? উত্তর দিলেন, তাঁর ফলমূল’।[9]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন, مَنْ عَادَ مَرِيْضًا أَوْ زَارَ أَخًا لَهُ فِى اللهِ نَادَاهُ مُنَادٍ أَنْ طِبْتَ وَطَابَ مَمْشَاكَ وَتَبَوَّأْتَ مِنَ الْجَنَّةِ مَنْزِلاً. ‘কোন ব্যক্তি কোন রুগ্ন ব্যক্তির পরিচর্যা করলে অথবা আল্লাহর উদ্দেশ্যে তার কোন ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করলে, একজন আহবানকারী (অন্য বর্ণনায় রয়েছে আল্লাহ তা‘আলা) তাকে ডেকে ডেকে বলে, তুমি উত্তম কাজ করেছ, তোমার পদচারণা উত্তম হয়েছে এবং জান্নাতে তুমি একটি ঘর তৈরি করে নিয়েছ’।[10]

عَنْ عَلِىٍّ رَضِىَ اللهُ قَالَ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ : مَا مِنْ مُسلِمٍ يَعُوْدُ مُسْلِمًا غُدْوَةً إِلاَّ صَلَّى عَلَيْهِ سَبْعُوْنَ أَلْفَ مَلَكٍ حَتَّى يُمْسِىَ وَإِنْ عَادَه عَشِيَّةً إِلاَّ صَلَّى عَلَيْهِ سَبْعُوْنَ أَلْفَ مَلَكٍ حَتَّى يُصْبِحَ وَكَانَ لَه خَرِيْفٌ فِىْ الْجَنَّةِ.

আলী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, ‘এমন কোন মুসলমান নেই যে সকাল বেলা কোন মুসলমান রোগীকে দেখতে যায়, তার জন্য সন্ধ্যা পর্যন্ত সত্তর হাযার ফেরেশতা দো‘আ না করে। আর সন্ধ্যা বেলা কোন রোগী দেখতে যায় এবং সকাল পর্যন্ত তার জন্য সত্তর হাযার ফেরেশতা দো‘আ না করে। আর তার জন্য জান্নাতে একটি ফলের বাগান সুনির্ধারিত করে দেয়া হয়’।[11]

রুগ্ন ব্যক্তিকে দেখতে গিয়ে নবী করীম (ছাঃ) তাদের জন্য নিম্নোক্ত দো‘আ করতেন- أَذْهِبِ الْبَأسَ رَبَّ النَّاسِ وَاشْفِ أَنْتَ الشَّافِىْ لاَشِفَاءَ إِلاَّ شِفَاؤُكَ شِفَاءً لاَ يُغَادِرُ سَقَمًا. আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) স্বীয় পরিবারের কোন রোগীকে দেখতে গেলে তার গায়ে হাত রেখে বলতেন, ‘হে আল্লাহ! হে মানুষের প্রভু! রোগ দূর কর, রোগ-মুক্তি দান কর। তুমিই রোগ-মুক্তি দানকারী। তোমার রোগ-মুক্তি ছাড়া কোন রোগ-মুক্তি নেই। এমন রোগ-মুক্তি কোন রোগ বাকী রাখে না’।[12]

ইসলামী শরী‘আতে রোগী দেখার বিধান শুধু মুসলমানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল রুগ্ন ব্যক্তির ক্ষেত্রে এ হুকুম সমভাবে প্রযোজ্য। নিম্নের হাদীছ তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

عَنْ أَنَسٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ كَانَ غُلاَمٌ يَهُوْدِىٌّ يَخْدِمُ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَمَرِضَ فَأَتَاهُ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم يَعُوْدُهُ فَقَعَدَ عِنْدَ رَأْسِهِ فَقَالَ لَهُ أَسْلِمْ فَنَظَرَ إِلَى أَبِيْهِ وَهُوَ عِنْدَهُ فَقَالَ أَطِعْ أَبَا الْقَاسِمِ فَِأَسْلَمَ فَخَرَجَ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهُوَ يَقُوْلُ الْحَمْدُ لِلّهِ الَّذِىْ أَنْقَذَهُ مِنَ النَّارِ.

আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, একটি ইহূদী ছেলে নবী করীম (ছাঃ)-এর সেবা করত। একদিন সে অসুস্থ হয়ে পড়ল। তখন নবী (ছাঃ) তাকে দেখতে গেলেন। তিনি তার মাথার কাছে বসলেন। তারপর তাকে বললেন, তুমি ইসলাম গ্রহণ কর। সে তার পিতার দিকে তাকাল। তার পিতা তার কাছেই ছিল। তখন তার পিতা বলল, তুমি আবুল কাসেমের আনুগত্য কর। তখন ছেলেটি ইসলাম গ্রহণ করল। অতঃপর নবী (ছাঃ) এই কথা বলতে বলতে সেখান থেকে বের হ’লেন, ‘সমস্ত প্রশংসা সেই সত্তার, যিনি তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়েছেন’।[13]

