ভূমিকা :
ইসলাম যে পাঁচটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত তার অন্যতম হ’ল যাকাত। ওশর হ’ল ফসলের যাকাত। ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ প্রভৃতি ইবাদতের মতই ওশর ফরয ইবাদত। আমাদের দেশের মুসলমানগণ যাকাতের সাথে কিছুটা পরিচিত হ’লেও ওশরের সাথে তেমন পরিচিত নয়। তাছাড়া ওশর যে ফরয ইবাদত এ সম্পর্কে অনেকের জানা নেই। অথচ ওশর ইসলামী অর্থনীতির মূল উৎস। যাকাত ও ওশর ব্যবস্থা চালু থাকলে দেশে দরিদ্রতা থাকতো না। কেননা যাকাত ও ওশর দারিদ্র্য বিমোচনের এক শক্তিশালী হাতিয়ার। এ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে পারলে অর্থনৈতিক মুক্তি আসবে। যার বাস্তব প্রমাণ আমরা দেখতে পাই খোলাফায়ে রাশেদার যুগে। আলোচ্য প্রবন্ধে আমরা ওশর সম্পর্কে আলোচনার করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
ওশরের পরিচয় :
‘ওশর’ আরবী শব্দ। যার অর্থ এক-দশমাংশ, দশ ভাগের এক ভাগ, জমির উৎপন্ন দ্রব্যের এক দশমাংশ।[1] ইসলামী শরী‘আতের পরিভাষায় জমিতে উৎপাদিত ফসলের যাকাতকে ওশর বলা হয়। আল-মু‘জামুল ওয়াসীত গ্রন্থে বলা হয়েছে, ما يؤخذ من زكاة الارض التي أسلم أهلها عليها. و هي التي أحياها المسلمون من الأرضين والقطائع ‘জমির উৎপাদিত ফসলের যাকাতকে ওশর বলা হয়, যা তার মালিক আদায় করে থাকে। আর এটি ইসলামে সেই বিধান যা মুসলমানগণ বিভিন্ন এলাকায় চালু রেখেছেন’।[2]
ওশর ফরয হওয়ার দলীল :
আল্লাহ তা‘আলা মানুষ সৃষ্টি করে পৃথিবীতে বসবাসের ব্যবস্থা করেছেন। আর পৃথিবীকে বসবাস উপযোগী করে যমীনকে করেছেন মানুষের জীবিকা নির্বাহের প্রধান উৎস। আল্লাহ বলেন, وَلَقَدْ مَكَّنَّاكُمْ فِيْ الْأَرْضِ وَجَعَلْنَا لَكُمْ فِيْهَا مَعَايِشَ قَلِيْلاً مَّا تَشْكُرُوْنَ، ‘আর আমরা তোমাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করেছি এবং তোমাদের জন্য সেখানে জীবিকা সমূহ প্রদান করেছি। কিন্তু তোমরা খুব কমই কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে থাক’ (আ‘রাফ ৭/১০)।
আর যমীন হ’তে উৎপাদিত ফসলের যাকাত ফরয করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَنْفِقُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا كَسَبْتُمْ وَمِمَّا أَخْرَجْنَا لَكُمْ مِنَ الْأَرْضِ وَلَا تَيَمَّمُوا الْخَبِيثَ مِنْهُ تُنْفِقُونَ وَلَسْتُمْ بِآخِذِيهِ إِلَّا أَنْ تُغْمِضُوا فِيهِ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللهَ غَنِيٌّ حَمِيدٌ، ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা যা উপার্জন কর এবং যা আমরা তোমাদের ৯জন্য ভূমিতে উৎপন্ন করি, সেখান থেকে উৎকৃষ্ট বস্ত্ত ব্যয় কর। আর সেখান থেকে নিকৃষ্ট বস্ত্ত ব্যয় করার সংকল্প করো না, যা তোমরা অন্যের কাছ থেকে নিতে চাওনা চোখ বন্ধ করা ব্যতীত। জেনে রেখ আল্লাহ অভাবমুক্ত ও চির প্রশংসিত (বাক্বারাহ ২/২৬৭)। আল্লাহ আরো বলেন,وَهُوَ الَّذِي أَنْشَأَ جَنَّاتٍ مَعْرُوشَاتٍ وَغَيْرَ مَعْرُوشَاتٍ وَالنَّخْلَ وَالزَّرْعَ مُخْتَلِفًا أُكُلُهُ وَالزَّيْتُونَ وَالرُّمَّانَ مُتَشَابِهًا وَغَيْرَ مُتَشَابِهٍ كُلُوا مِنْ ثَمَرِهِ إِذَا أَثْمَرَ وَآتُوا حَقَّهُ يَوْمَ حَصَادِهِ وَلَا تُسْرِفُوا إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ ‘তিনিই সেই সত্তা যিনি বাগিচাসমূহ সৃষ্টি করেছেন মাচান বিশিষ্ট ও মাচান ছাড়াই এবং সৃষ্টি করেছেন খর্জুর বৃক্ষ ও শস্যক্ষেত সমূহ, যেগুলির স্বাদ ভিন্ন ভিন্ন। আর সৃষ্টি করেছেন জলপাই ও ডালিম বৃক্ষ, পরস্পরে সাদৃশ্যপূর্ণ ও সাদৃশ্যহীন। তোমরা এগুলোর ফল ভক্ষণ কর যখন তা ফলবন্ত হয় এবং এগুলির হক আদায় কর ফসল কাটার দিন। আর তোমরা অপচয় করো না। নিশ্চয় আল্লাহ অপচয়কারীদের ভালবাসেন না’ (আন‘আম ৬/১৪১)।
ওশরের নিছাব :
আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, فِيمَا سَقَتِ السَّمَاءُ وَالْعُيُونُ أَوْ كَانَ عَثَرِيًّا الْعُشْرُ، وَمَا سُقِىَ بِالنَّضْحِ نِصْفُ الْعُشْرِ- ‘বৃষ্টি ও ঝর্ণার পানিতে উৎপন্ন ফসল বা নালার পানিতে উৎপন্ন ফসলের ওশর (১০ ভাগের এক ভাগ) এবং সেচা পানিতে হ’লে অর্ধ ওশর (২০ ভাগের এক ভাগ) যাকাত ওয়াজিব’।[3] এতে এক বছর অতিক্রম হওয়ার শর্ত নেই।[4]
উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে উদ্বৃত্ত ফসলে ওশর হবে। আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, يَقْضِي مَا أَنْفَقَ عَلَى الثَّمَرَةِ ثُمَّ يُزَكِّي مَا بَقِيَ، ‘প্রথমত ফসল উৎপাদনে যা খরচ করেছে তা পরিশোধ করবে, অতঃপর অবশিষ্টাংশের যাকাত আদায় করবে’।[5]
আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لَيْسَ فِيمَا أَقَلُّ مِنْ خَمْسَةِ أَوْسُقٍ صَدَقَةٌ، ‘পাঁচ অসাক্বের কম শস্যে যাকাত নেই’।[6]
উল্লেখ্য যে, ১ অসাক্ব সমান ৬০ ছা‘। ৫ অসাক্ব সমান ৬০×৫=৩০০ ছা‘। আর মাদানী ১ ছা‘ সমান এদেশের আড়াই কেজি ধরা হ’লে ৩০০ ছা‘ সমান ৩০০×২.৫০=৭৫০ কেজি। তথা ১৮ মন ৩০ কেজি।
নদী বা বৃষ্টির পানিতে এই পরিমাণ হ’লে ১০ ভাগের ১ ভাগ। আর সেচের পানিতে হ’লে ২০ ভাগের ১ ভাগ।[7]
প্রত্যেক ফসলের আলাদা নিছাব :
ওশর ফরয হওয়ার জন্য প্রত্যেক ফসল যেমন গম, যব, ধান ইত্যাদি পৃথক পৃথকভাবে নেছাব পরিমাণ হ’তে হবে। কয়েকটি ফসল মিলিতভাবে নয়। কোন ব্যক্তির কৃত্রিম সেচের মাধ্যমে ১০ মণ ধান ও ১০ মণ গম উৎপন্ন হ’লে তার জন্য উভয় ফসল একত্রিত করে ওশর ফরয হবে না।[8] তবে একই ফসলের বিভিন্ন শ্রেণী একই নিছাবের অন্তর্ভুক্ত। যেমন আটাশ, পারিজা, স্বর্ণা সহ বিভিন্ন শ্রেণীর ধান একই নিছাবের অন্তর্ভুক্ত।[9]
যেসব ফসলের ওশর ফরয :
যেসব ফসল জমিতে উৎপন্ন হয়ে মানুষের সাধারণ খাদ্য হিসাবে বিবেচিত হয় এবং তা ওযন ও গুদামজাত করা যায়, সে সকল ফসলেই কেবল ওশর ফরয। ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, إِنَّمَا سَنَّ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم الزَّكَاةَ فِيْ هَذِهِ الأَرْبَعَةِ الْحِنْطَةِ وَالشَّعِيْرِ وَالزَّبِيْبِ وَالتَّمْرِ، ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) গম, যব, কিসমিস এবং খেজুর এই চারটি শস্যের যাকাত প্রবর্তন করেছেন’।[10]
উল্লেখ্য যে, হাদীছে বর্ণিত চারটি শস্যের ওশরের কথা বলা হ’লেও এই চারটিকেই নির্দিষ্ট করা হয়নি। বরং ওযন ও গুদামজাত সম্ভব সকল শস্যই ওশরের অন্তর্ভুক্ত। যেমন ধান, ভুট্টা ইত্যাদি।
মধু নিছাব পরিমাণ হ’লে তার ওশর আদায় করতে হবে। ‘আমর বিন শো‘আয়েব তার পিতা ও দাদা হ’তে এবং তিনি নবী করীম (ছাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে,أَنَّهُ أَخَذَ مِنَ الْعَسَلِ الْعُشْرَ- ‘তিনি মধু থেকে এক-দশমাংশ যাকাত গ্রহণ করেছেন’।[11] একই রাবী হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, বনু মুত‘আন গোত্রের হেলাল (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট তার মধুর ওশর নিয়ে হাযির হন। তিনি তাঁর নিকট ‘সালাবাহ’ (سَلَبَةُ) নামক উপত্যকাটি বন্দোবস্ত চান। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে উক্ত উপত্যকা বন্দোবস্ত দেন। অতঃপর ওমর (রাঃ) যখন খলীফা হন, তখন ত্বায়েফের গভর্ণর সুফিয়ান বিন ওয়াহাব এ বিষয়ে জানতে চেয়ে খলীফার নিকট পত্র লেখেন। জবাবে খলীফা তাকে লিখিতভাবে জানান যে, ঐ ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট মধুর যে ওশর দিত, তা যদি তোমাকে দিতে থাকে, তবে ‘সালাবাহ’ উপত্যকায় তার বন্দোবস্ত বহাল রাখ। অন্যথা তা বনের মৌমাছি হিসাবে গণ্য হবে এবং যে কোন ব্যক্তি সেখান থেকে মধু আহরণ করতে পারবে’। রাবী বলেন,مِنْ كُلِّ عَشْرِ قِرَبٍ قِرْبَةٌ، ‘প্রতি ১০ মশকে ১ মশক যাকাত’।[12]
ত্বায়েফের বনু শাবাবাহর লোকেরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট মধুর যাকাত জমা দিত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মধু চাষের জন্য দু’টি সমতল ভূমিকে তাদের অনুকূলে বন্দোবস্ত দেন।[13]
অতএব যখনই মধু নিছাব পরিমাণ হবে, তখনই ওশর আদায় করতে হবে। এর জন্য বছর অতিক্রান্ত হওয়া শর্ত নয়। কিন্তু যদি কেউ অজ্ঞতা বশে ওশর না দিয়ে থাকেন, তিনি অবশ্যই মৌ চাষ থেকে পাওয়া সঞ্চিত অর্থের বছর শেষে যাকাত দিবেন।