(জ) দো‘আ ও কল্যাণ কামনা করা : মানব জীবনের সকল কল্যাণ-অকল্যাণের মূল চাবিকাঠি সর্বশক্তিমান আল্লাহর হাতে। তাই যেকোন সমস্যার সমাধান বা আশা-আকাঙ্খা পূরণের ক্ষেত্রে সাধ্যমত নিজ প্রচেষ্টার পাশাপাশি আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করতে হবে। সেক্ষেত্রে নিজের জন্য চাওয়ার পাশাপাশি দ্বীনী ভাইয়ের জন্যও প্রার্থনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে মুমিন ভাইয়ের প্রতি একটা পারস্পরিক আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। সাথে সাথে বন্ধুত্ব ও ভালবাসা বৃদ্ধি পায়। কোন ব্যক্তি যখন জানতে পারে যে, আমার অমুক দ্বীনী ভাই প্রভুর নিকটে আমার কল্যাণের জন্য প্রার্থনা করছে, তখন নিজের অজান্তেই তার হৃদয়ের মণিকোঠায় ঐ দ্বীনী ভাইয়ের জন্য একটা স্থায়ী আসন তৈরী হয়ে যায়। অর্থাৎ সে ঐ ভাইয়ের এহেন আচরণে যারপরনাই মুগ্ধ হয়। এমতাবস্থায় পরস্পরের অন্তরের সকল মলিনতা, বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি বিদূরিত হয়, যা তাদের পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় সুদৃঢ় করে।

মুসলমানের পারস্পরিক দো‘আ ও কল্যাণ কামনার অন্যতম মাধ্যম হ’ল ‘সালাম’। তাছাড়াও ছালাতের ভিতরে ও বাইরে দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন দো‘আয় নিজের কল্যাণ প্রার্থনার পাশাপাশি মুমিন ভাইয়ের জন্যও দো‘আ ও ক্ষমা প্রার্থনার বিধান রয়েছে। যেমন জানাযার ছালাতের দো‘আ।

(ঝ) যথোপযুক্ত সম্মান করা : প্রত্যেক মানুষকে তার পদমর্যাদা অনুযায়ী সম্মান করতে হবে, এটাই শারঈ হুকুম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, يَا مَعْشَرَ مَنْ أَسْلَمَ بِلِسَانِهِ وَلَمْ يُفْضِ الْإِيْمَانُ إِلَى قَلْبِهِ، لاَ تُؤْذُوا الْمُسْلِمِيْنَ وَلاَ تُعَيِّرُوْهُمْ وَلاَ تَتَّبِعُوْا عَوْرَاتِهِمْ، فَإِنَّهَ مَنْ تَتَبَّعَ عَوْرَةَ أَخِيْهِ اَلْمُسْلِمِ تَتَبَّعَ اللهُ عَوْرَتَهُ، وَمَنْ تَتَبَّعَ اللهُ عَوْرَتَهُ يَفْضَحْهُ وَلَوْ فِىْ جَوْفِ رَحْلِهِ. ‘হে ঐ সকল লোক! যারা মুখে ইসলাম গ্রহণ করেছে, কিন্তু ঈমান তাদের অন্তরে প্রোথিত হয়নি, তোমরা মুসলমানদেরকে কষ্ট দিয়ো না, তাদেরকে ভৎর্সনা কর না এবং তাদের দোষ-ত্রুটি অনুসন্ধান কর না। কেননা যে তার মুসলিম ভাইয়ের দোষ-ত্রুটি অনুসন্ধান করে বেড়ায়, আল্লাহ তার দোষ-ত্রুটি অনুসন্ধান করবেন। আর আল্লাহ যার দোষ-ত্রুটি অনুসন্ধান করবেন, তাকে অপদস্থ করবেন, সে তার বাড়ীতে অবস্থান করলেও’।[14] তবে অতিরঞ্জিতভাবে কারো সম্মান করা বা প্রশংসা করা ইসলামী শরী‘আতে নিষেধ। এমনকি কারো সামনা সামনি প্রশংসা করাও নিষেধ।[15] কেননা এর মাধ্যমে মানুষের অন্তরে অহংকার পয়দা হয়। যা তার জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ। কেননা কোন ব্যক্তির অন্তরে সরিষা পরিমাণ অহংকার থাকলে, সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।[16] অর্থাৎ অহংকারের শেষ পরিণতি জাহান্নাম।

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ اللهُ تَعَالَى اَلْكِبْرِيَاءُ رِدَائِىْ وَالْعَظْمَةُ إِزَارِىْ فَمَنْ نَازَعَنِىْ وَاحِدًا مِّنْهُمَا أَدْخَلْتُهُ النَّارَ وَفِىْ رِوَايَةٍ : قَذَفْتُهُ فِى النَّارِ.