উল্লেখ্য যে, মৌ চাষের ফলে সরিষার ফলন ২০ ভাগ বৃদ্ধি পায়। শুধু সরিষাই নয়, মৌমাছিরা ফুলের পরাগায়ন ঘটিয়ে নানা ধরনের রবি শস্য এবং আম, লিচু, কুল, কালোজিরা প্রভৃতির ফলন বৃদ্ধি করে। প্রতি বাক্স থেকে সপ্তাহে ৪-৫ কেজি মধু সংগ্রহ করা যায়। তবে অগ্রহায়ণ ও পৌষ মাসে মধু সংগ্রহ বেশী হয়। ফলে মৌ চাষে একদিকে যেমন সরিষার উৎপাদন বাড়ে, অন্যদিকে তেমন অল্প খরচে মৌ চাষ করে বেকারত্ব দূর করা যায়। জমি বা গাছের মালিকরাও মৌ চাষীদের নিকট এগুলি ভাড়া দিয়ে লাভবান হ’তে পারেন। মধুর ওশরও অন্যান্য ফসলের ন্যায়।[14]
যেসব ফসলের ওশর ফরয নয় :
গুদামজাত অসম্ভব এমন শস্যের ওশর ফরয নয়। যেমন শাক-সবজি বা কাঁচা মালের কোন ওশর নেই। ত্বালহা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,لَيْسَ فِى الْخَضْرَوَاتِ زَكَاةٌ، ‘শাক-সব্জিতে কোন যাকাত (ওশর) নেই’।[15] অর্থাৎ কাঁচামালের কোন ওশর নেই। সেকারণ আলু, রসুন, পেঁয়াজ, লাউ, কুমড়া, পটল, বেগুন বা এ জাতীয় শাক-সব্জির উপর ওশর ফরয নয়। একইভাবে কোন জমিতে ফসলের পরিবর্তে মাছ চাষ করলেও তার উপর ওশর ফরয হবে না। বরং এ জাতীয় সম্পদের বিক্রয়লব্ধ অর্থ এক বছর অতিক্রম করলে এবং নিছাব পরিমাণ হ’লে শতকরা ২.৫০ টাকা হারে যাকাত দিতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, لاَ زَكَاةَ فِيْ مَالٍ حَتَّى يَحُوْلَ عَلَيْهِ الْحَوْلُ ‘এক বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বে মালের যাকাত নেই’।[16] তবে কাঁচামালে ওশর ফরয না হ’লেও মালিক চাইলে তা থেকে স্বেচ্ছায় কিছু দান করতে পারেন। এতে তিনি ছওয়াবের অধিকারী হবেন। কেননা আল্লাহ বলেন,فَمَنْ تَطَوَّعَ خَيْرًا فَهُوَ خَيْرٌ لَّهُ، ‘অতঃপর যদি কেউ স্বেচ্ছায় বেশী দেয়, সেটা তার জন্য কল্যাণকর হবে’ (বাক্বারাহ ২/১৮৪)।
ওশর আদায়ের সময় :
ফসল পরিপক্ক হওয়ার পর যেদিন তা কর্তন করা হবে সেদিনই ওশর আদায় করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَآتُوْا حَقَّهُ يَوْمَ حَصَادِهِ، ‘তোমরা এগুলির হক আদায় কর ফসল কাটার দিন’ (আন‘আম ৬/১৪১)। উল্লেখ্য যে, শস্য কর্তন করে তা সংরক্ষণের জন্য যথাস্থানে রাখার পূর্বে নষ্ট হয়ে গেলে বা হারিয়ে গেলে তার উপর ওশর ফরয নয়। তবে তা সংরক্ষণের জন্য যথাস্থানে রাখার পরে মালিকের অলসতা বা অবহেলার কারণে নষ্ট হয়ে গেলে বা হারিয়ে গেলে তার উপর ওশর ফরয। আর তা সংরক্ষণের যথাসাধ্য চেষ্টা করার পরে নষ্ট বা হারিয়ে গেলে তার উপর ওশর ফরয নয়।[17]
ওশর বণ্টনের খাত সমূহ :
মুসলমানদের সকল সম্পদের যাকাত যেমন গৃহপালিত পশু, সোনা-রূপা ও মুদ্রা, ব্যবসায়ের মাল, খনিজ সম্পদ ও ফসলের ওশর আদায় এবং তার ব্যয়ের খাত স্বয়ং আল্লাহ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তাই ফসল কাটার পর তা পরিমাপ করে নিছাব পরিমাণ হ’লে তার ওশর অবশ্যই নির্ধারিত খাতে ব্যয় করতে হবে। আল্লাহ বলেন,إِنَّمَا الصَّدَقَاتُ لِلْفُقَرَآءِ وَالْمَسَاكِينِ وَالْعَامِلِينَ عَلَيْهَا وَالْمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمْ وَفِي الرِّقَابِ وَالْغَارِمِينَ وَفِي سَبِيلِ اللهِ وَابْنِ السَّبِيلِ فَرِيضَةً مِّنَ اللهِ وَاللهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ- ‘ছাদাক্বা সমূহ কেবল ফক্বীর, মিসকীন, যাকাত আদায়ের কর্মচারী, ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট ব্যক্তি, দাসমুক্তি, ঋণগ্রস্ত, আল্লাহর রাস্তায় এবং (দুস্থ) মুসাফিরদের জন্য। এটি আল্লাহর পক্ষ হ’তে নির্ধারিত। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়’ (তওবা ৯/৬০)। এখানে ‘ছাদাক্বা সমূহ’ অর্থ ফরয যাকাত, যা সকল প্রকার সম্পদের যাকাত ও ওশরকে শামিল করে। উক্ত আয়াতে আল্লাহ ৮টি খাত উল্লেখ করেছেন। সেকারণ নির্ধারিত খাতসমূহে ওশর বণ্টন করতে হবে।
ওশর সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা :
অনেকের ধারণা, যে জমির খাজনা দেওয়া হয় সে জমির উৎপাদিত ফসলের ওশর দিতে হবে না। এটি একেবারে ভুল কথা। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে কোন দলীল নেই। রাষ্ট্রকে যে পরিমাণ ট্যাক্সই দেওয়া হোক না কেন, তাতে ওশর আদায় হবে না। কারণ ওশর হ’ল ফরয ইবাদত, যা নির্দিষ্ট নিয়মে ও নির্দিষ্ট খাতে ব্যয় করতে হয়। আর ট্যাক্স হ’ল সরকারী কর, যা মুসলিম-অমুসলিম সবার জন্য প্রযোজ্য। এটিই জমহূর ওলামায়ে কেরামের মত।[18] খাজনার জমিতে ওশর দিতে হবে কি-না এ ব্যাপারে ওমর ইবনু আব্দুল আযীয (রহঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বলেন, الْخَرَاجُ عَلَى الأَرْضِ وَفِى الْحَبِّ الزَّكَاةُ ‘খাজনা হ’ল জমির উপর আর যাকাত (ওশর) হ’ল ফসলের উপর’।[19] অর্থাৎ খাজনা হ’ল ভূমিকর আর ওশর হ’ল ফসলের কর।
খাজনার জমিতে ওশর দিতে হয় না মর্মে যে দলীল পেশ করা হয়ে থাকে لاَ يَجْتَمِعُ عَلَى الْمُسْلِمِ خَرَاجٌ وَعُشْرٌ، ‘মুসলমানের উপর একই সাথে খাজনা ও ওশর একত্রিত হয় না।[20] এটিকে ইমাম বায়হাক্বী বাতিল বলেছেন। কেননা হাদীছের বর্ণনাকারী ইয়াহইয়া ইবনু আনবাসাহ হাদীছ জাল করার দোষে দুষ্ট।[21]
মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে ওশর :
ওশর দারিদ্র্য দূরীকরণের এক শক্তিশালী মাধ্যম। যাকাত যেভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রে সম্পদের প্রবাহ সৃষ্টি করে তেমনি ওশরও সম্পদের প্রবাহ সৃষ্টি করে দারিদ্র্য দূরীকরণে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে পারে। আল্লাহ তা‘আলা যমীন থেকে উৎপাদিত ফসলের ওশর প্রদানের নির্দেশ দিয়ে বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَنْفِقُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا كَسَبْتُمْ وَمِمَّا أَخْرَجْنَا لَكُمْ مِنَ الْأَرْضِ وَلَا تَيَمَّمُوا الْخَبِيثَ مِنْهُ تُنْفِقُونَ وَلَسْتُمْ بِآخِذِيهِ إِلَّا أَنْ تُغْمِضُوا فِيهِ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللهَ غَنِيٌّ حَمِيدٌ، ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা যা উপার্জন কর এবং যা আমরা তোমাদের জন্য ভূমিতে উৎপন্ন করি, সেখান থেকে উৎকৃষ্ট বস্ত্ত ব্যয় কর। আর সেখান থেকে নিকৃষ্ট বস্ত্ত ব্যয় করার সংকল্প করো না, যা তোমরা অন্যের কাছ থেকে নিতে চাওনা চোখ বন্ধ করা ব্যতীত। জেনে রেখ আল্লাহ অভাবমুক্ত ও চির প্রশংসিত’ (বাক্বারাহ ২/২৬৭)।
যাকাত ও ওশর আদায়ের জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যুগের চাহিদা মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করছিলেন। মূসা ইবনু ত্বালহা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, عِنْدَنَا كِتَابُ مُعَاذٍ عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم أَنَّهُ إِنَّمَا أَخَذَ الصَّدَقَةَ مِنَ الْحِنْطَةِ وَالشَّعِيْرِ وَالزَّبِيْبِ وَالتَّمْرِ، ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কর্তৃক মু‘আয (রাঃ)-এর নিকট প্রেরিত পত্র আমাদের নিকট ছিল। যাতে তিনি গম, যব, কিসমিস ও খেজুরের যাকাত গ্রহণ করেছেন’।[22]
তাই ওশর নিমেণাক্তভাবে দারিদ্র্য বিমোচন করতে পারে-
১. যাকাতের ন্যায় ওশর ব্যক্তিকে পবিত্র করে। আর পবিত্র হৃদয়ের ব্যক্তি খোলা মনে দরিদ্রদের সাহায্য-সহযোগিতা করার মাধ্যমে সমাজ থেকে দারিদ্র্য দূর করে। যেমন আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন,خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيهِمْ بِهَا، ‘তুমি তাদের সম্পদ থেকে ছাদাক্বা গ্রহণ কর। যা দ্বারা তুমি তাদেরকে (কৃপণতার কলুষ হ’তে) পবিত্র করবে ও পরিশুদ্ধ করবে’ (তওবা ৯/১০৩)।
২. ওশর ও ছাদাক্বায় সম্পদের প্রবৃদ্ধি ঘটে। ফলে সমাজ থেকে দরিদ্রতা উঠে যায়। এতে দাতার সম্পদও কমে না বরং তাতে আরো বরকত হয়। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَا نَقَصَتْ صَدَقَةٌ مِّنْ مَّالٍ، ‘ছাদাক্বায় সম্পদ হ্রাস পায় না’।[23] কেননা ধনীর দেওয়া যাকাত ও ওশর পেয়ে হকদার গণ ধনীর সম্পদ ক্রয় করে থাকে। ফলে তা পুনরায় ধনীর ঘরে ফিরে যায়। এভাবে সমাজে সম্পদের প্রবাহ বজায় থাকে।