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘অহংকার আমার চাদর এবং শ্রেষ্ঠত্ব আমার ইযার। সুতরাং যে ব্যক্তি এর কোন একটি নিয়ে আমার সাথে টানাটানি করবে, আমি তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাব। অপর বর্ণনায় আছে, তাকে আমি জাহান্নামে নিক্ষেপ করব’।[17]

অপরদিকে বয়সানুপাতে মানুষের প্রতি পারস্পরিক সম্মান ও ভালবাসা পোষণ করা উচিত। এ মর্মে রাসূল (ছাঃ) বহু হাদীছ বর্ণনা করেছেন। যেমন-

عَنْ أَبِىْ أُمَامَةَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ مَنْ لَمْ يَرْحَمْ صَغِيْرَنَا وَيُجِلُّ كَبِيْرَنَا فَلَيْسَ مِنَّا.

আবূ উমামা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ছোটদের প্রতি দয়া করে না এবং বড়দের প্রতি সম্মান করে না, সে আমাদের দলভুক্ত নয়’।[18] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন, إِنَّ مِنْ إجْلاَلِ اللهِ إِكْرَامَ ذِى الشَّيْبَةِ الْمُسْلِمِ ... ‘মুসলিম বয়োবৃদ্ধকে সম্মান করা আল্লাহকে সম্মান করার নামান্তর...’।[19] শুধু ছোট বা বড়দের ক্ষেত্রে নয়, ধনী-দরিদ্র, ব্যবসায়ী-চাকুরীজীবি, উঁচু-নীচু তথা সমাজের সর্বস্তরে পারস্পরিক মান-মর্যাদা প্রদান করা হ’লে একদিকে যেমন ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধি পাবে, অন্যদিকে সে সমাজে পূর্ণমাত্রায় শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে এতে কোনই সন্দেহ নেই।

[চলবে]


[1]. মুসলিম হা/২৫৬৭; মিশকাত, হা/৫০০৭।

[2]. মুওয়াত্ত্বা মালেক, মিশকাত হা/৫০১১, বঙ্গানুবাদ রিয়াযুছ ছালেহীন, হা/৩৮৩।

[3]. মুসলিম, তিরমিযী হা/১৯৩০; আবুদাঊদ হা/৪৯৪৬।

[4]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ; আল-আদাবুল মুফরাদ, হা/২২৫; মিশকাত হা/১৮৯৫।

[5]. আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৫১৮; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৯৮১, হাদীছ ছহীহ

[6]. মুসলিম হা/২৫৬৯; মিশকাত হা/১৫২৮

[7]. আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৫২২, হাদীছ ছহীহ

[8]. আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৫২১, হাদীছ ছহীহ

[9]. মুসলিম হা/২৫৬৮, বঙ্গানুবাদ রিয়াযুছ ছালেহীন, হা/৮৯৯।

[10]. তিরমিযী হা/২০০৮, হাদীছ হাসান; মিশকাত হা/৫০১৫

[11]. তিরমিযী হা/৯৬৯, হাদীছ ছহীহ, আবূদাউদ, বঙ্গানুবাদ রিয়াযুছ ছালেহীন, হা/৯০০।

[12]. বুখারী হা/৫৬৭৫, ৫৭৫০; মিশকাত হা/১৫৩০।

[13]. বুখারী, বঙ্গানুবাদ রিয়াযুছ ছালেহীন, হা/৯০১।

[14]. তিরমিযী হা/২০৩২, হাদীছ হাসান, ‘মুমিনকে সম্মান করা’ অনুচ্ছেদ

[15]. তিরমিযী হা/২৩৯৩, ২৩৯৪, হাদীছ ছহীহ

[16]. মুসলিম, মিশকাত হা/৫১০৭

[17]. মুসলিম, মিশকাত ‘ক্রোধ ও অহংকর’, হা/৫১১০।

[18]. আল-আদাবুল মুফরাদ, হা/৩৫৬ হাদীছ হাসান ছহীহ।

[19]. আবূদাঊদ হা/৪৮৪৩, হাদীছ হাসান, ‘মানুষকে তার পদমর্যাদা অনুযায়ী সম্মান প্রদান করা’ অনুচ্ছেদ; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৩৫৭






বিষয়সমূহ: নীতি-নৈতিকতা
ক্বিয়ামতের আলামত সমূহ (৩য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে ‘আত-তাহরীক’-এর ভূমিকা - বযলুর রশীদ
মাদ্রাসার পাঠ্যবই সমূহের অন্তরালে (৭ম কিস্তি) - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ছিয়ামের ফাযায়েল ও মাসায়েল - আত-তাহরীক ডেস্ক
মুসলিম সমাজে মসজিদের গুরুত্ব (৪র্থ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
গোপন ইবাদত : গুরুত্ব ও তাৎপর্য - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
মুসলিম সমাজে মসজিদের গুরুত্ব (৫ম কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
আল-কুরআনের আলোকে ক্বিয়ামত (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - রফীক আহমাদ - বিরামপুর, দিনাজপুর
জান্নাতের পথ - ড. নূরুল ইসলাম
মুসলিম সমাজে মসজিদের গুরুত্ব (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
সীমালংঘন ও দুনিয়াপূজা : জাহান্নামীদের দুই প্রধান বৈশিষ্ট্য (৪র্থ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
আযান ও ইক্বামত : বিভ্রান্তি নিরসন - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
আরও
আরও
.