৩. দেশে যাকাত ও ওশর আদায় ও যথাযথ বণ্টনের ব্যবস্থা থাকলে গাছ তলা ও পাঁচ তলার ব্যবধান দূরীভূত হবে। গরীব মানুষের অবস্থা উন্নত হবে। ফলে ধনী-গরীবের বৈষম্য দূর হবে। যার বাস্তব প্রমাণ আমরা দেখতে পাই ওমর (রাঃ)-এর যামানায় । রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মু‘আযকে ইয়ামনের গভর্ণর করে পাঠান। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) মারা যান। পরবর্তীতে হযরত ওমরের সময় তিনি সেখানকার এক-তৃতীয়াংশ ছাদাক্বার মাল মদীনায় পাঠান। কিন্তু ওমর (রাঃ) তা নিতে অস্বীকার করে বলেন, আমি তোমাকে সেখানে কর আদায়কারীরূপে পাঠাইনি। বরং তোমাকে পাঠিয়েছি সেখানকার ধনীদের নিকট থেকে ছাদাক্বা নিয়ে সেখানকার হকদারদের মধ্যে তা বিতরণ করার জন্য। জবাবে মু‘আয বললেন, مَا بَعَثْتُ إِلَيْكَ بِشَىْء وَأَنَا أَجِدُ أَحَدًا يَأْخُذُه مِنِّى! ‘আমি আপনার নিকটে কিছু পাঠাতাম না, যদি আমি সেখানে যাকাত নেওয়ার মত কোন হকদার পেতাম! একই কারণে পরের বছর তিনি সেখান থেকে ছাদাক্বার অর্ধাংশ প্রেরণ করেন। তৃতীয় বছর পুরোটাই প্রেরণ করেন। প্রতিবারেই ওমর (রাঃ) আপত্তি করেন এবং প্রতিবারেই মু‘আয (রাঃ) একই জবাব দেন’।[24]
৪. ওশর ও ছাদাক্বাকারীর সাথে সর্বদা আল্লাহ থাকেন। ফলে দানকারী বিপদাপদ থেকে নিরাপদে থাকেন। এতে সমাজে শান্তির সুবাতাস প্রবাহিত হয়। আল্লাহ বলেন,وَقَالَ اللهُ إِنِّي مَعَكُمْ لَئِنْ أَقَمْتُمُ الصَّلاَةَ وَآتَيْتُمُ الزَّكَاةَ وَآمَنْتُمْ بِرُسُلِي وَعَزَّرْتُمُوهُمْ وَأَقْرَضْتُمُ اللهَ قَرْضًا حَسَنًا لَّأُكَفِّرَنَّ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَلَأُدْخِلَنَّكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ، فَمَنْ كَفَرَ بَعْدَ ذَالِكَ مِنْكُمْ فَقَدْ ضَلَّ سَوَآءَ السَّبِيلِ- ‘আর আল্লাহ বলেছিলেন, আমি তোমাদের সাথে আছি। যদি তোমরা ছালাত কায়েম কর, যাকাত আদায় কর, আমার রাসূলগণের উপর বিশ্বাস স্থাপন কর ও তাদেরকে সাহায্য কর এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ দাও, তাহ’লে আমি অবশ্যই তোমাদের পাপ সমূহ মোচন করে দেব এবং অবশ্যই তোমাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবো, যার তলদেশ দিয়ে নদীসমূহ প্রবাহিত হয়। এরপরেও তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি কুফরী করবে, অবশ্যই সে সরল পথ থেকে বিচ্যুত হবে’ (মায়েদাহ ৫/১২)।
৫. ওশর দিলে সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত পাওয়া যায়। ফলে আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হয়ে ফল-ফসলে বরকত হয়। এতে সমাজ থেকে দারিদ্র্য উঠে যায়। নিমেণর হাদীছটি যার যথার্থ উদাহরণ-
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, এক ব্যক্তি একটি মাঠে অবস্থান করছিল। এমন সময় সে মেঘের মধ্যে একটি শব্দ শুনতে পেল : ‘অমুকের বাগানে পানি দাও’। অতঃপর মেঘমালা সেই দিকে সরে গেল এবং এক প্রস্তরময় স্থানে বৃষ্টি বর্ষণ করল। তখন দেখা গেল, সেখানকার নালাগুলির মধ্যে একটি নালা সমস্ত পানি নিজের মধ্যে ঢুকিয়ে নিল। তখন সে ব্যক্তি পানির দিকে এগিয়ে গেল এবং দেখল যে, এক ব্যক্তি তার বাগানে দাঁড়িয়ে সেচযন্ত্র দ্বারা পানি সেচ দিচ্ছে। তখন সে তাকে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর বান্দা! তোমার নাম কি? লোকটি জবাবে বলল, আমার নাম অমুক- যে নাম সে মেঘের মধ্যে শুনেছিল। তখন লোকটি বলল, হে আল্লাহর বান্দা! তুমি কেন আমার নাম জিজ্ঞেস করলে? সে বলল, এই পানি যেই মেঘের তার মধ্যে আমি একটি শব্দ শুনেছি যে, তোমার নাম করে বলা হয়েছে, অমুকের বাগানে পানি দাও! (হে আল্লাহর বান্দা, বল) তুমি তা দ্বারা কি কি কাজ কর? সে উত্তরে বলল, যখন তুমি এ কথা বললে তখন শুনো, এই বৃষ্টির পানিতে যা উৎপাদন হয়, তার প্রতি আমি দৃষ্টিপাত করি এবং তা ভাগ করি। অতঃপরفَأَتَصَدَّقُ بِثُلُثِهِ وَآكُلُ أَنَا وَعِيَالِى ثُلُثًا وَأَرُدُّ فِيهَا ثُلُثَهُ ‘এক-তৃতীয়াংশ দান করি, এক-তৃতীয়াংশ আমি ও আমার পরিবার খাই এবং এক-তৃতীয়াংশ জমিতে লাগাই’।[25]
৬. ওশর দিলে আল্লাহর রহমতে তা বহুগুণ বেড়ে যায়। ফলে তা দারিদ্র্য বিমোচন করে। আল্লাহ বলেন,مَثَلُ الَّذِينَ يُنْفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ فِي سَبِيلِ اللهِ كَمَثَلِ حَبَّةٍ أَنْبَتَتْ سَبْعَ سَنَابِلَ فِي كُلِّ سُنْبُلَةٍ مِّائَةُ حَبَّةٍ، وَاللهُ يُضَاعِفُ لِمَنْ يَّشَآءُ وَاللهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ- ‘যারা আল্লাহর পথে নিজেদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উপমা একটি শস্য বীজের ন্যায়। যা থেকে সাতটি শিষ জন্ম নেয়। প্রতিটি শিষে একশ’টি দানা হয়। আর আল্লাহ যার জন্য চান বহুগুণ বৃদ্ধি করে দেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ প্রাচুর্য দানকারী ও সর্বজ্ঞ’ (বাক্বারাহ ২/২৬১)।
৭. এটি ধনীদের সম্পদে গরীবের হক। এই হক আদায় করলে ধনীদের সম্পদ দরিদ্রদের মাঝে বণ্টিত হয়। ফলে তাদের অবস্থা উন্নত হয় এবং সমাজ থেকে দারিদ্র্য বিমোচিত হয়। আল্লাহ বলেন, وَفِي أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ لِّلسَّآئِلِ وَالْمَحْرُومِ- ‘আর তাদের ধন-সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের জন্য হক রয়েছে’।[26]
৮. ওশর ও যাকাত ব্যবস্থা জারী থাকলে মুসলিম কখনো নিজেকে অসহায় ভাববে না।
৯. ওশর সমাজ ও রাষ্ট্রের আর্থিক ভিতকে মযবূত রাখে। আল্লাহ বলেন,اَلَّذِينَ إِنْ مَّكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلاَةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ وَلِلَّهِ عَاقِبَةُ الْأُمُورِ- ‘তারা এমন লোক, যাদেরকে আমরা যদি পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করি, তাহ’লে তারা ছালাত কায়েম করে, যাকাত আদায় করে, সৎকাজের আদেশ দেয় ও অসৎকাজে নিষেধ করে। বস্ত্তত সকল কাজের পরিণাম আল্লাহর এখতিয়ারাধীন’ (হজ্জ ২২/৪১)।
ওশর অস্বীকারকারীর বিধান :
যে ব্যক্তি ওশরের ফরযিয়াতকে অস্বীকার করে, সে ইসলাম থেকে খারিজ। আর যে ব্যক্তি অবহেলাবশে তা দেয় না, সে ‘ফাসেক’। আল্লাহ বলেন,فَإِنْ تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلاَةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ فَإِخْوَانُكُمْ فِي الدِّينِ وَنُفَصِّلُ الْآيَاتِ لِقَوْمٍ يَّعْلَمُونَ- ‘অতঃপর যদি ওরা তওবা করে এবং ছালাত কায়েম করে ও যাকাত আদায় করে, তাহ’লে ওরা তোমাদের দ্বীনী ভাই। আর আমরা জ্ঞানী লোকদের জন্য আয়াতসমূহ বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে থাকি’ (তওবা ৯/১১)। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, ওশরকে অস্বীকার করলে সে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাবে যদি না সে তওবা করে। একারণেই ১ম খলীফা (১১-১৩ হি.) হযরত আবুবকর (রাঃ) যাকাত জমা দানে অস্বীকার কারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেনوَاللهِ لأُقَاتِلَنَّ مَنْ فَرَّقَ بَيْنَ الصَّلاَةِ وَالزَّكَاةِ، ‘আল্লাহর কসম, আমি অবশ্যই যুদ্ধ করব তাদের বিরুদ্ধে, যারা ছালাত ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য করে’।[27] এতে ওমর (রাঃ) সহ সকল ছাহাবী একমত হন, যা ‘ইজমায়ে ছাহাবা’ হিসাবে গণ্য।[28]
ওশর না দেওয়ার পরিণতি :
ওশর ও যাকাত আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক নির্ধারিত ফরয বিধান। যারা তা আদায় না করে নিজেদের জন্য জমা করে রাখবে তাদের পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। তারা দু’জাহানে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আল্লাহ বলেন,وَالَّذِينَ يَكْنِزُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنْفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ اللهِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ أَلِيمٍ- يَوْمَ يُحْمَى عَلَيْهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوَى بِهَا جِبَاهُهُمْ وَجُنُوبُهُمْ وَظُهُورُهُمْ هَذَا مَا كَنَزْتُمْ لِأَنْفُسِكُمْ فَذُوقُوا مَا كُنْتُمْ تَكْنِزُونَ- ‘যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য সঞ্চয় করে, অথচ তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে তুমি যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও। যেদিন সেগুলিকে জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে। অতঃপর তা দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্বদেশ ও পৃষ্ঠদেশে দাগানো হবে, (আর বলা হবে) এগুলি হ’ল সেইসব স্বর্ণ-রৌপ্য, যা তোমরা নিজেদের জন্য সঞ্চয় করেছিলে। এক্ষণে তোমরা যা সঞ্চিত রেখেছিলে তার স্বাদ আস্বাদন কর’ (তওবা ৯/৩৪-৩৫)।
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,مَنْ آتَاهُ اللهُ مَالاً فَلَمْ يُؤَدِّ زَكَاتَهُ مُثِّلَ لَهُ مَالُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ شُجَاعًا أَقْرَعَ لَهُ زَبِيْبَتَانِ يُطَوَّقُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، ثُمَّ يَأْخُذُ بِلِهْزِمَتَيْهِ يَعْنِي شِدْقَيْهِ ثُمَّ يَقُوْلُ أَنَا مَالُكَ، أَنَا كَنْزُكَ ثُمَّ تَلاَ : وَلاَ يَحْسَبَنَّ الَّذِينَ يَبْخَلُوْنَ، رَوَاهُ الْبُخَارِيُّ- ‘যাকে আল্লাহ সম্পদ দান করেছেন, অথচ সে এর যাকাত আদায় করেনি, ক্বিয়ামতের দিন তার সম্পদকে টেকো মাথার বিষধর সাপের আকৃতি দান করে তার গলায় বেড়ী পরানো হবে। সাপটি তার দুই চোয়াল চেপে ধরে বলবে, আমি তোমার সম্পদ, আমি তোমার সঞ্চিত ধন। অতঃপর তিনি সূরা আলে ইমরান ১৮০ আয়াতটি তেলাওয়াত করেন’।[29] যেখানে আল্লাহ বলেন,وَلاَ يَحْسَبَنَّ الَّذِينَ يَبْخَلُونَ بِمَآ آتَاهُمُ اللهُ مِنْ فَضْلِهِ هُوَ خَيْرًا لَّهُمْ بَلْ هُوَ شَرٌّ لَّهُمْ، سَيُطَوَّقُونَ مَا بَخِلُوا بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلِلَّهِ مِيرَاثُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاللهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ- ‘আল্লাহ যাদেরকে স্বীয় অনুগ্রহ থেকে কিছু দান করেছেন, তাতে যারা কৃপণতা করে, তারা যেন এটাকে তাদের জন্য কল্যাণকর মনে না করে। বরং এটা তাদের জন্য ক্ষতিকর। যেসব সম্পদে তারা কৃপণতা করে, সেগুলিকে ক্বিয়ামতের দিন তাদের গলায় বেড়ীবদ্ধ করা হবে। বস্ত্ততঃ আল্লাহর জন্যই হ’ল আসমান ও যমীনের মালিকানা। আর (গোপনে ও প্রকাশ্যে) তোমরা যা কিছু কর, সবই আল্লাহ খবর রাখেন’ (আলে ইমরান ৩/১৮০)।
আনাস বিন মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَانِعُ الزَّكَاةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فِي النَّارِ- ‘যাকাত ত্যাগকারী ক্বিয়ামতের দিন জাহান্নামে পতিত হবে’।[30]
আব্দুল্লাহ বিন আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘পাঁচটি বস্ত্তর কারণে পাঁচটি বস্ত্ত হয়ে থাকে।... (ক) কোন কওম চুক্তি ভঙ্গ করলে আল্লাহ তাদের উপর তাদের শত্রুকে বিজয়ী করে দেন। (খ) কেউ আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানের বিপরীত অন্য কোন বিধান দিয়ে দেশ শাসন করলে তাদের মধ্যে দারিদ্র্য ছড়িয়ে পড়ে। (গ) কোন সম্পদ্রায়ের মধ্যে অশ্লীলতা বেড়ে গেলে তাদের মধ্যে মহামারি ছড়িয়ে পড়ে। (ঘ) কেউ মাপে বা ওযনে কম দিলে তাদের জন্য শস্যের উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং দুর্ভিক্ষ তাদের গ্রাস করে। (ঙ) কেউ যাকাত দেওয়া বন্ধ করলে তাদের থেকে বৃষ্টি বন্ধ করে দেওয়া হয়’।[31] অন্য বর্ণনায় এসেছে, যদি ভূ-পৃষ্ঠে চতুষ্পদ জন্তু ও নির্বাক প্রাণী না থাকত, তাহ’লে বৃষ্টিপাত হ’ত না।[32]
কেউ ওশর ফাঁকি দিলে আল্লাহ তাকে দুনিয়াতে শাস্তি দিতে পারেন। সূরা ক্বালামে বর্ণিত বাগান মালিকের কাহিনী থেকে আমরা তা শিক্ষা নিতে পারি। যেভাবে মিসকীনদের ফাঁকি দিতে চাওয়ায় আল্লাহ বাগান মালিকদের শাস্তি দিয়েছিলেন।[33]
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,إِنَّا بَلَوْنَاهُمْ كَمَا بَلَوْنَا أَصْحَابَ الْجَنَّةِ إِذْ أَقْسَمُوا لَيَصْرِمُنَّهَا مُصْبِحِينَ، وَلَا يَسْتَثْنُونَ، فَطَافَ عَلَيْهَا طَائِفٌ مِنْ رَبِّكَ وَهُمْ نَائِمُونَ، فَأَصْبَحَتْ كَالصَّرِيمِ، ‘আমরা তাদের (মক্কাবাসীদের) পরীক্ষায় ফেলেছি, যেমন পরীক্ষায় ফেলেছিলাম বাগান মালিকদের। যখন তারা শপথ করেছিল যে, তারা খুব ভোরে অবশ্যই বাগানের ফল পেড়ে নিবে। কিন্তু তারা ‘ইনশাআল্লাহ’ বলেনি। অতঃপর তোমার প্রতিপালকের পক্ষ হ’তে ঐ বাগিচার উপর এক আসমানী গযব আপতিত হ’ল, যখন তারা নিদ্রামগ্ন ছিল। ফলে তা পুড়ে কালো ভস্মের ন্যায় হয়ে গেল’ (ক্বালাম ৬৮/১৭-২০)।
উপসংহার :
ফসলের যাকাত হ’ল ওশর, যা আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক নির্ধারিত ফরয বিধান। নিছাব পরিমাণ ফসল উৎপাদিত হ’লে তাতে ওশর দিতে হয়। নিছাব পরিমাণ না হ’লেও তা থেকে সাধারণ দান করবে। ফসলের যাকাত বা ওশর ফসল কাটা-মাড়ার সময় আদায় করতে হয়। ইচ্ছাকৃতভাবে বিলম্ব করা যাবে না। করলে তা আল্লাহর কাছে ঋণ হিসাবে গণ্য হবে। ওশর দারিদ্র্য বিমোচনের অন্যতম শক্তিশালী হাতিয়ার। ইসলামের এই ফরয বিধানকে গতিশীল করতে পারলে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ টন ওশর আদায় হবে। ফলে একদিকে দরিদ্রতা বিদূরিত হবে তেমনি অন্যদিকে ইসলামী অর্থনীতি শক্তিশালী হবে। ফলে সমাজ থেকে ধনী-গরীবের বিশাল ব্যবধান দূরীভূত হয়ে ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে ইনশাআল্লাহ। তাই আসুন! আমরা হিসাব করে ওশর আদায় ও বণ্টনে সচেতন হই। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সেই তাওফীক দান করুন-আমীন!
ড. মুহাম্মাদ আব্দুল হালীম
শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।
[1]. ড. মুহাম্মাদ ফজলুর রহমান, আধুনিক আরবী-বাংলা অভিধান (আল-মু‘জামুল ওয়াফী), ঢাকা : রিয়াদ প্রকাশনী, মে ২০০৯, পৃ. ৬৯৫।
[2]. ইব্রাহীম মাদকূর ও তার সাথীগণ, আল-মু‘জামুল ওয়াসীত (দেওবন্দ : কুতুবখানা হোসাইনিয়াহ, তাবি), পৃ. ৬০২।
[3]. বুখারী হা/১৪৮৩; মিশকাত হা/১৭৯৭।
[4]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৩৪৯।
[5]. বায়হাক্বী ৪/২৪৯, হা/৭৬০৮; ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ৮/৫১; মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, যাকাত ও ছাদাক্বা (রাজশাহী : হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, মার্চ ২০২৩), পৃ. ১৯।
[6]. বুখারী হা/১৪৮৪।
[7]. ইবনু কুদামা, শারহুল কাবীর ২/৫৬৩ পৃ.; মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-ওছায়মীন, শারহুল মুমতে‘ ৬/৭৮ পৃ.; মাসিক আত-তাহরীক, ১৬/১১ আগস্ট ২০১৩, পৃ. ১৪।
[8]. বুখারী হা/৬৯৫৫; মিশকাত হা/১৭৯৬।
[9]. ছহীহ ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/৪৫ পৃ.।
[10]. সুনানুদ দারাকুতনী হা/১৯৩৬; সিলসিলা ছহীহা হা/৮৭৯।
[11]. ইবনু মাজাহ হা/১৮২৪ হাসান ছহীহ; ইরওয়া হা/৮১০-এর আলোচনা।
[12]. আবুদাঊদ হা/১৬০০-০২।
[13]. ছহীহ ইবনু খুযায়মাহ হা/২৩২৫।
[14]. যাকাত ও ছাদাক্বা, পৃ. ৮৩-৮৫।
[15]. হায়ছামী, মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/৪৩৬৯ ইরওয়া হা/৮১৩-এর আলোচনা।
[16]. তিরমিযী হা/৬৩২; ইবনু মাজাহ হা/১৭৯২।
[17]. শারহুল মুমতে‘ ৬/৮২ পৃ.।
[18]. নববী, আল-মাজমূ‘ ৫/৫৪২-৫৫০; যাকাত ও ছাদাক্বা, পৃ. ১০১-১০২।
[19]. সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী হা/৭৭৪৬।
[20]. সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী হা/৭৭৪৮।
[21]. তদেব।
[22]. মুসনাদে আহমাদ হা/২২০৪১; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৮৭৯।
[23]. মুসলিম হা/২৫৮৮; মিশকাত হা/১৮৮৯।
[24]. ইরওয়া হা/৮৫৬-এর আলোচনা।
[25]. মুসলিম হা/২৯৮৪; মিশকাত হা/১৮৭৭।
[26]. যারিয়াত ৫১/১৯; মা‘আরেজ ৭০/২৪-২৫।
[27]. বুখারী হা/১৪০০; মুসলিম হা/২০; মিশকাত হা/১৭৯০।
[28]. যাকাত ও ছাদাক্বা, পৃ. ১১।
[29]. বুখারী হা/১৪০৩; মিশকাত হা/১৭৭৪।
[30]. ত্বাবারাণী ছগীর হা/৯৩৫; ছহীহুল জামে‘ হা/৫৮০৭।
[31]. ছহীহুত তারগীব হা/৭৬৫।
[32]. ইবনু মাজাহ হা/৪০১৯।
[33]. তাফসীরুল কুরআন ২৯তম পারা, ৩য় সংস্করণ সেপ্টেম্বর ২০০০, পৃ. ৬৫।